বেড়ানোর ভাল লাগার মুহূর্তগুলো সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিতে ইচ্ছে করে, অথচ দীর্ঘ ভ্রমণ কাহিনি লেখার সময় নেই? বেড়িয়ে এসে আপনার অভিজ্ঞতাগুলো যেমনভাবে গল্প করে বলেন কাছের মানুষদের - ঠিক তেমনি করেই সেই কথাগুলো ছোট্ট করে লিখে পাঠিয়ে দিন ছুটির আড্ডায়। লেখা পাঠানোর জন্য দেখুন এখানে। লেখা পাঠাতে কোনরকম অসুবিধা হলে ই-মেল করুন - admin@amaderchhuti.com অথবা amaderchhuti@gmail.com -এ।
ভরতপুরে একদিন
সূর্যাশিস পাল
~ ভরতপুরের আরও ছবি ~
শুক্রবার এমনিতেই অফিসে ঠিক মন বসে না। তারপর যখন সায়ন ভরতপুর ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা পেড়ে বসলো তখন উৎসাহের আর সীমা রইল না। শুক্রবারটা কাটলো বেড়িয়ে আসবার প্রস্তুতিতেই। রাত বারোটা নাগাদ একটি গাড়ি করে বেরিয়ে পড়লাম ভরতপুরের জন্য। আসা যাওয়ার মোট গাড়ি ভাড়া ৩৫০০-৪০০০ টাকা লাগবে। অবশ্য টোল ট্যাক্স মিলিয়ে টাকার অঙ্কটা আরও অনেকটাই ফেঁপে ওঠে। তাই আমার পরামর্শ হল যে ভরতপুর যেতে হলে ট্রেনে কিংবা বাসে যাওয়াই শ্রেয়। দিল্লি থেকে ভরতপুর পৌঁছাতে লাগে প্রায় তিন-চার ঘন্টা। ভরতপুর পৌঁছলাম যখন, সকাল হয়নি। তাপমাত্রা প্রায় চার-পাঁচ ডিগ্রি। চারিদিক কুয়াশার চাদরে ঢাকা। কিছুক্ষণ গাড়ির মধ্যে ঘুমিয়ে নিলাম। সফরের ক্লান্তি নিমেষেই ঝরে পড়ল। সূর্যের প্রথম আলোর সঙ্গেই শুরু হল ভরতপুর ভ্রমণ।
রাজস্থান আর উত্তরপ্রদেশের মাঝখানে অবস্থিত ভরতপুরের প্রধান আকর্ষণ এখানকার পাখিরালয় কিংবা বার্ড স্যাংচুয়ারি। ২৯ বর্গকিমি ব্যাপ্ত এই বার্ড স্যাংচুয়ারি ছিল রাজা রাজড়াদের শিকারভূমি। পরে ১৯৭৬ সালে জায়গাটিকে ভারত সরকার পাখিরালয় হিসেবে চিহ্নিত করে। ১৯৮৫ সালে এটিকে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তালিকায় যোগ করা হয়। প্রথমে এর নাম দেওয়া হয় ঘানা বার্ড স্যাংচুয়ারি। পরে নাম পরিবর্তন করে "কেওলাদেও" রাখা হয়। এই নাম রাখার পেছনেও একটি কাহিনি আছে। এই ন্যাশনাল পার্কের প্রায় মাঝামাঝি জায়গায় একটি শিবমন্দির আছে। সেই শিবমন্দিরের মূর্তি পাওয়া গেছিল একটি কলাগাছের নিচে, সেই থেকে দেবতার নাম এবং পার্কের নাম দুটিই "কেওলাদেও" অর্থাৎ কলার দেবতা। বিখ্যাত পক্ষীবিদ সালিম আলি এই পাখিরালয়ের প্রতিষ্ঠা করেন। পার্কের ভেতরে তাঁর নামাঙ্কিত একটি "ইন্টারপ্রিটেশন সেন্টার" আছে।
যাকগে আমাদের গল্পে ফিরে আসা যাক। পাখিরালয়ের টিকিট কিনে এবং রিক্সা ভাড়া করে বেরিয়ে পড়লাম বিহঙ্গ দর্শনের জন্য। এ ক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো যে ভরতপুরে পাখি দেখার সব চেয়ে ভালো সময় কিন্তু শীতের মরসুমে। কারণ এই সময়েই দেশদেশান্তর থেকে পাখিরা এখানে অতিথি হয়ে আসে। আবার কয়েক মাস পরে ফিরে চলে যায়। ভালো ক্যামেরা থাকলে দেখার আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে যাবে। যদি এখানে কিছুদিন থেকে যেতে চান তাহলে রাজস্থানের ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের গেস্ট হাউস আছে ন্যাশনাল পার্কের অভ্যন্তরেই আর পার্কের সীমানার ঠিক বাইরে ন্যাশনাল হাইওয়ের পাশেই আছে রাজস্থান ট্যুরিজমের লজ। আলাদা করে গাইড নেওয়ার দরকার নেই, পার্কের ভিতরে ঘোরাফেরার জন্য সাইকেল রিক্সা ভাড়া করা যায়। সেই রিক্সাচালকরাই আপনাকে বিভিন্ন পাখির নাম,তারা কোন দেশ থেকে এসেছে ইত্যাদি ইত্যাদি বলে দেবেন।
চোখ,কান খোলা রাখলে দেখতে পাবেন বিভিন্ন রকমের বক, সারস, হাঁস, পেলিক্যান,ইন্ডিয়ান হর্নবিল,টাইগার বার্ড,প্যারাকিট, নীলকণ্ঠ, ওরিয়েন্টাল ম্যাগপাই রবিন ইত্যাদি ছোট বড় নানা প্রজাতির পাখি।
পাখিরালয়ের ভিতরে ঘন জঙ্গল, বিস্তীর্ণ ঘাসজমি ছাড়াও বড় বড় জলাভূমি আছে। তাই এখানে ডাঙার পাখি ও জলের পাখি দুই-ই দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়াও অজগর,হরিণ,জংলি শুয়োর,নীল গাই, সম্বর, হায়না এবং শিয়াল চোখে পড়তে পারে। আর রাজস্থানের সর্বত্রই তো ময়ূর দেখা যায়। একদা ভরতপুরের প্রধান আকর্ষণ ছিল সাইবেরিয়ান ক্রেন, কিন্তু গত অনেক কাল যাবৎ তারা আর এদেশে আসছে না। তবে ইন্ডিয়ান সারস ক্রেনের আকর্ষণও নেহাত কম নয়। কয়েক ঘন্টা পাখিরালয়ে কাটিয়ে বেরিয়ে এলাম ভরতপুরের অন্য আকর্ষণগুলো দেখতে।
ভরতপুর স্বাধীনতার আগে ছিল হিন্দু জাঠ রাজাদের অধীনে। এই জাঠ রাজারা মুঘল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিপ্লব করে নিজেদের আধিপত্য স্থাপন করে। এদের মধ্যে সব চেয়ে পরাক্রমী রাজা ছিলেন রাজা সুরজমল। এইসব এখন ভুলে যাওয়া ইতিহাস। তার ছোঁয়া পাওয়া যায় ভরতপুরের লোহাগড় দুর্গে। দুর্গের মধ্যে যে মিউজিয়ামটি আছে সেটা শুধু সুন্দরই নয়, নিরিবিলিও। কুড়ি টাকার টিকিট কিনে দেখে নিলাম জাঠ রাজাদের অস্ত্র-শস্ত্র ,পোশাক-আশাক ইত্যাদি নানা সাজ-সরঞ্জাম। প্রায় ঘন্টা দুয়েক এখানে থেকে দিল্লি ফেরার পথ ধরলাম।
~ ভরতপুরের আরও ছবি ~
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক সূর্যাশিস পাল বর্তমানে নয়ডার একটি সফটওয়্যার ফার্মে কর্মরত। অবসর সময়ে গল্প-কবিতা লিখতে এবং পড়তে ভালোবাসেন।