ইতিহাসের পাথরা
সায়ন ভট্টাচার্য
ইতিহাস বিষয়টি কোনও দিন আমার প্রিয় ছিল না। ছোটবেলা থেকেই বিষয়টির প্রতি অবহেলা করে এসেছি, অথচ সেই ইতিহাস ও এক ইতিহাসবিদের আকর্ষণে চেপে বসেছি ট্রেনে। হাওড়া থেকে আপ মেদিনীপুর লোকাল। প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা পর মেদিনীপুর। স্টেশনচত্বরেই ক্ষণিক ঘোরাঘুরি করে আলাপ করে ফেললাম রাজাদার সঙ্গে। রাজাদার মারুতি গাড়িতেই রওনা দিলাম মন্দিরময় পাথরার উদ্দেশ্যে। মন্দিরময় পাথরা বলা হয়, কারণ এই গ্রামে আছে প্রায় তিনশো বছরের পুরোনো নানান টেরাকোটাসমৃদ্ধ মন্দির। স্টেশন থেকে দূরত্ব মাত্র বারো কিমি। অটোও মেলে, আমতলা - পাথরা। আধ ঘন্টার রাস্তা।
গাড়ি ছাড়তেই ইয়াসিন সাহেবের ফোনটা এল। আমাদের যাওয়ার কথা আগেভাগেই জানিয়ে রেখেছিলাম। জিজ্ঞাসা করলেন -
'কত দূরে?'
'গাড়িতে উঠে পড়েছি দাদা' উত্তর দিলাম।
ইয়াসিন সাহেব আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। ইনিই সেই ইতিহাসবিদ যাঁর টানে পাথরা আসা। শুধু ইতিহাসবিদ-গবেষক-লেখক নন, তিনি আস্ত এক ভারতবর্ষ যেখানে বাজে সম্প্রীতির সুর। নিজের জীবন বিপন্ন করে, সমস্ত চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে যিনি রক্ষা করেন পরধর্মের সম্পদ। পাথরার ইতিহাস ও পুরাকীর্তি আজও স্বমহিমায় বর্তমান শুধু এই মানুষটির জন্যেই।
আমাদের গাড়ি এসে থামল একটি মাঠে। গাড়ি থেকে নামতেই মন প্রসন্ন হয়ে গেল। বড় রাস্তাটা যেখানে গিয়ে মিশেছে ততদূর অবধি কোন বসতবাড়ি চোখে পড়ল না। রাস্তার এক পাশে সবুজ ঘাসের গালিচাঢাকা প্রান্তর। সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেশ কিছু মন্দির। আবার রাস্তার অপর দিকেও রয়েছে মন্দিররাজি। মন্দির প্রাঙ্গণ থেকে জমি ধাপে ধাপে নিচু হয়ে মিশে গেছে ধানজমিতে। ধানজমি মিশেছে নদীতে। আমাদের দেখে এগিয়ে এলেন প্রভাত ভট্টাচার্য্য মহাশয়। ইনিই পাথরার মন্দিরগুলি ঘুরিয়ে দেখাবেন। প্রাথমিক আলাপচারিতার পর জানতে চাইলাম, ইয়াসিন সাহেব কোথায়? প্রভাতবাবু বললেন – 'উনি এই গ্রামেই আছেন। মন্দিরগুলি দেখা হয়ে গেলে সাক্ষাৎ হবে।' অর্থাৎ আরও বেশ কিছুটা অপেক্ষা করতে হবে সেই মানুষটিকে দেখার জন্য।
শুরু করলাম নবরত্ন মন্দির থেকে। পঁয়তাল্লিশ ফুট উঁচু মন্দিরে অমূল্য টেরাকোটার কাজ। মন্দিরের চাতালে বসেই প্রভাতবাবু মেলে ধরলেন ইয়াসিন সাহেবের হাতে তৈরি পাথরার এক অতিকায় মানচিত্র, সেই মানচিত্রে নিপুণভাবে বোঝানো হয়েছে পাথরার মন্দিরগুলির অবস্থান ও পথ-নির্দেশ। চৌত্রিশটির মত মন্দির রয়েছে পাথরায়। বিদ্যানন্দ ঘোষাল হাতির পা থেকে উতরে যাওয়ার পর দ্বিগুণ উৎসাহে মন্দির নির্মাণের কাজ করে চলেন। পরবর্তীকালে তাঁর বংশধররাও বহু মন্দির তৈরি করেছেন। নবরত্ন মন্দিরের চারপাশ জুড়ে রয়েছে শিব মন্দির, তুলসী মঞ্চ। একটি শিব মন্দিরে প্রবেশ করে অবাক হয়ে গেলাম, মন্দির নির্মাণকালে ব্যবহৃত অর্থাৎ দু-আড়াইশো বছর আগের রঙ এখনও বিদ্যমান।
নবরত্ন ও তার সংলগ্ন শিবমন্দিরগুলির ঠিক অপর দিকেই রয়েছে কালাচাঁদ মন্দির। লাগোয়া শিব মন্দির রয়েছে তিনটি। ফলক দেখে জানা গেল ১৭৪৯ সালে নির্মিত। পাশেই সমসাময়িক সময়ে তৈরি মাকরা পাথরের দুর্গামন্ডপ। একে একে দেখে নিলাম শীতলা মন্দির, সর্বমঙ্গলা মন্দির, পঞ্চরত্ন মন্দির, ধর্ম মন্দির, সুড়ঙ্গ বাড়ি, কাছাড়ি বাড়ি, রাসমঞ্চ ইত্যাদি। শতাব্দীপ্রাচীন এই প্রত্নতাত্বিক নিদর্শনগুলির পোড়ামাটির কারুকাজ বহুলাংশে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। যেটুকু রয়েছে তার মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায় ব্যাধের পাখি শিকার, দশাবতার, রাম-হনুমান, রাম-সীতা,রাধা-কৃষ্ণ, কৃষ্ণ-যশোদা, কালী-দুর্গা, ষড়ভূজ চৈতন্য, কৃষ্ণ-বলরাম, নগরপাল, দ্বাররক্ষী, বিভিন্ন দাস-দাসী ইত্যাদি। প্রসঙ্গত বলে রাখি পাথরা ও তার মন্দিরগুলি নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে ইয়াসিন সাহেবের গবেষণামূলক গ্রন্থ - 'মন্দিরময় পাথরার ইতিবৃত্ত'।
ঘন্টা তিনেকে মন্দিরদর্শন সাঙ্গ করা গেল। এবার পালা ইয়াসিন সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাতের। আমাদের গাড়ি যেখানে থেমেছিল, ফিরে এলাম সেখানেই। একটি শিব-মন্দিরের চাতালে বসে অপেক্ষা করছিলেন তিনি। অতি সাধারণ আটপৌরে মানুষ। কিন্তু তাঁর চোখের দিকে তাকালে সন্ধান মেলে তাঁর শক্তির, তাঁর গভীরতার। আমাদের দেখেই মুখভর্তি হাসি, ক্ষণিকেই আপন করে নিলেন। শুরু হল গল্প। আজ পাথরাকে যেমন দেখছি, তেমনটি আগে ছিল না। কালের নিয়মে তলিয়ে যেতে বসা মন্দিরগুলির প্রতি গ্রামের মানুষরাই ছিলেন উদাসীন। কেউ কেউ মন্দির থেকে ইট খুলে নিজের বাড়ি মেরামত করিয়েছিলেন। আবার মাকড়া পাথর চুরি হয়ে বিক্রি হয়ে গেছে পর্যন্ত। ভারতের পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের গবেষক তারাপদ সাঁতরার উৎসাহে পাথরার পুরাতত্ত্ব সম্পদ রক্ষায় আত্মনিয়োগ করেন ইয়াসিন পাঠান। মুসলমান হয়ে হিন্দুদের মন্দির রক্ষা? মৌলবাদী শক্তিরা মেনে নেয় নি। তা সত্ত্বেও থামানো যায় নি ইয়াসিন সাহেবকে। নিজের সম্পাদনায় পত্রিকা প্রকাশ করে শুরু হয় প্রচার। চলে মানুষকে সচেতন করার কাজ। পরবর্তী কালে ১৯৯১ সালে সকল সম্প্রদায়ের লোক একত্রিত করে গঠন করেন পাথরা পুরাতত্ত্ব সংরক্ষণ কমিটি। শুরু হয় সরকারি স্তরে পাথরাকে তুলে ধরার চেষ্টা। এই দীর্ঘ লড়াই এর ফলে ২০০৩ সালে ভারতের পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ অধিগ্রহণ করে পাথরার চৌত্রিশটি মন্দির। ইতিমধ্যে আঠাশটি মন্দির সংস্কারও করা হয়েছে। রাজ্য সরকারের তরফেও পাথরাকে ঐতিহাসিক পর্যটন কেন্দ্র রূপে গড়ে তোলার পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে বলে জানা গেল। জমিজট কাটলেই খুব শীঘ্র ভ্রমণ মানচিত্রে উঠে আসবে পাথরার নাম। ইয়াসিন সাহেবের শরীরটা ইদানিং ভালো নেই। হার্ট ও কিডনির রোগে আক্রান্ত। বেশি কথা বলাও বারণ। তবুও তিনি আমাদের এতটা সময় দিলেন। নিজেদের দরিদ্র মনে হচ্ছিল। ফিরতে হবে। আমি প্রণাম করার জন্য ওঁর পা স্পর্শ করতে যেই নীচু হয়েছি অমনি সলজ্জে আমায় বুকে টেনে নিলেন। আমিও আঁকড়ে ধরলাম। বললাম 'ভালো থাকবেন দাদা।' উনি বললেন "এত তাড়াতাড়ি মরতে চাই না। এখনও অনেক কাজ বাকি।" আমার চোখে ততক্ষণে কংসাবতী নেমেছে। বিদায় জানিয়ে এক দৌড়ে চলে গেলাম নদীর পাড়ে। বেলা শেষের সূর্যের আলোয় নদীর জল ঝিক্মিক্ করছে।
বেসরকারি রপ্তানিকারক সংস্থায় হিসাবরক্ষক সায়ন ভট্টাচার্যের পেশাদারি জীবনের বাইরে অনেকটা জায়গা জুড়ে আছে প্রকৃতিপ্রেম ও সাংস্কৃতিকচর্চা। ছোট থেকেই নাট্যচর্চার সঙ্গে যুক্ত। বর্তমানে 'উত্তর-হাওড়া শিল্পীলোক' দলের সঙ্গে নাট্যাভিনয় ও পরিচালনার কাজে যুক্ত। গতানুগতিক ভ্রমণ নয়, খোঁজ চলে অনাঘ্রাত পশ্চিমবঙ্গে কিম্বা বাইরে। সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন।