বর্ণময় প্রাগ

কণাদ চৌধুরী


~ প্রাগের আরও ছবি ~

স্টুটগার্ট থেকে ফ্রাংকফুর্ট হয়ে নুরেমবার্গ - এইটুকু ট্রেন। তারপরে বাসে চড়ে প্রায় সাড়ে-তিন থেকে চার ঘন্টার রাস্তা পেরিয়ে প্রাগ। নুরেমবার্গে ট্রেন থেকে নামার পরে বাসটা কোথা থেকে ছাড়বে, সেটা খুঁজে বার করতে করতে বাস ছেড়ে যাওয়ার সময় প্রায় চলে যায় আর কী!! বড়মেয়ে বিবাহসূত্রে জার্মানিতে বসবাস শুরু করার পরে আমাদের এই প্রথম এদেশে আসা। গত দু-বছরে ইউরোপের অনেকটাই চষে ফেললেও মেয়ে এই প্রথম একার দায়িত্বে বাপ-মা কে নিয়ে বেরিয়েছে ইউরোপের একটা ছোট্ট টুকরো দেখাতে, সম্ভাব্য বাস মিস হওয়ার টেনশনে তার কাহিল অবস্থা। শেষ অবধি একটু জিজ্ঞাসাবাদ আর দৌড়াদৌড়ি করে বাসের দেখা মিলল। মস্ত দোতলা ডয়সে বানের বাস, তার চেহারাখানা দেখতে পাওয়ার পরেই আমাদের ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। মালপত্র জমা করে দোতলায় উঠে এক্কেবারে সামনের সারিতে আমাদের তিনজনের সিটে গুছিয়ে বসতে না বসতেই বাস দিল ছেড়ে। বাসের অভ্যন্তরটি বেশ বিলাসবহুল। পয়সা দিলে মিলবে শীতল বিয়ার থেকে শুরু করে উষ্ণ কফি, যা আপনি চাইবেন। পানীয়ের সঙ্গে মিলবে খাদ্যও, চাইলে ওয়াই-ফাই দিয়ে আপনি যুক্ত থাকতে পারেন আন্তর্জালে, আছে বিনোদনের জন্য চলচ্চিত্র দেখার সুবিধা, রয়েছে টয়লেট,ব্যবস্থা সব একেবারে এরোপ্লেন কিংবা ট্রেনের মতই।
বাস ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল নুরেমবার্গ শহরের মধ্যে দিয়ে। প্রথমে সামান্যই রাস্তা শহরের ভিতরে, তারপরেই বাস গিয়ে পড়ল জার্মানির বিখ্যাত হাইওয়ে – অটোবান-এ। আকাশ একটু মেঘলা হয়ে আছে, তবে বৃষ্টি নেই। প্রাণভরে দুই পাশের মনভুলানো,চোখজুড়ানো সবুজের সমারোহ দেখতে দেখতে পথ চলেছি। অনুমান করতে পারছিলাম, বাসের গতিবেগ ঘণ্টায় প্রায় একশো কিমি, কিন্তু যেসব ছোট-ছোট গাড়ি বাসকে পাশ কাটিয়ে হুউউশ করে চোখের পলকে দিগন্তে মিলিয়ে যাচ্ছে, তাদের গতিবেগ ঘণ্টায় দুশো-আড়াইশো কিমি-র কম হবেনা কিছুতেই। জার্মানির অভ্যন্তরে অটোবানে গাড়ির গতিবেগের ওপরে কোনও উর্দ্ধসীমা বেঁধে দেওয়া নেই, তবে চেক প্রজাতন্ত্রে প্রবেশ করার পরে আর এই লাগামছাড়া গতিতে গাড়ি চালানো সম্ভব নয়, সেখানে নিয়মকানুন আলাদা। অটোবানের পাশে একজায়গায় চোখে পড়ল বেশ কিছু উইন্ডমিল। অপ্রচলিত শক্তির সন্ধানে এখন সকলেই সক্রিয় হয়ে উঠেছে। নেদারল্যান্ড উইন্ডমিলের জন্যে বিখ্যাত হলেও জার্মানিতেও তাদের দেখা মিলল বেশ কয়েক জায়গায়। প্রায় তিনশো কিমি রাস্তা পাড়ি দিয়ে নুরেমবার্গ থেকে প্রাগে পৌঁছতে আমাদের সময় লাগল প্রায় চার ঘণ্টা।
বোহেমিয়া, মোরাভিয়া এবং সিসেলিয়া এই তিনটে অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয়েছে চেকোশ্লোভাকিয়া ভাঙে তৈরি হওয়া বর্তমানের চেক রিপাবলিক বা চেকিয়া দেশটি। এই দেশকে ঘিরে রয়েছে জার্মানি, পোল্যাণ্ড, স্লোভাকিয়া এবং অস্ট্রিয়া - ইউরোপের এই চারটি দেশ। চেক রিপাবলিকের রাজধানী প্রাগ বা প্রাহা শহরের ইতিহাস প্রায় এক হাজার বছরের পুরোনো। শহরের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত ভ্লাতভা নদীর ওপর সুদৃশ্য সেতু, অসংখ্য চার্চের সোনা বাঁধানো সুউচ্চ মিনার আর গম্বুজ, সুবিশাল প্রাগ দুর্গ, পুরোনো শহরের পাথরে তৈরি রাস্তা, অজস্র ঐতিহাসিক বাড়িঘর - সব মিলিয়ে প্রাগ ইউরোপের সবচেয়ে সুন্দর শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম, যাকে বলা হয় "এ সিটি অফ হানড্রেড স্পায়ার্স।" রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতে হয় শহরের বাড়িগুলোর দিকে। গথিক, বারোক, রোকোক, রোমানেস্ক নানান ধরণের স্থাপত্যের অজস্র উজ্জ্বল উদাহরণ ছড়িয়ে রয়েছে চতুর্দিকে। ১৯৪৫ সালের পরে শহরের পুনর্গঠনের সময় এইসব প্রাচীন স্থাপত্য এবং আধুনিক বাড়িঘরের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য বজায় রাখার সুপরিকল্পিত চেষ্টার ফলে প্রাগ ইউরোপের সবচেয়ে সুসংরক্ষিত শহরগুলোর একটি। পুরনো শহরের কেন্দ্রস্থলের মধ্যযুগীয় চেহারাটা প্রায় অবিকৃত থাকার জন্য ১৯৯২ সালের ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তালিকায় প্রাগ শহরের কেন্দ্রস্থলটিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। শিল্প, সঙ্গীত, বিজ্ঞান এবং রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু বিখ্যাত ব্যাক্তি যেমন কেপলার, মোজার্ট, কাফকা, আইনস্টাইন আর ভাকলাভ হাভেল, এদের নামও যুক্ত হয়েছে এই শহরের ইতিহাসের সঙ্গে।
হোটেলে পৌঁছে সামান্য বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়া গেল প্রাগের পুরনো শহরের দিকে। হোটেলের সামনেই ট্রামস্টপ,মেট্রো স্টেশনও বেশি দূর নয়। আমাদের আজকের গন্তব্য ছিল ওয়েনসেলাস স্কোয়ার আর তারপরে ওল্ড টাউন স্কোয়ার। প্রাগ শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ওয়েনসেলাস স্কোয়ার অনেকটা আমাদের কলকাতার বিবাদী বাগ বা ধর্মতলা অঞ্চলের মতো শহরের প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র। নামে স্কোয়ার হলেও,এটি প্রায় এক কিমি লম্বা, অতি প্রশস্ত আয়তাকার একটি ব্যুলেভার্দ, যার দক্ষিণপূর্ব প্রান্তে রয়েছে চেক ন্যাশনাল মিউজিয়াম। মিউজিয়ামের সামনে রয়েছে, যার নামে এই জায়গাটির নামকরণ হয়েছে, বোহেমিয়ার ডিউক সেই সেন্ট ওয়েনসেলাসের একটি মূর্তি, এটিকে বলা হয় 'ওয়েনসেলাস মনুমেন্ট।'

ব্যুলেভার্দ-এর দুই পাশে সার দিয়ে রয়েছে একের পর এক বিশাল অট্টালিকা, অফিস, হোটেল, বড় বড় দোকান আর নানাবিধ রেস্তোঁরা। প্রাগের বিভিন্ন মিটিং-মিছিল এবং বিক্ষোভ সমাবেশের জন্যেও এই স্থানটি খুব জনপ্রিয়। ১৯৮৯ সালে চেকোশ্লোভাকিয়ার কম্যুনিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান বা 'ভেলভেট রেভলিউশন'-ও সংগঠিত হয়েছিল এই ওয়েনসেলাস স্কোয়ারেই। মেট্রো স্টেশন থেকে রাস্তায় বেরিয়েই দেখতে পেয়েছিলাম আমাদের বহুপরিচিত কাস্তে-হাতুড়ি চিহ্নিত লাল পতাকা নিয়ে একদল লোক ওয়েনসেলাস মনুমেন্টের নীচে জমায়েত হয়েছে, সম্ভবত কোনও বিক্ষোভ কর্মসূচী নিয়ে। কম্যুনিস্ট শাসনের অবসান হলেও চেক রিপাবলিকে বামপন্থীরা এখনও রাজনৈতিক ভাবে যথেষ্ট সক্রিয়। সন্ধেবেলায় ওয়েনসেলাস স্কোয়ারে প্রচুর মানুষের সমাগম হয়েছে, যাদের মধ্যে আমাদের মতো পর্যটকের সংখ্যা নেহাত কম নয়। মানুষজন আর দোকানপাট দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম উত্তর-পশ্চিম দিকে যেখানে রাস্তাটি গিয়ে শেষ হয়েছে, সেখান থেকেই শুরু হয়েছে প্রাগের 'ওল্ড টাউন' বা পুরনো শহরের এলাকা। প্রচুর জানা-অজানা ব্র্যান্ডের দোকানের মাঝে চোখে পড়ল আমাদের দেশের অতি পরিচিত ব্র্যাণ্ড 'বাটা।' প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে, 'বাটা'-সাহেব ছিলেন এই চেক দেশেরই মানুষ।
প্রাগে তৃতীয় দিনের সকালটি আমরা নির্দিষ্ট করে রেখেছিলাম ইউনেস্কো হেরিটেজ তালিকায় অবস্থিত শুধু এই ওল্ড টাউন অঞ্চলটি পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখব বলে,তাই প্রথমদিন বিকেলে শুধু ওল্ড টাউন স্কোয়ারের বিখ্যাত অট্টালিকা আর চার্চগুলো একটু চোখ বুলিয়ে দেখে নিলাম। ওল্ড টাউন স্কোয়ারের বিশাল চত্বরকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি বিখ্যাত চার্চ - গথিক শৈলীর 'চার্চ অফ আওয়ার লেডি বিফোর টিন', আর পাশে রোকোক স্থাপত্যশৈলীর 'গোল্জ-কিনস্কী প্যালেস', বারোক শৈলীতে নির্মিত 'সেন্ট নিকোলাস চার্চ', স্কোয়ার-এর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ধর্মীয় সংস্কারক য়ান হৌস-এর স্মৃতিতে নির্মিত 'য়ান হৌস মেমোরিয়াল' এবং আরো কয়েকটি প্রাচীন সৌধ, যেগুলির নজরকাড়া স্থাপত্য উল্লেখের দাবি রাখে।

আর রয়েছে,'ওল্ড টাউন হল' এবং তৎসংলগ্ন মধ্যযুগীয় 'অ্যাস্ট্রোনমিকাল ক্লক',যেটা প্রাগ শহরের একটা অতি বিখ্যাত দ্রষ্টব্য। টিকিট কেটে টাউন হলের ওপরে উঠে ওল্ড টাউন স্কোয়ারের সুন্দর বিহঙ্গম-দৃশ্য অবলোকন করা গেল, টাউন হলের গবাক্ষপথে চোখে পড়ল পড়ন্ত বিকেলের আলোয় বিশাল প্রাগ দুর্গের রাজকীয় সৌন্দর্য। ওল্ড টাউন স্কোয়ারে প্রচুর পর্যটকের ভিড়, তাদের কাছ থেকে দু-পয়সা রোজগারের আশায় ঝলমলে ঘোড়ার গাড়ির গাড়োয়ানরা খদ্দের ধরতে ব্যস্ত, চলছে ম্যাজিক শো, মাদারি-কা-খেল, কেউবা রঙ মেখে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে,কেউবা বাদ্যযন্ত্রে তুলছে জনপ্রিয় পাশ্চাত্য গানের সুর। প্রাগের বিখ্যাত মধ্যযুগীয় 'অ্যাস্ট্রোনমিকাল ক্লক'-টি খুলে নেওয়া হয়েছে মেরামতির জন্য, প্রমাণমাপের পর্দায় ঘণ্টায় ঘণ্টায় ভেসে উঠছে তার কার্যকলাপের প্রতিচ্ছবি, সেটা দেখেই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাচ্ছেন সারা পৃথিবী থেকে আগত পর্যটকের দল। রাত অবধি ওল্ড টাউন স্কোয়ারে ঘুরে ফিরে একটা চিনে রেস্তোঁরায় রাতের আহার সেরে ফিরে যাওয়া হল হোটেলে।
প্রাগে দ্বিতীয় দিন একটু সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়া হল হোটেল থেকে। উদ্দেশ্য ছিল সকাল নয়টা নাগাদ পর্যটকদের ভিড় বাড়ার আগে আগেই প্রাগ ক্যাসলে পৌঁছে যাওয়া। সকালবেলা দেখলাম একজন পুরুষ এবং একটি মহিলা হোটেলের সামনের ট্রামস্টপের ছাউনিটি পরিষ্কার করতে লেগে পড়েছেন। যে যত্ন নিয়ে ওঁরা কাজটা করছিলেন,এখানে আমাদের দেশে আমরা নিজেদের বাড়ি অতটা যত্ন নিয়ে পরিষ্কার করিনা। আর রাতে হোটেলে ফেরার সময় দেখেছি, জনগণ জায়গাটা বিন্দুমাত্র অপরিষ্কার করে রাখেনি, একটা কাগজের টুকরো পড়ে নেই কোথাও, নেই একটা পানের পিকের দাগ। ইউরোপের যে ক'টা জায়গা দেখলাম এবার, সেখানকার এই পরিচ্ছন্নতার দিকটা মনকে অত্যন্ত আকর্ষণ করেছে। ট্রামস্টপে টাঙিয়ে রাখা সময়-সারণীতে নির্দিষ্ট সময় মেনেই আমাদের ট্রাম এল। পরিবেশবান্ধব এই গণ-পরিবহণ মাধ্যমটি শুধু প্রাগে নয়, ভিয়েনা এবং ব্রুসেলসেও দেখেছি বেশ জনপ্রিয়। মিনিট পনেরো পরে গিয়ে নামলাম প্রাগের দুর্গের গেটে। সকাল থেকেই পর্যটকদের ভিড় জমছে সেখানে, ট্যুরিস্ট বাস থেকে দলে দলে নামছেন দেশ-বিদেশের পর্যটকের দল, যাদের মধ্যে আবার চিনা এবং জাপানিদের সংখাধিক্য চোখে পড়ার মত। দুর্গের প্রবেশদ্বারে বেশ জোরালো এক দফা খানাতল্লাশির বেষ্টনী পেরিয়ে প্রবেশাধিকার পাওয়া গেল অবশেষে।

প্রাগ ক্যাসল বা চেক ভাষায় 'প্রাসস্কি হ্রাট' (Pražský hrad) গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডের তথ্যানুযায়ী বিশ্বের প্রাচীন দুর্গগুলির মধ্যে বৃহত্তম। প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ বর্গফিট অর্থাৎ প্রায় আঠারো একর জায়গার ওপর দাঁড়িয়ে আছে দুর্গটি। আনুমানিক ৮৮০ খ্রিস্টাব্দে এই দুর্গটি তৈরির কাজ শুরু হয়। বোহেমিয়া তথা ইউরোপের অন্যান্য শাসকদের হাতে এর কলেবর বৃদ্ধি পেতে পেতে এটি বর্তমানে এর এখনকার চেহারায় এসেছে। ১৯১৮ সাল থেকেই এই দুর্গ তদানীন্তন চেকোশ্লোভাকিয়ার এবং এখনকার চেক রিপাবলিকের রাষ্ট্রপতির সরকারি আবাসস্থল। দুর্গদর্শনের জন্য তিন ধরনের টিকিট আছে, আমরা কেটেছিলাম সার্কিট 'এ'-র টিকিট। এই টিকিটে আমরা দেখব সেন্ট ভিটাস ক্যাথিড্রাল,পুরোনো রাজপ্রাসাদ,সেন্ট জর্জেস বাসিলিকা, গোল্ডেন লেন এবং রসেনবার্গ প্রাসাদ।
প্রাগ দুর্গের অভ্যন্তরে অবস্থিত সেন্ট ভিটাস ক্যাথিড্রাল চেক রিপাবলিকের সবচাইতে বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ রোমান ক্যাথলিক গির্জা, যার দায়িত্বে রয়েছেন প্রাগের আর্চবিশপ। গথিক স্থাপত্যশৈলীর এই গির্জাটি তৈরির কাজ শুরু হয় আনুমানিক ৯৩০ খ্রিস্টাব্দে। বেশ কয়েক শতক ধরে এই চার্চের বিভিন্ন অংশের নির্মাণের কাজ চলতে থাকলেও আনুষ্ঠানিক ভাবে এটি খুলে দেওয়া হয় ১৯২৯ সালে। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ছাড়াও, চেক রাজা-রানিদের রাজ্যাভিষেক এই চার্চেই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকত। চেক রাজা, নানা সাধু-সন্ত এবং বিভিন্ন রাজপুরুষের মরদেহও সমাহিত হয়েছে এই চার্চেই। মূল বেদিটি ঘিরে রয়েছে বেশ কয়েকটি চ্যাপেল, যার মধ্যে বোহেমিয়ার রক্ষাকর্তা সন্ত ওয়েনসেলাসের নামাঙ্কিত চ্যাপেলটি সর্বপ্রধান এবং সবথেকে আকর্ষণীয়।

চ্যাপেলগুলোর সুউচ্চ রঙিন কাচের জানালার ওপর আঁকা রয়েছে খ্রীষ্টধর্ম এবং বোহেমিয়ার রাজপরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন দৃশ্য। এমনিতে কোনটা চার্চ, কোনটা চ্যাপেল, কোনটা ক্যাথিড্রাল আর কোনটাই বা কনভেন্ট,এসব ব্যাপারে আমি বিশেষ ভাবে অজ্ঞ, গির্জার অভ্যন্তর চাক্ষুষ দেখার অভিজ্ঞতাও বড়ো একটা নেই। তাই এই ক্যাথিড্রালের ভিতরে ঢুকে সেটার বিশালত্ব, বৈভব আর চোখ-ধাঁধানো অলঙ্করণ দেখে রীতিমত বিস্মিত হয়ে গেলাম। তবে বলতে দ্বিধা নেই, এযাত্রা যে কয়েকটা নামি ও দামি গির্জাদর্শন হয়েছে, সেখানে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ নিয়ে দেখেছি গির্জার ভিতরে রাখা পাইপ-অরগানগুলো। এই গির্জাটা মোটামুটি ভাবে ঘুরে দেখতে সময় লাগল ঘণ্টাখানেক। তারপরে পুরনো রাজ-প্রাসাদ আর দুর্গের ইতিহাসের ওপর একটা ছোট প্রদর্শনী দেখে গেলাম গোল্ডেন লেন দেখতে। বোহেমিয়ার রাজমুকুটের একটি প্রতিকৃতি এবং রাজা-রানিদের ব্যবহৃত কিছু মুল্যবান ঐতিহাসিক সামগ্রী এই প্রদর্শনীতেই রাখা রয়েছে। মূল জিনিসগুলি রাখা হয়েছে চার্চের ভিতরের একটি সুরক্ষিত কক্ষে, যেগুলি সচরাচর জনসমক্ষে আনা হয়না।
প্রাগের দুর্গের ভেতরে যেসব দ্রষ্টব্যগুলো দেখলাম, তারমধ্যে এই 'গোল্ডেন লেন' জায়গাটা আমার বেশ মজাদার লেগেছে। এক চিলতে গলির একধারে ছোট্ট ছোট্ট রঙিন বাড়িগুলো দেখতে দারুণ মজার লাগে, অনেকটা পুতুলখেলার বাড়িঘর বলে মনে হয়। ভিতরের জায়গা খুবই কম, ওই স্বল্পপরিসরে মানুষজন সেইসময় কিভাবে বসবাস করতেন সেকথা ভাবলে অবাক লাগে। কোনও একসময় দুর্গের প্রহরীদের থাকার জায়গা ছিল এই বাড়িগুলো, তারপরে স্বর্ণকারদের বসবাস হওয়ার ফলেই সম্ভবত রাস্তাটির নাম হয় 'গোল্ডেন লেন।' এখন অধিকাংশ বাড়িতেই চলছে স্যুভেনিরের দোকান। কয়েকটা বাড়ির ভিতরটাকে সাজিয়ে রাখা হয়েছে এমনভাবে, যাতে সেই পুরোনো দিনের বাসিন্দারা কিভাবে ওইটুকু জায়গার মধ্যে থাকতেন ও নিজেদের জীবিকানির্বাহ করতেন, সে সম্পর্কে দর্শকেরা একটা ধারণা পেতে পারেন। রয়েছে সেইসময়ের স্বর্ণকারের দোকান, সরাইখানা,দর্জির দোকান ইত্যাদির প্রায় অবিকল প্রতিরূপ। এই রাস্তার বাইশ নম্বর বাড়িতে কিছুদিন বসবাস করেছিলেন বিখ্যাত জার্মান সাহিত্যিক ফ্রাঞ্জ কাফকা - বাড়িটি এখন তাঁর বই আর কাফকা-সংক্রান্ত অন্যান্য স্যুভেনিরের দোকান। দ্বিতীয় দিনের প্রথমার্ধ প্রাগ দুর্গে কাটিয়ে, বিকেল ও সন্ধে কাটানো হল ভ্লাত্ভা নদীর ধার দিয়ে শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে আর ভ্লাত্ভা নদীর ভিতরে কামপা আইল্যাণ্ডে। দেখা হল কম্যুনিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক 'জন লেনন ওয়াল।' আর দিনের শেষে প্রাগের এক ঐতিহ্যশালী কফি হাউস, একশো বছরেরও বেশি পুরোনো 'ক্যাফে ল্যুভর'-এ কফি নিয়ে বসে কাটানো গেল কিছুটা সময়।

তৃতীয় দিনের সকালে মেয়ে আমাদের জন্য একটা ট্যুরের টিকিট কেটে রেখেছিল। একজন ইংরেজিভাষী গাইডের সঙ্গে প্রাগের ওল্ড টাউন আর জ্যুইশ কোয়ার্টার অঞ্চল আমরা পায়ে হেঁটে ঘুরব এবং গাইড আমাদের প্রাগের এই দুটি অঞ্চলের বিভিন্ন দ্রষ্টব্য স্থানগুলির ঐতিহাসিক দিক ও অন্যান্য বিশেষত্বগুলি সম্পর্কে অবহিত করবেন, এটাই 'ওয়াকিং ট্যুর'-এর অর্থ। ইউরোপের অনেক শহরেই এই ধরনের 'ওয়াকিং ট্যুর' পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। সাধারণত, কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে পাঠরত অল্পবয়েসি ছেলেমেয়েরাই এই গাইডের কাজ করে থাকে। কিছু ট্যুর আছে যেখানে একটা নির্দিষ্ট মূল্য ধরা থাকে, আবার কিছু ট্যুর আছে যেগুলো 'টিপস' নির্ভর, অর্থাৎ ট্যুরের শেষে পর্যটক খুশি হয়ে যা দিলেন, সেটাই ট্যুরের দক্ষিণা। আমাদের ট্যুরটি ছিল দ্বিতীয় ধরনের। শুনলাম সকালে একটা নির্দিষ্ট সময়ে 'পাউডার টাওয়ার' এর নিচে সবুজ ছাতা মাথায় দিয়ে আমাদের গাইড দাঁড়িয়ে থাকবেন, ওই ছাতাটাই তাঁর পরিচয় চিহ্ন। যদিও বিগত দুই দিনে প্রাগের ওল্ড টাউনের সঙ্গে আমাদের সামান্য পরিচয় ঘটেছিল কিন্তু জায়গাটাকে, বিশেষ করে জ্যুইশ কোয়ার্টার এলাকাটাকে আরও খুঁটিয়ে জানার ইচ্ছে থেকেই আমাদের এই ট্যুরে যোগ দেওয়া।
যথাসময়ে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেখি গাইড আরও জনাকয়েক পর্যটক পরিবেষ্টিত হয়ে অপেক্ষা করছেন। তিনি একজন পোলিশ ইহুদি তরুণ, প্রাগের বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস নিয়ে পড়াশুনা করছেন, নাম মিখায়েল। প্রাথমিক পরিচয়ের পালা শেষ করে তিনি আমাদের সামনে প্রাগের ইতিহাস নিয়ে একটি নাতিদীর্ঘ বক্তব্য রাখলেন। সেই মধ্যযুগ থেকে শুরু করে প্রথমে বিভিন্ন রাজতন্ত্র, তারপর প্রজাতন্ত্র, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের প্রাগ দখল, তারপর দীর্ঘ কম্যুনিস্ট শাসন এবং সেই শাসনের অবসান, দেশ বিভাজন এই সব মিলিয়ে ইতিহাসটা একটু লম্বাই হয়ে গিয়েছিল। গাইডের বক্তব্য শেষে শুরু হল ওল্ড টাউনের মধ্য দিয়ে আমাদের পথচলা।

প্রথম দ্রষ্টব্য 'পাউডার টাওয়ার।' পুরোনো প্রাগ শহরের যে তেরোটি প্রধান প্রবেশদ্বার ছিল, তার মধ্যে এটি একটি। ১৪৭৫ খ্রিস্টাব্দে গথিক শৈলীর টাওয়ারটি তৈরির কাজ শেষ হয়। কোনও এক সময় বারুদ মজুত করার জন্য এটি ব্যবহার করা হত, তাই এর নাম 'পাউডার টাওয়ার।' চেক রাজাদের রাজ্যভিষেকের সময় শোভাযাত্রা এই পথেই পুরোনো শহরে ঢুকত। এর পরে 'চার্চ অফ সেন্ট জেমস', 'কিউবিস্ট হাউস', 'স্ট্যাচু অফ ব্ল্যাক ম্যাডোনা', যেখানে মোজার্টের দুটি অপেরার প্রিমিয়ার হয়েছিল সেই 'এস্টেট থিয়েটার' ইত্যাদি দেখার পরে এসে পড়লাম ওল্ড টাউন স্কোয়ার অঞ্চলে। মিখাইলের কাছে শুনে নিলাম এই অঞ্চলের কিছু কিছু বাড়ির পিছনের ইতিহাস। তবে আমার খুব ভাল লাগল এই ওল্ড টাউন স্কোয়ারের এক প্রান্তে অবস্থিত সতেরো নম্বর বাড়িটির সামনে লাগানো ফলকটি দেখে। এলাকার অন্যান্য বাড়ির তুলনায় নিতান্তই সাদামাটা দেখতে এই বাড়িটি এক সময় ছিল মিসেস বেরটা ফ্যাণ্টা-র সালোঁ, যেখানে কাফকা, ম্যাক্স ব্রড এবং প্রাগের সেই সময়কার আরও অন্যান্য জার্মানভাষী বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে নিয়মিত আড্ডা দিতে আসতেন আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের সংজ্ঞা যিনি নতুন করে লিখেছিলেন, সেই আলবার্ট আইনস্টাইন আর আড্ডার পাশাপাশি তাঁর বেহালায় বাজিয়ে শোনাতেন মোজার্টের সুর। এর পরে ওল্ড টাউন স্কোয়ারকে পেছনে রেখে আমরা চলে এলাম প্রাগের জ্যুইশ কোয়ার্টারে। অঞ্চলটির সূত্রপাত ত্রয়োদশ শতকে, যখন এই জ্যুইশ কোয়ার্টার বা 'জোসেফব' এলাকাটি ছাড়া শহরের অন্য কোথাও ইহুদিদের বসবাস করার অনুমতি ছিলনা। ব্যাপক পুনর্নির্মাণের ফলে সামান্য কয়েকটি সিনাগগ এবং স্মৃতিসৌধ ছাড়া এলাকাটি এখন আর আসল চেহারায় নেই। নাৎসি অধিগ্রহণের সময় এই কয়েকটি জিনিস ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে যায়, কারণ হিটলার চেয়েছিলেন যে "ইতিহাস থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে এমন একটি জাতির জাদুঘর" হিসেবে এই স্মারকগুলি অক্ষত থাকুক।

আমাদের ট্যুর শেষ হল চার্লস ব্রিজের সামনে এসে। পাথরের তৈরি সেতুটি সম্ভবত প্রাগের সবচেয়ে বিখ্যাত ল্যান্ডমার্ক। ভ্লাত্ভাে নদীর ওপর এই সেতুটি একসময় ছিল প্রাগ দুর্গ এবং শহরের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র রাস্তা। দিনের অধিকাংশ সময় ব্রিজটি পর্যটক, হকার, বাজনদার, ছবি আঁকিয়ে ইত্যাদি নানাবিধ মানুষজনের ভিড়ে এতটাই ভারাক্রান্ত হয়ে থাকে যে পায়ে হেঁটে একে পারাপার করা এক দুঃসাধ্য কাজ। ব্রিজের দুইপাশে সারিবদ্ধ ভাবে রাখা আছে প্রায় তিরিশটি মূর্তি,যার কয়েকটির মনষ্কামনা পূর্ণ করার ক্ষমতা আছে বলে শোনা যায়, কাজেই সেগুলোর সামনে প্রচুর জনসমাবেশ। তবে মূল মূর্তিগুলি এখন স্থান পেয়েছে জাতীয় সংগ্রহশালায়,পর্যটকেরা ব্রিজের ওপর যে মূর্তিগুলি সজ্জিত দেখেন,সেগুলো সবই প্রতিকৃতি। চার্লস ব্রিজের ওপর দেখা থেকে সূর্যাস্তের দৃশ্য নাকি বড়ই সুন্দর, কিন্তু সেটা দেখতে হলে রাত ন'টা-দশটা অবধি অপেক্ষা করতে হবে, সুতরাং আমরা চলে এলাম আবার জ্যুইশ কোয়ার্টারে স্প্যানিশ সিনাগগ দেখতে। স্প্যানিশ সিনাগগ নামকরণের পেছনে রয়েছে সৌধটির স্থাপত্যে মূলত মূরিশ বা স্প্যানিশ স্থাপত্যশৈলীর প্রভাব। উজ্জ্বল সোনালি, সবুজ, নীল এবং লাল রঙের ব্যবহারে সজ্জিত হয়েছে সিনাগগটির ভিতরের দর্শনীয় অলংকরণ, যে কারণে এটিকে ইউরোপের সবচাইতে সুন্দর সিনাগগ বলা হয়ে থাকে। প্রাগ শহরে ওটিই ছিল আমাদের শেষ দ্রষ্টব্য।
দুর্গ আর প্রাসাদের গায়ে লেখা এক হাজার বছরের ইতিহাস, চার্চের সুসজ্জিত অন্দরমহল, পাথরে বাঁধাই করা রাস্তার ওপর শকটের অশ্বক্ষুরধ্বনি, মধ্যযুগীয় থেকে অত্যাধুনিক - শহর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য অট্টালিকায় অনুপম স্থাপত্যশৈলীর অনবদ্য ঐকতান,জনবহুল রাস্তায় বাদ্যযন্ত্রে সুরের মূর্ছনা তুলতে থাকা শিল্পী,শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা নদী,পথের ধারের সরাইখানাগুলোতে বিখ্যাত চেক বিয়ারের আস্বাদ-গ্রহণরত পর্যটকদের উপচে পড়া উচ্ছ্বল উপস্থিতি -সব মিলিয়ে প্রাগ ইউরোপের এক বর্ণময় এবং প্রাণোচ্ছল শহর। লণ্ডন, প্যারিস বা রোমের মত নামডাক না থাকলেও এই শহরের একটা অনন্য চরিত্র রয়েছে, যা ভ্রমণকারীদের মনকে ছুঁয়ে যাবেই যাবে। প্রাগ ঘুরে দেখার এক সুন্দর অভিজ্ঞতা মনে সঞ্চিত রেখে পা বাড়ালাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্যের দিকে।

~ প্রাগের আরও ছবি ~

আই.আই.টি. খড়গপুরের প্রাক্তনী কণাদ চৌধুরীর পড়াশোনা এরোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে। পরবর্তী সময়ে কর্মজীবন কেটেছে ভারতের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান সংস্থায়। অবসরজীবন কাটছে বেহালা বাজিয়ে,নানান ধরণের গানবাজনা শুনে,বই পড়ে,ফেসবুকে টুকটাক লিখে এবং সুযোগ পেলে একটুআধটু বেড়িয়ে। ভ্রমণ সংক্রান্ত লেখালেখির জগতে প্রথম পদক্ষেপ 'আমাদের ছুটি'র আঙিনাতেই।

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher