ইছামতীর তীরে

জ্যোতি প্রকাশ ঘোষ


"বহু দিন ধ'রে বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা,
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশিরবিন্দু।"

কলকাতার ভিড়ে প্রাণবায়ু যেন হাসঁফাস করছিল। কয়েকজন বন্ধু মিলে ঠিক করলাম একদিনের ছুটিতে কোথাও একটু ঘুরে আসব। দীঘা কিংবা বকখালি আর ভালো লাগে না। ক্রমবর্ধমান পর্যটকদের চাপে এরা যেন এদের নিজস্বতা হারিয়ে ফেলেছে। ঠিক করলাম উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার একটি সীমান্তবর্তী গ্রাম বেড়ি পাঁচপোতা ঘুরতে যাব। শিয়ালদহ-বনঁগা লাইনের গোবরডাঙা স্টেশন থেকে মাত্র ১১ কিমি দূরে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী সবুজেঘেরা সুন্দর একটি গ্রাম হল বেড়ি পাঁচপোতা। গ্রামটির বুকের উপর দিয়ে তিরতির করছে ছোট্ট একটি অশ্বখুরাকৃতি হ্রদ, স্থানীয় ভাষায় যাকে বাওর বলা হয়। অনেকদিন আগে এটি ইছামতী নদীর অংশ ছিল। তারপর ইছামতী নদী আস্তে আস্তে দিক পরিবর্তন করে একটু দূরে চলে যাওয়ায় এটি মূল নদী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অশ্বখুরাকৃতি হ্রদে পরিণত হয়েছে। পাঁচপোতার বুকে সুন্দর এই হ্রদ ছাড়াও আশেপাশে আরো কয়েকটি হ্রদ বা বাওর আছে। যেমন ডুমোর বাওর, ঝাউডাঙার বাওর, বলদেঘাটার বাওর ইত্যাদি। এরা যেন সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে বসে আছে নিজ নিজ সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী হয়ে। রূপের ছটায় কেউ কারো কাছে হারতে নারাজ। এ বলে আমি সেরা ও বলে আমি। পর্যটকদের কোন চাপ না থাকায় প্রকৃতিপ্রেমিকদের সেরা গন্তব্য বেড়ি পাঁচপোতা।

একটু সকাল সকাল শিয়ালদা থেকে চেপে বসলাম বনগাঁ লোকালে। ঘন্টা দুয়েকের থেকে একটু কম সময়ের মধ্যে পৌছে গেলাম গোবরডাঙা। সেখান থেকে অটো, বাস বা ট্রেকারে আধ ঘন্টার পথ বেড়ি পাঁচপোতা। এখানে শনি মঙ্গলবার বিরাট হাট বসে। দিনটি শনিবার হওয়াতে প্রথমেই পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখে নিলাম সুবিশাল গ্রাম্য হাটটিকে। প্রায় এক বর্গকিমি এলাকা নিয়ে সীমান্ত এলাকার সব থেকে বড় হাট এটি। দশ থেকে বারোটি গ্রামের প্রয়োজন মেটায় এই হাট। সব্জি থেকে দা-কুড়ুল কিংবা জামা-কাপড় সবই মেলে এখানকার হাটে। এখানকার সব্জি ট্রাকে করে পাড়ি দেয় পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে। চাষীদের সদ্য তুলে আনা সব্জি বিক্রি হচ্ছে এই হাটে।

বাজারের কাছেই অনুকুল ঠাকুরের মন্দির। প্রায় একবিঘা জমির ওপর অবস্থিত মন্দিরটি। পেছনেই বিশাল আমবাগান। মন্দিরদর্শনের পর বাগানের ভিতর দিয়ে এগিয়ে গেলাম বাওরের দিকে। বাওরে পৌঁছে নৌকা ভাড়া করে মুড়ি আর পাঁচপোতার বিখ্যাত তেলেভাজা নিয়ে ভেসে পড়লাম জলে। মাথার ওপর নীল আকাশ আর সামনে নিশ্চল জলরাশি, এ যেন এক স্বর্গীয় অনুভূতি। দেড়-দুঘন্টা যে কী ভাবে কেটে গেল তা বুঝতে পারলাম না। তবে এর থেকে আর বেশি সময় নেওয়া গেল না, এরপর আরও কয়েকটি জায়গা ঘুরতে হবে।

