রহস্যময় ডাইনোসর বিচ

মার্জিয়া লিপি


ইচ্ছেটা অনেকদিন ধরেই ছিল – ২০১৮-এর অক্টোবরে মালয়েশিয়া আর ইন্দোনেশিয়ার বালি ভ্রমণের জন্য মালিন্দো এয়ারলাইনসে টিকিট বুকিং করলাম। ক্রিসমাসের ছুটির পর বারো দিনের একটা ভ্রমণসূচির খসড়াও করে ফেললাম। পরিকল্পনার প্রথম চারদিন মালয়েশিয়া আর পরের আটদিন ছিল বালির জন্য নির্ধারিত। শুরুতে ভ্রমণসঙ্গী ছিল সাতজন, পরবর্তীতে বেড়ে সে সংখ্যা দাঁড়ায় দশজনে। সর্বকনিষ্ঠ সদস্য দ্রাবিড়ের বয়স সাড়ে চার আর বয়োজ্যেষ্ঠ বিশ্বজিৎ ভাদুড়ী দাদার বয়স চুয়ান্ন। সহকর্মী রহুল ভাই এয়ার টিকিট কিনেও শেষ পর্যন্ত আর অফিসের কাজের জন্য যোগ দিতে পারলেন না।

ভ্রমণসূচিতে স্থির হল ৩১ ডিসেম্বরে বালির কুটা বিচের বিখ্যাত আতসবাজি দেখব। বালি মূলত: ইন্দোনেশিয়ার একটা দ্বীপরাজ্য। আর ইন্দোনেশিয়া পৃথিবীর বৃহত্তম দ্বীপের দেশগুলোর অন্যতম। তেরোহাজারের বেশি দ্বীপ জীববৈচিত্র্য আর সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে অনন্য দেশটি। বিখ্যাত সবচেয়ে বড় ফুল রাফলেশিয়া অ্যারনোল্ডি আর গ্রেটার বার্ডস অব প্যারাডাইসের জন্য।

ইন্দোনেশিয়ার উৎপত্তি গ্রীকভাষায় 'ইন্দোস' আর 'নেসস' থেকে যার অর্থ ইন্ডিয়ান আইল্যান্ড। প্যাসিফিক রিং অব ফায়ার-এ অবস্থিত দেশটির মাটি ভূগাঠনিক ভাবে খুব অস্থির। চারশোটি আগ্নেয়গিরি রয়েছে ইন্দোনেশিয়ায় -যার মধ্যে একশো তিরিশটিই সক্রিয়। গত কয়েকবছরে আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ আর সুনামির কারণে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এদেশটি বার বার সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতি ঘটেছে বিভিন্ন পর্যায়ে অনেক। বছরে দুটি ঋতু দেখা যায়- বর্ষা এবং শুষ্ক। বিষুবরেখা বরাবরে অবস্থিত দেশটির তাপমাত্রা খুব বেশি উষ্ণ বা শীতল নয়। চৌত্রিশটি প্রদেশ রয়েছে ইন্দোনেশিয়ায় - যার মধ্যে জাভা, বালি এবং লুম্বক আয়তনের দিক থেকে বড়।

বালি বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রবাল দ্বীপ - নুসা পেনিডা, নুসা লেম্বানগান, নুসা কেনিঙ্গন নিয়ে গঠিত। পাশেই রয়েছে লুম্বক প্রদেশের বিখ্যাত আরো কিছু দ্বীপ। এসব দ্বীপের প্রত্যেকটিতে রয়েছে নিজস্ব স্বতন্ত্র সংস্কৃতি আর বৈশিষ্ট্য। দিনে-রাতে কমপক্ষে দ্বীপগুলোর তিনবার এসব প্রবাল দ্বীপের সৌন্দর্য আর বৈশিষ্ট্য বদলে যায়। সূর্যোদয়ের পর স্নিগ্ধ আর রাতের আলো-আঁধারের নীরবতায় দ্বীপরাজ্য যেন সৌন্দর্যের ভিন্ন পসরায় নিজেকে সাজায়। বালি ভ্রমণে অধিকাংশ পর্যটকই ভ্রমণের তালিকায় দ্বীপ - নুসা লেম্বানগান, নুসা পেনিডা এবং গিলি ট্রায়নগানকে অন্তর্ভূক্ত করে।

আমাদেরও আটদিনের বালি পর্বের ভ্রমণসূচিতে ছিল - কুটা আর উবুদের বিভিন্ন দর্শনীয় মন্দির - তানাহলট, ঊলুয়াতু, নুসা দুয়া সমুদ্র সৈকত, ড্রিম বিচ, পাদাংপাদাং সিক্রেট সমুদ্র সৈকত, জিমবারান বিচে সামুদ্রিক মাছে ক্যান্ডেল ডিনার, থার্টিফাস্ট নাইটে কুটা বিচের আতসবাজি, উবুদের রাইস টেরেস, আর্ট গ্যালারি, কফি প্ল্যানটেশন, ট্রারাঙ্গান জলপ্রপাত, জীবন্ত আগ্নেয়গিরি - কিন্তামানি, মাংকি ফরেস্ট, বার্ড জু ইত্যাদি। দ্বীপের তালিকায় রেখেছিলাম নুসা লেম্বানগান, নুসা কেনিঙ্গন, নুসা পেনিডা এবং গিলি ট্রায়নগানকে।

ভ্রমণের শুরুতে খুব উত্তেজনায় ছিলাম বালির কোরালদ্বীপ ভ্রমণ এবং পানির নীচের বিভিন্ন অ্যাকটিভিটি নিয়ে।

স্কুবা ড্রাইভিং এবং স্নর্কেলিং-এর জন্য বালি এবং লুম্বকের গিলি দ্বীপগুলো খুব বিখ্যাত। পানির নীচের জীববৈচিত্র্য অসাধারণ বর্ণিল ও অন্য রকম বিস্ময়কর। ইন্দোনেশিয়া ভ্রমণের ষষ্ঠদিনে আমরা রওনা দেই নুসা লেম্বানগান থেকে নুসা পেনিডায়। নুসা পেনিডা দ্বীপে যে কয়টি আকর্ষণীয় স্থান রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম ডাইনোসর বিচ বা কেলিংকিং বিচ। নীলাভ-সবুজ পানি, সোনালি ঝকঝকে রোদ আর মাখন রঙের সাদা সৈকতে ডাইনোসর আকৃতির বিচটি বৈশিষ্ট্যে স্বতন্ত্র ও অনন্য।

নুসা লেম্বানগানে আসতে হয় কুটার সেনোর বিচ থেকে ফাস্টবোটে। সৈকতের একেবারে কিনারায় অবস্থিত - স্বপ্নের মত সুন্দর একটা রিসর্ট - নুসা লেম্বানগানের মহাগিরি। প্রবালদ্বীপের কাচের মত স্বচ্ছ নীল পানি আর মহাগিরির সুইমিং পুল। রাত্রিযাপন শেষে ভ্রমণসঙ্গীদের ঘুমের মধ্যে রেখেই আমি আর সূর্য একটা মোটরবাইক নিয়ে রওনা দিলাম নুসা পেনিডার উদ্দেশ্যে। সেদিন ছিল বালিতে 'গালুনগন' উৎসব। প্রতি ছয়মাস পর পূর্ণিমা তিথিতে 'গালুনগন' উৎসব পালিত হয়। রঙ-বেরঙের বিভিন্ন পোশাক পড়ে মাথায় পূজার নৈবেদ্য নিয়ে ভিড় করে ছোট-বড় সকলেই বিভিন্ন মন্দিরে যান। বছরকয়েক ধরে এই দ্বীপটি অন্যরকম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে পর্যটকদের কাছে পরিচিতি পেয়েছে। মোটরবাইকে পঁয়তাল্লিশ মিনিট যাওয়ার পর ইয়েলো ব্রিজের নিচে টিকিটকাউন্টারের পাশে বাইক পার্ক করে স্পিডবোটের টিকিট কিনে নিলাম লাল রঙের এক লক্ষ রুপাইয়া দিয়ে যা বাংলাদেশের টাকায় মূল্যমান ছয় শত। মোটরবাইকের নম্বরসহ একটা ফোটোগ্রাফ তুলে নিলাম যাতে ফিরতি পথে একই রঙের কালো বাইকের সমুদ্র থেকে নিজেদের বাইকটা খুঁজে পেতে সুবিধা হয়। রওনা করলাম স্পিডবোটে - সবুজ রঙের পানির বুক চিরে রাজহংসীর মত। আধঘন্টার জলপথ পাড়ির শেষে পেলোবন হারবারে নেমে পুনরায় আরেকটি বাইক ভাড়া নিলাম ভরপেট পেট্রোলসহ সত্তরহাজার রুপাইয়ার বিনিময়ে। অগ্রিম টাকা শোধ করে রওনা দেওয়ার পূর্বে মোটরবাইকের মালিক জানালেন ফেরার পর তাঁকে না পেলে অপেক্ষার প্রয়োজন নেই। চাবি মোটরসাইকেলে রেখে চলে গেলেই হবে। সেখানে নাকি এরকমই রেওয়াজ। একথা শুনে মনে মনে তুলনা করলাম -জাতিগত ভাবে আমাদের দৈন্যদশার কথা।

আমরা চলছি পাহাড়ি উঁচু-নীচু পথ বেয়ে। কিছুদূর পরপর আবার পিচঢালা রাস্তা, অনেকটা আমাদের দেশের রাঙামাটি যাওয়ার রাস্তার মত। পথে অনেক বিদেশি ও বিদেশিনীকে দেখলাম স্কুটি এবং বাইক চালাচ্ছে। স্মার্টফোনে জিপিএস দেখে দেখে পথ চলেছি। মাঝেমধ্যে রাস্তা ভুল করে স্থানীয় পথচারীদের জিজ্ঞেস করে আবারও সঠিক পথের সন্ধান মিলছে। প্রায় ঘন্টাখানেক মোটরবাইকে চলার পর রাস্তা ভুলে সামনে চলে গিয়ে পুনরায় তীরচিহ্নিত সঠিক পথের সন্ধান খুঁজে পাই। কিছুদূর যাওয়ার পর রাস্তা কোথাও কোথায় বেশ ভাঙা। স্থানীয় মানুষজন খুবই সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাবের। পাহাড়ি রাস্তায় যদি বাইক চালানোর পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকে তবে হঠাৎ করে অ্যাডভেঞ্চার না করাই ভালো। প্রায় দেড়ঘণ্টা টানা গাড়ি চলার পর দেখা মিলল নুসা পেনিডার অন্যতম আকর্ষণীয় ডাইনোসর বিচ বা কেলিংকিং বিচের পার্কিং এলাকার। প্রবেশের জন্য টিকিট কিনত হল পঞ্চাশহাজার রুপাইয়া দিয়ে। মোটরবাইক রেখে অন্যদের অনুসরণ করে কিছু দূর যাওয়ার পরই চোখের সামনে ভারত মহাসাগরের এক অপরূপ রূপের দেখা মিলল।

সবুজ গাছপালা পেরিয়ে সাদা সৈকতের পর দিগন্তজোড়া স্বচ্ছ নীলাভ সবুজ রঙের সমুদ্র। অনেক পর্যটক এখানে এসে এর উপরিভাগের সৌন্দর্য দেখে চলে আসেন কিন্তু বালি ভ্রমণের প্রথম থেকেই আমার খুব ইচ্ছা ছিল ডাইনোসর বিচ-এর সিক্রেট পয়েন্টে যাওয়ার। উপরিভাগ থেকে সৌন্দর্য দেখে আমরা নিজেদেরকে আর থামাতে পারলাম না।

পাহাড় আর সমুদ্রের দুর্গম প্রকৃতির বন্য সৌন্দর্য বড়ই মুগ্ধ করে আমাকে।

নুসা পেনিডার কেলিংকিং বিচের উপরিভাগে পর্যটকদের জটলা। স্মার্টফোন আর ক্যামেরায় বিভিন্নভাবে ছবি তুলে স্মৃতিতে রেখে দিচ্ছে রহস্যময় সৈকতটিকে। সারা গায়ে উল্কিআঁকা ব্রাজিলের এক বিখ্যাত মডেলের ফোটোশ্যুট চোখে পড়ল। পায়ে হেঁটে নীচে নামার সময় কেউ বলছে চল্লিশ-পঞ্চাশ মিনিট, কেউবা বলছে আরো কিছু বেশি সময় লাগবে। বারবার আমি সূর্যের মুখের দিকে তাকাচ্ছিলাম। একপর্যায়ে তাকিয়ে বললাম, ভয়ের কি আছে? আমাদের তো একদিনে চোদ্দ ঘন্টা পাহাড়ে হাঁটার অভিজ্ঞতা রয়েছে; এ আর এমনকী?

এভাবে কোনোরকম প্রস্তুতি ছাড়াই সিক্রেট বিচের জন্য রওনা হলাম। পাহাড় বেয়ে কিছু দূর নীচে নামার পর গাছপালার মাঝখান দিয়ে ডাইনোসর বিচে যাওয়ার জন্য পথ পেয়ে গেলাম। খানিক পথ অতিক্রম করে দেখতে দেখতে ডাইনোসরের মাথার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম।

প্রথমে একটু সহজই মনে হয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয় ধাপে যাওয়ার পরই আসল রহস্যের শুরু হল। খুবই সরু পাহাড়ি পথ। দু'পাশ একদম ফাঁকা। শুধু কিছু চিকন চিকন লাঠি ও বাঁশ দিয়ে সিঁড়ির হাতলের মতো করে বানানো। বিভিন্ন উচ্চতার এলেবেলে সিঁড়ি। মনে হলো ভুটানে টাইগার নেস্টে যাওয়ার সময় ওপরে উঠে তেরশো সিঁড়ি অতিক্রম করেছিলাম কিন্তু এবারের অভিজ্ঞতা একেবারে ভিন্ন। সরু কাঠ আর বাঁশ ধরেই সবাইকে নীচে নামতে হচ্ছে, পাথরের খাঁজে খাঁজে কোথাও একটু প্রশস্ত পথ, কোথাওবা সরু পথ। একসঙ্গে দু-তিনজন ওঠানামা করা যায় না। দাঁড়িয়ে অন্যকে পাশ দিতে হয়। ট্রেকিং-এর সময় সঙ্গে করে খাওয়ার সেলাইন,পানি ও গ্লুকোজ নিয়ে যেতে হয়। কোরাল, পাথর, বালি আর বাতাসে আর্দ্রতার জন্য প্রচুর ঘাম হয়। শরীর থেকে লবণ বের হয়ে রক্তের চাপ কমে যেতে পারে। আবহাওয়া আর্দ্র থাকলেও দুর্ঘটনার সম্ভবনা থেকে যায়,কারণ নীচে নামার পথটা অনেক খাড়া,একটু স্লিপ করলেই বিপত্তি ঘটে যেতে পারে। মিনিট বিশেক পর প্রচন্ড গরম আর তাপে একসময় মনে হল বৃষ্টির মতো পানি ঝরছে গা থেকে। নীচে নামতে গিয়ে শরীরের ক্লান্তি আর অবসাদে মনে হল আবারও একই পথে ফিরতে হবে।

ডাইনোসর বিচের সামনের তিনদিকের সৌন্দর্য যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। নীল স্বচ্ছ পানিতে জোয়ারের সময় সিক্রেট পথটি ডুবে যায়। পানিতে ভরে যায় ডাইনোসরের নীচের দিকের গোপন সুড়ঙ্গপথটি। তৃষিত মুগ্ধ নয়নে চারপাশের সবুজ আর নীলের জলরাশি দেখছিলাম,দেখছিলাম প্রকৃতি আর ওপরের নীল আকাশকে। প্রচন্ড তাপদাহে আর ঝকঝকে রোদে ক্যামেরায় কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমি ওই পানিতে হেঁটে হেঁটে কিছুদূর গিয়ে একদম সামনে থেকে সাগরের ঢেউয়ের খেলা দেখে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম ফেরার জন্যে। হাতে সময় সীমিত,সেলফোনে নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছেনা তাই অনুভব করছিলাম নুসা লেম্বোগানে থাকা ভ্রমণ সঙ্গীরা আমাদের জন্য দুঃশ্চিন্তায় আছে। তাছাড়া কুটায় ফেরার উদ্দেশ্যে ফাস্টবোট ছেড়ে যাবে বিকাল সাড়ে চারটায়। ঘড়িতে দুপুর সাড়ে এগারোটা দেখে আর দেরী না করে সিক্রেট বিচ থেকে মই ধরে ওপরে উঠতে শুরু করি। ডাইনোসরের মাথায় উঠে ক্লান্ত-শ্রান্ত শরীর মাধ্যাকর্ষণ বলের বিপরীত দিকে ঠেলে এগোতে থাকি গন্তব্যে। অতিরিক্ত ঘামের কারণে শরীরে কোনো শক্তিই যেন অবশিষ্ট নেই। মুখের ভেতরে একটা কাঁচা আমের ললিপপ মুখে পুরে রেখেছিলাম যেনো গলা শুকিয়ে না যায়। তবুও অতিরিক্ত ঘামে আর গরমে গলা শুকিয়ে যেন কাঠ।

আবার চলা শুরু করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাইনোসর সিক্রেট বিচের নীলাভ-সবুজ পানি আমাদের সামনে দৃশ্যমান হল। এই পথ পাড়ি দিতে চল্লিশ মিনিট সময় লাগল। বিচে নামার একদম শেষপর্যায়ে পর্যটকদের সুবিধার জন্য একটা মই লাগানো আছে, সেই মই বেয়ে কেলিংকিং সিক্রেট বিচে পা রাখলাম।

বিচের একপাশে কিছু গাছ রয়েছে। অনেক পর্যটক সেখানে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে। তেমন মানুষ নেই, সবেমোট বারো-পনেরো জন হবে। ছায়াঘেরা গাছের এক পাশে কিছু স্থানীয় মানুষ কোমল পানীয় ও পাহাড়ি ফলের পসরা সাজিয়ে বসে আছে। আমাদের হাতে সময় কম তাই ছায়াঘেরা গাছের নিচে একটুক্ষণই বিশ্রাম নিলাম।

চারপাশের মনোরম পরিবেশের সৌন্দর্য ভাষায় বর্ণনার অতীত। দু'পাশ ঘিরে বিশাল উঁচু পাহাড়, পাহাড়ের গায়ে সবুজ গাছপালা আর নীল আকাশ আর নীলাভ সমুদ্রের জলরাশি মিলে মিশে একাকার। হঠাৎ ঘড়ির দিকে নজর গেল। প্রায় বারোটা, আমাদের বিদায় ঘণ্টা বেজে গেছে। যেতে হবে, নুসা পেনিডা থেকে ল্যাম্বাগানে তা নাহলে বালিতে ফিরে যাওয়ার ফার্ষ্ট বোট আমাদের রেখেই চলে যাবে।

আর দেরি না করে তৎক্ষণাৎ রওনা হয়ে গেলাম। আবার অভিকর্ষ বলের বিপরীতে ওপরের দিকে বেয়ে উঠতে হবে। হাতের ওপর ভর দিয়ে দিয়ে ওপরে উঠতে লাগলাম। উঁচু-নিচু সিঁড়ি; প্রায় চল্লিশ মিনিট পাহাড়ি পথ বেয়ে গন্তব্যের প্রায় নব্বই শতাংশ অতিক্রম করার পরই ঘটল বিপত্তি। অতিরিক্ত ঘামে রক্তচাপ কমে যাওয়ায় চোখ অন্ধকার হয়ে গেল। সিঁড়ির একপাশে বসে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ছেড়ে বাতাস থেকে অক্সিজেন নিচ্ছিলাম। সূর্যের কথামতো মাথা কিছুক্ষণ নিচের দিকে ঝুঁকে অপেক্ষা করছিলাম। ক্রমেই দৃষ্টিসীমা ঝাপসা থেকে স্পষ্ট হয়ে এল। আবারও পথ চলতে শুরু করে দশ মিনিটের মধ্যে ওপরে উঠে এলাম। লবণের অভাব পূরণের জন্যে ঢাউস সাইজের দুটো ডাব খেয়ে নিলাম। বরফ ঠান্ডা পানিতে হাত-মুখ ধুয়ে রেস্তরাঁ থেকে হালকা কিছু খেয়ে নিলাম। রেস্তরাঁর পাশেই ছিলো একটা কালোজামের গাছ। হাতের নাগাল থেকে কয়েকটা জাম পেরে মুখে দিতেই মিষ্টিস্বাদের রসে ভরে গেল মুখ। রেস্তোরাঁয় কথা বলে আরও কিছু জাম পেরে নিলাম নুসা লেম্বাগানে থাকা কন্যা ভোর আর সঙ্গীদের জন্যে। প্রয়োজনীয় শক্তি সঞ্চয়ের জন্যে পথে মধ্যে নাসি গোরেং আর চিকেন সাটো দিয়ে আগে ভাগেই মধ্যাহ্ন ভোজ সেরে নিলাম।

দেড়ঘণ্টা চড়াই-উৎরাই-এর পর মোটরবাইকে আমরা নুসা পেনিডায় - ব্যালাবন হারবার জেটিতে পৌঁছে একটা স্পিডবোটে আধ ঘন্টায় ফিরে আসি ইয়েলো ব্রিজে। ব্রিজের অপরপাশের নুসা কেনিঙ্গনের ব্লু লেগুন আর সিক্রেট ব্রিজে যাওয়ার লোভ সম্বরণ করে চলে এলাম নুসা লেম্বাগানের মহাগিরিতে অপেক্ষারত ভ্রমণ সঙ্গীদের কাছে।

বিকাল সাড়ে চারটেয় আমাদের ফাস্টবোট দুর্বার গতিতে ভারত মহাসাগরের বুক চিরে এগিয়ে গেল সেনোর বোটজেটির দিকে। যতই এগিয়ে যাচ্ছিলাম, ততই বিষন্নতায় মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে আসছিল।

হাঁটুপানিতে নেমে আমরা ঘাটে চলে এলাম। এদিকে ড্রাইভিং পার্কে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল দুটো অ্যাভেঞ্জা ব্রাণ্ডের গাড়ি। গল্প করতে করতে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ফিরে আসি কুটা বিচে আমাদের বাকুম বিচ রিসর্টে।

এই দ্বীপগুলোতে যেতে হলে ভ্রমণকারীদের যা করতে হবে:
ফাস্টবোটে চেপে যেতে হবে। বালিতে সেনোর নামে একটা বোটঘাট আছে ওখান থেকেই এই সব দ্বীপে যাওয়ার জন্য ফাস্টবোট সার্ভিস পাওয়া যায়। সকাল সাতটা থেকে শুরু করে বিকেল সাড়ে চারটে পর্যন্ত বোট সার্ভিস চলে। ইন্দোনেশিয়ান মুদ্রায় ৪৫০,০০০/- থেকে ৫৫০,০০/- রুপিয়া বা বাংলাদেশি টাকায় ২৮৫০/- থেকে ৩৪৫০/-এর ভিতর এই সব দ্বীপে যাওয়া-আসার টিকেট পাবেন। অনলাইনে অথবা হোটেলের আশেপাশের বিভিন্ন স্থানীয় দোকান থেকে এইসব দ্বীপে যাওয়ার জন্য তথ্য পাওয়া যাবে। দ্বীপগুলিতে যাওয়ার জন্য কিছু প্যাকেজও পাওয়া যায় অথবা বিভিন্ন বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য ভালভাবে জেনে নিজে নিজেই সব ব্যবস্থা করা যায়।

সতর্কতা:
সবুজ বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নুসা পেনিডা ছবির মত সুন্দর আর পরিচ্ছন্ন। তাই অপরূপ এই দ্বীপটিকে কোনোভাবে অপরিচ্ছন্ন করা উচিত নয়। কোরালদ্বীপে পলিথিন ব্যবহারে সতর্ক থাকতে হবে। শরীরের পানিশূন্যতা এড়ানোর জন্যে ট্রেকিং-এর সময় সঙ্গে খাওয়ার সেলাইন,পানি ও গ্লুকোজ নিয়ে যেতে হবে।

মার্জিয়া লিপি প্রাবন্ধিক ও পরিবেশবিদ। প্রকাশিত বইঃ 'আমার মেয়েঃ আত্মজার সাথে কথোপকথন, ৭১ মুক্তিযোদ্ধার মা, বাংলাদেশের উপকূল: পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য, জীবনীগ্রন্থ - সরদার ফজলুল করিম, সম্পাদিত বই: সরদার ফজলুল করিম দিনলিপি, মাঃ দুইবাংলার সাহিত্য সংকলন, শিশু বিশ্বকোষ ইত্যাদি।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher