পুরুলিয়ার পথে পথে

মলয় সরকার


~ পুরুলিয়ার আরও ছবি ~

হঠাৎই, ওই উঠলো বাই তো কটক যাই, না কটক নয়, ঝোঁক হল পুরুলিয়ার লাল মাটির বুকের ধুলো গায়ে মাখার। চড়ে বসলাম হাওড়া-রাঁচি ইন্টারসিটি এক্সপ্রেসে। তার আগে ঝটপট করে নেটের সাহায্যে ঘর বুক করে ফেলেছিলাম পুরুলিয়াতে ট্যুরিজম সংস্থার হোটেলে।

১৯/১২/১৮
ট্রেন বেশ ফাঁকা। ঝাড়গ্রাম ছাড়াতেই শালশিশুদের সঙ্গে দেখা। তারা ছোট ছোট কচি কচি সবুজ শরীর আর মাথা দুলিয়ে তাদের দেশে অভ্যর্থনা করতে লাগল। এই ঝাড়গ্রাম ছাড়ালেই বরাবরই আমার একটা অদ্ভুত ভাললাগা কাজ করতে থাকে। সেটা এই রাস্তার গাছপালা, মাঠ, পুকুর, পথচলতি মানুষজন বা ছোট তিরতিরে আধাশুকনো অখ্যাত নদী, যাই হোক না কেন। একঘণ্টা দেরিতে এসে পৌঁছালাম বরাভূম স্টেশনে। তখন সন্ধ্যা নেমে গেছে। বাইরে বেশ একটা ঘোরলাগা অন্ধকার। তারমধ্যে বৈদ্যুতিক আলোগুলোকে যেন মিটমিটে মাটির প্রদীপের মত লাগছিল। গাড়ি অপেক্ষা করছিল। পৌঁছালাম বেশ কিছুটা দূরে, অযোধ্যা গেস্ট হাউসে। গাড়ি যখন স্টেশন থেকে বেরিয়ে, বেশ জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল, পাহাড় দেখা যাচ্ছিল অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে, একটা গা ছমছমে পরিবেশের মত,বেশ উপভোগ করছিলাম। ড্রাইভার দেখাচ্ছিলেন, ওই দেখুন, দূরে যে আলো জ্বলছে সার দিয়ে একটু উঁচুতে ওটা আপার ড্যাম। আর ওর নীচে দেখুন লোয়ার ড্যাম। কাল দিনেরবেলা তো যাবেন, দেখবেন কী সুন্দর!

হোটেল – অযোধ্যা গেস্টহাউস,একেবারে নতুন,অযোধ্যা পাহাড়ের কাছেই বাঘমুণ্ডি গ্রামে, একেবারে গ্রামের পরিবেশের মধ্যেই। জায়গাটির স্থানীয় নাম ছাতাটাঁড়। এখানকার ছাতাপরবের জন্যই এই নাম। ভাদ্রমাসের শেষদিকে,বিশ্বকর্মা পূজার দিন এই পরব হয়। স্থানীয় রাজা ছাতা তুলতেন বা এখনও সেই বংশের কেউ না কেউ তোলেন। তারপর একটা গাছের ডাল বাড়ির সামনে ক্ষেতে বা মাটিতে পোঁতা হয় যাতে পেঁচা বা অন্য পাখি তাতে বসতে পারে। এটা গ্রামীণস্থানীয় কৃষিভিত্তিক পরব বুঝতে পারি।

হোটেল কর্ত্তৃপক্ষের এখনও পাকাপাকি পুরো পেশাদারিত্ব আসেনি। হোটেলটাতে সবকিছু যে একেবারে অন্য ব্যস্ত হোটেলের মত আছে তা নয়। তবে ছেলেগুলি স্থানীয় এবং বেশ ভদ্র বিনয়ী। রাতের খাওয়ার রুটি-মাংস ও কপির তরকারি ঘরেই দিয়ে গেল। রান্নাও বেশ ভাল,ঘরের রান্নার মতই। ছেলে বা মেয়েগুলি অপেশাদারিত্বের সরলতা নিয়ে আন্তরিকভাবে ঘরোয়া পদ্ধতিতে আপ্যায়ন করছে। এটার প্রতিও একটা ভাললাগা কাজ করছিল। পেশাদার হোটেলে তো অনেক থেকেছি। তাই এই অপেশাদারি ভাব একটু অন্যরকমের স্বাদ এনে দিল।

২০/১২/১৮
সকালে বেড টি দিয়ে গেল। খেয়ে স্নান করে বারান্দায় মিঠে রোদে পিঠ দিয়ে দাঁড়ালাম। গ্রামের জীবন ধীরে ধীরে জেগে উঠছে। চারপাশে শাল সেগুন পলাশ কালকাসুন্দে খেজুর গাছের ভিড়। একটা নাম না জানা ফুলের মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে হালকা একটা পাখির ডাকের সঙ্গে।

সসকালের ব্রেকফাস্ট সেরে বাইরে এসে দেখি একেবারে নতুন একটা সুইফট ডিজায়ার দাঁড়িয়ে আছে দরজায়,গাড়ির এখনও নম্বর পড়েনি। ড্রাইভার,আর একটি কমবয়সী ছেলে -'ছোটে'র সঙ্গে বেরোলাম। ভাল ছেলেটি আর বেশ হাসিমুখও। প্রথমে গেলাম লোহারিয়া শিব মন্দির। মন্দির বেশি বড় নয় তবে চৌহদ্দিটা বড়। তার মধ্যে আছে রামের মন্দির,রাধাকৃষ্ণের মন্দির ইত্যাদি। এলাকায় অনেক ছোট ছোট পূজা বা খেলনা সামগ্রীর দোকান। তবে জায়গাটা বেশ ঝাড়ু দেওয়া এবং পরিচ্ছন্ন। জিজ্ঞাসা করে জানলাম এক নতুন তথ্য। এখানে মন্দিরের বেশ কিছু ঘর আছে যেখানে নানা ধরনের ভক্তেরা শিবের কাছে মানত করে পড়ে থাকেন বহুদিন। এঁরা দেবার্চনায় সাহায্য করা বা জায়গাটা পরিচ্ছন্ন রাখার কাজ করেন। এঁদের খাবার জোগাড় ভক্তদের কাছ থেকেই হয়ে যায়। অনেকে তিন চার বা পাঁচ বছরও থাকেন মানত পূর্ণ করতে।

পাশেই কেষ্টবাজার ড্যাম, খুব বড় না হলেও মোটামুটি ভালই এবং জল সবুজ, পরিষ্কার। এখান থেকেই উঠতে লাগলাম ওপরে পাহাড়ের গা বেয়ে। চারিদিক সবুজে মোড়া। ছোটে জানাল,আপার ড্যাম থেকে জল ছেড়ে দিলে আসে লোয়ার ড্যামে। সেখান থেকে বাড়তি জল আসে কেষ্টবাজার ড্যামে। সেখান থেকে যায় খালে। এখানে তিনটে টার্বাইন আছে এবং নশো মেগাওয়াট বিদ্যুৎ হয়। উঠতে উঠতে দেখলাম গাড়ি এসে দাঁড়াল লোয়ার ড্যামের পাশে। ওপর থেকে দেখলাম তার ফিরোজারঙা সৌন্দর্য। তখন বেলা এগারোটা বেজে গেলেও হাল্কা কুয়াশার আস্তরণে ছেয়ে ছিল দূরের জল পাহাড় গাছপালা। মনে হচ্ছিল, লেকের সৌন্দর্যরানি তাঁর সম্পূর্ণ সৌন্দর্য একবারে দেখাতে একটু গররাজি। তাই হাল্কা কুয়াশার ওড়নায় মুখ ঢেকে রেখেছেন। শিল্পীরা অবশ্য তাই-ই বলেন - মুক্ত সৌন্দর্যের চেয়ে রহস্যাবৃত সৌন্দর্যই বেশি আকর্ষণীয়।

এখান থেকে গেলাম আপার ড্যামে। সে এক বিশাল জলাধার। সবুজ জলের ওপর পাক খেয়ে যাচ্ছে একঝাঁক পরিযায়ী পাখি। চারধারে সবুজের সমারোহ। তার সঙ্গে মিশেছে আকাশের মেঘধোওয়া নীলের ধারা। সব মিলিয়ে সে এক অনির্বচনীয় শোভা।

দু-একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ায় ধারটা কাঁটাতারের বেড়ার বন্ধনীতে। ব্যারেজের ঢোকার মুখেই দেখলাম একজন প্রহরী। ব্যারেজে মাছেরও চাষ হয়। প্রচুর মাছ ধরাও হয়।

পৌঁছলাম ময়ূরপাহাড়ে। সেটিই নাকি অযোধ্যা পাহাড়ের সর্বোচ্চ চূড়া। ছোট টিলামত। ওপরে উঠে চারপাশের দৃশ্য খুব সুন্দর। হাসতে হাসতে বললাম,ময়ূর পাহাড়,নামটি বেশ সুন্দর; কিন্তু ময়ূর তো ধারেকাছে দেখছি না। বলতে বলতেই গাড়ি এসে দাঁড়াল একটি চাষির কুঁড়ে লাগোয়া জমির পাশে। দেখি সেখানে পায়ে দড়ি বাঁধা মুরগির মত দুটি ময়ূর বাঁধা। ছোটে বলল,এখানে ময়ূর পাওয়াও যায়। লোকে ময়ূরের ডিম জোগাড় করে মুরগি দিয়ে সেই ডিম ফোটায়। তারপর বিক্রি করে। পরে অবশ্য একটা বন ময়ূরও দেখেছি। আর রাস্তার ধারে যে সমস্ত কুঁড়েঘরগুলো দেখছিলাম,তাদের গায়ে যে কী সুন্দর রঙ বেরং-এর চিত্রবিচিত্র শিল্পকর্ম করা আছে কি বলব। মন একেবারে আচ্ছন্ন হয়ে যায়।

এবারে যাওয়া মার্বেল লেকে। কেউ বলে ব্লু লেক। এটি আর কিছুই নয়,পাহাড়ের পাথর কেটে গভীর খাদ হয়েছে এবং তাতে পরিষ্কার জল জমে রয়েছে। চারধারে গ্রানাইটজাতীয় পাথর ছড়িয়ে রয়েছে। আর শক্ত পাথর থাকার জন্য খাদের মধ্যের জল,কাছাকাছি মাটির সঙ্গে না মিশতে পারায় একেবারে স্বচ্ছ ও নীল।

এখানে এসে জানতে পারলাম একটি অভাগী মেয়ের কাহিনি। লেকের কাকচক্ষু জলের দিকে তাকিয়ে আছি। দেখি সতের-আঠারো বছর বয়সের একটি মেয়ে,অসংলগ্ন পায়ে পায়ে, এগিয়ে গিয়ে আমাদের পেরিয়ে জলের ধারে উঁচু পাথরের ওপর বসল। চোখে কেমন একটা বিষণ্ণ উদাস দৃষ্টি। দেখে, ঠিক বিদেশি যে "মারমেড"এর মূর্তি দেখেছি তার কথা মনে হল। আদিবাসী ঘরের অশিক্ষিতা কন্যা,মলিন বেশবাসে,অযত্নলালিত একঢাল কেশরাশি ছড়িয়ে অনাদৃতা রূপ-যৌবন নিয়ে একরাশ বিষণ্ণতা মেখে মলিন হয়ে বসে আছে। খানিকক্ষণ আমাদের দিকে তাকিয়ে সে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে রইল। তারপর আমি ছবি নিচ্ছি দেখে আমায় কাছে ডেকে বলল,আমার একটা ছবি নে। নিলাম। তখন ও নানা অসংলগ্ন কথা বলতে শুরু করল।ওর হাবেভাবে একটু অসঙ্গতি লক্ষ্য করে আর সাড়া দিলাম না। ফেরার পথ ধরলাম। পরে আশপাশের লোকের থেকে শুনলাম ওর বিয়ে হয়েছিল। শ্বশুরবাড়ির লোক ওকে গ্রহণ করেনি, অন্যজাতের মেয়ে বলে তাড়িয়ে দিয়েছিল। তাই মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে। মনে হল,এই আমাদের দেশের মেয়েদের প্রকৃত ছবি,সে শিক্ষিতা না অশিক্ষিতা সেটা বড় কথা নয়। শিক্ষিত উচ্চবিত্ত/মধ্যবিত্ত সমাজের সঙ্গে অশিক্ষিত নিম্নবিত্ত আদিবাসী সমাজের আজও এই জায়গাটায় বড়ই মিল।

হোটেলে ফিরে এলাম, তখন বেলা দেড়টা। হাল্কা মুসুরির ডাল, বেগুনভাজা, চচ্চড়ি, মাছ, পাঁপড়ভাজা, চাটনি দিয়ে মধ্যাহ্নভোজন সেরে বিকালে গেলাম খয়রাবেরা ইরিগেশন ড্যাম দেখতে। বেশ সুন্দর নিরিবিলি জায়গা। চারধারে উঁচু পাহাড়ঘেরা সবুজ জঙ্গলে মোড়া। সবুজ পাহাড়ের ছায়া বুকে নিয়ে নিস্তরঙ্গ জল নির্বিকার শুয়ে আছে। ওদিকে শেষ বেলার সূর্য রাঙা আলোয় আকাশ রাঙিয়ে বাড়তি রঙটুকু ঢেলে দিয়েছে লেকের জলে। পাশে গড়ে উঠেছে একটি রিসর্ট ঠিক পাহাড়ের নীচে লেকের ধারটিতে। যেন ঠিক একটি মূর্তিমান অসুন্দর। এই সৌন্দর্যের পাশে সার্থক বেমানান হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

ড্যামের ধারে শুধু পলাশ, বনশিউলি আর শালের সবুজ জঙ্গল। রাস্তায় যেতে যেতে দেখি প্রচুর কুলের গাছ। ড্রাইভার আর ছোটে নতুন জানাল,এখানে প্রচুর লাক্ষাচাষ হয় - কুল,পলাশ আর কুসুম গাছে। চাষিরা লাক্ষার রঙ দেখে বুঝতে পারে কখন সেগুলো তোলার সময় হয়েছে। যেখানে যেখানে,যেসব ডালে লাক্ষা হয় সেগুলো কেটে নেয়। ডাল থেকে চেঁছে বা ডালগুলো ছোট করে কেটে ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে। বরাভূমে এর প্রচুর গুদাম আছে। ওখানে ওরা আগুনে গরম করে বা নানা প্রক্রিয়ায় গাছের ডাল থেকে আলাদা করে। তারপর সেগুলো বিভিন্ন জায়গায় যায়। রাজস্থান এর বড় খরিদ্দার। ওখানে যে গালার চুড়ি হয় তার গালা নাকি এই পুরুলিয়া জেলা থেকেই যায়। এটাও আমার কাছে নতুন তথ্য।

ফেরার সময় রাস্তায় দেখি গোটা রাস্তা জুড়ে গরু আর ছাগলের ঘরে ফেরার ভিড়। চলতে থাকলাম গরুর দলের পিছনে পিছনে। অস্তগামী সূর্যের মুখের দিকে তাকিয়ে গরুর দলের পিছনে গোধূলির প্রেক্ষাপটে যাওয়া - এ এক অন্য অভিজ্ঞতা।

অযোধ্যাপাহাড় থেকে আসতে আসতে ছোটে শোনাচ্ছিল কয়েক বছর আগের কথা যখন মাওবাদীদের ভয়ে এখানে কেউ আসত না। এই অযোধ্যা পাহাড়ে ওরাও আসতে ভয় পেত। তখন এই ড্যাম ছিল না,এত রাস্তা, আলো কিছুই ছিলনা। শোনাল শিক্ষিত কম্যাণ্ডার বিপ্লব ব্যানার্জীর কথা,যিনি ছিলেন এই পুরো এলাকার দায়িত্বে। পুলিশ তাঁকে যখন এনকাউন্টারে হত্যা করে,তাঁর মা-বাবাও তাঁকে সন্তান হিসাবে অস্বীকার করেন। তবে এখন এলাকা পুরো শান্ত,মানুষের এখন অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে সরকারি সাহায্য পেয়ে।

এক জায়গায় দেখলাম বেশ কিছু মহুয়ার গাছ জঙ্গলের মধ্যে। ছোটে বলল,এখানে ভালুকের খুব উৎপাত হয়। ভালুক মহুয়া খেতে ভীষণ ভালবাসে আর মহুয়া খেয়ে মাতাল হয়ে যায়। স্থানীয় আদিবাসী বাসিন্দারাও মহুয়ার তৈরি মদ খুব খায়। বিশেষ করে মেয়েরা খুব খায়। চাকরি জীবনে ঝাড়্গ্রামে দেখেছি মহুয়া যখন হয় তখন তার গন্ধেই বাতাস ম' ম' করে,গাছের তলা দিয়ে গেলেও যেন নেশা ধরে যায়। এর শুকনো ফুল খেতেও বেশ ভাল লাগে কিসমিসের মত।

রাস্তায় আসতে আসতে রাস্তায় লেখা দেখলাম চড়িদা গ্রাম। এখানে সবই হয় '-দা' নয় '-দি' যেমন ভুজুদি,সাঁওতালদি ইত্যাদি। সবই দাদা-দিদিদের ব্যাপার। চড়িদা কিন্তু আর পাঁচটা জায়গার মত নয়। এর অন্য বিশেষত্ব আছে। পুরুলিয়ার মুখোস বলতে যা বোঝায়, ছৌনাচের মুখোস,সবই এখানকার শিল্পীদের তৈরি। রাস্তার ধারে পরপর মুখোসের দোকান,সব দোকানে শিল্পীরা,শিশু প্রবীণ উভয়ই, অনবরত কাজ করে চলেছেন। আমরা অভিভূত এই শিল্পকেন্দ্রে এসে,শিল্পীদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে। একজন বললেন,তিনি ক্লিভল্যান্ডে বিদেশি খরচে একমাস কাটিয়ে এসেছেন। কেউ বললেন তিনি সরকারি পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পী। অনেকে আবার ছৌ নাচেন বা তাঁদের নিজেদের দলও আছে। অর্থাৎ এখানে সবাই শিল্পী। প্রায় একশ পরিবার কয়েক প্রজন্ম ধরে এখানে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত। দেখলে মনে হবে এটাই তো একটা দর্শনীয় স্থান হিসেবে বিখ্যাত হতে পারত। কিন্তু আমাদের দেশ বলেই হয়তো তেমন কিছুই হয়নি। শিল্পীরা বেশ কষ্টেই আছেন। সরকারি দাক্ষিণ্য প্রায় কিছুই পাননি। সরকারি উদ্যোগে যে মেলা হয় এখানে ওখানে, সেখানে যান ওঁরা। কিন্তু তাঁদের ব্যবহারে ও ব্যবস্থাপনায় এঁরা বিরক্ত। এক গ্রামীণ শিল্পের স্বর্গে পৌঁছে অদ্ভুত ভাললাগায় পেয়ে বসেছিল। কিনলাম বেশ কিছু মুখোশ। তবে দরাদরি করতে ইচ্ছা হল না। হিসাব করছিলাম,কত সময় আর কত কাঁচা মাল লেগেছে,সে দাম কি আমি দিচ্ছি? মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেছিল নিজের দেশের শিল্পের এই অবস্থায়। অথচ কত কাজেই তো সরকার কত কোটি কোটি টাকা হেলায় খরচ করছে।

২১/১২/১৮
আজ ভোর ছটাতেই এক বিভ্রাট। সকালে ঊঠে স্নান করতে যাব এমন সময় ঝুপ করে গেল অন্ধকার হয়ে। জিজ্ঞাসা করে জানলাম হোটেলের বিদ্যুৎ যোগাযোগের প্রধান তারটিই পুড়ে গেছে। সারাতে বেশ সময় লাগবে। অগত্যা কী আর করা যায় চুপচাপ ধৈর্য ধরে অপেক্ষায় থেকে বেরোতে প্রায় বেলা এগারোটা বেজে গেল।

কথ বলছিলাম হোটেলের বয় অজয়ের সঙ্গে। ও স্থানীয় ছেলে। এখানে অল্প কিছুদিন কাজ করছে। ওকে জিজ্ঞাসা করছিলাম এখানে এত খেজুর গাছ দেখছি,খেজুর রস আর গুড় পাওয়া যায় না? ও বলল,হ্যাঁ পাওয়া যাবে। খাবেন? অজয় ছেলেটির ব্যবহার বেশ ভাল। ওর কথায় পুরুলিয়ার আঞ্চলিক টানটি শুনতেও বেশ লাগছিল। বললাম, যা লাগে দেব, কাল ভোরে একটু আসল খাঁটি রস খাওয়াতে হবে। আর ভাল হলে বেশ কিছু গুড়ও নেব।

আজ বেরিয়ে প্রথমে গেলাম কাছেই টুর্গা ড্যামে। এটি তুলনামূলকভাবে ছোট - কেবলমাত্র চাষের জন্য ব্যবহার হয়। সবুজ পাহাড়ের কোলে বেশ সুন্দর লাগছিল, আরও ভাল লাগছিল এর ওপরে উড়ন্ত পরিযায়ী পাখির দলের চক্রাকার আলপনা আঁকা এবং নৈঃশব্দকে খানখান করে তাদের কলকাকলি। এখান থেকে অল্প উঁচুতে উঠেই পেলাম টুর্গা ফলস। সেটা আবার বেশ নীচে এবং যদিও সিঁড়ি আছে, তবু বেশ খাড়াই বলে লোকে ওপর থেকেই দেখে। নীচে লোকে কমই যায়। এটিও ছোট ঝরনা। তবে নৈঃশব্দের মাঝে বাতাসের শিরশিরানির সাথে জঙ্গলের লতাপাতার ভিতর থেকে অনবরত ঝরঝর শব্দের একটা কনসার্ট চলেছে। তার মাঝে দাঁড়িয়ে একটা মাতাল হওয়া পরিবেশ। এইখানে বহু জায়গায় রাস্তা তৈরির কাজ চলছে। তার ফলে গাড়ি চলাচলের বেশ অসুবিধা। পাহাড়ি রাস্তায় ঘুরে ঘুরে গেলাম বামনি ফলসের পথে। বামনি ফলস,কালকে যে লোয়ার ড্যাম দেখেছি,তাতে সমস্ত জল অবিরল ঢেলে চলেছে। এখানকার পাথরগুলো দেখলে মনে হয় পাললিক শিলা বা সেডিমেন্টেশন রক। তবে যদিও আমি ভূতত্ত্ববিদ নই, তবু মনে হল গ্রানাইট। হয়ত বহু বছর আগে সমুদ্রের তলা থেকে ঠেলে উঠেছে। বামনি ফলস যেতে গাড়ির রাস্তা থেকে বেশ নীচে নামতে হয়। সিঁড়ি যদিও আছে, কিন্তু সেগুলো পাহাড়েরই পাথর অবিন্যস্ত ভাবে পেতে তৈরি। অনেকটা রাঁচির কাছে দশম ফলস-এর মত। নামতে অবশ্য খুব কষ্ট হয় না, তবু পর্যটন বিভাগ রাস্তাটার ভাল ব্যবস্থা করতে পারত। বেশ কিছুটা নীচে নেমে দেখা গেল পাশাপাশি দু'তিনটি ঝরনা বেশ জোরে এবং অনেকটা জল নিয়ে বয়ে চলেছে। চারধারে সবুজ গাছপালায় ঘেরা পাহাড়ের বড় বড় পাথরের ওপর দেখি সবুজ হলুদ মসের রেখা। তার সঙ্গে আশেপাশে ভিজে পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে গুঁড়িগুঁড়ি ভাসন্ত জলকণার সাথে পাখি ও পাতার রহস্যময় শিরশিরানি শব্দ এক রহস্যলোকে পৌঁছে দেয়। এই জলধারা আবার আর একটু নীচে্র আরেকটি জলধারাকে নিয়ে মোটা জলধারা হয়ে ঝরছে। পাহাড়ের পথে অনেক জায়গাতেই দেখলাম ছোট ছোট জলধারা ধীরে ধীরে পাহাড় থেকে রাস্তা পেরিয়ে গড়িয়ে চলেছে।

এখান থেকে সাঁওতাল পল্লীর পাশ দিয়ে অনেক রাস্তা ঘুরে গেলাম তুলনামূলকভাবে কম খ্যাত সীতাকুণ্ড দেখতে। একটি মাঠের মাঝে বয়ে চলা একটি পাহাড়ি জলধারার পাশে একটি সিমেন্টের বাঁধানো ছোট কুণ্ড। তার মধ্যে দেখা যাচ্ছে ভুস ভুস করে জল উঠছে। এই জল লোকে খায়ও। গ্রামের কিছু মেয়ে-বউ পাশে স্নান করছে। তবে আমার মনে হল এটি আর্টেসীয় কূপ। এই জিনিস আমি মেদিনীপুর জেলার ঝাড়গ্রাম বা বাঁকুড়ার কয়েক জায়গায় দেখেছি। ঝাড়্গ্রামের কিছু চাষের মাঠে চাষের জল তোলার পাইপ পাততে গিয়ে দেখা গেছে পাইপ একটু বসাতেই বেগে জল উঠতে থাকে এবং তা অনবরত বেরোতে থাকে। এই অঞ্চলে পাথরের স্তর মাটির নীচে খুব উঁচুনীচু এবং অসমান। তাই এখানে অনেক আর্টেসীয় কূপ আছে।

দুপুরে একটি হোটেলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পাতায় যত্নসহকারে দেওয়া সাদা শিউলির মত ভাত,ডাল, আলুপোস্ত,আলুভাজা ও পাঁপড়ভাজা খেয়ে মনটা ভরে গেল। খিদেও পেয়েছিল খুব। তাই হোটেলের দারিদ্র্যের রঙের চেয়ে মালিকের আন্তরিকতার রং বেশি মন কেড়ে নিল। আবহাওয়া এত সুন্দর যে নীল আকাশের নীচে পাহাড় জঙ্গলের এই রাজ্যে ভীষণ ভাল লাগছে। খেয়েদেয়ে উঠতে গাড়ি ছুটল মুরুগুমা ড্যামের দিকে। রাস্তাটা খুব সুন্দর। পথের পাশে পাশে শিশু বৃক্ষের পত্তন করা হয়েছে এখন। আশা করা যায় সেগুলি বড় হলে আরও সুন্দর দেখাবে। নানান সাঁওতাল পল্লী, কুর্মী পল্লীর মাঝ দিয়ে, মুরগি, ছাগল, কুকুরকে পাশ কাটিয়ে,রাস্তা জুড়ে শুকোতে দেওয়া গম, ডালকে এড়িয়ে গাড়ি চলল মুরুগুমা ড্যামের দিকে। একে সাহারজোড় ড্যামও বলে। বাঁধটি বেশ বড় তবে এখন নাকি এটিকে আরও বড় করার জন্য আর পাড় বাঁধানোর জন্য জল কমানো হচ্ছে। তাই বাঁধে জল ভীষণ কম আর পাড়ে কর্মরত অনেক ট্রাক্টরের আনাগোনা। মনে মনে কল্পনা করলাম চারধারে পাহাড়ঘেরা জলে ভরা ড্যামটির সৌন্দর্য। লেকটির মাঝে একটি পাহাড় থাকায় সৌন্দর্য আরও বেড়েছে। সূর্য পশ্চিম দিগন্তে ঢলেছে, তবে অস্ত যেতে দেরি আছে। সে অপেক্ষা না করে ফিরতেই হল ঐতিহাসিক দেউলঘাটার মন্দির দেখতে।

বেশ কয়েক মাইল দূরে বড়াম পেরিয়ে গেলাম বেশ ঝোপজঙ্গলে ঢাকা, নদীর ধারে,দেউলঘাটার মন্দির দেখতে। দেখে আশ্চর্য হলাম এত ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন মন্দির অঞ্চলের কোন রক্ষার বা যত্নের ব্যবস্থা নেই! অবশ্য আমরা আমাদের কোন্ ইতিহাসেরই বা গুরুত্ব দিয়েছি? হেলায় এসব নষ্ট করছি। মন্দির একটি নয় দুটি। একই রকম দেখতে পাশাপাশি দুটি লম্বাটে টেরাকোটা কাজের মন্দির। বোধহয় সেন, পাল বা গুপ্তযুগের মন্দির। শিবের মন্দির। মন্দিরগাত্রে যা কিছু শিল্পকাজ ছিল, আজ আর তা বোঝা যায়না। টুকরোটাকরা এখানে ওখানে ছড়িয়ে রয়েছে। মন্দিরগুলির সম্প্রতি সংস্কার হয়েছে। তবে অপটু হাতে সংস্কার আর কবে আসলের মত হয়? শিল্পনন্দন তো আর হয়না। মন্দিরদুটিকে দাঁড় করিয়ে রাখা গেছে মাত্র। মন্দিরচত্বরটি মোটামুটি পরিষ্কার করা। তবে নিত্যপূজা হলে যে পরিচ্ছন্নতা বা পবিত্রতার চিহ্ণ থাকে, তা নেই। দর্শনস্থান হিসাবে পরিষ্কার আছে। এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে আলাপ হল। তিনিই ডেকে আলাপ করলেন। জানালেন এই নির্বান্ধব পুরীতে তিনি আটত্রিশ বছর আছেন। প্রথমে ওঁকে অশিক্ষিতা আশ্রমবাসিনী ভৈরবী ভেবেছিলাম। শীঘ্রই ভুল ভাঙল। উনি বলতে লাগলেন মন্দিরের ইতিহাস। জানলাম এগুলি মহাযান বৌদ্ধধর্মের মন্দি্র। পরে শিবের মন্দির হিসাবে ব্যবহার হচ্ছে। সেন, পাল বা গুপ্ত যুগে যখন বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মের রমরমা, তখন বাংলার অনেক জায়গায় বৌদ্ধ মন্দির তৈরি হয়। তার প্রমাণ দেখালেন পাশে তৈরি চারটি ছোট ঘরে চারটি মূর্তি দেখিয়্রে। মূর্তিগুলির বিশ্লেষণ করে বোঝালেন সেগুলি জগদ্ধাত্রী,দুর্গা ইত্যাদি হিন্দু বা আর্য দেবদেবীর মূর্তি হলেও তাতে বৌদ্ধপ্রভাব থাকায় সেগুলি ঠিক হিন্দুমূর্তি হয়নি। পরে আত্মপরিচয় দিয়ে বললেন,উনি বাঁকুড়া ক্রিশ্চান কলেজ থেকে স্নাতক হয়ে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর হন। পরে দীর্ঘদিন স্কুল চালান।

পরে এব্যাপারে দেখছিলাম যে,পণ্ডিতেরা বলছেন, বৌদ্ধমন্দির নয়, এগুলি জৈন মন্দির। আসলে কাছাকাছি তিনটি একই রকমের মন্দির ছিল তার মধ্যে এই দুটি পাশাপাশি,একটা একটু দূরে। বর্তমানে এই দুটিই টিঁকে আছে। দুটিতেই কিছু অশৈল্পিক রীতিতে সংস্কার হয়েছে। অবশ্য উপায়ও নেই,সেই ধরণের শিল্পীকে আজ পাওয়া মুস্কিল। এগুলি তৈরির সময়টা ওই দশম একাদশ শতাব্দী - যখন পাল বা সেন যুগ চলছে। সেইসময় এইসব অঞ্চল অর্থাৎ বাঁকুড়া-পুরুলিয়া, রাজা অনন্ত বর্মণ চোড় গঙ্গদেব দখল করেন। তিনি জৈনধর্মে বিশ্বাসী হওয়ায় রাজানুকুল্যে বেশ কিছু জৈন মন্দির গড়ে ওঠে। কাছাকাছি জায়গা পাকবিরা বা বান্দা অঞ্চলে এখনও যে সমসাময়িক মন্দিরগুলি রয়েছে, সেগুলি দেখলেই এগুলি যে দিগম্বর জৈন মন্দির তা বোঝা যাবে। সেখানে মন্দিরের দেওয়ালে ও নানা জায়গায় পার্শ্বনাথের মূর্তি রয়েছে। পরবর্তী কালে এগুলি পরিবর্তিত হয়ে হিন্দু মন্দির - শিবের বা বিষ্ণুর মন্দির হিসাবে টিঁকে থাকে। পাশের নদীটি কাঁসাই বা কংসাবতী। বিচিত্র সুন্দর কালো সাদা, বড় বড় পাথর ইতস্তত নদীর বুকে ছড়ানো। তার ফাঁক দিয়ে খরস্রোতা নদীটি এঁকেবেঁকে চলেছে। মন্দিরচত্বর থেকে একটা সিঁড়ি ধাপে ধাপে নদীর বুকে নিস্তব্ধতার মধ্যে দিয়ে নেমে গেছে। পাথরগুলি কিন্তু সত্যিই মন কাড়ে - একটা পাথরের একপাশ ঘন কৃষ্ণবর্ণ, অপর পাশ গৌরবর্ণ - প্রকৃতির কী বিচিত্র শিল্পকলা। যে তিনটি মন্দির ছিল, তারমধ্যে যেটি সবথেকে বড় সেটি নাকি ২০০২ সালে হঠাৎ ভেঙ্গে পড়ে। সেখানে আজ কিছু পাথরের ধ্বংসস্তুপ ছাড়া আর কিছু নেই।

তবে মন্দিরের আশপাশটি বড় সুন্দর। চারদিকে বড় বড় গাছে ঘেরা, ছায়ার আদরমাখা আশ্রমিক পরিবেশ। গাছে গাছে টিয়াপাখি এবং আরও নানা পাখির ঝাঁক -চতুর্দিক কলকাকলিতে মুখর। আমার ঠিক বিদ্যাসাগরমশাই এর লেখা 'শকুন্তলা'র কণ্বমুনির আশ্রমের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল।

যেতে মন চাইছিল না তবু যেতে হল। বেলাও পড়ে এসেছে - সন্ধে হয়ে এলে তো কিছুই আর দেখা যাবেনা। তার ওপর শীতের বেলা তো খুব তাড়াতাড়িই ফুরিয়ে যায়।

২২/১২/১৮
সকাল-সকালই বেরোতে হল হোটেল ছেড়ে। কারণ আজ রাতেই ফেরার ট্রেন। সারাদিন ঘুরেবেড়িয়ে সোজা চলে যাব পুরুলিয়া স্টেশনে। তারজন্য ব্যাগ গোছানোর সঙ্গে আরও একটি প্রয়োজনীয় কাজ সেরে রেখেছিলাম - গতকাল হোটেলের ছেলে অজয়কে বলে স্থানীয় দোকান থেকে বেশখানিক খেজুরের গুড় আনিয়ে নিয়েছিলাম। কলকাতার দোকানে যে গুড় পাওয়া যায়, তার না আছে স্বাদ না আছে গন্ধ। এ গুড়টি একেবারে খাঁটি কিনা জানিনা, তবে আমরা যে গুড় পাই তার থেকে অনেক ভাল। খুব ভোরে অজয় কিছুটা খেজুর রসও খাইয়েছে। রসের স্বাদটিও বেশ ভাল। খেজুরের রসের সঙ্গে ছেলেবেলাটাকে কিছুটা হলেও ফিরে পেলাম, যদিও বেশি রস খাওয়ার সাহস হয় নি। আজ গাড়ি নিয়ে এসেছে প্রথম দিনের ছেলেটি অর্থাৎ ছোটে। ছোটে বললেই মনে হয় বলি 'ছোটে নবাব।' অবশ্য ওকে এই গাড়ির নবাব-ই মনে হচ্ছিল। গাড়িটি একেবারে নতুন, এখনও নম্বর পড়েনি। বলল যে গাড়িটা ওর নিজের -সেটা অবশ্য ওর যত্ন দেখেই বুঝেছিলাম। লোকে নতুন বউকে যেমন যত্ন করে,ঠিক তেমনি যত্ন করছে। আর তেমনই নবাবি ওর হাবভাব। তবে ছেলেটির ব্যবহার খুবই ভাল।

আজ গাড়ি প্রথম থেকেই একটু উড়ুউড়ু মেজাজে। কারণটা পরে বুঝলাম। আজ তাকে কোন আজেবাজে রাস্তায় যেতে হবে না। সোজা ন্যাশনাল হাইওয়ে দিয়ে ঝড়ের মত উড়ে চলবে। প্রথমেই গেলাম মাঠা রেঞ্জের জঙ্গলে। শাল-সেগুনের ঘন জঙ্গল। তবে তখনও তার ঘুম ভাঙেনি। সবেমাত্র বিছানায় শুয়ে আড়মোড়া ভাঙ্গছে। অল্প অল্প পাখিদের কাকলি শোনা যাচ্ছে। আর গাছের ফাঁক দিয়ে মিষ্টি লাজুক রোদের ঘোমটা পরা দুষ্টু-মিষ্টি হাসিমুখ একটু একটু করে লুকিয়ে-চুরিয়ে উঁকি মারছে। তার সঙ্গে খেলায় না মেতে আমরা এগোলাম পাখিপাহাড়ের দিকে।

পাখিপাহাড় নামটার মধ্যেই কেমন যেন একটা রোমাঞ্চের গন্ধ আছে যা শুনলেই মনটা কেমন যেন আনচান করে ওঠে। কাছে গিয়ে দেখি শালের জঙ্গলের মধ্যে একটা একেবারে উদোম পাহাড় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। জঙ্গলের বাইরে থেকে শুধু মাথাটুকুই দেখা যায়। গায়ে রয়েছে নানা আঁকিবুঁকি সাদা সাদা দাগের। ঢুকলাম শালের জঙ্গলের মধ্যে - নির্দিষ্ট কোন বাঁধাধরা পথ নেই। এতেই যেন প্রকৃতিকে ঠিক রূপে পাওয়া যাচ্ছে্ এখানে। যত ভেতরে ঢুকলাম ততই যেন আশ্চর্যের সীমা হারিয়ে যেতে লাগল। দেখি পাহাড়ের গোড়ায় ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা অনেক পাথরের গায়ে বেশ মুন্সিয়ানার সঙ্গে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নানা পাখি, খরগোশ, প্যাঙ্গোলিন বা অন্য প্রাণীর ছবি। তবে তার মধ্যে পাখিটাই বেশী। আর পাহাড়ের মাথা থেকে গোটা গায়ে যে আঁকিবুঁকি দেখছিলাম তা নিছক আঁকা নয়,সেগুলো সব বহু পাখির ছবি খোদাই করা। বোঝা গেল কেন এটার নাম পাখিপাহাড়। শুনলাম এই পাহাড়ের বৃত্তান্ত।

শিল্পী শ্রী চিত্ত দে-র শৈল্পিক পাগলামির ফসল এই সুন্দর পাখিপাহাড়, যা আজ নানান শিল্পবোদ্ধা ও সৌন্দর্যরসিক পর্যটককে টেনে আনে পুরুলিয়ার এই অখ্যাত মাঠা রেঞ্জের জঙ্গলে। গভর্ণমেন্ট আর্ট কলেজের প্রাক্তনী ভাস্কর চিত্ত দে দুই দশকের বেশি সময় যাবৎ স্থানীয় আদিবাসী যুবকদের কাজে আকৃষ্ট করে,তাদের শিক্ষা দিয়ে এই সুবিশাল কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। কীভাবে যে তিনি এই বিশাল কাজ করছেন তা ভাবলে অবাক হতে হয়। ৮০০ ফুট উঁচু এই পাখিপাহাড়ের গায়ে এখনো অবধি প্রায় পঁয়ষট্টিটি পাখি চিত্রিত হয়েছে,পরিকল্পনা আছে শতাধিক পাখি আঁকার। এখানে সবচেয়ে বড় পাখিটি প্রায় ১২০ ফুট ও সবচেয়ে ছোটটি ৫৫ ফুট বিস্তৃত পক্ষ। শিল্পী প্রায় সারা ভারত ঘুরেছেন একটা সুযোগ্য কাজের ক্ষেত্র খুঁজে। শেষে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শ্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তাঁকে এই মাঠাবুরু রেঞ্জের পাহাড়টিতে কাজ করতে দেন। বিভিন্ন সংশোধনাগারফেরতদের পাশাপাশি স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে নিয়ে শিল্পী ১৯৯৭-এ এই কাজটি শুরু করেন। এই কাজ এখনও অসমাপ্ত, তবে এখনই এর খ্যাতি ছড়িয়েছে বেশ।

এখানে জঙ্গলে ঢুকে পাহাড়ের কাজ দেখছি এমন সময় দেখি একদল বন হরিণীর মত একটা বুনো ছন্দে সেই ভোরের বেলায়, যখন জঙ্গলের ভিতরে সূর্যের আলোও আড়মোড়া ছেড়ে ঢোকেনি, নানা বর্ণের শাড়ি পরে চলেছে একদল মাঝবয়সী মেয়ে। কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কোথায় চলেছ? জানলাম কাঠ কুড়াতে। হাতে তাদের একটি ছোট কাটারিগোছের। বললাম, কখন ফিরবে? চলতে চলতেই বলল, সাঁজ বেলায়।
-খাবে কী সারাদিন?
- সারাদিন আর খাব না, ভোরে পান্তা খেয়ে বেরাইছি। একেবারে সাঁজবেলায় বাড়ি গিয়ে খাব ।
-জল পাবে কোথায়?
কোমরের গেঁজে থেকে একটি প্লাস্টিকের জলের বোতল দেখিয়ে বলল, ঘর থেকে নিয়ে বেরাইছি।

বলতে বলতেই চলে গেল অনেক দূর, চোখের বাইরে জঙ্গলের আড়ালে। কতক্ষণ তাদের চলার পথের দিকে তাকিয়ে থাকার পর মন ফিরল পাখিপাহাড়ের কোলে। ভাবছিলাম এরাই তো প্রকৃতির বুনো পাখি।

ছুট লাগালাম একেবারে সোজা গড় পঞ্চকোট। মাঝে পড়ল পুরুলিয়া শহর। বেশ জমজমাট শহর ছাড়িয়ে আবার হাইওয়ে ধরে ছুটলাম। আনাড়া, বেগুনকোদর ইত্যাদি সব জায়গা, বসতি, ছোট ছোট বাজার আর আদিগন্তবিস্তৃত খোলা মাঠ যার দিকে তাকালে মনটাও প্রশস্ত হয়ে যায়। প্রায় বেলা বারোটা নাগাদ পৌঁছালাম ইতিহাস বিস্মৃত গড়পঞ্চকোটে। শেষের দিকে বেশ খানিকটা জঙ্গলাকীর্ণ রাস্তার পর ঢোকা গেল ঈপ্সিত স্থানে। দূরে দেখা যাচ্ছে সবুজ ঢাকা পঞ্চকোট পাহাড়। তার কোলে সরকারি আবাস বেশ দৃষ্টিনন্দন, শুনলাম আগে থেকে ব্যবস্থা করে এখানে থাকা যায়। কাছেই রয়েছে পাঞ্চেত ড্যাম। তবে আমাদের সময় কম বলে এবং অনেক ড্যাম দেখা হয়েছে আগে, সেজন্যও বটে, আমরা ড্যামে সময় নষ্ট না করে ইতিহাস দেখতেই আগে পছন্দ করলাম।

ঢোকার মুখেই দেখি একটি বেল গাছের তলায় মাথাখোলা ছোট একখানি খুপড়ি, পাথরের তৈরি। এককালে তা নাকি মন্দির ছিল, রাজপরিবারের দেবী কল্যাণেশ্বরীর। সেই মূর্তিই এখন পূজিত হচ্ছেন মাইথনে। তার পাশেই রয়েছে এক পঞ্চচূড়া বিষ্ণুপুরের টেরাকোটা মন্দিরের আদলে এক মন্দির,পঞ্চরত্ন মন্দির, যা বেশ কিছুটা সংস্কার করা হয়েছে,তবে অন্যান্য অনেক মন্দিরের মধ্যে এটাই এখনও দাঁড়িয়ে আছে কালের ভ্রূকুটিকে অগ্রাহ্য করে।

পঞ্চকোট থেকে বেরিয়ে রাস্তায় একটা দোকানে দ্বিপ্রাহরিক ভোজন সারা গেল। তারপরে প্রায় পড়ন্ত দুপুরে পৌঁছলাম জয়চণ্ডীপাহাড়ের তলায়। এই পাহাড়ের সঙ্গেই জড়িয়ে গেছে সত্যজিৎ রায়ের নাম তাঁর অবিস্মরণীয় কীর্তি 'হীরক রাজার দেশে'র শ্যুটিং-এর জন্য। তবে তার থেকেও বড় হল দেবীর মহিমা। পাহাড়ের মাথায় দেবীর মন্দির। ওপরে ওঠার জন্যসুন্দর সিঁড়ি আছে। তাতে অপেক্ষাকৃত দুর্বল বা বয়স্কদের জন্য মাঝে মাঝে বসার ব্যবস্থাও আছে। সিঁড়িগুলি বেশ চওড়া এবং সুন্দর। সিঁড়িতে ওঠার মুখেই আছে একটি গেট বা তোরণ। মন্দিরে পৌঁছানোর একটু আগে বাঁকের মুখে আছে একটি পুরানো ওয়াচ টাওয়ার। এটি ছিল স্থানীয় কাশীপুর রাজার ওয়াচ টাওয়ার। রাজার রাজবাড়ি প্রায় কুড়ি কিমি দূর। তবে এখন তালাবন্ধ। তাই আমাদের ড্রাইভার বৃথা যেতে রাজি হল না। ওপরে উঠে মনটা ভরে গেল। পাহাড়ের মাথাটা বেশ চওড়া। সেখানে বাহুল্যবর্জিত ছোট্ট মন্দিরে চন্ডীমাতা বিরাজ করছেন। পাশে আছে বজরংবলীর মন্দির। এখান থেকে দেখা যাচ্ছে দূরে আদ্রা-বাঁকুড়া লাইনের জয়চণ্ডীপাহাড় স্টেশন। এছাড়াও বহুদূরের দৃশ্য পরিষ্কার দেখা যায়। বেশ একটা অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করে।
সামনেই আসছে একটি মেলা। তার জন্য গোছগাছ, ম্যারাপবাঁধা শুরু হয়েছে দেখলাম।

বেশকিছুটা সময় আগেই পৌঁছে গেলাম পুরুলিয়া রেল স্টেশনে। কতকিছু দেখলাম, তবু মনে হল এখনও অনেক কিছুই দেখা হল না। ভারতবর্ষ তো অনেক বড় ব্যাপার,আমাদের ঘরের কাছে বাংলার অন্দরমহলেই আরও কত সৌন্দর্য ছড়িয়ে রয়েছে অবহেলিত হয়ে তাই-ই দেখা হল না। জীবন তো শেষ হয়ে এল। ভাবছিলাম আবার আসতে হবে এই মাটির টানে।

~ পুরুলিয়ার আরও ছবি ~

অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ক-আধিকারিক উত্তর চব্বিশ পরগণার সোদপুরের বাসিন্দা মলয় সরকার বর্তমানে আর্থিকভাবে অনুন্নত শ্রেণীর মানুষদের শিক্ষা স্বাস্থ্য ও পরিবেশ নিয়ে কাজে বিশেষভাবে যুক্ত। এছাড়া পড়াশোনা ও লেখালিখি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। নেশা দেশ-বিদেশ ভ্রমণ এবং উদ্যানচর্চা।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher