শ্রীলঙ্কায় দিনকয়েক
অরীন্দ্র দে
দক্ষিণের প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কা রাজনৈতিক, জাতিগত, এবং মহাকাব্যিক কারণবশত আমাদের খুব কাছের। স্বর্ণলঙ্কার গল্প তো আমরা সবাই জানি। দেবতাদের বাস্তুবিদ বিশ্বকর্মা স্বর্ণলঙ্কা বানিয়েছিলেন হর-পার্বতীর জন্য; সদ্যবিবাহিত হর-পার্বতীর একটি মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের বড় দরকার ছিল। গৃহপ্রবেশের জন্য মহাদেব আহ্বান করলেন সপ্তর্ষির অন্যতম পুলস্ত্যকে; তিনি পৌরোহিত্যের পারিশ্রমিক চেয়ে বসলেন গোটা প্রাসাদটাকেই। শিব-পার্বতী আর কী করেন; প্রাসাদ ঋষিকে দিয়ে তাঁরা চলে গেলেন কৈলাস পর্বতে। ক্রমে সেই প্রাসাদ লাভ করলেন পুলস্ত্য ঋষির পৌত্র কুবের; তারপর কুবেরের বৈমাত্রেয় ভাই রাবণ। এই স্বর্ণলঙ্কাতেই বন্দিনী ছিলেন রামায়ণের সীতা। প্রসঙ্গত, পুলস্ত্য সপ্তর্ষিমণ্ডল (Ursa Major)-এর একটি নক্ষত্র (ইংরেজি Phad বা Phecdaঃ Gamma Ursae Majoris) পৃথিবী থেকে দূরত্ব প্রায় ৮৩.২ আলোকবর্ষ।
বাঙালির পায়ের তলায় সর্ষে; আর কে না জানে প্রমোদভ্রমণে অধিকাংশ বাঙালিরই উৎসাহী, আমিও তার ব্যতিক্রম নই। অফিসে একদিন এলেন প্রাক্তন সহকর্মী টি.কে.দা (টি.কে. মুখার্জি), তিনিই মাথায় ঢোকালেন। বললেন, বসে বসে 'তব পদতললীনা আমি বাজাব স্বর্ণবীণা' গেয়ে কি হবে, চ' স্বর্ণলঙ্কা ঘুরে আসি।
উঠলো বাই তো কটক যাই, এক্ষেত্রে কটকটা কলম্বো, এবং তথায় আমাদের পদার্পণ স্থানীয় সময় রাত দুটোয়। তারিখটা ২০শে মার্চ, ২০১৬। ভোর হতেই আমাদের সারথি-তথা-গাইড মিস্টার অশান্তর অনুবর্তী হয়ে আমরা কলম্বোর উত্তর পূর্বের ছোট শহর সিজিরিয়ার পথে, কলম্বো থেকে প্রায় ঘণ্টা চারেক।
হোটেল বুক করাই ছিল; সান শাইন ভিলা সিজিরিয়া। সিজিরিয়া (সিংহ গিরি) প্রায় গ্রাম, গ্রামের চারপাশে জঙ্গল, তবু লোকে এখানে আসে সিজিরিয়া লায়ন রক দেখতে। অপরাহ্নের হুরুলা ইকো পার্কে হাতির দল ঘুরে বেড়াচ্ছে, সঙ্গে সাপ, ময়ূর (দুজনের খাদ্য খাদক সম্পর্ক কিন্তু দেখা গেল বেশ মিলেমিশেই এখানে আছে), আর পাখপাখালি। হাতিরা যখন রাস্তা পেরোয়, গাড়িঘোড়া সশ্রদ্ধে থেমে যায়। তবে দুঃখের কথা এই যে এখানেই আমার ক্যামেরা বিগড়োল, বাকী ট্রিপটা তাই নিয়েই ভুগতে হল।
পরদিন সকালে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট - সিজিরিয়া লায়ন রক; ভারতীয়দের জন্য প্রবেশমূল্য অর্ধেক। বারোশো সিঁড়ি ভেঙে অতিকায় রকফোর্ট্রেসটি দেখতে ঘণ্টাতিনেক লাগল। প্রাকৃতিক পাথরের কলাম সোজা উঠে গেছে সাড়ে ছশো ফুট; তার ওপর থেকে নিসর্গ অতি মনোরম। পঞ্চম শতকে রাজা কশ্যপ তাঁর রাজধানী তুলে আনেন এখানে। অট্টালিকা, হর্ম্যরাজির ধ্বংসাবশেষের মধ্য দিয়ে সরণি, জলাশয়, ভাস্কর্য ও চিত্রকলার সমাহার। রাজা কশ্যপ তার রাজধানী তৈরি করেছিলেন প্রস্তরশিখরে; পাথরের দেওয়ালের গায়ে রঙিন ফ্রেস্কো। ওঠার রাস্তার মাঝবরাবর ক্ষুদ্র এক উপত্যকায় সিংহ-আকৃতির এক অতিকায় তোরণ, তার নামেই জায়গার নাম সিংহগিরি। রাজামশাইয়ের মৃত্যুর পর রাজধানী ও রাজপ্রাসাদ পরিত্যক্ত হয়, ভবনটি বৌদ্ধমঠ রূপে ব্যবহৃত হতে থাকে চতুর্দশ শতক অবধি।
সিংহগিরি দেখে আমরা সেই সকালেই ক্যান্ডির পথে। পথিমধ্যে দ্যাম্বুল্লার স্বর্ণমন্দির দর্শন। এক অতিকায় বুদ্ধমূর্তি বহুদূর থেকেই দৃশ্যমান। দ্যাম্বুল্লা শ্রীলঙ্কার সর্বাপেক্ষা সযত্নরক্ষিত গুহামন্দির; বাইশ শতাব্দীর তীর্থস্থান, সন্নিহিত সমতল থেকে ১৬০ মিটার উঁচু; এধারে ওধারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে খান আশি গুহা, পাঁচটি স্যাঙ্কচুয়ারি, ২১০০ বর্গমিটার জুড়ে দেয়ালচিত্র (ম্যুরাল), একশো তিপ্পান্নটি বুদ্ধমূর্তি, সবই গৌতম বুদ্ধের জীবনের নানা পর্যায় নিয়ে। আর তিনটি মূর্তি শ্রীলঙ্কার রাজারাজড়ার ও চারটি মূর্তি বৌদ্ধ দেবদেবীদের। হীনযানে দেবদেবী নেই; মহাযানে বুদ্ধই দেবদেবী; আর সহজযানে মানুষের দেহেই দেবদেবীর অধিষ্ঠান। বৌদ্ধ দেবদেবীর আসল উপস্থিতি বজ্রযানে, আর সেই দেবদেবীরা আক্ষরিক অর্থেই অসংখ্য!
ক্যান্ডির পথে যেতে যেতে একটা স্পাইস গার্ডেন দেখা হল, নানাবিধ ভেষজ তথা আয়ুর্বেদীয় জিনিসপত্র সেখানে বিক্রি হচ্ছে। মশলাপাতির গাছ দেখে আমরা ক্যান্ডি পৌঁছলাম। ক্যান্ডি মধ্য শ্রীলঙ্কার একটি বড় শহর, পাহাড়ঘেরা উপত্যকার মাঝে; পাহাড় জুড়ে নিরক্ষীয় ঘনবর্ষণ বনাঞ্চল জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। ক্যান্ডি (বোগামবারা) হ্রদ এই শহরের হৃৎপিণ্ড, লোকজন খাওয়া দাওয়া সেরে সেখানে হাঁটতে যায়। ক্যান্ডি বৌদ্ধমন্দির ও বৌদ্ধস্মারকসমূহের জন্য সমধিক প্রসিদ্ধ। এখানকার দন্তমন্দির (Temple of the Tooth; Sri Dalada Maligawa) জগদ্বিখ্যাত। শ্রীলঙ্কার রাজাদের শেষ রাজধানী ছিল ক্যান্ডি। পূর্বতন ক্যান্ডিরাজত্বের রাজপ্রাসাদের মধ্যে এই মন্দির। আমাদের দাঁতনের মত এখানেও শাক্যমুনির দন্ত রক্ষিত। লোককাহিনি বলে খ্রিস্টপূর্ব ৫৪৩ সালে বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের পর, বিহারের কুশিনগরে চন্দনকাঠের চিতায় তাঁর অন্ত্যেষ্টি হয়। দাহকার্যের পর বুদ্ধদেবের শিষ্য ক্ষেমা চিতা থেকে তাঁর বাম শ্বদন্ত সংগ্রহ করে রাজা ব্রহ্মদত্তকে তা অর্পণ করেন। রাজকীয় সংগ্রহের সেই বুদ্ধদন্ত থেকেই দন্তপুরী, আজকের পুরী। বুদ্ধদন্ত অধিকারে থাকলে পৃথ্বীশাসনের অধিকার জন্মায়, এই ধারনা থেকেই কলিঙ্গরাজের সঙ্গে পান্ডুরাজের বুদ্ধদন্তের অধিকার নিয়ে যুদ্ধ লাগে। তখন বুদ্ধদন্ত সিংহলে যায়; অভয়গিরি বিহার তার জিম্মাদার নিয়োজিত হন। বুদ্ধদন্তের অধিকার নিয়ে টানাপোড়েন চলতেই থাকে; বর্মার বোগোর রাজা পর্তুগিজদের জলদস্যুদের লোভ দেখান, বুদ্ধদন্ত দিলেই হাতে গরম টাকা। রাজধানী স্থানান্তরিত হতে থাকে, অনুরারাধাপুরম থেকে পোলোন্নারুয়া, সেখান থেকে দমবেদানিয়া; পরিশেষে বুদ্ধদন্ত ক্যান্ডিতে। ক্যান্ডির আরেক আকর্ষণ কালচারাল সেন্টার – প্রতি সন্ধ্যায় লোকনৃত্যের আসর বসে সেখানে।
পরবর্তী গন্তব্য জেলা শহর নুয়ারা এলিয়া (সমতলের শহর); মধ্য শ্রীলঙ্কার শৈলশহর। চা বাগান, ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা হাওয়া, সরলবর্গীয় গাছ গাছালি... যেন ফেলে আসা দার্জিলিং। শ্রীলঙ্কার চায়ের খ্যাতি তো এখন বিশ্বজোড়া - তার মধ্যেও আবার সেরা নুয়ারা এলিয়ার চা। পাহাড়ের উপর থেকে নৈসর্গিক শোভা অতি মনোরম। এখানকার হাকগ্লা বোটানিক্যাল উদ্যান উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। পাশেই বর্ণাঢ্য ও জমকালো সীতা আম্মান মন্দির, শ্রী বক্ত হনুমান মন্দির; হনুমান নাকি এখানকার রাম্বোদা পাহাড় থেকেই সীতা সন্ধান শুরু করেছিলেন। গহন জঙ্গলের মধ্যে গলওয়ে অভয়ারণ্য পাখিবিলাসীদের স্বর্গ।
সেখান থেকে রাবণ গুহা, রাবণ জলপ্রপাত দেখে ইয়ালা। পথের দৃশ্য অতি মনোরম। পরদিন অতি ভোরে উঠি তাড়াতাড়ি ছুটি – উদ্দেশ্য ইয়ালা সাফারি। দক্ষিণপূর্ব শ্রীলঙ্কার ইয়ালা ন্যাশনাল পার্ক অতিবিস্তৃত, ভারত মহাসাগরের গা ঘেঁষে ৯৭৯ বর্গকিলোমিটার জায়গা জুড়ে তৃণভূমি, মধ্যে মধ্যে হ্রদের ছড়াছড়ি – নেকড়ে, চিতা, হাতি, কুমির… এ বলে আমাকে দেখ তো ও বলে আমাকে। ২০০৪-এর সুনামিতে এই উদ্যান খুব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল; কুড়ি ফুট উঁচু ঢেউয়ের ধাক্কায় প্রায় আড়াইশো লোক মারা গিয়েছিলেন। সেখানকার হোটেলে খেতে গিয়ে জম্পেশ একটা অভিজ্ঞতা হল। মেনুকার্ড নিয়ে কী খাবো কী খাবো করতে করতে টি.কে.দা ভাত খেতে চাইলেন, অর্ডার দিলাম শ্রীলঙ্কার স্পেশাল রাইসের - তিনি এলেন আটটি পার্শ্বপদ সহ। টি.কে.দা-কে বললাম, বিদেশবিভূঁইয়ে ওহে সুন্দর, মম গৃহে আজি জামাইষষ্ঠী রাতি। পরবর্তী গন্তব্য গল/ বেন্তোতা।
সুনামিতে গল শহর, শহরের ক্রিকেট স্টেডিয়ামটি সহ খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। শ্রীলঙ্কার দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলের এই শহরের প্রধান দ্রষ্টব্য ১৫৮৮ সালে পর্তুগিজদের দ্বারা নির্মিত এখানকার দুর্গটি। সপ্তদশ শতকের শেষদিকে ওলন্দাজরা এটিকে আরও শক্তপোক্ত করে। ঐতিহাসিক, পুরাতাত্ত্বিক ও স্থাপত্যগত ঐতিহ্যের দিক দিয়ে এর গুরুত্ব অসীম। ধন্য এদের অধ্যবসায়, নির্মাণের ৪২৩ বছর পরেও প্রতিটি দেওয়াল, প্রতিটি দরজা ঝকঝক করছে। আমাদের জয়সলমিরের দুর্গের মত এটিও লিভিং ফোর্ট – ভিতরে এখনও শ্রীলঙ্কার সরকারি নিবাসের পাশাপাশি ও ওলন্দাজদেরও বসবাস। ইউনেস্কো একে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করেছে – কারণ "an urban ensemble which illustrates the interaction of European architecture and South Asian traditions from the 16th to the 19th centuries."
গলে কিছুক্ষণ থেকে সন্ধ্যায় পৌঁছলাম বেন্তোতা – ওয়াটার স্পোর্টস, আয়ুর্বেদ ও নারকোলের জল থেকে প্রস্তুত মদ্যের জন্য সমধিক প্রসিদ্ধ। সঙ্গে বাড়তি পাওনা ইন্দুরুয়া সৈকতে সামুদ্রিক কচ্ছপের আস্তানা। পরের দিনটা কাটল আরাম করে - সমুদ্রস্নান ও জলক্রীড়ায়।
সকালে জলখাবার সেরে রওনা হলাম কলম্বোর পথে। কলম্বোতে বিশ্বজাহানের আর যে কোনও বড় শহরের মতই সুবিশাল হর্ম্যরাজি, বিশাল সব বিপণি আর আমোদপ্রমোদের আয়োজন। দুর্দান্ত গরমে সারাদিন ঘুরে ঘুরে পুরনো পার্লামেন্ট ভবন, প্রেমদাস ক্রিকেট স্টেডিয়াম, সৈকত এইসব দেখে ক্লান্ত, প্রায় বিধ্বস্ত অবস্থায় বিমানবন্দর। সারথি মি. অশান্ত নিয়ে গেলেন সুদৃশ্য ক্যানাল রোড দিয়ে । এই খাল কলম্বো বন্দর থেকে শহরের অন্যান্য অঞ্চলে পণ্যপরিবহণের এক অন্যতম মাধ্যম। সারা শ্রীলঙ্কা জুড়েই ছড়িয়েছিটিয়ে দামি মণি-মুক্তোর দোকান – এমনকি জেম মিউজিয়ামো আছে। এখানকার আবহাওয়া সাধারণতঃ প্রচণ্ড গরম, রোদে গা পুড়বেই। শ্রীলঙ্কাকে বিদায় জানিয়ে ২৭শে মার্চ ফেরার প্লেন ধরলাম কলম্বো বিমানবন্দর থেকে।
প্রয়োজনীয় তথ্যঃ শ্রীলঙ্কার ভিসা (ETA- Electronic Travel Authorisation) –এর জন্য আবেদন অনলাইনে http://www.eta.gov.lk/slvisa/ কিংবা http://www.eta.gov.lk/slvisa/visainfo/fees.jsp?locale=en_US শ্রীলঙ্কা পৌঁছেও ভিসা করে নেওয়া যায়।
(মূল লেখাটি ছিল ইংরাজিতে। অনুবাদ করেছেন শ্রী তপন পাল)
ভ্রমণ শুধুমাত্র নেশা বা ভালোলাগা নয়, ওইটাই জীবন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার কর্মী অরীন্দ্র দে-র কাছে। ভালোবাসেন পাহাড়ে চড়তেও। একাধিক হাই অল্টিচ্যুড ট্রেকের অভিজ্ঞতা রয়েছে। মাউন্ট ভাগিরথী-(২) সফল অভিযানটির সদস্য ছিলেন। ছবি তুলতে ভালোবাসেন। স্বপ্ন দেখেন জীবনে একটা রাত অন্তত স্পেসস্টেশনে কাটানোর।