নৌকা থেকে নেমে বাজারে চলে এলাম। বাজারের কাছেই টোটো স্ট্যান্ড। এখান থেকে টোটো নিয়ে চললাম কালাঞ্চী বর্ডার দেখতে। বর্ডারে খাওয়ার কোনও হোটেল নেই। তাই হয় পাঁচপোতা বাজার থেকে খেয়ে যেতে হবে নতুবা বর্ডারে গিয়ে আপনাকে রান্না করে খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সেই জন্য যাওয়ার আগে দুপুরে রান্না করে খাওয়ার জন্য আমরা পাঁচপোতা বাজার থেকে টাটকা আনাজপাতি ও রান্নার অন্যান্য সামগ্রী সংগ্রহ করে টোটোয় তুলে নিলাম। রান্নার জন্য গ্যাস আর প্রয়োজনীয় বাসনপত্র স্থানীয় ডেকরেটর্সের দোকান থেকে ভাড়ায় পেয়ে গেলাম। চাইলে হাটের থেকে দেশি মুরগি কিনে মাংসের দোকান থেকে কাটিয়ে নেওয়া যায়। তবে দেশি মুরগি পেতে গেলে একটু সকাল সকাল আসতে হবে। এছাড়া বাওড়ের সদ্য ধরা টাটকা মাছও বাজারে পাওয়া যায়।

পাঁচপোতা বাজার ছাড়ালে দু-ধারের দৃশ্য আস্তে আস্তে পাল্টে যেতে লাগল। দুপাশে ফাঁকা মাঠ আর মাঝখান দিয়ে পিচঢালা কালো রাস্তা। কিছুদূর যাওয়ার পর পুরন্দরপুর থেকে বাম দিকে পরপর দুটি রাস্তা বর্ডারে চলে গিয়েছে, একটি তেঁতুলবেড়িয়া বর্ডারের দিকে এবং অপরটি কালাঞ্চী বর্ডারে। প্রথমে গেলাম কালাঞ্চী বর্ডার দেখতে। বর্ডারের রাস্তায় ঢুকে, কিছুদূর গিয়ে দেখা গেল, কাঁধে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে বি এস এফ টহল দিচ্ছে। পরিচয় পত্র দেখাতে হল (ভোটার কার্ড, আধার কার্ড অথবা প্যান কার্ড)। এরপর অনুমতি নিয়ে হাঁটতে লাগলাম বর্ডারের রাস্তা দিয়ে। কাঁটাতারের পাশ বরাবর পিচের রাস্তা আর কয়েক হাত অন্তর অন্তর বি এস এফ-এর টহল। নদীর ওপারে বাংলাদেশ। এই নদীটির নাম ইছামতী। নদীর অন্যদিকে বাংলাদেশের যশোর জেলার ভুলোট গ্রাম। এখানে ইছামতী নদী হল ভারত-বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সীমারেখা। এপারে দাঁড়িয়ে ওপারের লোকজন, বাড়িঘর, দোকানপাট ইত্যাদি স্পষ্ট দেখা যায়।


হাওড়ার পদ্মপুকুর রামকৃষ্ণ বিদ্যামন্দিরের শিক্ষক জ্যোতি প্রকাশ ঘোষ ভালোবাসেন কলমের আচঁড়ে কোন কিছু ফুটিয়ে তুলতে - ভ্রমণ কাহিনি ছাড়াও গল্প বা উপন্যাস। "অনুভূতি" নামের গল্পটি নিয়ে অভিজিত দত্তের পরিচালনায় একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচিত্র যথেষ্ট সুনাম কুড়িয়েছে।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher