তিনচুলেতে তিনদিন

মালবিকা ব্যানার্জ্জী


~ তিনচুলের আরও ছবি ~

গরম গরম আলুর পকোড়ায় কামড় বসাতে বসাতে কর্তা তারাভরা আকাশের তলায় দূরের পাহাড়ের গায়ে আলোমাখা এক অচিনপুরীর দিকে আঙুল তুলে দেখালেন, "ওই... ওই যে বাঁদিকে দূরে ঝলমল করছে..ওটা দার্জিলিং। আর পাশেরটা কালিম্পং। সামনে আলোকমালার মত যেটা দেখা যাচ্ছে,ওটা তিস্তা ভ্যালি। ওপরে টাইগার হিল,চটকপুর আর ডানদিকে ওপরে ডাউহিল!"
সামনের আবছায়া পাহাড়ের গায়ে যেন সহস্র জোনাকি জ্বলছে। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রয়েছি। এতবার পাহাড়ে গেছি;তবু,পাহাড় আমাকে মুগ্ধ করে আজও।

দার্জিলিং-এ দুরাত্তির কাটিয়ে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল তিনচুলে। দার্জিলিং থেকে দূরত্ব মাত্র বত্রিশ কিমি হলেও রাস্তা খুব একটা সুবিধের নয়। গাড়িগুলো যে কারণে এটুকু পথ আসতে আড়াই হাজার টাকার চেয়ে একপয়সা কম নিল না। যাইহোক,তাকদাকে পিছনে ফেলে আমরা যখন তিনচুলে তে এসে পৌছলাম ঘড়িতে তখন দুপুর একটা। 'হামরো গেস্টহাউস'-এ আমাদের বুকিং আগে থেকেই করে রাখা ছিল। গেস্টহাউসের মালিক সুরেনজী বাইরেই অপেক্ষা করছিলেন আমাদের জন্যে। দেখেই এক গাল হেসে অভ্যর্থনা জানালেন। ওঁর সঙ্গে ফোনে বহুবার কথা হয়েছিল এবং সেই থেকেই মানুষটি সম্পর্কে কেমন একটা ধারণা হয়ে গিয়েছিল। রাস্তা-লাগোয়া ছবির মত সুন্দর হোমস্টে - ফুলে ফুলে ভরা। রাস্তার উচ্চতা থেকে সিঁড়ি দিয়ে একটু নেমেই থাকবার ঘরগুলো। এখানের সব আস্তানাগুলো এই প্যাটার্নের। উনি আমাদের ঘর দেখিয়ে দিলেন। বিছানা, টেবিল, চেয়ার, টিভি, গিজার নিয়ে দারুণ সুন্দর কাঠের ঘর। ওপরে দুটি আর নীচে দুটি -মোট চারটি ঘর গেস্টহাউসে। ঘরের বারান্দা থেকেই পাহাড় দেখে দেখে সময় কাটিয়ে দেওয়া যায়।

ডাক পড়ল দুপুরের খাবারের। সুরেনজীকে আগে থেকেই কর্তা বলে রেখেছিলেন ওঁর অর্গানিক ফার্মের সবজি খাওয়ানোর জন্যে। কথামত তিনি সব ব্যবস্থা করেই রেখেছেন - গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত,ডাল,রাই শাক,নিজের খেতের সবজি,চিকেন,তিল দিয়ে বিনস ফ্রাই,দারুণ একটা আচার আর পাঁপড়। তখন,তাপমাত্রা নামতে শুরু করেছে;তার মধ্যে গরম গরম সুস্বাদু খাবার অমৃতসম লাগছিল। সুরেনজী নিজের হাতে আমাদের পরিবেশন করে খাওয়ালেন। দুপুরের খাবার খেয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালাম।

তিনচুলের গল্প শুরু করলেন সুরেনজী। তাকদা থেকে তিন কিমি উপরে ৫৮০০ ফুটে অবস্থিত এই গ্রামে উনুনের মত দেখতে তিনটি চূড়া ছিল, সেখান থেকেই এই নামকরণ। WWF (World Wide Fund for Nature)-এর উৎসাহে এখানকার গ্রামবাসীরা প্রায় সকলেই মডেল অর্গানিক ভিলেজ এবং ভিলেজ ট্যুরিজম শুরু করেছেন। সুরেনজী নিজেও পর্যটকদের কথা ভেবে জন্যে তৈরি করছেন অর্গানিক ফার্মিং , কমলালেবু, প্যাশন ফ্রুট, চায়ের বাগান, অ্যাংগলিং-এর ব্যবস্থা। জানালেন কাছেই একটা বৌদ্ধগুম্ফা আছে, যেখানে এক লামা দীর্ঘ সতেরো বছর ধরে ধ্যান করেছিলেন।

বিকেলে আমরা বেরিয়ে পড়লাম,পায়ে হেঁটে আশপাশটা একটু ঘুরে দেখবার জন্যে। রাস্তার দুপাশে দীর্ঘ পাইনের সারি সূর্যালোক প্রবেশে বাধা দেয়। জঙ্গল থেকে ভেসে আসছে ঝিঁ-ঝিঁ-র ডাক,সঙ্গে অচেনা বুনো ফুলের গন্ধ। ইতিউতি বনমুরগিরা দৌড়ে ঢুকে যাচ্ছে জঙ্গলে। সামনেই সেই বৌদ্ধগুম্ফাটি, নিভে আসা আলোয় যেন আরও রহস্যময় হয়ে উঠেছে। আলোআঁধারি পথ ধরে গুম্ফাতে পৌঁছালাম,সেখানে তখন সন্ধ্যের প্রার্থনা চলছে। গম্ভীর মন্ত্রধ্বনি ও দ্রিম দ্রিম বাদ্যধ্বনি এক অলৌকিক পরিবেশ তৈরি করেছে।
ফেরার পথে এক অচেনা সারমেয় বন্ধু হয়ে পুরো রাস্তা সঙ্গ দিল,যেন কতকালের চেনা। ঝরনার কুলু কুলু ধ্বনি শুনে খুঁজতে গিয়ে দেখি,আরে এতো পাইনবনের মধ্যে দিয়ে বাতাসের ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা। নেশার মতো ঝিমঝিমে।
সন্ধেবেলা গরম পকোড়া সহযোগে চা আর আড্ডা। রাতের ডিনার তাড়াতাড়ি সারলাম এবং মেনুতে যথারীতি সেই এলাহি ব্যাপার।

পরের দিন ভোরে দরজায় ঠক ঠক শব্দে ঘুম থেকে উঠে পড়লাম। দরজা খুলে দেখি সুরেনজী সূর্যোদয় দেখার জন্য ডাকছেন। একটা দারুণ সূর্যোদয়ের সাক্ষী থাকলাম।
আজ বেরোবো সাইট সিয়িং-এর জন্য। ন'টায় ব্রেকফাস্ট সেরে গাড়িতে উঠলাম। প্রথমেই গেলাম গুম্বাদাঁড়া ভিউ পয়েন্ট -সেখানে দিগন্ত জুড়ে সপার্ষদ তিনি - মাথা থেকে পা পর্যন্ত পুরোটা দেখা যাচ্ছে। কাঞ্চনজঙ্ঘার নিচেই নামচি শহরটি দেখা যাচ্ছে আবছা।


পরের গন্তব্য লামাহাট্টা। পাহাড়ের ধাপে পাইন আর রংবাহারি ফুলের সমারোহ এখানে। অনেকটা চড়াই ভেঙ্গে লামাহাট্টা পার্কের এক্কেবারে উপরের 'হোলি লেক'-এ এসে পৌঁছলাম। পার্কটি থেকেও 'স্লিপিং বুদ্ধ'কে পরিষ্কার দেখা গেল।


সেখান থেকে চললাম লাভার্স পয়েন্টে। এটি তিস্তা-রঙ্গিতের সঙ্গমস্থান। কথিত আছে,কোনও এক যুগল এখান থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মাহুতি দেয় নীচের চড়ায়। লাভার্স পয়েন্ট থেকে গাড়ি করে নেমে এলাম তিস্তার পাড়ে। একদল বাচ্চা হৈ-হৈ করে পিকনিক করছে। ইতিউতি মাছ ধরার যন্ত্রপাতি লাগানো। কয়েকটা তাঁবুও নজরে এল। নীলচে সবুজ তিস্তাকে ছুঁয়ে দেখলাম জলে নেমে। ফেরার পথে রাস্তায় পেশক চা বাগান দেখে নিলাম।

আমাদের শেষ গন্তব্য ছিল বড়ামাঙ্গওয়ার অরেঞ্জ গার্ডেন। তিরিশ টাকা মাথাপিছু টিকিট কেটে গাইড সহযোগে গার্ডেনে ঢোকা যায়। এসময় বাগান উপচে পড়ছে কমলালেবুর ভারে। নিচে একটি জুস ফ্যাক্টরিও আছে। বেলা পড়ে আসছে,সাথে পেট চুঁইচুঁই। এবার ফেরার পালা। তিনচুলেতে ফিরে দেখলাম সুরেনজী হাসিমুখে বসে রয়েছেন লাঞ্চ রেডি করে। এখানে ঝুপ করে সন্ধে নেমে আসে। সন্ধ্যের পর বিশেষ কিছু করার থাকে না। কটেজের লনে বসে সুরেনজীর সাথে অনেকক্ষণ গল্প করলাম। সে গল্পে উঠে এল ওখানকার আপাত সাদামাটা মানুষগুলোর জীবনযাপন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিংবা সুরেনজীর ইকোট্যুরিজমের প্রেরণার উৎস। রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম। পরের দিন ফেরার টিকিট বাগডোগরা থেকে ১০.৩০ এর ফ্লাইটে। ভোর ছটাতেই গাড়ি চলে আসলো। এত সকালেও ভাবিজী আমাদের জন্যে যত্ন করে পুরি-সবজি বানিয়ে দিয়েছেন। সুরেনজীর মা ও স্ত্রী খাদা পড়িয়ে বিদায় দিলেন। বারবার বললেন, আবার যেন আসি। একরাশ মনখারাপ নিয়ে গাড়িতে উঠলাম। আবার সেই ইট-কাঠ কংক্রিটের জঙ্গলে ফেরা।

ফেরার পথে দেখলাম অপূর্ব সুন্দর তিনটি চা-বাগান -'রংলি -রংলিয়ট', 'গিয়েল' আর 'তিস্তা ভ্যালি'। যতদূর চোখ যায় মনমাতানো সবুজের গালিচা বিছানো আর নীল পাহাড়ের বুকে আলগোছে আটকে থাকা মেঘের দল। মনটা ভারি হয়ে আসছে। আসলে,তিনচুলের উষ্ণতা তখন জড়িয়ে ধরেছে মনের প্রতিটি খাঁজে আর তাই গাল বেয়ে নামছে নোনা ধারা।

~ তিনচুলের আরও ছবি ~

কর্পোরেট বিজ্ঞান গবেষক মালবিকা ব্যানার্জ্জী নেশায় ভ্রামণিক। ভালোবাসেন বেড়িয়ে এসে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় সেইসব ভ্রমণকাহিনি লিখতে।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher