বেড়ানোর ভাল লাগার মুহূর্তগুলো সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিতে ইচ্ছে করে, অথচ দীর্ঘ ভ্রমণ কাহিনি লেখার সময় নেই? বেড়িয়ে এসে আপনার অভিজ্ঞতাগুলো যেমনভাবে গল্প করে বলেন কাছের মানুষদের - ঠিক তেমনি করেই সেই কথাগুলো ছোট্ট করে লিখে পাঠিয়ে দিন ছুটির আড্ডায়। লেখা পাঠানোর জন্য দেখুন এখানে। লেখা পাঠাতে কোনরকম অসুবিধা হলে ই-মেল করুন - admin@amaderchhuti.com অথবা amaderchhuti@gmail.com -এ।
বিনসরে এক বিকেল
অরিন্দম পাত্র
নৈনিতাল থেকে চলেছি বিনসরের পথে। আলমোড়া হয়ে যেতে হবে। হোটেল থেকে বলে দিয়েছিল, দাদা এখানে দুটো বিনসর আছে - রাণীক্ষেতের বিনসর মহাদেব আর আলমোড়া হয়ে বিনসরের জঙ্গল। আমাদের গাড়ির ড্রাইভারকে বললাম, যাব বিনসরের জঙ্গলে। ড্রাইভার রাজকুমার আগ্রার ছেলে, দিল্লিতে থাকে। নৈনিতালে আগেও এসেছে, কিন্তু এইসব দিক চেনেনা। বললাম "ভাইয়া, আপ ঠিক তারাহ্ সে রাস্তা পাতা কর লিজিয়ে ইন লোঁগো সে..!"
তা রাস্তায় খুব একটা অসুবিধা হয়নি। রাজকুমার খুব করিতকর্মা ছেলে। প্রায় চার ঘন্টা লাগল পৌঁছতে। আলমোড়া ঢোকার একটু আগেই দেখা গেল তুষারশুভ্র গিরিশৃঙ্গ - সম্ভবত নন্দাদেবী পর্বত। দুচোখ ভরে দেখলাম। আর পড়ল গোলু দেবতার মন্দির, কিন্তু সেটি জঙ্গলের বেশ কিছুটা ভেতরে, চড়াই উঠতে হয় বলে আর গেলাম না। পাশেই গঙ্গানাথ মন্দিরপ্রাঙ্গণ দর্শন করে চলে এলাম বিনসর।
আমাদের রিসর্টের নাম ছিল বিনসর ইকো ক্যাম্প। লোকেশন বিনসর ইকো ফরেস্ট জোনে। একটু বেশ খাড়া চড়াই উঠতে হয়। তবে গাড়ি উঠে যায়। তারপর বেশ খানিকটা ভাঙ্গাচোরা কাঁচা রাস্তা। নাচতে নাচতে গাড়ি চলে এল বিনসর ইকো ক্যাম্পের সামনে।
প্রবেশ করতেই উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন রিসর্টের হেড কুক কাম ম্যানেজার রমেশজী রডোডেনড্রন ফুলের নির্যাস দিয়ে তৈরি ওয়েলকাম ড্রিঙ্ক দিয়ে। শান্তশিষ্ট ভাল মানুষ। নৈনিতালের বাসিন্দা। ওনার শ্যালক চন্দনও এখানেই কাজ করেন।
ঘরে গিয়ে লাগেজপত্র রেখে রমেশজীর সঙ্গে পুরো ইকো ক্যাম্প ঘুরে ঘুরে দেখলাম। অনেকগুলি বিভিন্ন ডিজাইনের কটেজ। পুরো জায়গাটা খুব সুন্দর ভাবে সাজানো। চারিদিকে সুন্দর গাছপালা আর ফুলের সমারোহ। প্রচুর থাইম, মিন্ট আর রোজমেরি'র গাছ দেখালেন রমেশজী, যেগুলি থেকে পাতা তুলে উনি হার্বাল টি বানিয়ে থাকেন (পরে সন্ধ্যার সময় সেই চা আমাদের খাইয়েও ছিলেন)!
