গোয়েচা লা-র পথে
সুদীপ্ত ঘোষ
~ জোংরি-গোয়েচা লা ট্রেকরুট ম্যাপ ~ জোংরি-গোয়েচা লা ট্রেকের আরও ছবি ~
প্রাককথন
সব গল্পেরই একটা শুরু শেষ থাকে। সব ঘটনারও তাই। কিছু জিনিস নিয়ম মেনে হয় না, আর হয় না বলেই জীবন এত মজার। এই ভনিতা কেন সে কথা বলি। শুরুর সেই দিন, তারিখ বা সময়টা ঠিকঠাক মনে নেই, সম্ভবত জুনের মাঝামাঝি, জুলাই বা অগাস্ট হলেও ক্ষতি নেই। অফিসের ব্যস্ত সময়ে হঠাৎ বাপ্পার ফোন "সুদীপ্ত দা, নভেম্বরে 'গোয়েচা লা' ট্রেক, আর তুই যাচ্ছিস।" কিছু বলার আগেই ফোন কাট। এরপর অফিস, ফিল্ড, ট্রেনিং-এর নেভার এন্ডিং চাপে দিমাগ থেকে গোয়েচালা গন। সেপ্টেম্বরে টিকিট বুকিং কবে হল, টিমে কারা আছে, কারা নেই কিস্যু জানি না। জায়গাটা নিয়ে পড়াশোনা, হোমওয়ার্ক কিছুই করতে পারি নি। যদিও পরবর্তীকালে সেটা শাপে বর মনে হয়েছে কখনও কখনও। মাঝে মাঝে বাপ্পার মেসেজ 'কলকাতার টিকিটটা কাট। আমাদের বাকি বুকিং কমপ্লিট। 'লাকি' গাইডের ব্যাপারটা ফাইনাল করে ফেলেছে।' আমার অবস্থা শোচনীয়, কিভাবে ম্যানেজ দেব কিছুই বুঝতে পারছি না। একদিকে এতদিনের বন্ধুত্ব, পাহাড়ের হাতছানি, অন্যদিকে অফিসের চোখরাঙানি। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত আবার ইলেকশন ডিউটির ভ্রূকুটি। যাই হোক, সব কিছু কাটিয়ে শেষ মুহূর্তে অফিসকে সামলে রুকস্যাক পিঠে বেরিয়ে পড়লাম। জয়পুর থেকে কলকাতা হয়ে বাউরিয়া। রাতটুকু বাড়িতে কাটিয়ে পরদিন প্যাকিং-এর ফাইনাল টাচ সেরে রাতের ট্রেনে চেপে পড়লাম। পনেরো জনের বড় দল। কিছু চেনা, কিছু অচেনা মুখ। থোড়াই কেয়ার। 'যদি হও সুজন, তেঁতুল পাতায় ন'জন।' 'ন'জন যদি হতে পারে, 'পনেরো' জনে কেন নয়? শিয়ালদহ থেকে 'কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস' যখন ছাড়ল ঘড়িতে তখন 'আটটা কুড়ি।' ন' টা নাগাদ বাকিদের ব্যাগ থেকে উঁকি দিতে শুরু করেছে নানান সাইজের টিফিন বক্স। লুচি, পরোটা, তরকারি, আলুরদম, সুজির হালুয়ার গন্ধে বাঙালি তখন বিপ্লবী। সদ্য আলাপের ভদ্রতার আচ্ছাদন সরিয়ে রেখে প্রাণপণে ঝাঁপিয়ে পড়লাম লুচি পরোটার উদ্দেশে। কয়েকঘন্টার আলাপ যে কখন বন্ধুত্বে বদলে গেছে, তখনও বুঝতে পারি নি।
১২ নভেম্বর, ২০১৮
সকালে ঘুম ভাঙল পাঁচটা নাগাদ। বাকিরা গভীর ঘুমে। ট্রেন রাইট টাইম। চা খেয়ে ফ্রেশ হয়ে দরজায় এসে দাঁড়ালাম। রেললাইনের ধারে ঢালু জমি বেয়ে ছোট ছোট চা বাগান, সব্জির খেত। ঝকঝকে আকাশে সোনাঝরা রোদ। ট্রেন নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছাল সাড়ে সাতটা নাগাদ। লটবহর নিয়ে ওয়েটিং রুম। স্নান করে, ব্রেকফাস্ট সেরে ট্যাক্সি স্ট্যান্ড। দুটো গাড়িতে মালপত্র বাঁধাছাঁদা সেরে, নারকোল ফাটিয়ে, 'দুগগা' বলে যাত্রা শুরু হল।
গন্তব্য ইয়ুকসাম। প্রাচীন সিকিমের রাজধানী। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে দূরত্ব প্রায় দেড়শো কিলোমিটার। গাড়িতে প্রায় ঘন্টা ছয়েকের রাস্তা। যদিও পাহাড়ি রাস্তায় দূরত্ব আর সময়ের অহি-নকুল সম্পর্কের কথা সবারই কম বেশি জানা। ষ্টেশন চত্বর ছাড়িয়ে এগিয়ে চলেছে গাড়ি। শহর ছাড়িয়ে এসে পড়েছি মিলিটারি চৌহদ্দিতে। সবুজের ছায়া ঢাকা কালো পিচ ঢালা রাস্তা। পাশে দাম্ভিক শাল, সেগুনের জঙ্গল। চিরহরিৎ অরণ্যের 'উচ্চ যেথা শিরের' ভিড়ে, নিজের অজান্তেই 'চিত্ত ভয়শূন্য' হয়ে ওঠে। মহানন্দা স্যাংচুয়ারির মধ্যে দিয়ে চলা এই পথ-মাহাত্ম্য পথিক মাত্রই জানে। কালীঝোরা, রাম্বি বাজার পেরিয়ে মেল্লি পৌঁছাতে দুপুর প্রায় গড়িয়ে গেল। ভাত, ডাল, শাকভাজা দিয়ে লাঞ্চ সারলাম। কিছুটা জিরিয়ে আবার চলা শুরু। তিস্তা পেরিয়ে ঢুকে পড়লাম সিকিমে। তিস্তা ছেড়ে এবার সঙ্গ নিল রঙ্গিত। মেল্লি – নয়াবাজার রোড ধরে জোরথাং পৌঁছাতে বেলা পড়ে এল। রাস্তা বন্ধ। সারাই-এর কাজ চলছে। চা, শিঙাড়া সহযোগে পড়ে পাওয়া সময়ের সদ্ব্যবহার করা হল। ইয়ুকসাম যখন পৌঁছালাম পাহাড়ের হিসাবে তখন যথেষ্ট রাত। ঝিরঝিরে বৃষ্টিভেজা রাতে শীতের চাদর আস্তে আস্তে জড়িয়ে ধরল আমাদের।
১৩ নভেম্বর, ২০১৮
ট্রেকের প্রথম দিন: ইয়ুকসাম (৫,৬৪৩ফুট/১,৭২০ মি) থেকে সাচেন (৭,২০০ ফুট/ ২,১৯৫ মি)
পশ্চিম সিকিমের গেইজিং সাব-ডিভিশনের অন্তর্গত ছবির মত ছোট্ট শহর ইয়ুকসাম। ইয়ুকসামের ইতিহাসও কিন্তু খুব চিত্তাকর্ষক। প্রায় সাড়ে তিনশো বছর আগে, তৎকালীন সিকিমের রাজধানী ছিল ইয়ুকসাম। অতীত ছেড়ে বর্তমানে ফিরি। সেই অর্থে, 'ট্রেকার্স ডেন' হল ইয়ুকসাম। আমাদেরও পথ চলা শুরু ইয়ুকসাম থেকে। প্রথমদিন ট্রেক ইয়ুকসাম (৫,৬৪৩ফুট/১,৭২০ মি) থেকে সাচেন (৭,২০০ ফুট/ ২,১৯৫ মি), দূরত্ব ৮ কিলোমিটার। গাইডের সহায়তায় নিয়মমাফিক সইসাবুদ মিটিয়ে, প্রশাসনিক অনুমতি জোগাড় করার পর শুরু হল আমাদের পথ চলা। শুরুতে বলেছিলাম না, কিছু জিনিস নিয়ম মেনে হয় না, সেটা আরও একবার দেখা গেল। আমাদের পনেরো জনের টিমে আরও তিনজন নতুন বন্ধু জুটে গেল। একই পথের পথিক।
গতকাল রাতে বৃষ্টি হয়েছে। কালো ঝকঝকে পিচ রাস্তা ছুঁয়ে আলগোছে গোলাপি 'চেরি ব্লসম।' পশমের বলের মত পাহাড়ি কুকুর। স্কুলের পোশাক পরা কচিকাঁচার দল। এসব দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম। পাহাড়ের প্রতিটা বাঁক তার নিজের মত করে সুন্দর। কাঞ্চনজঙ্ঘা ন্যাশনাল পার্কের ইন্টারপ্রিটেশন সেন্টার পেরিয়ে, ডানহাতি পাকদণ্ডি বেয়ে শুরু হল চড়াই। আঁকাবাঁকা সর্পিল রাস্তা বেয়ে ওঠানামা। শহুরে সভ্যতা কে পায়ে পায়ে পিছনে ফেলে রেখে এগিয়ে চলা। এ এক দুর্নিবার হাতছানি। 'কত টা পথ পেরলে তবে পথিক বলা যায়...?' উত্তর জানা নেই। 'ফা খোলা'র (Pha Khola) ঝুলন্ত সেতু পেরিয়ে প্রবেশ করলাম নিবিড় জঙ্গলে। কাঞ্চনজঙ্ঘা ন্যাশানাল পার্ক। ট্রেকের প্রথম দিনের জড়তা তখনও কাটেনি। ছবি তোলার অবকাশে ক্ষণিকের বিরতি। আবার চলা। মেঘলা আকাশে বৃষ্টির ভ্রূকুটি। সবুজ জঙ্গলে ওক, ম্যাপলের ভিড়। মাঝে মধ্যে সবুজ ক্যানভাসে গোলাপি তুলির টান, চেরি ব্লসম। একটানা ডেকে চলেছে ঝিঁঝিঁর দল। গতকাল রাতের বৃষ্টিতে পথ কোথাও কোথাও ভারী, পিচ্ছিল। পাখির কলতান, ঝিঁঝিঁর ডাক ছাপিয়ে কানে ভেসে আসছে টুংটাং ঘন্টাধ্বনি। আমাদের লটবহর নিয়ে হাজির ইয়াকের দল। দেখতে দেখতে আমাদের পেরিয়ে চলে গেল ওরা। 'সুশে খোলা' (Tshushay Khola) পার হয়ে আবার বিরতি, কিঞ্চিৎ জলযোগ। প্রতিটা ব্রিজের মজা হল অনেকটা করে উতরাইয়ে নেমে আবার চড়াই। মাধ্যাকর্ষণের সঙ্গে সে এক কঠিন দ্বন্দ্ব। এরপর আর একটা ব্রিজ। মেন্টোগাং খোলা (Mentogang Khola) পার হয়ে কিছুটা চড়াই ওঠার পর জঙ্গলের মধ্যে একফালি সমতল জায়গা। সার বেঁধে তাঁবু লাগানো। পৌঁছে গেছি সাচেন। আমাদের আজকের আস্তানা। পিঠের ব্যাকপ্যাক যে যার টেন্টে রেখে, কিছুটা এগিয়ে বাম দিকে নেমে এলাম। টিনের শেড ঘেরা কিচেন। পাশের শেডে কাঠের টেবিল পাতা। পাশে তিরতির করে বয়ে চলেছে পাহাড়ি ঝোরা। ঝোরার জলে হাত মুখ ধুয়ে বসতেই হাজির গরমাগরম ম্যাগি। তারপরেই ধোঁয়াওঠা চা। সারাদিনের দৈহিক ক্লান্তি মেটানোর জন্য যথেষ্ট। সন্ধ্যে নামতেই শীতটা টের পেলাম। টেন্টে ঢুকতে ইচ্ছা হল না। শেডে বসেই শুরু হল আড্ডা আর গান। অবশ্যই পাহাড়, জঙ্গলকে বিরক্ত না করে। এর মাঝেই ডিনারের জন্য ডাক। ডিনার শেষ করে ফিরে এলাম টেন্টের কাছে। আরেকদফা আড্ডার পর সেঁধোলাম স্লিপিং ব্যাগে। ছমছমে জঙ্গুলে অন্ধকার জুড়ে তখন শুধুই ঝিঁঝিঁর আর্তনাদ।
১৪ নভেম্বর, ২০১৮
দ্বিতীয় দিন: সাচেন (৭,২০০ ফুট/ ২,১৯৫ মিটার) থেকে সোকা (৯,৭০১ ফুট/২,৯৫৭ মিটার)
ঘুম ভাঙল পাখির ডাকে। সবুজের গন্ধ মাখা সকাল। আজকের ট্রেক সাচেন (৭,২০০ ফুট/ ২,১৯৫ মিটার) থেকে সোকা (৯,৭০১ ফুট/২,৯৫৭ মিটার)। দূরত্ব ৭ কিলোমিটার। ঘণ্টা ছয়েকের রাস্তা। পুরি-সব্জী ব্রেকফাস্টের পর শুরু হল আমাদের পথ চলা। পাতার ফাঁক গলে আনমনা রোদের আলপনা। আকাশে তখনও মেঘের আনাগোনা। শুরুতেই ছোট অঘটন। গ্রুপের সবচেয়ে ফিট ট্রেকার প্রবীরদার পা হড়কাল। কপাল ভালো চোট লাগেনি। আবার চড়াই। নিচে প্রবহমান 'রাথং চু' নদী। বাকিদের কাছ থেকে শুনছি, জানছি এই পাহাড়, জঙ্গল, নদী। আর দুচোখ ভরে দেখছি। অজ্ঞতা যে এত বড় আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেবে আগে কোনদিন ভাবিনি।
বাখিম পৌঁছানোর আগে রাস্তা খাড়াই। অনেকটা চড়াই ভেঙে আবার কিছুটা উতরাই। চতুর্থ সেতু 'প্রেক চু'র ওপর। নদী এখানে খরস্রোতা। ব্রিজে ঝোলানো রঙিন প্রেয়ার ফ্ল্যাগ। সেতু পেরিয়ে কিছুটা বিশ্রাম। লক্ষ্যকে ছোট ভগ্নাংশে ভেঙে অতিক্রম করার চেষ্টা। উঁচুনিচু সর্পিল পাকদণ্ডি বেয়ে আবার চড়াই। পাহাড় জুড়ে তখন শুধুই ওক, রডোডেন্ড্রনের সারি। নিস্তরঙ্গ সময়ে মাঝে মাঝে পাখিদের কলতান। পাখিদের সেই গান শুনতে শুনতে হেঁটে চলেছি হিমালয়ের বুকে। বাতাসে তখন মুক্তির আশ্বাস। আমাদেরও বিশেষ তাড়া নেই। প্রকৃতির সান্নিধ্য উপভোগ করতে করতে পৌঁছালাম বাখিম। ছোট একটা চায়ের দোকান। একটা ভিউ পয়েন্ট। সাদামাটা, বাহুল্য বর্জিত। সামনে আদিগন্ত ইয়ুকসাম ভ্যালি। আমাদের নতুন তিন বন্ধুদের সাজেশন মেনে এক কাপ করে চা খাওয়া হল। মশলা দেওয়া। যেটা না খেলে হয়ত কিছু জিনিস অপূর্ণ রয়ে যেত। আর, কৌশিকদার মত কিছু মানুষের সান্নিধ্য জীবনে খুব জরুরি, যারা কিছু না বলতেই অনেক কিছু বুঝে যায়। না হলে জলযোগ ছাড়া বাখিমের সেই প্রকৃতিদর্শনের স্বাদ হয়ত কিছুটা কম পড়ে যেত। পাশেই একটা ফরেস্ট রেস্ট হাউস। ভূমিকম্পের পর এখন জীর্ণ দশা। ঠিক হল ফেরার পথে একটা রাত বাখিমের জন্য বরাদ্দ।
বাখিম থেকে সোকা ২ কিলোমিটার। কিন্তু প্রায় পুরোটাই চড়াই। ওয়াকিং স্টিকে ভর দিয়ে আবার উঠে দাঁড়ালাম। উচ্চতার হেরফের এবার সবারই কম বেশি মালুম হচ্ছে। পাহাড় চড়তে দমে টান। সোকা পৌছাতে প্রায় তিনটে বাজল। মেঘ, কুয়াশা ঘেরা এক বিষণ্ণ পরিবেশ। সোকার ট্রেকার্স হাটের পাশেই আমাদের টেন্ট লাগানো হয়েছে। পৌঁছানোর পর চায়ের কাপ হাতে ট্রেকার্স হাটে আড্ডা জমালাম। বাইরে তখন বৃষ্টি নেমেছে। বিকেলেই ঘন নিকষ কালো অন্ধকার। টিমটিমে মোমের আলোকবৃত্ত ঘিরে আমরা। অঞ্জন, প্রতুল, চন্দ্রবিন্দুর সুরে গলা মেলাচ্ছি সবাই। তাল মেলাচ্ছে পাশের বিদেশী ট্রেকারের দল। সোকার ঠান্ডায় তখন বন্ধুত্বের উত্তাপ।
রাতে শুরু হল মুষলধারে বৃষ্টি। সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। টেন্টের তলা দিয়ে ঢুকতে শুরু করেছে জল। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঠান্ডা।
১৫ নভেম্বর, ২০১৮
তৃতীয় দিন: সোকা (৯,৭০১ ফুট/২,৯৫৭ মিটার) থেকে জোংরি (১৩,০২৪ ফুট/ ৩,৯৭০ মিটার)
ভোরের দিকে বৃষ্টিটা ধরে এল। আকাশ যদিও মেঘাচ্ছন্ন। সকালে মিনিট কয়েকের জন্য পান্ডিম দেখা দিয়ে আবার মুখ লুকিয়েছে। গতকাল সোকাটা ঘুরে দেখা হয় নি। এখন দেখলাম। সবুজ ঘাস জমি, কিছুটা সমতল, কিছুটা ঢেউ খেলানো। একটা ছোট্ট মনাস্ট্রি। একটা ক্যাফে। চা, কফি, চকোলেট পাওয়া যায়। গোটা দুই ক্যাম্পসাইট। একটা ফরেস্ট রেস্ট হাউস। কয়েকঘর বসতি। ট্রেকারদের অধিকাংশই ভিনদেশি। কুয়াশাঘেরা সবুজ ঘাস জমিতে চরে বেড়াচ্ছে ধূসর ঘোড়া। স্বছন্দে কোন হলিউডি ছবির দৃশ্যপট।
পাহাড়ের কোলে সেই ছোট্ট হ্যামলেট পেছনে ফেলে আবার এগিয়ে চলা। রাস্তা বেশ চড়াই। একটু হাঁটলেই হাঁফ ধরছে। আবহাওয়া রাত থেকেই খারাপ ছিল, এবার টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হল। নীল ঝকঝকে আকাশ বোধহয় হাঁটার কষ্ট লাঘব করে। মেঘলা দিন, বৃষ্টির সাথে সেই সম্পর্কটা একদমই ব্যস্তানুপাতিক। আধাঘণ্টা হাঁটার পর এল সেই বিখ্যাত 'রডোডেন্ড্রন ট্রেল।' ছোট ছোট গাছের গুঁড়ি দিয়ে বানানো পথ অনেকটা ছোটবেলার ড্রয়িং খাতার সেই পাহাড়ি রাস্তা। পথে দেখা হল ফিরতি পথের ট্রেকারদের সঙ্গে। খবর পেলাম উপরে প্রচণ্ড ঠান্ডা। জোংরি থেকেই ফিরতে হয়েছে। সুতরাং, আশু সাবধান।
সোকা থেকে ফেডাং –এর রাস্তার মাঝামাঝি জায়গা থেকেই শুরু হয়ে গেল 'স্নো ফল'। রডোডেন্ড্রনের জঙ্গল তখন তুষাররাজ্য। একটানা হেঁটে চলেছি, দাঁড়ালেই প্রচণ্ড ঠাণ্ডায়হাত পা জমে যাওয়ার উপক্রম। প্রত্যেকেই অসম্ভব ক্লান্ত। ঠাণ্ডার চোটে বুই (সৌরভ) সামান্য অসুস্থ হয়ে পড়ল - AMS (acute mountain sickness)। পাহাড়ে ঠান্ডা আর উচ্চতাজনিত সমস্যা। ঠিক হল একটু বিরতি দিয়ে লাঞ্চ করে নেওয়া হবে তার মধ্যে বুই সুস্থ হলে এগোনো হবে, না হলে নেমে আসা হবে। যাই হোক লাঞ্চ করে, ORS, COCA- 30 দেওয়ার পরে বুই অনেক সুস্থবোধ করায় হাঁটা শুরু হল।
ফেডাং (১২,০৮৩ ফুট/ ৩,৬৮৩ মিটার) পৌঁছালাম একটা নাগাদ। কপালজোরে ট্রেকার্স হাটে গরম চা জুটে গেল। সঙ্গে পাহাড়ি পিঠে জাতীয় খাবার। বেশ সুস্বাদু। ফেডাং ছেড়ে জোংরি যাওয়ার জন্য, বাঁ দিকের রাস্তাটা ধরলাম। ডান দিকের রাস্তা কোকচুরাং-এর। ওই পথে ফেরা। ফেডাং থেকে চড়াই। আবার জঙ্গল। বরফে ঢাকা। পায়ের তলায় বরফ কুচিতে, স্লিপ হওয়ার আশঙ্কা। উচ্চতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গলের চরিত্রগত পরিবর্তনও লক্ষণীয়। ঘন সবুজ অরণ্য শেষ হয়ে অপেক্ষাকৃত ছোট গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। তুষাররাজ্যে স্বাগত জানাচ্ছে। গাছের ডালে ছুরির ফলার মত লেগে তুষারকণা। দেওরালি টপের আগে অসুস্থ হয়ে পড়ল ওই তিন বন্ধুর একজন। দেওরালি টপে সেজন্য ক্ষণিকের বিরতি। কিঞ্চিৎ জলযোগ। প্রবীরদার বিখ্যাত কাঁচা লঙ্কা মাখা মুড়ি-চানাচুরে শীত কিছুটা হলেও কমল। দেওরালি টপ থেকে রাস্তার বাকি অংশ অপেক্ষাকৃত কম চড়াই। বরফের চাদর ঢাকা পাহাড় পেরিয়ে জোংরি পৌঁছাতে সাড়ে চারটে বেজে গেল। আজকের ট্রেক সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং ছিল। একসঙ্গে অনেকটা ওপরে উঠে আসা, সঙ্গে হাড় কাঁপানো ঠান্ডা। ঠান্ডা হাওয়ায় বাইরে দাঁড়ানো যাচ্ছে না। পারদ হিমাঙ্কের অনেকটা নিচে - প্রায় মাইনাস আট ডিগ্রি। দিনের শেষে স্মার্টফোন জানাল আজ পাড়ি দিয়েছি ৮.৪ কিলোমিটার।
১৬ নভেম্বর, ২০১৮
চতুর্থ দিন: জোংরি (১৩,০২৪ ফুট/ ৩,৯৭০ মিটার) থেকে জোংরি টপ (১৩,৭৭৮ ফুট/ ৪,২০৩ মিটার)
উচ্চতাজনিত সমস্যা, সঙ্গে অত্যধিক ঠাণ্ডায় রাতে বিন্দুমাত্র ঘুম হল না। রাতের তাপমাত্রা মাইনাস তেরো সেন্টিগ্রেডের আশেপাশে। সারাদিনের ক্লান্তি, পাহাড় চড়ার ধকল সত্ত্বেও ঘুম আসছে না। তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় রাতটা কাটল। ভোর চারটে নাগাদ বেরোন। জোংরি থেকে জোংরি টপ। সূর্যোদয় দেখে ফেরা। আজ রেস্ট ডে। ১৩,০০০ ফুট উচ্চতায় অ্যাক্লিমাটাইজ (acclimatize) করতে অধিকাংশ ট্রেকার এখানে একদিনের বিরতি নেন। আমাদের ক্ষেত্রেও এর অন্যথা হয়নি।
চারটে নাগাদ তৈরি হয়ে তাঁবুর চেন খুলতেই, তাঁবুর গা বেয়ে নেমে এল একরাশ বরফ। বাইরে বেরিয়ে দেখি চারদিক সাদা চাদরে ঢাকা। বোতলের জল জমে কঠিন বরফ হয়ে গেছে। হেডল্যাম্পের (হেড টর্চ) গোলাকার আলোক বলয়ে তুলোর মত ভেসে বেড়াচ্ছে তুহিন। সেই আলো আঁধারির মধ্যে শুরু হল আমাদের পথ চলা। হেডল্যাম্পের আলো ফেলে এগিয়ে চলেছি জোংরি টপের দিকে সঙ্গী প্রেম ভাই, স্নেহাশিস আর গাইড। চড়াই ভেঙে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে হাওয়ার দাপট। ঠান্ডাটা কিছুতেই বাগ মানছে না। শরীর গরম রাখতে একটানা চড়াই ভেঙে উঠে চলেছি। দমে টান পড়ছে প্রচণ্ড।
ভোরের আলো একটু একটু করে ফুটতে শুরু করেছে। ফিকে হয়ে আসা সেই অন্ধকারে হঠাৎ আবিষ্কার করলাম পাহাড়ের শিরদাঁড়া বরাবর সরু একফালি রাস্তায় আমরা কজন। জ্যামিতিক ভাষায় বৃত্তাকারে আমাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে হিমালয়। অনেকটা সেই মহাভারতের চক্রব্যূহ। আজ বলতে বাধা নেই, সেই বিশালতার সামনে দাঁড়িয়ে বুকটা একটু কেঁপে উঠেছিল। পরে মনে হয়েছিল, হয়ত এটাই জীবন। শুধু জীবনের বাধার পাহাড়গুলো হয়ত হিমালয়ের মত শ্বেতশুভ্র নয়। স্নেহাশিস একে একে চিনিয়ে দিল কাঞ্চনজঙ্ঘা (৮,৫৩৪ মি), কাবরু (৭,৩৫৩ মি), মাউন্ট পান্ডিম (৬,৬৯১ মি), কুম্ভকর্ণ। আর তারপর... সূর্য উঠল। হিমালয়ের রক্তিম অভিনন্দনে শুরু হল দিন।
জোংরি টপ থেকে নামার পর, নটা নাগাদ ক্যাপ্টেন বিবেকদার ডাকে জরুরি মিটিং। টিমের কয়েকজনের সামান্য শারীরিক অসুবিধা হছে। আর, নতুন বন্ধু তিনজন ফিরে যাচ্ছে। কারণ, শারীরিক অবনতি। তার উপর আবহাওয়া প্রতিকূল। মেঘে ঢেকে গেছে উপত্যকা। ঠান্ডা আরও বাড়তে চলেছে। তিনজন ফেরত যাওয়ায় আমাদের টিমের মনোবল একদম তলানিতে। অনেক আলোচনার পর শেষমেশ ঠিক হল রাতটা তাঁবুতে না কাটিয়ে ট্রেকার্স হাটে কাটাব। আর কাল যদি বাকিদের শারীরিক উন্নতি হয় উপরে উঠব নাহলে ফেরা।
ব্রেকফাস্ট করে দলের বাকিরা জোংরি টপের দিকে রওনা হল। মেঘ কেটে আবার নীল আকাশ। সামনের পাহাড়ি ঝোরা জমে বরফ। বরফে আগায় চকচকে রোদ। রোদে গা ভিজিয়ে বই খুলে বসেছে একজন। সম্ভবত রাশিয়ান। সামনে চরে বেড়াচ্ছে ইয়াক (আদতে Dzo)। গলায় বাঁধা ঘণ্টার টুং টাং শব্দ ঘুরে ফিরে ভাসছে বাতাসে। নিচের উপত্যকায় একদলা সাদা মেঘ। ট্রেকার্স হাট লাগোয়া এক চিলতে দোকানে পসরা সাজিয়েছে পাহাড়ি আন্টি।
ফিরে আসার পর অনিন্দ্য বলছিল, "জোংরি টপে চড়ার সময় মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল, 'বেশ তো ছিলাম। কেন এত কষ্ট করছি...??' জোংরি টপে দাঁড়িয়ে সে উত্তর পেয়ে গেলাম।" হয়তো এই উত্তরটা খুঁজতেই বার বার ছুটে যাওয়া।
১৭ নভেম্বর, ২০১৮
পঞ্চম দিন: জোংরি (১৩,০২৪ ফুট/ ৩,৯৭০ মিটার) থেকে কোকচুরাং (১২,১৫২ ফুট/ ৩,৭০৪ মিটার) হয়ে থানসিং (১২,৯৪৬ ফুট/ ৩,৯৪৬ মিটার)
সকাল হল মেঘহীন আকাশে। চায়ের কাপ হাতে বাইরে দাঁড়াতেই টের পেলাম কনকনে ঠান্ডা। বরফে মোড়া চরাচর। আজকের গন্তব্য থানসিং, দূরত্ব আট কিলোমিটার। ঝরনার বরফ ভেঙে ডেকচিতে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। গরম জলে হাত মুখ ধুয়ে শুরু হল দিন। ব্রেকফাস্টের পর শুরু হল হাঁটা। জোংরি আর থানসিং মোটামুটি একই উচ্চতায়। কিন্তু পথের শুরুতে খাড়া উতরাই। তারপরে চড়াই ভেঙে থানসিং।
জোংরি ক্যাম্পসাইট থেকে শুরুর হাল্কা চড়াই ভেঙে এসে পড়লাম দিগন্তবিস্তৃত সবুজ ঘাসজমিতে (meadow)। পাশে পাহাড়চূড়ায় গতকালের জোংরি টপ। দূরের পাহাড়গুলো আরেকটু কাছে। কিছুটা নীচে একটা ছোট মনাস্ট্রি। পাশে গুল্ম-ঝোপে জমা বরফ। নীচ থেকে চড়াই ভেঙে উঠে আসছে ঘোড়া আর ইয়াকের একটা দল। বিবেকদা জুম করছে ক্যামেরার লেন্স।
ঘাসজমি পার হয়ে শুরু হল নিচের দিকে নামা। আবার সেই রডোডেন্ড্রনের জঙ্গল। কোকচুরাং-এর ট্রেকার্স হাট দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। ঘন জঙ্গলের মাঝে কাঠের বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি। পাশ দিয়ে কুলকুল করে বয়ে যাচ্ছে 'প্রেক চু।' নদী এখানে স্রোতস্বিনী। একটা ছোট কাঠের ব্রিজ। ট্রেকার্স হাটের সামনের বেঞ্চ, গোলা পাথরে (rolled boulder) হাত-পা ছড়িয়ে বসে পড়েছি সবাই। একটু বিশ্রাম। সকাল থেকে পাড়ি দিয়েছি প্রায় ছয় কিলোমিটার। এখনও বাকি প্রায় দুই কিলোমিটার। গাইড মঙ্গল, সমানে তাড়া লাগাচ্ছে। 'জলদি চলিয়ে সাব। মৌসম খারাব হো রাহা হ্যায়।' ক্লান্ত পা আর চলতে চাইছে না। কিন্তু হিসেব মত আজ চড়াই কম ভেঙেছি। আর তো বাকি মাত্র দু কিলোমিটার।
ব্রিজ পেরিয়ে 'প্রেক চু'র ধার ধরে এগিয়ে চললাম। নদীখাত বেয়ে বয়ে আসা ছোট, বড় নানান সাইজের বোল্ডার পেরিয়ে আঁকাবাঁকা সরু পথ। কেবল চড়াই। আবহাওয়া সত্যি খারাপ হতে শুরু করেছে। ঘন মেঘে ঢেকে গেছে চারিদিক। শুরু হল ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি। ঠান্ডা বাড়ছে। ফিরতি পথের ট্রেকারের দলের সাথে দেখা। প্রায় চল্লিশজনের বড় গ্রুপ। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে নিচে নামছে। পোর্টারের কাঁধে চাপিয়ে দুজনকে নামিয়ে আনতে দেখলাম। ঠান্ডায় কাবু। হাইপোথার্মিয়া। আরেকজন স্ট্রেচারে, ভাঙ্গা পা। আমাদের অবস্থাও সঙ্গিন। ধোঁয়াটে কুয়াশা, বৃষ্টি, পিচ্ছিল পাথুরে রাস্তা ভুলিয়ে দিয়েছে আমাদের দিনের শুরুর আনন্দ। দৃশ্যমানতা খুবই কমে এসেছে, দশ হাত দূরের জিনিস পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। শেষের এই দু' কিলোমিটার যেন শেষ হতেই চায় না। মনে হচ্ছে হেঁটে চলেছি আদি অনন্তকাল। অবশেষে প্রায়ান্ধকার ভ্যালির মধ্যে আবছা দেখা গেল থানসিং-এর ট্রেকার্স হাট। আর কিছুটা...। ক্লান্ত শরীরটা টেনে নিয়ে চললাম আজকের আস্তানার দিকে।
ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচতে প্ল্যান একটু চেঞ্জ করা হল। আগে ঠিক ছিল, একরাত থানসিং কাটিয়ে পরের রাত লামুনেতে কাটিয়ে সামিট করা হবে। কিন্তু লামুনেতে রাত কাটানো ঝুঁকির হয়ে যাবে। একে অসম্ভব ঠান্ডা (মাইনাস ১৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের আশেপাশে), তাছাড়াও ঝোড়ো হাওয়ার দাপট, সঙ্গে আবহাওয়ার খামখেয়ালীপনা। আবার থানসিং থেকে সামিট করার অর্থ, অতিরিক্ত কায়িক পরিশ্রম। যাইহোক, দ্বিতীয়টি বেশী গ্রহণযোগ্য হল। সুতরাং রাতের খাওয়া তাড়াতাড়ি মিটিয়ে স্লিপিং ব্যাগের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে সঁপে দিলাম। ঘড়ির রেডিয়াম ডায়ালে তখন সবে সাতটা। শহর কলকাতা তখন হয়ত সান্ধ্য চায়ের কাপে।
১৮ নভেম্বর, ২০১৮
ষষ্ঠ দিন: থানসিং (১২,৯৪৬ ফুট/ ৩,৯৪৬ মিটার) থেকে গোয়েচা লা টপ (ভিউ পয়েন্ট ওয়ান) (১৬,২০০ ফুট/ ৪,৯৪০ মিটার)
রাত একটা থেকে হাঁটা শুরু। উত্তেজনা কিনা জানি না, চেতন-অবচেতনের দোলাচলে সময়টা কেটে গেল। সাড়ে বারোটা থেকে প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল। এক কাপ চা গলাধঃকরণ করে যখন বাইরে এলাম তখন রাত প্রায় সোয়া একটা। টর্চ, হেড ল্যাম্পের কৃত্রিম আলো ছাপিয়ে সেই আদি অকৃত্তিম জ্যোৎস্না। আকাশে শুক্ল পক্ষের চাঁদ। আর গোয়েচালার পথে তখন একদল চন্দ্রাহত !
থানসিং থেকে লামুনের রাস্তায় চড়াই উতরাই বিশেষ নেই। দুপাশে খাড়া পাহাড়, ভ্যালি বরাবর আঁকাবাঁকা সরু পায়ে চলা পথ ধরে হেঁটে চললাম। গাইড মঙ্গল জানাল টেম্পারেচার মাইনাস আঠারো ডিগ্রি। চোখ মুছতে গিয়ে টের পেলাম চোখের পাতায় কুচি কুচি বরফ জমে। প্রচন্ড ঠান্ডায় আঙুল অবশ হয়ে যাচ্ছে। পাথরের আড়ালে কাগজ জ্বালিয়ে কিছুটা আগুন করে দিল মঙ্গল আর ছোটু। আগুনে হাত সেঁকে রক্ত চলাচল কিছুটা স্বাভাবিক হল। লামুনে পৌঁছলাম রাত তিনটে নাগাদ। আকাশে যে একসঙ্গে অতগুলো তারা দেখা যায় সেটা কি আগে জানতাম ! কি জানি ...! হয়ত না। স্নেহাশিস আর চন্দনের তুল্যমূল্য লড়াই শুরু হয়ে গেছে কে কটা তারাখসা দেখতে পেয়েছে। আমিও গোটাকতক প্রত্যক্ষ করলাম।
লামুনে পার হবার পর শুরু হল চড়াই। ডানদিকে পাহাড় থেকে নেমে বাঁদিকে নদীতে মিশেছে অজস্র নালা। জমাটবাঁধা বরফে হাঁটার বিপদ অনেকেই হয়ত জানেন। যথাসাধ্য সাবধানতা অবলম্বন করে এগিয়ে চলা। সামিতি লেক ঘিরে তখন শেষ রাতের অন্ধকার। পথ চলার সুবিধার জন্য পাঁচজন করে তিন ভাগে ভাগ হয়ে এগিয়ে চললাম।
সামিতি লেক পার হওয়ার পর চড়াই আরো খাড়া। পথের এই ভাগের চ্যালেঞ্জ যেন সবচেয়ে বেশি। রাতজাগা ক্লান্ত শরীর, তিন-সাড়ে তিন ঘন্টা টানা হাঁটার পর অবসন্ন পা বনাম গোয়েচা লা টপের হাতছানি...এক তীব্র মানসিক দ্বন্দ্ব। অক্সিজেন লেভেল বেশ কম। হৃদযন্ত্রের গতি ক্রমশ দ্রুতগামী। দমে সাংঘাতিক টান পড়ছে। ক্লান্ত শরীর টেনে নিয়ে চলেছি লক্ষ্যের দিকে। আকাশ ততক্ষণে ফরসা হতে শুরু করেছে। রাত ও দিনের সে এক অদ্ভুত সমাপতন।
শেষ চড়াই ভেঙে ওঠার পর রাস্তা ডানদিকে বাঁক নিয়েছে। বাঁ দিকে হিমবাহসৃষ্ট সুগভীর গিরিখাত। রাস্তা এখানে ভীষণ সঙ্কীর্ণ। বিপদসংকুল। সুন্দরও যে ভয়ঙ্কর হতে পারে তা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। সামনে পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ। গোয়েচা লা টপ (ভিউপয়েন্ট ওয়ান) থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার সেই সৌন্দর্য বর্ণনা করার ধৃষ্টতা আমার নেই। নীল আকাশের ব্যাকড্রপে দিনের প্রথম আলো এসে পড়ল পাহাড়চূড়ায়। তপ্ত কাঞ্চনবর্ণা পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ তখন সত্যিই সার্থকনামা। ফেরার পর কোনো এক ব্লগে দেখেছিলাম এক অদ্ভুত ছবি...। গোয়েচা লা টপ থেকে সূর্যোদয়ের মুহূর্তের সাক্ষী এক ট্রেকারের দু চোখে জলের ধারা। অভিব্যক্তি বাঙ্ময় হয়ে ধরা পড়েছে সে ছবিতে। সেই মুহূর্ত ভুলিয়ে দিল সব প্রতিকূলতার কথা।
ফেরার পথে সামিতি লেকের পাশে প্যাকড ব্রেকফাস্ট খোলা হল। ফেরার বিশেষ তাড়া নেই। রাতে যখন এই পথে গেছি অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাই নি। সকালের রোদে ভ্যালি জুড়ে শুধুই নানা রঙের আলপনা। নীল আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে সাদা পাহাড়। একপাশে খরস্রোতা নদী। ভ্যালি জুড়ে হলুদ আর লাল ফুল। মাঝে মাঝে সাদা শিরা উপশিরার মত পাহাড়ি নালা। লামুনে ক্যাম্পসাইটে পৌঁছালাম সকাল পৌনে দশটা নাগাদ। দেখা হল বিদেশী যুগলের সঙ্গে। গোয়েচা লা-র ছবি দেখতে চাইলেন। চা বিস্কুটের পরে বিদায় নিয়ে চললাম থানসিং-এর উদ্দেশে।
সন্ধের আগে থেকেই শুরু হয়ে গেল আড্ডা। আমাদের থেকেও খুশি মঙ্গল ও তার দলবল। হারমোনিকার সুরে তখন নেপালী লোকগীতি। একটার পর একটা অবিরাম গেয়ে চলেছে, তারপর সবাই একসঙ্গে ধরল 'রেশম ফিরিরি...।' ট্রেকিং-এর অবিচ্ছেদ্য অংশ। নিস্তব্ধ ভ্যালি জুড়ে তখন শুধুই গ্রাম্য পাহাড়ি সুর।
চন্দনের ডাকে সেই প্রবল ঠান্ডায় ট্রেকার্স হাটের বাইরে এলাম একবার। 'তুষারের রাজধানী ধুয়ে যায় জ্যোৎস্নায়।' স্নেহাশিস বলেছিল "প্রকৃতি এখানে মন্দির হলে, মাউন্ট পান্ডিম বিগ্রহ, ....আর এই কুটির যেন নাটমঞ্চ।"
১৯ নভেম্বর, ২০১৮
সপ্তম দিন: থানসিং (১২,৯৪৬ ফুট/ ৩,৯৪৬ মিটার) থেকে বাখিম (৮,৬৫৪ ফুট/ ২,৬৩৮ মিটার)
এবার ফেরার পালা। ব্রেকফাস্ট করে সকাল নটা নাগাদ আবার শুরু হল পথ চলা। উতরাই। থানসিং থেকে নিচের পথ ধরলাম। আকাশে মেঘ রোদের লুকোচুরি। ফেলে আসা চেনা বাঁক, কাঠের সেতু পেরিয়ে চলা। পাশে পাইনের জঙ্গল বেয়ে নামতে শুরু করেছে কুয়াশা। দেখতে দেখতে কোকচুরাং ট্রেকার্স হাট। চকোলেট ব্রেক। আকাশে তখন মেঘ ঘনাতে শুরু করেছে। পাড়ি দিতে হবে লম্বা পথ। রডোডেনড্রনের জঙ্গল। বাঁ দিকের পথ ধরে চললাম। বৃদ্ধ মহীরুহের শিকড়, শিরা উপশিরার মধ্যে দিয়ে একফালি পায়েচলা পথ। পেঁচালো লতায় শ্যাওলার ছোপ। লেগে আছে কুচি কুচি বরফ। সাদা বরফের বুক চিরে তিরতির করে বয়ে চলেছে ঝরনা। বেলা বারোটায় সাঁঝের আঁধার। শুরু হল স্নো ফল। বরফের মধ্যে গুটিকয় Tibetan Snow Cock। বিরক্ত না করে এগিয়ে চললাম।
ফেডাং পেরোনোর পর শুরু হল ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি। উতরাইয়ে নামছি বলে একটানা চলা সম্ভব হচ্ছে। সোকা পেরোনোর পর সন্ধ্যে ঘনিয়ে এল। টর্চ, হেডল্যাম্প জ্বেলে সার বেঁধে নামছি সবাই। ঘন অন্ধকারের মধ্যে বাখিম পৌঁছালাম। সকলেই অসম্ভব ক্লান্ত । আজ হেঁটেছি প্রায় ১৯.৬ কিলোমিটার।
২০ নভেম্বর, ২০১৮
অষ্টম দিন : বাখিম (৮,৬৫৪ ফুট/ ২,৬৩৮ মিটার) থেকে ডুবডি
আজ ট্রেকের শেষদিন। বাখিম থেকে ইয়ুকসামের বদলে যাব ডুবডি গ্রাম। বসন্ত, মঙ্গলদের গ্রাম। গ্রামে রাত কাটানোর সেই আন্তরিক নিমন্ত্রণ ফেরানোর সাধ্য আমাদের ছিল না। শুধু চলতে হবে একটু বেশি, সব মিলিয়ে প্রায় ষোল কিলোমিটারের মত।
বাখিম থেকে সেই একই পথে ফেরা। ঢালু রাস্তা বেয়ে নেমে চলা। উতরাইয়ে চলার কষ্ট তেমন নেই। মুহূর্তে পৌঁছে গেলাম সাচেন। ট্রেকার্স হাটের চায়ে গলা ভিজিয়ে আবার চলা।
একে একে 'মেন্টোগাং খোলা' (Mentogang Khola) 'সুশে খোলা' (Tshushay Khola) পার হয়ে নেমে চলেছি। গোলাপি চেরিব্লসম মোড়া কাঞ্চনজঙ্ঘা ন্যাশানাল পার্কের তোরণ পেরিয়ে, 'ফা খোলা'র (Pha Khola) ঝুলন্ত সেতু পেরিয়ে এসে পড়লাম ইয়ুকসাম। ইয়ুকসাম পেরিয়ে এগিয়ে চললাম ডুবডির দিকে। বিকেল গড়িয়ে দিন তখন সন্ধেতে ঢলে পড়েছে। পাহাড়ের মাথা ছাড়িয়ে উঁকি দিয়েছে ত্রয়োদশীর চাঁদ। মুঠোভরা জ্যোৎস্না ঢেলে দিচ্ছে পাহাড়ে, জঙ্গলে। জঙ্গলের আবডালে জমাট বাঁধছে জোনাকির দল। গাছের ডাল ছুঁয়ে জ্যোৎস্না গলে পড়েছে সেই একলা পাহাড়ি পথে। কিন্তু আমার ভালো লাগছে না। কোথাও একটা কষ্ট হচ্ছে। এই পাহাড়, এই জঙ্গল, এই আড্ডা এই সবকিছু ফেলে আমাকে ফিরতে হবে জয়পুর। পিছনে দূর থেকে ভেসে আসছে গলার আওয়াজ...... শুভ, বাবুকা, ডাব্বু। অন্য বাঁকে আমি হেঁটে চলেছি, একা... দূরত্ব বাড়িয়ে।
পুনশ্চ : উচ্চতাসংক্রান্ত তথ্যাবলী ইন্টারনেটসূত্রে প্রাপ্ত, ত্রুটি মার্জনীয়।
~ জোংরি-গোয়েচা লা ট্রেকরুট ম্যাপ ~ জোংরি-গোয়েচা লা ট্রেকের আরও ছবি ~
প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তনী সুদীপ্ত ঘোষ বর্তমানে 'জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া'-এর জয়পুর অফিসে কর্মরত। কাজের জন্য বছরে ছয় মাস পাহাড়ে, জঙ্গলে। ফিল্ডে থাকাকালীন অবসর কাটে বই পড়ে। ক্রাইম থ্রিলার আর ভ্রমণ কাহিনি বিশেষ পছন্দ। জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে পাখি দেখাও পছন্দের তালিকায় নতুন সংযোজন। ভালো লাগে ঘুরে বেড়াতে। পাহাড় আর জঙ্গল দুইই বিশেষ প্রিয়। এছাড়া বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া অন্যতম পছন্দের কাজ। লেখালিখির হাতেখড়ি 'আমাদের ছুটি'তেই।