চমৎকার চৌকরি
অরিন্দম পাত্র
বিনসর ইকো ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে পড়লাম সকাল সকাল,আজকের গন্তব্য চৌকরি ভায়া পাতাল ভুবনেশ্বর।
সুদীর্ঘ পথ। মাঝেমধ্যে পথের ক্লান্তি ভুলিয়ে দিচ্ছে এক একটা বাঁক -শ্বেতশুভ্র শৃঙ্গরাজি উঁকি মেরে যাচ্ছে। আর আমাদের শিরায় শিরায় শক্তি সঞ্চার করে যাচ্ছে।
তবে দীর্ঘ কুমায়ুন ভ্রমণে প্রতিদিনের ক্লান্তিকর জার্নি আজ অল্প হলেও থাবা বসাচ্ছে আমাদের শরীরে। গাড়ি থামিয়ে মাঝে মাঝে মিসেসকে আর ছেলেকে চোখেমুখে জল দিয়ে আর ওষুধ খাইয়ে পরিচর্যা করতে হচ্ছে। আমি এখনও অবধি ঠিক আছি। ঈশ্বরেরআশীর্বাদে পাহাড়ি পথে এখনো অবধি অতটা অসুস্থ হই নি।
যাই হোক,এইভাবে চলতে চলতে এসে পড়লাম পাতাল ভুবনেশ্বর। প্রবেশপথের বাইরে দোকান থেকে পুজোর উপাচার কিনে নিয়ে চললাম। আশেপাশে বেশ কিছু লজ,হোম স্টে-র দেখা মিলল। কুমায়ুনের যাত্রাপথে পাতাল ভুবনেশ্বর একটি অন্যতম দ্রষ্টব্য স্থান। পুরাণ মতে তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর বাস এই গুহাগর্ভে। কথিত আছে আদি শঙ্করাচার্য প্রথম এই গুহামন্দিরে পূজাপাঠ চালু করেন।
পুজোর ডালি নিয়ে এগিয়ে চললাম পায়ে পায়ে। আগেই ঠিক করে নিয়েছিলাম গুহাগর্ভে প্রবেশ করব না। ছেলে আর মিসেসের শরীর ভাল ছিল না আর ওদের একা রেখে নীচে নামা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। গুহামন্দিরের প্রবেশপথ দেখলেও বুক শুকিয়ে যায়। খুব সঙ্কীর্ণ এবং মাথা নীচু করে হামাগুড়ি দিয়ে প্রবেশ করতে হয়।
যাই হোক,বাইরের ছোট্ট মন্দিরে পূজারীজির কাছে পুজো দিয়ে আমরা ফিরে চললাম। পূজারীজি হাল্কা তিরস্কার করলেন,"আরে দাদা! কুছু হবে না। নীচে যান না!" প্রচুর বাঙ্গালী পর্যটকের সংস্পর্শে এসে ওঁর বাংলাটা কিন্তু জবরদস্ত হয়ে উঠেছে! হাসিমুখে আমাদের অক্ষমতার কথা জানিয়ে চলে এলাম।
আবার গাড়ি ছুটল,চৌকরি আরও প্রায় ৩৯ কিমি দূরে। কে এম ভি এন-এর গেস্টহাউস এখানকার থাকার জায়গাগুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ। তবে এযাত্রা আমাদের ঠাঁই হতে চলেছে হোটেল ওজস্বীতে।
দেখতে দেখতে চলে এলাম হোটেলে। সুন্দর ছিমছাম হোটেল। দীর্ঘযাত্রা শেষ হতে সবাই বেশ খুশি হয়ে উঠেছিলাম। ছেলে আর মিসেসও অল্পবিস্তর সুস্থ হয়ে উঠেছিল। খিদেয় পেট চুঁইচুঁই করছিল সবার। ছেলের ইচ্ছে হল চাইনিজ খাওয়ার। সেইমত হোটেলের রুমে লাঞ্চ আনিয়ে খেয়ে নেওয়া হল। আমার ঘুম আসছিল না। সামনে বিরাট বাগান আর একটা প্রশস্ত বারান্দা মত সাজানো জায়গা - ভিউপয়েন্ট গোছের। ওইখানে দাঁড়িয়ে চারিদিকের দৃশ্যসুখ উপভোগ করছিলাম। চৌকরিকে বলা হয় কুমায়ুনের মাউন্টেন গ্যালারি। কিন্তু আজ আকাশ সাদা পেঁজা তুলোর মত কুণ্ডলীপাকানো মেঘে ঢাকা। হিমালয়ের তুষারশৃঙ্গমালা আজ অদৃশ্য।
হঠাৎ পেছনে বিকট আওয়াজ শুনে ঘুরে তাকিয়ে দেখি,পর পর বেশ কয়েকটি রুমের বাইরে রাখা বাসনকোসন নিয়ে কাড়াকাড়ি খেলায় মেতেছে এক পাল বানর। পাশেই ঘন জঙ্গল আর গাছপালার সমারোহ। ওনাদের আবির্ভাব ওখান থেকেই ঘটেছে বোধকরি। এমতাবস্থায় আর বাইরে থাকা উচিত না বুঝে তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে পড়লাম। তখনও ওনারা আমাদের ঘরের সামনে নেমন্তন্ন খেতে হাজির হন নি!
আস্তে আস্তে বেলা পড়ে আসছে। বাইরে মুখ বাড়িয়ে আর তেনাদের দেখা পেলাম না। ছেলে আর ছেলের মা ঘুমে অচেতন। ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে দরজা টেনে লক করে বেরিয়ে পড়লাম। হোটেল রিসেপশনে জিজ্ঞেস করে জানলাম বাইরে বেরিয়ে ডানদিকে অল্প হাঁটলেই সানসেট পয়েন্ট পাওয়া যাবে। আর বাঁ দিকে গেলে পরমহংস আশ্রম।
ঠিক করলাম আশ্রমে কাল সকালে যাব। আপাতত সানসেট পয়েন্টে যাই। বাইরে বেরিয়ে রাজকুমারের সঙ্গে দেখা -আমাদের সারথি। সব শুনে উনিও আমার সঙ্গী হলেন। দুজনে গল্প করতে চললাম অচেনা পথ ধরে। মিনিট আষ্টেক হেঁটে এলাম সানসেট পয়েন্টে। সূর্য তখন প্রায় ডুবু ডুবু! আমার ছবি তোলার নেশার ব্যাপারে এতদিনে রাজকুমার ওয়াকিবহাল। উনি আমাকে বেশ ক'টা ভাল জায়গা দেখিয়ে সেখান থেকে ছবি তুলতে বললেন। পশ্চিম আকাশে রাঙা কমলালেবুর মত সূর্য অস্ত গেল। রাজকুমার আর আমি হোটেলে ফিরে চললাম।
বিনসরের রাতটা ছিল কোজাগরী লক্ষ্মী পূর্ণিমার রাত। গোল থালার মত পূর্ণচন্দ্র উঠেছিল আকাশে। চৌকরির আকাশেও দেখা পেলাম সেই একইরকম চাঁদের! সেই শোভা দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়লাম কখন।
পরের দিন ভোরবেলা চৌকরি আমাদের নিরাশ করেনি। চৌকরির মাউন্টেন গ্যালারি নাম মাহাত্ম্যের প্রমাণ পেয়েছিলাম পরের দিন ভোরেই। ঘুম ভাঙল বেশ ভোরে। সাড়ে পাঁচটা বাজে। জানলার পর্দা সরিয়ে উঁকি মারলাম। অল্প অল্প আলো ফুটবে ফুটবে করছে। গায়ে একটা সোয়েটার চাপিয়ে বেরিয়ে এলাম বাইরে। সামনের সেই ভিউ পয়েন্টের কমন বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। পুব আকাশ আস্তে আস্তে রাঙা হয়ে উঠছে। লালচে আভা পুব দিগন্ত জুড়ে। প্রচুর পাখির কলতানে তখন কান পাতা দায়। চৌকরিতে ভোর জেগে উঠছে।
তখনও কি জানতাম দিনের আলো ফুটলে কী অপরূপ দৃশ্য দেখতে পাব! সেই অনুপম ভোরের ছবি ক্যামেরাবন্দী করতে তখন আমি ব্যস্ত। লালচে থেকে কমলা তারপর আস্তে আস্তে সোনালী রোদ নেমে এল। অস্পষ্ট আলোর আভায় দেখা যাচ্ছিল কাছের পাহাড়গুলোর স্তরের পর স্তর (mountain layers)। রোদ ওঠার পর দূরদিগন্ত জুড়ে দৃশ্যমান হয়ে উঠল হিমালয়ান রেঞ্জ! সে এক অপরূপ দৃশ্য! আকাশে গতকালের মত মেঘের চিহ্নমাত্র আজ আর নেই। চৌকরি আজ সত্যিই মাউন্টেন গ্যালারি -সার্থকনামা হয়ে উঠেছে!
এ দৃশ্য তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছিলাম। হঠাৎ কানে ভেসে এল দূর থেকে সুগম্ভীর প্রার্থনা সঙ্গীত। পরমহংস আশ্রম থেকে ভেসে আসা জলদগম্ভীর সেই প্রার্থনাগীতি! মুহূর্তে যেন পরিবেশ হয়ে উঠল ঐশ্বরিক। অনন্যসুন্দর এবং আধ্যাত্মিক যেন সে এক অনুভূতি!!
তবু ঘরে ফিরে আসতে হল তাড়াতাড়ি। সকাল সাড়ে নটার মধ্যে চেক আউট করতেই হবে। অনেকটা পথ যেতে হবে আজ মুন্সিয়ারির উদ্দেশ্যে - প্রায় ৯০-১০০ কিমি।
রেডি হয়ে ঘর ছেড়ে দিয়ে লাগেজ রিসেপশনে রেখে একবার এগিয়ে চললাম পায়ে পায়ে পরমহংস আশ্রমের দিকে। হোটেল থেকে বেরিয়ে বাঁ দিকে একটা পায়ে চলা রাস্তা ধরে কিছুক্ষণ এগোলেই আশ্রম পড়ে। প্রার্থনাগীতি আপাতত বন্ধ এখন। আশ্রমের কাছে এসে স্থানুবৎ হয়ে গেলাম। যে হিমালয়ান রেঞ্জ ঘরের বারান্দা থেকে ক্যামেরার জুম বাড়িয়ে দেখছিলাম,আশ্রমের একটু পিছনের অংশ থেকে সেই তাদেরই যেন হাত বাড়িয়ে ছুঁতে পারব! মনের আনন্দে আমি তখন শুধু ছবি তুলতে ব্যস্ত। আশ্রমে যাওয়ার কথা ভুলেই গেছি।
চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল, গাছের আড়ালে দূরের ছোট্ট দোতলা বাড়িটা। হঠাৎ চটক ভাঙ্গল ঢং ঢং করে ঘন্টার আওয়াজে। কোথা থেকে আওয়াজ আসছে দেখতে গিয়ে দেখি... ওকি! ওটা একটা স্কুল না? সত্যিই তো। এতক্ষণে দূর থেকে কচিকাঁচাদের শোরগোলের আওয়াজও শুনতে পেলাম। সকালে স্কুল বসেছে, ছোট্ট বিদ্যার্থীরা স্কুলে আসছে এক এক করে। এই উদাত্ত, নৈসর্গিক পরিবেশের মাঝে স্কুলটিকে দেখে সুনির্মল বসু মহাশয়ের কবিতাখানা মনে পড়ে গেল!
"আকাশ আমায় শিক্ষা দিল
উদার হতে ভাই রে,
কর্মী হবার মন্ত্র আমি
বায়ুর কাছে পাই রে।
পাহাড় শিখায় তাহার সমান -
হই যেন ভাই মৌন-মহান,
খোলা মাঠের উপদেশে -
দিল-খোলা হই তাই রে।"
উদার প্রকৃতির মাঝে এই বিদ্যালয়ে পাঠরত বাচ্চারা যে সুন্দর শিক্ষা পাবে,তা কি আর আমাদের ইট-কাঠ-পাথরের যান্ত্রিক সভ্যতার স্কুলে দেওয়া সম্ভব? বাচ্চাগুলির কাছে ছুটে চলে যেতে ইচ্ছা করছিল কিন্তু আমাদের গাড়ি ছাড়ার সময় হয়ে গেছে। তাই হিমালয়কে প্রণাম জানিয়ে বাচ্চাগুলির উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কামনা করে এগিয়ে চললাম। গন্তব্য মুন্সিয়ারি..
পেশায় চিকিৎসক (নাক কান ও গলা বিশেষজ্ঞ) অরিন্দম পাত্র-এর নেশা ছবি তোলা। এছাড়াও দেশের মধ্যে নানা জায়গায় ভ্রমণ করা তাঁর আর এক শখ।