গোঁসাইকুণ্ড ট্রেক

পল্লব চক্রবর্তী


~ ল্যাংটাং-গোঁসাইকুণ্ড ট্রেকরুট ম্যাপ ~ গোঁসাইকুণ্ড ট্রেকের আরও ছবি ~

-এবার আমরা কিন্তু বিদেশে গিয়ে ট্রেক করব।
অর্জুনের কথাশুনে আন্দাজ করতে পারি এটা কোথায় হতে চলেছে, তবু মজা করে বলি,- কোথায় রে? সুইস আল্পস, নাকি আন্দিজের কোথাও? আমার কিন্তু পাসপোর্টও নেই, পয়সাও নেই। অর্জুন গম্ভীর গলায় জানায় – ওসব কিসসু লাগবেনা, তুই নেপালের গোঁসাইকুণ্ডের নাম শুনেছিস তো? এবার যাওয়া হচ্ছে ওখানে, তুই ইমিডিয়েট তরুণদাকে ফোন কর।

ল্যাংটাং ভ্যালি আর গোঁসাইকুণ্ড ট্রেকের কথা আগেই পড়েছি। নেপালের জনপ্রিয় ট্রেক রুটগুলোর মধ্যে অন্যতম। স্বয়ং উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় গিয়েছিলেন গোঁসাইকুণ্ড। কিন্তু দু'দিনে ধুনচে থেকে ৪৩৮০ মিটার উচ্চতায় গোঁসাইকুণ্ডে পৌঁছে ৪৬১০ মিটার উঁচু পাস পেরিয়ে সুন্দরজাল হয়ে কাঠমাণ্ডু পৌঁছানো আমার মতো সখের ট্রেকারের পক্ষে বেশ কঠিন কাজ। তবু পাহাড়ের জন্য মন কেমন করে ওঠে, ফোন লাগাই কলকাতার ট্রেকার্স মহলে পরিচিত নাম তরুণদাকে। বাষট্টি বছরের টগবগে তরুণদা আশ্বাস দেন, -যদি পাহাড়কে ভালোবাসো আর মনে জোর থাকে তবে এ ট্রেক মোটেও কঠিন নয়। মিনমিন করে বলি, -যেতে তো ইচ্ছা করছে, কিন্ত পেরে উঠব তো? তরুণদা শেষটুকু আর শোনেন না, বলেন, – ঠিক আছে, তোমার টিকিট কেটে ফেলছি। তরুণদার বাড়িতে টিম মিটিং-এ দেখা হয় পুরো দলের সঙ্গে, অর্জুন আর স্নিগ্ধাদি ছাড়া সবাই আমার অপরিচিত। তবু বয়সের ভেদরেখা পেরিয়ে বন্ধু হয়ে যাই সবাই।

শেষপর্যন্ত পাহাড়ের টানে বেড়িয়ে পড়ি। পিছনে পড়ে থাকে ছকেবাঁধা জীবনের রোজনামচা। একে বাইরের দেশ তার ওপর সব মিলিয়ে এগারো দিন, বেজায় ভারি হয়ে পড়ে স্যাক। ৭ অক্টোবর দুগগা দুগগা বলে আমরা দশ জন চেপে বসি মিথিলা এক্সপ্রেসে। সকালে প্রায় আড়াই ঘণ্টা লেট করে রক্সৌল পৌঁছানোর পরই তরুণদা ঝটপট টাঙ্গা ঠিক করে ফেলেন নেপালের বীরগঞ্জ যাওয়ার জন্য। এটাই নাকি নেপাল প্রবেশের একমাত্র বাহন। ভাঙাচোরা ধূলিধূসরিত রাস্তা আর যানজট পেরিয়ে নদীর ওপর ব্রিজ অতিক্রম করে বিদায় জানাই আমার মাতৃভূমিকে। হাতঘড়ির কাঁটাকে নেপালের সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে দিই পনেরো মিনিট।

বীরগঞ্জ পৌঁছে তাড়াতাড়ি কাঠমাণ্ডু যাওয়ার গাড়ি ঠিক করে হাতমুখ ধুয়ে একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট আর লাঞ্চ সেরে ফেলি। ছেড়ে দেয় গাড়ি। পারসা ন্যাশনাল পার্কের ঘন সবুজের বুক চিরে চলে যাওয়া রাস্তা ধরে যেতে বেশ ভালই লাগছিল। আরও কিছুটা যাওয়ার পর শুরু হল পাহাড়ি রাস্তা। তবে শেষের দিকটা রাস্তার বদলে কেবল বোল্ডার আর ধুলো। এদিকে সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত হয়ে এসছে। ক্লান্তি আর বিরক্তি নিয়ে সবাই চুপচাপ বসে আছি। এমন সময় ওপর থেকে দেখা গেল কাঠমাণ্ডু শহরের আলো – চারপাশের পাহাড়ঘেরা এক উপত্যকায় মিট মিট করে জ্বলছে হাজার জোনাকি, অসাধারণ সেই ছবি। এর প্রায় আরও দু'ঘণ্টা পরে গাড়ি এসে থামল থামেল বাজারে এক হোটেলের সামনে।
কাঠমাণ্ডুতে হাসি মুখে স্বাগত জানালেন আমাদের এই ট্রেকিং ক্লাবের আর এক সিনিয়র সদস্য এবং কর্মসূত্রে গত পাঁচ বছর ধরে এই শহরের বাসিন্দা সুকান্তদা। বলতে গেলে আমাদের এই সফরের সব ব্যবস্থাপনা তাঁরই। সুকান্তদা আলাপ করিয়ে দিলেন তার পাশে দাঁড়ানো এক নেপালি যুবকের সঙ্গে - সুবর্ণ শ্রেষ্ঠা, এক এনজিও তে চাকরিসুত্রে ল্যাংটাং ভ্যালি আর গোঁসাইকুণ্ড অঞ্চলে মাঝে মাঝে যেতে হয় তাঁকে। এই সুবর্ণ দাজুই হবেন আমাদের আগামী কয়েক দিনের গাইড। হোটেলে ঢুকে আগে ভালো করে স্নান করি, সারাদিনের রাস্তার ধুলোময়লা আর ক্লান্তি ধুয়ে ফেলে অনেক হালকা লাগে নিজেকে। আগামীকাল আমাদের কাঠমাণ্ডুতে বিশ্রাম আর টুকটাক ঘুরে দেখা। নেপালকে কিন্তু একদমই বিদেশ বলে মনে হয় না আমাদের। স্থানীয়রা সবাই যথেষ্ট ভালো হিন্দি বলেন আর ভারতীয় মুদ্রা চলে সর্বত্র, আমাদের মুদ্রায় একশো টাকা নেপালি মুদ্রায় একশো ষাট টাকার সমান। রাস্তায় চোখে পড়ে প্রচুর ট্রেকিং আর মাউন্টেনিয়ারিং সরঞ্জামের দোকান। সবাই ঠিক করি কাল ট্রেকিং-এর জন্য প্রয়োজনীয় টুকটাক জিনিস কিনব।

পরদিন সকালে উঠে স্নান করে বেরিয়ে পড়ি পশুপতিনাথজীর মন্দিরের উদ্দেশ্যে। পাণ্ডার উৎপাতবিহীন এই মন্দিরে পশুপতিনাথ দর্শন করে মনটা বেশ খুশি খুশি লাগে। পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখি দরবার স্কোয়ার আর আশেপাশের যা কিছু দ্রষ্টব্য। বারে বারে মনে পড়ে যায় ফেলুদা, তোপসে আর লালমোহনবাবুর কথা, সেই ছোটবেলায় কাঠমাণ্ডুর সঙ্গে পরিচয় তো তাঁদের হাতধরেই। শহর ঘুরে মন ভরে না, সবটাই প্রায় বাকি থেকে যায়। দেখা হয় না পাটন কিংবা ভক্তপুর। নিজেকে বোঝাই, আমরা তো নিছক ট্যুরিস্ট নই, আমরা ট্রেকার! ফেরার পথে যদি সময় পাই, তখন না হয় দেখা যাবে।

পরদিন ঠিক সাড়ে ছটায় কুয়াশামাখা এক অস্পষ্ট ভোরে আমাদের মাইক্রোবাস কাঠমাণ্ডু ছাড়ল – গন্তব্য ধুনচে, রসুয়া জেলার সদর শহর, কাঠমাণ্ডু থেকে দূরত্ব মোটামুটি ১৩০ কিলোমিটার। মাঝখানে এক জায়গায় ব্রেকফাস্ট সেরে নেওয়া হল। আরও বেশ কিছুটা যাওয়ার পর দেখা হল ত্রিশূলী নদীর সঙ্গে। এগোতে লাগলো বাস এবং সময়। ত্রিশূলী বাজার পেরিয়ে লাঞ্চ করলাম আমরা। এরই মাঝে চার-চারবার চেকপোস্টে বাস থামিয়ে কীসব কাগজপত্র পরীক্ষা করা হল। এরপর যে রাস্তা শুরু হল সেটা দেখে আঁতকে ওঠার জোগাড়। এবড়ো-খেবড়ো বোল্ডারের ওপর দিয়ে অসম্ভব দুলতে দুলতে এগোচ্ছে বাস, পাশেই নেমে গেছে গভীর খাদ। এক জায়গায় দেখা গেল একটা ট্রাক পড়ে আছে খাদের অতল গভীরে। আমরা কথাবার্তা প্রায় বন্ধ করে শক্ত করে ধরে আছি সিটের হাতল। এভাবে প্রায় ঘণ্টাখানেক কাটল। এরপর আবার এক চেকপোস্ট, এটা ল্যাংটাং ন্যাশনাল পার্কের প্রবেশদ্বার। এবার রীতিমতো যে যার স্যাক খুলে মালপত্র নামিয়ে দেখাতে হল নিরাপত্তা কর্মীদের, দিতে হল প্রবেশ মূল্য। আরও এক কিলোমিটার এগিয়ে যখন ধুনচে পৌঁছালাম, তখন দিনের আলো প্রায় নিভে এসেছে। দশঘণ্টা পর আমরাও একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
কিছু দোকানঘর, বেশ কিছু হোটেল আর গোঁসাইকুণ্ড কিংবা ল্যাংটাং ভ্যালি ট্রেক করতে আসা মানুষজন – এই নিয়ে রসুয়া জেলার সদর শহর ধুনচে। আমাদের অবশ্য বিশ্রাম করার জো নেই। তরুণদা তাড়া লাগান, আমারা নাকি চার কিলোমিটার দূরে এক জায়গায় বিরল রেনবো ট্রাউট মাছের চাষ হয় সেখানে যাব আর একেবারে টাটকা মাছ খাব। অগত্যা হোটেলে স্যাক রেখে কোন রকমে হাতমুখ ধুয়ে গাড়ি করে বেড়িয়ে পড়ি চার কিলোমিটার দূরের উদ্দেশ্যে। ঘুরে দেখলাম এই এই বিরল মাছের প্রজনন কেন্দ্র। পাশের এক রেস্টুরেন্টের ছাদে বসে ঠাণ্ডার মধ্যে গরম কফির সাথে টাটকা রেনবো ট্রাউট মাছ ভাজা মন্দ লাগেনা। তবে মাছের কিলোপ্রতি যা দাম তাতে কলকাতায় খুব ভালো মানের ইলিশ হয়ে যায়। তবে আসল চমকের তখনো বাকি ছিল - ফেরার সময় নাকি হেঁটে ফিরতে হবে পুরো রাস্তা। কী সর্বনেশে কথারে বাবা! সেই সকাল থেকে একটানা জার্নি করেছি, ভয়ঙ্কর রাস্তার ঠেলায় হাত পা সব খুলে আসার জোগাড় হয়েছে, আর এখন যদি এই অন্ধকারে এতোটা রাস্তা ঠ্যাঙাতে হয়! বেজায় বিরক্তি নিয়ে ব্যাজার মুখে হাঁটতে থাকি। আচমকা কাঁধে হাত রাখেন তরুণদা, বলেন - এই হাঁটাটার দরকার ছিল, কাল খুব কাজে লাগবে। একটিমাত্র হেড ল্যাম্পের আলোতে ঘন অন্ধকারে আমরা চলতে থাকি। স্নিগ্ধাদি গান ধরে "আকাশ ভরা সূর্য তারা, বিশ্বভরা প্রাণ ..."। বিদেশ বিভূঁইয়ের অচেনা রাস্তা, নির্জন ঘন অন্ধকার, দূরে জোনাকির মত মিটমিটে আলো জ্বলা ধুনচে শহর, ঝকঝকে তারাভরা রাতের আকাশ... সত্যিই বিস্ময়ে তাই জাগে!

যখন ধুনচে এসে পড়ি, ছোট্ট শহরটা ঘুমোবার আয়োজন করছে। হাতমুখ ধুয়ে একেবারে খেতে বসে যাই। একঘেয়ে নেপালি থালির সাথে দু'টুকরো চিকেন পাতে পেয়ে পুলকিত হই। খাওয়ার পর টিম মিটিং হয়। সবাই যে যার স্যাক গোছাই। কাল সকালেই হবে বহু প্রতীক্ষার অবসান, হাঁটতে শুরু করব গোঁসাইকুণ্ডের পথে। সারাদিনের ক্লান্তিতে শোবার সঙ্গে সঙ্গেই চোখ বুজে আসে।

পরদিন ভোরবেলায় উঠে পড়লাম। জানলা দিয়ে নাম-না-জানা সুন্দর কিছু তুষারশৃঙ্গ দেখা যাচ্ছে। শীতের কামড় একদম নেই। ঝটপট তৈরি হয়ে নিলাম সকলে। রুটি আলুর তরকারি দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে নেমে পড়লাম পথে, সকাল তখন ঠিক আটটা। শরতের সুন্দর সকালে নরম সোনা রোদের মধ্যে এগোতে লাগলাম সবাই। একটু এগোনোর পর বাঁ দিকে একটা মিনারেল ওয়াটার ফ্যাক্টরি পড়ল। এর পর থেকে রাস্তাটা নিচের দিকে নামতে শুরু করল। দূর থেকে কানে আসছে কোনো এক ঝরনার আওয়াজ। চারিদিক সবুজে সবুজ। আর কিছুটা যাওয়ার পর দেখা হল এক নদীর সঙ্গে। এটাই ত্রিশূলী নদী, এর উৎসের দিকেই আমরা যাব। ভারী স্যাকটা নামিয়ে একটু বসি নদীর পাশে। চোখে-মুখে ঠাণ্ডা জল দিয়ে খুব আরাম লাগে। ক্ষণিকের বিরতির পর আবার যাত্রা শুরু। এবার ত্রিশূলী নদীর ওপর ঝুলন্ত সেতু পার করে উল্টো দিকের পাহাড়ে এসে পড়ি।

এরপর থেকে একটানা চড়াই। ঘন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ক্রমশ উঠতে থাকি ওপরে। চলতে চলতে সবাই পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। ঘর্মাক্ত শরীরে নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের সাথে যুদ্ধ করে ঘন্টা দেড়েক চলার পর একটা ছোট হোটেল চোখে পড়ে। চকলেট, ড্রাই ফ্রুটস আর ওআরএস মেশানো জল খেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম। আবার দমফাটা চড়াই পথে হাঁটা শুরু হয়। ধীরে ধীরে চলতে চলতে প্রায় আড়াইটার সময় একটা ছোট্ট সমতল জায়গায় উঠে এলাম। এটাই ২৬২৫ মিটার উচ্চতার দেওরালি। শুনেছিলাম ছ'ঘণ্টায় পৌঁছে যাব আজকের গন্তব্য চন্দনবাড়ি, কিন্তু দেওরালি আসতেই ছ'ঘণ্টা লেগে গেল। আমাদের গাইড সুবর্ণ দাজু সামনের এক পাহাড় দেখিয়ে বললেন ওই পাহাড়ের মাথায় আমাদের উঠতে হবে। চন্দনবাড়ি আর কতদূর জিজ্ঞাসা করাতে সুবর্ণ দাজু হাসি হাসি মুখ করে জানালেন, - "অউর থোড়াসা হায়।" স্যুপ নুডলস দিয়ে দুপুরের খাওয়া সেরে আবার পথে নামলাম সবাই। এবার চড়াই আগের থেকেও বেশি। দু'পা হেঁটে দাঁড়িয়ে পড়তে হচ্ছে, পিঠের স্যাকটাকে জগদ্দল পাথরের মতো মনে হচ্ছে। নিজের নামের প্রতি মর্যাদা দিয়ে তরুণদা চলেন সবার আগে। অর্জুন, সুকান্তদা কিংবা বয়োকনিষ্ঠ টিনটিন এগিয়ে যেতে থাকে ক্রমশ। আমি আর অভিজিৎ ধীরেসুস্থে এগোতে থাকি। কিন্তু প্রাণান্তকর চড়াই যেন আর ফুরোয় না। ওদিকে ঘন জঙ্গলের মাঝে ফুরিয়ে আসে দিন। হাঁপাতে হাঁপাতে এসে পড়ি ডিমসা বলে একটা ছোট্ট গ্রামে। একটা ছোট হোটেলের বারান্দাতে বসি বিশ্রামের জন্য। হোটেলের সাইনবোর্ডে ডিমসার উচ্চতা দেখায় ৩১০০ মিটার। আগের দলটা বোধহয় অনেকখানি এগিয়ে গেছে। আমাদের পিছনে স্নিগ্ধাদি, সঞ্জয়দা সহ চার জন আসছে। এদিকে অন্ধকার ক্রমশ নিবিড় হয়ে আসছে।

