চলতে চলতে গোয়েচা লা
অভিষেক মারিক
~ জোংরি-গোয়েচা লা ট্রেকরুট ম্যাপ ~ জোংরি-গোয়েচা লা ট্রেকের আরও ছবি ~
"কাল সে তো দৌড়না পড়েগা।"
স্বভাবসুলভ ভঙ্গীতে মুখজোড়া হাসি ছড়িয়ে কথাগুলো বলল সাওয়ান। আমরা যথারীতি কোনও পাত্তা দিলাম না। সাওয়ান ওরকমই এতদিনে আমরা বুঝে গেছি। ঠাট্টাতামাসা করেই যাচ্ছে সবার সঙ্গে। সতের বছরের পাহাড়ি ছেলেটা খুব সহজেই এতগুলো অচেনা অসমবয়সী লোকেদের সঙ্গে মিশে গেছে।
আজ আমাদের ট্রেকের অষ্টম দিন। কোকচুরাং থেকে শোকা যাওয়ার এই পথ প্রায় ১০ কিলোমিটারের অবরোহণ। কর্দমাক্ত পিচ্ছিল পাহাড়ি পথে মাঝে মধ্যেই ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছি। গত সাতদিনে এরকম রাস্তা আর কোথাও পাইনি। এতটা পথ পেরিয়ে আজকে তাই প্রথমবার বিরক্ত লাগছে। যত তাড়াতাড়ি পৌঁছানো যায় এই আশাতে জোরে হাঁটতে শুরু করে টাল সামলাতে না পেরে দুই-তিন বার আছাড়ও খেলাম।
কলেজে পড়ার সময় থেকেই সিকিমের গোয়েচা লা যাওয়ার স্বপ্ন আমাকে পেয়ে বসেছিল। গত কয়েক বছর ধরে যখন বন্ধুদের বলে কয়েও চিঁড়ে ভিজল না, তখন বুঝলাম "যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।" কিন্তু এই ট্রেকে একলা চলতে গেলে পকেট গড়ের মাঠ হয়ে যাওয়ার চান্স। তাই ইন্টারনেটে অনেক গবেষণা করে একটি নামজাদা ট্রেকিং এজেন্সির সঙ্গে শরতের পেঁজা মেঘেদের সাথী করে নেমে পড়লাম গোয়েচা লা-র পথে। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে ট্রেকের বেসক্যাম্প ইয়ুকসামে যখন পৌঁছলাম ততক্ষণে সূয্যিমামা পাহাড়ের কোলে ঢলে পড়েছেন। একদা সিকিমের রাজধানী ছিল পশ্চিম সিকিমের এই ছোট্ট নিরিবিলি শহর। শহরের প্রবেশপথেই সুন্দর বৌদ্ধ মঠ ও প্রার্থনা পতাকাবেষ্টিত মায়াবী হ্রদ মন ভালো করে দেয়।
ইয়ুকসামের হোমস্টেতে ট্রেক গাইড তাশি আমাদের অভ্যর্থনা জানাল। বছর তেইশের লম্বা ছিপছিপে নেপালি যুবক তাশি মুখে ছদ্ম গাম্ভীর্য নিয়ে কথা বললেও তার চোখের কোণে এক চিলতে হাসি। বাঙালি, মারাঠি, তেলেগু, আফ্রিকান, ফরাসী ও দিল্লীবাসী সহযোগে আমাদের সতেরো-জনের যাত্রীদল যেন এক ছোট্ট বিশ্ব। নৈশাহারের পর তাশি যখন ট্রেকের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিচ্ছিল, দেহে মনে এক রোমাঞ্চ অনুভব করলাম। পরের দিন থেকে সেই স্বপ্নযাত্রার শুরু!
সেদিন রাতে উত্তেজনায় ঠিকমত ঘুম হল না। আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই উঠে পড়লাম। মনোময় আকাশ মাথায় করে দাঁড়িয়ে আছে ঝলমলে হিমালয়। আবার ভালবেসে ফেললাম এই হাজার হাজার বছরের পুরনো বুড়োটাকে। সকাল নটা নাগাদ প্রাতরাশের পরে শুরু হল পথ চলা। গুগুল, হোয়াটস্অ্যাপ, ফেসবুকের ধরাছোঁয়ার বাইরে ন'দিনের অন্য এক জীবন। পাকদণ্ডী বেয়ে ধীরে ধীরে উঠে চললাম আমরা – সতেরজন নগরবাসী, তাশি ও তার সঙ্গে দশজনের সহকারী দল এবং মালবহনকারী কিছু টাট্টু ঘোড়া। ঘন চিরহরিৎ জঙ্গলের আকাশচুম্বী গাছের পাতার ফাঁকের নীলাকাশের নকশা, পাহাড়ি অজানা পাখির কিচির-মিচির ডাকে গাছের ডালে লুকোচুরি খেলা, সন্নিকটে বয়ে চলা আপাত অদৃশ্য প্রেকচু নদীর গর্জন, ভিজে মাটি ও বন্য ঝরাপাতার মাতাল গন্ধ – আদিম জগতের এক দ্বার খুলে দিল কাঞ্চনজঙ্ঘা জাতীয় উদ্যান।
সারা পথ জুড়ে অজস্র বরফশীতল ঝোরা। তিনটে সুদৃশ্য ঝুলন্ত ব্রিজ পেরিয়ে চড়াই-উৎরাই বেয়ে সেদিনের ক্যাম্পসাইট সাচেন পৌঁছাতে একটা বেজে গেছিল। ইয়ুক্সাম থেকে আট কিমি দূরে সাত হাজার ফিট উচ্চতার সাচেনের কোনও নৈসর্গিক দৃশ্য উপস্থাপনের দায় নেই। চারদিকে গভীর জঙ্গলে ঘেরা বলে দিনের বেলাতেও আঁধারময় ও স্যাঁতস্যাঁতে। কিন্তু তাশি জানাল পরবর্তী ক্যাম্প দশ কিমি দূরে। সাচেনে ক্যাম্প না হলে একদিনে আমাদের আঠেরো কিমি পথ পাড়ি দিতে হত যা আমাদের পক্ষে কষ্টকর ও ক্ষতিকারকও। অলস সময় পরস্পরের মধ্যে আলাপচারিতা ও উনো কার্ডের আসরে কেটে গেল। দিনের শেষে ডিনার করে যখন আমরা যে যার টেন্টের ভেতর স্লিপিং ব্যাগে সিঁধলাম তখন সবে সন্ধ্যা সাতটা।
সকাল ছ'টা না বাজতে বাজতেই টেন্টের বাইরে হট্টগোল। ঘুমমাখা চোখে বাইরে উঁকি মেরে দেখি একটা রোগা-পাতলা স্পাইক হেয়ারকাট মারা ছেলে ও তার সঙ্গে বছর পঁচিশের বুদ্ধিদীপ্ত স্বাস্থ্যবান এক যুবক মহোৎসাহে প্রতি টেন্টে গিয়ে সবাইকে জোর করে ঘুম থেকে তুলে গরম গরম চা পরিবেশন করছিল। সাওয়ান ও বুদ্ধা। এলাচ-আদার তৃপ্তিদায়ক চা দেহটাকে চাঙ্গা করে তুলল। এক প্লেট পোহা উদরস্থ করে সকাল আটটার মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম। প্রায় দুই কিলোমিটার অল্প বিস্তর ওঠানামার পরে সামনে দেখা দিল খরস্রোতা প্রেকচু নদী যদিও হাতের নাগালের বাইরে। যে পাহাড়কে দুভাগে চিরে প্রেকচু গর্জন করতে করতে ফেনিল ধারায় বয়ে গেছে সেই পাহাড়দুটোকে যুক্ত করেছে কংক্রিটের এক ঝুলন্ত ব্রিজ। ঠাণ্ডা হাওয়াতে পত্ পত্ করে ডানা মেলে উড়তে থাকা বাহারি তিব্বতি প্রেয়ারফ্ল্যাগে মোড়া এই সেতু এতটাই মনোরম যে পঁয়তাল্লিশ মিনিট কোথা দিয়ে বয়ে গেল ঠাহর করতে পারলাম না।
তাশি জানাল ব্রিজের পরে দুদিন টানা চড়াই। তাই সবাই যেন ধীরে সুস্থে আপন সুবিধানুসারে ওপরে ওঠে। তা নাহলে ক্লান্তি আসবে, মাউন্টেন সিক্নেস্ হওয়ার প্রবল চান্স। তাশির কথা শিরোধার্য করে আমরা এগিয়ে চললাম শম্বুক গতিতে। আকাশে মেঘের আনাগোনা অনেক বেড়ে গেছে। চলতে চলতে বাখিম নামক এক জায়গাতে যখন পৌঁছলাম তখন ঘড়ির কাঁটা বারো ছুঁইছুঁই। বাখিম গ্রামের পরিধি দু-তিনটে ছোট বাড়ি ও একটা টী-স্টলেই সীমাবদ্ধ। ধোঁয়া ওঠা গরম ম্যাগি দিয়ে পথ চলার রশদ যোগাতে যোগাতে দেখলাম ধূসর মেঘ সারা উপত্যকা ঢেকে ফেলল।
দু'কিলোমিটার চড়াইয়ের পরে পৌঁছলাম শোকাতে। চারদিকে সুউচ্চ চিরহরিৎ গাছের সারির মধ্যে শোকা একটা উন্মুক্ত অঞ্চল। মিলন, আমাদের সাপোর্ট স্টাফের একজন, বলল এত মেঘ না থাকলে চারদিকে পাহাড়ের মেলা দেখা যেত। শোকাতে ঠাণ্ডা অনেকটাই বেড়ে গেছে, হাওয়াও চলছে ভালো। সাচেনের মত আর্দ্রতা এখানে নেই। কিন্তু মেঘগুলো যেন পেছন ছাড়ছে না! এখানে যা কিছু কুঁড়েঘর বা টেন্ট আছে সবকিছুই ট্রেকিংয়ের জন্য। কাঞ্চনজঙ্ঘা জাতীয় উদ্যানে তাছাড়া সাধারণ মানুষের বসবাসের অনুমতি নেই। কিন্তু তার মাঝেও একটা সুন্দর বৌদ্ধমঠ ছোট্ট এক পুকুরের ধারে মাথা তুলেছে। তাশির কাছে পরে জেনেছিলাম 'শো' শব্দের অর্থ ছোট ও 'কা' শব্দের অর্থ পুকুর। সেই পুকুরের ওপরে ফুটে ওঠা মঠ-মেঘ-আকাশ-গাছের সম্মিলিত মায়াবী প্রতিবিম্ব দেখলে মনে হয় নামটা সত্যিই সার্থক। শুকনো ধূপের গোছা কেউ মঠের দরজায় জ্বালিয়ে দিয়েছিল। অচেনা ভালোলাগার গন্ধে মনটা ভরে গেল। ধর্মাচারে বিশ্বাস না থাকলেও ভগবানকে সাক্ষী রেখে বললাম "বেহায়া সব মেঘের দল, এবার তোরা উড়ে চল।"
মঠ থেকে ক্যাম্পসাইটে ফেরার সময়ে শুনলাম কয়েকজন উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করছে। এগিয়ে গিয়ে দেখি আমাদের টেন্টের ঠিক পেছনে নীল আকাশে মাথা তুলেছে পান্ডিম, কাবুরু ইত্যাদি শৃঙ্গরা। দিনের শেষে পড়ন্ত আলোতে জ্বলন্ত পাহাড় অবর্ণনীয়। মঠের দিকে তাকিয়ে মন থেকে বললাম "ধন্যবাদ।"
"ফেদং আ গয়া"।
অস্ট্রেলিয়ানিবাসী সত্যজিতের কথায় আগের দিনগুলোর স্মৃতির জাল ছিঁড়ে বর্তমানে এসে পৌঁছলাম। ভাবতে ভাবতে কখন যে আধা রাস্তা নেমে এসেছি খেয়াল নেই। ফেদংয়ে কোনও জনবসতি নেই। খোলামেলা এই জায়গা শুধুমাত্র বিশ্রাম নেওয়ার জন্য। জোংরি, কোকচুরাং ও শোকা – এই তিন জায়গা থেকে তিনটে পথ এসে একসাথে মেশে। একটু বিশ্রাম নিয়ে এগিয়ে গেলাম শোকার দিকের অবরোহণের পথে। এই রাস্তার নতি অনেকটাই বেশি। কিছুক্ষণ পরে হাঁটু ব্যথা করতে লাগল। মনে পরে গেল এই রাস্তাতেই তৃতীয় দিন এসেছিলাম জোংরি যাওয়ার পথে। সেদিনের কথা ভুলি কি করে!
সেদিন ভগবান মজার খেলা খেলে এক চিলতে পাহাড় দেখিয়ে আমাদের লোভ বাড়িয়ে আবার মেঘের জাল ফেলে দিল। শোকায় সেদিন রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে নেমে এলো ঝিরঝিরে বৃষ্টি। পরের দিন সকালেও একই অবস্থা। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে রওনা দিলাম জোংরির পথে। শোকা থেকে জোংরি প্রায় আট কিলোমিটারের এই পথ খাড়া ওপরে উঠে গেছে। পিঠের রুক্স্যাক, বেহায়া বৃষ্টি আর কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়ায় ওপরে ওঠা আরও কঠিন। যত সামনে এগোলাম বড় গাছের সংখ্যা কমতে লাগল। রডোডেন্ড্রন গাছের যেন মেলা বসে গেল। রডোডেন্ড্রনের এই প্রাচুর্য কাঞ্চনজঙ্ঘা ন্যাশনাল পার্কের বিখ্যাত হওয়ার অন্যতম কারণ। এপ্রিল-মে মাসে এখানে ফুলের জলসা লেগে যায়।
ফেদং পেরিয়ে সেদিন যখন জোংরিতে পৌঁছলাম তখন বেলা তিনটে বাজে। অবিরাম বৃষ্টির মধ্যে টেন্টে থাকার কোনও প্রশ্নই নেই। সবাই মিলে একটা কাঠের কুটিরে মাথা গুঁজলাম। সন্ধ্যাবেলার আড্ডার আসরে জানা গেল পুনেনিবাসী বছর পঞ্চাশের মৃণ্ময়ী-চারুতাদের গানের চর্চা আছে। বসে গেল মারাঠি-বাংলা-হিন্দি গানের আসর। অনেকবার ছুক্ ছুক্ করতে করতে অবশেষে বুদ্ধা এসে ধরল নেপালি গানের মেঠো সুর। গানের জোয়ারে ভেসে গেল দিনের সব ক্লান্তি।
ভোর ছটা নাগাদ উঠে দেখি বৃষ্টি থেমে আকাশ অনেকটা পরিষ্কার। অবিলম্বে জোংরি ভ্রমণাভিযান শুরু। প্রায় তেরো হাজার ফিট উচ্চতায় জোংরি বিশাল এক মিডো (meadow)। অসংখ্য ধূপ-গাছের ঝোপে ভরা ও ছোট-বড় পাহাড়ি ঝোরায় ঘেরা জোংরি রৌদ্রছায়ায় অপার্থিব হয়ে উঠেছিল। ৩৬০ ডিগ্রী ভিউ পাওয়ার জন্য যতক্ষণে জোংরি টপে (জোংরির সবচেয়ে উঁচু স্থান, উচ্চতা – ১৩,৬৭৫ ফিট) উঠলাম ততক্ষণে আবার মেঘের পর্দা ঢেকে ফেলল তুষারধবল শৃঙ্গদের মুখ। জোংরি টপে গিয়ে দেখি আমাদেরই দুই সহযাত্রী দক্ষিণ আফ্রিকার বাসিন্দা শেনয়েট ও আয়ালা আগেই ওখানে পৌঁছে গেছে। শেনয়েট ও আয়ালার পাল্লায় পড়ে যেতে হল জোংরির ছোট্ট মনাস্ট্রিতে। এই দিনটায় আমাদের কোনও গন্তব্য নেই। উচ্চতার সঙ্গে পরিবর্তিত আবহাওয়ায় মানিয়ে নিতে আজকে জোংরিতে আমাদের বিশ্রামের দিন। তাই মঠের বাইরে ছোট ছোট বৌদ্ধস্তূপগুলোর পাশে বসেই দিনের অর্ধেক কেটে গেল।
ট্রেকের পঞ্চম দিনে আমরা জোংরি ছেড়ে পা বাড়ালাম পরবর্তী ক্যাম্পসাইট থানসিংয়ের পথে। আকাশ জুড়ে আজও ছড়িয়ে আছে মেঘেদের ঘরবাড়ি। এদিন সকাল সকাল জোংরি টপ থেকে সূর্যোদয় দেখার প্ল্যানও ভেস্তে গেছিল একারণে। থানসিং ও জোংরি সমুদ্রপৃষ্ঠের থেকে প্রায় একই উচ্চতায় হলেও দশ কিলোমিটারের ওঠানামার পথ। জোংরির সুবিশাল চারণভূমির মধ্যে দিয়ে আমরা হেঁটে চললাম। চলার পথে দেখা পেলাম বরফগলা জলের স্নিগ্ধ হ্রদ লক্ষ্মী-তালের। আকাশে মেঘ থাকলেও এদিনের নিসর্গ সত্যিই মাতাল করে দেয়। জোংরি থেকে প্রায় ছ'কিমি অবরোহণের পথে চলে পৌঁছলাম কোকচুরাং। এই সেই কোকচুরাং যেখানে সপ্তম-দিনে ফেরার পথে এসে থাকব। উন্মাদ প্রেকচু এই প্রথমবার হাতের ছোঁয়ার মধ্যে। আকাশের মেঘ নিচে নেমে এসে এখানে এক রহস্যময় আবহাওয়া সৃষ্টি করেছে। কাঠের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি দু'তিনটে ছোট ছোট সেতু নদী অতিক্রম করার একমাত্র পথ। এই দিকের পাহাড়ের রূপ কিছুটা আলাদা। রডোডেন্ড্রনের সাম্রাজ্য এখানে নেই বললেই চলে। তার বদলে স্থান করে নিয়েছে লাল-হলুদ পাতার কিছু শ্যাওলা ও গুল্মজাতীয় গাছ। মাঝে মাঝে গাঢ় নীলের ছোঁয়াও চোখে পরে। আমার জ্ঞানের পরিধির বাইরে এই সব গাছের নাম। সারা পথ ধরে প্রেকচু আমাদের ডানদিকে বয়ে চলেছে। মাঝে মাঝে মেঠো পথে কাটাকুটি খেলে জলের ধারারা প্রেকচুতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
থানসিংকে একটা বিশাল খেলার মাঠ বললেও অত্যুক্তি হয় না। চারদিকে হঠাৎ মাথা তোলা হাজার ফুটের দেওয়ালরূপী পর্বতের মাঝে সবুজ ঘাসে ভরা চারণভূমি। এখানে পৌঁছে লাঞ্চ শেষ করেই কেউ আর ক্রিকেট খেলার লোভ সম্বরণ করতে পারল না। প্লাস্টিকের গোলা ও কাঠের পাটাতন দিয়ে শুরু হয়ে গেল 'ভ্যালি ক্রিকেট'-এর আসর। সন্ধ্যাবেলার স্যুপ খেতে খেতে সবাই মিলে তাশিকে ধরলাম তার পর্বত অভিযানের গল্প বলতে। তাশি একের পর এক তার মাউন্টেনিয়ারিং কোর্স করার গল্প, প্রথম সামিটের অভিজ্ঞতা, ট্রেকিং জীবনের স্মৃতি বলে গেল আর আমরা দৈনন্দিন গতে বাঁধা জীবনের গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসানো মানুষেরা গোগ্রাসে সেগুলো গিললাম। মনটা আলাদা রকম ভালোলাগায় ভরে গেল।
পরেরদিন লামুনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হল দুপুরের পরে। সকালের দিকে আকাশ পরিষ্কার থাকলেও ন'টা বাজতে না বাজতেই থান্সিং সাদা মেঘে ঢেকে গেছিল। লামুনে থান্সিং থেকে চার কিমি দূরে মাউন্ট পান্ডিমের পাদদেশে অবস্থিত। উপত্যকার মধ্যে দিয়ে প্রায় সমতল পথ বলে পৌঁছাতে মাত্র এক ঘণ্টা মত লাগল। চারদিকের বরফ-ঢাকা শৃঙ্গের মাঝে এই ক্যাম্প-সাইটে কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া হাড় কাঁপিয়ে দেয়। পাহাড় থেকে উপত্যকার দিকে বয়ে চলা এই ঠাণ্ডা হাওয়াই আবার শাপে বর হল। অবাধ্য মেঘগুলোও উড়ে গেল তার সঙ্গে। তখনও সূর্যাস্তের একঘণ্টা বাকি। কেউ যেন পাহাড়গুলোতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। চোখ ঝলসানো এই রূপ দেখে আমরা সবাই হতবাক।
...
চিন্তায় ডুবে যাওয়ার জন্যই হোক বা অতিরিক্ত চলার পরে হাঁটুর ব্যথাটার জন্যই হোক – চলতে চলতে হঠাৎ হড়কে গেলাম।
'আরে, সামলে চল। এখানে তো আর কাদা নেই রে! পড়ে গেলি কি করে?'
দেখি কলকাতার জুপিটারদা একটু পিছন থেকে নেমে আসছে। কী উত্তর দেব ভেবে না পেয়ে বোকার মত হাসলাম। তাড়াতাড়ি উঠে গা-হাত-পা ঝাড়লাম।
'আর একটুখানি! ওই দেখ শোকা দেখা যাচ্ছে।'
সত্যি তো! পাহাড়ের ওপর থেকে লিলিপুটের দেশের মত ফুটে উঠেছে শোকার মঠ, ছোট জলাশয় ও ট্রেকার্স হাটগুলো। আধঘণ্টা ধীরে ধীরে হেঁটে পৌঁছলাম শোকার ক্যাম্প-সাইটে। বাকি সবাই আসতে আসতে বিকেল হয়ে গেল। সন্ধ্যাবেলা শুরু হল ডাম্ব-শারাডের খেলা। টেন্টগুলোর পাশে ট্রেকার্স হাটে আমরা খেলছিলাম। হঠাৎ তাশিরা আমাদের জোর করে বাইরে বের করে দরজা জানলা বন্ধ করে দিল। কৃত্রিম ফতোয়া জারি করে বলল আমরা যেন ভেতরে না ঢুকি যতক্ষণ না পারমিশন দেওয়া হয়। আধঘণ্টা পরে আমাদের ভেতরে ডাকা হল। যা দেখলাম তা অভাবনীয়। তাশিরা মোমের আলোতে সারা কটেজ ভরিয়ে দিয়েছে। টেবিল জুড়ে সাজানো হয়েছে রকমারি খাবার – পাহাড়ের ওই উচ্চতায় কি করে বানাল ওরা! তাদের মধ্যে সবচেয়ে অকল্পনীয় হল এক চকোলেট কেক গোলাপি–সাদা ক্রিম দিয়ে সাজানো। আমাদের সার্থকভাবে গোয়েচা লা পৌঁছানোর জন্য ট্রেক কোম্পানির তরফ থেকে উপহার।
চোখের সামনে আগের দিনটা আবার ঝলসে উঠল। সত্যি তো! এই তো কালকেই আমরা গোয়েচা লা দেখে এলাম। লামুনেতে পরশুদিন সূর্যাস্তের পরে আমরা নৈশাহার করে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিলাম। পরেরদিন দীর্ঘ পথের যাত্রা। সূর্য ওঠার আগে গোয়েচা লা যেতে হবে এবং তারপর লামুনেতে ফিরে লাঞ্চ করে আবার কোকচুরাংয়ের দিকে যেতে হবে। রাত একটা নাগাদ উঠে ফ্রেশ হয়ে দু'টোর মধ্যে বেড়িয়ে পড়তে হল গোয়েচা লার উদ্দেশ্যে। হেড-টর্চের আলোতে অন্ধকারের যাত্রীরা পাহাড়ে যেন অগুন্তি জোনাকির উৎসব শুরু করে দিল। লামুনে থেকে একটু এগিয়ে দেখতে পেলাম চাঁদের আলোয় ফুটে উঠেছে এক হ্রদ – সমিতি লেক। সেদিন ফেরার পথে দিনের আলোয় এই লেকই ছড়াচ্ছিল শতবর্ণের ছটা। লেকের পাশ কেটে চড়াইয়ের পথে এগোতে থাকলাম। এখানে চারদিকের ভূপ্রকৃতি অনেকটা কড়াইয়ের মত। আমরা যেন সেই কড়াইয়ের তলা থেকে ক্রমশ কানার দিকে উঠে চলেছি আর চারদিকে তুষারাবৃত শৃঙ্গের সারি কড়াইয়ের কানার বাইরে থেকে অতন্দ্র প্রহরীর মত আমাদের দিকে চেয়ে আছে। যত ওপরে উঠলাম দূরের তুষারধবল শৃঙ্গগুলো তত এক একটা বিশালকায় দৈত্যের চেহারা নিল।
গোয়েচা লা ভিউপয়েন্টে পৌঁছলাম চারটে নাগাদ। প্রায় সাড়ে পনের হাজার ফিটের উচ্চতায় এই ভিউপয়েন্ট। কাঞ্চনজঙ্ঘা, উত্তর কাবুরু, দক্ষিণ কাবুরু, গোয়েচা ও নাম না জানা আরও অনেক শৃঙ্গ আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, যেন আমাদের জন্যই যুগ-যুগান্তর ধরে অপেক্ষমান। চাঁদের আলোয় নীলচে কাঞ্চনজঙ্ঘা যেন কোন এক স্বপ্নলোকের দেশ। তারপর এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। দিনের প্রথম আলোতে দুধ-সাদা গিরিমালা গেরুয়া রঙের চাদরে গা ঢাকল। উত্তেজনায় সবাই চিৎকার করে উঠলাম। আকাশে আজ এক চিলতে মেঘ নেই। অবশেষে সহায় হল ভগবান। প্রভাতের নরম মিঠে আলোতে হিমালয় যেন হেসেই চলল। ভুবনমনমোহিনী রূপ যেন এতদিনের পথ চলার ক্লান্তি হরণ করল। সারাবিশ্বে ছড়িয়ে থাকা অচেনা অজানা মানুষগুলোর জীবনের এক স্মরণীয় মুহূর্ত এক সুতোয় বেঁধে দিল এই হিমালয়।
...
শোকার এই ছোট্ট হাটে এখন উৎসবের আমেজ। বুদ্ধা নেপালি গান 'রেশম ফিরিরি' ধরেছে। তাশি তার গাম্ভীর্যের মুখোশ খুলে নাচছে। সবাই মিলে গলা মেলালাম, নেচে উঠলাম গানের তালে তালে। সবাই মিলে একসঙ্গে অদ্যই শেষ রজনী। ইয়ুকসামে পৌঁছে আমাদের সহকারী দল আলাদা হয়ে যাবে। তারপরের দিন আমরা আবার ফিরে যাব সমতলের দূষিত দুনিয়ায়। হয়তো আর দেখা হবে না কোনোদিনও। শুধু ফেসবুকের অ্যালবাম বা হোয়াটস্অ্যাপের ছবিগুলো ধরে রাখবে এই সুন্দর মুহূর্তগুলো। বুদ্ধা সুরেলা কণ্ঠে শুরু করল – 'লাগ যা গালে।' মদনমোহনজীর সুরে কালজয়ী সেই গানে আমরাও যোগ দিলাম। প্রেমের গান হলেও এই মুহূর্তে এর চেয়ে যথাযথ আর কি হতে পারে! 'ফির য়ে হসিন রাত হো না হো, সায়দ ফির ইস্ জনম মে মুলাকাত হো না হো!'
~ জোংরি-গোয়েচা লা ট্রেকরুট ম্যাপ ~ জোংরি-গোয়েচা লা ট্রেকের আরও ছবি ~
কলকাতার বাসিন্দা আই টি প্রফেশনাল অভিষেক মারিক ভালোবাসেন বেড়াতে। মূলতঃ ট্রেকিং। ভারতের বিভিন্ন জায়গায় তো বটেই, এমনকী বিদেশেও। নির্জন শান্ত পাহাড়ি পরিবেশ আর সেখানকার সরল মানুষজন তাঁকে আকর্ষণ করে। সেই টানেই বারবার ছুটে যান হিমালয়ে। এর পাশাপাশি স্থানীয় খাবার চেখে দেখতেও তিনি উৎসাহী। খাওয়া ছাড়া বেড়ানোর মানে আছে নাকি?