খুব জোর ক্ষিদে পেয়েছিল, রমেশজীকে বলতেই উনি বল্লেন "স্যার জি, ডাইনিং রুম মে চলে আইয়ে ফ্রেশ হোকে।" এখানে রুম সার্ভিস নেই।
ডাইনিং হলে দ্বিপ্রাহরিক আহারাদি সেরে উঠলাম। রমেশজীর হাতের রান্না সত্যিই সুস্বাদু। খাওয়ার পর্ব সারার পরে আলাপ হল এই বিনসর ইকো ক্যাম্পের মালিক, সুদর্শন তরুণ যুবক রবি মেহরার সঙ্গে। রমেশজী আলাপ করিয়ে দিলেন। খুব ভাল মানুষ এই রবিজী। এত বড় প্রপার্টির মালিক, এতটুকুও অহঙ্কার নেই। আমাদের সঙ্গে অনেক গল্প করলেন। রবিজী বিদায় নিতে আমরা রুমে চলে এলাম বিশ্রাম নিতে। কিন্তু রমেশজী বলে রাখলেন বিকেল চারটের সময় তৈরি থাকতে, জঙ্গলের মধ্যে অল্প ট্রেক করে একটা ভিউ পয়েন্ট আছে, সেখান থেকে সানসেট দেখাবেন।
নির্ধারিত সময়ে রমেশজীর সঙ্গে জঙ্গলের ভেতরে ঢুকলাম। হাল্কা চড়াই ভেঙে চলে এলাম পাইন ফরেস্টের ভেতর। আরও বেশ খানিকটা উঠতে হল। একটা ছোট্ট হাট বানানো রয়েছে। ওখান থেকেই সানসেট দেখা যাবে।
জায়গাটা এত চমৎকার যে বলে বোঝানো যাবে না! মেঘহীন আকাশে দিগন্ত জুড়ে বিরাজ করছে হিমালয়ের শৃঙ্গরাজি। নন্দাদেবী, নন্দাঘুন্টি, চৌখাম্বা, ত্রিশূল, পঞ্চচুল্লী!সে এক দেখার মত দৃশ্য! ধীরে ধীরে সূর্য ডুবে যেতে থাকল, আর তার রঙের ছটা পড়ে সোনারঙের হয়ে উঠল ওই তুষারশৃঙ্গগুলি! পরে অবশ্য আরও কাছ থেকে এই দৃশ্য দেখেছি যথাক্রমে মুন্সিয়ারি এবং কৌশানি থেকে।
চন্দনও গিয়েছিল আমাদের সঙ্গে। জানতে পারলাম ভিউ পয়েন্ট থেকে দূরের ঘন জঙ্গলে যাওয়া যায় জীপ সাফারিতেও। অনেক বিদেশি আসেন, তাঁদের জঙ্গল ট্রেকিং-এও নিয়ে যায়। আরো জানাল যে, এই জঙ্গলে অনেক লেপার্ড আছে। আমাকে ছবিও দেখাল ওর মোবাইল থেকে, নাইট সাফারির সময় তোলা। বলাই বাহুল্য এইসবের প্ল্যান আমার মত ভীতু মানুষের ছিল না!
অসাধারণ সূর্যাস্ত দেখে ধীরে ধীরে নেমে এলাম হোটেলে। সন্ধ্যার স্ন্যাক্স চলে এল, খেয়ে রুমে রিল্যাক্স করলাম বেশ কিছুক্ষণ। রবিজী বন ফায়ারের বন্দোবস্ত করলেন। অন্যান্য টুরিস্টদের সঙ্গে আমরাও খুব আনন্দ করলাম। তারপর রাতের খাওয়া সেরে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। আগামীকাল আমাদের গন্তব্য চকৌরি।
পেশায় চিকিৎসক (নাক কান ও গলা বিশেষজ্ঞ) অরিন্দম পাত্র-এর নেশা ছবি তোলা। এছাড়াও দেশের মধ্যে নানা জায়গায় ভ্রমণ করা তাঁর আর এক শখ।
অজন্তা-ইলোরা ছুঁয়ে আসা
পলাশ পান্ডা
আজাদ হিন্দ এক্সপ্রেস যখন আহমেদনগর স্টেশনে পৌঁছাল ঘড়িতে রাত সাড়ে তিনটে। প্ল্যাটফর্মে নামার পর একটু ঠান্ডা অনুভব করলাম। যদিও মার্চের তৃতীয় সপ্তাহ তবু এখানকার ওয়েদারটাই এমন, সারাবছরই এখানে রাতের বেলাতে হাল্কা ঠান্ডার অনুভুতি থাকে। আগে থেকেই রাজীব তার অটো নিয়ে অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য। আহমেদনগর স্টেশনটি সুন্দর সাজানগোছানো এবং বেশ পরিষ্কার-পরিছন্ন। অটোতে উঠে স্টেশন থেকে বেরিয়ে যখন রাস্তায় এলাম পুরোটা ফাঁকা - নগরের ঘুম ভাঙতে দেরি আছে তখনো।
আহমেদনগর জেলাটি মহারাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত, অবস্থান পুণের প্রায় ১২০ কিমি উত্তর-পূর্বে এবং আওরাঙ্গাবাদ থেকে ১১৪ কিমি দূরে। আহমেদ নিজাম সাহর নাম থেকেই এর নামকরণ হয়েছিল। ১৪৯৪ সালে পরাক্রমশালী বাহমনি বাহিনীর বিরুদ্ধে আহমেদ নিজাম সাহ এই স্থানে যুদ্ধ জয় করেন এবং তারপর তিনি নিজের নামে এর নামকরণ করেন। আহমেদনগরে এখন রয়েছে ভারতীয় আর্মড কর্প সেন্টার এবং স্কুল। সেখানে সেনাবাহিনিতে নিয়োগ করা ও ট্রেনিং দেওয়া হয়ে থাকে।
রাজীবের মুখে শুনলাম নগর থেকে কুড়ি কিমি দূরে পিপলগাঁও নামে এক জায়গায় নাকি একটা সুন্দর আঙুরের খেত রয়েছে। পরদিন বিকেল বেলা একটা বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। নানা রাস্তা ঘুরে শেষে এক সহৃদয় ব্যক্তির কৃপায় সেই আঙুরের খেতটা খুঁজে পেলাম। অনেকটা জায়গা জুড়ে রয়েছে সেই আঙুরের খেতটি, সুন্দরভাবে মাচার ওপর ঝুলে রয়েছে গাছগুলি। একটা সারি থেকে আর একটা সারি মধ্যে প্রায় তিন ফুটের ব্যবধান।। পুরো খেতটি লোহার তার দিয়ে ঘেরা রয়েছে। কিন্তু যে উদ্দ্যম ও কষ্ট সহ্য করে এতদূর এলাম সেই আশা নিভে গেল, যখন দেখলাম আঙুরের খেতে একটাও আঙুর নেই। দেখেই মনে হল, যেন কয়েকদিন আগেই সব আঙুর তোলা হয়ে গেছে। কী আর করা যাবে, সেই পুরনো প্রবাদ "আঙুর ফল টক" মনে করে যখন ফেরার জন্য মনস্থির করলাম ঠিক সেই সময় পেছন থেকে একজনের ডাক শুনে দাঁড়িয়ে গেলাম। লোকটি আমাদের কাছে এসে আমাদের এখানে আসার কারণ শুনে কিছুটা হতাশ হলেন। আজ ইন্সিওরেন্স কোম্পানির লোক এই খেতটি দেখতে আসার কথা ছিল, আমাদেরকে সেই কোম্পানির লোক বলেই মনে করেছিলেন।
আমরা আঙুর দেখতে না পাওয়ার দুঃখ প্রকাশ করতে উনি মুচকি হেসে পথ দেখিয়ে খেতের কিছুটা ভেতরে নিয়ে গেলেন। ভেতরে ঢুকে তো অবাক হয়ে চেয়ে দেখলাম, থোকা থোকা আঙুর ঝুলে রয়েছে। কিছু আঙুর এখনো পাকতে দেরি আছে তাই সেগুলো এখনো গাছে রয়ে গেছে। এই প্রথম আমি চাক্ষুষ আঙুরের খেত দেখলাম।
পরদিন আমাদের গন্তব্য প্রায় দুশো কিমি দূরে ইমাজিকা থিম পার্ক। অনেকখানি পথ অতিক্রম করতে হবে, তাই সকাল সকাল গাড়িতে চেপে বসলাম। যখন পৌঁছালাম তখন ঘড়িতে একটা বাজে। তাড়াতাড়ি গাড়ি পার্ক করিয়ে সোজা টিকিট কাউন্টারে লাইন দিলাম। ইমাজিকা থিম পার্কটি মহারাষ্ট্রের রায়গড় জেলার খোপোলিতে তিনশো একর জায়গার উপর গড়ে উঠেছে।
পার্কটি তিনটি ভাগে বিভক্ত -থিম পার্ক, ওয়াটার পার্ক ও স্নো পার্ক। প্রথমে প্রবেশ করলাম 'আই ফর ইন্ডিয়া' তে। এখানে নব্বই ফুট প্রশস্ত পর্দায় ভারতবর্ষের বিশেষ জায়গাগুলিকে এমনভাবে দেখানো হয় যেন মনে হয় যেন পাখির মতো আকাশে উড়তে উড়তে পুরো ভারতবর্ষটাকে দেখছি। এর পর গেলাম 'প্রিন্স অফ ডার্ক ওয়াটারস – সিনেমা ৩৬০' তে। এখানে মেঝের উপর চিত হয়ে শুয়ে পড়ে মাথার ওপরের পর্দায় ভেসে ওঠা সিনেমা দেখতে হয়। 'মিঃ ইন্ডিয়া শো' টা মূলত রাইডবেসড।
সবথেকে মজার লাগল'রাজাসুরাস রিভার এডভেঞ্চার'। যদিও উইক ডে, তবু এই ইভেন্টে দেখলাম সবথেকে বেশি ভিড়। এটা ছোটদের পক্ষে একটু বিপজ্জনক হওয়ার জন্য আমরা বড়রা তিনজন গেলাম। এইভাবে একে একে ঘুরে নিলাম সেলিমঘর, আলিবাবা আর চল্লিশ চোর, আরো অনেক কিছু। আমার দুর্বল হৃদয় হওয়ার কারণে কিছু ইভেন্ট যেমন নাইট্রো, স্ক্রিমার মেশিন, ডিপ স্পেস-এর মত ড্রাইভগুলো বাইরে থেকেই উপভোগ করে কাটালাম। এইভাবে যে কখন ঘড়িতে সাতটা বেজে গেছে তা টের পাইনি। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে গোটা ইমাজিকাটা আলোর রসনায়ে মোড়া হয়ে গেল। আমরাও ফেরার রাস্তা ধরলাম।
তৃতীয় দিন আমাদের গন্তব্য হল অজন্তা ও ইলোরা। আজ অনেকটা পথ যেতে হবে। আগে থেকে গাড়ি ঠিক করা থাকলেও গাড়ি আসতে আসতে প্রায় সকাল আটটা বেজে গেল। আহমেদনগর থেকে অজন্তার দূরত্ব কম করে ২১৫ কিমি। আর ইলোরার দূরত্ব কম করে ১৩৫ কিমি। ড্রাইভার বলল একদিনে দুটো স্পট ঠিক ঠাক কভার করা যাবেনা, তাই কেবল ইলোরা ও তার সঙ্গে আওরাঙ্গবাদের কিছু বিশেষ দ্রষ্টব্য দেখা উচিত। কিন্তু আমিও নাছোড় বান্দা এতদূর এসে অজন্তা না দেখে ফিরব না। সেইমত ঠিক হল আগে অজন্তা যাওয়া হবে এবং ফেরার পথে ইলোরা ঢুকব। আমাদের গাড়ি NH-60 ধরে এগোতে থাকল। এখানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ খুবই কম। তাই দিনের বেলা আবহাওয়া খুবই শুষ্ক। রাস্তার দুইধারে দেখলাম সেলো পাম্পের মাধ্যমে আখের চাষ হচ্ছে। শুধুমাত্র এই আহমেদনগরেই ঊনিশটা চিনির কারখানা রয়েছে, এই নগর সমবায় আন্দোলনের জন্মস্থান হিসাবেও পরিচিত। আওরাঙ্গবাদের যানজট কাটিয়ে মাঝখানে দুপুরের ভোজন সেরে যখন অজন্তায় পৌঁছালাম তখন ঘড়িতে ১২:১০ মিঃ।
পার্কিং এরিয়া থেকে বাস ধরবার জন্য স্ট্যান্ডে এলাম। এখান থেকে মূল গেটের দূরত্ব ৪ কিমি। এই দূরত্ব অতিক্রম করার জন্য মহারাষ্ট্র ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (MTDC)-এর ব্যাটারিচালিত এসি ও নন এসি বাসের ব্যবস্থা রয়েছে। আমাদের লাইন অনুযায়ী একটি এসি বাসে জায়গা হল। বাস গিয়ে দাঁড়াল অজন্তা গুহাবলীর পাদদেশে।
অদূরের টিকিট কাউন্টারে গিয়ে টিকিট কেটে এগোতে শুরু করলাম। এগোনোর পথেই বাঁদিকে দেখতে পেলাম এমটিডিসি-র একটি সুন্দর রেষ্টুরেন্ট। তার পাশেই ট্যুরিস্টদের সুবিধার জন্য বিরাট এক সাইন বোর্ডে অজন্তার গুহাগুলির নাম্বারসহ ম্যাপ দিয়ে বর্ণনা দেওয়া রয়েছে। এরই ফাঁকে রাস্তার পাশে টগর গাছের ডালে একটি টিকেলস ব্লু ফ্লইক্যাচার বসে থাকতে দেখলাম। খুব কাছাকাছি থাকায় সুন্দর কয়েকটি ছবি পাওয়া গেল।
গিরিখাতের পাথর কেটে তিরিশটি গুহা নিয়ে অজন্তা গুহাবলী। গুহাগুলিকে পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখতে হয়। এখানে দেখলাম পোর্টারের ব্যবস্থাও রয়েছে। বারোশো টাকার বিনিময়ে চারজন পোর্টার কাঁধে বয়ে ঘুরে দেখায়। আমরা ধীরে ধীরে চড়াই সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে এলাম। এখান থেকে পুরো দৃশ্যটা সুন্দর দেখা যায়। এই গুহাগুলি মূলত বৌদ্ধধর্মের উপাসনা গৃহ ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব দুই থেকে সাত দশকের মাঝামাঝি এই গুহাগুলি তৈরি হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। অজন্তার দেওয়ালের চিত্রগুলিতে বুদ্ধের জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। ১৯৮৩ সালে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের আওতায় আনা হয় অজন্তাকে। আমরা ১নং গুহার দিকে এগোতে লাগলাম। গুহা মন্দিরগুলিতে দুটি বা তিনটি প্রবেশদ্বার রয়েছে। একটি মূল প্রবেশদ্বার ও অন্যগুলো পার্শ্বদ্বার হিসাবে ব্যবহৃত হত। প্রত্যেক গুহার ভেতরে ঢুকতে গেলে প্রথমে জুতো খুলে ঢুকতে হয়। গুহার ভেতরে একসঙ্গে সাত-আট জনের বেশি ঢুকতে দেওয়া হয় না। গুহার বাইরে যতটা গরম ভেতরে ততটা ঠান্ডা।
গুহার ভেতরে ঢুকতেই সবার প্রথমে চোখে পড়ল সামনের দেওয়ালে বুদ্ধের একটি বিশাল মূর্তি। ধর্মচক্রপ্রবর্তন মুদ্রায় এই মূর্তিটি শিল্পনৈপুণ্যে অনবদ্য। গুহার অন্যান্য দেওয়ালে রয়েছে জাতক কাহিনির ফ্রেস্কো। ওখান থেকে বেরিয়ে ২নং গুহায় প্রবেশ করলাম। ২নং গুহার প্রবেশদ্বার ১নং গুহার চেয়ে বেশি কারুকার্যমন্ডিত। গুহার ভেতরে ঢুকে দেখলাম চারিপাশে রয়েছে বড় চারটে স্তম্ভ। প্রতিটি স্তম্ভে সুন্দর কারুকার্য রয়েছে। মেঝে ব্যতীত দেওয়াল ও ছাদের সর্বত্রই চিত্রিত। দেওয়াল জুড়ে বুদ্ধের জীবনকাহিনি ছাড়াও বিভিন্ন পশু, পাখির ছবি রয়েছে। এইভাবে তৃতীয় ও চতুর্থ গুহা ঘুরে নেবার পর আমার শরীরটা একটু খারাপ করতে লাগল। পাহাড়ি রুক্ষ এলাকা হওয়ার কারণে এখানে এইসময়টা ভীষণ গরম। একটা ছায়াঢাকা জায়গা দেখে বসে পড়লাম। আমার সঙ্গীরা পরের দর্শনের জন্য এগিয়ে গেল। অজন্তা উপভোগ করার জন্য একটা গোটা দিন ঘোরাও যথেষ্ট নয়।
এখান থেকে সোজা যাব ইলোরাতে, দূরত্ব ১০০ কিমি আর আওরাঙ্গবাদের থেকে দূরত্ব ৩০ কিমি। যখন ইলোরার গেটে পৌছালাম তখন ঘড়িতে চারটে বাজে। গুহাগুলি সন্ধে সোয়া ছটা পর্যন্ত খোলা থাকে। এই ইলোরাকে স্থানীয় লোকেরা ভেলুরা বা এলুরা বলে থাকে। ধারণা করা হয় প্রাচীন এলাপুরা নাম থেকে এই নামের উৎপত্তি হয়েছে। এখানে মোট চৌত্রিশটি গুহা রয়েছে। যার মধ্যে সতেরটি হিন্দু ধর্মের, বারটি বৌদ্ধ ধর্মের ও পাঁচটি জৈন ধর্মের। এটি বর্তমানে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের আওতায় আনা হয়েছে। ইলোরাতে যতগুলি গুহা রয়েছে তার মধ্যে ষোল নং গুহা কৈলাসনাথ মন্দির নামে খ্যাত, যেটি সব থেকে বিস্ময়কর ও ইলোরার প্রাণ কেন্দ্র।
টিকিট কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে সরাসরি ষোল নং গুহাতে প্রবেশ করলাম। পুরো গুহাটি একটি মাত্র পাথর কেটে তৈরি হয়েছে। তিন দিকের পাথর কেটে খাদ তৈরি করে এই ৩০০ ফুট লম্বা, ১৫০ ফুট চাওড়া আর ১০০ ফুট উঁচু মন্দিরটি বার করা হয়। প্রত্যেক শিবমন্দিরের সামনে যেমন একটি ষাঁড় বিদ্যমান থাকে তেমনি এখানেও এই গুহার প্রবেশদ্বারের সামনে নন্দীর প্রতিকৃতি রয়েছে। মন্দিরে ঢুকে প্রথমেই ডান দিকে রয়েছে পার্বতী ও বাম দিকে রয়েছে গণেশের মূর্তি। আর সামনেই চোখে পড়ল অনেকগুলো পদ্মের উপর অধিষ্ঠিত দেবী লক্ষ্মী। দ্বার থেকে বাম দিকের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই প্রথমেই চোখে পড়ল ১১৫ ফুট লম্বা বিস্ময়কর অলঙ্কৃত স্তম্ভ। যেটি সম্পূর্ণ একটি মাত্র পাথর খোদাই করে নির্মিত। এই কৈলাস মন্দিরের চারিপাশটাই বিভিন্ন দেব দেবীর মূর্তি রয়েছে। মন্দিরটি পাঁচটা ভাগে বিন্যস্ত। যথা গোপুর, অর্ধ্মন্ডপ, নাটমন্দির, জগমোহন, গর্ভগৃহ ও শিখর। বিভিন্ন তলের মধ্যে যোগসূত্রের মাধ্যম হিসাবে সিঁড়ি রয়েছে। এই মন্দিরটিতে ১২০ ধরনের শিবের মূর্তি রয়েছে। পুরো মন্দিরটিকে একটি রথের আকৃতিতে খোদাই করা হয়েছে। মন্দিরের বাম দিকের দেওয়ালে খোদিত হয়েছে মহাভারতের যুদ্ধের কাহিনি আর ডান দিকের দেওয়ালে খোদিত হয়েছে রামায়নের কিছু কাহিনি।
কিছু কিছু জায়গায় দেখলাম মেরামতির কাজ চলছে, সেই জন্যে মন্দিরের সর্বত্র যাওয়া যাচ্ছে না। ডান দিকের সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠে এলাম। এখান থেকে মন্দিরের অনেকটা ভাগই চোখে পড়ছে। পড়ন্ত সূর্যের কিরণে কৈলাসনাথ মন্দিরটিকে আরো মায়াবী দেখালো। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে এই অপরূপ প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন দেখতে দেখতে কখন যে ঘড়িতে ছটা বেজে গেছে বুঝতেই পারিনি। এবার ফেরার পালা। বাকী রয়ে গেল ইলোরা-অজন্তা দুইয়েরই আরও আরও সব গুহা, আওরঙ্গাবাদের গুহাবলী, অজেয় কেল্লা দৌলতাবাদ, বাদশাহ আওরঙ্গজেবের সমাধিক্ষেত্র, তাজমহলের আদলে তৈরি বিবি কা মকবারা। এযাত্রায় তবু অজন্তা-ইলোরাকে বুড়িছোঁয়া তো হল – এটুকুই পাওয়া।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ দপ্তরের কম্পিঊটার অপারেটার পলাশ পান্ডা-র সখ ফোটোগ্রাফি ও বেড়ানো।