নীলাকুরিঞ্জির খোঁজে

গার্গী মন্ডল


~ মুন্নারের আরও ছবি ~

নীলগিরি, আক্ষরিক অর্থে নীল রঙের পাহাড়। দক্ষিণ ভারতে যে পশ্চিমঘাট পর্বতমালা আছে, তার কিছুটা অংশকে বলা হয় নীলগিরি। এই নীলগিরির উচ্চতম শিখরটির নাম ডোডাবেট্টা, যেটি উটি শহর থেকে মাত্র ছয় কিমি দূরে অবস্থিত। নীলগিরি পর্বতমালা উত্তর-দক্ষিণে নব্বই কিমি এবং পূর্ব-পশ্চিমে মোটামুটি আশি কিমি জুড়ে বিস্তৃত। তামিলনাড়ুতে একটি জেলার নাম নীলগিরি, যেখানে ডোডাবেট্টা অবস্থিত। এছাড়াও কর্ণাটক ও কেরালাতেও বেশ কিছুটা অংশে নীলগিরি বিস্তৃত।

কথিত আছে নীলগিরি পর্বতের নামকরণ হয়েছে এক বিশেষ ফুল থেকে। এই ফুলের নাম হল নীলাকুরিঞ্জি। অদ্ভুত সুন্দর এই বেগুনি রঙের ফুলটি বারো বছরে একবার ফোটে। বর্ষার শেষে যখন একটু একটু করে রোদ উঠতে থাকে,সেই শরতের নীল আকাশের নীচে আস্তে আস্তে ফুটতে থাকে নীলাকুরিঞ্জিরা। ক্রমে পাহাড় ঢেকে যায় এই নীলচে-বেগুনী রঙের ফুলে, দূর থেকে মনে হয় নীল পাহাড় অথবা নীলগিরি। নীলাকুরিঞ্জি ফুলের গাছটি আসলে একটি গুল্ম। পাহাড়ি রাস্তার ধারে বা পাহাড়ের ওপরে ঝোপ করে ফুটে থাকে এরা। ফুলগুলি সবচেয়ে সুন্দর দেখায় সকালবেলায়, যখন জ্বলজ্বল করতে থাকে নরম সূর্যের আলোয়।

এই বিশেষ ফুলটির সম্মানে নীলগিরির নামকরণ হলেও আজ এই ফুল অনেকাংশেই কম দেখতে পাওয়া যায়, যার মূল কারণদুটি হল বসতি গড়ে ওঠা এবং চা বাগান বানানো। দেখা গেছে চা চাষ এই ফুলের জন্য যথেষ্ট হানিকারক। সেইজন্য এখন তামিলনাড়ু, কর্ণাটক বা কেরলের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আর এর দেখা পাওয়া যায়না। এই ফুলটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আপাতত কেরল সরকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে বেশ কিছু পাহাড়ি এলাকাকে জাতীয় উদ্যান বানিয়ে। এদের মধ্যে বিশেষ হল মুন্নারের এরাভিকুলাম জাতীয় উদ্যান। এছাড়াও আছে কানন দেভান উদ্যান, কুরিঞ্জি স্যাংচুয়ারি, চিনার জাতীয় উদ্যান ও মারায়ূরের (মুন্নার থেকে চল্লিশ কিমি দূরে) কিছু অংশ।

খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারলাম ২০১৮-তে এই ফুল দেখতে পাওয়ার সবচেয়ে সম্ভাবনা বেশি এরাভিকুলাম জাতীয় উদ্যানে। বর্ষার শুরু থেকেই এখানে যাব বলে ঠিক করে রেখেছিলাম - নীলগিরি দেখতে, যে ফুল বারো বছরে একবার ফোটে তাকে চাক্ষুষ করতে। বাধ সাধল এই বছরের কেরলের ভয়ঙ্কর বন্যা যাতে মুন্নার বহুলাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। বিভিন্ন খবরের কাগজ ও চেনাজানা লোকেদের কাছ থেকে বারবার খোঁজ নিয়ে অবশেষে ট্রেনের টিকিট কেটেই নিলাম, কিছুটা অনিশ্চয়তা আছে জেনেও। এরাভিকুলাম উদ্যানের টিকিট আর হোটেল অনলাইনে বুক করে নিলাম। তারপর, সবরকম ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে, খানিক ভগবানের উপর ভরসা করে, ২৯শে সেপ্টেম্বর, শনিবার যাত্রা করলাম মুন্নারের উদ্দেশ্যে - নীলাকুরিঞ্জির সন্ধানে।

ব্যাঙ্গালোর থেকে তিন-চারটি ট্রেন আছে আলুভা যাওয়ার জন্য। আমরা যাচ্ছি কন্যাকুমারী এক্সপ্রেসে। রাত আটটায় ট্রেন ছাড়ল, পরদিন সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ আলুভা স্টেশন পৌঁছল,ঘন্টা দেড়েক লেটে। স্টেশনে নেমে পুট্টু আর ডিমের তরকারি খেয়ে নিলাম। পুট্টু হল ভাত আর নারকেল দিয়ে তৈরি কেরলের একটি খাদ্য। খাওয়াদাওয়া সেরে আলুভা থেকে বাসে মুন্নারের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। মাঝে কোঠামাঙ্গলাম বলে এক জায়গায় বাস বদলাতে হল। আলুভা থেকে মুন্নারের দূরত্ব প্রায় একশো পঁচিশ কিমি, জনপ্রতি বাস ভাড়া একশো পনেরো টাকা, সময় লাগল প্রায় পাঁচ ঘন্টা। প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করেও যাওয়া যেতে পারে, খরচা পড়বে প্রায় তিন হাজার টাকা। আলুভা থেকে মুন্নারের রাস্তায় পড়বে বেশ কিছু নয়নাভিরাম জলপ্রপাত। আদিমালী (মুন্নারের ত্রিশ কিমি আগে) থেকে কিছুটা এগোলেই শুরু হয়ে যাবে চা বাগান। এই পাহাড়ি রাস্তায় চলার জন্য সঙ্গে পর্যাপ্ত পরিমাণে জল ও কিছু বমির ওষুধ রাখা বাঞ্ছনীয়। মুন্নারে নানারকম বাজেটের হোটেল আছে থাকার জন্য। খাওয়ার জন্যও প্রচুর রেস্টুরেন্ট আছে, ভারতবর্ষের সবরকম খাবারই মোটামুটি পাওয়া যায়।

অনলাইন বুকিং ছাড়াও এরাভিকুলাম উদ্যানের জন্য মুন্নারের কে.এস.আর.টি.সি. বাসস্ট্যান্ডের সামনে অফিস থেকে টিকিট পাওয়া যায়। আমাদের তিনজনের জন্য একটি স্টিলক্যামেরা ব্যবহারের অনুমতিসহ অনলাইনে খরচ পড়েছিল চারশো টাকা। টিকিট কাটার সময় উদ্যানে প্রবেশের সময় পছন্দমত বাছাই করার সুযোগ আছে। উদ্যান খোলা থাকে সকাল সাতটা থেকে বিকেল পাঁচটা অবধি,এর মধ্যে যতক্ষণ খুশি এখানে সময় কাটাতে পা্রা যায়। গেটে টিকিট দেখালে উদ্যানেরই বাসে আপনাকে আপনার টাইম স্লট অনুযায়ী মূল উদ্যানে নিয়ে যাওয়া হবে। সেই মূল উদ্যান থেকেও আবার বাস আছে গেটে ফিরিয়ে আনার জন্য। মুন্নার টাউন থেকে এরাভিকুলাম যাওয়ার জন্য সরকারি বাস আছে। মারায়ূর অভিমুখী বাসে চেপেও পৌঁছতে পারেন। অটো, জিপ তো আছেই। মুন্নার থেকে দূরত্ব চৌদ্দ কিমি।

টিকিটে উল্লেখিত নির্দিষ্ট সময়ে উদ্যানের প্রবেশদ্বারে পৌঁছে গেলাম। এরপর ওদের বাসে করে যাত্রা করলাম অজানা সেই নীলাকুরিঞ্জির উদ্দেশ্যে। বাসে করে যেতে যেতে সবুজ চা বাগানে আবৃত মুন্নারের সৌন্দর্য উপলব্ধি করলাম। চা বাগানের ঢাল বেয়ে বাস চলল পাহাড়ের আঁকেবাঁকে। কিছুক্ষণ পরেই দেখা গেল রাস্তার দুইধারে ফুটে রয়েছে এক ধরণের বেগুনি রঙের ছোট ছোট ফুল। মাঝারি মাপের ঝোপের মধ্যে থোকা থোকা হয়ে ফুটে আছে এই ফুল। মনে সন্দেহ হচ্ছিল - এই কি নীলাকুরিঞ্জি! হঠাৎ পাশ থেকে এক সহযাত্রী তাঁর বাচ্চাকে বলে উঠলেন - এটাই নীলাকুরিঞ্জি। শোনার পর আরও একাগ্র নজরে দেখতে লাগলাম ফুলগুলিকে। দুইরকম ফুল দেখা গেল। দেখতে দেখতে বাস পৌঁছে গেল তার নির্দিষ্ট স্টপেজে। সেখানে নেমে প্রায় এক কিমি হাঁটা পথ। এই পথ বানানো হয়েছে পাহাড়ের মধ্য দিয়েই, এঁকেবেঁকে। পথের দুধারে পাহাড়ের ঢাল, তারই মধ্যে ফুটে রয়েছে থোক-থোক নীলাকুরিঞ্জি। এরই মধ্যে নানা রকম অজানা পাখির কিচির মিচিরও ভেসে আসছিল। এরাভিকুলাম উদ্যান নীলগিরি টাহর (Tahr) নামে এক লুপ্তপ্রায় পাহাড়ি ছাগলের জন্যেও বিখ্যাত। পড়ন্ত বিকেলে বহুল জনসমাগম হওয়ায় কোন বিশেষ পাখি বা নীলগিরি টাহর চোখে পড়লনা।

এরাভিকুলামে পরদিন সকালেও বুকিং ছিল আমাদের। সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ আমরা উদ্যানে হাজির হয়েছিলাম। সকালের সূর্যের নরম মিঠে আলোয় চাক্ষুষ করলাম নীলাকুরিঞ্জির অদ্ভুত রূপ। সূর্যস্নাত ফুলগুলি চারিদিকে মনে হল ছড়িয়ে আছে বেগুনি মখমলের মত। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম যে এখনও পাহাড় জুড়ে সমস্ত ফুল ফোটেনি। মনে মনে কল্পনা করলাম নীলগিরির সেই অভাবনীয় সৌন্দর্য,যখন সে পুরোটায় ঢাকা পড়বে বেগুনি গালিচায় আর ভোরের সূর্যচ্ছটায় জ্বলজ্বল করবে সদ্যস্নাত কিশোরীর মত। এই সময়টায় লোকজন একটু কম থাকায় দেখতে পেলাম কিছু নতুন ধরনের পাখি,যেমন নীলগিরি থ্রাশ ও নীলগিরি ফ্লাইক্যাচার। দূরে চোখ যেতেই দেখলাম একটা পাথুরে টিলার ওপর পাঁচ-ছ'টি নীলগিরি টাহর রয়েছে - কেউ শুয়ে, কেউ বসে,কেউবা দাঁড়িয়ে। কিছুক্ষণ বাদে একটি টাহরকে খুব কাছ থেকে দেখা গেল,সে বোধহয় কোনভাবে দলছুট হয়ে লোকজনের মধ্যে এসে পড়েছে। প্রচণ্ড লাজুক এই প্রাণীটি সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় আপাতত এই এরাভিকুলামেই বর্তমান। উদ্যানের গার্ডদের কাছে জানা গেল যে এখানে নীলাকু্রিঞ্জির অনেক রকম প্রজাতি আছে। নীলাকুরিঞ্জি ট্রেকিং বলে একটি প্যাকেজে এদের মধ্যে অনেক প্রজাতির দর্শন মেলে। আমাদেরকে ওঁরা তিন রকম প্রজাতি দেখালেন। অবাক হলাম,একটি প্রজাতি সাদা রঙের,তার মধ্যে নীলের ছিটেফোঁটাও নেই।

দুপুরে ফেরার পালা। এগারোটা নাগাদ ফিরতি পথে বাস ধরলাম। মুন্নারে ফিরে এসে লাঞ্চ করে একটি ট্যাক্সি ভাড়া করে বেরিয়ে পড়লাম চারপাশটা একটু ঘুরে দেখতে। যা যা দেখলাম,তার মধ্যে মাটুপেট্টি ড্যাম আর একটি চা ফ্যাকট্রি। ব্রিজের উপর থেকেই দেখলাম ড্যামের সৌন্দর্য। এখানে বোটিং ও ওয়াটার স্পোর্টসের ব্যবস্থা আছে। চা ফ্যাকট্রিটিতে নানারকম চায়ের আস্বাদন করার সুবিধা আছে। এছাড়াও চা তৈরি করার সমগ্র প্রক্রিয়াটি খুব সাবলীল ভাবে বোঝানো হয়। চায়ের সম্বন্ধেও অনেক কিছু জানা যায়, যেমন গ্রীন টি ও হোয়াইট টি কাকে বলে, তাদের প্রক্রিয়াকরণ ও উপকারিতা। এছাড়াও গাড়ির ড্রাইভার আমাদেরকে একটি ফুলের বাগান আর বেশকিছু ভিউপয়েন্ট এবং একটি এলিফ্যান্ট রাইডেও নিয়ে গিয়েছিলেন।

সবকিছু শেষে বিকেল চারটে নাগাদ আলুভার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম, তখন শুরু হল আকাশ ভেঙে মুষলধারে বৃষ্টি। দেখলাম বজ্রবিদ্যুৎসহ বৃষ্টির এক ভয়াল রূপ। মনে পড়ে গেল কয়েক দিন আগের মুন্নারের বন্যাকবলিত রূপ। যাইহোক, আলুভা পৌঁছে গেলাম ঠিকমতই। ডিনার করে ব্যাঙ্গালোরগামী ট্রেনে উঠে পড়লাম। শুয়ে শুয়ে আমাদের ছোট্ট এই মুন্নার সফরের কথা ভাবতে লাগলাম। মনের গভীরে কোথাও সারাজীবনের জন্য হয়তো একটা ছবি আঁকা হয়ে গেল - ঘন সবুজ চা বাগানের ঢালে উজ্জ্বল নীলাভ শাড়ি পরিহিতা এক স্নিগ্ধ মোহময়ী - নীলগিরি।

~ মুন্নারের আরও ছবি ~

পেশায় সাইকিয়াট্রিস্ট ডঃ গার্গী মণ্ডল বর্তমানে বাঙ্গালোরের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড নিউরোলজিক্যাল সায়েন্সেস (NIMHANS)-এ কর্মরত। নেশা দেশভ্রমণ।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher