চতুর্থ কেদার - রুদ্রনাথ
সুমন্ত মিশ্র
একঘর অন্ধকারে যখন জোনাকি জ্বলে - সে যেন এক মস্ত বড় আলোর নিশান! গাছেদের পাতায় চোঁয়া সবুজ আলো - যেন ঘরের কালোয় রঙমশালের ফুলকি! দুন এক্সপ্রেসের টিকিটটাও ছিল অমনি এক আলোর নিশান, আমার 'না' এর অন্ধকারে অমনই রঙমশালের ফুলকি! যাব'না'-ই ঠিক ছিল! সেদিনটায় কেমন সব ওলটপালট হয়ে গেল! মায়ের ওপর একরাশ অভিমান নিয়ে অফিস এসে যখন নিজের কম্পিউটারটায় বসলাম, অভিমানে বারবার মন বলছিল, 'থাকব না, পুজোয় কিছুতেই থাকব না বাড়িতে!' সে তো হল, কিন্তু যাব কোন চুলোয়! আজ সেপ্টেম্বরের আট তারিখ, আর সপ্তাহ তিনেক পরেই তো মহালয়া, আমার জন্য কে আর ট্রেনের বার্থ রেখে অপেক্ষা করছে! এদিকে পকেটেরও তো ঠনঠনে অবস্থা! গতবার সাগর থেকে ফিরেছিলাম রুদ্রনাথ যাওয়ার সাধ অপূর্ণ রেখে! ভেবে দেখলাম কম রেস্তোয় একমাত্র সেই সাধই পূর্ণ হতে পারে - যদি এযাত্রায় চতুর্থ কেদার সহায় হন! রেল-এর সাইট দেখাল, মহালয়ার রাতে কিছু 'বার্থ' খালি আছে।-তা নাহয় হল, কিন্তু ফেরার? আছে, তাও আছে - নবমীর রাতে মাত্র একটা বার্থই খালি আছে, উপাসনা এক্সপ্রেস-এ! টিকিট হল, ফোন করলাম সাগরের সোনু পেয়িং গেস্টহাউসের গোবিন্দজিকে, হয়ে গেল থাকার ব্যবস্থাও! 'প্রাণে খুশির তুফান' তুলে মাত্র এক ঘন্টাতেই সেরে ফেলা হল রুদ্রনাথ দর্শনের প্রস্তুতি।
মহালয়ার রাতে স্যাক্ কাঁধে যখন ট্রেনে চড়লাম, সহযাত্রীরা গভীর ঘুমে ডুবে। নিজের নির্ধারিত বার্থ খুঁজে নিয়ে সে ডুব দিতে আমারও বেশি সময় লাগল না। ঘুম ভাঙল চারদিকের ক্যাঁচর-ম্যাঁচর শব্দে। ট্রেন দাঁড়িয়ে, হকারদের ব্যস্ত যাতায়াত, জানলা গলে ঢুকে আসা নরম রোদ্দুর - সব ছেড়ে চোখ পড়ল সাইড বার্থে মুখোমুখি বসা দুটো পুঁচকের দিকে। ছোট্ট মুখে যেন খুশি উপচে পড়ছে – মনে হল এ যেন সক্কাল সক্কাল দেবদর্শন! 'গুড মর্নিং', বলে ভাব জমালাম! জানলাম ওরা মাসতুতো ভাইবোন, দাদু-দিদাকে সঙ্গে নিয়ে পুজোর ছুটিতে কুমায়ুন বেড়াতে যাচ্ছে! একজন থাকে জামসেদপুর, অন্যজন কল্যাণী। আগে জানতাম 'মানুষ' নামক দ্বিপদ জন্তু বড় হতে হতে মনুষত্বে জারিত হয়ে প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠে! নিজের বয়স যত বেড়েছে একথার অসারতা ততই বেশি করে উপলব্ধি করেছি! আজ মনে হয় মানুষের মনুষত্বের যেটুকু অবশেষ, তা থাকে তার ওই ক্ষুদে চেহারাতেই! বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটুকুরও অবলুপ্তি ঘটে, তখন সে পরিপূর্ণ দুপেয়ে জন্তু! যাক্ সে কথা, ওদের সঙ্গে হাসি-মজায় বেশ কেটেছিল সারাটা দিন! লখনউ আসতে ওরা নেমে গেছিল! যেতে যেতে ঘাড় ঘুরিয়ে ওদের হাত নাড়ার ছবিটা ভালোবাসায় ধুইয়ে দেয় আজও! আরও এক রাত ট্রেনে কাটিয়ে ভোরবেলায় পৌঁছেছিলাম হরিদ্বার। এখান থেকে গন্তব্য গোপেশ্বর, সেখান থেকে সাগর।
হরিদ্বারে স্টেশন লাগোয়া বাসস্ট্যান্ড, সেখান থেকে গোপেশ্বরের বাস ছাড়ল সাড়ে সাতটায়! প্রায় ২৩৫ কিমি পথ, সময় লাগে সাত থেকে সাড়ে সাত ঘন্টা! ভাবলে অবাক হই, সমতলে যে আমি তিন ঘন্টা বাসজার্নিতেই হাঁপিয়ে উঠি, পাহাড়ে বারো ঘন্টা জার্নিতেও তার এতটুকু ক্লান্তি আসে না কেন! চারপাশে নীল-সবুজের ছায়া, পান্নাসবুজ নদীর স্রোত, পথ উজিয়ে বয়ে যাওয়া অবিরাম ঝরনাধারা সব কেমন দেহ-মন জুড়িয়ে দেয়! এমনকি ভেড়ার পালের পথ অবরোধ - ভালো লাগে তাও! হৃষিকেশ, দেবপ্রয়াগ, শ্রীনগর, কর্ণপ্রয়াগ, চামোলি হয়ে গোপেশ্বর পৌঁছলাম যখন সময় প্রায় তিনটে ছুঁই ছুঁই! গোপেশ্বর রুদ্রনাথের শীতকালীন আবাস, কার্তিক মাসের সংক্রান্তিতে