রাজ কাহিনি

তপন পাল


রাজস্থানের তথ্য ~ রাজস্থানের আরও ছবি

প্রস্তাবনা

কাজেকম্মে দিল্লি গেলে ফেরার পথে আমি একবার নিজামুদ্দিন আউলিয়া (সুলতান-উল-মাশায়েখ, মেহবুব-এ-ইলাহী, শেখ খাজা সৈয়দ মুহাম্মদ নিজামুদ্দিন আউলিয়া (১২৩৮ - ৩ এপ্রিল ১৩২৫) সাহেবের দরগায় মাথা ঠুকে আসি। আমি আদৌ ধর্মপরায়ণ লোক নই, তবে চিশতিয়া তরিকার এই সুফি সাধকটির রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী চরিত্রটি আমার বড় প্রিয়। দরগার পরিবেশটি আমার ভারি ভাল লাগে, গলি তস্য গলির ভিতর দিয়ে, জুতো জমা রেখে, লাল গোলাপ আর ধূপ নিয়ে, সাদা পাজামা-পাঞ্জাবিপরা পুণ্যার্থীদের সঙ্গে যাত্রা, অত ভিড়, তবু কী সুশৃঙ্খল। তার মধ্যেই কেউ টাকা চায়, আবার কেউ এসে বলে বাবু, এসেছো যখন দুটো খেয়ে যাও। কী করে বাঙালি বলে বুঝতে পারে কে জানে, সম্ভবত আমার হিন্দি শুনে। সিঁড়ি ভাঙতে কষ্ট হলে না চাইতেই কেউ না কেউ হাত বাড়িয়ে দেয়, বাবুজি, মেরা হাত পকড়ো, আউলিয়াজি নে মুঝে ভেজ দিয়া। নিজামউদ্দিন দরগাহ কমপ্লেক্সের মধ্যে সুফি কবি আমির খসরু এবং মুঘল রাজকুমারী জেহান আরা বেগমের সমাধি। ইনায়াত খান-এর সমাধিও দরগাহের কোণার কাছাকাছি; মির্জা আসাদুল্লাহ খান গালিব (ডিসেম্বর ২৭, ১৭৭৯ — ফেব্রুয়ারি ১৫, ১৮৬৯) শুয়ে আছেন একটু দূরে।

আমার পুত্র আবার আজমির শরিফের ভারি ভক্ত। ছাত্রাবস্থায় তার গবেষণার বিষয় ছিল রাজস্থানের ভূতত্ত্ব; সেই সূত্রেই গরিব-এ-নেওয়াজ সুলতান-উল-হিন্দ খাজা মইনুদ্দিন চিশতী (১১৪১ – ১২৩৬) সাহেবের সঙ্গে তার চেনাশোনা। চাকুরিপ্রাপ্তি, বিবাহ বা সন্তানলাভ, ব্যক্তিগত জীবনে কোন প্রাপ্তিযোগ ঘটলেই সে আজমির ছোটে চাদর চড়াতে। একবার তো পয়লা রজব হতে ছয় রজব ব্যাপী বার্ষিক উরস উৎসবেও গিয়েছিল। সুফি সাধকের ছ'দিন ব্যাপী উরস ভারতের সর্ববৃহৎ মুসলিম মেলা; চিস্তি ধারার সাজদানশিন (Successor-Representative) বুলন্দ দরওয়াজায় সাদা পতাকা তুলে এর আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন। গোলাপজল, চন্দনবাটা, কাওয়ালি, নজরানা, শুকনো ফল আর বনেদি মশলার সমাহারে তবরুখ পোলাও – সে নাকি এক হই হই কাণ্ড! তবে শেষ দিনটিই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। প্রাতঃকালীন প্রার্থনার পর জমায়েত তথা জামাত; কোরান দরুদ (নবী এবং তাঁর পরিবার-পরিজন, সন্তান-সন্ততি ও সহচরদের প্রতি আল্লাহর দয়া ও শান্তি বর্ষণের জন্য প্রার্থনা) পাঠ আর জাতি-ধর্মনির্বিশেষে ভক্তদের পরস্পরের মাথায় পাগড়ি বন্ধন – শান্তি, সুখ ও সমৃদ্ধির প্রার্থনা। উরসের সময় দরগা দিনরাত খোলা থাকে, দরগার প্রধান দরজা জন্নতি দরওয়াজা (স্বর্গের দ্বার) এমনিতে সাধারণত বন্ধ রাখা হয়, কিন্তু এইসময় খুলে দেওয়া হয়। বারবার যাতায়াতের সূত্রে পুত্রের কিছু চেনা পরিচয়ও হয়ে গেছে। সেই আমাকে প্রস্তাব দিল আজমির ঘুরে আসতে।

রাজপুতদের প্রতি আমার খুব একটা মুগ্ধতা নেই। এক-একটা নগরকেন্দ্রিক রাজ্য, কাজ নেই কর্ম নেই সুযোগ পেলেই অন্য রাজাদের সঙ্গে অবান্তর মারপিট করে, নিজেদের ঝগড়ায় নির্বোধের মত বাইরের লোককে ডেকে আনে, এবং হেরে আসে। আর প্রতিপক্ষ প্রবল হলে সুড়সুড় করে নিজেদের বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে তার বিয়ে দেয়। রানি তো দূরস্থান, মাউন্টব্যাটেন সাহেবকে সামনে পেলেও তার সঙ্গে ছবি তোলার জন্য হামলে পড়ে। কিন্তু কীই বা আর করা যাবে; টড সাহেবের হাত ধরে রবি-অবন খুড়ো-ভাইপো এদের নিয়ে এত আদিখ্যেতা করল যে কোথায় চাপা পড়ে গেল প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনী, আইসিএস রমেশ চন্দ্র দত্তের রাজপুত জীবন-সন্ধ্যা (১৮৭৯)! এদেশে শিক্ষিত লোকের কথা তো কেউ শোনে না।

বিস্তর বিতর্ক আলাপ আলোচনার হিসাব নিকাশের পর ভ্রমণসূচিটি দাঁড়াল এইরকমঃ
১৫ই জুনঃ কলকাতা হতে বেলা দুটো কুড়ির ইন্ডিগো ৬ই ৩৯৪ উড়ানে চারটে চল্লিশে জয়পুর।
১৬ই জুনঃ দিনভর আজমির ও পুষ্কর
১৭ই জুনঃ সারাদিন ধরে জয়পুর ঘুরে ফিরে দেখা
১৮ই জুনঃ নাহারগড় ঘুরে ফিরে দেখা; এবং সেই সঙ্গে জয়পুর দিনভর
১৯শে জুনঃ জয়পুর হতে বেলা দশটা পঁয়ত্রিশের স্পাইসজেট এসজি ২৯৮১ উড়ানে বেলা বারোটায় জয়সলমীর। (কিন্তু টিকিট কাটার পরে উড়ান পুনর্বিন্যস্ত হয়ে হল জয়পুর তিনটে পঁচিশ, জয়সলমীর চারটে চল্লিশ)
২০শে জুনঃ জয়সলমীর; ঘুরে ফিরে দিনভর
২১শে জুনঃ জয়সলমীর হতে বেলা বারোটা কুড়ির স্পাইসজেট এসজি ২৯৮৩ উড়ানে দিল্লি বেলা দুটো পাঁচে।
দিল্লি হতে সন্ধ্যা ছটা পঞ্চাশের স্পাইসজেট এসজি ২৫৩ উড়ানে কলকাতা রাত নটা পাঁচে।
ফেরার সময় দিল্লি হয়ে ফেরার কারণ তিনটে। প্রথমত, জয়সলমীর বিমানবন্দর ছোট, মূলত সামরিক; ২৭০০ মিটারের একটি মাত্র রানওয়ে। শুধু স্পাইসজেটই এখান থেকে পরিষেবা দেয়। ফলে অন্য বিমান সংস্থার বিমানে উঠলে মাঝরাস্তায় বিমান বদলের সময় লটবহর আমাকে সামলাতে হবে। পুরো পথটাই স্পাইসজেটের সঙ্গে এলে সেই বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি। দ্বিতীয়ত, রেওয়াজ আছে আজমির দেখে ফেরার সময় দিল্লি হয়ে ফিরতে হয়, খাজা মইনুদ্দিন চিশতি সাহেবের সঙ্গে দেখা করার পর নিজামুদ্দিন আউলিয়া সাহেবের সঙ্গে দেখা না করলে জিয়ারত কবুল হয় না। তৃতীয়ত, কেউ আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞাসা করেন তোমার প্রিয় শপিং মল কোনটি, আমি নির্দ্বিধায় উত্তর দেব দিল্লি বিমানবন্দর। ঘণ্টা তিনেক সময় পাওয়া যাবে ঘুরে ফিরে দেখতে, কফি খেতে, কেনাকাটা করতে। সেটাই বা কম কী! বস্তুত বিষয়টি এমন দাঁড়িয়েছে যে আমি দিল্লি যাচ্ছি শুনলেই আমার পৌত্রী নাচতে নাচতে বলে দাদাই এবারে সফট টয় হনুমান আনবে, এবারে বাঘ, এবারে জলহস্তী ইত্যাদি ইত্যাদি।

প্রথম দিন
বাড়ি থেকে বেরিয়ে বিমানবন্দর, এবারে আর ভুল করিনি, ঢোকার আগে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পাঁচ টাকার চা খেয়ে ঢুকেছি । নচেৎ প্রতিবারে যা হয়, উড়োজাহাজ ধরার তাড়ায় হুড়মুড় করে বিমানবন্দরে ঢুকি; তারপরে পন্থা প্রকরণ পেরিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে বোর্ডিং পাস নিতেই ভারমুক্ত, হাতে কিছুটা সময়। তখন সারা দুনিয়ার চা তেষ্টা বুকের ভিতর থেকে উঠে আসে; পঁচানব্বই টাকায় এক কাপ চা খেতে বাধ্য করে। পিতামহাশয় প্রয়াত হয়েছেন অনেককাল। নচেৎ তিনি যদি জানতে পারতেন আমি পঁচানব্বই টাকায় এক কাপ চা খেয়েছি, নির্ঘাত আমাকে ধরে পিটতেন। তবে ওই আর কী! তুমি যাও বঙ্গে, কপাল যায় সঙ্গে। ঢুকে দেখলাম জল ফুরিয়েছে। ৫০০ মিলি লিটারের এক বোতল জল কিনলাম ষাট টাকায়। নির্মাতা সংস্থাটি মহারাষ্ট্রের – তাঁরা জানাচ্ছেন যে সহ্যাদ্রি পর্বতমালার অতলে বহু যুগ ধরে সুপ্ত ছিল এই 'ভলক্যানিক ওয়াটার'। বিস্তর কাঠখড় পুড়িয়ে 'ফ্রম দ্য ডেপথস অফ টাইম' তাকে তুলে আনা হয়েছে শুধু তুমি খাবে বলে।

কিছুটা অপেক্ষা; আন্তর্জাল ঘেঁটে দেখা গেল উড়ান ৬ই ৩৯৪ গুয়াহাটি থেকে আসছেন, আমাদের জয়পুর নামিয়ে তিনি উড়ে যাবেন মুম্বই। বিমানপোত VT IHL। ইনি সাড়ে বারো বছরের পুরাতন। আগে তিনি টার্কিশ এয়ারলাইন্স-এ TC JPB নামে চলতেন। ২০১৮র মার্চে তার ভারত আগমন। তার আজকের নির্ঘণ্ট মুম্বই-জয়পুর-কলকাতা-গুয়াহাটি-কলকাতা-জয়পুর-মুম্বই-কলকাতা।

তিনি এলেন, আমরাও উঠে বসলাম। আসন সামনের বাঁদিকে, জানলার পাশে। আমাদের এবারের যাত্রা অনেকখানিই নির্দায়, নির্ভার। জয়পুর ও জয়সলমীর দুজায়গাতেই হোটেল বুক করা আছে; আন্তর্জাল মাধ্যমে গাড়ি ঠিক করে রাখা আছে দুজায়গাতেই, টাকাও মেটানো আছে। শুধু খাওয়া খরচটা হলেই চলে যাবে; আর বুড়োবুড়ির খেতে ক'পয়সাই বা লাগে! যাত্রা শুরুর প্রারম্ভে পাইলটকাকু সবাইকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন আমাদের একটু দেরি হয়ে গেছে, তবে মেকআপ দেওয়া যাবে। শুনে আমি হতবাক! বলে কী! আমার নাতনির স্কুল যাওয়ার অটোওয়ালা তো এমনটি বলে – তাই বলে পাইলটকাকুও বলবেন!
ডাইনে দক্ষিণেশ্বর রেখে গঙ্গা পার, নিচে কয়েকটি রেলগাড়ি দেখা গেল। আমরা চলেছি পশ্চিমে, সূর্যদেবের সঙ্গে, তাই দিবালোক দীর্ঘায়িত। তিনটেয় কলকাতা ছেড়ে পাঁচটা কুড়িতে আমরা যখন মেঘ ফুঁড়ে জয়পুর নামলাম, রোদ্দুর দেখে মনে হল কত আর বাজে, এই দুটো আড়াইটে হবে। বিমানযাত্রাটি দীর্ঘতর হওয়ায় ২৯০০০ ফুট ওপরেও চা পাওয়া গেল; স্বল্পমেয়াদী উড়ানে গরম কিছু পাওয়া যায় না, ফলের রস খেয়েই তেষ্টা মেটাতে হয়।

জয়পুরে নেমে দেখা গেল আমাদের নামের বোর্ডলাগানো ধ্বজা সারথির হাতে উড্ডীন। সোজা হোটেলে; হোটেলেটি 'বেশিরিক্ত' রকমের ভাল। শুধু একটাই অসুবিধা, গরম জল চাইলে কলে গরম জল পড়ে, আর ঠাণ্ডা জল চাইলে যে জলটা পড়ে সেটা গরম জলের চেয়েও গরম। তা কীই বা আর করা যাবে। রাজস্থানে গরম বেশি পড়ে সেটা জেনেই তো আমরা গেছি। তবে গরমে কিঞ্চিৎ অসুবিধা হলেও সুবিধা হয়েছে তার চেয়ে বেশি। এটা পর্যটনের অফ সিজন, গুটিকয়েক সাহেব মেম ছাড়া কেউ কোত্থাও নেই, ঘুরে ফিরে বড় আরাম! আমার আবার ভিড়ে অ্যালার্জি কিনা!

সারথি মহোদয় জানালেন আগামীকাল তিনি সকাল নটায় আসবেন, কারণ এখানে সকাল হয় দেরি করে।

দ্বিতীয় দিন

উপরওয়ালে রে আজব তেরা মায়া... আমার মত ধর্ম উদাসীন, প্রায় নাস্তিক মানুষকেও ঘাড় ধরে ঈদের দিন হাজির করালেন বাবা সন্নিধানে, আজমির শরিফে। উপমহাদেশের কৃষ্টি-সংস্কৃতিতে একমাত্র খৃস্টান বাদে সব ধর্মের লোককেই দেখেছি অন্য ধর্মের উপাসনাস্থলে যেতে ও প্রার্থনা জানাতে। যে হিন্দু বারাণসী যায়, সে বৌদ্ধদের সারনাথটাও একবার ঘুরে আসে, মন্দিরে গিয়ে পাশের জ্ঞানবাপি মসজিদেও একবার মাথা ঠুকে আসে। যে শিখ হেমকুন্ড সাহেব যান, তিনি ফেরার পথে বদরিনাথ, হরিদ্বারটাও ঘুরে নেন। আর সুফি সংস্কৃতির পিরবাবাদের মাজার তো ছড়ানো সমগ্র উপমহাদেশে। আজমির নিজামুদ্দিন আউলিয়া সাহেব তো অনেক বড় ব্যাপার, সিউড়ির পাথরচাপুড়ির দাতাবাবার মাজার বা তার চেয়েও প্রাচীন বোলপুরের সিয়ানের পিরবাবা সৈয়দ মাখদুম সাহেবের মাজার, বা আমার ঘরের কাছেই বাবা বড়খান গাজিসাহেবের মাজার; এখানে তো সব ধর্মের লোকেই যায়। পুরীর শ্রীজগন্নাথ মন্দিরে, মক্কার মতই, বিধর্মীদের ঢুকতে দেওয়া হয় না। অথচ পিপলির কাছেই, রাস্তার উপরেই দণ্ড মুকুন্দপুর গ্রাম শ্রীজগন্নাথের মুসলমান ভক্ত দাসিয়ার জন্মস্থান হওয়ার সুবাদে তীর্থস্থান, সেখানে সবার জন্যে দরজা খোলা। রাজস্থানের পোখরানের কাছে রামদেওরা গ্রাম, বাবা রামদেবজি নামের এক তনওয়ার রাজপুত মুনি ১৩৮৪ খৃস্টাব্দে এখানে সমাধিলাভ করেছিলেন; তার স্মরণে ১৯৩১ এ গড়ে উঠেছে মন্দির। সেখানে হিন্দু মুসলমান সবাই যান, নিজের নিজের মতে প্রার্থনা জানান; এবং আশ্চর্যজনকভাবে মুসলমান ভাইদের কাছে রামদেবজি রামপিরবাবা।

বিভিন্ন ঘরানার, যথা চিশতিয়া, কালান্দারিয়া, মাদারিয়া, কাদেরিয়া, সোহরাওয়ার্দি, আহমদিয়া এবং নাকশাবান্দিয়া, সুফিরা বঙ্গদেশে এসেছিলেন; তাদের মধ্যে সালিক (শরিয়তে বিশ্বাসী) এবং মজ্জুব (শরিয়তে বিশ্বাস প্রায় নেই) দুই শ্রেণীর সুফিরাই ছিলেন, তবে মজ্জুব ফকিররাই বাংলায় বেশি প্রভাব ফেলেন। বাংলার হিন্দু মুসলমানের যুক্তসাধনার নিদর্শন পিরপূজা। পির বলতে আমি এখানে শাহ্, শেখ, মুরশিদ, ওস্তাদ, সুফি প্রমুখ সাধুসন্তদের, এবং যুদ্ধে নিহত মুসলমান সেনাপতিদেরও বোঝাতে চাইছি। কবরকে মসজিদ বানানো ইসলামে নিষিদ্ধ। তাই মাজারে নামাজের চল নেই; হিন্দুদের কাছে তা গ্রহণযোগ্যতা পায়। মাজারকেন্দ্রিক এই পিরপ্রথার উৎপত্তিস্থল ইরান-আফগানিস্থান। কিন্তু দুই বাংলায় ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রান্তবাসী তান্ত্রিক গুরুবাদ ও বৈষ্ণব গোঁসাইবাদ এ প্রথার উর্বর ভূমি প্রস্তুত করেই রেখেছিল। হিন্দুরা যেমন অতীতের দেব-দেবীদের কাছে মানত করত, পূজা করত, সন্ধ্যাবাতি জ্বালাত, তেমনি পিরের দরগাতেও মানত করা, জীবিত বা বিদেহী আত্মার কাছে প্রার্থনা, সমাধিতে সন্ধ্যাবাতি দেওয়া, ধূপধোঁয়ার স্থলে আগরবাতি বা গন্ধবাতি জ্বালানোর রেওয়াজ হয়ে যায়। সুফিরা বিশ্বাস করে শেষের সেই ভয়ঙ্কর দিন সমাসন্ন, তাই মায়া প্রপঞ্চময় জাগতিক মোহ বন্ধন কাটিয়ে আমাদের উচিত সেই পরমপিতার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য প্রস্তুত হওয়া। সুফিদের ধ্যান ধারণা বিশ্বাস আচার হিন্দুদের ভক্তিবাদের সঙ্গে মেলে অনেকখানিই। কিন্তু ভক্তিবাদ যেখানে সমাজের মধ্যে থেকে ঈশ্বর আরাধনার কথা বলে, সুফিবাদ সেখানে হেঁকে বলে, 'না হে! সমাজের বাইরে এসো। এই আমাকে দেখছো না!' সে দিক থেকে তাঁরা বরং হিন্দুদের যোগী সম্প্রদায়ের অনেকখানি নিকটবর্তী।

নিজামুদ্দিন আউলিয়া, তাঁর পূর্বসূরীদের ন্যায়, প্রেম বা ইশককে স্রষ্টা বা আল্লাহ প্রাপ্তির পন্থা বা পথ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তাঁর মতে স্রষ্টার প্রতি ভালবাসা মানবতার প্রতি ভালবাসার জন্ম দেয়। মইনুদ্দিন চিস্তি (১১৪২ – ১২৩৬) নিজামুদ্দিন আউলিয়া (১২৩৮ – ১৩২৫)-রা ভারতে এসেছিলেন এক অশান্ত সময়ে, 'রণধারা বাহি জয়গান গাহি উন্মাদকলরবে - ভেদি মরু পথ গিরি পর্বত যারা এসেছিল সবে' - তাদের পিছন পিছন। ফিরে দেখলে মনে হয় এদের ভূমিকা অনেকাংশেই ছিল খৃস্টান মিশনারিদের মত; দেশবাসীর যুদ্ধ, বিদেশি বিধার্মিক শাসন, অর্থনৈতিক শোষণের ক্ষতে মলম মাখানো যাতে অপশাসন অসহনীয় বলে মনে না হয়, পরিণামে দেশীয় জনসাধারণের কাছে ভিনদেশি ধর্ম তথা শাসনের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে, শাসনের ভিত শক্ত হয়। মোঙ্গল আক্রমণের পর, দিল্লি সুলতানেট-এ মামলক ও পরবর্তী তুঘলক শাসনের সেই কাল দিনগুলিতে তাদের উদ্ভব। সামাজিক ক্ষেত্রে খৃস্টান মিশনারিদের অবদানের জন্য আজও তারা স্মরণীয়, এদের ক্ষেত্রে শুধুই আবেগ, আর লাল গোলাপ।

ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহান এক অনন্য নাম। তিনিই শেষ রাজপুত রাজা যিনি দিল্লি শাসন করেছিলেন। তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে তাঁর পরাজয়ের মাধ্যমেই দিল্লিতে মুসলিম শাসন শুরু হয়। বিজয়ী বীর মুহাম্মদ ঘুরি দিল্লিতে সালতানাত প্রতিষ্ঠা করেন। পৃথ্বীরাজ-সংযুক্তার কাহিনী নিয়েও বাঙালির মুগ্ধতার শেষ নেই। আমাদের কৈশোরে 'শ্রীমান পৃথ্বীরাজ' বলে একটা সিনেমা বেরিয়েছিল। বাবা গো বাবা! সে কী ভিড়; দুমাস ধরে রোজ হাউসফুল! সে গল্প অবশ্য অন্য। পৃথ্বীরাজ চৌহানের সভাকবি চাঁদ বরদাইয়ের সংস্কৃত কাব্য 'পৃথ্বীরাজরস' থেকেই তাঁর আখ্যানের প্রচার ও জনপ্রিয়তা। স্বয়ম্বরসভা থেকে সংযুক্তাকে নিয়ে পৃথ্বীরাজের ইলোপমেন্টের পর তাঁর শ্বশুর জয়চাঁদ হাত মেলালেন শত্রুপক্ষের সঙ্গে। ১১৯১তে তরাইনের প্রথম যুদ্ধে পৃথ্বীরাজের কাছে পরাজিত হয়ে পালিয়েছিলেন মুহাম্মদ ঘুরি। প্রতিশোধস্পৃহা ছিলই, তাতে ইন্ধন যোগালেন জয়চাঁদ; ঘুরিকে দিল্লি দখলের আহ্বান জানিয়ে, সহায়তার আশ্বাস দিয়ে। পরিণতি ১১৯২ এ তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধ, পৃথ্বীরাজের মৃত্যু ও সংযুক্তার হারেম গমন, মতান্তরে অন্তঃপুরে আত্মাহুতি। এহেন মুহাম্মদ ঘুরি বিজয়গর্বে আজমিরের হিন্দু মন্দির ধূলিসাৎ করে সেখানে মসজিদ ও ইসলাম ধর্মের শিক্ষাকেন্দ্র নির্মাণ করলেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিস্তির অনুগ্রহেই তাঁর যুদ্ধজয়। চিস্তির সঙ্গে পৃথ্বীরাজের একটা মন কষাকষি আগে থেকেই ছিল, চিস্তির আগমনে রাজা পৃথ্বীরাজ ক্ষুদ্ধ হয়ে তাকে বিতাড়িত করার চেষ্টা করেছিলেন। তবে কিনা চিস্তি যদি এতই ক্ষমতাবান তাহলে মুহাম্মদ ঘুরিকে প্রথমবার গোহারা হেরে, ক্ষমা নিয়ে, ল্যাজ গুটিয়ে পালাতে হল কেন; কেন দ্বিতীয়বারে জয় পেতে হল, তাও আবার জয়চাঁদের পিছন ধরে!

সপ্তম শতকে আজমির শহর গড়ে ওঠে; অজয়মেরু পর্বত থেকেই আজমির নাম। পূর্বের অজয়মেরুর দুর্গটির নাম এখন তারাগড় দুর্গ। ১১৯৩ খ্রিষ্টাব্দে পৃথ্বীরাজ চৌহানকে হারিয়ে গজনীর মুহাম্মদ ঘুরি আজমির দখল করেন। সেই থেকে শুরু ক্ষমতা দখলের লড়াই; ১৩৯৮ খ্রিষ্টাব্দে তৈমুরলঙ ভারত আক্রমণ করে চলে যাবার পর রানা কুম্ভ কিছুদিন আজমিরের রাজা হন। ১৪৭০ থেকে ১৫৩১ পর্যন্ত আজমির মলোয়ার সুলতানদের দখলে থাকে। ১৬১৬ খ্রিষ্টাব্দের ১০ জানুয়ারি ব্রিটিশ দূত স্যার টমাস রো তারাগড় দুর্গে জাহাঙ্গীরের সঙ্গে প্রথম দেখা করে ভারতে ব্যবসা বাণিজ্যের অনুমতি চান। বেগম নূরজাহানের প্রিয় ছিল আজমিরি গোলাপের আতর। শাহজাহানের জ্যেষ্ঠ পুত্র দারার জন্ম এখানেই। ১৬৫৯ খ্রিষ্টাব্দে ঔরঙ্গজেব আজমিরের কাছে ডোরালে ভাইদের হারিয়ে ক্ষমতা দখল করেন। ঔরঙ্গজেবের পর আজমির দখল করেন সিন্ধিয়ার রাজারা। ১৮১৮ সালে ব্রিটিশের হাতে।

স্টেশনের বিপরীতে মাদার গেট পেরিয়ে দোকানে ঠাসা ঘিঞ্জি পথ পেরিয়ে পুরানো শহর। এখানেই দরগা শরিফ। সর্বধর্মাবলম্বীদের জন্যই অবারিত দ্বার, খালি পায়ে মাথা ঢেকে এলেই প্রবেশাধিকার। খাজা মৈনুদ্দিন চিস্তির জন্ম পারস্যের সঞ্জারে, ১১৪১এ। মক্কা হয়ে মদিনা যাওয়ার পথে তিনি ভারতবর্ষে যাওয়ার জন্য আল্লাহর নির্দেশ পান। আজমিরকে ঘাঁটি করে ইসলাম ধর্মের প্রচার করতে থাকেন। ১২৩৬ খ্রিষ্টাব্দে ৯৫ বছর বয়সে আজমিরেই তাঁর জীবনাবসান, এখানেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। ১২৩৬ খ্রিষ্টাব্দে দাস সুলতান ইলতুতমিশ এই মসজিদের নির্মাণকাজ শুরু করেছিলেন; শেষ হয় ষোড়শ শতকে মোঘল সম্রাট হুমায়ুনের হাতে। প্রবেশদ্বারটি তৈরি করেছিলেন হায়দারাবাদের নিজাম। ডাইনে আকবরি মসজিদ, ৩২৩ মিটার উঁচু মূল প্রবেশদ্বার রূপার পাতে মোড়া বুলন্দ দরওয়াজা। জাহাঙ্গিরও এখানে মসজিদ গড়েন। ১৬৫০ খ্রিষ্টাব্দে শাহজাহান শ্বেতপাথরের জুমা মসজিদ তৈরি করান; চূড়াটি সোনার পাতে মোড়া। ভেলভেটে মোড়া শ্বেতমর্মরের সমাধিবেদি রূপোর রেলিং দিয়ে ঘেরা, সোনায় মোড়া গম্বুজাকৃতি সিলিং। এই সমাধিবেদির অদূরে দক্ষিণে মৈনুদ্দিন চিস্তির কন্যা বিবি হাফিজ জামাল ও শাহজাহান কন্যা চিমনি বেগমের সমাধি। এই মাজার ঘিরে গড়ে উঠেছে দুটি মসজিদ, একটি সম্মেলন কক্ষ। দরগা খোলা থাকে শীতকালে ভোর পাঁচটা থেকে রাত নটা; আর গ্রীষ্মকালে ভোর চারটে থেকে রাত দশটা। ভক্তরা ইচ্ছা সামর্থ্য ও অভিরুচি অনুসারে চাদর, ফুল, সুগন্ধি আতর ইত্যাদি দেন। আর আর্থিক দান তো আছেই – ভোগের জন্য অথবা মাজারের দৈনন্দিন রক্ষণাবেক্ষণের জন্য।

দিনে দুবার, ভোরবেলা ফজরের নমাজের আধঘণ্টা আগে আজানের সুরে আর বিকালে আসরের নমাজের পর মাজার প্রক্ষালন ও পুষ্প প্রদান – এর নাম খিদমত। বাজনা বাদ্যি ও মন্ত্রোচ্চারণের মধ্য দিয়ে মাজারের চার কোণে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন – তার নাম রস। রাতে ইশার নমাজের এক ঘণ্টা পরে করকা, সমাপ্তি অনুষ্ঠান। দরজা বন্ধ হওয়ার কুড়ি মিনিট আগে পাঁচবার ঘণ্টাধবনি – ভক্তদের মাজার খালি করে দেওয়ার অনুরোধ, মাজার প্রক্ষালন। তৎপরে ছবার ঘণ্টাধবনি, কওয়ালদের বিশেষ করকা গীত, অতঃপর রাতের মত দরজা বন্ধ। দিনের সব নমাজ শেষ হলে মেহফিল-এ-শমা (শমাখানা বা মেহফিলখানা শহম চেরাগের পশ্চিমে), কাওয়ালি ও কোরান পাঠ।

মাজারের একটি দর্শনীয় বস্তু হল এনাদের ডেগ, অর্থাৎ মস্ত মস্ত বাসনকোসন, তার মধ্যে কিছু আবার সম্রাট আকবর প্রদত্ত। মাজারের পূর্বাংশে বেগমি দালান, শাহজাহান কন্যা জাহান আরা বেগমের তৈরি। আজমিরে পৌঁছে চিস্তি সাহেব প্রথমে যেখানে থাকতেন, যেখানে রাজার উটকে মন্ত্রবদ্ধ করে অনড় করেছিলেন, সেখানে আজ আউলিয়া মসজিদ; ১৮৫১ সালে নির্মিত। ১৫৭১ সালে নির্মিত লাল বেলেপাথরের আকবরি মসজিদ শাহজাহানি দরওয়াজা আর বুলন্দ দরওয়াজার মধ্যিখানে, বর্তমানে মৈনিয়ুয়া উসমানিয়া দারুল উলুম, ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। মাজারের উত্তরাংশে, সানদিলখানা মসজিদের পিছনে ভূগর্ভস্থ বাবা ফরিদ কি চিল্লা; বছরে তিন দিনের জন্য খোলা হয়।

যে দোকান থেকে পূজা উপকরণ কিনে জুতো জমা রেখেছিলাম, সেই দোকানের লোক দরগা শরিফ অবধি নিয়ে গেলেন, ঘুরিয়ে দেখিয়ে লাইনে দাঁড় করিয়ে দিলেন। সেই ভদ্রলোককে নমস্কার; আমার মত ধর্ম উদাসীন, প্রায় নাস্তিক মানুষকেও তিনি অসীম ধৈর্যে ও অধ্যবসায়ে পুরো চত্বরটি ঘুরিয়ে দেখালেন, যাবতীয় বোকা বোকা প্রশ্নের উত্তর দিলেন বিন্দুমাত্র বিরক্ত না হয়ে।

চারটে লাইন, প্রতি লাইনে ন্যূনতম শ'পাঁচেক লোক। দাঁড়িয়ে আছি, দেবদূত বা ফেরেশতার মত এক অচেনা ভদ্রলোক এসে জিজ্ঞাসা করলেন, 'আপনি পালসাহেব না?' স্বীকার করলাম, সঙ্গে বললাম 'আপনাকে তো ঠিক চিনছি না।' মন্দিরে ঢোকার আগে সারথি মহোদয় থেকে উপকরণ দোকানদার – সবাই বলেছিলেন কোথাও টাকাপয়সা না দিতে ও ব্যাগ সামলে রাখতে। ভদ্রলোক বললেন 'আমি ইসলামিয়া হাসপাতালের ম্যানেজমেন্টে ছিলাম।' তখন আমার মনে পড়ল। ১৯৯২ – ১৯৯৯ আমি যখন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে কর্মরত ছিলাম তখন তাঁদের সঙ্গে কিঞ্চিৎ যোগাযোগ ছিল। আমার বাবার প্রস্টেট অপারেশনও হয়েছিল ইসলামিয়া হাসপাতালে।

ভদ্রলোক বললেন, আসুন! আপনি মেহমান। খিদমতগিরির সুযোগ দিন। আপনাকে খাদিম পরিবারের একজনের সঙ্গে 'ফিট' করে দিচ্ছি – সোজা বাবার কাছে চলে যান। আর হ্যাঁ! বাবাকে আমার হয়ে একটু বলবেন। সব দেখেশুনে আমি চিত্তির। এতো হিন্দু তীর্থস্থানের দস্তুর গো; লাইন ভেঙে আগে যাওয়া! এখানেও হয়! ব্যস! আধ ঘণ্টার মধ্যে আমাদের পূজাআর্চা সারা।

মির সাজত আলি মসজিদে মির্জা গালিব নাকি রোজ নমাজ পড়তে আসতেন। কথাটি বিশ্বাস হল না। গালিবের জন্ম আগ্রায়, তের বছর বয়সে বিয়ের পর দিল্লিতে থিতু হওয়ার পর তিনি আর ঠাঁইনাড়া হয়েছিলেন বলে জানা নেই। আর মির্জা গালিব নিয়ম করে রোজ নমাজ পড়তে যাচ্ছেন, চোখ বন্ধ করে অনেকক্ষণ ভেবেও সেরকম কোন ছবি মনে এলো না। রেল স্টেশনের কাছে ১৮৮৮তে তৈরি ভিক্টোরিয়া ক্লক টাওয়ার, এডওয়ার্ড মেমোরিয়াল হল। অতীতের রাজবংশীয় স্কুল বর্তমানের মেয়ো কলেজ। আড়াই দিন কা ঝোপড়া মসজিদ মহম্মদ ঘুরির নির্দেশে কুতুবুদ্দিন আইবক কর্তৃক সংস্কৃত কলেজের ধ্বংসাবশেষের উপর নির্মিত, ভারতবর্ষের সর্বপ্রাচীন মসজিদগুলির অন্যতম, আজমিরের প্রাচীনতম স্থাপত্য।

আজমির থেকে পুষ্কর নির্জন পাহাড়ি রাস্তায় তেরো কিলোমিটার - পুরাণমতে পুরী-বদ্রীনাথ-দ্বারকা-রামেশ্বরম বাদে এই ধামই ভারততীর্থে পবিত্রতম! তবু হিন্দু তীর্থস্থানসুলভ হইচই নেই, ব্রহ্মান্ডস্রষ্টা ব্রহ্মা নিঃসঙ্গতায় বসে থাকেন তীর্থযাত্রীর আশায়। বজ্রনাভ নামের অসুরকে পদ্মের আঘাতে বধ করেছিলেন ব্রহ্মা - পদ্ম থেকে কিছু পাপড়ি ঝরে পড়েছিল মর্ত্যে, সৃষ্টি হয়েছিল হ্রদ। পুষ্কর তীর্থের বৃত্তান্ত এই। মতান্তরে পরশুরাম এই তীর্থের প্রতিষ্ঠাতা। ব্রহ্মা হাতে পদ্ম নিয়ে যজ্ঞের স্থান নির্বাচনে বেরিয়েছিলেন। তাঁর হাতের পদ্মটি যেখানে পড়েছিল সেই জায়গাটিই পুষ্কর। ব্রহ্মা পুষ্প (ফুল) নিক্ষেপ করেন নিজ হাতে (কর); পুষ্প + কর থেকে পুষ্কর। ব্রহ্মামন্দির স্থাপিত হওয়ার কাহিনিটিও বেশ জমজমাট। ব্রহ্মার মনে ভারি দুঃখ। তিনি জগৎপিতা, অথচ তাঁর নামে কোনও মন্দির নেই। যেমনি ভাবা তেমনি কাজ; পিতামহ ব্রহ্মা পুষ্করে ব্রহ্মামন্দির স্থাপন বাসনায় এক যজ্ঞের আয়োজন করলেন। যজ্ঞারম্ভের সময় উপস্থিত, কিন্তু ব্রহ্মাপত্নী সাবিত্রীদেবী অনুপস্থিত, ওই যা হয় আর কী! ঘরসংসার সামলে, সব কাজ সেরে, সাজগোজ করে বান্ধবীদের সবাইকে জড় করে আসতে একটু দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু পত্নী বিনা যজ্ঞের ফল শূন্য বিবেচনায় জগৎপিতা ব্রহ্মা তড়িঘড়ি গায়ত্রী দেবীকে বিবাহ করে তাঁকে সঙ্গে নিয়ে সেই মহাযজ্ঞে আহুতি দেন। আগে থেকে একটু ইনটুমিন্টু ছিল বোধহয়, গট-আপ কেস। ব্রহ্মা ঠাকুরদার গুণের তো শেষ নেই। সরস্বতী ব্রহ্মার কন্যা না স্ত্রী নাকি উভয়ই সে সংশয় আমার আজও যায়নি। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, শতপথ ব্রাহ্মণ, মৎস্যপুরাণ, ভাগবৎপুরাণ সগৌরবে ব্রহ্মার কন্যাগমনের কথা বলে। মনুষ্যকুলে ব্রহ্মার অপূজার একটি কারণ হতে পারে তাঁর এই চ্যুতি। সাবিত্রীদেবী উপস্থিত হয়ে সব দেখেশুনে খাপ্পা, স্বামীকে অভিশাপ দিলেন, জগতের কোথাও কোনদিন ব্রহ্মামন্দির হবে না; এমন দুশ্চরিত্রের মন্দির হওয়ার দরকার নেই। অতঃপর সুভদ্রা-দ্রৌপদী সংবাদ – গায়ত্রীদেবীর অনুনয়, দিদি আমি তোমার দাসী। মন গললো, অভিশাপ সংশোধিত হল, হয়ে হল 'পুষ্কর ছাড়া আর কোথাও ব্রহ্মামন্দির হবে না।' সেই থেকে ব্রহ্মা অপূজনীয়। মন্দির শুধু সাধুসন্তদের জন্য; গৃহীদের সেখানে পূজা দেওয়ার রীতি নেই। গায়ত্রীদেবী অভিমানে পাহাড় থেকে ঝরনায়, যা আজও গায়ত্রী ঝরনা। দুর্ভাগ্যক্রমে, ইতিহাস প্রথমাদের প্রতি বড়ই নিষ্করুণ। শিব বললেই আমরা পার্বতীর কথা ভাবি, অর্জুন বললেই সুভদ্রার, শ্রীকৃষ্ণ বললেই সত্যভামার, শাহজাহান বললেই মমতাজমহলের, জাহাঙ্গির বললেই নুরজাহান, মহারাজা সওয়াই মান সিং বললেই গায়ত্রী দেবী, রিচারড বার্টন বললেই এলিজাবেথ টেলর – একবারও মনে পড়ে না যে এরা কেউই প্রথমা নন। ইতিহাস তাই সাবিত্রীর অভিশাপের কথা মনেও রাখেনি। ব্যাংকক স্কাইট্রেনের চিতলম স্টেশনের কাছে ১৯৫৬ তে নির্মিত এরায়ান মন্দির ব্রহ্মারই।

আর ব্রহ্মামন্দিরের পিছনে টিলার উপরে সাবিত্রীদেবীর মন্দির। মহাতীর্থ পুষ্করে পাঁচশতাধিক মন্দির আর বাহান্নঘাটের এক পুকুর। পুকুরে স্নান করলে মোক্ষ সুনিশ্চিত। সতীবিয়োগে মর্মাহত শিব নাকি এত কেঁদেছিলেন যে তাঁর চোখের জলেই পুষ্কর হ্রদ। বৈপরীত্য বড় নাড়ায়, এক বৃদ্ধ স্ত্রীর বিলম্বে ধৈর্য হারিয়ে দ্বিতীয়বার পিঁড়িতে বসেন, আর এক বৃদ্ধ স্ত্রীবিয়োগে মুহ্যমান।

বছরের একটিমাত্র সময়ে - কার্তিকী একাদশী থেকে কার্তিকী পূর্ণিমা এই পাঁচ দিন – পুষ্কর জেগে ওঠে তার বিশ্বখ্যাত মেলায়। এই সময়ে পুণ্যস্নানে গ্যারান্টিপ্রদত্ত পরিত্রাণ। তার লোভে দেবদেবীরাও নাকি পাপীতাপী লোকজনের পাপচক্ষুর অগোচরে এখানে পুণ্যস্নানে আসেন। পুষ্করের উটের মেলায় উট ও অন্যান্য পশু কেনাবেচা হয়, লাল ধুলো আর সোনালি বালি ঢেকে দেয় আকাশ বাতাস। তবু এই মেলার অনেকখানি ঘিরেই মানুষের চাওয়া পাওয়া, আমোদ-প্রমোদ। উৎসবের শুরু আকাশে গ্যাসবেলুন উড়িয়ে। তারপর পাঁচদিন বেলুন ওড়ানো, নাচ-গান, বড় গোঁফের প্রতিযোগিতা, নববধূর সাজে সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা; আর উটের দৌড়।

খোলা চত্ত্বরের একপাশে গাড়ি রাখা হল, পাশে উটওয়ালারা দাঁড়িয়ে আছেন। লাল জামার সঙ্গে হাটুরে ধুতি, মাথায় রাজস্থানী পাগড়ি, মোটা গোঁফ। যদিও দূরত্ব সামান্য, তথাপি উটের পিঠে চেপে ব্রহ্মামন্দিরে যাওয়াটাই দস্তুর। কিন্তু আমাদের সাহস হল না। অগত্যা হাঁটা। দুপাশে পূজা উপকরণের দোকানপাট। সেখানে জুতো জমা দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে অনেকখানি উঠে মন্দির; ঘন্টা নেড়ে ভেতরে। ছোটখাটো লম্বাটে পাথরের চাতাল, লাইনে দাঁড়িয়ে চতুর্মুখী জগৎপিতা দর্শন, দর্শনান্তে মন্দিরপরিক্রমা, গর্ভগৃহের আলোআঁধারি। মন্দিরে অনেকানেক দেবতা, সবাই খালিপায়ে। শুধু প্রহরী সূর্যদেবের পায়ে বুটজুতো। দশম শতকের সর্পশোভিত আপ্তেশ্বর শিবমন্দির ব্রহ্মামন্দিরের পাশেই, ভূমির অনেক নীচে; মানুষের পাপে নাকি এই মন্দির আস্তে আস্তে আরও বসে যাচ্ছে। তারপর যাওয়া হ্রদে।

সিং সভা গুরুদোয়ারা ঊনবিংশ শতকের। বরাহ মন্দির পুষ্করের সর্ববৃহৎ ও সর্বপ্রাচীন মন্দির, দ্বাদশ শতকে রাজা অনজি চৌহান ভগবান বিষ্ণুর তৃতীয় অবতার বরাহের মন্দির নির্মাণ করান। রংজিকেও ধরা হয় ভগবান বিষ্ণুর অন্যতম অবতাররূপে; তাঁর মন্দির দক্ষিণ ভারতের গোপুরম ধাঁচের। পাপমোচিনী মন্দিরে আছেন একাদশীমাতা, ভক্তদের পাপ মোচনার্থে। শ্রীপঞ্চকুণ্ড শিবমন্দিরের প্রতিষ্ঠা নাকি পঞ্চপাণ্ডবের হাতে। মনমহল পুষ্করের এক মস্ত প্রাসাদ, রাজা প্রথম মান সিংহের রাজকীয় অতিথিশালা, এখন হোটেল।

আজকের মত ভ্রমণ শেষ। আগামীকাল জয়পুর...

(ক্রমশঃ)

রাজস্থানের তথ্য ~ রাজস্থানের আরও ছবি

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অডিট ও অ্যাকাউন্টস বিভাগের কর্মী তপন পাল বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি এবং ইন্ডিয়ান রেলওয়ে ফ্যান ক্লাবের সদস্য। ভালোবাসেন বেড়াতে আর ছবি তুলতে। 'আমাদের ছুটি'-র জন্যই তাঁর কলম ধরা। সক্রিয়ভাবে যুক্ত রয়েছেন 'আমাদের ছুটি'-র সঙ্গেও।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher