বিদায়বেলায় বাঁকুড়ায়
তপন পাল
প্রথম দিন
ইংরেজ আমলে রাজকর্মচারীদের মধ্যে ফেয়ারওয়েল ট্রিপ বলে একটি কথা খুব চালু ছিল। অর্থাৎ উচ্চপদস্থ কোনও সরকারি কর্মচারী বদলি অথবা অবসর গ্রহণের আগে, তার এলাকাভুক্ত সকল অধস্তন অফিসগুলি ঘুরে দেখতেন, যথা জেলাশাসক যেতেন মহকুমা অফিসগুলিতে। স্বাধীনতার পরেও দশক চার-পাঁচেক প্রথাটি বহাল ছিল। এবং এই উপলক্ষে খাওয়াদাওয়া, উপহার প্রদান, অশ্রুপাত ইত্যাদি প্রভৃতি।
তাই জানুয়ারি মাসের শুরুতে অফিস থেকে আমার যখন বাঁকুড়া যাওয়ার হুকুম হল, আমি উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী না হয়েও নিজেকে উচ্চপদস্থ ভাবতে শুরু করলাম। আমার জন্ম ১৯৫৯-এর জানুয়ারিতে। ২০১৯ এর জানুয়ারিতে ষাট পূর্ণ হয়ে ৩১শে জানুয়ারি অপরাহ্ণে চাকরিজীবন থেকে মিলিয়ে যাওয়ার কথা। তার আগে এই!!
বাড়ি থেকে বেরিয়ে দ্বিতীয় সেতু, বর্ধমান। তারপর দামোদর পেরিয়ে, বর্ধমান বাঁকুড়া রোড ধরে দামোদরের শাখানদী বোদাই-এর দক্ষিণতীরে হদলনারায়ণপুর গ্রামে। হদলনারায়ণপুর গ্রামের মন্ডল উপাধিধারী জমিদার পরিবারের আদিপুরুষ মুচিরাম ঘোষ মল্লরাজা গোপাল সিংহের রাজত্বকালে (১৭২০-১৭৫২) নীলপুর থেকে এসে এখানে বসবাস শুরু করেন। তারপর গোপাল সিংহের সভাসদ গণিতজ্ঞ শুভঙ্কর দাসের সঙ্গে আলাপ হয়ে মুচিরামের কপাল খুলল – প্রথমে হদলনারায়ণপুরের প্রশাসক পদ লাভ, তৎপরে মন্ডলপতি উপাধি। ক্রমে জমিদারি বিস্তার, অট্টালিকা ও মন্দির স্থাপন। বালজাকের বিখ্যাত উক্তি - Le secret des grandes fortunes sans cause apparente est un crime oublié, parce qu' il a été proprement fait (Behind every great fortune, there is a crime which has not been found) মেনে পরিবারের আয়ের প্রধান উৎস ছিল নীল চাষ।
গ্রামে ঢোকার মুখেই ব্রহ্মাণী দেবীর দালান মন্দির; কষ্ঠিপাথরের মূর্তিটি উচ্চতায় ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি, প্রস্থ ২ ফিট ১১ ইঞ্চি। মূর্তিটির পায়ে, দুই পাশে এবং পিছনের খিলানে সবশুদ্ধু পাঁচটি প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুণ্ডের অনুকৃতি থেকে পণ্ডিতদের ধারণা ইনি 'পঞ্চকুণ্ডাঅগ্নিমধ্যস্থা' পার্বতী। কখনও কোন এক "মুড়োকাটা" চক্রবর্তী এখানে বসতি স্থাপন করেন। তাঁর বালবিধবা মেয়ে স্বপ্নাদেশ পেয়ে দামোদরের দহ থেকে এই মূর্তি উদ্ধার করেন। মতান্তরে রানি ময়রা নামের এক তাম্বুলি মহিলা স্বপ্নাদেশ পেয়ে দামোদরের পাশে গভীর কাদার ভিতর থেকে মূর্তিটি উদ্ধার করে প্রতিষ্ঠা করেন। দামোদরে মূর্তির ছড়াছড়ি চিরদিনই; বর্ধমানের কাঞ্চননগরের কঙ্কালেশ্বরী কালীবাড়ির তিন ফুট চওড়া ও পাঁচ ফুট লম্বা অখণ্ড পাথরে খোদিত অপ্রথানুগ অষ্টভূজা বিগ্রহটিও দামোদরে পাওয়া গিয়েছিল ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে।
হদলনারায়ণপুরের অপরাপর দ্রষ্টব্য মন্ডল পরিবারের বসতবাড়ি, রাসমঞ্চ এবং তাঁদের নির্মিত তিনটি টেরাকোটা মন্দির (বড় তরফ, মেজ তরফ ও ছোট তরফ)। মন্ডল পরিবারের বড় তরফের প্রাসাদোপম দোতলা অট্টালিকাটি মহামহিম। পশ্চিমবাংলার গ্রামে এহেন সাতমহলা বসতবাড়ি বিরল। বসতবাটির প্রাঙ্গণে সতেরো চূড়াবিশিষ্ট,আটকোণা,দ্বিতল রাসমঞ্চ; উচ্চতা ৪০ ফুট এবং ভিত্তি বরাবর প্রতি দিকের দৈর্ঘ্য ৮ ফুট ৩ ইঞ্চি। দেওয়ালগাত্রে অনন্তশয়নে বিষ্ণু,পুত্রকন্যাসহ মহিষমর্দিনী, শিববিবাহ,কৃষ্ণের গোষ্ঠলীলা,গজলক্ষী,রামসীতা এবং কৃষ্ণরাধিকা। বসতবাটির ভিতরের উঠানে ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত রাধাদামোদরের ত্রিখিলান দালানসহ দক্ষিণমুখী পঞ্চরত্ন মন্দির।
গ্রামের উত্তর দিকে মেজ তরফের পূর্বমুখী রাধাদামোদরের নবরত্ন মন্দির; তার পূর্বে ও উত্তরে ত্রিখিলান দালান। মন্দিরের দেওয়ালের টেরাকোটা অনুপম, পূর্ব দিকের খিলানে লঙ্কা যুদ্ধ,অনন্তশায়ী বিষ্ণু,কৃষ্ণের চূড়াবাঁধা ও ষড়ভুজ গৌরাঙ্গ|
ছোটতরফের আবাসগৃহের প্রাঙ্গণে দক্ষিণমুখী নবরত্ন মন্দিরটির আদল গির্জার মত; সামনে ত্রিখিলান দালান, পশ্চিমে দেওয়াল ঘেঁষে সিঁড়ি। মন্দিরের দক্ষিণ ও পশ্চিম দেওয়ালে সূক্ষ্ম টেরাকোটা অলংকরণ। কেন্দ্রীয় খিলানের শীর্ষে অর্জুনের মৎসচক্ষু লক্ষ্যভেদের বড় প্যানেল। শ'দুয়েক বছর আগে বাবুরাম মন্ডল তার নাবালক পুত্র গঙ্গাগোবিন্দের নামে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।
তারপর সোনামুখী হয়ে বিষ্ণুপুর; তাকে পাশ কাটিয়ে পাঁচমুড়া। বাঁকুড়ার ঘোড়া (এবং হাতি,ষাঁড়,দুগ্গাঠাকুর...) বলে অধুনাখ্যাত গৃহসজ্জার উপকরণটি নির্মাণের শিল্পকেন্দ্রগুলি হল পাঁচমুড়া, রাজাগ্রাম, সোনামুখী ও হামিরপুর। প্রতিটি শিল্পকেন্দ্রের নিজস্ব ধাঁচ ও শৈলী রয়েছে,তবে সবাইকে ছাপিয়ে পাঁচমুড়াই এখন অতিখ্যাত। এখানকার শৈলীই সার্বজনীন মান্যতা পেয়েছে। মনস্কামনা পূর্ণ হওয়ার পর প্রতীকী কৃতজ্ঞতা প্রকাশের লৌকিক পন্থা অশ্বত্থ বেদিমূলে অথবা ধর্মরাজের থানে পোড়ামাটির ঘোড়া প্রদান। গ্রামীণ ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের জন্য সৃষ্টি হয়ে রূপারোপিত পোড়ামাটির ঘোড়া আজ বিশ্বখ্যাত। এর অভ্যন্তরভাগ ফাঁপা; বিভিন্ন অংশ পৃথক পৃথকভাবে কুমোরের চাকায় নির্মিত হওয়ার পর সেগুলিকে জোড়া দেওয়া হয়। কাঁচামাটি দিয়ে তৈরি পাতার মতো আকৃতিবিশিষ্ট কান ও লেজ ঘোড়ার দেহের তিনটি গর্তে প্রতিস্থাপিত হয়।
গ্রামের প্রতিটি ঘরেই এই কাজ হয়,তালড্যাংরা থানার এই গ্রামে টেরাকোটা শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন কুম্ভকার সম্প্রদায়ের প্রায় তিনশো শিল্পী৷ প্রতিটি বাড়িই একটি করে স্টল৷ সেখানেই ঘরের ভিতর,বারান্দায় পসরা সাজানো৷ পাশেই পসরা বানাচ্ছেন শিল্পীরা৷ শিল্পবস্তুর পাশাপাশি তৈরি হচ্ছে প্রাত্যহিক কাজে ব্যবহৃত রান্নার হাঁড়ি, খোলা, ভাঁড়, জলের কলসি, জালা,সরা...। শিল্পবস্তুতে ব্যবহৃত রঙ বাজারের কোনও রাসায়নিক রঙ নয়,জমি এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে ঘরের মেয়েদের দ্বারা সংগৃহীত। মাটির সামগ্রী পুড়ে কালো বা লাল হওয়া পুরোটাই কৌশলের উপর নির্ভর করে। লাল রঙ করার জন্যে ভাটির ভিতর উৎপন্ন ধোঁয়াকে বের করে দেওয়া হয় ভাটির গায়ের বিভিন্ন গর্তের মাধ্যমে। এবং কালো রঙ করার জন্যে গর্তগুলিকে বন্ধ করে উৎপন্ন ধোঁয়াকে বাইরে বেরতে দেওয়া হয় না।
তালড্যাংরা থেকে বাঁকুড়া। শহরে ঢোকার আগে এক্তেশ্বর শিব মন্দিরে। দ্বারকেশ্বর নদের তীরে এই মন্দিরে শিবের রুদ্রমূর্তির একটি অদ্ভুত উদ্ভাস একপদ রূপ পূজিত হয়। বিগ্রহের এক পা কিন্তু দুই হাত। এই ধরনের শিবমূর্তি অন্য কোনও শিবমন্দিরে নেই। বিষ্ণুপুরের রাজা এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন ল্যাটেরাইটে, পরবর্তীকালে বেলেপাথর ও ইটের কাজ যুক্ত হয়েছে। মন্দিরটির কাঠামো অত্যন্ত দৃঢ়,যা বাংলার অন্যান্য মন্দিরে সাধারণত দেখা যায় না। মন্দিরটি বাংলার নিজস্ব শৈলীরও নয়।
কিংবদন্তি অনুসারে, বিষ্ণুপুর ও সামন্তভূম রাজ্যের মধ্যে সীমান্ত-সংক্রান্ত বিবাদের নিষ্পত্তি করার জন্য স্বয়ং শিব দুই রাজ্যের সীমানাতে স্থিত হয়ে তাদের মধ্যে একতা তৈরি করেন;তাই তিনি একতার ঈশ্বর এক্তেশ্বর। এরকমটি স্বচ্ছন্দে ভেবে নেওয়া যেতে পারে যে সীমানা নির্দেশক স্মারকরূপেই মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল। নবম শতকে মন্দির নির্মাণ করা হতো ত্রিরথ আসনে। মন্দির দেওয়ালের পাদদেশ অধিকার করেছিল তিনটি মোল্ডিং-এর বেদিবন্ধ। মোল্ডিংগুলির একটি ছিল বর্তুলাকার। এই মন্দিরটিই এই শৈলীর একতম নিদর্শন। বেদিবন্ধের উপর থেকে মন্দিরের আদিরূপ সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়েছে। এক্তেশ্বরের গর্ভগৃহে কূপসদৃশ গভীর মেঝে বাংলার প্রস্তর মন্দির স্থাপত্যের ক্ষেত্রে একক উদাহরণ,যদিও প্রতিবেশী উড়িষ্যা রাজ্যে এরকম অনেক নিদর্শন রয়েছে। তবে পুরোহিত আপনাকে বোঝাবেন যে এই মন্দিরটি দ্বাপরযুগে পান্ডবদের নির্দেশে স্বর্গের স্থপতি দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা দ্বারা নির্মিত; বা দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য এখানে ধ্যান করে সঞ্জীবনী মন্ত্র লাভ করেছিলেন। গবেষকদের একাংশের মতে এটি জৈন মন্দির; কালক্রমে হিন্দু মন্দির হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। সংলগ্ন অঞ্চলটির নামও এক্তেশ্বর। আগে বর্ষায় দ্বারকেশ্বর মন্দির ভাসাত। সম্প্রতি রাজ্য সেচ দফতর দ্বারকেশ্বরের পাড় বাঁধিয়ে মন্দিরটিকে রক্ষা করেছেন। সারা শ্রাবণমাস ভক্তরা শুশুনিয়া পাহাড়ের ঝরনার জল নিয়ে এসে এখানে শিবের মাথায় ঢালেন। প্রতিবার বাংলা বছরের শেষের তিনদিন এখানে গাজন বসে। প্রথম দিন পাটস্নান, দ্বিতীয় দিন রাতগাজন ও তৃতীয় দিন দিনগাজন। গাজনের মেলা ছাড়া শিবরাত্রি ও পৌষ সংক্রান্তিতে আরও দুটো মেলা হয় এক্তেশ্বরে।
অফিসের কাজকম্ম কিছুটা সেরে সন্ধ্যায় রানীগঞ্জ-মেজিয়া-বাঁকুড়া রাজপথ ধরে বাঁকুড়া শহরে ঢোকার ঠিক আগেই বাঁ দিকে বিকনা, দেড়শ বছরেরও বেশি সময় ধরে ডোকরা গ্রাম বলে পরিচিত। গ্রামের গোটা চল্লিশেক ঘরের বাসিন্দারা সকলেই পুরুষানুক্রমে ডোকরা শিল্পী। ঢুকেই মনসা দেবীর থান এবং বিভিন্ন ভোটিভ মূর্তি; তখনও শিল্পীরা কাজ করছেন। অতিশয় জটিল এবং অনেকগুলি ধাপের মধ্যে দিয়ে চলেছে পিতল ঢালাইয়ের কাজ।
ডোকরাতে পিতল গলানোর কাজটি আগে করা হত কয়লার ভাটিতে। পরিবেশ দূষণ কমাতে ও শিল্পীদের স্বাস্থ্যের কথা ভেবে এখন এসেছে ইলেকট্রিক বা গ্যাস ওভেন। প্রথমে মোমের ওপর নকশা তোলা হয়, এর পর দেওয়া হয় বালি আর মাটির আস্তরন। দু ধরনের স্তর থাকে, প্রথমে লোনা মাটি, দ্বিতীয় স্তরে লোটা মাটি। তারপর পিতল গলিয়ে সেটি একটি ছিদ্র দিয়ে ঢেলে দেওয়া হয় মাটির ছাঁচে। ঠান্ডা হলে মাটির ছাঁচটিকে ভেঙ্গে বার করা হয় শিল্পবস্তুটিকে। বাজারের সঙ্গে তাল রেখে, জনরুচির সঙ্গে কিঞ্চিৎ আপোষে, শিল্পে অধুনা কিঞ্চিৎ পরিবর্তনের হাওয়া। অনেক লোকশিল্পের মতই ডোকরার মধ্যে একটা rustic character ছিল। পরিশীলিত রুচির বাবুমশাইদের কাছে বিক্রি করার দায়ে বাংলার ডোকরার কাজে কোণাচে ভাব এখন কমার মুখে,তার জায়গা নিচ্ছে উড়িষ্যার মতন সুতোর কাজ, বস্তারের মত পালিশ। ঠিক যেমন খোলা আকাশের নিচে ধর্মরাজের থানে পড়ে থাকা গ্রাম্য,অসভ্য,গেঁয়ো,সরল সাদাসিধা অকর্ষিত অসংস্কৃত পাঁচমুড়ার ঘোড়া শহুরে মধ্যবিত্তের ফ্ল্যাটের কোণে ঠাঁই পাওয়ার তাগিদে আজ পালিশ খায়, গহনা পরে।
দ্বিতীয় দিন
বাঁকুড়ায় অবস্থিতি কলেজ মোড়ে রাস্তার ওপরেই বালিকা বিদ্যালয়ের বিপরীতের বাংলোতে। সকালবেলা বাংলোটাকে দেখে মন খারাপ হয়ে গেল। বিগত আটতিরিশ বছর কাজে অকাজে, দরকারে অদরকারে, পশ্চিমবঙ্গের সদর মফস্বলে ছড়িয়ে থাকা সরকারের বিভিন্ন দফতরের ডাকবাংলো, পরিদর্শন বাংলো, গেস্ট হাউস, সার্কিট হাউসে রাত্রিবাস করেছি। শুরু হয়েছিল মালদা শহরের মকদুমপুরের বারলো গার্লস স্কুলের বিপরীতের ডাকবাংলো দিয়ে, যৌবনের উপবন মালদা পঞ্চানন্দপুরের সেই গঙ্গা ভবন আজ নিহিত পাতালছায়ায়। আর শেষ হল এখানে। আগামীমাস থেকে আর কেউ আমার জন্যে কোনও বাংলোর গেট খুলে দাঁড়াবে না। সে হোকগে! এককালে বেড়াতে গিয়ে সরকারি থাকার জায়গা না হলে চলতো না, কারন বেসরকারি ব্যবস্থা বলতে তেমন কিছু ছিল না। এখন চিত্রটি অনেকখানিই বদলেছে।
অনেক রাত অবধি বাংলোয় কাজ করেছি, সকালেও আবার তাই নিয়ে বসা গেল। দশটায় অফিস। কাজ কিছুটা সেরে বেরনো হল। প্রথম গন্তব্য ঝিলিমিলি। সন্ধ্যারাগে ঝিলিমিলি ঝিলমের স্রোতখানি বাঁকা, আঁধারে মলিন হল।
ঝিলিমিলি যাওয়ার পথের দুধারে অরণ্যানী, তার মধ্য দিয়ে কংসাবতী প্রবাহিতা। ওয়াচ টাওয়ার থেকে দৃষ্টি অবাধ চরাচরে তীব্র নির্জনতা। কূজন, কাঠবিড়ালি, মধ্যে মধ্যে বনমুরগির আশ্লেষ, শালের জঙ্গল, লাল মাটির রাস্তা, আর আদিগন্ত সবুজ। টুসু পরব এইসময়েই। এখান থেকে তালবেরিয়া ড্যাম আট কিলোমিটার। আরণ্যক টিলায় ঘেরা অনেকখানি স্বচ্ছ টলটলে জল। তারপর সুতানের জঙ্গল-শাল, পিয়াল মহুয়া কেন্দ শিরিষ, সেগুন শিমুল পলাশ কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়া খিরিশ আকাশমণি। তার মধ্যেই 'বারো মাইল ভিউ পয়েন্ট'; রাস্তার ধারে দুটি ওয়াচ টাওয়ার। এলিফ্যান্ট করিডর, জঙ্গলে ঢাকা বিস্তৃত উপত্যকা, দূরবর্তী গ্রাম, কাঁসাই মুকুটমণিপুর মাখামাখি সে এক জমজমাট ব্যাপার। এই জঙ্গলে তেমন জন্তু জানোয়ার নেই।
সেখান থেকে মুকুটমণিপুর। শীতের ছোট বেলা ততক্ষণে পড়ে এসেছে। গাড়ির সামনে কিছু কাগজপত্র লাগানো ছিল; তাই বাঁধের পাড় বরাবর গাড়ি নিয়ে চলার অনুমতি পাওয়া গেল। কংসাবতী আর কুমারী নদীর সঙ্গমে বাঁধ, জলের ছলচ্ছল। আকাশ অস্তাভায় রঙিন, অনেকদূর দিয়ে একটু আগে ক্যাথে-প্যাসিফিকের মালবাহী বিমান উড়ে গেছে মুম্বই থেকে হংকং, আটতিরিশ হাজার ফুট দিয়ে; রেখে গেছে ধোঁয়ার দুটি রেখা। রাস্তার একদিকে কংসাবতীর ব্যাপ্ত জল আর অন্যদিকে পাহাড় আর ছোট ছোট গ্রাম। পাশের গ্রাম থেকে মেয়েরা দল বেঁধে এসেছে, পাঁইপাঁই করে সাইকেল চালাচ্ছে। চারিদিকে পাখির ডাক। শুধু ঝালমুড়িওয়ালা ফুচকাওয়ালারই অভাব। চাইলে নৌকো করে এখানে ড্যামের মধ্যে ঘোরা যায়; কংসাবতী ও কুমারী নদীর মোহনা থেকে নৌকো চড়ে নদীর ওপারে যাওয়া যায় আর সেখান থেকে ডিয়ার পার্কে যাওয়া যায়। তবে আমার সেই সময় বা সাহস হয়নি।
টিলার ঢালে ওয়েস্ট বেঙ্গল ফরেস্ট ডেভেলপমেন্টের সোনাঝুরি টুরিস্টলজটি সরকারি, আর টিলাশীর্ষের বনবাংলোর পথ -প্যাঁচানো চড়াই। বাঁধ ধরে ছয় কিলোমিটার গেলে পরেশনাথ টিলায় পার্শ্বনাথ স্বামীর মন্দির। নদী পেরিয়ে আরও দেড় কিলোমিটার গেলে সবুজদ্বীপ। আরও চার কিলোমিটার গেলে গোরাবাড়ি পেরিয়ে অম্বিকানগর – অতীতের কীর্তিখ্যাত রাজা অনন্তধবল দেও-এর অম্বিকা মন্দির। এক সময়ে এই স্থান ছিল জৈন ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ পীঠস্থান। ইতিউতি খুঁজলে পাওয়া যায় ভাঙা মূর্তির অংশও। কিছুটা এগিয়ে ব্যারেজ; সেচের কাজে জল ছাড়া হয়। আপাতত লকগেট বন্ধ।
বাংলোর ডাল-ভাত এই শীতে পছন্দ হচ্ছিল না। তাই অনেক রাতে খেতে যাওয়া হল দ্বারকেশ্বর পেরিয়ে ধলডাঙ্গা বলে একজায়গায়, ধাবাতে। যাওয়ার পথে ভৈরবস্থানে; কাল শিব দেখেছি, এবার কালী না দেখলে হয় নাকি! মাকে পাত্তা না দিলে বাবা নাকি খুব অসন্তুষ্ট হন, দেওঘরের পান্ডা অনেক বছর আগে এমনটি বলেছিলেন। তাই শহরের ভৈরবস্থানে -যেখানে মহাকাল ভৈরব ও মহাকালীর অবস্থান পাশাপাশি। আশি বছর আগে এই ভৈরবস্থানকে দেবস্থান হিসাবে আবিষ্কার করেন জনৈক জয়দেব বন্দ্যোপাধ্যায়; মন্দিরটি পারিবারিক হলেও প্রবেশাধিকার অবাধ। তবে মন্দিরটির সর্বাঙ্গে যেন মেঠো বন্যতার ছাপ। তাই দেখে পণ্ডিতদের ধারণা দক্ষিণ রাঢ়বঙ্গে আর্যীকরণের আগে থেকেই দেবস্থানটি ছিল। পরবর্তীকালে দক্ষিণ রাঢ়বাংলার আর্যীকরণকালে আদিবাসীরা ক্রমশ দক্ষিণে চলে যাওয়ায় ধর্মস্থানটিতে আর্য প্রভাব পড়ে; বটবৃক্ষের নিচে ঠাঁই পায় মহাকাল ভৈরব। তাঁর নিঃসঙ্গতা ঘোচাতে স্থাপন করা হয় মহাকালীকে।
ধলডাঙ্গারধাবার সামনে তখন সারি সারি কলকাতাগামী বাস দাঁড়িয়ে। পেট পুরে খেয়েদেয়ে কনকনে শীতে অনেক রাতে বাংলোয়।
তৃতীয় দিন
ড. মিহির চৌধুরী কামিল্যা ভাষাতাত্ত্বিক তথ্যপ্রমাণের সাহায্যে প্রমাণ করেছেন, 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' রচয়িতা বড়ু চণ্ডীদাস বাঁকুড়া জেলার ছাতনার অধিবাসী ছিলেন। মৌখিক ইতিহাস বলে গৌড়ের নবাবের বেগম (মতান্তরে কন্যা) রাজসভায় চণ্ডীদাসের ভক্তি-প্রেমের গান শুনে মুগ্ধ হন, চণ্ডীদাসের গুণের অনুরাগিণী হয়ে পড়েন। ঈর্ষাকাতর নবাব চণ্ডীদাসকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। হস্তিপৃষ্ঠে আবদ্ধ চণ্ডীদাস কশাঘাতে মৃত্যুবরণ করেন, বেগম সেই দৃশ্য দেখে শোকে মুর্চ্ছিতা হয়ে প্রাণবিয়োগ করেন। ছাতনায় বাসলি দেবীর দুটি মন্দির। পুরাতন মন্দিরটির ভিত্তিবেদি অতি উঁচু, পাথরের চৌকাঠগুলির গায়ে পদ্মের বড় বড় নকশা। প্রতিতুলনায় ১৮৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত পঞ্চরত্ন মন্দিরটি নবীন, ঝকঝকে। লোক বিশ্বাসে বড়ু চণ্ডীদাস পূজিত বাসলি দেবীর মূর্তিটি তাঁর ভিটের আদি মন্দির থেকে প্রথমে বর্তমানে ভেঙে পড়া মন্দিরটিতে এনে রাখা হয়েছিল। পরে এই মন্দিরটি ভেঙে পড়লে সেটিকে পঞ্চরত্ন মন্দিরটিতে স্থানান্তরিত করা হয়।
ছাতনা চন্ডীদাস বিদ্যাপীঠের পিছনে গোলাকৃতি মজবুত ইটের সিমাফোর টাওয়ার। ১৮২০ সালে তদানীন্তন ভারত সরকার বার্তাপ্রেরণের মাধ্যম হিসেবে কলকাতা থেকে বোম্বাই পর্যন্ত প্রতি ৮ মাইল অন্তর ১০০ ফুট উঁচু এই টাওয়ারগুলি নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু পুরোপুরি রূপায়িত হবার আগেই উন্নত পদ্ধতিতে টেলিগ্রাফ আবিষ্কার হলে মাঝখানেই এই প্রকল্প পরিত্যক্ত হয়।
ছাতনা রেল স্টেশন থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে শুশুনিয়া পাহাড়, আর তাকে ঘিরে পর্যটনকেন্দ্র বিহারীনাথ; বাঁকুড়া জেলার উচ্চতম পাহাড় (১৪৮০ ফুট), এবং বনাঞ্চল। কিছু প্যালিওলিথিক প্রত্নসামগ্রী উদ্ধার হওয়ার পর থেকে এই পাহাড় ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলি নিয়ে পুরাতাত্ত্বিকরা আগ্রহী হন। একটি ছোট জলাধারকে আর একটি প্রাচীন জৈনমন্দির নিয়ে বিহারীনাথ। পশ্চিমবঙ্গের প্রাচীনতম শিলালিপিটি এই পাহাড়েই অবস্থিত। নৈঃশব্দ ঘিরে আছে পাহাড়ে।
সেখান থেকে শাল, সেগুন, মহুয়াঘেরা আদিবাসী গ্রাম বড়ন্তি। খান বিশেক পরিবারের গ্রামটির প্রতিটি বাড়ি যেন রং-তুলির ক্যানভাস। তার পাশেই ছোট ছোট টিলার মাঝে নীল আকাশের নীচে এক সুবিশাল হ্রদ মুরারডি। গ্রামের একদিকে পঞ্চকোট পাহাড় আর অন্যদিকে বিহারীনাথ পাহাড়। মুরাডি এবং বড়ন্তি পাহাড়ের মাঝে বিস্তৃত এলাকা জুড়ে সেচ বাঁধ। আর বাঁশ, শাল, পিয়াল, আমলকী, বহরা, হরিতকী, নিম; সারি সারি খেজুর গাছ। এছাড়া সর্বব্যাপী পলাশবন। বসন্ত হেথায় বড়ই মনোরম। প্রচুর পাখি আর প্রজাপতির আনাগোনা এখানে। বসন্ত আসছে বোঝা গেলো এখানে এসে। এখানকার বেল কার্ভ সদৃশ পাহাড়টি অতিখ্যাত।
বড়ন্তি থেকে সাঁতুরি শালতোড়া মেজিয়া হয়ে, দামোদর পেরিয়ে, রানীগঞ্জ। তারপর কলকাতা।
হিসাবশাস্ত্রের স্নাতকোত্তর শ্রী তপন পাল West Bengal Audit & Accounts Service থেকে অবসর নিয়েছেন সম্প্রতি। তাঁর উৎসাহের মূলক্ষেত্র রেল - বিশেষত রেলের ইতিহাস ও রেলের অর্থনীতি। সে বিষয়ে লেখালেখি সবই ইংরাজিতে। পাশাপাশি সাপ নিয়েও তাঁর উৎসাহ ও চর্চা। বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি এবং ইন্ডিয়ান রেলওয়ে ফ্যান ক্লাবের সদস্য শ্রী পালকে বাংলা লিখতে শিখিয়েছে 'আমাদের ছুটি'। স্বল্পদূরত্বের দিনান্তভ্রমণ শ্রী পালের শখ; কারণ 'একলা লোককে হোটেল ঘর দেয় না'।