পটবদ্ধ হবার পর ছ'মাস এখানেই পূজিত হন দেব। প্রায় ৪,৬০০ ফুট উচ্চতায় চামোলি জেলার সবচেয়ে বড় শহর এবং প্রশাসনিক সদর দফতর এই গোপেশ্বর। মাত্র গতবছরই ঘুরে যাওয়ায় ঠিক কোথায় নামলে সাগর যাবার গাড়ি পাওয়া যাবে জানাই ছিল। সেইমত নেমে খোঁজ করি জিপের। স্ট্যান্ড তখন এক্কেবারে ফাঁকা, খানিক সময় লাগবে বুঝে কিছু উদরস্থ করতে উদ্যত হই। স্ট্যান্ডের পাশেই একটা দোকানে জুটে যায় ডিম-টোস্ট। ইতিমধ্যেই গোবিন্দজি একবার ফোন করে খবর নিয়েছেন। আমার অবস্থান জানিয়ে ওঁকে আশ্বস্তও করেছি। আনমনে রাস্তার মানুষজন দেখতে দেখতেই 'মন্ডল' যাওয়ার গাড়ি চলে আসে! জিপের মাথায় স্যাক চাপিয়ে সামনের একটা সিটে বসি! গোপেশ্বর থেকে সাগর কুড়ি-পঁচিশ মিনিটের রাস্তা, দুরত্ব ১০ কিমি। গতবার এটুকু পথই ছিল রোমাঞ্চ ঠাসা, রকমারি মাতালের রঙ্গময় মূর্তি! সত্যিই, এতবছর ধরে পাহাড়ে আসছি ভরদুপুরে এমন দৃশ্য আমার চোখে পড়েনি কখনও! মনে আছে মুজতবা আলীর 'চাচা' বলেছিলেন -"শিখের বাচ্চা, রক্তে তার তিনপুরুষ ধরে আগুন মার্কা ধেনো।" হলফ করে বলতে পারি, শিখের রক্তে যদি তিনপুরুষের ধেনো হয়, এই পাহাড়িগুলোর রক্তে তবে চোদ্দপুরুষের! প্রায় আধঘন্টা অপেক্ষার পর দশজন প্যাসেঞ্জার নিয়ে জিপ ছাড়ল। গোপেশ্বর পেরোতেই এবারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি! কখনও বমি তো কখনও কারও জিনিস পড়ে যাওয়া, সঙ্গে মহিলাদের গণ জায়গাবদল! - সবকিছু সয়ে প্রায় পাঁচটা নাগাদ নামলাম গোবিন্দ সিং নেগির হোটেলের সামনে। দুহাত বাড়িয়ে রাস্তাতেই স্বাগত জানালেন উনি। সঙ্গে নিয়ে দেখিয়ে দিলেন আমার বরাদ্দ ঘর।
এখানে বেলা বড়, তাই 'ফ্রেশ' হয়ে বাইরে বেরিয়েও দেখি চারদিকে ফটফটে আলো! ঘরের বাইরে খোলা ছাদে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকি রুদ্রনাথের পথে! সেখানে তখন ঘন মেঘের ঘনঘটা! গতবার কল্পেশ্বর গিয়ে কালগোট-ডুমক-তালি-পানার হয়ে যে পথ রুদ্রনাথ গেছে, সে পথ ধরেই যাবার ইচ্ছে ছিল। দেবগ্রাম থেকে রুদ্রনাথের সেই পথ ৩৪ কিমি। আর এবারের পথ সাগর থেকে পুঙ্গ বুগিয়াল-লিটি বুগিয়াল-পানার-পিতৃধার-ধলাবনি ময়দান হয়ে - ২১ কিমি। আবার অনেকে মণ্ডল থেকে অনুসূয়াদেবী-হংস বুগিয়াল-নাওলা পাস হয়ে রুদ্রনাথ যান, নেমে আসেন সাগর হয়ে। মন্ডল থেকে রুদ্রনাথের সে পথ ২০ কিমি, ওই পথই সবচেয়ে জনপ্রিয়!
"খানা খায়েঙ্গে?", নেগি সাহেবের কথায় ভাবনার স্রোত থামে! মোবাইলে দেখি সবে সাড়ে সাতটা। জানাই, একটু পরে হলে ভালো হয়। সম্মতি দিয়ে বলেন, "সুবাহ জলদি নিকালনা পড়েগা, ইস্ লিয়ে জলদি খানা খাকে শো যানা-ই আচ্ছা হ্যায়, হর্ রোজ দো পহর কে বাদ মৌসম খারাব হো রেহে হ্যায়!" ওঁকে বলি, - কাল এখানেই থাকছি, তাই একটু দেরি হলেও অসুবিধা নেই। খুশি হয়ে ওঁর সঙ্গেই রাতের খাবার খাওয়ার নিমন্ত্রণ জানিয়ে চলে যান। সাগর-এ গোবিন্দজির মত এমন আপাদমস্তক ভদ্রলোক বিরল! আদপে এখানে থাকার জায়গা দুটি, এক এই 'সোনু পেয়িং গেস্টহাউস' অন্যটি 'হরিয়ালি লজ।' গতবার এসে প্রথম হরিয়ালি লজেই নেমেছিলাম। গ্রামের একেবারে শেষপ্রান্তে গাছ-গাছালি ছাওয়া সবুজ বাড়িটি প্রথম দর্শনে ভাল লাগলেও, কিছুক্ষণ সময় কাটিয়েই বুঝেছিলাম ওটা আসলে গ্রামের মদ্যপদের আড্ডাখানা! সে জায়গায় গোবিন্দজির এই গেস্টহাউস প্রকৃত অর্থেই অতিথিশালা! গতবারের একরাত্রির ঊষ্ণ আতিথেয়তাই এবারও ফিরিয়ে এনেছে আমাকে। সে রাতে ভাবিজির বানান কাঁচা রাজমার ডাল আর বেগুনের তরকারি দিয়ে রুটি খেয়ে যখন শুতে গেলাম মোবাইল জানাল সবে রাত নটা!
ভোরবেলা ঘুম ভাঙল বাইরের ঝমঝম শব্দে, বৃষ্টি নেমেছে। আজ কোনোই তাড়া নেই, তাই 'রেজাই' মুড়ি দিয়ে আবার পাশ ফিরে শোওয়া। এবার ঘুম ভাঙে সাতটায়। ভালো করে কান পাতি - না, কোনো বৃষ্টির আওয়াজ শোনা যায়না! দরজা খুলে বাইরে আসি, বৃষ্টি ভেজা সাগর তখনও বেশ জুবুথুবু! আকাশে টুকরো টুকরো কালো মেঘ, তবে তা মনের কোথাও আশঙ্কার মেঘ ছেয়ে ফেলার মত নয়! আজ চারপাশটা ঘুরেফিরে দেখব। ইচ্ছে আছে রুদ্রনাথের পথে কিছুটা এগিয়ে দেখে আসারও। তাই সময় নষ্ট না করে তৈরি হয়ে নিই। সকালের জলখাবার সেরে নটাতেই নেমে আসি সাগরের পথে।
হোটেলের পাশ দিয়ে ধাপে ধাপে কংক্রিটের পথ, উঠে গেছে রুদ্রনাথের দিকে। মিনিট পনেরো চলতেই শেষ হয় গ্রামের বাড়ি-ঘর। পথ এবার ক্ষেতের মাঝ দিয়ে। বেশ চড়াই, হাঁপ ধরছে, মধ্যে মধ্যে দাঁড়িয়ে বিশ্রাম নিই। চারদিক সবুজে সবুজ, কোথাও কোথাও পাকা শস্যের হলুদ ছাপ, বৃষ্টিধোয়া সকালে সত্যিই বলতে ইচ্ছে করছে, 'আমি কি হেরিলাম হৃদয় মেলে।' চলতে চলতেই সঙ্গী জুটে যায়। "সাব দেখো, নিচে, বাঁয়া তরফ, উ, উ নিচে।" ঘাড় ঘুরিয়ে দূরে তাকিয়ে দেখি, -ভোরাল-এর মত লাগে। ওঁকে জিজ্ঞেস করি, ওগুলো কী? বলেন, "হামলোগ বোলতে কাঙ্খর, আপলোগ সায়েদ হিরণ বোলতে!" সকাল সকাল এতটা আশা করিনি, আবার গাইতে ইচ্ছে হল - 'আমার নয়ন-ভুলানো এলে।' সঙ্গীর নাম গজেন্দ্র সিং, সাগর থেকে ২ কিমি উঠে চন্দাকোটি - পথিকদের প্রথম বিশ্রাম ছাউনি - তার লাগোয়া চায়ের দোকান চালান ইনি। ওঁর সঙ্গে দোকান অবধি এসে এগিয়ে যাই আরও কিছুটা ওপরে। চন্দাকোটির পর রাস্তা বাঁক নিয়ে ঘুরে যায়, অদৃশ্য হয় সাগর, শুরু হয় বড় বড় গাছে ছাওয়া জঙ্গুলে পথ। আরও এক কিমি এগিয়ে আবার নেমে আসি। গজেন্দ্র সিং-এর হাতে 'মিঠি চায়' খেয়ে ফিরে আসি সাগর।
আচ্ছা পাহাড়ের বুকে একটা জায়গার নাম 'সাগর' কেন? প্রশ্নটা করেছিলাম গোবিন্দজিকে। উত্তরে যা বললেন সেটা বেশ চমকপ্রদ! এই গোপেশ্বর অঞ্চলই ছিল সগর রাজের রাজধানী। সগর হলেন ভগীরথ-এর পূর্বপুরুষ! সগর পৌত্র অংশুমানের ছেলে দিলীপ, তাঁর পুত্র ভগীরথ। সগর রাজ যে চণ্ডীমন্দিরে পূজো দিতেন সেটাও নাকি এই গ্রামেই অবস্থিত! তাই সগর রাজের নামেই এজায়গার নাম সাগর। আমরা এপার বাংলার লোক। ভগীরথের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতা অন্তহীন! গঙ্গার পবিত্র জলধারা কোন কৌশলে তিনি এখাতে বইয়ে ছিলেন ভাবলে আজও হতবাক হতে হয়! কাহিনি শুনে বেরিয়ে পড়ি চণ্ডীমন্দির দর্শনে। বাসরাস্তা থেকে আধ কিমি টানা নেমে গিয়ে চণ্ডী মন্দির। আজকের মন্দির নেহাতই নব্য, প্রাচীনের একটুকরো অবশেষও আজ নেই! গড়পড়তা পাড়ার দেবী মন্দিরের ধাঁচেই আজকের এই মন্দির। কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে এক ঘন্টাতেই ফিরে আসি গেস্টহাউস। গোবিন্দজীর দোকানে আড্ডা চলে বিকেলভর, বিকিকিনির ফাঁকেই জেনে নিই রুদ্রনাথ পথের খুঁটিনাটি। পাহাড়ের মাথার পিছে সূয্যি অস্ত যেতেই এপারের ঢালে ঢালে সন্ধে নামে। মশাদের গুনগুনানির রেশ নিয়ে উঠেপড়ি আড্ডা ছেড়ে। কাল সাগর ছেড়ে ওপরে ওঠার পালা। তাই স্যাক্ গুছিয়ে, ফোন চার্জে রেখে যখন বাইরে আসি সন্ধ্যের কালো ডানায় তখন ঘন মেঘের গুঁতোগুঁতি, পাহাড়ের ঝুঁটি জুড়ে বিদ্যুতের ঝিলিক, শরীর জুড়ে গুরুগুরু কাঁপন! মুহূর্তেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে, আমি ঠাঁই নিই খোলা জানলার পাশে, মোবাইলে বাজিয়ে দিই, "সঘন গহন রাত্রি…..!"
ঘুম ভাঙে চণ্ডীমন্দিরের শিবস্তোত্র পাঠে। দরজা খুলে পা রাখি জল-থইথই চাতালে, পাহাড়ে অন্ধকার তখন আলোর পরশ পেতে উন্মুখ। মাথা তুলে শুধু তারাদের খুঁজি, দু-একখানের সঙ্গে চোখ টেপাটেপি করে ঢুকে আসি ঘরে। বেশ কিছু জিনিস এখানে রেখে ওপরে যাব, সেগুলো ভালো করে গুছিয়ে রেখে নিজের ন্যাপস্যাকটা আরও একদফা 'চেক্' করে নিয়ে প্রস্তুতি সারি। সকাল ছটায় ভাবিজী যখন চা নিয়ে আসেন, আমি তখন রীতিমত তৈরি! চায়ে চুমক দিতেই বাইরে বেশ একটা হৈচৈ কানে আসে! ওপরের চাতাল থেকে রাস্তায় ঝুঁকে কী ব্যাপার বোঝার চেষ্টা করি! কিছুক্ষণ অনুধাবন করে বুঝি কোনোকিছু চুরি গিয়েছে। গোবিন্দজী কাছাকাছি আসতেই খবর নিয়ে জানি - মন্দিরপথের তোরণের ঘন্টা চুরি গেছে - নবরাত্রির মধ্যে এমন একটা ঘটনা এঁদের কাছে অশুভ ঠেকছে! আমার কেন জানি মনে পড়ে যায় বহুব্যবহৃত একটা বাংলা কথা, -"ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্য।" শুধু এক্ষেত্রে নয় যখনই কোনো কিছুতে ভক্তদের একসঙ্গে দুঃখ পেতে দেখি, আমার এই কথাটাই কেন জানি মনে পড়ে! কোথাও যেন রাজনৈতিক দলের অনুগামীদের সাথে ভক্তের স্লোগানের একটা মিল খুঁজে পাই! দুই-ই কেমন অন্তঃসারশূন্য ঠেকে! এক্ষেত্রে অবশ্য অতটা বলা যায় না! উৎসবের দিনে ঘন্টা চোরের যে আর্থিক কিছু 'মঙ্গল' হবেই এ আর বলার অপেক্ষা রাখে না! ভাবিজীর বানানো রুটি-সব্জি দিয়ে 'নাস্তা' সেরে রুদ্রনাথের পথে যখন পা পড়ল, মোবাইল জানাল সকাল আটটা।
রাতভেজা সাগর-এ আজ হইহই করা রোদ্দুর! গাছেদের পাতায় পাতায় প্রাণের নেচে ওঠার আনন্দ, পাখিদের বাসায় নতুন করে জেগে ওঠার গান! পাহাড়ে আজ আলোর আলোতে চারদিক আলোকময়! আধঘন্টা একটানা চলে উঠে আসি চন্দাকোটি। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি কেউ একজন উঠে আসছেন, সঙ্গী পাওয়া যাবে মনে করে অপেক্ষার সিদ্ধান্ত নিই, গজেন্দ্রকে চায়ের অর্ডার দিয়ে ছবি তোলায় ব্যস্ত হই। চায়ের কাপে শেষ চুমুক পড়তেই উঠে আসেন অচেনা আগন্তুক। পরিচয় সারি, নেহাতই পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের এক যুবক, বাড়ি দিল্লি, ইনিও যাবেন রুদ্রনাথ, তবে আজই, সেখান থেকে কাল নেমে যাবেন অনুসূয়া-মন্ডলের পথে। আমার আজ পানার পর্য্যন্তই যাওয়া - সেখান থেকে কাল রুদ্রনাথ দর্শন। ওঁর তাড়া থাকায় আর কালক্ষেপ না করে এগিয়ে যাই জঙ্গুলে পথে। প্রায় পৌনে দশটা নাগাদ পৌঁছই এক বিস্তীর্ণ সবুজে। এ সবুজ মন ভালো করে, এ সবুজ ক্লান্তি ঝরায়, এ সবুজ আপন করে থামতে বলে - পৌঁছেছি এ পথের প্রথম বুগিয়াল 'পুঙ্গ বুগিয়াল।'। কিন্তু থামার যে জো নেই! সঙ্গীর তাড়া, তাই হুমহুমিয়ে এগিয়ে চলা।
পুঙ্গ বুগিয়ালের পর এবারের পথ ঘন অরণ্যে। বিশালাকার গাছেদের অন্তঃপুরে ঢুকে পড়ার আগে ঘাড় উঁচিয়ে দেখে নিই মেঘের চাদর ঢাকা পানার-এর মুণ্ডুখানা। ঢুকে পড়ি গভীর অরণ্যে, শুরুতেই পাহাড়ি ঝরনার ওপর কাঠের পুল পেরিয়ে শুরু হয় নির্মম চড়াই। আধঘন্টা হাঁটতেই সঙ্গীর চেয়ে কিছুটা পিছিয়ে পড়ি, পাখির শিস্ আর ঝিঁঝিঁর ডাকে আধো-আঁধারি রাস্তা তখন আরও রোমাঞ্চকর! মাঝে মাঝে পেরিয়ে আসি গাছেদের জাপটে জড়িয়ে থাকা কুয়াশার ধোঁয়াশা, নিভৃত পথ যেন সত্যিই ছুঁয়ে আছে পরমেশ্বরের আপন জগৎ! তবু আমি তো নেহাতই ইহলোকের একলা পথিক! তাই পথ চলতে হাঁফ ধরে, ঘেমেও যাই সপসপে, মনে উৎকন্ঠা থাকে - 'কতদূর এলাম'! আজব এক পথে চলেছি, এতবড় অরণ্য ঘেরা পথে কোথাও একটা পথ নির্দেশ চোখে পড়ে না! কতটা চললাম, আর কতটা চলেই বা সামনের 'পড়াও' কিছুই বোঝার উপায় নেই! মোবাইল জানাচ্ছে বেলা প্রায় সাড়ে এগারোটা। হিসেবমত এতক্ষণে 'মুলি খড়ক' পৌঁছে যাবার কথা, কিন্তু না, ধারেকাছে পৌঁছেছি কিনা তাও ঠাহর হচ্ছে না! মনকে বোঝাই জীবনে কোনো হিসেবই যখন মেলেনি তখন এটা মেলাতেই বা এত উদগ্রীব কেন!
হঠাৎ কানে আসে কাক ডাকার শব্দ, পাহাড়ে এর সাঙ্কেতিক অর্থ - কাছেপিঠে লোকালয়ের উপস্থিতি। আরও কয়েক মিনিট চলতেই দেখা মেলে একটা চালা ঘরের, অনুমান করি, এই তবে মুলি খড়ক! এগিয়ে যাই, ঘরের মধ্যে দুটো অংশ - একদিকে বিশ্রামের জন্য ঢালা বিছানা পাতা, তারই এককোণে থরেথরে রেজাই আর কম্বলের স্তুপ, অন্যদিকে উনুনের গনগনে আঁচ, সেখানে খাবার বন্দোবস্ত। সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ভেতরে চোদ্দ-পনের বছরের একটি ছেলে হাসিমুখে বলে উঠল, নমস্তে সাব, আও, চায় পিয়োগে? আর তখনই হল সর্বনাশ, রান্নাঘরের দাওয়ায় বসতে গিয়েই বুঝলাম পাগুলো টেনে (cramp)ধরছে। কোনোরকমে বুড়ো আঙুল চিপে ধরে সোজা করলাম, ব্যাগের বোতল বার করে ওকে বললাম, ভর্তি করে জল দে। সেই জলে গ্লুকোজ আর নুন মিশিয়ে গলায় ঢাললাম, শেষ হলে আরও একদফা। তারপর ওকে বললাম, জাদা মিঠা ডালকে চায় বানা, উও ভি বড়ি গেলাস মে! সব খেয়ে মিনিট পনেরো পর আস্তে আস্তে নিজের পায়ে দাঁড়ালাম! শুরু করলাম ওখানে দাঁড়িয়েই জগিং, চলল মিনিট দশ। বুঝলাম সামলে নিয়েছি! পাহাড়ে এরকম 'ক্র্যাম্প' এর আগে কখনও হয়নি! একেতো পুরোটাই চড়াই তার ওপর গোটা রাস্তায় কোথাও জলের চিহ্ন মাত্র নেই। একদিকে সারাটা রাস্তা ঘেমেছি, অন্যদিকে তৃষ্ণার্ত হয়েই হেঁটেছি, তাই এই অবস্থা। যাক্, স্বাভাবিকতা ফিরে পেয়ে 'ছোটু'র সাথে গল্প জুড়ি - ছোটু ওর দাদুর সঙ্গে এই অতিথিশালা চালায়, দাদু এখন ভেড়ার পাল নিয়ে বেরিয়েছেন, তাই এখন একাহাতে ওকেই সব সামলাতে হচ্ছে।
আবহাওয়া ক্রমশ খারাপ হচ্ছে, ছোটুকে জিজ্ঞেস করি, লিটি বুগিয়াল এখান থেকে কতদুর, পানার পৌঁছতেই বা কত সময় লাগবে? ও হেসে বলে, "জাদা সে জাদা এক্ ঘন্টা লাগেগা, আপ আরাম আরাম সে চলে যাও, পৌঁছ্ যাওগে।" ওকে বলি, দেখ বাবা ঠিক বলছিস তো, আমার শরীর কিন্তু ঠিক নেই! ও আবারও হেসে বলে, "আপ আগর চাহো তো আজ রুদ্রনাথ ভি যা সকতে হো।" পাহাড়ে মানুষের এই সরলতা আজও আমায় মুগ্ধ করে! ও ইচ্ছে করলেই আমায় ভয় খাওয়াতে পারত, সেক্ষেত্রে ওর কিছু আর্থিক লাভ তো হতই! সে রাস্তায় না হেঁটে ও বরং আমায় সাহস জুগিয়েছে আবারও পথ চলার। হাঁটা দিলাম, উচ্চতা বাড়ছে, স্বাভাবিক নিয়মেই বড় বড় গাছের বদলে শুরু হয়েছে ছোট ছোট ভুজগাছে ছাওয়া পথ। দামাল মেঘের দল মজা করে ছুঁয়ে যাচ্ছে বাঁদর টুপির ঝুঁটি, অল্প হেঁটেই চলে আসি 'লিটি বুগিয়াল' - পাহাড়ের ঢালে একখন্ড সবুজ খোলা প্রান্তর। এখানেও একখানা অতিথিশালা, ভেতর থেকে ডাক আসে চা খেয়ে যাবার। ফেরার পথে খেয়ে যাবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এগিয়ে চলি। একটুখানি এগিয়েই শুরু হয় পাকদন্ডি, পাহাড় মুখ ঢাকে ঘন সাদা কুয়াশায়, হারিয়ে যায় আগে-পিছের পথ, শুরু হয় সাবুদানার মতো বরফ পড়া। এ একপ্রকার ভালোই, লক্ষ্য দেখা দিলেই পৌঁছনোর আকুতি থাকে, এখন সে সবের বালাই নেই, শুধুই পায়ে পায়ে এগিয়ে চলা। আরও মিনিট কুড়ি চলেই পৌঁছে যাই ছবির মত সুন্দর এক মস্ত বুগিয়াল - পানার। শ্যামলবরণ পানার তখন মেঘ মুড়ি দিয়ে জুবুথুবু। শীতল অভ্যর্থনা নিয়ে গুটি গুটি এগিয়ে যাই ভান্ডারি অতিথিশালার দিকে।
পিঠের স্যাক্ বাইরে রেখে, জুতো খুলে সোজা ঢুকে পড়ি রান্নাঘরে। "আও দাদা, হিঁয়া বৈঠ", - বলে উনুনের ধারে পাতা কম্বলে বসতে বলে 'প্রকাশ।' প্রকাশ ভান্ডারি - আপাতত এই অতিথিশালা চালানোর দায়িত্বে। উনুনের লাল আঁচে মুখ রাঙিয়ে হাত সেঁকতে থাকি। খিদে পেয়েছে, ওকে 'ম্যাগি' বানানোর কথা বলি, কিন্তু পোড়া কপাল, - একজন যাত্রী নাকি কিছুক্ষণ আগে ওর শেষ ম্যাগির প্যাকেটখানিও উদরস্থ করে গেছে। বাংলার এক সংবাদমাধ্যমে থেকে থেকেই ঘোষিত হয় 'এগিয়ে থাকে, এগিয়ে রাখে' বাণী। এই এগিয়ে থাকার রহস্য আজকের ভুখা পেটে কিছুটা উন্মোচিত হয়! বেশ বুঝতে পারি আগের যাত্রীটি ছিলেন আমার ওই ক্ষণিকের সহযাত্রী, এগিয়ে থাকার সুফল উনিই উদরিকরণ করেছেন। শেষমেশ খিচুড়ির ফরমায়েশ করে ঘামে ভেজা কাপড় পাল্টে, ঢাকামুড়ি দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ি। প্রকাশের ডাকে যখন ঘুম ভাঙে তখন বেলা তিনটে। খিচুড়ি আর পাঁপড় ভাজা দিয়ে দুপুরের খাবার সেরে আশপাশ একটু ঘুরে দেখতে বেরিয়ে পড়ি। দেখব কী, তখনও আদিগন্ত চাপ চাপ কুয়াশার জোব্বামোড়া পানার। রুদ্রনাথের রাস্তা যে রিজ্ ধরে এগিয়ে গেছে সে পথেই ঘুরে আসি কিছুক্ষণ, উল্টো দিকে যে পথ নেমে গেছে কল্পেশ্বরের কোলে, সে পথও দেখে আসি এগিয়ে। পড়ন্ত বেলায় চুপটি করে উঠে বসি প্রকাণ্ড এক বোল্ডারের মাথায় - রহস্যে মোড়া পানারকে দুচোখ ভরে দেখি।
প্রকাশের অতিথিশালার দুটো ভাগ - একটা ইট-সিমেন্টের পাকা দেওয়াল ওপরে টিনের চালা। অন্যটা মাটির দেওয়াল, খড়ের চালা। দুটো অংশেই দু'খানা করে ঘর। কাঁচাঘরে একটা রান্নাঘর অপরটায় শোবার ব্যবস্থা, পেছন দিকে একখণ্ড গোয়ালঘর। পাকা ঘরের দুটোতেই শোবার ব্যবস্থা -যাত্রীদের জন্য সাধারণত ওই পাকা ঘর দুটোরই ব্যবস্থা থাকে। 'পায়ে পায়ে হিমালয়' বইয়ের লেখক শ্রীযুক্ত অমিয় রায়ের কাছে শুনেছি ওই পাকা অংশটা নাকি ব্রিটিশদের বানানো। আকাশপথে শত্রু শক্তির গতিবিধি লক্ষ্য রাখবার জন্য এখানে সেনা মোতায়েন থাকত। ওই বই পড়েই জানা, এই ঘরের আশেপাশে রাত্রির অন্ধকারে ভৌতিক গতিবিধির কথা! শিবঠাকুরের দেশে তাঁর চেলা-চামুণ্ডাদের সঙ্গেও এই প্রথম সাক্ষাৎ হবে ভেবে মনে বেশ একটা সুপ্ত উত্তেজনা আছেই। "চায় বন্ গ্যায়া দাদা, আ যাও" – কুয়াশার ওড়না দোলানো প্রকাশের চিৎকারে উঠে পড়ি। এগিয়ে যেতে নজরে আসে ছায়াছায়া পথ ধরে দুজনের দ্রুত নেমে আসার দৃশ্য। প্রকাশের কাছে নেওয়া চায়ের গেলাস আর ভুট্টাপোড়া হাতে দাঁড়িয়ে থাকি রান্নাঘরের দাওয়ায়, তাকিয়েই থাকি যুগলের নেমে আসার পথে। সন্ধ্যে নামছে, কুয়াশাও যেন আরও রহস্যময়ী হয়ে উঠছে, কনকনে ঠান্ডায় জড়োসড়ো হয়েও এই নিভৃত প্রকৃতিকে বলতে ইচ্ছে করে, "অতল কালো স্নেহের মাঝে/ডুবিয়ে আমায় স্নিগ্ধ করো।"
সন্ধের মুখে বেশ কিছু যাত্রী চলে আসায় সে রাতে আমার ঠাঁই হয়েছিল রান্নাঘর লাগোয়া ঘরে। আর হ্যাঁ, সারারাত ভুত-প্রেতের গতিবিধি টের না পেলেও মেঠো ইঁদুর আর প্রকাশের কিছু 'বিশেষ' অতিথির কল্যাণে 'ঘুম' নামক শব্দের সঙ্গেও সখ্যতা হলনা রাতভোর! পাহাড়ে অন্ধকার থাকতেই বিছানা ছাড়ার অভ্যেস, সেইমত সাড়ে চারটেতেই ক্যামেরা হাতে বাইরে এলাম। নিকষ কালো আকাশ তখন ঝলমলে কবিতা -"কেবল তারা। কেবল তারা।/শেষের শিরে মাণিক পারা,/হিসাব নাহি সংখ্যা নাহি/কেবল তারা যেথায় চাহি।" অবর্ণনীয় সে দৃশ্য! সারারাতের নিদ্রাহীন দুচোখ তখন খুশিতে ডগমগ! পানারের নিস্তব্ধতায় কান পেতে চরে বেড়াই আপন খেয়ালে। ধীরে ধীরে পূব আকাশে রঙ ধরে, ফিরে যায় চঞ্চল ভোরালের পাল, মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকি পশ্চিম থেকে উত্তরের দেওয়ালে। অপেক্ষা শুধু শুভ্রপটের সেজে ওঠার। একে একে রঙ মাখে চৌখাম্বা থেকে ত্রিশুল, নন্দাদেবী থেকে নন্দাকোট। মনের কোনে উঁকি মারে প্রিয় 'কালকূট'-এর ক'টা কথা -"দুঃখ জীবনের সমগ্রতায় অনতিক্রমণীয়। সুখ থাকে দুঃখের কুন্ডলীতে। নাম তার ঝলকিত দ্যুতি। সামান্য জীবনকালের কয়েকটি স্বপ্নময় মুহূর্ত মাত্র।" এই সেই 'মুহূর্ত', আর এর খোঁজেই বারে বারে ছুটে আসা। মাথা নিচু করে বলতে ইচ্ছে হয়, -'সার্থক জনম আমার!'
সকালের সাজুগুজু সেরে, ছাতুর সরবত গলায় ঢেলে যখন বেরোনোর তোড়জোড় করছি প্রকাশ এসে একটা অনুরোধ করে আমায়। তার গোয়াল থেকেই রোজ রুদ্রনাথের পুজোর দুধ পৌঁছয় মন্দিরে। আজ সেই বরাদ্দ দু'সের দুধ নিয়ে যেতে হবে আমাকে! প্রকাশকে বলি - এ তোমার অনুরোধ নয় ভাই, এ আমার কাছে আশীর্বাদ! ওর কাছেই জানি, পথে পড়বে এ পথের সবচেয়ে উঁচু জায়গা পিতৃধার, সেখানে পূর্বপুরুষদের শান্তিকামনায় পুজো দিলে তা নাকি গৃহীত হয়, আত্মা শান্তিলাভ করে। শুধু পূর্বপুরুষ নয়, জীবনের পথে যাঁদের হারিয়েছি. স্মৃতির পটে আজও তাঁদের উপস্থিতি ঊজ্জ্বল, হঠাৎ হারিয়ে ফেলা সেইসব আপনজনের শান্তি কামনায় কিছু করলে নিজেরই যে ভালো লাগে! অতএব পিতৃধারে পূজো দেওয়ার জিনিসও সঙ্গে নিয়ে হাঁটা 'জয় রুদ্রনাথ' বলে - সবে সকাল সাড়ে সাতটা।
আজও একা একাই পথচলা। পানারে যাঁরা গতরাত কাটিয়েছেন তাঁরা আজ কেউ যাবেন সাগর, কেউবা আসবেন এই পথেই। যাঁরা রুদ্রনাথ আসবেন, তাঁদের রাত্রিবাসও ওখানেই। আমারই শুধু দর্শন শেষে এখানে ফিরে আসা। অগত্যা জলদি বেরিয়ে পড়া। বরফঢাকা চূড়াদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে ঢিমে তালে এগিয়ে চলা। ঘন নীল আকাশের নিচে ঢেউ খেলানো পৃথিবীর বুকে এলিয়ে থাকা বেণীর মত পথ। তাই ধরে আধঘন্টা যেতে না যেতেই পেছনে অদৃশ্য হয় পানার - ডানদিকে খাড়া পাথরের দেওয়াল আর বাঁদিকে অতল খাদ, এরই মাঝে আঁকাবাঁকা পথ ধরে হাঁটা পিতৃধারের দিকে। দেড় ঘন্টাতেই পৌঁছই পিতৃধার।
পাথর সাজিয়ে তৈরি করা তোরণ, তাতে ঝোলানো ঘন্টা, পেরোতে হয় প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে। একপাশে পাথরঘেরা একখণ্ড দেবস্থান - এখন দাঁড়াব না, তাই তরতর করে নেমে এগিয়ে যাই পঞ্চগঙ্গার দিকে। এবার পুরোটা পথই উৎরাই, তিনদিক খোলা পাহাড়ের ঢাল - সামনে চৌখাম্বা, ডানদিকে ত্রিশূল, দুনাগিরি - বেশ লাগছে। সূর্য পেছনে, প্রজাপতির মত রোদ কখনও পিঠে বসছে আবার উড়ে যাচ্ছে, নীল আকাশে এদিক ওদিক উড়ে যাচ্ছে শরতের সাদা মেঘের দল। দেখতে দেখতেই পেরিয়ে যাই পঞ্চগঙ্গা - পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা ঝরনাধারা অবহেলায় কুলকুলিয়ে নেমে যাচ্ছে নদীর স্রোতের সন্ধানে। পঞ্চগঙ্গা পেরিয়েই ঢুকে যেতে হয় হাজারো গাছগাছালির অন্দরে। পরে জেনেছি এই গাছপালা নানারকম ভেষজ ওষুধের জন্য প্রসিদ্ধ। গাছে ছাওয়া পথই হঠাৎ করে একেবারে নব্বই ডিগ্রি ঘুরে যায়, দেখা মেলে দেবালয়ের। পাহাড়ি পথ, এখানে লক্ষ্য পিছলে-পিছিয়ে চলে! যেই ভাবি এই বুঝি পৌঁছে গেলাম, ওমনি পথ একটু দুলুনি নিয়ে উঠেনেমে পিছিয়ে যায়। প্রায় পৌনে তিনঘন্টা একনাগাড়ে হেঁটে পৌঁছই আমার অভীষ্টে - চতুর্থ কেদার, রুদ্রনাথ। যেখান থেকে পথ ধাপে ধাপে উঠে গেছে মন্দিরের দিকে তার ডানদিকেই এক যাত্রীনিবাস। বাঁ দিকে পরপর পূজারীদের থাকার জায়গা ও মন্দিরের অতিথিশালা।
বাইরে একজন দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁকে জিজ্ঞেস করেই পৌঁছই প্রধান পুরোহিতের ঘরের সামনে, - স্যাক থেকে দুধের জার বার করে ওনার হাতে দিই। আমায় জিজ্ঞেস করেন, "পূজা চড়ানা হ্যায়?" বলি - না, শুধু দর্শন করব। হাতে চাবির গোছা নিয়ে হনহনিয়ে এগিয়ে যান মন্দিরের দিকে, আমি অনুসরণ করি। মন্দিরের দরজা খোলা হয়, দর্শন সারি। মায়ের জন্য একটু ফুল নিয়ে পূজারীকে কিছু দক্ষিণা এগিয়ে দিই। খুশি মুখে বলেন, "পরসাদি লেনা হ্যায় তো আ যাইয়ে মেরা রুমকে পাস।" একটু পরে আসছি জানিয়ে বসে পড়ি মন্দিরের চাতালে। মূল মন্দিরে উঠে আসার আগে বাঁদিকে পরপর ছোট ছোট মন্দিরের সারি, তারা যেন পাহাড়ের গায়ের ভেতরই গাঁথা! সবকটাই শিব মন্দির, ফুসা ঘাস ঝালর হয়ে ঝুলে আছে মন্দিরের মাথায় মাথায়। ছোট্ট চাতালের ওপর মূল মন্দির কিছুটা স্বতন্ত্র, তবে তার লাগোয়াই বনদেবতার মন্দির। চারদিক দেখতে দেখতেই কখন হারিয়ে ফেলি নিজেকে। নিস্তব্দ্ধ চরাচরে আমার অবস্থা তখন - "পলক নাহি নয়নে, হেরিনা কিছু ভুবনে/নিরখি শুধু অন্তরে সুন্দর বিরাজে।" কতক্ষণ ওভাবে বসেছিলাম খেয়াল নেই, সম্বিত ফিরল হেলিক্প্টারের বিকট আওয়াজে – উত্তরাখণ্ডের নতুন উৎপাত এটি। রাজার রাজস্বলোভ যেমন টাইগার হিলে রিসর্ট তৈরি করে, ওই একই লোভে ছাড়পত্র মেলে আকাশপথে পঞ্চকেদার দর্শনেরও! লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু! হোক না মৃত্যু, লাগুক না মৃত্যু মিছিল - সে সাধারণের বইতো নয়! মিছিলই যে রাজার বিনোদন, তাই উন্নয়ণের নামে এই অসভ্যতা চলছে, চলবেও!
পূজারীজির কাছে প্রসাদ নিয়ে যখন ফেরার পথ ধরি, মন ভারাক্রান্ত। সাত-পাঁচ ভাবনায় মন বিক্ষিপ্তও, তবু ফিরে চলা। পঞ্চগঙ্গার ঢালেই দেখা হয়ে যায় গতরাতের পরিচিত যাত্রীদের সঙ্গে, সামান্য কিছু কথা, আবার এগিয়ে যাওয়া স্ব-স্ব গন্তব্যে। পিতৃধারে পৌঁছে প্রিয়জন স্মরণ, মন্ত্রহীন পূজার্চনা। বড় ভালো লাগে, প্রিয়জনের আাত্মা শান্তি পেল কিনা জানিনা, আমার আত্মা শান্তি পায়। দূরের দুধসাদা পাহাড়ের কোলে তখন ধূমায়িত মেঘের ভীড়, যেন সেখানেও ধূপ-ধুনোর আরতি চলছে। প্রায় আড়াইটা নাগাদ পোঁছই পানারে। দুপুরের খাবার সাজিয়ে প্রকাশ তখন আমার অপেক্ষায়।
সে রাতে ঠাঁই হল পাকা ঘরের একটাতে। ১৬ কিমি হাঁটার ধকলে শুয়েও পড়লাম সাত তাড়াতাড়ি। একঘুমে সকাল - ভুতের নাচন দেখা তো দূরঅস্ত, সামান্য আলাপচারিতার সৌজন্যটুকু থেকেও কেন বঞ্চিত থেকে গেলাম তা তাঁদের প্রভু দেবাদিদেব-ই জানেন! দরজা খুলে বাইরে বেরিয়েও মন খারাপ করা দৃশ্য – চারপাশ কুয়াশাচ্ছন্ন। পানারের সবুজ আঁচল জুড়ে ঘোলাটে কুয়াশার বাড়াবাড়ি রকমের দাপাদাপি। কিছুটা হতাশ হয়েই তাড়াতাড়ি নিচে নেমে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম, তাই চা খেয়েই রওনা সাগরের পথে। অল্প নেমেই লিটি বুগিয়াল - যাওয়ার পথে দেওয়া প্রতিশ্রুতিমত হাজির হই কিষাণ সিং-এর অতিথিশালায়। চায়ের গেলাস হাতে গল্প জমে কিষাণের সাথে। গতকাল থেকেই যেটা মাথায় ঘুরছে সেটা জিজ্ঞেস করি ওকে, আচ্ছা এই যে এত পুণ্যার্থী আসেন তোমাদের কাছে, তাঁদের প্রয়োজনের জন্য তোমরা কোনো শৌচালয়ের ব্যাবস্থা করনি কেন? –পুরুষরা যদিও বা চালিয়ে নেয়, মহিলাদের সম্মানের কথাটা তোমাদের মনে হয়না? ও অসহায় ভাবে বলে, "বন বিভাগ নে ইধার তানাশাহি চালাতে হ্যায় দাদা, এক ভি কিলে ঠোকনেকে লিয়ে উনকি পারমিশন লেনা পড়তা!" একই কথা কাল প্রকাশের কাছেও শুনেছি, অবাক লাগে! যে পথে তীর্থযাত্রীদের আসার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি, সেই পথেই তাদের ন্যূনতম প্রয়োজনকেও অবজ্ঞা করছি! এর জন্য বোধহয় শুধুই দেশের দোহাই দেওয়া যায়না! অমরনাথের পথেই যে শয়ে শয়ে বায়ো-টয়লেটের ব্যাবস্থা দেখে এসেছি, তাহলে এখানে কিসের অসুবিধা! কিষাণকে বলি, ডি এম সাহেবকে বলনি কেন? এখন তো সরকার নিজের নিজের জেলায় শৌচালয় স্থাপনের জন্য ওনাদের পুরস্কৃত করছেন! ওর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, বলে, "আজ ডি এম সাব উপর আ রেহে হ্যায়, রাস্তেমেই আপসে ভেট হোগা, আপহি হামারে লিয়ে বোল্-দেনা দাদা!" ওকে আশ্বস্ত করে বিদায় নিই। অল্প যেতে না যেতেই চলে আসে ছোটুর দোকান। "আ গ্যয়া দাদা, চায় পিয়োগে?" - ছোটুর গলা। অনুচ্চারে বলি - তোকে না বলার সাধ্য যে আমার নেই! ঘাড় নেড়ে জানাই, - হ্যাঁ। চা বানানোর ফাঁকেই স্যাকের বোতল বার করে জল ভরে দেয় ছোটু। ফেরার সময় ওকে জড়িয়ে ধরে বলি - আবার এলে তোর কাছে একরাত কাটিয়ে যাব বেটা। চেনা পথ, তায় উৎরাই - তরতরিয়ে এগিয়ে চলি। পুঙ্গ বুগিয়ালে এসে দেখি লোকে লোকারণ্য, বুগিয়ালের সবুজ গালিচায় রঙবেরঙের মানুষের মেলা, কেউ খচ্চরের পিঠে কেউবা পায়ে হেঁটে। ভালো লাগে, ছোটু, কিষাণজী, প্রকাশ সবাই তো ওই জনমানবশূন্য প্রান্তরে বসে থাকে এদেরই প্রতীক্ষায়। সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করে এগিয়ে যাই ওঁদের উল্টো পথে। সাগর পৌঁছই যখন, সবে সাড়ে দশটা।
পরদিন দুপুরে অনুসূয়াদেবী মন্দির ঘুরে আসি, সাগরের রাস্তায় তখন মানুষের ছোট ছো জটলা। খোঁজ নিয়ে জানি, ডি.এম. সাহেব রুদ্রনাথ থেকে ফিরবেন, তাই সবাই অপেক্ষারত। আমারও কিছু কথা বলার আছে, তাই তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে ওনার অপেক্ষায় থাকি। এর মধ্যেই গোবিন্দজির সৌজন্যে অনেকে জেনেছেন আমি ডি.এম. সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে চাই, অনেকেই আমার কাছে আসছেন আর নিজেদের সমস্যা বলছেন। ওঁদের অনুরোধ, আমি যেন কথাগুলো সাহেবের সামনে তুলে ধরি! ওঁদের বোঝাই নিজেদের সমস্যা নিজেদেরই বলতে হয়, অন্যদের দিয়ে বলানো অসৌজন্য। দেখতে দেখতে প্রায় পড়ন্ত বিকেলে ডি.এম সাহেব আসেন। নেগিজির দোকানের সামনেই চেয়ার পেতে অভ্যর্থনা জানান হয়। ওঁর পাশেই একটা চেয়ার আমার জন্যও বরাদ্দ হল। আলাপপর্বের পরেই উনি জানতে চান আমি কি বলতে চাই। ওঁকে অনুরোধ করি আগে স্থানীয়দের কথা শুনুন, পরে আমি বলব। সেইমত কথা এগোয়, লক্ষ্য করি গ্রামের বেশীরভাগ মানুষের কথাই উনি তাচ্ছিল্যে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। তখন ওঁকে বলি, সুমন সাহেব (ততক্ষণে ওঁর নাম জেনেছি,- বিনোদ কুমার সুমন, ডি.এম, চামোলি) সত্যজিৎ রায়ের নাম শুনেছেন? বেশ উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠেন - হাঁ হাঁ। বলি, ওঁর একটা গল্প বলি শুনুন। চিত্রশিল্পী বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের ওপর একটা ডকুমেন্টরি করবার সময় শিল্পী সত্যজিৎ-কে এই কথাগুলো বলেছিলেন - "আমার মনে হয় অনেক জিনিস শিল্পী বা সমালোচকদের চেয়ে সাধারণ লোক তাদের সহজ বুদ্ধিতে বোঝে বেশি। আগে শান্তিনিকেতনে যখন আমরা বাইরে বসে ছবিটবি আঁকতুম, তখন সাঁওতালরা এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখত। একবার মনে আছে, একপাল মোষের ছবি এঁকেছি। কতগুলো সাঁওতাল মেয়ে এসেছে, তাদের একজন ছবিটা দেখে বলল – এতগুলো কেড়া(মোষ) দিলি, আর একটা বাচ্চা দিলি নাই? এই একটা কথায় ছবিটার একটা মস্ত ভুল ও ধরিয়ে দিল!" – সাহেব, এই গল্পটা আমি আপনাকে শোনালাম এঁদের জন্য, আপনি এঁদের কথাগুলো একটু ভালো করে শুনুন, দেখবেন অনেক কথাই ওঁরা ঠিক বলছে। অবাক হয়ে দেখলাম উনি আবার ধৈর্যসহকারে সবার কথা শুনলেন। সবশেষে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, "বোলিয়ে দাদা আপকে লিয়ে ম্যায় ক্যায়া কর সকতা হুঁ।" আমি রুদ্রনাথের পথের সমস্যাগুলো ওঁকে এক এক করে বলি। বলি - রাস্তায় মাইলফলক বসানোর কথা, জঙ্গলের রাস্তায় পানীয় জলের ব্যবস্থার কথা, অতিথিশালায় শৌচালয়ের কথা। সব শুনে বলেন, "হাম আপনি আঁখো সে সবকুছ দেখকে আয়া, আজই আট লাখ রুপিয়া স্যাংশান কিয়া হুঁ ড্রিঙ্কিং ওয়াটারকে লিয়ে। বাকি সারা কাম ভি হো জায়েগা ছে মাহিনে কি অন্দর। ম্যায় আপকো রিকোয়েস্ট কর রাহা হুঁ আগলে সাল ফির আনেকে লিয়ে।" বাকি সবাইও হই হই করে বলে ওঠেন - হাঁ সাব আ যাইয়ে ফির আগলে সাল। ওঁদের আন্তরিকতা মন ছুঁয়ে যায়, মুচকি হেসে জানাই, চেষ্টা করব।
পাহাড়ে আসি, তীর্থে ঘুরি, তবু মনে মনে এই কথাটাই জানি -'সবায় নিয়ে সবার মাঝে লুকিয়ে আছ তুমি / সেই তো আমার তুমি ।।'
সুমন্ত মিশ্র 'হরফ' নামে একটি প্রিপ্রেস ইউনিট চালান। হিমালয়ের আতিথ্যগ্রহণ ও ফুটবল খেলার দৃষ্টিসুখ অসীম তৃপ্তি দেয় তাঁকে। ভালোবাসেন রবিঠাকুরের গান শুনতে, প্রবন্ধ পড়তে, ছোটগাছকে বড় করতে, বেড়াতে আর নানারকমের মানুষের সহচর্য পেতে! ইন্টারনেটের দুনিয়ায় 'আমাদের ছুটি' কিছু সমমনস্ক মানুষের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ করে দেওয়ায় আনন্দিত।