ইয়েলোস্টোন পার্কে

কালীপদ মজুমদার


জুন মাসের এক মিষ্টি বিকেলে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে যখন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ওয়মিং রাজ্যের অন্তর্গত ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্কের গার্ডিনার গেটে এসে পৌঁছালাম আকাশে তখন কালো মেঘের ঘনঘটা। গেটে টিকিটের সঙ্গে কর্তৃপক্ষ পার্কের একখানা ম্যাপও আমাদের হাতে দিয়েছিলেন। সেই মানচিত্র অনুসরণ করে এগিয়ে যেতে যেতে শুরু হল পাহাড়ি পথ। আঁকাবাঁকা পথের দুই কিনারের পাহাড়ে চিরসবুজ পাইনের শোভা আর ঘন সবুজে আবৃত উন্মুক্ত তৃণভূমি পাহাড়ের ঢাল বেয়ে হু হু করে নেমে এসেছে পথের কিনারে। সেই শ্যাম তরুরাজি আর কোমল তৃণভূমির অপরূপ শোভা সহজেই সকলের মন হরণ করল। খাড়া পাহাড়ের গায়ে কোথাও মস্ত পাথরের চাঁই এমন ভাবে ঝুলছে যে মনে হয় এখুনি হয়ত খসে পড়বে সেই বিকট পাথর। একবার খসে পড়লেই কী যে অনর্থ ঘটবে ভাবতেই ভয়ে চোখ বুজে আসে। পথ মাঝে মাঝে এমন বাঁক নিচ্ছে যে মনে হয় কী যেন অদেখা রয়ে গেল সেই ফাঁকে। পথের কিনারের পাইনের পল্লবে পাতায় চঞ্চল প্রাণের স্পর্শ দেখে মনে হল এমন অপরূপকে দুদণ্ড দাঁড়িয়ে একটু আদর করে যাই।

আসার পথে লিভিংস্টোন বলে একটা জায়গা থেকে পার্কের পথ ধরেছিলাম। তখন থেকেই ইয়েলোস্টোন নদী কখনও কাছে, কখনও দূরে - সঙ্গে সঙ্গে আসছিল। চলতে চলতে পথ একজায়গায় দুভাগ হল। বাঁ হাতের পথ ধরে এগিয়ে চললাম। সেই পথে দেখে নিলাম আনডাইন ফলস আর ফ্যান্টম লেক। মাথার ওপরে আধখানা চাঁদের মতন বাঁকা রুজভেল্ট আর্চের তলা দিয়ে পথ। ইতিমধ্যে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়তে লাগল। বিরাট শূন্যতার মাঝে কোথাও কোনও প্রাণের সাড়া নেই। সেই তুলনাহীন শোভার মাঝে যখন বিভোর হয়েছিলাম এমন সময় আচমকা কড়াৎ করে মেঘ ডেকে উঠল। সেই অপরাহ্ন বেলার আকাশ জোড়া নিকষকালো মেঘের সন্মিলনে অসময়ে বুঝি সন্ধ্যার আগমন ঘটল। নির্জন,নিঃসীম বিরাটের আঙ্গিনা জুড়ে এক এক বার বিদ্যুতের ঝলকে সমুখের অজানা পাহাড় আর বনভূমি আমাদের সামনে এক রহস্যপুরীর মতন হয়ে দেখা দিল। মেঘের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে এগিয়ে চললাম। সামনে বিপুল জলের গর্জন শুনতে পাচ্ছিলাম। পৌঁছে দেখি দুর্বার ইয়েলোস্টোন নদী উঁচু পাথরের ওপর থেকে নীচে লাফিয়ে পড়ে সৃষ্টি করেছে টাওয়ার ফলস। এই পাহাড় আর প্রকৃতি ইয়েলোস্টোনের জন্মভূমি। পাহাড়ের বুকে নদীর উদ্দামতা দেখে বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেলাম।

