বেড়ানোর ভাল লাগার মুহূর্তগুলো সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিতে ইচ্ছে করে, অথচ দীর্ঘ ভ্রমণ কাহিনি লেখার সময় নেই? বেড়িয়ে এসে আপনার অভিজ্ঞতাগুলো যেমনভাবে গল্প করে বলেন কাছের মানুষদের - ঠিক তেমনি করেই সেই কথাগুলো ছোট্ট করে লিখে পাঠিয়ে দিন ছুটির আড্ডায়। লেখা পাঠানোর জন্য দেখুন এখানে। লেখা পাঠাতে কোনরকম অসুবিধা হলে ই-মেল করুন - admin@amaderchhuti.com অথবা amaderchhuti@gmail.com -এ।
ইচ্ছাপূরণের মুলকারখায়
গৌতম দে
এবারের ঘুরতে যাওয়াটা প্রথম থেকেই একটু অন্যরকম করার ইচ্ছা ছিল। অন্যরকম মানে মানুষের ভিড় থেকে দূরে প্রকৃতির কোলে কয়েকটা দিন কাটানো। ইন্টারনেটের সৌজন্যে এরকম একটা জায়গার খোঁজ পাওয়াও গেল। মুলকারখা লেক, একটা ছোট্ট সরোবর এবং সেটা এতটাই ছোট যে ম্যাপ ঘেঁটে খুব কষ্ট করে খুঁজে বের করতে হয়। জায়গাটা সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান অতি সীমিত। তবে এটুকু জানা গেল যে মুলকারখা যেতে গেলে ট্রেক করে যেতে হবে। দুদিনের ট্রেকরাস্তার বেশিরভাগটাই জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। যথাসময়ে দার্জিলিং মেলের টিকিট কেটে,ব্যাগবোগালি নিয়ে আমরা চারজন রওনা হয়ে পড়লাম।
ভারতীয় রেলের তথাকথিত মর্যাদা বজায় রেখে ট্রেন প্রায় এক ঘন্টা লেটে নিউজলপাইগুড়ি পৌঁছাল। স্টেশন থেকে বেরিয়ে একটা অটো ভাড়া করে SNT বাসস্ট্যান্ড।সকাল সাড়ে নটা। বাস যখন ছাড়ল, শিলিগুড়িতে হালকা ঠান্ডার অনুভূতি। সেবক কালীবাড়ি পর্যন্ত যথেষ্ট ট্রাফিক জ্যাম ঠেলতে ঠেলতে বাস চলছে। রাস্তা বেজায় খারাপ। এইভাবে প্রায় আড়াইঘন্টা পর সিকিমের সীমানা রংপো পৌঁছানো গেল। এখানে বলে রাখা ভালো, ট্যুর বুকিং করার সময় কেউ চাইলে লিংসে পর্যন্ত গাড়িও বুক করা যায়। রংপোতে লাঞ্চ সেরে একটা ছোটো গাড়ি ভাড়া করে চলে এলাম লিংসে।এখানে আবার আমরা প্রবেশ করলাম পশ্চিমবঙ্গে।
লিংসের কথা বলতে গেলে বলতে হয় প্রকৃতির মাঝে কয়েকঘর মানুষের বাস। যারা সত্যি প্রকৃতিকে ছুঁতে চায় তাদের জন্য আদর্শ গন্তব্য। আমাদের ওয়েলকামসং-টা পাখিদের কাকলিতেই খুঁজে পেলাম যেন। এখানে সবজায়গাতেই হোমস্টেতে থাকা। যাঁর বাড়িতে আমরা অথিতি সেই ললিতজী আবার জোর করে আমাদের লাঞ্চ করালেন। এরপর বেরোনো হল একটা ছোট ঝরনা দেখতে। জঙ্গলের মাঝবরাবর রাস্তা। প্রায় বুকসমান উঁচু এলাচ গাছের বনের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছলাম ঝরনার কাছে। কিছুক্ষণ ঝরনার পাশে কাটানোর পর ফিরে এলাম বাড়ি। ওদিকে অনেকক্ষণ ধরেই চলছে আকাশে মেঘেদের ডাকাডাকি। বৃষ্টি হতোই,হতেই হত। কিন্তু যেটা হল তার অভিজ্ঞতা জীবনেও ভোলার না! ভীষণ জোরে শিলাবৃষ্টি শুরু হল। এত শিল পড়ছিল, মনে হচ্ছিল যেন টিনের ছাদ ফুটো হয়ে যাবে। প্রায় পনেরো মিনিট শিল পরার পর সব শান্ত, আস্তে আস্তে ঠান্ডা নামছে পাহাড়ে। শান্ত পাহাড় কেমনভাবে ঘুমের দেশে হারিয়ে যায়, দেখিয়ে দিল।
পরদিন সকালে ব্রেকফাস্টে মোমো। সেরেই হাঁটা শুরু হল ঝুসিং-এর উদ্দেশ্যে। ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে আঁকাবাঁকা পাথুরে রাস্তা। দমের ঘাটতির জন্য থেমে থেমে প্রাকৃতিক শোভা উপভোগ করতে করতে হাঁটা। তিনঘন্টা হাঁটার পর পৌঁছে গেলাম ঝুসিং। জঙ্গলের মাঝখানে একটু ফাঁকা জায়গা আর তার মাঝখানে কয়েকটা কাঠের ঘর। ছবির মত সুন্দর। এখানেও দারুণ আপ্যায়ন পেলাম।
দেখলাম আগের দিনের শিলাবৃষ্টি কী ক্ষতি করেছে ফসলের! একটা অলস সময় কাটানো, কিছু পাহাড়ি ফুলের ছবি তোলা, তারপর গল্প করতে করতেই সন্ধ্যা নামল। রাত্রে খাওয়া-দাওয়া সেরে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়া হল।
পরদিন সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট সেরে মুলকারখার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া আবার। এখানকার জঙ্গল আরো ঘন আর রাস্তা আরো চড়াই। তাই স্বাভাবিকভাবেই যাত্রাপথে বিরতির সংখ্যা এবং সময় দুটোই বাড়তে লাগল। পুরো রাস্তাটাই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হলেও মাঝেমাঝে দু-একটা করে ঘরবাড়ি চোখে পড়ছিল। বাড়িগুলো দেখে শুধু মনে হচ্ছিল এই পান্ডববর্জিত জায়গায় কী করে মানুষগুলো থাকে! কী যে এদের জীবিকা,কী করে সময় কাটে,ভেবে পাচ্ছিলাম না! এখানে প্রত্যেক বাড়ির সামনে ছোটখাটো চাষ হয়। এলাচ,পেঁয়াজ,ভুট্টা এইসব ফসল।বুঝলাম দিনআনা-দিনখাওয়া মানুষগুলোর চাষবাস আর সামান্য কিছু পশুপালনই রুটি-রুজি। প্রাণান্তকর চড়াই রাস্তায় ছয় কিলোমিটার হেঁটে মুলকারখা গ্রামে পৌঁছানো গেল। যদিও রাস্তাটা আমার কাছে ষাট কিলোমিটার মনে হয়েছিল!
মুলকারখা গ্রামটা ঠিক সাত থেকে দশটা বাড়ি নিয়ে। খুব সুন্দর গ্রাম। রাত্রে একটা ছোট বনফায়ার-এর ব্যবস্থা করা হল। গল্প করে, মুরগির রোস্ট খেয়ে কখন যে সময় কেটে গেল। ঘড়ির কাঁটাকে কে আর আটকাতে পারে! পরদিন সকালবেলা তিন কিলোমিটার হেঁটে মুলকারখা লেকের কাছে পৌঁছলাম। বড় বড় পাইনগাছে ঘেরা লেকটা হাল্কা ঠান্ডা হাওয়ায় আমাদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। আকাশ পরিষ্কার থাকলে কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বতশ্রেণীর প্রতিবিম্ব দেখা যায় সরোবরের জলে। যদিও আমরা যখন পৌঁছলাম তখন আকাশের মুখ ভার। লেকের জলে চোখে পড়ল অন্য পাহাড়ের উপস্থিতি। এখানে নাকি যা মনস্কামনা করা যায় তাই পাওয়া যায়।স্থানীয় লোকেরা এটাকে মনোকামনা লেক বলে। ৭৩০০ ফিট উচ্চতায় এই লেক। শীতের বরফগলা জলই লেকের উৎস। লেক নিয়ে কিছু গল্পকথা আছে। যেমন লেকের জলে নাকি কোনো পাতা পড়ে না। পড়লেই পাখিরা ছোঁ মেরে নিয়ে যায়, পরিষ্কার রাখে লেকের জল।
লেকের ধার ধরে সারসার লাল-নীল-হলদে-সবুজ পতাকা। তাতে লেখা আছে শান্তির বাণী, হাওয়ায়-হাওয়ায় যা নাকি ছড়িয়ে যাবে পাহাড়ের আনাচে-কানাচে।
লেকের পাশে বসে থাকলে ঘড়ির কাঁটা সত্যি চলতে চায় না, তবু চলতে তো হয়ই। তাই ছবি তুলে আবার ফিরে চলা গ্রামের উদ্দেশ্যে। ব্রেকফাস্ট সেরে হাড়ভাঙা উৎরাই পেরিয়ে নামতে হল পিতামচেন গ্রাম পর্যন্ত। সেখান থেকে গাড়ি ধরে নেমে চলা রংপোর পথে। এবার যে ঘরে ফেরার গান গাইতে হবে।
কী দিয়ে গেলাম জানিনা। তবে অনেক কিছু নিয়ে গেলাম। ওই যে কী একটা কথা আছে না "LEAVE NOTHING BUT FOOTPRINTS AND TAKE NOTHING BUT MEMORIES"। চোখে ভরে নিয়ে গেলাম মুলকারখার সৌন্দর্য, সব কি আর ক্যামেরায় ধরা যায়! আর কী রেখে গেলাম? রেখে গেলাম মনের অনেকগুলো ইচ্ছে, তার মধ্যে যেমন একটা ছিল এখানে আবার ফিরে আসার কথা।
নেটওয়ার্ক ও সিকিউরিটি প্রফেশনাল গৌতম দে বর্তমানে লিনডে-তে কর্মরত। স্বল্পপরিচিত জায়গায় ঘুরে বেড়ানোটাই একটা নেশা। ভালোবাসেন ট্রেক করতে ও মোটরসাইকেলে করে ঘুরে বেড়াতে।
মুকুটমণিপুরে
অংশুমান পাত্র
হাওড়া স্টেশন থেকে বাঁকুড়া প্রায় ২৩১ কিলোমিটার। আরামপ্রিয় যাত্রা করতে হলে ট্রেনে করে যাওয়াই শ্রেয়। বাঁকুড়ার একটি ছোট্ট শহর মুকুটমণিপুর। কিন্তু ছোট্ট এই শহরটি পর্যটকদের সম্মোহিত করে রাখে তার অভাবনীয় প্রকৃতির মাধুর্যে আর বিখ্যাত টেরাকোটার শিল্পকলায়। আমার এই ভ্রমণকাহিনি মুকুটমণিপুর বাঁধের পাড়ে বসে দিগন্তবিস্তৃত জলের কোলাহল উপভোগ করতে করতে লেখা।
বাঁকুড়া স্টেশন থেকে ৫৪ কিলোমিটার দূরে মুকুটমণিপুর। বাসে দিব্যি পাকা রাস্তায় বনশোভা উপভোগ করতে করতে পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। সময়টা শীতকাল আর আত্মীয়ের বাড়ির সুবাদে থাকার সংস্থান হয়ে গেল। ঠিক করে নিলাম মুকুটমণিপুর ড্যাম আর সংলগ্ন অতি প্রাচীন অম্বিকানগর রাজবাড়ি পরিদর্শন করব। সকালে উঠে স্নান সেরে বেরিয়ে পড়লাম প্রথমে মুকুটমণিপুর ড্যামের উদ্দেশ্যে। আঁকাবাঁকা রাস্তায় পাখির কলতান শুনতে শুনতে পৌঁছে গেলাম একেবারে ড্যামের কাছে।
একপাশে গভীর পাথুরে খাদ অন্যপাশে নদীর একাংশ। যেতে যেতে প্রথমে কংসাবতী ভবন পড়ে, আর তারপর পাশে সার দিয়ে খাবারের দোকান। চেখে দেখতে পারেন গ্রামীণ খাবারের স্বাদ। মুকুটমণিপুর ঢোকার রাস্তায় সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে অনেকগুলো হোটেল হয়েছে। তবু ছুটির মরসুমে আগে থেকে হোটেল বুক করে রাখতে পারলে সুবিধা। কিছুটা এগোলে ড্যামের নিচে তৈরি হয়েছে নানা দোকান,টেরাকোটা সামগ্রী থেকে ঘরসাজানোর নানা উপকরণ সবই পেয়ে যাবেন এখানে। টেরাকোটার জিনিস বলতে বাঁকুড়াখ্যাত লালমাটির তৈরি হাতি ঘোড়া ইত্যাদি কী নেই! ড্যামের ওপরের রাস্তায় চেকপোস্টের কাছে আসতে চোখে পড়ল অনেকগুলি অটো আর মোটরচালিত গাড়ি যাকে ঠেলাগাড়ির এক অভিনব রূপান্তর বলা যেতেই পারে। অটোভাড়া তিন-চারশো টাকার মধ্যেই,আর মোটরচালিত গাড়ি নেবে দেড়শো থেকে দুশো টাকা, এতে আপনাকে সবকটি দর্শনীয় স্থান ঘুরিয়ে দেখাবে। প্রথমেই গাড়ি চলল সঙ্গমস্থলের উদ্দেশে - কুমারী আর কংসাবতী নদীর মিলন। নৌকায় করে পাঁচশো টাকায় সঙ্গমটি কাছ থেকে দেখবেন আর উপরি পাওনা ডিয়ার পার্ক। নদীর জলে সূর্যকিরণ পড়ে তার আলোকছটায় অপরূপ লাগছিল।
চললাম বিখ্যাত পরেশনাথ মন্দিরের দিকে। এই মন্দির নাকি হাজার বছরের পুরোনো,আগে ছিল অনেকটা নীচে সমতলে, কিন্তু প্রকৃতির খেয়ালে উঠে এসেছে ওপরে। সিঁড়ি পেরিয়ে ওপরে উঠে কথা হচ্ছিল মন্দিরের পুরোহিতের সঙ্গে। প্রতিদিন তিনি অনেকটা পথ অতিক্রম করে আসেন দেবতার সেবায়। আহা প্রকৃতির কী অপরূপ শোভা! মন্দিরের কাছে এক বড় পাথরে উঠে দেখছিলাম একপাশে সুতোর মতো নদীটা আর অপরপ্রান্তে পাহাড় আর সবুজের সমারোহ। শীতের সূর্যের ঝলমলানিতে মনে হচ্ছিল আসাটা সত্যি সার্থক। মন্দিরের নিচে ছোটখাটো দোকান টুকিটাকি জিনিস কেনার জন্য।
এর পরের গন্তব্য মুসাফিরানা নেচার পার্ক - কয়েকবছর আগেই তৈরি হয়েছে পাহাড়ের ওপরে। পুরো মুসাফিরানার গায়ে চিত্রিত আর বর্ণিত হয়েছে বাঁকুড়ার দর্শনীয় স্থানগুলি। দশ টাকা প্রবেশমূল্য দিয়ে ঢুকে পড়লাম। ছাতার মতো বসার জায়গা আর সামনে বিস্তৃত নদী। এটি একটি থিম পার্ক, আনাচে কানাচে বাংলা হরফ ক খ গ-এর বাহার। পরিবার নিয়ে নির্জনে সময় কাটানোর এর থেকে ভালো জায়গা আর হয়না।
মুকুটমণিপুর দর্শন সেরে গাড়ি চলল অম্বিকানগরের উদ্দেশে। মাঝে গোড়াবাড়ি পেরোলেই অম্বিকানগর। নেমেই প্রথমে চললাম অম্বিকানগর মন্দিরের দিকে,মন্দির আর রাজবাড়ির ইতিবৃত্ত জানার কৌতূহল ছিল। মন্দির পরিদর্শনের পর হেঁটেই চললাম রাজবাড়ির উদ্দেশে। রাজবাড়ির সদস্যদের আমার আসার কারণ জানাতে তাঁরা আপ্যায়ন করে নিয়ে গেলেন সেই ঘরে যেখানে রয়েছে পুর্বপুরুষদের ছবি আর বংশলিপি। জানতে পারলাম এই বংশের দেবী মুকুটমণির নামানুসারে হয়েছে মুকুটমণিপুরের নাম আর দেবী অম্বিকার নামানুসারে তৈরী হয়েছে অম্বিকানগর। কেউ বিপ্লবী আবার কেউবা প্রখ্যাত কারুশিল্পী ছিলেন এই বংশে। আসল রাজবাড়ির অংশটা চাক্ষুষ দেখলাম, যদিও অনেকটাই ভঙ্গুর। সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফিরে এলাম।
ডঃ অংশুমান পাত্র রৌরকেল্লার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির মেটালার্জিকাল ও মেটেরিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে অধ্যাপনা করেন। অবসর সময়ে নেশা ভ্রমণ।