মানালির ডায়েরি
কৌস্তুভ মজুমদার
~ মানালি-রোটাং পাসের আরও ছবি ~
৯ই অক্টোবর ২০১৬, রবিবার, কুরুক্ষেত্র, রাত ৯:২৫ মিনিটঃ
কুরুক্ষেত্র! তবে মহাভারতের যুদ্ধক্ষেত্র নয়, এটা হল মোটেল গোল্ডেন সারসের পাঁচতারা উঠোন। এখানে দাঁড়িয়ে থাকা আরও দুটো বাসের পাশে আমাদের বাস দাঁড়িয়েছে। মিতা আর আমি চলেছি দিল্লি থেকে মানালি। রাজারা পরে যোগ দেবে। হোটেল চত্বরে হলুদ রঙের আলোআঁধারি। খোলা আকাশের নীচে বসবার বেঞ্চি। আশপাশ পাম গাছ আর ফোয়ারা দিয়ে সাজানো। ঝাঁ-চকচকে বিত্তবান পরিবেশ। আসলে কুরুক্ষেত্র মানেই বর্তমান আর ইতিহাস ছেড়ে মন চলে যায় একেবারে পৌরাণিক যুগে। মহাভারতের ঘটনা আমার মতে সামাজিক জ্যামিতির বৃহত্তম এবং কঠিনতম উপপাদ্য। ভাবতে অবাক লাগে, এই আদি মহাকাব্যই আমাদের দেশের যাবতীয় সভ্যতার (এবং অসভ্যতার) ভিত্তি।
আমরা এই সারস হোটেলে থেমেছি ডিনার করতে। ভাত, ডাল, ভাজি, মিক্স ভেজ খেতে দুজনের খরচা হল ছশো টাকারও বেশি। আমাদের বাস দিল্লি ছেড়েছে সন্ধে ছটা কুড়ি নাগাদ। প্রায় সাড়ে পাঁচশো কিলোমিটার রাস্তা যেতে সময় লাগার কথা দশ-বারো ঘণ্টা। এসি লাক্সারি কোচ। বাসের ছাদ থেকে সিট পর্যন্ত গ্লাস উইন্ডো। সব আরামকেদারার সঙ্গে রয়েছে মোবাইল চার্জিং পয়েন্ট। জলের বোতলও দেওয়া হয়েছে সবার জন্য। বাসের মধ্যে একটা বাঙালি দল ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে এ কোণ থেকে ও কোণ কথা ছোঁড়াছুড়ি করে যাচ্ছিল। কাজেই বেশ একটা হৈচৈ ভাব নিয়ে আমরা সোনিপাত–পানিপথ–করনাল হয়ে কুরুক্ষেত্র অবধি পৌঁছেছি। অর্থাৎ শ্রীনগর–কন্যাকুমারী হাইওয়ে ধরে আমরা তিন ঘণ্টায় প্রায় ১৭৫ কিলোমিটার উত্তরে চলে এসেছি। এরপর আম্বালা হয়ে চণ্ডীগড়। সেখান থেকে বিলাসপুর, সুন্দেরনগর, মান্ডি, ভুন্টার, কুল্লু হয়ে মানালি। বিয়াসের ধার ধরে পাহাড়ি পথ। কিন্তু রাতের বেলা বাইরের দৃশ্য বিশেষ উপভোগ করার নেই। কাজেই এবারে বাসে উঠে ঘুমের একটা চেষ্টা করা দরকার।
১০ই অক্টোবর ২০১৬, সোমবার, মানালি, সকাল ১১:৩০ মিনিটঃ
মানালি বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছেছি সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ।
ভোর চারটের সময় আমাদের বাস মান্ডিতে রিফ্রেশমেন্ট ব্রেক দিয়েছিল। গায়ে জ্যাকেট চাপিয়ে বাসের বাইরে পা রাখতেই পাহাড়ি ঠান্ডার ঝলক টের পেলাম। অন্ধকার ভেদ করে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে হিমালয়। কয়েকটা হোটেল–রেস্তোঁরায় আলো জ্বলছে, আর গোটা চারেক নাইট সার্ভিসের বাস ওই রেস্তোঁরাগুলোর সামনে থেমেছে। বাসের লোকজনও ভাগাভাগি করে রেস্তোঁরাগুলোতে ঢুকেছে। কেউ কেউ দেখলাম চা–কফিরও অর্ডার দিল।
মান্ডি থেকে মানালি আরও ১০৮ কিলোমিটার।
সকালে ঘুম ভাঙতে দেখি দিনের আলো ফুটেছে। ঘড়িতে দেখলাম সাড়ে ছটা, আর বাসের জানলা দিয়ে দেখলাম পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে বিয়াস নদী আমাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলেছে। পাহাড়ের ঢালে গাছগাছড়ার ফাঁক দিয়ে কোথাও কোথাও ঘর বাড়ি দেখা যাচ্ছে। আরও প্রায় ঘণ্টাখানেক এই পাহাড়ি পথে চলার পর বাস অপেক্ষাকৃত জমজমাট দোকানপাট ঘেরা একটা জায়গায় থামল। কন্ডাকটারের হাঁকডাকে বুঝলাম মানালি এসে গেছি।
বাইরে কনকনে ঠান্ডা। বাস থেকে লাগেজ সংগ্রহ করে একজনকে জিজ্ঞাসা করতেই সে বিয়াস হোটেলের পথ দেখিয়ে দিল (এখানে কুলিও ছিল, কুড়ি টাকায় লাগেজসমেত বিয়াস হোটেলে পৌঁছে দেবে)। আমরা বাস রাস্তার উতরাই ধরে পুবদিকে সামান্য এগিয়ে বাঁদিকে বাঁক নিতেই দেখলাম বিয়াস নদীর লাগোয়া হিমাচল ট্যুরিজমের হোটেল বিয়াস। বাসস্ট্যান্ড থেকে আক্ষরিক অর্থেই দু মিনিটের রাস্তা।
হোটেলের চেক-ইন বেলা বারোটায়। রিসেপসনের ভদ্রলোক বললেন দশটা নাগাদ ঘর পেয়ে যেতে পারি। রাজাদের আসতে আসতে সেই বিকেল। হোটেলের ক্লোকরুমে মালপত্র রেখে ফ্রেশ হয়ে রাস্তায় বেরলাম।
প্রজাপতি ব্রহ্মার পুত্র বৈবস্বত মনুর মানসজাত মানালি। পুরাণের গল্প অনুযায়ী, ভগবান মনুর সপ্তম অবতার বৈবস্বত অবগাহনের সময় একটি ছোট্ট মৎস্য দেখলেন। সেই মৎস্যের নির্দেশ অনুযায়ী বৈবস্বত মনু তাকে ভক্তিভরে সংরক্ষণ এবং পালন করতে শুরু করলেন। কালক্রমে সেই মৎস্য বিশাল আকৃতি ধারণ করল এবং বৈবস্বত মনু তাকে সমুদ্রে ছেড়ে দিয়ে এলেন। সেই মৎস্য সমুদ্রে যাবার পূর্বেই আসন্ন মহাপ্রলয় সম্বন্ধে বৈবস্বত মনুকে সতর্ক করে দিয়েছিল। প্রলয়কালে,সমগ্র পৃথিবী যখন জলে নিমজ্জিত,ওই মৎস্যের দৌলতে সপ্তঋষি সহ বৈবস্বত সুরক্ষিত রইলেন। এই মৎস্যই ভগবান বিষ্ণুর মৎস্য অবতার। কালের প্রবাহে প্রলয়ের সমুদ্র প্রশমিত হল। তার পরিবর্তে রইল সুবিশাল পর্বতরাজি আর নদী। এই পর্বতের কোলেই হল ভগবান মনুর নামাঙ্কিত মানালসু। "মনু-আলয়" থেকে কলিযুগের ডাকে মানালি। নদীর নাম বিয়াস। মানব জন্মের সৃষ্টিও নাকি বিয়াসের ধারে এই মানালিতে।
পৌরাণিক স্বর্গের সংজ্ঞা আমার জানা নেই,তবে এই জায়গাটা নিঃসন্দেহে স্বর্গীয়। মানালির উচ্চতা ২০৫০ মিটার। সেই পুরাণের আমল থেকেই পাহাড়ের বুক চিরে ছুটে চলেছে বিয়াস। হোটেল থেকে বেরিয়ে উত্তর দিকে এগোতেই বিয়াস নদীর ওপরে পর পর দুটো ব্রিজ দেখলাম। দুটো ব্রিজই ওয়ান ওয়ে। আমরা প্রথম ব্রিজটা পেরিয়ে নদীর পুব পাড়ের রাস্তায় উঠলাম। ব্রিজের দক্ষিণ দিকে আমাদের হোটেল বিয়াস। আর উত্তরে তাকিয়ে দেখলাম হিমালয়ের মাথায় বরফ পড়েছে। রাস্তার অন্য ধারে পাহাড়ের ঢালে মানালি শহর আর দেবদারু গাছের জঙ্গল। নদীর ধারের রাস্তা ধরে হাঁটাহাঁটি করে সত্যি মন ভরে গেল।
বেলা সাড়ে আটটা নাগাদ মনে হল খিদে পেয়েছে। নদীর ধার ছেড়ে হোটেলের পাশ কাটিয়ে বাসস্ট্যান্ডের দিকে এলাম। বাসস্ট্যান্ডে দেখলাম কয়েকটা কন্সট্রাকসানের কাজ চলছে। সবগুলোই বোধহয় হোটেলের। এখানে এই মুহূর্তে গোটা চারেক বাস দাঁড়িয়ে আছে আর মেরেকেটে জনা দশেক স্থানীয় লোক ঘোরাফেরা করছে। শহরের মধ্যে এত ফাঁকা বাসস্ট্যান্ড আগে কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ল না। জায়গাটা চারদিকে পাহাড় ঘেরা। সামনের পাহাড়ের গায়ে সেই সাজানো দেবদারু গাছের সারি। আর উত্তরে শহরের মাথায় বরফের মুকুট। সেই সঙ্গে উত্তর-পশ্চিম দিকে উডল্যান্ড জুতোর হোর্ডিং-ও চোখে পড়ল। স্থানীয় একটা রেস্তোঁরায় রুটি-রাজমার তরকারি আর লিকার চা দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারলাম।
খেয়েদেয়ে আবার বিয়াস নদীর দিকে হাঁটা লাগালাম। হোটেলের কাছে এসে দেখলাম উল্টো দিকে পাহাড়ের ঢাল ধরে একটা সিঁড়ি উঠে গেছে প্রায় কুড়ি-পঁচিশ ফুট। সেখানে কয়েকটা দোকান উঁকিঝুঁকি মারছে। ওপরে উঠে দেখলাম জায়গাটা একটা বাজার। রাস্তার দুপাশেই আনাজপাতি, ফলমূল, জামাকাপড়, শীতের পোশাক, খাবারদাবার এমনকী গরমাগরম জিলিপিও বিক্রি হচ্ছে। এখন হবে না। বিকেলে একবার হিমাচলী জিলিপি টেস্ট করে দেখতে হবে।
দোকানগুলোতে এখনও তেমন ভিড় জমেনি। পশ্চিমদিকে আরও একটু এগোতেই দেখলাম আমাদের রাস্তাটা আড়াআড়ি (উত্তর-দক্ষিণ)বিস্তৃত একটা ঝকঝকে চত্বরে এসে মিশেছে। মোড়ের মাথায় একটা ছোট্ট, কিন্তু ভীষণ সুন্দর মন্দির। গেরুয়া মন্দিরের গায়ে কাঠের কারুকার্য। এটা দুর্গামন্দির। ঝকঝকে চত্বরের পুরোটাই রঙিন কাগজ দিয়ে সাজানো। এটাই মানালি ম্যাল।
গতকাল সারারাত বাস জার্নি করেছি। তাই এখন আর ম্যালে না ঘুরে হোটেলের ফিরতি পথ ধরলাম। হোটেলে এসে একটু অপেক্ষা করে সোয়া দশটা নাগাদ ঘর পেয়ে গেলাম। ঘরের লাগোয়া বারান্দায় এসে দেখলাম নিচে অপরূপা বিয়াস আপনভোলা হয়ে ছুটে চলেছে।
আসলে এই দৃশ্য তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করার জন্যই লগ হাট, কটেজ বা অন্যান্য হোটেল ছেড়ে বিয়াস হোটেলের ঘর নেওয়া। সত্যি,এখানকার বারান্দায় বসে মানালি আর বিয়াসের রূপ দেখে দিনের পর দিন কাটিয়ে দেওয়া যায়।
আপাতত চুপচাপ বিয়াসের শোভা অনুভব করি। তারপর লাঞ্চ সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে কাছাকাছি কোথাও ঘুরে আসা যাবে।
১০ই অক্টোবর ২০১৬, সোমবার, মানালি, সন্ধ্যে ৭:৫০ মিনিটঃ
সারাদিনে যা বুঝলাম,মানালির সৌন্দর্য বড় আটপৌরে। এ আলাদা করে খুঁজতে হয় না, যেন নানা অছিলায় নিজেই বার বার সামনে হাজিরা দিয়ে যায়। আসলে এখানে দার্জিলিং, মুসৌরি, কালিম্পং-এর মত ঘিঞ্জি ভাব নেই,তাই প্রকৃতিও অনেক পরিস্ফুট। রাস্তাঘাটে যতজন লোক থাকা দরকার,যেন হিসেব করে ঠিক ততজনই পথে নেমেছে। এরা মুলতঃ হিন্দিভাষী, কিন্তু উচ্চারণে হিমাচলী নিজস্বতা আছে। স্থানীয় লোকজন (বিশেষতঃ মেয়েরা)ফর্সা এবং সুঠাম চেহারায় আর্যদের কথা মনে করিয়ে দেয়। আরও দেখলাম, ম্যাল অঞ্চল ছাড়াও বিভিন্ন দ্রষ্টব্যের আশেপাশে ছড়ানোছেটানো বাজার গড়ে উঠলেও মানালির বিকাশ ঘটেছে প্রধানতঃ বিয়াসের ধার ধরে। মোদ্দা কথা, এত সহজ সরল শান্ত প্রবাহমান সৌন্দর্য আগে কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।
লাঞ্চ সারলাম বিয়াস হোটেলের রেস্তোঁরাতেই। রেস্তোঁরাটা ছোটো। তবে বাইরের বারান্দাতেও টেবিল – চেয়ার পেতে খাবার বন্দোবস্ত রয়েছে। নিরামিষ লাঞ্চ। দাম একটু বেশি। খাবারের পরিমাণও।
খেয়ে দেয়ে বেরোতে বেরোতে বেলা দুটো বাজল। এখানকার সাইটসিয়িং বলতে পুরানো মানালির মনু মন্দির আর মানালি-কুল্লুর পথে ছয় কিলোমিটার যেতে কুল্লুর এককালীন রাজধানী জগৎসুখ যেখানে অষ্টম শতকে তৈরি পাথরের গৌরীশঙ্কর মন্দির আর পনের শতকের সন্ধ্যা গায়ত্রী মন্দির অবশ্যদ্রষ্টব্য। এখানেই নাকি অর্জুন মহাদেবের তপস্যা করে পাশুপথ অস্ত্র সংগ্রহ করেন। অনতিদূরে রয়েছে হিড়িম্বা টেম্পল, বশিষ্ঠ আশ্রম, সোলাং -রোটাং, খান তিনেক তিব্বতী মনাস্ট্রি, নাগ্গার ক্যাসল ইত্যাদি। এছাড়া নানা ইনডোর গেমসের পসরা সাজিয়ে রয়েছে ক্লাবহাউস। এর মধ্যে আগামীকাল কেলং যাবার পথে সোলাং – রোটাং দেখে নেওয়া যাবে। আর নাগ্গার ক্যাসল-এ আমাদের বুকিং আছে ১২ তারিখ। তাই আপাততঃ আমরা কাছাকাছির মধ্যে বশিষ্ঠ আশ্রমের দিকে যাওয়া স্থির করলাম।
বশিষ্ঠ আশ্রম মোটামুটি দুই থেকে আড়াই কিলোমিটার পথ। বাসস্ট্যান্ডের দিকে একটু এগোতেই একটা অটো পেয়ে গেলাম। সাদাসিধে স্বাস্থ্যবান ড্রাইভার ভাড়া চাইল একশো টাকা। সারা বছর পর্যটনের ওপর ভর করেই ওর জীবিকা নির্বাহ। কাজেই দরদস্তুর করার বিশেষ ইচ্ছে হল না।
অটো ডানদিকে তিব্বতী কলোনি ছাড়িয়ে মানালি–লে সড়ক ধরে উত্তরমুখে ছুটে চলল। একসময় বাঁ দিকে বিয়াস নদী চলে এল একদম রাস্তার পাশে। ড্রাইভার বলল এখানে নাকি র্যাফটিং হয়। আরও একটু এগিয়ে মানালি–লে সড়ক এবং বিয়াস ছেড়ে ডান দিকে চড়াই ওঠা। দেখতে দেখতে একটা বাজার এলাকায় পৌঁছে ড্রাইভার সামনের দিকে দেখিয়ে বলল, "বশিষ্ঠ আশ্রম আগে হ্যায়।"
এলাকাটা আসলে একটা পাহাড়ি মফঃস্বল অঞ্চল। রাস্তার দু পাশে ছোটোখাটো হোটেল-রেস্তোঁরা আর মূলতঃ শীতবস্ত্রের দোকান। দোকানের জিনিসপত্রের মধ্যে চোখ টানল হিমাচলী টুপি। দরাদরি করে সত্তর টাকা দিয়ে একটা কিনেও ফেললাম। আর সৌখিন পোশাক পরা দোকানদারের চাপাচাপিতে দেখলাম ছিঙ্গু কম্বল। যতদূর বুঝলাম,স্থানীয় উচ্চারণে এগুলোর নাম পেরু। দোকানদারের কথায়,ছিঙ্গু নামে এক দুষ্প্রাপ্য প্রাণীর লোমের তৈরি এই রঙচঙে কম্বল। এই দুষ্প্রাপ্য প্রাণী এবং দুষ্প্রাপ্য কম্বল দুয়েরই জন্মস্থান নাকি খোদ ভূস্বর্গ। ম্যজিক কম্বলের একদিক ঢাকা দিলে গরম,আর অন্য দিকে ঠান্ডা হয়। দাম পঞ্চাশ শতাংশ ছাড় দিয়ে ৭৫০০ টাকা। সঙ্গে নানান রকম ফ্রি গিফট আর 'বিফলে মূল্য ফেরত' এর টোপ। টোপ গিললে বাড়িতে মাল পৌঁছে যাবে পনেরো দিনে। এখানে প্রায় সব দোকানিরাই এই কম্বল দেখানোর জন্য ব্যস্ত। এদের সঙ্গে দু-চার কথা বলতে বলতে তিরিশ গজ এগোতেই দেখলাম বশিষ্ঠ আশ্রম।
আশ্রমের আশেপাশে গোটা দুয়েক পূজার সামগ্রী বিক্রির দোকান। এখানে তিনটি ধাপে কাঠের কারুকার্যমণ্ডিত তিনটি মন্দির আছে। রাস্তার সমতলের মন্দিরটা ছেড়ে একটু এগোলেই দু'ধাপ নিচে মূল মন্দির। মন্দিরে ঢুকে চাতাল। পূর্বদিকের মন্দিরে পূজারি রয়েছে। এখানকার উষ্ণ প্রস্রবণে ছেলে আর মেয়েদের স্নান করার আলাদা বন্দোবস্ত। দেখলাম অনেকেই সেখানে পুণ্যস্নানে মেতেছে। প্রস্রবণের ছবি তোলা নিষেধ। আরও দেখলাম,নব বিবাহিত দম্পতিও সদলবলে এই আশ্রমে এসেছে পুণ্য অর্জনের জন্য।
হিমাচলের কাঠের মন্দিরগুলোর একটা প্যাটার্ন আছে মনে হল। কারণ,সকালে দেখা ম্যালের দুর্গা মন্দিরের সঙ্গে বশিষ্ঠ আশ্রমের গড়নের অনেক মিল। রাস্তা থেকে কয়েক ধাপ উঠে আরও একটা মন্দির। এখানেও ভালোই জনসমাগম হয়েছে। নিচে রাস্তার ধারের মন্দিরটাতে দেখলাম একদল বিদেশিনী তিলক কেটে নিজেদের ছবি তুলতে ব্যস্ত। সংস্কৃতির কী অদ্ভুত মেলবন্ধন!
বশিষ্ঠমুনি এখানে ঠিক কোথায় বসে তপস্যা করেছিলেন জানি না তবে পুরাণ-ইতিহাস-ভূগোল-দর্শনার্থী-পুণ্যার্থী-স্নানার্থী মিলে জায়গাটার স্থানমাহাত্ম্য আছে। কথিত আছে লক্ষণের বাণ ওই উষ্ণকুণ্ডের উৎস। জলে সালফার আছে। স্নানে নাকি নানান রোগের উপশম হয়।
বেলা সোয়া তিনটে নাগাদ ফিরতি পথ ধরলাম। এবারের গন্তব্য হিড়িম্বা মন্দির। সেই মতো বাজারের মধ্যে এসে অটো ধরলাম। আবার মানালি-লে সড়ক দিয়ে দক্ষিণদিকে এসে বিয়াস পেরিয়ে উত্তরপশ্চিমমুখী হিড়িম্বা টেম্পল রোড ধরে পৌঁছলাম মন্দিরের কাছে। ছয় কিলোমিটার রাস্তা পেরোতে অটো ভাড়া পড়ল দুশো টাকা।
মন্দিরের সামনেটা ঘিঞ্জি দোকানপাটে ভরতি। প্রবেশপথের সামনে গোটা দুয়েক ভিখারি,কতগুলো পূজাসামগ্রীর দোকান,ছবি তোলার জন্য একটা চমরী গাই,খাঁচার মধ্যে জোড়া খরগোস,হিমাচলী পোশাক পরে ছবি তোলার ব্যবসা,ভ্রাম্যমান ছবিওয়ালা – কী নেই! মহাভারতীয় মতে,এখানেই নাকি ভীম আর হিড়িম্বার বিবাহ হয়। আর ভারতীয় ইতিহাস অনুযায়ী,১৫৫৩ সালে মহারাজা বাহাদুর সিং-এর আমলে তৈরি হয় এই সাতাশ মিটার উঁচু চারধাপের প্যাগোডাসধর্মী কাঠের মন্দির। আবার এখানেই পাষাণ বেদিতে পড়েছে ভগবান বিষ্ণুর পায়ের ছাপ। ভিতরে পিতলের দেবী মূর্তি। বাইরে দর্শনার্থীদের লম্বা লাইন। মন্দির চত্বরেও ভ্রমণার্থীদের ভিড়ভাট্টা। মন্দিরের চারপাশে পাইন আর দেবদারু গাছের নিস্তব্ধ জঙ্গল। এর পুরনো নাম ঢুংরী জঙ্গল। তাই মন্দিরেরও ডাকনাম ঢুংরী মন্দির।
লাইন দিয়ে মন্দিরের ভিতরে ঢোকার কোনও প্রশ্নই নেই। তাই মন্দিরের আশে পাশে প্রায় সাড়ে চারটে অবধি ঘোরাঘুরি করে আমরা চললাম ম্যালের দিকে। সার্কিট হাউস রোড ধরে দু কিলোমিটার গেলেই ম্যাল। এবার অটো নিল আশি টাকা। সেই সুন্দর ঝকঝকে রঙিন কাগজ দিয়ে সাজানো ম্যাল রোড। অনেক হোটেল-রেস্তোরাঁ-দোকান রয়েছে এখানে। এর মধ্যে উত্তর ভারতীয়,দক্ষিণী,চিনে,বিলিতি,এমনকী ভাত-ডাল-পোস্তর বাঙালি রেস্তোঁরাও আছে।
পাহাড়ঘেরা ম্যাল লোকজনে ভর্তি। চোখে পড়ল স্টেট ব্যাঙ্কের এটিএম,সকালে দেখা উডল্যান্ডের সেই শোরুম। ম্যাল রোডের মাঝে মাঝে ফুলগাছের চারপাশে বসার জায়গাগুলোও সব ভর্তি। একটু এগোতেই পেয়ে গেলাম সকালের সেই দুর্গা মন্দির। মন্দির ছাড়িয়ে হিমাচল ট্যুরিজমের অফিস। তার পাশে ট্যাক্সি অ্যাসোসিয়েশান। এক কথায়, মানালিতে এটাই সবচেয়ে জমজমাট জায়গা।
আমরা ফিরেছি ঘণ্টাখানেক হল। রাজাদের এখনও পাত্তা নাই। আগামীকাল কেলং যাব। এখানে প্রতি মঙ্গলবার মেন্টেনেন্সের জন্য রোটাং পাসের রাস্তা বন্ধ থাকে। তবে কেলং যাওয়ার কোনও বিধিনিষেধ নেই। ট্যাক্সি অ্যাসোসিয়েশান থেকে জেনেছি আগামী কালও সকাল আটটা থেকে বেলা একটা অবধি শুধু কেলং যাত্রীদের জন্য পারমিট দেওয়া হবে । আমাদের অবশ্য পারমিট হয়ে গেছে। ভাবছি,কাল সকাল সাড়ে আটটার মধ্যেই বেড়িয়ে পড়ব।
১১ ই অক্টোবর ২০১৬, মঙ্গলবার, সোলাং ভ্যালি, সকাল ১০:২০ মিনিটঃ
সোলাং ভ্যালি পৌঁছতে সময় লাগল ঠিক পঁয়ত্রিশ মিনিট।
কমল কিশোর ওর পক্ষীরাজের মত ধবধবে সাদা ইনোভা গাড়ি নিয়ে বিয়াস হোটেলে চলে এসেছিল সকাল সাড়ে আটটার আগেই। কিন্তু বাঙালির ধর্ম মেনে আমরাই বেরোতে বেরোতে নটা বাজিয়ে দিলাম। দোষ দিয়ে লাভ নেই, সাতসকালের ঠান্ডার কনকনানি আর সুন্দরী বিয়াসের মায়াজাল কাটাতে এটুকু অতিরিক্ত সময় তো বরদাস্ত করতেই হবে। প্রথমে শীত উপেক্ষা করে স্নান করার চ্যালেঞ্জ, তারপর পেটপুরে আলুর পরোটা–আচার–কফি দিয়ে বিয়াস হোটেলের বিনি পয়সার ব্রেকফাস্ট, তারপর হোটেলের বিল মিটিয়ে গাড়িতে লাগেজ ওঠানো - সময় বহিয়া যায়… । রাজাদের গাড়ি পারমিট করাতে পারেনি, কাজেই ওরাও আমাদের সঙ্গেই চলেছে এ যাত্রায়।
কিছু কিছু লোক আছে, যাদের পরিচয়ের প্ল্যাকার্ড নিয়ে বেড়াতে হয় না, কারণ প্রথম দর্শন থেকে এদের কখনও অপরিচিত বলে মনেই হয় না। আমাদের চালক কমলকিশোর অনেকটা সেই ধাঁচের। ওর বাড়ি-গাড়ি সব শিমলার। চেহারায় হিমাচলী, ব্যবহারে আন্তরিক, দিব্যি খোশ গল্প করতে করতে আমাদের নিয়ে সোলাং অবধি চলে এল। যেন কতদিনের চেনা।
মানালি থেকে সোলাং ভ্যালি তেরো কিলোমিটার। পাহাড় কেটে তৈরি মানালি-লে জাতীয় সড়ক বিয়াসের সঙ্গে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলতে খেলতে চলে গেছে উত্তর দিকে। সবুজ ফেনিল জলরাশির ওপারে পাহাড়। সেই যেখানে রাস্তা নেমেছে বিয়াসের পাশে, সেখানে আজ দেখলাম অনেক লোক। কেউ কেউ নদীতে নেমে পড়েছেন গা ভেজাতে।
বিয়াস মোটামুটি রাস্তার বাঁ দিক ধরে বয়ে চলেছে। তাকে কখনও দেখা যাচ্ছে, কখনোবা যাচ্ছে না। শহর ছাড়িয়ে আরও একটু এগোতেই দৃষ্টি পড়ল নীচের দিকে এক বিস্তীর্ণ সবুজের গালিচার ওপর, যেখানে লুকিয়ে পড়া বিয়াসের পাশে কতগুলো মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং ছবির মত সাজানো। বাড়িগুলোর ছাদের গড়ন বিলিতি ঢঙে। সব বাড়ির ছাদই প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে সবুজ রং করা। দূর থেকে দেখে মনে হল এগুলো হোটেল। আসলে এটা একটা ছোট উপত্যকা, যার পর আবার পাহাড়ের প্রাচীর। সবুজ থেকে ক্রমশ শুকনো হয়ে যাওয়া পাহাড়ের মাথায় হালকা বরফের আস্তরণ। একেবারে ক্যানভাসে আঁকা।
আজ রোটাং পাস বন্ধ বলে রাস্তায় গাড়ি ঘোড়া নেই। একটা ভেড়ার পাল ছাড়া কোনও প্রাণীরই দেখা পাইনি সারা রাস্তায়। রাস্তার অবস্থা ভালো। হিমালয়ের বুক চিরে ঊর্ধ্বমুখী রাস্তা হলেও রাস্তায় ঘন ঘন বাঁক নেই। মাথার ওপর ঝকঝকে নীল আকাশ। উপরি হিসাবে পাহাড়ের গায়ে-মাথায় বরফ দেখা দিতে লাগল প্রায় সমস্ত যাত্রাপথেই।
প্রায় আধঘণ্টা পরে আমাদের গাড়ি মূল রাস্তা ছেড়ে বাঁ দিকের রাস্তা ধরল। নিস্তব্ধ রাস্তায় পাইন-দেবদারুর সঙ্গে কানাকানি করতে করতে খানিক দূর যেতেই দেখলাম এক জায়গায় কয়েকটা গাড়ি পার্ক করা আছে। বুঝলাম আমরা সোলাং ভ্যালি পৌঁছে গিয়েছি।
গাড়ি থেকে নেমে দেখলাম এখানে হোটেল রয়েছে, মুদিখানার দোকান রয়েছে, বড় বাগান-ছাতার নীচে ছোটো চায়ের দোকান রয়েছে, ট্যুরিস্টও রয়েছে। এখান থেকে খানিকটা চড়াই উঠে আবার একটা রাস্তা। তারপর মাঠ। তারপর পাহাড় পাহাড় আর পাহাড়। যত্ন করে বরফঘষা ফিকে রঙের পাহাড়ের সামনে সেই মার্কা মারা দেবদারু–পাইনের সারি অনন্তকাল ধরে কিসের যেন প্রতীক্ষা করে চলেছে।
মাঠের মধ্যে যত না ট্যুরিস্ট, হুড়োহুড়ি তার চেয়ে অনেক বেশি। ন্যাড়া মাঠে প্যারাগ্লাইডিং চলছে। একজন মহিলা প্যারাগ্লাইডারকে দেখলাম শূন্য থেকে প্রায় উড়ে এসে শুকনো ডাঙায় আছাড় খেল। তৎক্ষণাৎ রিটায়ার্ড হার্ট। বরফ থাকলে একরকম, কিন্তু এই শুকনো পরিবেশে প্যারাগ্লাইডিং করার দুঃসাহস দেখাতে গেলে বাদবাকি ট্যুর হরিবোল হয়ে যেতে পারে। তাই প্যারাগ্লাইডিং বাদ দিয়ে মাঠ পেরিয়ে গেলাম রোপওয়ে ষ্টেশনে। রোপওয়ে ক্যাব যাচ্ছে পাহাড়ের ওপরের দিকে। ভাড়া সাড়ে ছশো টাকা করে। টিকিট কেটে ক্যাব এ উঠে পড়লাম।
ক্যাবে মোটামুটি ছ'জন বসতে পারে। রোপওয়ের রাস্তাটায় পাহাড়ের ঢাল জুড়ে সবুজ ঘাস বোনা। মিনিট দশেকের জার্নি। এরই মধ্যে কয়েক মুহূর্তের জন্য সবুজ পাহাড়ের পিছন দিকে বরফমোড়া হিমালয় উঁকি মেরে গেল। রোপওয়ে থেকে নেমে দেখলাম সাইনবোর্ডে এখানকার উচ্চতা লেখা আছে ১১, ৮০০ ফুট।
ঠান্ডা আছে। তবে তাতে রোদ্দুরের প্রলেপও আছে। রোপওয়ে স্টেশনের পাশেই সাজানোগোছানো রেস্তোঁরা। পাহাড়ের ঢালে সেই চোখ-ভালো-করা সবুজ ঘাসের আস্তরণ। আশেপাশে নানা জাতের ছোট বড় নাম-না-জানা গাছগাছালি। একদিকে বুনো গাছের ফাঁক দিয়ে দেখলাম, দূরে, পাহাড়ের চুড়োয় কেউ যেন তুলি দিয়ে বরফের প্রলেপ এঁকে দিয়েছে।
এখানেও বাঙালির সেই চেনা হৈ-হুল্লোড়। যথারীতি সবচেয়ে বেশি ভিড় জমেছে রেস্টুরেন্টে। রোপওয়ে স্টেশন আর রেস্টুরেন্ট ঠিক পাশাপাশি। এর পিছন দিকেও, পাহাড়ের গায়ে ঠিক যেন হাতে বোনা দেবদারু গাছের সারি। তার ওপরের দিকে খয়েরি রঙের পাহাড় চুড়োয় সাদা বরফের আঁচড়। সব মিলে দুর্দান্ত ছবি। কিন্তু তবুও, এ হিমালয়কে কেমন একটু যেন অন্য রকম লাগছে।
বরফ ঢাকা হলে কেমন হত জানি না, তবে আজকের সোলাং এর সবচেয়ে আভিজাত্য ওর উচ্চতায়। অক্টোবরের পরিষ্কার আকাশে এখানে বরফের আশা করা বৃথা। তাই যা দেখলাম সেটাকে মগজবন্দি করে এই বেলা কেলং-এর দিকে রওয়ানা দিয়ে দেওয়াই শ্রেয়। সামনে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দুর্গম পাহাড়ি পথ। অতএব, চরৈবেতি চরৈবেতি।
১১ ই অক্টোবর ২০১৬, মঙ্গলবার, মারহি, দুপুর ১২:৪৫ মিনিটঃ
যতই তাড়াহুড়ো করি না কেন, সোলাং ভ্যালি ছেড়ে রওয়ানা হতে হতে সেই সোয়া এগারোটা বেজে গেল। সোলাং-রোটাং প্রায় পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার রাস্তা। তার ওপর আমরা রোটাং পেরিয়ে যাব কেলং অবধি। রাস্তার বেশ কিছু অংশ আবার শুনেছি অগোছালো ভাবে রাখা ফিতের মতো প্যাঁচালো। সুতরাং মনে মনে একটু তাড়াহুড়ো ছিলই। কিন্তু গাড়ি দু-চারটে বাঁক ঘুরতেই সমস্ত চিন্তা যেন ম্যাজিকের মতো উধাও হয়ে গেল।
রাস্তার দুপাশে দুর্ভেদ্য পাহাড় আর আকাশছোঁয়া সার সার দেবদারু–পাইন–বার্চ জাতীয় গাছ। গাছের পিছনে রুক্ষ পাহাড়ের ঢাল। গাছের রঙ একেবারে তরতাজা সবুজ নয়; বরং পাহাড়ের সঙ্গে রঙ মিলিয়ে সামান্য ফিকে। একদম হাত মেলানোর দুরত্বে পাহাড়ের লাগোয়া বরফের প্রাচীর। আশ্চর্য! প্রতিটা বাঁক ঘুরতেই এই বরফের পাহাড় যেন নানা রকম ভঙ্গিমায় পথের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ছে। আমাদের দেশে প্রকৃতি যেন সৌন্দর্যের পসরা নিয়ে ছেলেখেলা করেছে।
বিয়াস নদী পথের দৃশ্যকে যোগ্য সঙ্গত করছে; হঠাৎ হঠাৎ কোনও বাঁক ঘুরেই মনে হচ্ছে ওই বরফের চুড়ো ভেঙে নদীটা নেমে এসে পাহাড়ি ব্রিজের নিচ দিয়ে সোজা মানালির দিকে দৌড় লাগিয়েছে। "নদী আপন বেগে পাগলপারা।" এই রকম ছবি ক্যালেন্ডার ছাড়া আর কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। গাড়ির বাকি সকলেই নির্বাক দর্শক। একমাত্র কমলকিশোরই যা ব্যস্ত। ওর বহু পরিচিত এই সৌন্দর্য ওকে কতটা অভিভূত করছিল বুঝতে পারছিলাম না, কিন্তু এরই মধ্যে ও সোলাং থেকে চার কিলোমিটার এগিয়ে "Ladakh Motor India" লেখা এক গুমটি অফিসে পারমিট দেখিয়ে এল। অফিসের আশেপাশে দু-চারটে গাড়ি চোখে পড়লেও জনবসতি নেই। তবে কমল বলল, কাছাকাছি নাকি পালচান নামে একটা ছোট গ্রাম আছে। আরও বেশ খানিকটা এগিয়ে কমলই চিনিয়ে দিল রহল্লা ফলস। এখন সময় কম। তাই ঠিক হল ফেরার সময় এখানে নামা হবে। তারপর বিয়াস লেকের ব্রিজ পেরিয়ে একটু যেতেই আমাদের গাড়ি একটা পাহাড় ঘেরা তেরপল রঙা উপত্যকায় ঢুকে পড়ল। কমল বলল "ইয়ে হ্যায় মারহি।"
এখানেই আপাততঃ টি ব্রেক নেওয়া হয়েছে। আমরা সোলাং ভ্যালি ছেড়ে প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার চলে এসেছি। আগেই বলেছি, এলাকাটা চারদিক পাহাড় দিয়ে ঘেরা। রাস্তাটা যেন উপত্যকার এক দরজা দিয়ে ঢুকে একটা বাঁক নিয়ে উল্টো দিক দিয়ে বেড়িয়ে গেছে। এখানকার উচ্চতা ৩৩৬০ মিটার। উপত্যকার প্রবেশ করেই বাঁ দিকের পাহাড়ের ঢালে গলা জড়াজড়ি করে একটা মন্দির আর একটা চোর্তেন। প্রত্যন্ত হিমালয়ের বুকে ধর্মের কোনও ভাগাভাগি নেই। আমরা পায়ে পায়ে গিয়ে দেখলাম মন্দিরের দরজা বন্ধ (স্থানীয় একজন মহিলা বললেন, এটা নাকি দুর্গা মন্দির)।
ওপর থেকে উপত্যকাটা একদম ছবির মতো দেখাচ্ছে। খয়েরি রঙের পাহাড়ি দুর্গের মাঝখান দিয়ে পাটকিলে রঙা রাস্তা। তার পাশে কতগুলো রেস্তোঁরা, গোটা পাঁচ -সাত গাড়ি, একটা টুরিস্ট বাস আর সবসুদ্ধু জনা ত্রিশেক লোক। আরেকটা বিশেষত্ব হল, এখানে একটাও গাছ নেই। এইসব নিরামিষ উপকরণ দিয়ে অদ্ভুত সৌন্দর্য তৈরি হতে পারে ভাবতেই পারছি না।
ছবিতে দেখা লাদাখ উপত্যকার সঙ্গে এখানকার অনেক মিল। মারহি আদতে রোটাং পেরিয়ে কেলং, কাজা যাত্রীদের জন্য একটা হল্ট পয়েন্ট। এখানে যাত্রীরা খাওয়া দাওয়া সারতে নামে। বরফ পড়ে রোটাং পাস বন্ধ হলে ট্যুরিস্টরা সাধারণতঃ মারহি পর্যন্ত আসতে পারে। এখানেও প্যারাগ্লাইডিং-এর আসর বসে। তবে আজ রোটাং বন্ধ; তাই অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসও বন্ধ।
আমরা রাস্তার ধারে খোলা রেস্তোঁরায় চা নিয়ে বসেছি। লিকার চা এক গ্লাস পঁচিশ টাকা। রোটাং এখান থেকে এখনও পনেরো কিলোমিটার। ঘড়ি বলছে প্রায় দুপুর একটা। কমলকিশোর বলছে "জলদি কিজিয়ে।" অতএব, মারহির মোহ এবার ত্যাগ করতেই হচ্ছে।
মারহি ছাড়াতেই নিচের দিকে ক্রমশঃ ছোট হয়ে আসা বিয়াস লেককে ঘিরে ফিতের মতো রাস্তাগুলো দেখা দিতে লাগল বার বার। এক এক পাক ঘুরে ওপরে উঠছি, আর বিয়াস লেক এবং তার সংলগ্ন ঘূর্ণিপাক রাস্তা এক ফ্রেম করে ছোট হচ্ছে। আগেই বলেছি এ হিমালয় কেমন যেন অপরিচিত। আমি উত্তর সিকিম দেখেছি, আবার গাড়োয়ালের হিমালয়ও দেখেছি; সেখানে পাহাড়ের গায়ে সবুজের আবরণ যেন আদিম প্রকৃতির লজ্জা নিবারণ করে তাকে আরও সুন্দরী করে তুলেছে। কিন্তু এখানকার সৌন্দর্য বড় নগ্ন আর পুরুষালি। সবুজ দূরের কথা, আশপাশের পাহাড়ে একটা ঘাসও চোখে পড়ছে না। এটা পীর পাঞ্জাল রেঞ্জ। এ আসলে যত না হিমালয় তার চেয়ে অনেক বেশি হিন্দুকুশ আর কারাকোরাম। এই পথ শোভা দেখতে দেখতে অনেকটা চড়াই উঠে রাস্তার ডানদিকে দেখলাম একটা ইগলু আকৃতির আস্তানা। কমল গাড়ি থামিয়ে বলল, "হাম লোগ রোটাং পাশ আ গয়ে। উও হ্যায় বিয়াস মাতা মন্দির। আপলোগ ঘুমকে আও।"
প্রায় ৪০০০ মিটার উচ্চতায় পৃথিবীর বুকে পা ফেলে হাঁটার রোমাঞ্চ ঠিক বলে বোঝাতে পারব না। ঘড়িতে বাজে দুপুর একটা চল্লিশ। এখানে আজ আমরা ছাড়া অন্য কোনও পর্যটক নেই। রাস্তার ডান দিকের পাহাড়ে তিরিশ-চল্লিশ মিটার দূরে কতগুলো পাথুরে সিঁড়ি চড়ে বিয়াস টেম্পল। পায়ে পায়ে সিঁড়ি ভেঙে উঠতে উঠতে পৃথিবীর শীতলতম ঝোড়ো হাওয়া কানে সপাটে ঝাপটা মারল। কোনোরকমে হাতে গ্লাভস, মাথায় জ্যাকেটের টুপি চাপিয়ে ওই মারাত্মক ঠান্ডা সামাল দিতে দিতে বিয়াস মাতার মন্দিরে পৌঁছতেই কোথা থেকে যেন একজন মিলিটারি জওয়ান আমাদের পাহারা দিতে চলে এল। ইশারায় জানাল মন্দিরের ভিতরে ঢোকা নিষেধ। মন্দিরের মাথায় হলুদ পতাকা। আশে পাশে আরও কতগুলো পতাকা প্রবল হাওয়ায় উড়ছে। এখানে এখন বরফ নেই। তবুও এই ভয়ঙ্কর পাথুরে পাহাড়ের মধ্যেও কী যেন এক অনাবিল আকর্ষণ রয়েছে, যার টানে লক্ষ লক্ষ পর্যটক প্রতিবছর এখানে ছুটে আসে।
মিনিট পনেরো পর ফটোসেশন শেষ করে নীচে নামলাম। গাড়ি সামান্য একটু এগোতেই দেখলাম রাস্তার ডানদিকে একটা চোর্তেন। রাস্তার পাশে অগভীর খাদ। তার পাশেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে সার সার পাহাড়ের চূড়ো। খয়েরি থেকে ক্রমশ নীল হয়ে যাওয়া সেইসব পাহাড়ের গায়ে-মাথায় শুভ্র বরফের প্রলেপ। আকাশে ঝকঝকে রোদ্দুর। আর এত নীল আকাশ আমাদের মতো শহুরে লোকের কাছে নিতান্ত দুষ্প্রাপ্য। আমরা এখানেও হৈ হৈ করে গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। গাড়ির বাইরে আসতেই আবার শুরু হল কনকনে ঠান্ডা হাওয়ার ভয়ঙ্কর আক্রমণ। আবহাওয়ার যা অবস্থা, এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকাই দায়। এরমধ্যেই এক হাতের গ্লাভস খুলে কোনরকমে ছবি তোলা হল।
রোটাং পাসকে আশ মিটিয়ে উপভোগ করে বেলা দুটো দশ নাগাদ আমরা গাড়ি স্টার্ট করলাম। গন্তব্য গ্রামফু পেরিয়ে আরও সাত-আট কিলোমিটার পাহাড়ি রাস্তা পেরিয়ে কোকসার - স্পিতি উপত্যকার দক্ষিণের সদর দরজা।
~ মানালি-রোটাং পাসের আরও ছবি ~
কৌস্তভ মজুমদারের বেড়ে ওঠা কলকাতায়। পেশায় গার্ডেনরিচ শিপবিলডার্সের ইঞ্জিনিয়ার। ঘোরা আর পড়া দুটোই নেশা। সেই থেকেই লেখার নেশার উৎপত্তি। নিজের ফেসবুক প্রোফাইলের বাইরে 'আমাদের ছুটি'-তেই প্রথম লেখা পাঠানো।