পুরাভিদা কোস্টারিকা
শ্রাবণী ব্যানার্জী
বেশ কয়েক বছর ধরেই বন্ধু-বান্ধব মহলে কোস্টারিকা দেশটার খুব গুণগান শুনতে পাই। বিশেষ করে যারা মার্কিন মুল্লুকের পূর্ব দিকে থাকেন তারা যেন হঠাৎ করেই আবিষ্কার করে ফেলেছেন যে দশ-বারো ঘন্টা ধরে প্লেনে হাওয়াই যাওয়ার থেকে ঘরের কাছে কোস্টারিকাই ঢের ভালো। আগ্নেয়গিরি, উষ্ণপ্রসবণ থেকে ফল-ফুল ও সুন্দর সীবিচ্ নিয়ে এ নাকি অনেকটা হাওয়াই-এরই মিনি ভার্সান। অতএব কিছু দিন আগে আমরাও অত্যন্ত উৎসাহভরে কোস্টারিকার দিকেই রওনা হলাম। তাহলে আসুন সেখানে পৌঁছোনোর আগেই সে দেশটি সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ খোঁজ খবর নিয়ে নেওয়া যাক।
উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার মধ্যবর্তী দেশগুলির দিকে তাকালে মনে হয় তারা যেন একটি বড়সড় ডুগডুগির মধ্যভাগ, যেখানটিকে হাতে ধরে অতি অনায়াসেই নাড়িয়ে দেওয়া যায়। একদিকে আত্লান্তিক ও অন্যদিকের প্যাসিফিক বা প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝের এই দেশগুলি ক্ষমতা ও আকৃতি সব দিক থেকেই খুবই ছোট। কোস্টারিকাও এর ব্যতিক্রম নয়।
প্রায় দশ-বারো হাজার বছর আগে সেই সুদূর মঙ্গোলিয়া অঞ্চল থেকে শিকারের পিছু পিছু ধাওয়া করে একদা জোড়ালাগা উত্তর আমেরিকার বেরিং স্ট্রেট্ ধরে লোকজন এই মহাদেশগুলিতে প্রবেশ করে। এক সময়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য তারা সেই স্থানগুলিকে বেছে নেয় যা ছিল চাষআবাদের পক্ষে অনুকূল। তার ফলে চারিদিকে আগ্নেয়গিরি, পোকামাকড়, কুমীর ও জঙ্গলে ভরা আজকের এই কোস্টারিকা তাদের কাছে খুব আকর্ষণীয় ছিল না। পনেরোশো দুই সালে চতুর্থবার আমেরিকা পাড়ি দেবার সময়ে যখনক্রিষ্টোফার কলম্বাসের জাহাজ ঝড়ে ভেঙে যায়,তিনি একান্ত নিরুপায় হয়েই এদেশের উপকূলে নোঙ্গর ফেলতে বাধ্য হন। বলাবাহুল্য তখনও তিনি এদেশে বিরাট জনসংখ্যা কিছু দেখতে পাননি, কিন্তু অবাক হয়েছিলেন স্বল্পসংখ্যক এই মানুষগুলির অসম্ভব মিষ্টি ব্যবহারে। শুধু খাবারদাবার নয়, প্রচুর সোনার জিনিস দিয়ে তারা সম্পূর্ণ অপরিচিত সাদা মানুষগুলিকে এমনভাবে আপ্যায়ন করেছিল যে কলম্বাসের বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিল এরা নিশ্চয়ই খুব ধনী, তাই স্প্যানিশ ভাষায় জায়গাটির নাম রেখেছিলেন কোস্টারিকা, যার মানে ইংরাজীতে দাঁড়ায় রিচ্ কোষ্ট। যদিও পরবর্তীকালে স্প্যানিয়ার্ডরা এদেশটিকে দখল করতে এসে সোনাদানার থেকে ঢের বেশি সাপখোপ পোকামাকড় ও কুমীরের উপদ্রব দেখে মানে মানে সরে পড়ে, কিন্তু কোস্টারিকা বা রিচ্ কোস্ট নামটি কিন্তু থেকেই যায়।
মাত্র শ'দুয়েক বছর আগে যেন প্রায় হঠাৎ করেই ইউরোপীয়ানরা আবিষ্কার করে এদেশের আগ্নেয়গিরির উর্বর মাটিতে অত্যন্ত ভালো কফি তথা কলা, আনারস ইত্যাদি ফলানো সম্ভব। তারা শুধু গাছের চারা নয়,তার সঙ্গে জাহাজ বোঝাই করে নিয়ে আসে বেশ কিছু গরু।যাতে সেগুলি এদেশের অফুরন্ত গাছপালা খেয়ে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়ে প্রচুর দুধ দিতে পারে, তাহলে ভবিষ্যতে চীজ-এর ব্যবসায় সুবিধে হবে। আজ সেই গরুরা শুধু চীজ উৎপাদনে নয়, শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে যে রেটে বংশবৃদ্ধি করেছে তাতে রীতিমত ট্রাফিক বন্ধ রেখেই তেনারা গাড়ির রাস্তা দিয়ে হাঁটাচলা করেন।
কোস্টারিকার রাজধানী স্যান হোজে বিমান বন্দরে পৌঁছে টাকা ভাঙাতে গিয়ে রীতিমত অবাক হলাম। টাকার গায়ে বাঁদর, পাখি, হরিণ, জঙ্গলের ছবি দিয়ে যেন গোটা রেনফরেষ্টটাকেই চোখের সামনে তুলে ধরেছে। আমরা মূল শহরে না থেকে তার লাগোয়া সুন্দর করে সাজানো লাসাবানাতে ছিলাম। আমাদের হোটেলটির লবি শুরুই হয়েছে চোদ্দতলায়, তার নীচের তলাগুলি অফিস। সে রাত্রে কাঁচেঘেরা হোটেলে বসে চারিদিকে পাহাড়ের গায়ে আলোর চমক দেখে বড় ভালো লেগেছিল। এদেশের মাটিতে পা দিয়েই বুঝেছিলাম সামান্য কিছু মেলানো-মেশানো থাকলেও সাদা চামড়া অর্থাৎ ইউরোপীয়ানদের সংখ্যাই বেশি। ট্যাক্সি ড্রাইভাররা গাড়ির মিটারটিকে 'মারিয়া' বলে সম্বোধন করে। নাহ্, মিটার থেকে মারিয়া কথাটি আসেনি, এসেছে ভার্জিন মেরি থেকে। কারণ এদেশের ট্যাক্সি ড্রাইভাররা প্রমাণ করতে চায় তারা কতটা সৎ, যদিও পৃথিবীর আর পাঁচটা শহরের মত এদের সততাকেও একটু সন্দেহের চোখে দেখাই ভাল। সত্যি কথা বলতে কী গোটা দুয়েক মিউজিয়াম আর একটি বড়সড় থিয়েটার বিল্ডিং ছাড়া স্যান হোজেতে বিশেষ কিছুই দেখার নেই, তাই এদেশটিকে ভালো লাগাতে হলে শহর থেকে বেরিয়ে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
দেশটি সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই না জানায় প্রথম দুদিন ট্যুর কোম্পানীর সাহায্য নিলাম। শুরুতেই তারা নিয়ে গেল একটি কফি প্ল্যান্টেশনের জায়গায়। গাইড ঝোপের মত কফি গাছগুলির কাছে নিয়ে গিয়ে কত রকমের বীন্ থেকে আরম্ভ করে ঠিক কী কারণে কফির দামের তারতম্য হয় সেসব বোঝাতে লাগল। এখানে চকোলেটে মোড়ানো কফির দানা টেষ্ট করে এত ভালো লেগে গেল যে নিজের ব্লাড সুগারের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে একটা বড়সড় বাক্সই কিনে ফেললাম যাতে পথে যেতে যেতেই সেগুলির সদ্ব্যবহার করতে পারি। কর্মচারীরাও অত্যন্ত বুদ্ধিমান কোনও সন্দেহ নেই, কারণ তারা নিজেরা কষ্ট করে শুকোতে দেওয়া কফি বিনগুলি না তুলে ট্যুরিষ্টদের হাতেই বেলচা জাতীয় একটা কিছু ধরিয়ে দিয়েছে যাতে তারাই সেগুলিকে বস্তায় ভরতে পারে। একজন ট্যুরিষ্টকে জিজ্ঞাসা করায় বলল তারা আমেরিকার এক অত্যন্ত নামজাদা ট্যুর কোম্পানীর সঙ্গে এসেছে যাতে বেড়ানো ছাড়াও এদেশের সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে অংশগ্রহণ করার একটা অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারে। সেই অ্যাডভেঞ্চারের স্পিরিটেই তারা নাকি দুধ দোয়া থেকে রেস্টুরেন্টে গিয়ে কুটনো কোটা মায় রান্নাবান্না পর্যন্ত করে এসেছে। ট্যুর কোম্পানীগুলোর বিজ্ঞাপনের মাহাত্ম্য দেখে অত্যন্ত চমৎকৃত হলাম অর্থাৎ এ শুধু ফ্রি সার্ভিস নয়, একেবারে যাকে বলে গ্যাঁটের পয়সা খরচ করে ব্যাগার খাটা।
এরপর গেলাম পোয়াস্ ভলক্যানো দেখতে যার শেষ অগ্নুৎপাতটি ঘটে ২০০৯ সালে। সাবধানতা অবলম্বন করা সত্ত্বেও প্রায় গোটা চল্লিশেক মানুষ সেসময়ে এর শিকার হয়। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে নানা রঙের ফুল প্রজাপতি ও পাখি দেখেও খুব আনন্দ পেলাম বিশেষ করে টোকন্ পাখি যার ঠোঁটের সাইজ দেখলেই মাথা ঘুরে যায়। সাতশো মিটার উচ্চতায় ঝকঝকে রোদে হাল্কা ফিরোজা রঙের জলে ভরা ভলকানোর ক্রেটার দুটি দেখে সত্যিই মোহিত হয়ে গেলাম। গাইড বলল এটা জল নয়, পুরোটাই পরতে পরতে সালফার বা গন্ধক তারফলে সামান্য একটি পোকাও এখানে বাঁচতে পারে না কারণ এটাই পৃথিবীর সবথেকে বেশি অ্যাসিডে ভরা লেক। এ তল্লাটে হাঁটাটা যদিও একটু কষ্টকর, তবু একসময় হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম বোটস্ লেকে, তার রং আবার গাঢ় নীল। ফেরার পথে জঙ্গলের রাস্তায় শ্রান্ত এক মহিলা আর কতদূর হাঁটলে বোটস্ লেকটি দেখতে পাবেন জিজ্ঞাসা করায় অত্যন্ত উৎসাহভরে বললাম 'আর মাত্র পাঁচমিনিট, এই মেরে এনেছো প্রায়' তাতে ধন্যবাদের পরিবর্তে সেই বয়স্কা মহিলা রীতিমত খিঁচিয়ে উঠে বললেন, গত আধঘন্টা ধরে নাকি লোকজন ওনাকে 'ওনলি ফাইভ মিনিটস্ আর অলমোসট্ দেয়ার' কথাটা বলে আসছে।
জঙ্গলের মধ্যেই এক রেস্টুরেন্টে আমাদের মধ্যাহ্নভোজন সারা হল। এদেশের প্রধান খাদ্য দেখলাম গ্যালো পিন্টো রাইস যা কিনা পেঁয়াজ ও কালো বিন্ দিয়ে ভাজা ভাত। ইউরোপীয়ানরা আসার আগে যা ছিল এখানকার নেটিভদের খাদ্য, এখন অবশ্য সাইডে তার সাথে কলা সেদ্ধ বা ভাজাও দেওয়া হয়। এদেশে বহু রেস্টুরেন্টেই 'সেভিচে' বলে একটা ডিস্ দেখবেন যা কাঁচা মাছ, পেঁয়াজ, আদা, লাল লঙ্কা ও পাতিলেবুর রস সহযোগে তৈরি, কাঁচা মাছে আপত্তি না থাকলে এটি যথেষ্টই মুখরোচক। এছাড়া আমাদের মাছের পাতুড়ি স্টাইলের কলাপাতায় মোড়া তামালে তো আছেই। ভুট্টার গুঁড়োর আবরণের ভেতর আলু টমেটোর পুর দিয়ে বিভিন্ন ভাজা খেতেও এরা অভ্যস্ত, যদিও আয়ারল্যান্ডের মত এদের প্রধান খাদ্য আলু নয় বা ইতালিয়ানদের মত এরা জোর কদমে টমেটোও খায় না, তবুও আমরা যেন না ভুলি কোস্টারিকার মত মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলিই পৃথিবীর লোকের কাছে এই খাবারগুলি তুলে ধরে। আলু আর টমেটো এই অঞ্চলের মানুষেরই আবিষ্কার। যারা আজ ধূমপানে অভ্যস্ত তারাও কি তামাকবিহীন ধূমপানের কথা ভাবতে পারতেন? কারণ তামাকও এদেরই অবদান। টমেটোপেস্টবিহীন পিৎজা, গরম গরম আলুর চপ ছাড়া মুড়ি, আলুশূন্য আলুকাবলি বা শেষপাতে একটু টমেটো চাটনি ছাড়া খিচুড়ি খাওয়ার কথা ভাবতেও যেন কষ্ট হয়। কিন্তু কলম্বাস নতুন মহাদেশ আবিষ্কার করার পূর্বে অর্থাৎ মাত্র পাঁচশো বছর আগেও আমাদের তথা গোটা পৃথিবীর লোকের কাছেই এগুলি ছিল সম্পূর্ণ অজানা। সেদিন ভোজনের পর লাপাজ জলপ্রপাতের কাছে গিয়ে দেখি, সেটিকে ব্যাক্গ্রাউন্ডে রেখে বেশ কিছু অল্পবয়সী ভারতীয় মেয়ে বিভিন্ন পোজে হিন্দি সিনেমার নায়িকাদের স্টাইলে ছবি তুলে যাচ্ছে। রকমসকম দেখে মনে হল এই সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যটিকে বোধহয় এদের ভবিষ্যতে ছবিতে দেখেই উপভোগ করতে হবে। জলপ্রপাতের আশেপাশে ছোট ছোট হামিংবার্ডদের বনবন্ করে পাখা ঘোরানো দেখেও মুখ হাঁ হয়ে যায় যেন এক-একটা মিনি ফ্যান প্রচন্ড গতিতে ঘুরে যাচ্ছে।
এরপর সার্চি বলে একটি জায়গায় এদেশের হাতের কাজ দেখতে গেলাম যেখানে নানা ধরণের পাথরের মূর্তির সাথে রংবেরঙের চাকাও চোখে পড়ল। এদেশে অবশ্য কারোর কোনও তাড়া নেই, দেখলাম বেশ কিছু গরু বড় রাস্তা দিয়েই হাঁটাচলা করছে আর গাড়িগুলো ধৈর্যসহকারে তাদের চলে যাবার অপেক্ষায় আছে। একটি মেয়ে আবার বিভিন্ন স্বাদের চিজের টুকরো ট্যুরিষ্টদের হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে, যাতে ভালোলাগা মাত্রই তাদের কাছে গছিয়ে দিতে পারে। এখান থেকে আরিনাল ভলকানো পর্যন্ত যেতে অনেকটা সময় লাগে তাই অবসর বিনোদনের জন্য আমাদের গাইড এদেশ কতটা ভালো সেই গুণগান করে কানের গোড়ায় মধুবর্ষণ করতে লাগল। গত ষাট বছর ধরেই এদেশে মিলিটারির পেছনে টাকা খরচ না করে সেই টাকায় বাচ্চাদের ফ্রিতে স্কুলে পড়ানো হয়, তার ফলে এদেশে শতকরা ছিয়ানব্বই ভাগ লোকজন নাকি শিক্ষিত। এদেশে বাচ্চারা স্কুলে ফ্রিতে খেতেও পায়, তাই মিলিটারির পেছনে অপচয় না করে সেটিকে সৎকাজে লাগায়। পাশ থেকে একটি অবশ্যম্ভাবী স্বগতোক্তি কানে এল - কিছু বাঁদর ছাড়া আর কেই-বা এদেশ দখল করতে আসবে যে মিলিটারির পেছনে টাকা ঢালতে হবে? কথাটার মধ্যে আংশিক সত্যতা বা যুক্তি থাকলেও পুরোটা অবশ্যই নয়। নিকারাগুয়া বা পানামার মত প্রতিবেশী দেশগুলি যেখানে কিনা অবাধে ড্রাগের ব্যবসা চলে, তারা এই মিলিটারিবিহীন দেশটিতে ঢুকে অনায়াসেই রাজত্ব চালাতে পারত, কিন্তু পারেনি শুধু একটাই কারণে যে এদের এক অতীব শক্তিশালী দাদা খুব কাছেপিঠেই আছেন যার নাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিবেশী দেশগুলি মোক্ষমভাবেই জানে যে এরা কার ছত্রছায়ায় আছে, তাই ঘাঁটাতে সাহস পায় না। পানামার একদা মিলিটারি লিডার মানুয়েল নরিয়েগার কথাই ভেবে দেখুন আমেরিকার সাথে এঁটে উঠতে না পেরে গত পঁচিশ বছর ধরে জেলখানার জাঁতাকলেই ইঁদুরের মত আটকে থেকে মাত্র কিছুকাল আগে দেহ রেখেছেন। অতএব অন্যের ঘাড় দিয়ে যদি সুরক্ষাটি হয়েই যায় তাহলে এরাই বা খামোকা টাকা খরচ করে মরে কেন। বুদ্ধিমান জাত কোনও সন্দেহ নেই আর দাদাগিরির ব্যাপারেও আমেরিকারও কোনও জুড়ি নেই।
বেলা হয়ে যাওয়ায় একসময় আমাদের মধ্যাহ্নভোজনের জন্য নামিয়ে দেওয়া হল। রেস্টুরেন্টে হঠাৎ বাংলায় কথা শুনে চমকে উঠলাম। এক মহিলা সেলফোনে চিৎকার করে বলছেন - 'আরে ভাবতে পারবি না এদেশে পেয়ারার কী সাইজ আর তেমনি পাকা পেঁপে!' বাঙালির দর্শন পেয়ে আলাপ করার লোভটাও সামলাতে পারলাম না, শুনলাম ওনারা টেক্সাসের বাসিন্দা।
আরিনাল ভলকানো পৌঁছে তার আশেপাশে সবুজের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। যদিও বহুদিনই অগ্নুৎপাত হয়নি তবু সে এখনও জীবন্ত। এই আগ্নেয়গিরির দেশে আশেপাশে উষ্ণপ্রস্রবণ বা হট্ স্প্রিং থাকাটা আদৌ অস্বাভাবিক নয় আর এরপর সেরকমই একটি জায়গায় আমাদের নিয়ে যাওয়া হল।
এই বলডি উষ্ণ প্রস্রবণের এলাকাটি এতটাই বড় ও চারিদিকে এমনভাবে গাছপালা ও ফুল দিয়ে সাজানো যে ঢুকলে রীতিমত তাক্ লেগে যায়। প্রায় গোটা পনেরো বিশাল গরম জলের পুল যার কোথাও ওপর থেকে ঝরনার মত জলের ধারা আর কোথাও বা বাচ্চাদের জন্য পেল্লাই ওয়াটার স্লাইড। শুধু তাই নয় অনেক পুলের মধ্যে আবার বড় বড় ভাসমান বার যাতে শরীর ডুবোনো ও সুরাপান দুটি কাজ এক যোগেই সারা যায়। সামলাতে না পারলেও কোনও আনন্দরসে বঞ্চিত হওয়াই আমার ধর্ম নয়, তাই মদিরাহস্তে আমিও শরীরটাকে গরম জলে ডুবিয়ে দিলাম। কিঞ্চিৎ পান করার পরই মাথা ঝিমঝিম করে উঠল, অগত্যা পানীয় শেষ করার দিকে নজর না দিয়ে বার-এর মূল্য চোকাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। বারটেন্ডার হাঁ করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল ভাবখানা এমন –
এখনও তোমার পান, বন্ধু, হয়নিতো অবসান
তবু এখনি যাবে কি চলি -
সে রাত্রের ডিনার আগ্নেয়গিরির পাদদেশে একটি রেস্টুরেন্টে সারা হল। চারিদিকে জঙ্গলে ঘেরা রেস্টুরেন্টের পাশেই আবার একটি হোটেল যার সম্মুখে হেলিপ্যাড। চারিপাশে রংবেরঙের ফুল ঝরনা সবকিছু নিয়ে যাকে বলে একেবারে এলাহি কান্ড। রাত্রে এ জায়গা দেখলাম আবার নবরূপে জেগে উঠল। বিভিন্ন রঙের আলো ফুল ঝরনার ওপর পড়ে যেন এক স্বপ্নপুরীর আকার নিল, ইংরাজিতে যাকে বলে ম্যাজিকাল অ্যাটমোস্ফেয়ার।
শেষ তিনদিন আমরা প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে মানুয়েল আন্তোনিয়ে বলে একটি জায়গায় ছিলাম। জঙ্গল, ক্যানোপি ট্যুর ও সুন্দর সীবিচ্ ছাড়াও এ জায়গাটি তার ন্যাশনাল পার্কের জন্য বিখ্যাত। সকাল সাতটায় খোলার সঙ্গে সঙ্গেই ঢুকে পড়লে জীবজন্তু বেশি দেখার সম্ভাবনা, কারণ সেটা তাদের প্রাতরাশের সময়। সাইনবোর্ডে লিখিতভাবে মানা করা হলেও দেখলাম কিছু ট্যুরিষ্ট বাঁদরদের বাদাম খেতে দিচ্ছে কারণ তারা নাকি অত্যন্ত কিউট! কেউ কেউ জঙ্গলে টারজানের মত খেল দেখাচ্ছে আর কেউবা পূর্ণ উল্লাসে ট্যুরিস্টদের পেছনে লেগেছে। আমার চোখের সামনেই এক বাঁদর গাছ থেকে ঝুলে এক ভদ্রলোকের মাথা থেকে বেসবল ক্যাপ হাওয়া করে দিল আর একটি বাঁদর একটি পিকনিক টেবিল থেকে সোডার বোতল নিয়ে চম্পট দিল। চালচলনে নিঃসন্দেহে তেনারা কিউট্, যতক্ষণ আমার নয় অন্যের মাথার টুপি টার্গেট করছে। এক আমেরিকান মহিলার সঙ্গে সামান্য গল্প জুড়েছিলাম কিন্তু সেই অন্যমনস্কতার সুযোগে এক বাঁদর সেল্ফিস্টিক্ সমেতই ক্যামেরাটিকে সটান্ তার কাছে টেনে নিল। রাগার পরিবর্তে ভদ্রমহিলা তো হেসেই খুন ভাবখানা এমন আহা বাঁদর বলে কি একটু সেল্ফি তোলার সখ হতে নেই? অগত্যা অন্যের ক্যামেরা ধরা অবস্থায় আমিই বাঁদরটির একটি ছবি তুলে নিলাম। হঠাৎ খেয়াল করলাম ঠিক আমার মাথার ওপরেই গাছে একটি স্লথ শুয়ে আছে, অতএব বেশীক্ষণ তার তলায় দাঁড়ানোর ঝুঁকিটা আর নিলাম না।
ন্যাশনাল পার্কের বাইরেই দেখলাম লোকজন ডাব বিক্রি করছে। কাছে যেতে বলল এক একটি চার ডলার। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন এঁরা নিজেদের কারেন্সির বদলে ডলারে দাম বলাটাকেই সুবিধাজনক বলে মনে করেন। দাম শুনেই মাথা চড়ে গেল যেখানে চারিদিকে নারকেল গাছের সারি সেখানে ডাবের এত দাম হয় কি করে? ঝগড়া করার অদম্য ইচ্ছা থাকলেও আমার স্প্যানিশের যা দৌড় তাতে ভাষার পরিবর্তে সদ্য দেখে আসা বাঁদরদের মত কিছুটা দাঁতমুখ খিচোনোই সার হত। তাছাড়া গাছে যতই ডাব ঝুলুক না কেন সেগুলিকে নামিয়ে আনার ক্ষমতা যেখানে আমার নেই সেক্ষেত্রে দাম নামানোর দিকে মনঃসংযোগ করাই ভাল। চার থেকে দুই-এ নামাতে পেরেই নিজের ওপর কনফিডেন্স বেড়ে গেল, তাই দুটি ডাব কিনে গাছের তলায় গিয়ে বসলাম। এমন সময় একটি হরিণ ছলোছলো নয়নে আমার পাশে এসে দাঁড়াল। আহা এ যেন একেবারে পিওর শকুন্তলার সিন্, তাই অনতিবিলম্বে তাকেও ক্যামেরাবন্দী করে ফেললাম।
সারাদিন সমুদ্রের তীরে বসে বেগুনপোড়া হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়, তাই একটা পাবলিক বাস নিয়ে একটু গ্রামের দিকে চলে গেলাম। বাস দেখে তো আমি হাঁ একেবারে সুন্দর ঝকঝকে গদিআঁটা এসি বাস আর ভাড়াও অত্যন্ত কম। জানলার দিকে তাকিয়ে চারিদিকে জবা, কলকে, রঙ্গন, কৃষ্ণচূড়া আর আম কলা পেয়ারা ও নারকেল গাছের সারি দেখে আমার ছোটবেলায় বেড়ে ওঠার জায়গাটির কথাই মনে পড়ে যাচ্ছিল। এখন অবশ্য তা শুধু স্মৃতিতেই হাতড়ানো সম্ভব, গাছপালার পরিবর্তে এখন সেখানে শুধুই কংক্রিটের জঙ্গল। এক জায়গায় বাস কিছুক্ষণের জন্য থামল, দেখলাম গ্রাম বাংলার মতই বেশ বড়সড় একটা হাট বসেছে। ফল-সবজি থেকে মাটির হাঁড়ি, গয়না, আখের রস সবই বিক্রি হচ্ছে অনেকটা যেন কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ির সেই হাটের পটভূমি। পাকা আম দেখে খাবার ইচ্ছা হলেও ছুরি নেই, সেটি অভিনয়ের দ্বারা বোঝানোর সাথেসাথেই লোকটি আমটিকে ভালো করে ধুয়ে ছুরি দিয়ে কেটে কলাপাতার ওপর সাজিয়ে পরিবেশন করল। এক মহিলা দেখলাম বিরাট বাদামী রংএর লোমওয়ালা একটা খোলা থেকে কীসব বার করে মুখে দিচ্ছে। ইশারায় কী জিজ্ঞাসা করার সাথে সাথেই কয়েকটি আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে খেয়ে দেখতে বললেন আর পাছে ভেতরের বিশাল দানাটিকে ভুল করে গিলে ফেলি তাই খাওয়ার পদ্ধতিটাও দেখিয়ে দিলেন। মুখে দিয়ে মনে হল আঁশফল খাচ্ছি। লালচে রঙের দিশি আমড়ার মত একটা কিছু বিক্রি হচ্ছে যার নাম নান্জি। পড়ে জানলাম সেটা নাকি অরিজিনাল কোসটারিকান ফল যা পচিয়ে আজও স্থানীয়রা নেশা করে আর তার সাথে আখের রস নেশা আরো জোরদার করতে সাহায্য করে।
এদেশের মাটিতে পা দেবার সাথে সাথেই 'পুরাভিদা' কথাটার কী মাহাত্ম্য তা বুঝে গিয়েছিলাম। কিঞ্চিৎ হাসিহাসি মুখের সঙ্গে এই কথাটা বললেই দেখবেন আপনি বহুজায়গায় উৎরে যাচ্ছেন। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে একটি মেক্সিকান সিনেমায় শব্দটা ব্যবহার করা হয় যা ইংরাজী করলে দাঁড়ায় 'পিওর লাইফ।' এদেশে কিন্তু এ শব্দটির প্রয়োগ এমনই, যা সব ট্রান্স্লেসনেরই ঊর্ধ্বে। স্প্যানিশে 'ওলা' যা কিনা ইংরাজীতে 'হ্যালো' তা অবশ্যই এদেশে চলে কিন্তু 'পুরাভিদা' বললে আপনি চট্ করে হয়ে যাবেন এদের খুব কাছের মানুষ। রাস্তায় কারোর সাথে দেখা হলে তাকে 'ওলা' বা 'হ্যালো' না বলে আপনি বললেন 'পুরাভিদা' অর্থাৎ নমস্কারের পরিবর্তে সৌজন্য বিনিময়ের জন্য বললেন - কি ভাই সব ভালো তো? কথাবার্তা চালানোর মধ্যে পুরাভিদা বললে মানেটা দাঁড়ায় - আর ভাই এই তো জীবন, বেশি চাপ নিও না। বাক্যালাপের শেষে বলার অর্থ - আচ্ছা ভাই তাহলে আসি, আবার দেখা হবে। এদেশের মত একটা কথার জোরে সারা না গেলেও আমেরিকায় 'পুরাভিদা' অনেকটা হয়ে দাঁড়ায় প্রারম্ভে - হে হোয়াটস্ আপ ? কথাবার্ত্তা চলার মাঝখানে - দিস ইজ্ লাইফ ম্যান্, টেক্ ইট ইজি। শেষে গুড বাই এর বদলে পুরাভিদা হয়ে যায় - 'সি ইউ, টেক্ কেয়ার।'
শেষ দিনটাতে আমরা 'হাকো' বলে একটা সমুদ্র তটে গেলাম, ইংরাজিতে 'জাকো' পড়ে যতই গগন ফাটান না কেন স্প্যানিশে জ এর উচ্চারণ 'হ' এর মত হয় অর্থাৎ জাকো হয়ে যাবে 'হাকো'। এখানে নেমে ম্যাক্ডোনাল্ড, পিৎজা হাট আর কেন্টাকি ফ্রায়েড চিকেনের রমরমা দেখে খেয়াল করলাম এ তল্লাটে আমেরিকানদের ছড়াছড়ি। তার ফলে রাস্তাঘাট বা দোকানপাটে অনেকেই ইংরাজি বলেন। আশেপাশে প্রচুর আগ্নেয়গিরি থাকায় সমুদ্রতটে বালির রং কালো, যদিও জল খুব পরিস্কার। গ্রামগঞ্জে বা শহরে যেখানেই যান না কেন এদেশে দেখবেন বাচ্চারা রাস্তাঘাটে ফুটবল খেলে যাচ্ছে কারণ বাঙালিদের মত এদেরও ফুটবল-অন্ত প্রাণ আর হাকোও তার ব্যাতিক্রম নয়। এই জায়গাটিতে ট্যুরিষ্টের সংখ্যাই বেশি তাই রাত্রে এই সমুদ্রতটটি পার্টির আনন্দে মেতে ওঠে।
আমাদের দেশের মত এদেশেও দেখলাম লোকজন ডিরেকশন দেওয়ার সময় রাস্তার নামের ধার ধারে না, ল্যান্ডমার্কের ওপর ভরসা করেই জবাব দেয়। যেমন ধরুন, কাউকে ম্যাকডোনাল্ডের ডিরেকশন জিজ্ঞাসা করলে জবাব পাবেন - পাঁচশো মিটার উত্তরে গিয়ে বাঁহাতের রাস্তা নিয়ে কিছুটা এগোলেই একটা স্টেডিয়াম দেখতে পাবে আর তার ঠিক পেছনেই ম্যাকডোনাল্ড। সেখানে ঢুকে আবার দেখবেন হাইজিনের কী কড়াকড়ি, প্রত্যেকের মাথাই জাল দিয়ে ঢাকা যাতে চুল উড়ে এসে খাবারে না পড়ে। হোটেলের কর্মচারীটি বলল এখানে গ্রামদেশে কোথাও কোথাও রাস্তার নামই থাকে না সেখানে কোন হলুদ রঙের বাড়ির সামনে সাদা গরু বাঁধা আছে তার ওপর নির্ভর করেই ডিরেকশন দেওয়া হয় অর্থাৎ ভারতবর্ষের সঙ্গে মিল বহুদিক থেকেই। মুশকিল একটাই, এধরনের ডিরেকশনের আয়ু ততদিনই যতদিন তেনারা গায়ের রঙের দিক থেকে একই আছেন। দুঃখের বিষয় গরু বা বাড়ির মধ্যে কেউ একটি রং পরিবর্তন করলেই সেটি সুকুমার রায়ের 'ঠিকানা' হয়ে দাঁড়ায়।
এদেশে অত্যন্ত স্বল্প জনসংখ্যা বা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিক থেকে ভারতবর্ষের সঙ্গে অমিল থাকলেও ফলফুল বা আরও বহুদিক থেকে মিলটাও চোখে পড়ার মত। সময়ের অভাবে এবারে আর অতলান্তিকের দিকটা যাওয়া হল না, তাই সেটিকে ভবিষ্যতের জন্যই তুলে রাখলাম। এদেশে এসে চারিদিকে আমার অত্যন্ত পরিচিত ফুল ফলের গাছগুলিকে দেখে বা কল্কে ফুল আঙ্গুলে পরে কিছুক্ষণের জন্যও যেন আমি আমার ছেলেবেলার ফেলে আসা আনন্দের স্মৃতিটাকে ফিরে পেয়েছিলাম, যার মূল্য আমার কাছে অপরিসীম। তাই কোস্টারিকাকে বিদায় জানানোর সময় হয়ে এলেও তাকে ঠিক 'গুড বাই' বলতে মন চাইল না পরিবর্তে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল - 'পুরাভিদা কোস্টারিকা' তোমার সঙ্গে আবার দেখা হবে, টেক কেয়ার।
শ্রাবণী ব্যানার্জীর জন্ম ও বেড়ে ওঠা কলকাতায়। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির বাসিন্দা। বাংলা সাহিত্যের পাশাপাশি সঙ্গীতচর্চা ও ইতিহাসপাঠে জড়িয়ে আছে ভালবাসা। কৌতূহল এবং আনন্দের টানেই গত কুড়ি বছর ধরে বিশ্বের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত করে বেড়াচ্ছেন।