চেনা অচেনা হাম্পি
অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়
বিজয়নগর সাম্রাজ্যের কেন্দ্রভূমি হাম্পি দেখার ইচ্ছা ছিল অনেক দিন থেকেই। সেটা দেখার একটা সুযোগ আসতেই তা হাতছাড়া করলাম না। হাম্পির ট্রেডমার্ক বিটঠালা মন্দিরের 'পাথরের রথ'এর ছবি বই আর পত্রপত্রিকায় প্রায়ই প্রকাশিত হয়। এখন আবার ইন্টারনেটের যুগ, তাই এই রথের অজস্র ছবি সেখানেই মিলে যায়।
বিটঠালা মন্দিরের কাছেই উদ্ধার হয়েছে বহু প্রাচীন পোড়ামাটির পাত্রের টুকরো। সম্রাট অশোকের শিলালিপি পাওয়া গেছে নিতুর আর উদে-গোলাম-এ। এই স্থান যে সম্রাট অশোকের সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ছিল তা সন্দেহাতীত।
হাম্পির নাম পম্পা ক্ষেত্র, কিষ্কিন্ধ্যা ক্ষেত্র বা ভাস্কর ক্ষেত্র। তুঙ্গভদ্রা নদীর প্রাচীন নাম পম্পা। রামায়ণে বর্ণিত কিষ্কিন্ধ্যা হাম্পির খুব কাছেই বলে মনে করা হয়। সেকালে এই কিষ্কিন্ধ্যা রাজ্যের রাজা ছিলেন বালি আর সুগ্রীব। বালির কাছে মার খেয়ে সুগ্রীবের ঠিকানা হয়েছিল মাতঙ্গ পর্বত। রামায়ণের কাল থেকেই এই অঞ্চল অতি প্রসিদ্ধ। সাধে কী এই অঞ্চলকে বেছে নিয়েছিলেন শরদিন্দুবাবু 'তুঙ্গভদ্রার তীরে' লিখবার জন্য।
হাম্পি বাসকালে এক সকালে আমাদের গন্তব্য হয়েছিল 'হেমকূট পর্বত'। শীতের সকালের সোনালী আলোয় হেমকূটের ভগ্ন এবং পরিত্যক্ত মন্দিররাজির মধ্যে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে মনটা বার বার পিছনের দিকে ছুটে চলে যাচ্ছিল। চোখে পড়ল একটা বড় পাথরের গায়ে কোন এক অজানা শিল্পী 'রামায়ণের কাল'কে ধরে রেখেছেন। রাম-লক্ষ্মণ-সীতা দেবীর সঙ্গে বীর হনুমান।
পাথরের গায়ে সারিবদ্ধ ভাবে ছোট ছোট গর্ত করা রয়েছে। এই গর্তে তেল আর সলতের সাহায্যে বাতি জ্বালানো হত। দিবাশেষে সূর্যদেব পাহাড়ের আড়ালে অদৃশ্য হলে আঁধার নেমে আসত। জ্বলে উঠত সারি সারি আলো। পাহাড়ের ওপরের এই সারিবদ্ধ আলো নিশ্চয় অনেক দূর থেকে দেখা যেত। তা ভাবতেই মনটা কোথায় যেন হারিয়ে যায়, সেই স্বপ্নরাজ্যে। ভাবি এমনটা কেন আর দেখি না!
সকালের সোনালী আলোয় হেমকূট পর্বতের ওপরে ঘুরে বেড়াতে বড়ই আনন্দ হচ্ছিল। পাহাড়ের ওপর থেকে চারপাশে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। একটা বড় পাথরের ওপর সূর্যের আলো পড়ে পাথরটিকে শ্রীময় করে তুলেছিল। পাথরটির গায়ে হাত ছোঁয়াতেই মনে হল ও যেন বলে উঠল – 'তুমি কি রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের নাম শুনেছ? উনিও মাঝে মাঝে এখানে এসে দাঁড়াতেন। আমার সঙ্গে অনেক কথা হতো। আমি এই পাহাড়ের উপর থেকে অনেক কিছু দেখতে পাই। ওঁকে সে সব কথা বলতাম। কিন্তু উনি বেশি দিন থাকতে পারলেন না।' এই বলে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। আর কোনও কথা শুনতে পেলাম না। আমার এক সঙ্গী এসে পৌঁছাতেই অন্যমনস্ক ভাবটা কেটে গেল। মনে হল স্বপ্নটা যেন ভেঙে গেল।
রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের কথা মনে পড়ল। কুড়ি বছর রাজত্ব চালিয়েছিলেন। পণ্ডিতদের মতে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন কৃষ্ণদেব রায়। তাঁর শেষ জীবনটা অবশ্য বড়ই দুঃখে কেটেছিল। শিশুপুত্রকে যুবরাজপদে অভিষিক্ত করেছিলেন,কিন্তু তার অকালমৃত্যু (বিষ প্রয়োগে) রাজাকে মানসিক ভাবে কিছুটা হলেও অশক্ত করেছিল।
হরিহর ও বুকার হাত ধরে যে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের পত্তন হয়েছিল ১৩৩৬ সালে, তার অনেক পরে সিংহাসনে বসেছিলেন রাজা কৃষ্ণদেব রায় (১৫০৯)। তাঁর রাজত্বকালে পর্তুগাল থেকে একাধিক মানুষ বিজয়নগর এসেছিলেন। তাঁদের একজন ডোমিঙ্গস পেস। রাজা কৃষ্ণদেব রায় কেমন মানুষ ছিলেন, কী ভাবে তাঁর দিন শুরু হত, প্রভাতকালে রাজা কী করতেন, এইসব বিবরণ ডোমিঙ্গস পেস লিখে গেছেন। হাম্পির আর্কিয়োলজি মিউজিয়মে ওঁর লেখার সামান্য কিছু অংশ প্রদর্শিত হয়েছে। এই লেখা পড়লে বোঝা যায় কী অসাধারণ শক্তির অধিকারী ছিলেন রাজা কৃষ্ণদেব রায়।
দিনের আলো ফোটার অনেক আগেই ঘুম থেকে উঠে পড়তেন রাজা। সারা দেহে তেল মেখে কোমর স্বল্পবস্ত্রে আবৃত করে একহাতে খুব ভারী মাটির গদাজাতীয় কিছু নিয়ে অপর হাতে তলোয়ার নিয়ে ব্যায়াম করতেন। শরীর ঘর্মাক্ত হলে একজন কুস্তিগীরের সঙ্গে কুস্তি লড়তেন। তারপর ঘোড়ায় চড়ে তীব্র গতিতে একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত ছুটে বেড়াতেন। ভোর হলে স্নান করে মন্দিরে যেতেন। প্রাত্যহিক দেবার্চনা সমাপন করে তবে রাজসভায় গিয়ে বসতেন। যে মানুষের দিন শুরু হত এমনভাবে তিনি যে অনন্যসাধারণ পুরুষ ছিলেন তা আর বলে দিতে হয় না।
সকালে দুর্গামন্দির, মাতঙ্গ পর্বত ইত্যাদি দেখে তুঙ্গভদ্রা নদী পেরিয়ে অপর দিকে এসে বেশ কিছুটা হেঁটে বিজয় বিটঠালা মন্দিরের দিকে চলেছি। মন্দিরের কাছে পৌঁছতে সকাল পার হয়ে দুপুর গড়িয়ে গেল। বিটঠালা মন্দিরে না ঢুকে পাশের রাস্তা ধরে এগিয়ে চলি কয়েকটা প্রাচীন অথচ পরিত্যক্ত মন্দির দেখবার জন্য।
বিটঠালা মন্দিরের পাশ দিয়ে যেতেই মনে পড়ছিল প্রায় ছশো বছর আগেকার কথা। অসাধারণ সুন্দর এই মন্দিরচত্বরের মূল মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শরদিন্দুবাবুর 'তুঙ্গভদ্রার তীরে' উপন্যাসের নায়ক রাজা দ্বিতীয় দেবরায়। এর অনেক পরে রাজা কৃষ্ণদেব রায় মন্দিরচত্বরে কয়েকটি মন্দির যোগ করেন এবং মন্দিরের বর্তমান রূপ প্রদান করেন বলে জানিয়েছে একটি সূত্র। অবশ্য পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। মুস্কিল এটাই, পণ্ডিতরা কিছুতেই একমত হন না। নানা মুনির নানা মত। তাই আমাদের মতো সাধারণ মানুষের হচ্ছে মুস্কিল। তবে আমরা ধরে নিচ্ছি রাজা দ্বিতীয় দেবরায় বিটঠালা মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।
বিটঠালা মন্দিরকে ডানদিকে রেখে মাটির পথ ধরে সামান্য এগিয়ে গেলেই রাস্তাটি দুটি ভাগ হয়েছে। বাঁদিকের রাস্তাটি কম্পভূপা পথ নামেই খ্যাত। এক পথের শুরুতেই এবং বিটঠালা মন্দিরের উত্তর পশ্চিম কোণে রয়েছে ১৫ ফুট উঁচু একটি পাথরের তুলাদণ্ড। রাস্তাটি ধরে টিলার উপর দিয়ে এগিয়ে গেলেই পৌঁছানো যায় তুঙ্গভদ্রা নদীর কিল্লাঘাটে, ১৩৫২ শকাব্দের বৈশাখ মাসের শেষ বিকালে এখানেই এসে পৌঁছেছিলেন কলিঙ্গদেশের রাজকন্যা কুমারী ভট্টারিকা বিদ্যুৎমালা এবং তাঁর বোন মণিকঙ্কণা। সেদিনের কালবৈশাখীর ঝড়ে এই দুই কন্যার জীবন ওলটপালোট হয়ে যায়। শরদিন্দুবাবুর উপন্যাস পড়ে সেদিনের কাহিনি সকলের জানা।
রাজগুরু আর্য কূর্মদেব রাজার বিবাহানুষ্ঠান তিনমাস পিছিয়ে দিয়েছেন। আর কুমারীদ্বয়কে প্রতিদিন সকালে স্নান সেরে পম্পাপতির মন্দিরে পূজা দেবার নিদান দিয়েছেন। এইসব নানা ঘটনার কথা ভাবতে ভাবতে কম্পভূপা পথের এক প্রান্তে অবস্থিত 'রাজার তুলাদণ্ড'-এর পাশ দিয়ে অনেকটা পথ কখন যে পেরিয়ে এসেছি তা আর বুঝতে পারি নি। সূর্যদেব মাথার উপরে অগ্নিবর্ষণ করছেন। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। পাহাড়ি পথ জনশূন্য। ছোট ছোট ভাঙ্গা মন্দিরগুলি রাস্তার ধারে পড়ে রয়েছে। মন্দিরে আজ আর দেবসেবা হয় না। জন্মেছে আগাছা, ছাদ ভেঙে পড়ছে। এমন একটা মন্দিরে এসে বসে পড়েছি। শরীর আর চলছিল না। একটা স্তম্ভে ঠেস দিয়ে বসেছিলাম। কতক্ষণ জানি না।
শুনতে পাচ্ছিলাম কয়েকজনের কণ্ঠস্বর। তারা আলোচনা করছে রাজগুরু আচার্য কূর্মদেব শ্রাবণ মাসে রাজা দ্বিতীয় দেবরায়ের বিবাহের দিন ঠিক করেছেন। এই কয়েকটা দিন রাজাকে কায়িক পরিশ্রম কম করতে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। রাজপ্রাসাদ ছেড়ে দূরে পরিভ্রমণ না করতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। বিবাহের আগে যেন কোন অঘটন না ঘটে। তাছাড়া রাজাকে তাঁর পছন্দমত খাবার এবং স্নেহজাতীয় খাদ্য বেশি দেওয়া হচ্ছে। যাতে এই কয়েক সপ্তাহে তাঁর স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটে এমনকী কিছুটা ওজন বৃদ্ধি হলেও ক্ষতি নেই। বিবাহের ঠিক পূর্বে রাজাকে তুলাদণ্ডে বসিয়ে রাজভাণ্ডার থেকে এনে সমপরিমাণ রত্ন, মণিমুক্তা, সোনার গহনা ইত্যাদি দিয়ে ওজন করা হবে। সেই রত্নরাজি রাজা দান করবেন পম্পাপতি মন্দিরের পুরোহিতদের। এটাই রাজকীয় রীতি। এই রাজকীয় প্রথার কথা জেনে এতোটাই অবাক হয়েছিলাম যে মুখ দিয়ে কোন আওয়াজ বের হয়েছিল হয়তো।
হঠাৎ মৃদু ধাক্কায় চোখ খুলে দেখি অল্পবয়সী একজন স্থানীয় ব্যক্তি ঝুঁকে পড়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। বলল,কেয়া হুয়া বাবুজি? হাত নেড়ে জানালাম, না, কিছু হয়নি। বুঝলাম,আমি তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম নিশ্চয়। পৌঁছে গিয়েছিলাম রাজা দ্বিতীয় দেবরায়ের কালে। দুঃখ হচ্ছিল রাজার বিয়ের অনুষ্ঠানটা আর আমার দেখা হল না!
হাম্পিবাসের শেষদিনে সকাল-সকালই বের হয়েছিলাম আমরা। গন্তব্য একবারে তুঙ্গভদ্রা নদী পেরিয়ে মাতঙ্গ পর্বত, তবে তার আগে দুর্গাদেবীর মন্দিরে দেবীদর্শন হয়েছে। কিছুটা দূর থেকে পর্বত দেখে যাওয়া হল পম্পা সরোবর। পাশেই লক্ষ্মী দেবীর মন্দির। সরোবরের পাশে অস্থায়ী আস্তানা গেড়েছে অনেক মানুষ। মনে হল রাজস্থানবাসী। পম্পা সরোবরের পাশে ঝোপঝাড়ে তাই পা ফেলাই যাচ্ছে না! সেই সঙ্গে পদ্মগন্ধ!
অটোচালক-কাম-গাইড শ্রীমান ভিজ্জি/বিজ্জু তুঙ্গভদ্রা নদীর ধারে পৌঁছে দিয়ে আমাদের মোটর-চালিত নৌকায় নদী পেরিয়ে কিছুটা হেঁটে বিট্ঠালা মন্দিরের কাছে চলে যেতে উপদেশ দিল। জানাল,রাস্তা ধরে গেলে অনেক সময় লেগে যাবে। আমরাও তাই তুঙ্গভদ্রা পেরিয়ে ওপারে চলে এলাম।
আমার গতি মন্থর, তাই সকলের পিছনে পড়েছি। নজরে এল রাস্তার ধারে ভাঙা মন্দির। সামান্য কিছুটা দূরে সরকারি বাস দাঁড়িয়ে ছিল। সেটি ঘুরে চলে গেল। বুঝলাম এই ফেরীঘাট পর্যন্ত বাস আসে।
রাস্তার ধারে খাকি পোশাকে একজন দাঁড়িয়ে। আমাদের ভাঙা মন্দিরের ছবি তুলতে দেখে কী যেন বলল। হিন্দির সঙ্গে স্থানীয় ভাষার মিশ্রণে খিচুড়ি ভাষায়। আমার বোধগম্য হল না কিছু। মনে হল বলছে,পাশের জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ে কিছু দেখার আছে। পাশে আমাদের এক সঙ্গী ছিলেন। জানালেন,লোকটি বলছে পাহাড়ের গায়ে ভৈরব রয়েছেন। আমি তো এক পায়ে খাড়া!
আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল লোকটি। আমরা চলেছি তার পিছু পিছু। ঝোপঝাড় কাঁটা গাছে ভর্তি জায়গাটি। এবার শুরু হল বড় বড় পাথর টপকানো। বড় পাথরের ওপর ওঠা এই বয়েসে আমার পক্ষে একটু অস্বস্তির তো বটে। তা ছাড়া টাল সামলাতে না পারলে...
বেশ কয়েকটি পাথর টপকে কিছুটা উপরে উঠে দেখতে পেলাম একটি পাথরের গায়ে মূর্তি খোদাই করা রয়েছে। জায়গাটিতে দু-তিন জন দাঁড়াতে পারবে। সেখানে পৌঁছে মূর্তিটিকে ভালো করে লক্ষ্য করছি। হঠাৎ কার যেন কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। মনে হল দূর থেকে কেউ আমাকে ডাকছে মৃদু অথচ গম্ভীর স্বরে। এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে একটু অবাক হলাম। এবার স্পষ্ট শুনলাম, তুই কী ভাবছিস? আমি তোকে ডাকছি।
একটু সাহস পেয়ে জবাব দিলাম, তুমি কি কিছু বলছ? ভৈরব জানাল, এখানে আমি একা পড়ে রয়েছি সেই কত কাল ধরে। কেউ তো আর আসে না। একমাত্র 'বাবু' আমার কাছে মাঝে মাঝে এসে চুপ করে বসে থাকে। সে-ই তোদের এখানে ডেকে নিয়ে এসেছে। বুঝলাম ভৈরব কার কথা বলছে। আর্কিওলজি বিভাগের যে সাধারণ চাকুরে আমাদের এখানে নিয়ে এসেছে ভৈরব তার কথাই বলেছে।
একটা কথা জানার ইচ্ছা হচ্ছিল। নিজেকে সামলাতে পারলামনা। জিজ্ঞাসা করলাম, ভৈরবের পাঁচটা মুখ, মাথায় জটা আর দেহে সাপের অলঙ্কার থাকে। সেসব তো কিছু দেখতে পাচ্ছিনা। উত্তর পেলাম সঙ্গে সঙ্গেই, হ্যাঁ,ঠিক বলেছিস। তুই তো জানিস শিব পঞ্চানন, জটাধারী। আর সারা অঙ্গে সাপ ঘুরে বেড়ায়। তবে যে ছেলেটি আমাকে এখানে এনেছে, সে আমাকে যেমন ভাবে ভেবেছে আমি তাই-ই! বুঝলাম ভৈরব শিল্পীর কথা বলছেন।
আবার বলতে শুরু করল ভৈরব, তখন তো চারপাশ অন্য রকম ছিল। অনেকেই এখানে আসত। আমার ভালো লাগত। একদিন এমন সব ঘটনা ঘটল না, কী আর বলব, সবকিছু পাল্টে গেল। তবে আমি পাহাড়ের আড়ালে রয়েছি,তাই আমার অসম্মান হয়নি। এরপর আর কিছু শুনতে পেলাম না।
বুঝলাম ভৈরব কী বলল। ১৫৬৫ সালের ২৬শে জানুয়ারির কথা, দক্ষিণভারতের সুলতানদের সম্মিলিতভাবে বিজয়নগর আক্রমণের কথা। তালিকোটার সেই যুদ্ধে সেদিন হাম্পিসহ বিজয়নগর রাজ্যের পতন ঘটে। এই ঘটনায় সবকিছু পাল্টে যায়। ধ্বংস করা হয় হাম্পি। মানুষজন এখান থেকে পালিয়ে গেল। মারা পড়ল অনেকে। ভাঙল অনেক দেবালয়। এখন হাম্পি একটি ধ্বংসস্তূপ। দেশবিদেশ থেকে লোকজন এটাই দেখতে আসে।
দেবদেবীর চেহারা বিষয়ে আমি একেবারে অজ্ঞ। পৌরাণিক অভিধান বলছে,পুরাকালে অন্ধকাসুরের সঙ্গে যখন মহাদেবের যুদ্ধ হয়েছিল, তখন অন্ধক মহাদেবের মস্তকে পদাঘাত করলে মস্তক চারভাগে বিভক্ত হয়ে যায় এবং নির্গত রক্তধারা থেকে ভৈরবের জন্ম হয়। এটাই সব নয়। কালিকাপুরাণমতে নন্দী, ভৃঙ্গী, মহাকাল ও বেতাল - এরাও শিবের ভৈরব।
অপরমতে, ভৈরব শিবের একজন পার্ষদ। ব্রহ্মা এবং বিষ্ণু একবার গর্বিত হয়ে মহাদেবকে অপমানিত করলে মহাদেব ক্রুদ্ধ হন। মহাদেবের ক্রোধ থেকে ভৈরবের জন্ম হয়। জন্মানোর পরপরই তিনি দেবতাদের পরাজিত করেন।
এটা ভৈরব কি ভৈরবের মূর্তি নয় সেসব ভাবতে আমার ইচ্ছা হল না। তবে পাহাড়ের গায়ে খোদাইকরা মূর্তিটি দেখে মন ভরে গেল। আর্কিওলজিকাল সার্ভের এই মানুষটি আমাদের এটি না দেখালে কোনোদিন জানতে পারতাম না এই ঝোপঝাড়ের মধ্যে এমন সুন্দর একটি মূর্তি রয়েছে।
হাম্পিতে এসে অনেক অজানাকে দেখা হল। আবার অনেকটাই অজানা রয়ে গেল। তবে যেটুকু দেখলাম সে সব কোন দিনই ভুলতে পারবনা।
প্রাণীবিদ্যার অধ্যাপক অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়ের নেশা বেড়ানো আর ছবি তোলা। বাংলার গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে থাকা চোখের আড়ালে চলে যাওয়া টেরাকোটার মন্দিরশিল্পকে ক্যামেরার দৃষ্টিতে পুনরুদ্ধার করাই তাঁর ভালোলাগা। পাশাপাশি চলে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ভ্রমণ ও অন্যান্য লেখা।