বেড়ানোর মতই বইপড়ার আদতও বাঙালির চেনা সখ – তা ছাপা হোক বা ই-বুক। পুরোনো এই ভ্রমণ কাহিনিগুলির নস্টালজিয়া তাতে এনে দেয় একটা অন্যরকম আমেজ। আজকের ভ্রমণপ্রিয় বাঙালি লেখক-পাঠকেরা অনেকেই শতাব্দীপ্রাচীন সেইসব লেখাগুলি পড়ার সুযোগ পাননি। পুরোনো পত্রিকার পাতা থেকে অথবা পুরোনো বইয়ের নির্বাচিত কিছু অংশ তাই পুনঃপ্রকাশিত হচ্ছে 'আমাদের ছুটি'-র পাঠকদের জন্য।
['সাইকেলে কাশ্মীর ও আর্য্যাবর্ত্ত' –এই ভ্রমণকাহিনিটি ধারাবাহিকভাবে বেরোত প্রবাসী পত্রিকায় ১৯২৬ খ্রীষ্টাব্দে। লেখক শ্রী অশোক মুখোপাধ্যায় বিশেষ পরিচিত কোনও নাম নন। আজকের ইন্টারনেট-গুগুল ম্যাপ-ইন্সটাগ্রাম-ফেসবুক লাইভ যুগের তরুণ-তরুণীদের জন্য এখানে রইল প্রায় একশো বছর আগের কয়েকজন অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় বাঙালি তরুণের ভ্রমণকথা।]
সাইকেলে কাশ্মীর ও আর্য্যাবর্ত্ত
শ্রী অশোক মুখোপাধ্যায়
আয়োজন
(কলিকাতা হইতে কুল্টি)
১
তারিখটা ঠিক মনে নেই, জুলাই মাসের একটা সন্ধ্যায় কয়েক বন্ধু মিলে আমাদের ক্লাবে (Gay Wheelers Club) ব'সে এবার পূজায় কোথায় যাওয়া যাবে তারই আলোচনা হচ্ছিল। সেদিন বৃষ্টিটা যেমন এলোমেলো ভাবে পড়্ছিল, সেইরকম আমাদের গন্তব্য সম্বন্ধে জল্পনাকল্পনাটাও কোনো একটা স্থির সিদ্ধান্তে উপস্থিত হ'তে পার্ছিল না। অনেক আলোচনার পর পেশোয়ার যাওয়াই যখন কতকটা ঠিক হ'য়ে এল তখন আনন্দ বল্লে, "আকর্ষণবিহীন পেশোয়ার অপেক্ষা ভূস্বর্গ কাশ্মীর যাওয়াই কি আনন্দদায়ক ও একটু বেশী adventurous ব'লে মনে হয় না?" কথাটা সকলেরই মনে লাগ্ল। কাশ্মীর পৃথিবীর মধ্যে একটি দেখ্বার মতো জায়গা। আর সাইকেলে যাওয়া দুঃসাহসিকতা ও নূতনত্বের বিষয় ব'লেই বোধ হয় আর কোন প্রতিবাদ উঠ্ল না। কাশ্মীর যাওয়া যখন স্থির হ'ল তখন কেউ কেউ এটা 'আগাগোড়া সাইকেল ভ্রমণ' হোক্ এই ইচ্ছা প্রকাশ করায় অনেক তর্কের পর শেষে আমাদের প্রোগ্রাম দাঁড়াল - Calcutta to Srinagar and Back Via Nagpur অর্থাৎ 'কলিকাতা হইতে শ্রীনগর ও শ্রীনগর হইতে নাগপুর হইয়া কলিকাতা প্রত্যাবর্ত্তন।'
ম্যাপে দেখা গেল, এই ভ্রমণটি ৪০০০ মাইলের বরঞ্চ কিছু বেশীই হবে আর সময়ও নেহাৎ কম লাগ্বে না। সেইজন্য কেবল চার জনের অতিরিক্ত উৎসাহের জন্য আমাদেরই যাওয়া ঠিক হ'ল। প্রোগ্রামটা শেষ করা ও যাতে এই ভ্রমণটি বেশ সুচারুরূপে সম্পন্ন হয় সেই উদ্দেশ্যে আমাদের প্রত্যেককে নিম্নলিখিত এক-একটি কাজের ভার দেওয়া হ'ল -
১। অশোক মুখোপাধ্যায় - General Manager, অর্থাৎ যাতে সমস্ত কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন হয় তার জন্য দায়ী।
২। আনন্দ মুখোপাধ্যায় - Engineer, অর্থাৎ সাইকেল মেরামত ও সাইকেল সম্বন্ধীয় সব রকম কাজের জন্য দায়ী।
৩। নিরঙ্ক মজুমদার - Quarter Master, অর্থাৎ খাওয়া দাওয়ার বন্দোবস্ত ও ঐ সম্বন্ধীয় সব রকম কাজের জন্য দায়ী।
৪। মণীন্দ্র ঘোষ - Log keeper, অর্থাৎ দৈনিক সব রকম ঘটনা, রাস্তা ও দূরত্ব প্রভৃতির হিসাব রাখবার জন্য দায়ী।
২২শে সেপ্টেম্বর আমাদের যাওয়ার দিন ঠিক করা গেল। যাওয়ার কয়েক দিন আগে আমাদের সাইকেল চারখানা আগাগোড়া মেরামত করা হ'ল। সাইকেলে বেশী জিনিস নেওয়া অসম্ভব ব'লে আমরা নিতান্ত দরকারী জিনিস ভিন্ন আর কিছুই নিলাম না। তাতে আমাদের প্রত্যেকের সরঞ্জাম এই দাঁড়াল - ১টি কম্বল, ১টি লুঙ্গি, ১টি খাকি সার্ট, ১টি তোয়ালে, ১টি এনামেল কাপ। এছাড়া সাইকেলের 'টায়ার' ব্যতীত যাবতীয় সরঞ্জাম, প্রয়োজনীয় ঔষধপত্রাদি ও shaving set (ক্ষুর ইত্যাদি) সকলে ভাগ ক'রে নেওয়া হ'ল। এইসব সরঞ্জাম সমেত প্রত্যেক সাইকেলের ওজন দেখা গেল ৫৪ পাউন্ড।
আমাদের সাইকেল চারটির মধ্যে ১টি Imperial Triumph, ১টি Albion ও ২টি Standard । আমরা Dunlop, Moseley, Burgounan ও Richmond টায়ার ব্যবহার করেছিলাম। তখন বেজায় গরম ও সাইকেল নিয়ে যাওয়া বিশেষ কষ্টকর ব'লে জম্মুতে গরম কাপড়-চোপড় পাঠাবার ব্যবস্থা করা হ'ল। আমাদের যাওয়ার পোষাক হ'ল - খাকী সর্ট, সার্ট, কোট, হ্যাট, মোজা ও 'সু'।
যাত্রা কর্বার কয়েক দিন পূর্ব্বে আমরা কলিকাতার মেয়র ও স্থানীয় একজন M.L.C. ও দু'একজন নামজাদা লোকের চিঠি (introductory letter) যোগাড় ক'রে নিলাম। বলা বাহুল্য, এগুলি পুলিশের অনাবশ্যক অনুসন্ধিৎসা ও সহানুভূতির (?) হাত থেকে কতকটা রক্ষা করে। শুন্লাম, পুলিশ কমিশনারের এইরূপ একখানি চিঠি সঙ্গে থাক্লে পুলিশের হাঙ্গাম থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়। সেইজন্য আমরা তাঁর সঙ্গে দেখা ক'রে জান্লাম যে তাঁরা 'খোজ খার' না ক'রে কাউকে কোন রকম চিঠিপত্র দেন না। খোঁজ নেওয়ার জন্য আমাদের ঠিকানা রেখে দিলেন - কিন্তু আজ পর্য্যন্ত তাঁদের 'সুপারিস-পত্র' পাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। এইজন্যই আমাদের যাওয়ার দিন পেছিয়ে দিতে হ'য়েছিল।
নানা প্রকারের বিদ্রূপ ও উৎকন্ঠার মধ্য দিয়ে যাওয়ার দিন ক্রমশঃ এগিয়ে এল। এখন এইখান থেকে আমাদের দৈনিক-লিপি আরম্ভ করা যাক্।
কাশ্মীর-অভিমুখে
২২শে সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার - এই ঘটনাবহুল ভ্রমণের এক অধ্যায়ের আজ প্রথম দিন। আমাদের আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের বিদায় দিতে সমবেত হ'লেন। বয়োজ্যেষ্ঠেরা যাত্রার সময় কল্যাণ কামনা কর্লেন - বন্ধুরা 'all success' ব'লে বিদায় দিলেন। তখন রাত সাড়ে চারটা। সমস্ত নগর নিস্তব্ধ, সুষুপ্ত, পথ জনশূন্য, আমরা ল্যাম্প জ্বেলে রওনা হ'লাম। আমরা হাওড়া পুলে এসে দেখ্লাম পুল খোলা। কাজেই আমাদের এখানে প্রায় মিনিট পনের দাঁড়াতে হ'ল। পরে হাওড়া ষ্টেশনকে বাঁ দিকে ফেলে ক্রমশঃ আমরা গ্রাণ্ডট্রাঙ্ক রোডে পড়্লাম। তখনও বেশ অন্ধকার, কিন্তু রাস্তার আলো নিবিয়ে দেওয়ায় আমাদের একটু অসুবিধা হ'তে লাগ্ল। ভোরবেলা লিলুয়ায় এসে ল্যাম্প নিভিয়ে দিলাম। রাস্তা খারাপ হ'তে আরম্ভ হ'ল। পাঁচ মাইল-ষ্টোনের কাছে দেখা গেল মিটার আল্গা হ'য়ে যাওয়ায় সরে গেছে -তাতে কিছু ওঠে নি। নেমে মিটার ঠিক ক'রে আমরা সাইকেলে উঠ্লাম।
সূর্যোদয় হ'য়েছে। বালিতে গঙ্গাকে ডান দিকে রেখে উত্তরপাড়া; কোন্নগরের ভিতর দিয়ে চলেছি। দু'পাশে মিলের মাঝখান দিয়ে রাস্তা চলেছে। গাড়ী ঘোড়া ও লোকজনের ভিড়ও কম নয়। কলকাতার আঁচ এখনও একেবারে যায় নি। মাঝে মাঝে রেলের লাইনের গেট বন্ধ থাকায় আমাদের নাম্তে হচ্ছিল। ক্রমশঃ রাস্তার পাশে গাছপালা সুরু হ'ল। সবুজ শাখা-পত্রসমাচ্ছন্ন বাগানের ভিতর দিয়ে বাড়ীগুলি পিছনে রেখে আমরা ব্যাণ্ডেলের কাছে এসে পড়্লাম। প্রখর রোদে তৃষ্ণার্ত্ত হ'য়ে চা খাওয়ার জন্য মাইল খানেক কাঁচা রাস্তা দিয়ে ব্যাণ্ডেল ষ্টেশনে গেলাম।
রওনা হতে বেলা নটা হ'য়ে গেল। আবার গ্র্যাণ্ডট্রাঙ্ক রোড ধ'রে চল্লাম। রাস্তা অপেক্ষাকৃত ভাল কিন্তু রোদের তেজে আমাদের বিশেষ কষ্ট হচ্ছিল। মগরা ছাড়াতে প্রায় বারটা বাজ্ল। জল খাওয়ার জন্যে আমাদের প্রায়ই এখানে সেখানে নাম্তে হচ্ছিল। এবার অগ্রসর হওয়া কঠিন হ'য়ে উঠ্ল। রাস্তার ধারে একটা বড় আম গাছের ছায়ায় আমরা বিশ্রাম কর্তে নাম্লাম। আশেপাশের কুঁড়ে থেকে কয়েকটি চাষী সপরিবারে আমাদের ঘিরে দাঁড়াল। এখনও মনে পড়ে তাদের দেওয়া জল আমরা কত তৃপ্তির সঙ্গে খেয়েছিলাম। মিনিট পনের বিশ্রামের পর আবার রওনা হ'লাম। এবার রাস্তা ক্রমশঃ বেশ ভাল হ'তে আরম্ভ হ'ল। বেলা একটার পর আমরা বৈঁচিতে মন্মথ কুমার মহাশয়ের গোলাবাড়ীতে খাওয়া দাওয়ার জন্য উপস্থিত হ'লাম। এখানে আগেই খবর দেওয়া ছিল।
বেলা চারটার সময় চা খাওয়ার পর আমরা রওনা হ'লাম। সবুজ ক্ষেত্রের ভিতর দিয়ে আম কাঁঠাল গাছের ছায়ায় ঢাকা লাল রাস্তাটি এঁকে বেঁকে বর্দ্ধমানের দিকে চ'লে গেছে। সূর্য্যের তেজ কমে আসাতে আমাদের কষ্ট অনেক কমে গেল। এতক্ষণে সমস্ত দিনের শ্রান্তি লাঘব হ'ল। বাংলা মায়ের স্নিগ্ধ-শ্যামল ছবিখানি আমাদের মনের মধ্যে একটি রঙীন রেখা টেনে দিলে। বন্ধু অশোক উচ্ছ্বসিত হ'য়ে গান গেয়ে উঠ্ল।
কিন্তু বেশীক্ষণ এ উচ্ছ্বাস রইল না। কিছু আগেকার ছোট্ট মেঘখানি একটু একটু ক'রে সমস্ত আকাশ ছেয়ে ফেলেছে। চারদিক অন্ধকার; ঝড় সুরু হ'ল। বৃষ্টি আসন্ন দেখে গান থামিয়ে আমরা জোরে যেতে লাগ্লাম। বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা টুপির পাশ দিয়ে মুখে পড়তে লাগ্ল। আকাশের এই রকম অবস্থার জন্য বর্দ্ধমান পৌঁছানর আশা ত্যাগ ক'রে দূরে ষ্টেশন দেখে সেখানে আশ্রয় নিতে উপস্থিত হ'য়ে দেখলাম শক্তিগড় ষ্টেশন। আমাদের সেখানে পৌঁছানর সঙ্গে সঙ্গে খুব জোরে বৃষ্টি আরম্ভ হ'ল। রাত কাটাবার জন্য দু'খানা বেঞ্চ দখল ক'রে কম্বল পেতে বিছানা পেতে ফেল্লাম। চার পাশে সাইকেলের উপর আমাদের ভিজা পোষাক রাখা হ'ল। রাত ন'টার পর বৃষ্টি থাম্লে নিরঙ্ককে খাওয়ার যোগাড়ের জন্য পাঠান হ'ল, বেশী রাত হওয়ায় দোকান বন্ধ হ'য়ে গেছে। কিছু পাওয়া গেল না। হ্যাভারস্যাক থেকে নাসপাতি নিয়ে, আর চিনির সরবত তৈরী ক'রে সে-দিনের মতো খাওয়া শেষ ক'রে ফেল্লাম।
ডায়েরী লেখার পর মশা ও ছারপোকার অনুগ্রহে বৃথা ঘুমের চেষ্টা ক'রে বাইরে খোলা প্ল্যাটফরমে এসে দাঁড়ালাম। ছিন্ন মেঘের ফাঁক থেকে পঞ্চমীর চাঁদের ক্ষীণ জ্যোৎস্না গাছের ভেজা পাতার উপর প'ড়ে পল্লীমায়ের আর এক শ্রী দেখালে। ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছিল। কোটটাকে গায়ে টেনে দিয়ে প্ল্যাটফরমে পায়চারি ক'রে আমরা কোনোরকমে রাত কাটিয়ে দিলাম। আজ মোট ৬৫ মাইল আসা হ'ল।
২
২৩ শে সেপ্টেম্বর বুধবার - তখন আলো-আঁধারের মিলন-মুহূর্ত্ত। সদ্যোজাত শিশু-অরুণের রক্তিম আভা পৃথিবীর কোলে এসে পৌঁছয় নি। আমরা প্রস্তুত হ'য়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। লাল রাস্তার দু'পাশের শিশিরে ভেজা সবুজ ঘাসের রেখা যেন রাস্তাটির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাদের সঙ্গে চল্তে সুরু কর্ল। কালকের রাতের শ্রান্তি আজ ভোরের হাওয়ায় যেন কোথায় চ'লে গেল। ক্রমশঃ আশে পাশের, গাছে-ঢাকা বিহঙ্গ-নীড়ের মতো স্নিগ্ধ ও শান্তিপূর্ণ গ্রামগুলি ফেলে রেখে আমরা বর্দ্ধমানের কাছে এসে পড়্লাম। এখানে সেখানে বাগানের দেয়ালে কোথাও বা গাছের গায়ে 'ডিঃ গুপ্ত', 'গেলের পাঁচন' প্রভৃতির বিজ্ঞাপন দেখা যেতে লাগ্ল। ধূমপানরত বৃদ্ধেরা একবার আমাদের দিকে আগ্রহশূন্য-দৃষ্টি নিক্ষেপ ক'রে আবার নিজ-নিজ কাজে গভীর মনঃসংযোগ কর্তে লাগলেন। একটা ছোট পুল পার হ'য়ে আমরা কার্জ্জন গেটের মধ্যে দিয়ে বর্দ্ধমান সহরে প্রবেশ কর্লাম। এক বন্ধুর বাড়ীতে উপস্থিত হ'য়ে তাকে যথেষ্ট বিস্মিত ক'রে তুলেছিলাম। এত ভোরে এরূপ অভিনব বেশে হঠাৎ আমাদের আবির্ভাবের কারণের উত্তরে শুধু 'Surprise' ছাড়া আর কোন উদ্দেশ্য নাই বুঝিয়ে একখানা বেঞ্চে বসে পড়্লাম, ক্ষিদেটা তখন বেশ রীতিমতভাবেই অস্থির ক'রে তুলেছে। এখানে চা ও মোটা গোছের জল-যোগের পর, গত রাত্রের জাগরণের অবসাদহেতু আজ আর অগ্রসর হওয়া সম্বন্ধে মতদ্বৈধ হ'ল, তখন পকেট থেকে একটা টাকা বের ক'রে তার সাহায্যে ভাগ্য-পরীক্ষা ক'রে দেখা গেল। আজ এখানে থাকার দলেরই জিৎ হ'য়েছে। সুতরাং কাছেই নিরঙ্কর মামা শ্রীযুক্ত অতুলচন্দ্র ঘোষ মহাশয়ের বাড়ী থাকায় সেখানে গিয়ে ওঠা গেল।
গুরুতর আহার ও রীতিমত বিশ্রামের পর সাইকেল পরিষ্কার ক'রে সন্ধ্যার আগে সহর দেখ্তে বার হ'লাম। সহর দেখে আমরা ষ্টেশনের দিকে চল্লাম। এখানে নূতন electric installation সুরু হ'য়েছে দেখা গেল। ষ্টেশনে নিরঙ্ক চিঠি লিখে আসানসোলে আমাদের থাকার বন্দোবস্ত ক'রে তার নিজের কর্ত্তব্য শেষ কর্লে। সকলের কৌতুহল-দৃষ্টি এড়িয়ে ও উপর্য্যুপরি প্রশ্নের যথা সম্ভব উত্তর দিয়ে বাড়ী ফির্তে রাত ন'টা হ'ল। খাওয়া-দাওয়ার পর আমরা গত রাত্রের রাত্রিজাগরণের অবসাদটুকু পুষিয়ে নেওয়ার জন্যে বিনা বাক্যব্যয়ে শুয়ে পড়্লাম। আজ ৮ মাইল এলাম। কলকাতা থেকে মোট ৭৩ মাইল আসা হ'ল।
২৪ শে সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার - রওনা হতে ৫টা বাজল। ষ্টেশনের পাশ দিয়ে গ্র্যান্ড-ট্রাঙ্ক রোড ধ'রে আসানসোলের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হ'লাম। ফর্সা হ'য়ে এল; রাস্তাটির বাঁদিকে ধান ক্ষেতের ওপারে দূরে কতগুলি সাদা মন্দিরের চূড়া দেখা গেল। খানিক দূর যাওয়ার পর অশোকের সাইকেলের ফ্রি হুইল একটু গোলমাল সুরু কর্লে। বাহনের ডাক্তার আনন্দর তখন ডাক পড়্ল। মিনিট দশেক কস্রতের পর সেটাকে ঠিক ক'রে আবার চল্লাম। চন্চনে রোদে তেষ্টা পেতে গলসি থানায় নেমে জল খেলাম। থানায় দু'একটী কনেষ্টবল ছাড়া আর কেউ নেই। জিজ্ঞাসা ক'রে জানা গেল ইন্স্পেক্টার-বাবুরা সদলবলে বেলজিয়ামের রাজদম্পতির প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য লাইনের ধারে সারবন্দী হ'য়ে পাহারা দিতে গেছেন। পর পর বারখানি ওভারল্যান্ড মোটর ধূলো উড়িয়ে আমাদের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। ধূলোয় সমস্ত শরীর ভ'রে গেল - এটা ভারী বিরক্তিকর। কে জান্ত তখন এই অসুবিধাটুকু অল্পবিস্তর রোজই ভোগ কর্তে হবে।
রাস্তার রং গেরিমাটির মতো লাল হ'তে সুরু হ'য়েছে। রেলের লাইনটি ক্রমশঃ স'রে আস্তে আস্তে একবারে রাস্তা ডিঙিয়ে পাশে পাশে চল্ল। বাঁ দিকে পানাগড় ষ্টেশন। দূরে ডান দিকে কাঁসর ঘন্টার বাজনা শুনে আজ যে সপ্তমী পূজা, মনে পড়ে গেল। বেলা প্রায় সাড়ে ন'টা। পূজাবাড়ীতে এ বেলার মতো আতিথ্য গ্রহণ করা সকলের ইচ্ছা হওয়াতে আমরা একটা কাঁচা রাস্তা ধ'রে প্রায় মাইলখানেক যাওয়ার পর কাঁকসা গ্রামের মধ্যে পূজাবাড়ীতে পৌঁছলাম। এ রকম নূতন ধরণের অতিথিদের অভ্যর্থনা কর্বার জন্য বাড়ীর কর্ত্তারা মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না। এত কষ্ট স্বীকার ক'রে আমাদের দেশ ভ্রমণে যাওয়ার অর্থ, যখন তাদের যথাসাধ্য চেষ্টা ক'রেও বোঝাতে না পেরে একটু অপ্রস্তুত হ'য়ে পড়েছি, বাড়ীর ছেলেরা তখন বেরিয়ে এসে আমাদের এই সঙ্কটাপন্ন অবস্থা থেকে উদ্ধার কর্লেন। তাঁরা আমাদের পোষাক ও সাইকেলের সরঞ্জাম দেখেই সমস্ত বুঝতে পেরেছিলেন ও বাইরের একখানা ঘরে আমাদের বিশ্রামের ব্যবস্থা ক'রে দিলেন। আমরা পোষাক ছেড়ে লুঙ্গি প'রে চান কর্বার বন্দোবস্ত কর্তে লাগলাম। কর্ত্তারা একেই আমাদের সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছিলেন তার ওপর যখন লুঙ্গি প'রে আমরা পুকুরে চান কর্তে গেলাম, তখন বৃদ্ধ পুরুত মশায়ের সঘন দৃষ্টিপাত জানিয়ে দিল যে আমাদের এরূপ ম্লেচ্ছ-আচরণ তিনি বরদাস্ত কর্তে পার্ছেন না। কিন্তু আমরা তাতে নাচার। পরে সে দিন রাস্তায় আমাদের অনেক কষ্ট পেতে হয়েছিল। তখন বলাবলি করেছিলাম বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের অভিশাপের ফল না কি!
বেলা তিনটার পর রোদের ঝাঁঝ কম্লে আমরা বেরুলাম। বাঁ দিকে দূরে অস্পষ্ট পাহাড় দেখা গেল। অবেলায় খাওয়ার জন্য বড় আলস্য বোধ হ'তে লাগ্ল। মন্থর গতিতে চলেছি, সাম্নে থেকে একটা গরুর গাড়ী এসে আমাদের পাশে উপস্থিত হ'ল। গরু দু'টির রকম দেখে বোঝা গেল তারা আমাদের মানুষ ছাড়া, অন্য কোন জীব ঠাউরেছে। তিন জন পর-পর পাশ কাটিয়ে চ'লে যাওয়ার পর গরু দুটি ভয় পেয়ে হঠাৎ একেবারে ঘুরে মাঠে নেমে পড়্ল, আর সেই সঙ্গে আনন্দর সাইকেলের সাম্নের চাকা গরুর গাড়ীর পিছনের সঙ্গে ধাক্কা লেগে এমন বেঁকে গেল যে সাইকেল একেবারে অচল হ'য়ে পড়ল। তখন বেলা পাঁচটা - আসানসোল আটাশ মাইল দূরে - এরূপ দুর্ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। সাইকেলের রিমের এরকম অবস্থা দেখে ভারী মুস্কিলে পড়লাম। কারণ এ-কে মেরামত কর্তে যে সরঞ্জামের দরকার তা সাইকেলে ব'য়ে আনা সম্ভবপর নয়, কাজেই আমাদের সঙ্গে তা ছিল না। যাই হোক কোন উপায় না দেখে আমরা বিনা সরঞ্জামে যতদূর সম্ভব মেরামতের চেষ্টা ক'রে অকৃতকার্য্য হ'য়ে যখন ট্রেণে সাইকেলখানিকে পাঠাবার জন্য ষ্টেশনের খোঁজে কাছের এক গ্রামে যাওয়ার আয়োজন কর্ছি, তখন হঠাৎ বর্দ্ধমানের দিক থেকে একখানা মোটর লরী আস্ছে দেখ্তে পেলাম। কাছে এলে তাকে ইসারা ক'রে থামান গেল। গাড়িখানি নূতন। কলকাতা থেকে কিনে মোটর সার্ভিসের জন্য বরাবর পাঞ্জাবে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের নিজের অবস্থা বুঝিয়ে তাদের সঙ্গে একটা রফা ক'রে, সাইকেল শুদ্ধ আনন্দকে ঐ লরীতে আসানসোলে পাঠানর ব্যবস্থা করা গেল।
যখন তিন জনে সব হ্যাঙ্গাম মিটিয়ে সাইকেলে উঠ্লাম তখন সন্ধ্যা হয় হয়। মাইল দুই আসার পর যখন দুর্গাপুরের জঙ্গলে ঢুক্লাম তখন বেশ অন্ধকার হ'য়ে গেছে। আলো জ্বাল্তে হ'ল। রাস্তাটি হটাৎ ঢালু হ'য়ে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে চলেছে। দু'পাশে বড় বড় গাছ দৈত্যের মতো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। সমস্ত নিস্তব্ধ, কেবল সাইকেলের সোঁ সোঁ শব্দ যেন এই নিস্তব্ধতায় আরও বেড়ে উঠ্ল। অন্যমনস্ক হ'য়ে ঢালু রাস্তায় পর পর তিন জন চলেছি, কতক্ষণ তা মনে নেই। চমক ভাঙ্ল যখন দেখি আমরা পরস্পরের ঘাড়ের উপর। ধূলো ঝেড়ে উঠে দেখি সাইকেল তিনখানি তিন জায়গায় প'ড়ে ঘুর্ছে। হঠাৎ এ বিপত্তির কারণ আর কিছু নয়, রাস্তা মেরামত হওয়ার দরুণ বড় বড় গাছের গুঁড়ি ও ডাল-পালা-ফেলা বন্ধ রাস্তার ওপরে সাইকেল ক'রে যাবার আমাদের অন্যায় চেষ্টা! পরে আরও অনেক জায়গায় দেখেছিলাম P.W.D, No Throughfare এর নোটিশ এমনি ক'রেই দেয়।
জঙ্গল পার হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে রাস্তা খারাপ ও উঁচু নীচু হতে সুরু হ'ল। দু'পাশে অন্ধকার ঢাকা মাঠে এখানে সেখানে কয়লা-স্তূপের আগুনের অস্পষ্ট আলোয় কুলীরা জটলা কর্ছে। থেকে থেকে তাদের মাদলের বাজনা শোনা যাচ্ছে। বুঝ্তে পার্লাম আমরা কয়লা খনির দেশে এসে পড়েছি। ক্রমশঃ চাঁদের ক্ষীণ আলো দেখা দিল। অণ্ডাল ছাড়িয়ে রাণীগঞ্জে চা খেয়ে নেওয়া যাবে মনে কর্লাম্ কিন্তু রাস্তা থেকে ষ্টেশন পাঁচ ছ' মাইল দূর শুনে একেবারে আসানসোলের দিকে পাড়ি দিলাম। আসানসোলের কয়েক মাইল দূর থেকে Colliery (কোলিয়ারির) সাহেবদের মোটরের চোখ-ঝল্সান আলো আমাদের ব্যতিব্যস্ত ক'রে তুল্লে। অশোকের সাইকেলের ফ্রি হুইল আবার গোলমাল সুরু কর্লে। বোঝা গেল আসানসোলে রীতিমত সংস্কার না কর্লে এর দ্বারা আর কাজ চল্বে না। কাঁকসা থেকে বেরিয়ে অবধি একটা না হাঙ্গাম লেগেই রয়েচে। মিউনিসিপ্যালিটি ও ষ্টেশনের আলো দেখ্তে দেখ্তে, আমরা পিচ দেওয়া রাস্তা দিয়ে সহরের মধ্যে এসে পড়লাম। তখন রাত দশটা। রাস্তার ওপরে এক সাইকেলের দোকানে আনন্দকে দেখে আমরা নেমে পড়্লাম। সাইকেল মেরামত আরম্ভ হ'য়ে গেছে দেখে বর্দ্ধমানের বন্দোবস্ত-অনুযায়ী নিরঙ্কর আত্মীয় শ্রীযুক্ত অতুলকৃষ্ণ বসুর বাড়ীতে আশ্রয় নিলাম। সমস্ত দিন হায়রানের পর কয়েক পেয়ালা চা অমৃতের মতো মনে হ'ল।
আজ ৬৬ মাইল আসা গেছে। কলকাতা থেকে মোট ১৩৯ মাইল আসা হ'ল।
২৫শে সেপ্টেম্বর শুক্রবার - সকালে উঠে চা খেতে ন'টা বাজ্ল। মিস্ত্রীকে তাড়া দেবার জন্য সকলে তার দোকানে উপস্থিত হ'লাম। এসে শুন্লাম সামনের ফর্কটি (Fork) আর না বদল কর্লে চল্বে না। কাল রাত্রে দেখ্তে পাই নি, আজ দেখে বুঝতে পার্লাম মিস্ত্রীর কথাই ঠিক। গাড়ীটির Fork (ফর্ক) ও একখানা mud guard (মাড্ গার্ড) বদল আর Rim (রিম্) মেরামত করা হ'ল। বলা বাহুল্য এখানে এ সবের দাম ক'লকাতার দ্বিগুণ।
এইসব হ্যাঙ্গাম মিটিয়ে ফির্তে প্রায় বারটা বাজ্ল। খাওয়া-দাওয়ার পর বেরুতে বেলা সাড়ে তিনটা হ'ল। সহরের ভেতর দিয়ে আমরা চলেছি। বাঁদিকে সারি সারি দোকান ও ডান দিকে বরাবর রেলওয়ে কর্ম্মচারীদের পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন কোয়ার্টার ছাড়িয়ে আমরা বি, এন, আর পুলের ওপর উঠ্লাম; নীচে দিয়ে লাইনটি আদ্রার দিকে চ'লে গেছে। বাংলার দৃশ্য এখানে একেবারে বদ্লে গেল। দূরে ছোট পাহাড় আর তাদের পায়ের নীচে ধানে-ভরা সবুজ ক্ষেত। ঘাসে মোড়া উঁচু নীচু মাঠের ওপর দিয়ে লাইনটি ক্রমশঃ অদৃশ্য হ'য়ে যাচ্ছে। রাস্তাটিও সঙ্গে-সঙ্গে ঢেউয়ের মতো একবার উঁচু একবার নীচু হ'য়ে চল্ল। এরকম রাস্তায় সাইকেল চালান ভারী কষ্টকর। ওপরে ওঠবার সময় সাইকেল সবচেয়ে উঁচু জায়গাটীর কাছ পর্য্যন্ত এসে একেবারে থেমে পড়ে। নাম্বার সময় অবশ্য খুব আরাম কিন্তু লাভ লোকসান খতিয়ে দেখলে লোকসানের ভাগই বেশী। সীতারামপুরের কাছে নিয়ামতপুরে এসে জল খাওয়ার জন্য নাম্তে হ'ল। একে এ রকম রাস্তা তার ওপর রোদের ঠেলায় প্রাণ অস্থির। বেলা সাড়ে পাঁচটার সময় আকাশে মেঘ জম্তে সুরু কর্ল। কুলটির কাছে যখন এলাম মেঘে আকাশ ছেয়ে ফেলেছে - ঠাণ্ডা বাতাসও বইছে। বড় সুবিধা বোধ হ'ল না। আমাদের বরাকর পৌছানর কথা ছিল। সে প্রোগ্রাম বদ্লে কুল্টীতে রাত কাটাবার বন্দোবস্ত করা হ'ল। রাস্তার উপরে ডানদিকে কুলটী কারখানার (Kulti Iron Works) সাহেবদের লাইন বন্দি বাঙ্গলো। এখানকার মেডিক্যাল অফিসার ডাক্তার রায়ের নাম আমরা আগেই শুনেছিলাম। ইনি খেলা-ধূলার বিশেষ উৎসাহী ও টুরিষ্টদের উপর এঁর বিশেষ সহানুভূতি আছে। এঁর বাঙ্গলো খুঁজে পেতে বিশেষ অসুবিধা হলো না। আমাদের দেখে খুব খুসী হলেন। পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমাদের থাক্বার বন্দোবস্ত হ'য়ে গেল।
আজ মহাষ্টমী। এখানকার বাঙ্গালী ভদ্রলোকের প্রতি বৎসর দুর্গোৎসব করেন। সহরটি খুব ছোট জায়গা - কারখানাটিকে উপলক্ষ্য ক'রে সহরটি গ'ড়ে উঠেছে। সহরের দৃশ্য বেশ মনোরম। রাস্তায় বিজলীবাতি ও জলের কলেরও অভাব নাই। শ্রান্ত হ'য়ে সহরের বাইরে খোলা মাঠে এসে বস্লাম। পাতলা কুয়াসার জাল ছিঁড়ে চাঁদের আলো সহরটিকে ঘিরে ফেলেছে।
আজ ৯ মাইল এগিয়েছি, কল্কাতা থেকে ১৪৮ মাইল আসা হ'ল।
- ক্রমশঃ -
(প্রবাসী, শ্রাবণ ১৩৩৩ সংখ্যা)
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ হিতেশরঞ্জন সান্যাল মেমোরিয়াল আর্কাইভ
[ মূলের বানান ও বিন্যাস অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। - সম্পাদক ]