ক্রমে আলো কমে আসতে লাগল। এবার মাইল কুড়ি দূরে রাতের আস্তানা ক্যানিয়ন লজের পথ ধরলাম। বন্ধুর পথ একসময় ওপরে উঠতে লাগল। পথের দুই কিনারে আধপোড়া পাইনের সারি দেখে জানতে পারলাম ১৯৮৮ সালে ভয়ঙ্কর এক অগ্নিকান্ডে বাইশ লক্ষ একর আয়তনের এই পার্কের প্রায় সাত লক্ষ একরের মত অঞ্চল পুড়ে যায়। দগ্ধ বৃক্ষকুল আজও তার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এক সময় আমরা চলে এলাম বরফের দেশে। সেখানে মহাশূন্যের বুকে অসীম শুভ্রতা চারদিকে বিস্তার করে চলেছে।

এক রূপকথার অনুভূতি। তুষার পথের ৮৮৫৯ ফুট উঁচু শীর্ষবিন্দু-'ডুনরাভেন পয়েন্ট'-এ যখন উঠে এলাম,মুহূর্তে আদিগন্ত বিস্তৃত রজত শোভার বুকে হারিয়ে গেলাম আমরা। চারদিকের দূর প্রসারিত নৈসর্গিক শোভা এক সম্মোহনী মায়াজাল বিছিয়ে দিয়েছে চরাচরের বুকে। সেই রূপসাগরের সৌন্দর্যে সবাই আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম। সন্ধ্যার পরে এসে আশ্রয় নিলাম রাতের ঠিকানা ক্যানিয়ন লজে। গভীর রাত্রে চাঁদের আলোয় হোটেলের কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরের তুষারাবৃত প্রকৃতির শোভা দেখে মন ভরে গেল।

পরদিন ভোরে আবার বেরিয়ে পড়লাম পার্কের বিখ্যাত গাইসার অঞ্চল দেখব বলে। আমাদের প্রথম লক্ষ্য দূরের 'নরিস গাইসার বেসিন'। বাতাসে ঠান্ডার কামড়। পথে পড়ল ওয়াশবার্ন হট স্প্রিং আর 'লোয়ার ফলস'। লোয়ার ফলসে আবার দেখা ইয়েলোস্টোন নদীর সঙ্গে। নদী এখানে দুরন্ত বেগে পাহাড়ের ওপর থেকে সশব্দে লাফিয়ে পড়ছে অনেক নীচের পাথরের বুকে। সফেন জলরাশির গর্জন আর উন্মত্ততা দেখে স্তব্ধ হয়ে গেলাম বিষ্ময়ে। দেশ বিদেশের কত মানুষ যে জড়ো হয়েছে এই সুন্দরের আঙ্গিনায়। দক্ষিণে, দূরের ফোর্ট্রেস মাউনন্টেনের তলার দিক থেকে ইয়েলোস্টোন নদীর উৎপত্তি। সেখান থেকে এসে ইয়েলোস্টোন লেক হয়ে সে নদী চলে গেছে পূবের নর্থ ডাকোটা রাজ্যের দিকে। লোয়ার ফলস থেকে নেমে অনেক নীচের এক মহা ভয়ঙ্কর গিরিখাতের মধ্যে দিয়ে পথ করে দুরন্ত বেগে ছুটে চলেছে সেই নদী। দুই কিনারে তার হেলান দেওয়া ভয়ঙ্কর খাড়া পাহাড়। সেই দীর্ঘ পাহাড়ের দেওয়ালে নানা রঙের পাথরের সমাবেশ দেখে অবাক হলাম। দূরে, অনেক নীচের গভীরে ক্ষীণ রেখার মতন বয়ে চলেছে নদী। সেদিকে তাকিয়ে গা শির শির করতে লাগল। এই গিরিখাত-ই বিখ্যাত 'গ্র্যান্ড ক্যানিয়ান অফ ইয়েলোস্টোন' নামে পরিচিত। এবার নদীর উৎস মুখের দিকে উঠে দেখা পেলাম আপার ফলসের। নদীর গর্জনের সঙ্গে জলের ছটার বুকে আলোর বিচ্ছুরণের সে কী শোভা! শিশু আর বৃদ্ধ সহ বহু মানুষের আনন্দ কলতানে চারদিক মুখরিত হয়ে উঠেছে।

নদী অঞ্চল ছেড়ে নরিসের প্রস্রবণের এলাকায় যখন এলাম, পথের কিনারের গাছপালার আড়াল পার হতেই সামনে দেখতে পেলাম সীমাহীন শূন্য প্রান্তরের বুকে উষ্ণ প্রস্রবণের মেলা বসেছে। পৃথিবীর বৃহত্তম সক্রিয় আগ্নেয়গিরিগুলির মধ্যে একটির ওপরে নরিস গাইসার বেসিন অবস্থিত এবং এটি একটি ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলও বটে। কাঠের পাটাতনের পথ ধরে পায়ে পায়ে চলে এলাম নীচের বিরাট খোলা প্রান্তরের বুকে। চার দিকে কেবল বাষ্প কুন্ডলী পাকিয়ে পাকিয়ে নিরন্তর আকাশে উঠে চলেছে। এক জায়গায় গিয়ে দেখলাম কুন্ডের বুকে টগবগ করে ফুটছে কাদা। সে যেন ভাত ফোটার শব্দ। কোথাও মনে হয় চচ্চড়ি রান্নার শব্দ, আবার কোথাও ফোঁস ফোঁস শব্দ। এমন কত বিচিত্র ধ্বনি যে শোনা যায় প্রতিটি গাইসার থেকে যা আমাদের পরিচিত শব্দ দিয়ে বর্ণনা করে বোঝানো সম্ভব নয়। তপ্ত জলের কুন্ড, ফুটন্ত কাদা, আর বাষ্পের ধোঁয়া এমন নানা রকমের প্রস্রবণের বুকে কত রকমের যে বিষ্ময়কর রঙের খেলা যা দেখে মুখে কথা সরে না। পিনহুইল, স্টীমবোট, হোয়েলস মাউথ, কংগ্রেস, মনার্ক, এমন অসংখ্য গাইসার আর পোর্সিলিন, ইয়েলো ফানেল, ব্লু মাড, এমারেল্ড এমন নানা হট স্প্রিং, কত নাম আর কত চরিত্র তাদের। সংখ্যায় যেমন অগুনতি, রূপেও তারা অবর্ণনীয়। তবে নরিসের বিস্ময় স্টিমবোট গাইসার। এই প্রস্রবণটি পৃথিবীর উচ্চতম সক্রিয় উষ্ণ প্রস্রবণ। কখনও কখনও তার উৎক্ষেপণ উচ্চতা তিন থেকে চার'শ ফুট পর্যন্ত উপরে পৌঁছে যায় এবং সক্রিয়তা বারো ঘন্টা পর্যন্তও স্থায়ী হতে পারে।

বিকেল হয়ে আসছিল। নরিসের বিস্তীর্ণ প্রস্রবণ অঞ্চল ছেড়ে এবার চললাম পার্কের উত্তর সীমানার ম্যামথ হট স্প্রিং এলাকার দিকে। পথে এল 'রোরিং মাউন্টেন'এবং'অবসিডিয়ান ক্লিফ' আর ইন্ডিয়ান ক্রীক। দেখলাম সোয়ান লেক। পথ চলতে চলতে পাহাড়ের ঢালে দেখা হল সারা গা লম্বা লম্বা লোমে ঢাকা বাইসন পরিবারের সঙ্গে। তারা কিন্তু শান্ত নয় তেমন। পাহাড় আর দূর বিস্তীর্ণ উদার শ্যামল প্রকৃতির মাঝে ছোট ছোট নালার বুকে স্বচ্ছ নীল জলধারা আর পথে প্রান্তরে সবুজ ঘাসের গালিচায় ঢাকা চোখ ভোলানো প্রকৃতি প্রতি মুহূর্তে মন হরণ করে চলেছে। সেই অসীম সুন্দরের বুকের ওপর দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ দেখা হল বাদামী ভালুক, গ্রিজলি বিয়ারের সঙ্গে। তবে সে দেখা মুখোমুখি দেখা নয়। কিছুটা দূর থেকে দেখা। পড়ন্ত বিকেলে ঢেউ খেলানো সবুজ প্রান্তরের পথে একা সে চলছিল আপন মনে। যেমন অতিকায় তার চেহারা তেমনি তার স্বাস্থ্য। চলতে চলতে একসময় নালার ঢালে হারিয়ে গেল সে। বিরাট আকাশের নীচে দিকে দিকে কত রকমের মনভোলানো সুন্দরের ছবি আঁকা। ম্যামথের একটু আগে পাহাড়ের ঢালে একটা মরা গাছের ওপরে দেখি ছোট একটা কালো ভালুক চুপটি করে বসে আছে। তবে সে বসা কেবল ক্ষণিকের জন্য মাত্র। সেই চঞ্চল ভালুক এমন দুষ্টু যে মানুষের জটলা দেখে তার উৎসাহ যেন আরও বেড়ে গেল। তার দুষ্টুমি দেখে আমাদের হাসি আর ধরে না।

ম্যামথের রাতের আশ্রয়ে এসে দেখি আর এক বিপত্তি। আমাদের ঘরের সামনে কতকটা নীলগাই-এর মতন দেখতে এক 'মুজ' দাঁড়িয়ে রয়েছে। হোটেলের নিরাপত্তা কর্মীরা তাকে বাবা-বাছা করে যতই সরাতে চায় ততই সে বেঁকে বসছে। কোনরকম আঘাত বা অত্যাচার করা যাবে না, দেশের এমন নিয়ম মানতে গিয়ে গলদঘর্ম হচ্ছেন তারা। এদিক ওদিক চেয়ে দেখি পিছনের টিলার ওপরে, গাছের তলায়, পথের কিনারে নানা জায়গাতেই তারা অনেকে ঘোরাঘুরি করছে। কিছুতেই যখন নড়ানো গেলো না সেই গোঁয়ারগোবিন্দকে,একসময় সুযোগ পেয়ে টুক করে তার পিছন দিয়ে গিয়ে উঠলাম ঘরের বারান্দায়। অনেক রাত্রে কাঁচের জানলা দিয়ে পিছনের ন্যাড়া পাহাড়ের মাথায় একপায়ে দাঁড়ানো একটা গাছের পিছনে চাঁদের শোভা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম।

পরদিন ভোরে প্রথমেই গেলাম হোটেলের কাছে 'ম্যামথ হট স্প্রিংস' দেখতে। সে যেন স্তরে স্তরে সাজানো পাথরের প্রাসাদ। মাটির গভীর থেকে খনিজ মিশ্রণের তপ্ত জলের ধারা উঠে আসছে ওপরে। পাষাণ-প্রাসাদের ছাদের ওপর দিয়ে সেই মিশ্রণের তপ্ত জলধারা অবিরাম গড়িয়ে পড়ছে নীচের দিকে। খাড়া পাথরের চওড়া ছাদের ওপরে,বিভিন্ন খোপে এবং দেওয়ালে কত রকমের যে রঙের বাহার খুলেছে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন! স্তরের ওপরে স্তরে রঙের বিন্যাস। উজ্জ্বল দুধসাদা মেঝের বুকে কত যে রঙের সমাবেশ হয়েছে সেখানে। সে শোভা এমন অপরূপ সুন্দর আর ঝলমলে যে চোখ সরিয়ে আনা দুষ্কর। সেই গরম জলের কিনারে দেখলাম কাদাখোঁচা পাখিরা তাদের খাবার খুঁজে বেড়াচ্ছে ঘুরে ঘুরে। কল্পনার সেই পাষাণ-প্রাসাদের নীচে এসে দেখি পাহাড়ের ঢালে আর দিকে দিকে ফোটা ফুলের মেলা বসেছে। ধরার আঙ্গিনার বুকে সেই অনাবিল ফুলের হাসি জীবনের সব গ্লানি মুহূর্তে ধুয়ে নিয়ে গেল। দূরে আকাশচুম্বী নীল পাহাড়ের মাথায় মাথায় তুষার শোভা, নীচে শ্যামল বনানীর সীমাহীন ঢেউ-এর তলে নয়ন মনোহর ফুলের বুকে মৌমাছিদের মেলা। শীতল বাতাস আর মিষ্টি রোদের সঞ্জীবনী ধারায় সেই সুন্দরের দেশের সব মধুময় হয়ে উঠল। অনেক কষ্টে সে জায়গা ছেড়ে আমরা চললাম পার্কের শেষ দক্ষিণের বিখ্যাত 'ওল্ড ফেইথফুল' গাইসারের দিকে। এই গাইসারটি বিশাল এই পার্কের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে প্রায় দশ হাজার তপ্তকুন্ডের মধ্যে সর্বাধিক পরিচিত নাম। ইয়েলোস্টোন লেকের পাশ দিয়ে চলেছিলাম আমরা। সেখানে লেকের কিনারে বরফঠান্ডা জলের তলা থেকে জায়গায় জায়গায় ফোয়ারা দিয়ে নিরন্তর গরম জল উঠে আসতে দেখে অবাক হলাম। সারাটা লেকের তলায় নাকি এমন অজস্র তপ্তকুন্ড ভরা। এমন বৈপরীত্যভরা দৃশ্য এই পার্কের সর্বত্রই দেখা যায়।

একসময় আমরা চলে এলাম লোয়ার এবং মিডওয়ে গাইসার বেসিন অঞ্চলে। ফায়ারহোল নদীর সুগভীর নীল জলের তীরে অনাদি প্রান্তরের বুক জুড়ে যে সংখ্যাহীন প্রস্রবণের মেলা বসেছে তার বর্ণনা দেবার সাধ্য কোথায়। তবে সেখানে 'মিডওয়ে গাইসার বেসিন' অঞ্চলে সকল শোভার সেরা ইয়েলোস্টোনের বৃহত্তম হট স্প্রিং 'গ্র্যান্ড প্রিসমেটিক' স্প্রিং-এর সঙ্গে কোন কিছুরই তুলনা চলে না। সেই প্রস্রবণের কিনারা ঘিরে অপরূপ হলুদ এবং কমলা রঙের বলয় রেখার মনভোলানো শোভা। ৩৭০ ফুট ব্যাস বিশিষ্ট সেই তপ্ত জলকুণ্ডের তলদেশ থেকে সুগভীর পান্না রঙের যে আভা উদ্ভাসিত হয়ে চলেছে তেমন শোভা যেমন বিরলেরও বিরলতম তেমনি দুর্লভও বটে। বর্ণালী আভার সেই শোভায় পলকেই মোহিত হয়ে গেলাম সকলে। এমন রঙের বিন্যাস একমাত্র প্রকৃতির ভান্ডারেই সম্ভব। গ্র্যান্ড পিসমেটিক-এর দুর্লভ শোভা জীবনের এক অমূল্য অনুভূতি। গ্র্যান্ড প্রিসমেটিকের শোভা দেখে শেষ বিকেলে 'ওল্ড ফেইথফুল'-এর খোলা মাঠের সামনে যখন এলাম তখন সেখানে চারদিকে একটা শূন্যতার পরিবেশ। সেই মাঠের কিনারের দেখলাম একটা জায়গা থেকে মাঝেমাঝে সামান্য ফোঁস ফোঁস শব্দ হচ্ছে আর একটু একটু বাষ্প বেরিয়ে আসছে থেকে থেকে। জায়গাটার সামনের দিকে একটু তফাতে অর্ধচন্দ্রাকারে বানানো সিমেন্টের লম্বা বেদি। বহু মানুষ সেখানে পাশাপাশি এক সঙ্গে বসতে পারবে। কচ্ছপের পিঠের আকৃতির সেই খোলা মাঠের শেষ সীমানা ঘেঁসে অরণ্যশোভিত পাহাড় নীরবে চেয়ে আছে আমাদের দিকে। এদিক ওদিকে কিছু তপ্ত জলের কুণ্ড। সবুজ বলয়রেখার পাহাড়ের নীচ দিয়ে নালা বয়ে চলেছে তির তির করে। এখানে ওখানে কিছু মানুষজন ঘোরাঘুরি করছে। চারদিকে কেমন একটা শূন্যতার ভাব। জায়গাটাকে দেখে আহামরি তেমন কিছু মনে হল না। তবুও ভাবলাম, এসে যখন পড়েছি দেখেই যাই। সিমেন্টের বেদীতে পছন্দ মতন একটা জায়গা দেখে বসে আছি। ধীরে ধীরে লোক সমাগম বাড়তে লাগল। বসবার জায়গাটাও ভরে গেল ক্রমে। একসময় লোকজনের ব্যস্তসমস্ত ভাবটাও বেড়ে উঠল। বড় বড় ক্যামেরা দাঁড় করিয়ে কয়েকজন ক্যামেরাম্যান বার বার ঘড়ি দেখছেন। বুঝলাম কিছু একটা ঘটতে চলেছে। সারা এলাকাটা কখন যে লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল খেয়াল করিনি। চারদিকে নজর ঘুরে বেড়াচ্ছে আমার। হঠাৎ বিকট শব্দে চমকে উঠলাম। চেয়ে দেখি সামনের সেই জায়গা থেকে বিপুল গরম জলের ফোয়ারা সবেগে ঠেলে উঠছে আকাশের অনেক ওপরে। জল, বাষ্প, গর্জন আর আমাদের উচ্ছাস, সব কিছু মিলে সে এক সমুদ্রমন্থনের কল্লোল। অবাক হয়ে সেই বিস্ময়ের দিকে চেয়ে আছি অপলক দৃষ্টিতে! আকাশের অনেক ওপরে উঠেই চলেছে বাষ্পমিশ্রিত সেই দুরন্ত জলরাশি। মিনিটখানেকের বেশি সময় ধরে সেই গর্জনের তান্ডব চলল সমানে। মনে হল মহা এক অঘটন ঘটে চলেছে পৃথিবীর বুকে। ছবি তোলার হিড়িক পড়ে গেল সকলের মধ্যে। তারপর যেমন হঠাৎ তার উৎপত্তি, তেমনি হল তার বিলয়। মনে হল এতক্ষণ বুঝি স্বপ্ন দেখছিলাম। দেখতে দেখতে লোকজন ফাঁকা হয়ে গেল। বছরের পর বছর ধরে গড়ে ঘন্টা দেড়েক পরে পরে তার এই উচ্ছ্বাস চলে আসছে অবিরাম। নিয়মিত তার এমন স্থির আর নিশ্চিত উচ্ছ্বাস থেকেই কি এমন নাম পেল সেই ভয়ঙ্কর সুন্দর?

নানা রকম প্রাণী আর অরণ্যবৈচিত্র্যে ভরা এই পার্কের একদিকে গাইসার আর হট স্প্রিং-এর শোভার আবেদন। আবার বাষ্পধারার কুন্ডলীর কিনারে কিনারে, পাহাড়ের মাথায় সবুজ গাছপালার সারি। এমন বিপরীতের মাঝে দূরে শৈল শিরে শিরে তুষার শোভা। লেকের বিপুল নীল-সবুজ শীতল জলরাশির তলে উষ্ণ ফোয়ারার চমৎকার। নীল আকাশের নীচে এমন নানা অজানা রহস্য আর সুন্দরের আদিগন্ত বিস্তৃত শোভা দেখে মন মুগ্ধ হয়ে যায়। তবে যতটুকু দেখলাম তার অনেক বেশি রয়ে গেল অদেখা,অজানা। তৃপ্তি আর পিপাসা নিয়ে ইয়েলোস্টোন পার্কের দক্ষিণের জ্যাকসন হয়ে আমরা ফিরে চললাম আপন আস্তানায়।

এই পার্কের পাঁচটি প্রবেশপথে আছে। তার মধ্যে উত্তরে ইউ এস ৮৯ হয়ে গার্ডিনার প্রবেশপথ, ইউ এস ২১২ ধরে কুক সিটি আর সিলভার গেট হয়ে উত্তরপূবের প্রবেশপথ - এই দুটি গেট সারা বছর খোলা থাকে। বাকি ইউ এস ২০ হয়ে পশ্চিম ইয়েলোস্টোন পথ, ইউ এস ৮৯ দিয়ে জ্যাকসন হয়ে দক্ষিণের পথ আর ইউ এস ২০-১৬-১৪ ধরে কোডি হয়ে পূবের পথ, এই প্রবেশ দ্বারগুলি শীতকালে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত বন্ধ থাকে।

ভারতীয় ভূতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণ (জি এস আই)-এর প্রাক্তন কর্মী কালীপদ মজুমদার দীর্ঘ কর্মজীবনে নিযুক্ত ছিলেন ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের নানান প্রত্যন্ত এবং দুর্গম অঞ্চলে। অবসরগ্রহণের পর সন্তানদের সঙ্গে মিলিত হবার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার সুযোগ আসে। সেখানে অবস্থানকালে বিরাট সেই দেশের সামান্য কিছু অংশ ভ্রমণের সুযোগ হয়। সেইসব ভ্রমণকাহিনি লেখার জন্যই 'আমাদের ছুটি'-তে কলম ধরা।

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher