বাংরিপোসির বৃত্তান্ত

সন্দীপ পাল


নিজে গাড়ি চালিয়ে লংড্রাইভে যাওয়ার আলাদা একটা মজা আছে। এর আগে আমার দৌড় ছিল দুর্গাপুর (১৫০ কিলোমিটার) ও মায়াপুর ইস্কন (১১৮ কিলোমিটার) অবধি। এবারে সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে গন্তব্য উড়িষ্যার বাংরিপোসি (২৪৫ কিলোমিটার)। সব গুছিয়ে, বাড়ির বিভিন্ন জায়গায় তালা লাগিয়ে বেরোতে বেরোতে সাড়ে ছটা। পর্যাপ্ত পরিমাণে জল ও প্রাতরাশ সঙ্গে নিয়েছিলাম যাতে রাস্তায় বিশেষ সময় নষ্ট না হয়।

প্রথমে চন্দননগর থেকে দিল্লি রোড ধরে ডানকুনি। সেখান থেকে হাওড়ার মধ্যে দিয়ে গাড়ি ছুটল। ধুলাগড়ের কাছে একশ টাকা টোলট্যাক্স। তারপর উলুবেড়িয়া, বাগনান, দেউলটির পর রূপনারায়ণের ওপর সেতু পেরিয়ে কোলাঘাট। প্রথম দুঘন্টায় ৮০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে কোলাঘাটে খানিক চাবিরতি। আমার কাকা ওখানকার বাসিন্দা, দেখা করতে চলে এল। খানিক আড্ডা দিয়ে আবার পথ চলা শুরু। এরপর পাঁশকুড়া, ডেবরা পেরিয়ে সোজা খড়্গপুর। ডেবরাতে ষাট টাকা টোল ট্যাক্স। খড়্গপুরের কাছে বেশ খানিকটা রাস্তার হাল খুব খারাপ। মুম্বাই রোড (৪৯ নম্বর জাতীয় সড়ক) ধরে গাড়ি এগিয়ে চলেছে - গজাশিমুল,ফেকো-র পর পশ্চিমবঙ্গের সীমানা পেরিয়ে পড়লাম ঝাড়খন্ডে। এরপর বাহারাগোড়া মোড় থেকে বাঁদিকে গাড়ি ঘোরালাম। এখান থেকে বাংরিপোসি ২৯ কিলোমিটার। মাঝে সুবর্ণরেখার ওপর সেতু পেরিয়ে উড়িষ্যায় এলাম। রিসর্টে যখন পৌঁছলাম ঘড়িতে সাড়ে বারোটা বাজে। গাড়ি রিসর্টে ঢুকিয়ে ওডোমিটারে দেখলাম ২৪৫ কিলোমিটার পাড়ি দিয়েছি ছ' ঘন্টায়।

সিমলিপাল খৈরী রিসর্ট
আমরা ঘর বুক করেছিলাম খৈরী রিসর্টে। ৪৯ নম্বর জাতীয় সড়কের ঠিক পাশেই রিসর্টটি। জাতীয় সড়ক সোজা উঠে গেছে সামনের ঠাকুরানী পাহাড়ে। বাঁহাতে একটা বড় পুকুর, আর ডানহাতে রিসর্টের সদর দরজা। এসি,নন-এসি মিলিয়ে সাকুল্যে চোদ্দটি ঘর আছে। এসি ঘরভাড়া ১৫০০ টাকা, নন-এসি ১০০০ টাকা। গাড়ি রাখার অনেক জায়গা। রিসর্টের বাগানটি বেশ গোছানো। দেখে বোঝা যায় কিছু ঘর বেশ পুরোনো, কয়েকটি যদিও পরবর্তীকালে নতুন করে তৈরি করা হয়েছে। রিসর্টটি বহুদিন ওটিডিসি-র দ্বারা পরিচালিত হলেও বছর সাত-আটেক হল স্থানীয় এক অধিবাসী রিসর্টটির মালিক ও তিনিই রিসর্টটি লোক দিয়ে চালান।

প্রচন্ড খিদে পেয়ে গিয়েছিল। দুপুরে গিয়ে মধ্যাহ্নভোজন করব, ফোনে বলে রেখেছিলাম। খাবারের টেবিলে বসতেই সামনে এল গরম ভাত, সাথে আলুচোখা, ডাল, ফুলকপির বেশ সুন্দর তরকারি, ডিমের কারি, চাটনি ও পাঁপড়। খাবার বেশ সুস্বাদু। ডাইনিং রুমের ঠিক পাশেই রান্নাঘর। প্রত্যেকবার রান্না করে গরম গরম দিতেই দেখেছি। রাতে চিকেনকষার স্বাদও দুর্দান্ত ছিল।

ঘন্টা দুয়েক বিশ্রাম নিয়ে বিকেল চারটে নাগাদ গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। যাব বিসই নামে একটি গ্রামে, সেখানে প্রতি শনিবার হাট বসে। রিসর্ট থেকে বিসই ১৬ কিলোমিটারের পাহাড়ি পথ। গাড়ি ঠাকুরানী পাহাড় অভিমুখে চলতে শুরু করল। রাস্তার দুপাশে পলাশ,শিমুল ছড়িয়ে ছিটিয়ে। যদিও বাংরিপোসিতে শিমুলের আধিক্য বেশি চোখে পড়েছে। সামনের রাস্তা পাহাড়ের ওপর উঠে গেছে। এই প্রথমবার আমার পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা - একেই পাহাড়ি চড়াই,তার ওপর আঁকাবাঁকা রাস্তায় গাড়ি চালাবার আলাদা একটা রোমাঞ্চ আছে। পথে চোখে পড়ল মা দ্বারসুনি মন্দির। বিসই থেকে রাস্তা দুভাগ হয়ে যায়। সোজা গেলে যাওয়া যেতে পারে বাঁকাবাল ও সেখান থেকে সুলাইপাত বাঁধ এবং জলাধার। বাঁকাবাল জলাধারের কাছাকাছি পৌঁছেও ফিরে আসতে বাধ্য হই,রাস্তা সারানোর কাজ চলছিল। তবে ফেরার পথে আদিবাসী গ্রামের কুঁড়েঘরের রংবেরঙের কারুকার্য দেখে মুগ্ধ হতেই হয়। সন্ধে হয়ে আসছে। গাড়ি চালাতে চালাতে হঠাৎ দূরের পাহাড়ের দিকে চোখ আটকে গেল। চারিদিকে লাল আভা ছড়িয়ে পাহাড়ের কোলে সূর্যাস্ত - মন রাঙানো দৃশ্য। গাড়ি থামিয়ে কিছু মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দী করলাম। রিসর্টে যখন ফিরলাম - অন্ধকার নেমেছে - ঘড়িতে সাড়ে ছটা বাজে। পরেরদিন কোথায় যাব তা নিয়ে বিস্তর খোঁজাখুঁজি ও আলোচনার পর ঠিক হলো ঘাটশিলা ঘুরে আসা যেতে পারে। গুগুল ম্যাপে দেখলাম রিসর্ট থেকে ঘাটশিলার দূরত্ব প্রায় ৭৫ কিলোমিটার।

পরদিন ভোরবেলা প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে মনটা ভরে গেল - বেশ শীতল পরিবেশ, গাছে গাছে পাখিদের কলরব, রিসর্টের সদর দরজা দিয়ে বেরিয়েই সামনের পুকুরে জলে ওপারের গাছপালার প্রতিচ্ছবি। জাতীয় সড়ক ধরে এগোতে চোখে পড়ল অনতিদূরে ঠাকুরানী পাহাড় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। একটু এগোতেই ডানহাতে হোটেল বাংরিপোসি - যেখানে বসে স্বনামধন্য লেখক বুদ্ধদেব গুহ লিখেছিলেন 'বাংরিপোসির দু'রাত্তির'।

রিসর্টের ম্যানেজারবাবুকে আমাদের ঘাটশিলা যাওয়ার ইচ্ছা জানাতে উনি বললেন যে জাতীয় সড়ক দিয়ে গেলে সময় বেশি লাগবে এবং রাস্তার অবস্থাও তথৈবচ। তার চেয়ে আদিবাসী গ্রাম, খানিক জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে শর্টকাট রাস্তা দিয়ে গেলে তাড়াতাড়ি পৌঁছব। রাস্তা হয়ত চওড়ায় ছোট, কিন্তু বেশিরভাগটাই মসৃণ। গুগুল-এ দেখলাম,ঠিকঠাক বুঝতে পারলামনা। বললাম, প্রধান জায়গার নামগুলো বলুন লিখে নিই, স্থানীয় লোকজনকে জিজ্ঞেস করে যাওয়া যাবে। বললেন, প্রথমে রিসর্ট থেকে জাতীয় সড়ক ধরে তিন-চার কিলোমিটার গিয়ে বাঁদিকের রাস্তা ধরে যাবেন জোকা, তারপর সেখান থেকে অস্তি, তারপর ডুমুরিয়া ও অবশেষে মুসাবনি হয়ে ঘাটশিলা।

সকাল আটটায় রিসর্টে পুরি-সব্জি,চা খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। জাতীয় সড়ক থেকে বাঁদিকের রাস্তায় ঢুকলাম। মাঝে স্থানীয় কিছু লোককে জিজ্ঞেস করতে করতে চলেছি। দু-একবার বিপথে এগিয়েও গাড়ি ঘুরিয়ে আবার সঠিক পথ ধরলাম। একসময় হঠাৎ দেখলাম সামনে কাঁচা, ধুলোমাখা রাস্তা - গাড়ি হেলেদুলে চলছে। গাড়ির তলা মাঝে মাঝে লেগে যাচ্ছে হঠাৎ উঁচু হয়ে থাকা মাটির টিলাতে। গুগুলে দেখাচ্ছে 'unknown road'! একজনকে জিজ্ঞেস করাতে বললেন ঠিক রাস্তা দিয়েই যাচ্ছি,আরেকটু এগোলে ভালো রাস্তা পাবো। তাই-ই পেলাম। আধঘন্টা পর জোকা পৌঁছলাম। সেখান থেকে অস্তি যাওয়ার পালা। প্রায় একঘন্টার রাস্তা। মসৃণ, কখনো সোজা, কখনো আঁকাবাঁকা, কখনো চড়াই-উৎরাই রাস্তা ধরে গাড়ি ছুটছে হু-হু করে। ভেতরের রাস্তা বলে গাড়িঘোড়া নেই বললেই চলে। যেতে যেতে কিছু জায়গার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মুগ্ধ করে। কখনো রাস্তার দুধারে শালবন-লালমাটি, কখনো আদিবাসী গ্রামের সুন্দর সাজানো বাড়িঘর, কখনো ছোট ছোট বাজার।

অস্তি পৌঁছে একটা মোড় থেকে ডানদিকের রাস্তা চলে গেছে ডুমুরিয়ার দিকে। এবারে উড়িষ্যা পেরিয়ে ঝাড়খণ্ডে পড়লাম। প্রত্যেকটা জায়গার আলাদা একটা সৌন্দর্য আছে. মুসাবনি পৌঁছে প্রথম পেট্রল পাম্প পেলাম - পেট্রল ভরে নিলাম। তারপর আবার পথ চলা - এখানকার বাজার, রাস্তাঘাট বেশ জমজমাট। গুগুল-ও যেন স্বস্তি পেয়েছে ঠিকঠাক পথনির্দেশ দিতে পেরে। সুর্দা রোড ধরে এগোতেই একটা মোড়ে লেখা দেখলাম ডানদিকে ঘাটশিলা আর মাত্র ছয় কিলোমিটার। একটু পরেই চলে এল সুবর্ণরেখার ওপর ব্রিজ। পেরিয়েই ডান হাতে চোখে পড়ল হিন্দুস্তান কপার লিমিটেডের বিশাল কারখানা। সোজা এগিয়ে একটা মোড় থেকে আবার ডানদিকে। সামান্য এগোতেই ডানহাতে সার্কাসমাঠের পাশে ছোট রাস্তা। রাস্তাটা যেখানে দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে দুভাগ হয়ে যাচ্ছে ঠিক সেখানে বাঁহাতে পড়বে 'গৌরীকুঞ্জ'।

গৌরীকুঞ্জ
বাংলার বিখ্যাত সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর বাড়ি হল গৌরীকুঞ্জ। কর্মসূত্রে এসে সুবর্ণরেখার তীরের এই জায়গাটিকে ভালোবেসে ফেলেন। প্রায় কুড়ি বছর এই বাড়িতে থাকেন ও এখানেই মারা যান। বাড়িটিকে রক্ষণাবেক্ষণ করে সংগ্রহশালায় পরিণত করা হয়েছে। সেখানে আছে ওঁর ব্যবহৃত পোশাকাদি,গ্রন্থসমূহ,হাতে লেখা 'পথের পাঁচালী'-র খসড়া ও নানাবিধ ছবি - একজন ভদ্রলোক সব বুঝিয়ে দিলেন। ঘর থেকে বেরিয়ে উঠোনের পাশে ছোট মাঠের মতো জায়গা,তারপর 'অপুর পাঠশালা'-সেখানে বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করছে।

বুরুডি হ্রদ
গুগুল ম্যাপে দেখলাম গৌরীকুঞ্জ থেকে বুরুডি হ্রদ যেতে প্রায় আধ ঘন্টা লাগবে। হাতে সময় কম - গাড়ি ছোটালাম সময় নষ্ট না করে। ঘাটশিলা টাউন পেরিয়ে,হাইওয়ে পেরিয়ে গাড়ি গিয়ে পড়ল সরু রাস্তায়,একসময় রাস্তার দুপাশে গাছ,ঘাসের জঙ্গল। গ্রামের মধ্যে দিয়ে সামনের রাস্তা ওপরের দিকে উঠে গেছে - সামনে পাহাড়। গাড়ি গিয়ে উঠল হ্রদের পাশের বাঁধ রাস্তায়। যদিও ভরদুপুরে এসেছি তবুও বুরুডি হ্রদের অপরূপ পরিবেশ মুগ্ধ করে। এখন হ্রদের জল কম কিন্তু পরিষ্কার,ওপারে চালচিত্রের মতো সাজানো পাহাড়ের সারি। সজোরে হাওয়া বইছে। রোদের তাপ যেন গায়ে লাগছেনা। বোটিং-এর ব্যবস্থা রয়েছে। খানিক ঘুরে, চা খেয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম - ফিরতে হবে।

টানা ঘন্টাতিনেক ৯০ কিলোমিটার ড্রাইভ করে দুপুর তিনটে নাগাদ রিসর্টে ফিরলাম। গাড়ি থেকে নেমে ডান পা-টা আর ভাঁজ করতে পারছিলাম না পেশিতে এত লাগছে। যাইহোক, মধ্যাহ্নভোজন সেরে খানিক বিশ্রাম নেওয়া গেল। বিকেলে বুড়িবালামের তীরে ঘুরে এলাম। খুব সুন্দর জায়গা। পরেরদিন সকাল আটটা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম - ঘরে ফেরার পালা।

পরিশিষ্ট: তিনদিন দুরাতে চারজনের খাবার খরচ পড়েছিল ১৮৪১ টাকা। মানে জনপ্রতি ২৩০ টাকা প্রতিদিন। যারা ট্রেনে যেতে চান: ধৌলি এক্সপ্রেস (১২৮২১) হাওড়া থেকে সকাল ৬টা - বালাসোরে পৌঁছনোর সময় সকাল ৯:৩৫, বালাসোর থেকে ডেমু প্যাসেঞ্জার ট্রেন (৭৮০১৩) সকাল ১০:০৫ - বাংরিপোসি স্টেশন পৌঁছনোর সময় দুপুর ১২:৩০। স্টেশন থেকে অটো পাওয়া যাবে।

পেশায় ব্যারাকপুর রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ কলেজের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ডঃ সন্দীপ পাল সোসাইটি ফর রেডিয়েশন রিসার্চ ও ইন্ডিয়ান বায়োফিজিক্যাল সোসাইটির সদস্য। জীববিদ্যার সাথে যুক্ত থাকার কারণেই হয়তো প্রকৃতির প্রতি অমোঘ টানে ঘুরে বেড়ান দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জায়গায়। একসময় ছবি আঁকতেন, আর এখন ছবি তোলাটা প্রায় নেশার পর্যায়ে পৌঁছেছে। হালে লেখালেখির চর্চাটা বেড়েছে মূলত তাঁদের জন্যে যাঁরা ওঁর লেখা মন দিয়ে পড়েন ও উৎসাহ দেন প্রতিনিয়ত।

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher