গোয়ায় বারবার
সুচন্দ্রিমা চৌধুরী
যখন তৃতীয়বার গোয়া যাওয়ার প্রস্তাব তুললাম, বাড়ির সকলে এককথায় প্ল্যানটা নাকচ করে দিল। প্রথম দুবার গোয়া গেছিলাম অনেক আগে। তখন নর্থ গোয়াতেই ছিলাম। একদিনের ট্যুরে সাউথ গোয়া ঘুরে এসেছিলাম। প্রতিবারই ভাল লেগেছিল। এবার বেশ অনেকটা সেই পাহাড় টানার মত সমুদ্র মন টানছিল। কলকাতা থেকে কাছেপিঠে সমুদ্রে যাবার অনেক অপশন। আমি দিল্লি থেকে যাব। মন চাইছিল একটা ছোট শহর হবে সমুদ্রের ধারে। নিরিবিলি আর নিজস্বতাসমৃদ্ধ এক সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ থাকবে। সমুদ্রের ধারে ছিমছাম থাকার জায়গা হবে - যেখানে বসে ক'টাদিন সমুদ্রের ঢেউ গুনে কাটিয়ে দেব। শেষ যেবার গেছিলাম তখনই ঠিক করে ফেলেছিলাম যে এরপর এলে সাউথ গোয়াতে থাকব। বাড়ির সকলে নাকচ করলে হবে কী – আমি তো ছবিতে দেখেছি ও পড়েছি সাউথ গোয়ার বিচ সম্বন্ধে। নর্থ গোয়ার সঙ্গে অনেক ফারাক। এবার শুধু বাড়ির লোকজনকে বোঝানো। করলাম কী, থাকার জায়গা আর তার চারপাশের ছবি দেখাতে থাকলাম, জায়গার নাম না বলে। তাতেই কাজ হল - সমুদ্র, আশপাশ আর হোটেল দেখে বাড়ির লোকজন দু পায়ে রাজি। তারপর আর কী? জায়গার নামটা বলতেও এবার আর কোন বাধা এল না। এবার তিনদিন শুধু সমুদ্রে আর আশপাশের প্রকৃতি ও পরিবেশে ডুব দিয়ে কাটিয়ে দেব - এই ঠিক হল।
এয়ারপোর্ট থেকে গাড়ি ছুটল। সাউথ গোয়ার দিকে মোড় ঘুরে পাহাড়ি রাস্তায় বাঁক নিতেই যেদিকে দুচোখ যায় কাজুর গাছ। তার ওপারে নীল সমুদ্র। এই বিশাল কাজুর বাগান পেরিয়ে সাউথ গোয়ায় প্রবেশ করতেই সুন্দর ছোট ছোট গ্রামের মধ্যে দিয়ে রাস্তা। বর্ধিষ্ণু সব গ্রাম। নারকেল গাছের ছায়ায় ছবির মত সব বাড়ি। এদিকে এক অদ্ভুত ধরনের নারকেল দেখলাম -হলুদ রঙের। এয়ারপোর্ট থেকে আড়াই ঘণ্টার রাস্তা কোলভা। জমজমাট জায়গা। মাছুয়ারাদের পট্টির পাশেই আমাদের রিসর্ট। ঘরের বিশাল কাঁচের জানলা দিয়ে দেখা যায় দিগন্তবিস্তৃত আরবসাগর।
যখন পৌঁছলাম,তখন সূর্য পশ্চিম দিগন্তে ঢলে পড়েছে। সমুদ্রের জলে তখন নানা রঙের খেলা। ঘরের বাইরেই লন আর লন পেরলেই বিচের বালি শুরু। এদিকটায় ফরেনারদের আনাগোনাই বেশি। আর দক্ষিণ ভারতীয়রাও আসে অনেক। ফরেনারদের মধ্যে রাশিয়ানরা আসে প্রচুর। একসময় বহুদিন ধরে একমাত্র রাশিয়া থেকেই সরাসরি বিমান নামত গোয়ায়। আর এইজন্য প্রচুর রাশিয়ানদের আসাযাওয়া শুরু থেকেই। এমনকী এই সাউথ গোয়ায় অনেক দোকানে রাশিয়ান লেখা দেখতে পাবেন ও রাশিয়ান খাবারও পাবেন। এখানকার ছোট দোকানদাররা রাশিয়ান বলতেও পারে। শুরু থেকেই এই রৌদ্রস্নাত ঝলমলে বিচ, সুন্দর আবহাওয়া আর সস্তায় থাকা ওদের আকর্ষণ করেছে।
যাক বলছিলাম হোটেলের কথা। লন পেরলেই বালি শুরু। কোলভায় মাছুয়ারাদের বিরাট পট্টি। ছাউনিকরা মাছুয়াপট্টি ছাড়াও বর্ধিষ্ণু সচ্ছল মাছুয়ারাদের বাড়িও সমুদ্রের পাড় ধরে। যাদের পাকাবাড়ি তাদের নিজস্ব নৌকা। পরদিন ভোরেই সমুদ্রের ধার ধরে হাঁটতে হাঁটতে এইসব নৌকাদের পাড়ে ভেড়ানোর দৃশ্য দেখছিলাম। কী কঠোর পরিশ্রম করে নৌকাগুলোকে পাড়ে তুলছিল একসঙ্গে দশ থেকে বারোজন মিলে।
জীবনযাত্রাই এদের সবাইকে একত্র করে রেখেছে। ওদের নৌকা পাড়ে লাগতেই শুরু হয়ে গেল মাছের বেচাকেনা। কত মাছ চলে গেল প্যাকিং বাক্সে – প্যাক হয়ে চলে যাবে দূরদূরান্তে। কিছু চলে গেল রোদে শুকাতে। বাকি মাছ নিয়ে বসে গেল বাজার। এই সকালের মাছের বাজারে মাছ না কিনলেও মাছের গন্ধ সহ্য করতে পারলে এ বাজারে ঢুঁ মারা এক অনন্য অভিজ্ঞতা। জীবনের এক সুন্দর ছবি দেখতে পাওয়া যায়। গোয়া থাকাকালীন এক দিনও এই বাজার মিস করিনি। অনেক বিদেশীকে দেখেছি এখান থেকে মাছ নিয়ে যেতে। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি এই বিচগুলির ধারে অনেক বাড়ি ভাড়া পাওয়া যায় থাকার জন্য। এই বাড়িগুলিতে কেয়ারটেকার, রান্না করা খাবার ও সবরকম সুব্যবস্থা আছে। বাড়িগুলোর পরিবেশও ভারি মনোরম। চাইলে নিজেরা রান্না করেও খাওয়া যায়। অথবা বাজার করে কেয়ারটেকারের হাতে তুলে দিলে, তারাও খাবার বানিয়ে দেয়। বিদেশীদের বিরাট দলটি যাদের রোজ মাছ কিনতে দেখতাম,এমনই এক বাড়ি ভাড়া করে ছিল। প্রতিদিন ওরা টাটকা মাছ নিয়ে যেত। এই সদ্য ধরা মাছের কিছু আবার চলে যেত বিচের শ্যাকের দোকানিদের কাছেও। বিচের উপর সার দিয়ে কাঠের মাচা বাঁধা – খাওয়ার ও বসার জায়গা। নানান রকমারি সব নাম তাদের। এদেরই শ্যাক বলে। এখানে নানান টাটকা খাবার পাওয়া যায় আর পাওয়া যায় ঘণ্টা হিসেবে বসার জায়গা - সমুদ্রকে কাছ থেকে অনুভব করার জন্য। এখানে বলে রাখা ভাল - নর্থ গোয়ার বিচ ও শ্যাকের অভিজ্ঞতা থেকে এখানের অভিজ্ঞতা তুলনা করে লাভ নেই। এখানে বিচ অনেক নিরিবিলি। শ্যাকগুলিও অনেক ছিমছাম ও সুন্দর। একদিনের বেশি থাকলে, একই শ্যাকে একের বেশি বার গেলে ওরা খাতির করে আর ঘণ্টাপিছু চার্জ করে না। রাতের অন্ধকারে যখন এই শ্যাকগুলো মোমবাতির আলোতে সেজে ওঠে, কালো অন্ধকার চিরে সমুদ্রের গর্জন আছড়ে পড়ে তখন বড়ই মোহময় হয়ে ওঠে পরিবেশ।
ভোরবেলা মাছের বাজারের বেচাকেনা সাঙ্গ হলে রোজ হাঁটতে বেরোতাম সমুদ্রের পাড় বরাবর। কোলভা বিচ বিশাল লম্বা। ডান দিকে ঘণ্টাখানেক হাঁটলে পৌঁছে যাওয়া যায় বেতাল বেতিম বিচে। আর বাম দিকে ঘণ্টা খানেক হাঁটলে পৌঁছে যাওয়া যায় বেনৌলিম বিচে। এই হাঁটাহাঁটি আর সমুদ্রস্নান চলল তিনদিন ধরে। তার সঙ্গে সমুদ্রপারের শ্যাকগুলোতে ইচ্ছেমত খাওয়া দাওয়া। এখানের সমুদ্রে স্নান করার কোন বাধা নেই। অনেক লাইফ গার্ডের পোস্ট আছে। তারা সবসময় নজরদারি করে। আমরা কালীপুজোর সময় গিয়েছিলাম বলে সমুদ্রে ঢেউ পেয়েছি বেশ ভালই। আর আবহাওয়াও ছিল খুব ভাল। মে-জুনের গরমটা বাদ দিলে বাকি সব সময়ই আবহাওয়া ভালই থাকে। এরই মধ্যে একদিন দুপুরে ঘুরে এলাম নর্থ গোয়া যার মধ্যে পাঞ্জিমও পরে। পাঞ্জিম শহরটা দারুণ সুন্দর। মেন বাজারটাতে পুরনো আর নতুনের সমন্বয় চোখ কাড়ার মত। পাঞ্জিম শহর ও আশেপাশে পর্তুগিজ আমলের পুরনো সব চার্চ ঘুরে দেখতে একদিন লাগল। একদিন ঘুরে এলাম দুধসাগর জলপ্রপাত। একদিন সাউথ গোয়া ট্যুরে গেলাম - নানান মন্দির ও প্রত্যন্ত গ্রাম ঘুরতে।
গোয়ার সমুদ্রের একটা অদ্ভুত মাদকতা আছে। তবে এই সমুদ্রের সাথে প্রেম জমাতে গেলে যেতেই হবে সাউথ গোয়াতে। পুরনো গোয়াকে নতুন করে পেতে যতবার ছুটে যাবেন গোয়া আপনাকে নিরাশ করবে না। সাউথ গোয়ার বিচগুলো অনেক পরিষ্কার। এখানে ভিড় নেই। পালোলেম,বেতাল বেতিম,বেনৌলিম, মরজিম, আগণ্ডা আর কোলভা হল কয়েকটি নাম করা বিচ যেখানে খুব ভাল থেকে শুরু করে মাঝারি মানের সব রকমের হোটেল পাবেন। এগুলির মধ্যে যেকোনো জায়গায় সমুদ্রের ধারে আপনার পছন্দমত জায়গা বুক করতে পারেন। যদি বড় গ্রুপ নিয়ে যান তবে বাড়ি ভাড়া নিতে পারেন - অন্য রকম করে উপভোগ করতে পারবেন।
সাউথ গোয়ার আসল আকর্ষণ হল এখানে কম লোকজনের আনাগোনার কারণে প্রকৃতিকে মনের মত করে খুঁজে পাওয়া যায়। ঘন সবুজ প্রকৃতি আর পরিষ্কার সোনালি, নিরিবিলি সমুদ্র সৈকত এখানের প্রধান আকর্ষণ। পালোলেম এদের মধ্যে মন কাড়বে সবচেয়ে বেশি। যদি পাহাড় আর সমুদ্রকে একসঙ্গে পেতে চান তবে পালোলেম বিচে যেতে পারেন। আর যদি নিরিবিলির মধ্যেও গোয়ার নিজস্ব কালচার আর মানুষগুলোর জীবন আরও কাছ থেকে দেখতে চান- তবে যেতে হবে কোলভা বা বেতাল বেতিমে। যদি বড়দিন বা নিউইয়ারের সময় যান এক অন্য গোয়াকে দেখতে পাবেন। এসব সময় এখানে কার্নিভাল হয়। উৎসবের রঙে সেজে ওঠে গোয়ার শহর।
সাউথ গোয়ার সব বিচেই স্নান করা যায়। আর নিরিবিলি হওয়াতে এখানে স্নান করার অভিজ্ঞতাও অন্যরকম হবে। বিচগুলোতে নানান জলক্রীড়ারও ব্যাবস্থা আছে। বিচ থেকে রাস্তায় উঠলে দুধারে দোকানিদের পশরা। নানা খাবার, কাজুর ও ট্যাটু বানানোর দোকানগুলো নানা রঙে ও আমেজে সেজে ওঠে সন্ধ্যার অন্ধকার জাঁকিয়ে বসতেই। বিচের লাগোয়া ছোট ছোট শহরগুলো পুরো জমজমাট হয়ে ওঠে সন্ধ্যের বেচাকেনায়। এখানে নানান স্থানীয় খাবার দোকান। তাতে গোয়ানিজ থেকে চাইনিজ সবধরনের খাবার পাওয়া যায়। একবার মালাবার চিংড়ির কারি চেখে দেখতে পারেন। আর তাছাড়া রাতেও যদি সমুদ্রকে ছাড়তে মন না চায়, সমুদ্রের বিচেও সুন্দর পরিষ্কার শ্যাকে রাতের খাবার পাবেন। তাতে পাবেন নানান দেশ বিদেশের খাবার থেকে শুরু করে গোয়ার নিজস্ব খাবারও। সাউথ গোয়ার বিচগুলিতে ফরেনারদের আধিক্যই বেশি। যদি নর্থ গোয়ায় আগে গিয়ে থেকেও থাকেন, সাউথ গোয়া গেলে তাকে অন্য রূপে পাবেন। গোয়া যাবার আদর্শ সময় নভেম্বর থেকে মার্চ। কেউ কেউ আবার গোয়ায় বর্ষার রূপ দেখতেও যান। সেও এক অনবদ্য অভিজ্ঞতা।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যঃ
১। সাউথ গোয়া থেকে নর্থ গোয়া ঘুরে আসা যায়। নর্থ গোয়া যেদিন যাবেন, সেদিনই চার্চ ও মঙ্গেশকার মন্দির ঘুরে আসা যায়। পানাজির বাজার দেখতে ভুলবেন না। পুরাতন আর আধুনিকের এমন মেলবন্ধন খুব কম জায়গায় দেখতে পাওয়া যায়।
২। স্পাইস গার্ডেন ট্যুরে না যাওয়াই ভাল। বরং সময় পেলে দুধসাগর জলপ্রপাত ঘুরে আসা যায়।
৩। যেকোনো বিচের ধারে মার্কেটে সাইকেল, বাইক ও গাড়ি সবই ঘন্টা হিসেবে ভাড়া পাওয়া যায়।
৪। সাউথ গোয়াতে আগে থেকে থাকার জায়গা বুকিং করে যাওয়াই শ্রেয়।
সুচন্দ্রিমা চৌধুরী একজন শিক্ষাবিদ। শিক্ষামূলক ও পাঠ্যপুস্তক লেখা বাদে ঘোরা তাঁর নেশা। তাঁর মনে হয় সেইসব দেশবিদেশে ঘোরার অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেওয়ার মধ্যে যে আনন্দ তা ঘোরার থেকে কিছু কম নয়। প্রতিটি চেনা-অচেনা জায়গারই এক অনন্যতা আছে। তা দেখার জন্য চাই চোখ ও মন। এরকমই চেনা অচেনা, জানা অজানা জায়গার অভিজ্ঞতা তাঁর ভাগ করে নেওয়ার ইচ্ছা 'আমাদের ছুটি'র পাঠকদের সঙ্গে।