বুঝতে পারছিনা পিছনের দলের জন্য অপেক্ষা করব, না অভিজিৎ আর আমি এগিয়ে যাব। শেষ পর্যন্ত ঠিক করলাম একটু অপেক্ষা করি স্নিগ্ধাদিদের জন্য। এখানে এক কাপ লিকার চা এর দাম ভারতীয় মুদ্রায় ৫০ টাকা। সময় কাটানোর জন্য এক কাপ চা কিনে দুজনে ভাগ করে খাই। ওদিকে স্নিগ্ধাদি, সঞ্জয়দার দেখা নেই। হোটেল মালিককে জিজ্ঞাসা করা হল চন্দনবাড়ি আর কতটা, ইনি হাসি হাসি মুখে নেপালিতে যা বললেন তার মানে দাঁড়ায়, - অউর থোড়াসা হ্যায়। এতক্ষণে বুঝে গেছি আমাদের 'থোড়াসা' আরা নেপালি 'থোড়াসার' মধ্যে কয়েক যোজন তফাৎ। উপায়ান্তর না দেখে হাঁটতে শুরু করলাম দুজনে। আমি কিংবা অভিজিৎ কেউই রাতের বেলায় ট্রেক করিনি কখনো। দুজনের কারও কাছে হেডল্যাম্পও নেই, ছোট টর্চই সম্বল। আর কতটা যেতে হবে বুঝতেও পারছিনা। তার ওপর রাতের বেলায় পথ হারানোর ভয়ও আছে। বুকের ভিতরটা কেমন খালি খালি লাগতে থাকে। তবু যত সম্ভব দ্রুত এগোতে থাকি। আলগা পাথর আর ডান দিকে নেমে যাওয়া খাড়া খাদকে পাশ কাটিয়ে নিঝুম অন্ধকারে চড়াই ভেঙে উঠতে থাকি। গাছপালার ফাঁকে মাথার উপর উঁকি দেয় মিটিমিটি তারা, একঘেয়ে সুরে ডাকতে থাকে ঝিঁঝিঁ। হঠাৎ এই গা ছমছমে পরিবেশে এক বাঁকের মুখে চমকে উঠলাম ঘোড়ার খুরের আওয়াজ শুনে। ওপর থেকে তীর বেগে নিচে নেমে আসছে দুটো ঘোড়া। ঘোড়সওয়ারদের চিৎকার শুনে বুঝলাম আমাদের সরতে বলছে। মুহূর্তের মধ্যে অভিজিতকে নিয়ে খাদের কিনারায় এসে দাঁড়াই। একেবারে গায়ের পাশ দিয়ে হুড়মুড়িয়ে উদাসী রাজপুত্রের মতো ঘোড়া ছুটিয়ে নিচে নেমে যান স্থানীয় দুজন। সাক্ষাত মৃত্যুর হাত এড়িয়ে হাপরের মতো শ্বাস নিতে নিতে ভাবতে থাকি, ঘোড়সওয়ারদ্বয় শেষ পর্যন্ত গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে তো! ক্রমে মিলিয়ে আসে ঘোড়ার খুরের শব্দ। বিধ্বস্ত শরীরে কোন রকমে উঠতে থাকি। ঠিক তখনি বহু ওপরে চোখে পড়ে কিছু আলো। কেউ যেন টর্চ জ্বেলে সংকেত দিচ্ছে। বুঝি ওটা তরুণদা বা অর্জুন। আমরাও টর্চের সংকেত দিই। আরও আধঘণ্টা পর এসে পৌঁছাই আজকের আস্তানা চন্দনবাড়ি গ্রাম যার আর এক নাম শিং গোম্ফা। শরীর একেবারে অবসন্ন। ছুটে এসে কাঁধ থেকে স্যাক খুলে নেয় অর্জুন, বাকিরা হাত ধরে বসায় আমাদেরকে। তরুণদা এগিয়ে দেন চায়ের কাপ। মনে মনে ভাবি এই জন্যই তো ট্রেক করতে আসা, এই ভালবাসা, এই সহমর্মিতা আর কোথায় পাব! একটু সুস্থ হয়ে হিসেব করে দেখি আজ সাড়ে দশ ঘণ্টা হেঁটেছি। শুরু করেছিলাম ধুনচের ১৯৫০ মিটার থেকে শেষ করেছি এখানে ৩৩০০ মিটার উচ্চতায়। একদিনে উচ্চতা অর্জন করেছি ১৩৫০ মিটার বা ৪৪৫০ ফুট ! আরও আধঘণ্টা পর একইরকম বিধ্বস্ত অবস্থায় স্নিগ্ধাদিসহ বাকী চারজন এসে পড়ল। সামান্য ডাল ভাত তরকারি মুখে দিয়ে সর্বাঙ্গে ব্যথা নিয়ে শুয়ে পড়ি, বাইরে তখন হাড়কাঁপানো ঠান্ডা।

পরদিন সকালে অনেকটা সুস্থ লাগে নিজেকে। আমাদের হোটেলের ঠিক উল্টো দিকেই একটা ছোট বৌদ্ধ মনাস্ট্রি চোখে পড়ে। প্রাচীন এই মনাস্ট্রির নাম অনুসারেই চন্দনবাড়িকে শিং গোম্ফাও বলে। আজই আমরা ৪৩৮০ মিটার উচ্চতায় গোঁসাইকুণ্ড পৌঁছাব। প্রথম দিকে রাস্তা প্রায় সমতল। দুপাশে গাছের নিবিড় ছায়ায় এগিয়ে চললাম। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর উত্তর দিগন্তে অনেকগুলি তুষারশৃঙ্গ দেখা গেল, সুবর্ণ দাজু সঙ্গে না থাকাতে এদের নাম আর জানা হল না। গাছের আড়ালে এই সব নাম-না-জানা শৃঙ্গের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে পৌঁছে গেলাম চোলাংপাতি। এখানে তিব্বতী প্যানকেকের সঙ্গে মধু দিয়ে চমৎকার ব্রেকফাস্ট সেরে ফেললাম আমরা। কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর এবার হাঁটা শুরু লাওরিবিনার উদ্দেশ্যে। আর গাঞ্জালা পাস।

এবার পথটা পুরোপুরি চড়াই। চলতে চলতে ক্রমে ফুরিয়ে আসে বড় গাছপালা। প্রায় ৪০০০ মিটার উচ্চতায় ভারী স্যাক পিঠে নিয়ে চড়াই ভাঙতে হাঁফ ধরে যায়। দু'পা এগিয়েই দাঁড়িয়ে পড়তে হয় একটু অক্সিজেনের জন্য। বেশ সময় লাগে লাওরিবিনা আসতে। এখানে ২০১৫ সালের নেপালের ভয়াবহ ভুমিকম্পের কিছু নিদর্শন চোখে পড়ে। এক হোটেলে মধ্যাহ্নভোজন সারতে বসি। কিন্তু সেই একই কালো ডাল, শাকপাতা সিদ্ধ আর আলু ছোলার তরকারি আর মুখে রোচে না। একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার পথে নামি। পরবর্তী গন্তব্য ৪২০০ মিটার উচ্চতার বুদ্ধমন্দির। রাস্তা বেশ চড়াই, তবে দূরত্ব খুব বেশি নয়। এখানে বোধহয় এককালে কোন ছোটোখাটো বৌদ্ধ মনাস্ট্রি ছিল, ভূমিকম্পের কারণে এখন আর কিছুই প্রায় অবশিষ্ট নেই। অবশ্য ছোট এক সুন্দর বুদ্ধ মূর্তি আছে। আগে শুনেছিলাম এখান থেকে গনেশ হিমাল এবং পুরো ল্যাংটাং রেঞ্জ সহ প্রচুর তুষার শৃঙ্গ দেখা যায়। কিন্তু নেপালে আসার পর আজই প্রথম দেখি আকাশে মেঘের আনাগোনা। একটু বিরতির পর ফের হাঁটা শুরু। এবার চড়াই অনেক কম, তবে বিকেল দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। আজ আমি, অভিজিৎ আর অর্জুন একসঙ্গে চলেছি। বৃক্ষরেখা শেষ হয়ে গেছে লাওরিবিনাতেই, এখন চারপাশে শুধুই রুক্ষ নেড়া কালো রঙের পাহাড়।

একটা বাঁক ঘুরতেই তিনদিকে পাহাড়ের কোলে, অনেক নিচে একটা ছোট নীল রঙের জলাশয় দেখা গেল। এটি বোধহয় সরস্বতী কুণ্ড। আরও কিছুটা এগিয়ে আরও একটা কুণ্ড, এটা আকারে বেশ বড়। ম্যাপ অনুসারে এটি ভৈরব কুণ্ড। শুনেছিলাম এই এলাকায় নাকি ছোট বড় মিলিয়ে একশ আটটি কুণ্ড বা প্রাকৃতিক জলাশয় আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় আর পবিত্র হল গোঁসাইকুণ্ড। নীল জলের টলটলে ভৈরব কুণ্ডের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে মনে হচ্ছিল আমরা যেন স্বপ্নের ভিতর হাঁটছি। মেঘলা বিকালের মন খারাপকরা আলোতে মায়াবী লাগছে চারপাশ। দেখতে দেখতে কালো হয়ে এল নীল জল -সন্ধ্যা নেমে আসছে। ঠিক তখনই অনেক দূরে কিছু বাড়ি ঘরের টিনের চাল চোখে পড়ল। বুঝলাম গোঁসাইকুণ্ড আর খুব দূরে নেই। হাল্কা চড়াই পথ পেরিয়ে যখন আমাদের স্বপ্নের গোঁসাইকুণ্ডে পৌঁছলাম তখন অন্ধকার নেমে এসেছে আর টিপটিপ বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে, আর সেইসঙ্গে কনকনে ঠান্ডা হাওয়া বইছে। গোঁসাইকুণ্ড দেখা আর পুজো দেওয়া তোলা রইল কাল সকালের জন্য। উঠলাম পাশের এক কাজ চালানোর মতো কাঠের তৈরি হোটেলে। কমবেশি আমরা সবাই ক্লান্ত বিধ্বস্ত। তার ওপর উচ্চতার জন্য গা বমি, মাথাযন্ত্রণা তো আছেই। আজকেও প্রায় দশ ঘণ্টা হেঁটেছি। দুদিনে ১৯৫০ মিটার থেকে ৪৩৮০ মিটার উচ্চতার এই গোঁসাইকুণ্ড উঠে এসেছি। কোনরকমে রাতের খাওয়া সেরে ঢুকে পড়লাম লেপের নিবিড় আশ্রয়ে। সারা রাত একটুও ঘুম হল না, শুধু আমি নই, প্রায় সবারই এক অবস্থা।

কাকভোরে চলে এলাম গোঁসাইকুণ্ডের পাশে। ভোরের স্নিগ্ধ আলোতে চারপাশের পাহাড়ের কোলে সযত্নে বেড়ে ওঠা গোঁসাইকুণ্ড দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। লেকের জল এতটাই নীল, যে মনে হয় তুলি ডুবিয়ে রঙ করা যাবে। ক্রমে পুব আকাশে রঙ ছড়িয়ে পড়ল, পাহাড়ের মাথা ছাড়িয়ে সূর্য উঠল, সকালের সোনা রোদ লুটোপুটি খেতে লাগলো গোঁসাইকুণ্ডের জলে। পাশেই টিনের চালের এক ছোট মন্দির। অধিষ্ঠাতা দেবতা গোঁসাই অর্থাৎ মহাদেব। তাঁর ত্রিশূলের আঘাতেই এই গোঁসাইকুণ্ডের জন্ম, আর এর থেকে উৎপত্তি নেওয়া নদীর নাম ত্রিশূলী। আমরা ধূপ জ্বালিয়ে, কাজু, কিসমিস আর চকোলেট দিয়ে পুজো দিলাম, বসে থাকলাম জলের পাশে পাথরের ওপর। তাড়া লাগান তরুণদা - এবার যে আমাদের ফিরতে হবে, পাড়ি দিতে হবে অনেকখানি পথ। দ্রুত স্যাক গুছিয়ে গোঁসাইকুণ্ডের নীল জলের হাতছানিকে পিছনে ফেলে ফের পথে নামলাম...

~ ল্যাংটাং-গোঁসাইকুণ্ড ট্রেকরুট ম্যাপ ~ গোঁসাইকুণ্ড ট্রেকের আরও ছবি ~

পদার্থবিজ্ঞানের স্নাতক পল্লব চক্রবর্তী পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বাণিজ্য কর দফতরের আধিকারিক।ভালোবাসেন নানা ধরণের বই পড়তে। নেশা ব্যাগ ঘাড়ে করে পরিবারের কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে কাছে বা দূরের ভ্রমণে বেড়িয়ে পড়া। বেশি পছন্দের পাহাড় আর বন। এক সময় দার্জিলিং-এ চাকরি করেছেন বেশ কিছু দিন। সেই থেকে পাহাড়ের সঙ্গে মায়ার বন্ধনে জড়িয়ে পড়া।

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher