পশ্চিম হুগলী - ঐতিহ্যের খোঁজে

তপন পাল


প্রস্তাবনা
ষাট পেরিয়েছি। শারীরিক সক্ষমতা বা কষ্টসহিষ্ণুতা কমেছে কি না জানিনা, তবে কিঞ্চিৎ কমেছে আত্মবিশ্বাস। আর তার সঙ্গে সমানুপাতিক বেড়েছে আমাকে নিয়ে প্রিয়জনদের উদ্বেগ। তাই হুটহাট করে ট্রেনে বাসে বেরোনো নিষেধ। না বেরোলেই ভাল হয়, তবে যদি যেতেই হয়, গাড়ি নিয়ে সারথি নিয়ে যাও। বাংলায় ল্যাংবোট বলে একটি শব্দ আছে, Long Boat এর অপভ্রংশ এই শব্দটির বাংলা অর্থ 'জাহাজের পিছনে যে নৌকা বাঁধা থাকে' - ব্যঙ্গে নিত্যসঙ্গী অনুচর। ল্যাংবোট নিয়ে বেরোনো মানে বেরোনোর অর্ধেক আনন্দই মাটি, সর্বদা তোমাকে অপর একজনের ইচ্ছা অনিচ্ছা মেনে চলতে হবে। তবু, কী-ই বা আর করা যাবে।

যাত্রা
গরম একটু কমতে, একটু বৃষ্টির পর, জুনের বাইশ তারিখে ভোর ভোর বাড়ি থেকে বেরিয়ে দ্বিতীয় সেতু, সাঁতরাগাছি শলপ পেরিয়ে ডানকুনি। সেখান থেকে বাঁয়ে ঘুরে, রেললাইন আর সরস্বতী নদী পেরিয়ে গুগুলকথিত অহল্যাবাই হোলকার রোড ধরে মশাট খেজুরিয়া পেরিয়ে গজার মোড়। গুগুলমামা বললেও রাস্তায় কোথাও দোকানের সাইনবোর্ডে বা অন্যত্র অহল্যাবাই হোলকার রোড নামটি দেখলাম না। অনেক খুঁজেও মালওয়া রাজ্যের এই রাণীটির (৩১শে মে ১৭২৫ – ১৩ই আগস্ট ১৭৯৫) সঙ্গে এই রাস্তার কোন সম্পর্ক পেলাম না। এর ইতিহাস কারও জানা আছে? জানা থাকলে জানাবেন। গজার মোড় থেকে থেকে কিঞ্চিৎ এঁকেবেঁকে দ্বারহাট্টা; হুগলী জেলার একটি প্রাচীন ও বর্ধিষ্ণু গ্রাম। এখানে আমাদের দ্রষ্টব্য দ্বারিকচন্ডী মন্দির ও অন্যান্য কয়েকটি মন্দির।

দ্বারহাট্টা
দ্বারহাট্টার দ্বারিকচন্ডী মন্দির হুগলি জেলার প্রাচীনতম মন্দিরগুলির অন্যতম, এমনটিই বই পড়ে জানা ছিল। গিয়ে দেখা গেল ধন্য বাঙালির ইতিহাস চেতনা, বছর তের আগে যারা মন্দিরটির সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ করেছিলেন তাঁরাই নিজেদের নাম জাহির করেছেন, বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে মন্দিরের লৌকিক অতীত। পাশে এক শিবমন্দির, সেখানে এক পিসিমা টগর ফুল তুলছিলেন, তাঁকে মন্দিরের বয়স জিজ্ঞাসা করাতে জানালেন তাঁর ওই গ্রামে বিয়ে হয়েছে বাষট্টি বছর হয়ে গেল ('জানোই তো! তখন কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে হত'!), তখন থেকেই তিনি মন্দিরটি দেখছেন। কিঞ্চিৎ ঘাঁটাঘাঁটি করে জানা গেল দ্বারিকাচণ্ডীর পূর্বতন টেরাকোটা অলংকৃত মন্দির মোহিনীমোহন সিংহ রায়ের পূর্বপুরুষ ফতে সিং দ্বারা ১১২৬ বঙ্গাব্দে স্থাপিত। জমিদারবাবু নাকি স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন বর্তমান মন্দিরের দক্ষিণদিকের পুকুরে একটি কাঠামো নিমজ্জিত, তাতে কুশ, গঙ্গামাটি ও গঙ্গাজল দিয়ে প্রতিমা বানিয়ে মন্দির স্থাপন। আশ্চর্যের কিছু নেই, ঠাকুর দেবতারা বড়লোকদেরই স্বপ্ন-টপ্ন দেন, আর গরিবদের দেন দুঃখকষ্ট। পরবর্তীকালে এক পুরোহিত দেবীর অঙ্গহানি করায় মূর্তি বিসর্জন দেওয়া হয়,তারপর থেকে নাকি ঘটেই পূজা হত এবং ঘটের শীষযুক্ত ডাবে দেবীমাহাত্ম্যে অল্পসময়ের মধ্যেই গাছ জন্মে যেত। মন্দিরের বেদীতে শিয়াল প্রস্রাব করাতে মন্দিরটির পুনর্নির্মাণ ও পুনরাভিষেক ১৪১৩ বঙ্গাব্দে। প্রতিষ্ঠাকালে মন্দিরের জন্য যে বাইশ বিঘা জমি ধার্য করা হয়েছিল তার আয় থেকেই নিত্যপূজার খরচ চলে। জমিদার সিংহরায় পরিবার দেবীপূজার দায়িত্বে।

উঁচু ভিত্তিবেদীর উপর প্রতিষ্ঠিত পূর্বমুখী আটচালা রীতির মন্দিরটির বাইরের দেওয়ালে এখন আর কোন টেরাকোটার অলংকরণ নেই; অলিন্দেও যৎসামান্য। গর্ভগৃহের সামনে নাটমন্দির গোছের ঢাকা চত্বর, পিছনে পঞ্চমুণ্ডীর আসন, পাশে দেবীর পুকুর। গর্ভগৃহে নিত্যপূজিতা শ্রীশ্রী দ্বারিকাচণ্ডী চতুর্ভুজা দুর্গা, সঙ্গে লক্ষ্মী,সরস্বতী,কার্তিক ও গনেশ; নেই মহিষাসুর। দুর্গাপুজোর সময় দ্বারিকা চণ্ডীর বলিদান হওয়ার পর চারপাশের দশ-বারোটি গ্রামের পুজোর বলিদান হয়।

সেখান থেকে রাজরাজেশ্বর মন্দির। ১১৩৬ সালে জমিদার সিংহরায় পরিবার কর্তৃক নির্মিত মন্দিরটি বর্তমানে রাজ্য পুরাতত্ত্ব দপ্তরের রক্ষণাধীন। সিংহরায় পরিবার আদতে রাজস্থানের যোধপুরের বাসিন্দা, ষোড়শ শতকে রাজা মানসিংহের বোনের সঙ্গে সম্রাট আকবরের বিবাহে মুসলমানের সঙ্গে কুটুম্বিতা স্থাপনের আতঙ্কে এনারা বাংলায় চলে আসেন। উঁচু ভিত্তিবেদীর ওপর প্রতিষ্ঠিত পূর্বমুখী ত্রিখিলান প্রবেশ দ্বারের আটচালা রীতির মন্দিরটির বহির্গাত্রে অনুপম পোড়ামাটির কাজ, তাতে জলযান ও সেনাবাহিনী, নাবিক ও কামানের সহাবস্থান। গর্ভগৃহের সামনে ঢাকা বারান্দা, সিংহরায় পরিবারের কুলদেবতা রাজরাজেশ্বর হেথায় নিত্যপূজিত। সামনে তিনটে আটচালা রীতির ভগ্নপ্রায় মন্দির, সংস্কারের কাজ চলছে। শ্রমিকরা জানালেন সিংহরায় পরিবারের কলিকাতাবাসী বাবু কাজটি করাচ্ছেন।

হরিপাল
সেখান থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে হরিপাল। আমার এক কাকার নাম ছিল হরি পাল, আর আমার এক মাসির শ্বশুরবাড়ি হওয়ার সূত্রে হরিপাল নামটি ছোটবেলা থেকেই আমার শোনা। তখন ভাবতাম আমার কাকার নামেই জায়গাটার নামকরণ, কাকাও দাবি করতেন পুরো হরিপালটাই নাকি তাঁর। হরিপাল নামে এক সেনাপতি সিঙ্গুরের পশ্চিমে হাটবাজার ও দীঘি-সরোবর শোভিত এক গ্রামের পত্তন করে তার নাম রাখেন হরিপাল। এই হরিপালের কন্যা কানেড়ার বীরত্বকাহিনী ধর্মমঙ্গল কাব্যে বর্ণিত। গৌড়েশ্বর ধর্মপাল কানেড়ার সৌন্দর্য ও সাহসের খ্যাতি শুনে তাঁর পাণিপ্রার্থী, গৌড়েশ্বরের প্রতাপে ভীত হরিপাল কন্যাদানে সম্মতও; কিন্তু বাধ সাধলো কানেড়া, তার পছন্দ ধর্মপালের তরুণ সেনাপতি মহাবীর লাউসেন। সে এক হইহই কাণ্ড। তবে এখন কাকার জমিদারি দেখতে নয় - বিশালাক্ষী মন্দির, চণ্ডালি মার মন্দির, বুড়ো-মার মন্দির আর রায়পাড়ায় মন্দির দেখতেই আমাদের আসা। আর জানেনই তো, হরিপালের দই ব্রহ্মস্বাদসহোদর।

বিশালাক্ষীতলায় প্রাচীন বিশালাক্ষী মায়ের মন্দির। প্রতিমা দ্বিভুজা ত্রিনেত্রা রক্তাম্বরী খড়্গহস্তা বিশালাক্ষী। পায়ের কাছে সবুজ গাত্রবর্ণের বেচারা অসুর গরুচোরের মত বসে। মন্দিরের সম্মুখে নাটমন্দির (নির্মাণ ১৪০৪ বঙ্গাব্দ) পারাবত পুরীষে মোড়া, সেখানেই কয়েকজন ভোগের পটল কাটছেন। দেখে বিশেষ সাহস হল না, যদি এরা ভোগ খেয়ে যেতে বলেন! তাড়াতাড়ি সেখান থেকে হাওয়া। এই মন্দিরটিও শুনেছিলাম অতিপুরাতন, কিন্তু কিছুই উৎকীর্ণ নেই। কয়েক বছর আগে সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ হয়েছিল, তার আগের কোনো কিছু জানার উপায় নেই। একবার ভারতীয় রেলমুগ্ধ সঙ্ঘের বার্ষিক অধিবেশনের জন্য শিয়ালদহ স্টেশনের ইতিহাস লেখায় হাত দিয়েছিলাম। তার জন্য প্রয়োজন ছিল বিভিন্ন নাগরিক পরিষেবা - যথা কলের জল,ডাকবাক্স, ফোনবুথ,ঘোষণার মাইক, বইয়ের দোকান, ওষুধের দোকান ইত্যাদি – কবে থেকে শিয়ালদহ স্টেশনে চালু হয়েছিল তা জানা। জানতে যেখানেই গেছি, কেন জানতে চাইছি তা অতিকষ্টে বোঝানোর পর শুনতে হয়েছিল 'আমি তো এই পোস্টে দু বছর হল এসেছি, তার আগে কী হয়েছে বলতে পারবো না।' এখানেও দেখি সেই অবস্থা।

সেখান থেকে অনেকখানি গিয়ে চণ্ডালি-মার লম্বাটে মন্দির, মন্দির বন্ধ। মনে হল ইনি দশমহাবিদ্যার অন্যতমা মাতঙ্গী নন তো! আবার অনেকখানি গিয়ে বুড়ো-মার মন্দির। বেশ বিস্তৃত মন্দির, নাটমন্দির, প্রাঙ্গণে টগর কামিনী কাঠচাঁপা। পূজা চলছে, বিগ্রহ ফুট দুয়েকের রক্তবর্ণ মাতৃমুখ, তাইতে জ্বলজ্বলে তিনটে চোখ। ইতোমধ্যে এক পশলা বৃষ্টি, আমরা কিছুক্ষণ বসলাম মন্দিরে। জনবিশ্বাসে বিশালাক্ষী-মা, চণ্ডালি-মা ও বুড়ো-মা সহোদরা তিন ভগিনী; একের অদর্শনে অন্যতমা দর্শন অসম্পূর্ণ থাকে।

সেখান থেকে রায়পাড়ার রাধাগোবিন্দ মন্দির কমপ্লেক্সে। রাধাগোবিন্দ মন্দির তখন বন্ধ, দেবতা দিবানিদ্রায়, এবং এই মন্দির কমপ্লেক্সটি পারিবারিক, সাতবাড়ি রায়বংশীয়দের দেবত্র। আমাদের ঘোরাঘুরি করতে দেখে জনৈক প্রস্তাব দিলেন, প্রশান্ত রায়বাবুকে চেঁচিয়ে ডাকুন, তিনি মন্দির খুলে আপনাদের দেখার ব্যবস্থা করে দেবেন। আমার ভরদুপুরবেলা লোককে বিব্রত করতে ইচ্ছা করল না। রাধাগোবিন্দ মন্দিরের পাঁচিলের বাইরে, দক্ষিণদিকে আটচালা দোলমঞ্চ ও তিনটি উঁচু বেদীর উপর আটচালা ধাঁচের একদরজার শিবমন্দির, দুটি পূর্বমুখী, একটি পশ্চিমমুখী। বহির্গাত্রে পোড়ামাটির কাজ ক্ষয়ে এসেছে। তিনটে শিবমন্দিরের দক্ষিণে ওইরকমই আরও একজোড়া পশ্চিমমুখী ভগ্নপ্রায় শিবমন্দির। আরও দক্ষিণে, চালতাতলা ফুলবাগানে ওইরকমই আরও চারটি শিবমন্দির।

আঁটপুর
সেখান থেকে হাজরা মোড়, সরু গ্রামীণ রাস্তা ধরে আঁটপুর। আঁটপুর হুগলি জেলার একটি গ্রাম; নদীর ধারে আটটি গ্রামের - তড়া, বোমনগর, কোমরবাজার, ধরমপুর, আনারবাটি, রানিরবাজার, বিলাড়া ও লোহাগাছি - সমন্বয়ে গঠিত। কথিত ভূরিশ্রেষ্ঠ রাজার আট সেনাপতির নিবাস ছিল এই আট গ্রামে – সেই সূত্রেই বিষখালি নাম বদলে হয় আঁটপুর। অতীতে আঁটপুরে হাওড়া-আমতা-চাঁপাডাঙা-শিয়াখালা রুটের ন্যারোগেজ রেলপথের একটি রেলস্টেশন ছিল। আঁটপুর তার টেরাকোটা মন্দিরের জন্য অতিখ্যাত। মন্দিরগুলি এবং রামকৃষ্ণ-প্রেমানন্দ আশ্রমের জন্য পর্যটকরা এখন আসছেন, গ্রামীণ অর্থনীতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে;তাই গ্রাম হলেও বর্তমানে এটিকে আধা-শহর বলা চলে। এখানকার মুখ্য মন্দির একশো ফুট উঁচু, সাতচল্লিশ ফুট দীর্ঘ ও ঊনচল্লিশ ফুট প্রস্থের ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত রাধাগোবিন্দজিউ মন্দির। মন্দিরটি আটচালা রীতির, সামনের দিকে দোতালা ছাদের সঙ্গে একটি দালান। মন্দিরটির গায়ে অসাধারণ পোড়ামাটির কারুকাজ, মন্দিরের ভিতের ইট নাকি গঙ্গামাটি ও গঙ্গাজলে তৈরি। বিশ্বাস করলাম না কারণ সেখান থেকে নিকটবর্তী গঙ্গা – বালি বা শেওড়াফুলি বা বৈদ্যবাটি - কমবেশি চল্লিশ কিলোমিটার। টেরাকোটার বিষয়বস্তু অষ্টাদশ পুরাণ, মহাকাব্যদ্বয়, ইতিহাস ও সমকালীন বিষয়বস্তু থেকে আহরিত। রাধাকৃষ্ণ, দুর্গা ও চণ্ডী, যুদ্ধের দৃশ্য - অশ্বারোহী, গজারোহী এবং উটারোহী সৈন্য, কামান-বন্দুক, বাদশা এবং সাহেবরাও সেখানে উপস্থিত। মন্দিরটি বর্তমানে কিঞ্চিৎ ক্ষতিগ্রস্ত; তাই নিরাপত্তার কারণে ভিতরে প্রবেশ বন্ধ। এই মন্দিরটির ঠিক সামনেই প্রায় পাঁচশো বছরের পুরোনো একটি বকুলগাছ; বস্তুত এবারে আঁটপুর আসার প্রথমতম ও প্রধানতম উদ্দেশ্য তিনটি অতি প্রাচীন বকুলগাছ সন্দর্শন; বাকি দুটি ক্রমশ প্রকাশ্য। রাধাগোবিন্দজিউয়ের মূল মন্দিরের উত্তরে তিনশো বছরের পুরোনো কাঁঠাল কাঠের খড়ের ছাউনির চণ্ডীমণ্ডপ, শেষ সংস্কার ১৪২৪ বঙ্গাব্দ। চণ্ডীমণ্ডপটি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সংরক্ষিত হেরিটেজ তালিকার অন্তর্ভুক্ত। মূল মন্দিরের সামনের মাঠে চারটি আটচালা ও একটি পঞ্চরত্ন মন্দির, রাসমঞ্চ। রাস্তার ওপারেই মস্ত পুকুর, প্রতিষ্ঠা ১২৮৯ বঙ্গাব্দ, কাকচক্ষু জল। তার ঘাটের সিঁড়ির মুখে দুটো আটচালা মন্দির।

এই পরিবারের আদি পুরুষ কন্দর্প মিত্র কোন্নগর থেকে হুগলি জেলার আঁটপুরে বসবাস শুরু করেন। তিনিই ১৬৮৩ খৃস্টাব্দে পুজো শুরু করেন। আগে পুজো হত খড়ের চালের একটি ঘরে। পরে ১৭৪৭-এ আটচালাটি তৈরি হয়। কন্দর্প মিত্রের পৌত্র কৃষ্ণরাম মিত্র এই পরিবারের অন্যতম কৃতী পুরুষ। তিনি ছিলেন বর্ধমানের রাজা প্রতাপচাঁদ এবং উদয়চাঁদ মহতাবের দেওয়ান। সেই সূত্রে জমিদারিও লাভ করেছিলেন। তাঁর সময় থেকেই এই পরিবারের পুজোর জৌলুস বাড়তে থাকে। আগে আটচালাটির ঠিক সামনে কাঁঠালকাঠের একটি নাটমন্দির ছিল। এক সময়ে ঝড়ে তা ক্ষতিগ্রস্ত হলে আর একটি নাটমন্দির তৈরি করা হয়।

পুরনো প্রথা অনুসারে জন্মাষ্টমীর দিনে প্রতিমা নির্মাণের জন্য মাটি তোলা হয়। এক চালার সাবেক রীতির প্রতিমা ঐতিহ্যবাহী শোলার সাজে পূজিতা হন। শুক্লা প্রতিপদ তিথিতে বোধনের মাধ্যমে পুজোর সূচনা হয়। সে দিন থেকে নবমী পর্যন্ত প্রত্যহ চণ্ডীপাঠ। নবপত্রিকা স্নান সামনের পুকুরে। কৃষ্ণরাম মিত্র তাঁর যাবতীয় সম্পত্তি দেবোত্তর করে দিয়ে গিয়েছিলেন। পুজোয় ব্যয়ভার চলে দেবোত্তর এস্টেট থেকে। আজও অব্যাহত কুমারীপুজো ও কনকাঞ্জলি প্রথা। আর পাঁচটি শিবমন্দির - গঙ্গাধর, রামেশ্বর (বড়শিব), বাণেশ্বর, জলেশ্বর, আর ফুলেশ্বর। প্রতিটি শিবমন্দিরের গায়েই টেরাকোটার কারুকাজ।

মন্দিরটি তৈরি করিয়েছিলেন বর্ধমানরাজের দেওয়ান কৃষ্ণরাম; এবং যথারীতি রায়তদের রক্ত নিংড়ে। আমার হয়েছে এই এক জ্বালা, কোন মন্দির মসজিদ স্থাপত্য দেখতে গেলে তার শিল্পসুষমার চেয়ে তার অর্থনীতির দিকে মন বেশি যায়। আমার তো তাজমহলে গেলেও আজকাল বিরক্ত লাগে। একটা দানব, দাদা থেকে ভাই, ভাইপোকে খুন করাল, নিজের বাপের সমাধি বানাল না; উলটে পিসিশাশুড়ি যখন তা বানালেন সুকৌশলে নিজের মাকেও সেখানে ঢুকিয়ে দিল, মেয়ের প্রেমিককে বধ করল, মেয়ের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হল – তবু দেখো তাকে নিয়ে আদিখ্যেতার শেষ নেই। কার পয়সায় তাজমহল হয়েছিল - তার জেরে শাহজাহানের রাজত্বকালে কতবার দুর্ভিক্ষ হয়েছিল – সে খবর কেউ রাখে না।

বাজার থেকে বাঁয়ে কিছুটা গেলে গৌড়ীয় বৈষ্ণব তীর্থ আঁটপুরের দ্বাদশ গোপাল পরমেশ্বর দাস ঠাকুরের শ্রীপাট। চারপাশে অনেক গাছপালা, যেন তপোবন। এই মন্দিরটির ঠিক সামনেই প্রায় তিনশো বছরের পুরোনো সিদ্ধবকুল; দ্বিতীয় অতি প্রাচীন বকুলগাছ সন্দর্শন।

সেখান থেকে ঘুরে আবার সেই মন্দিরের সামনে দিয়েই শ্রীরামকৃষ্ণ মন্দির। আঁটপুরে বাবুরাম ঘোষের (পরবর্তীকালে স্বামী প্রেমানন্দ) গ্রামের বাড়ি (বাবুরাম ঘোষের দুর্গাবাড়ি; দুর্গাপূজা হত বলে)। নরেন (তখনও বিবেকানন্দ হননি) আটজন গুরুভাই নিয়ে শীতে এখানে বেড়াতে এসেছিলেন। ১৮৮৬ সালের ক্রিসমাস ইভের দিনে, শুকনো পাতা জ্বালিয়ে হাত পা সেঁকতে সেঁকতে তারা যিশুর জীবন নিয়ে আলোচনা করছিলেন। তখনই অগ্নিসাক্ষী করে তাঁরা - নরেন্দ্র (বিবেকানন্দ),বাবুরাম (প্রেমানন্দ),শরৎ (সারদানন্দ),শশী (রামকৃষ্ণানন্দ),তারক (শিবানন্দ), কালী (অভেদানন্দ),নিরঞ্জন (নিরঞ্জনানন্দ),গঙ্গাধর (অখণ্ডানন্দ) এবং সারদা (ত্রিগুণাতীতানন্দ) সন্যাঅভস গ্রহণ করেন। আজ সেখানে হয়েছে ধুনিমণ্ডপ। মণ্ডপের গায়ে নয় সন্ন্যাসীর খোদাই করা মূর্তি। চারপাশে পোড়ামাটির কাজে শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনী বিধৃত। স্বামী প্রেমানন্দের জন্মস্থান এই বসতবাড়ি রামকৃষ্ণ মিশন অধিগ্রহণ করে ১৯৮৬ খৃষ্টাব্দে, গড়ে ওঠে রামকৃষ্ণ-প্রেমানন্দ আশ্রম। ক্রিসমাস ইভের প্রতিবছর অনুষ্ঠান হয়। মিশনের সামনের মাঠে ত্রিভঙ্গমুরারী এক প্রাচীন বকুলগাছ, তৃতীয় অতি প্রাচীন বকুলগাছ সন্দর্শন। পাশে মস্ত পুকুর।

রাজবলহাট
আঁটপুর থেকে ৬ কিমি দূরে রাজবলহাট। অতীতের ভুরশুট রাজ্যের রাজধানী ছিল রাজবলহাট। শনিভানগড়ের রাজা চতুরানন্দ নামের এক ব্যক্তির কাছে পরাজিত হন। চতুরানন্দের নাতি কৃষ্ণ রায় ভুরশুট রাজ্য স্থাপন করেন ১৫৮৩-৮৪ খৃষ্টাব্দে। তার বংশধর প্রতাপ নারায়ণ ছিলেন প্রজাপালক ও দাতা প্রকৃতির রাজা। তার পুত্র শিবনারায়ণ,তস্য পুত্র নরনারায়ণ রায় ভুরশুটে রাজত্ব করেন। নরনারায়ণের রাজত্বকালের শেষে বা তার মৃত্যুর অব্যবহিত পরে বর্ধমানরাজ কীর্তিচন্দ্র ভুরশুট রাজ্য দখল করে নেন। ভুরশুট রাজ্যের রাজধানী রাজবলহাটে তিনটি গড় বা দুর্গ ছিল যদিও বর্তমানে তার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়না। ভুরশুট রাজারা পাঁচশো বিঘা জমি দেবী রাজবল্লভীর মন্দিরের সেবায় দেবোত্তর সম্পত্তি হিসেবে দান করেছিলেন। রাজবলহাট জায়গার নাম দেবী রাজবল্লভীর নামানুসারেই চিহ্নিত। ভূরিশ্রেষ্ঠরাজ রাজা রুদ্রনারায়্ণ রায় এই মন্দির নির্মান করেন ষোড়শ শতকে। পুনঃপ্রতিষ্ঠা ১৩৪০ বঙ্গাব্দের আষাঢ়ে; নাটমন্দিরটির প্রতিষ্ঠা ১৩৪৬-এর মাঘে। মায়ের নবকলেবর ১৩৮৯ বঙ্গাব্দের বৈশাখে। উপর্যুপরি সংস্কারে আজ এই মন্দিরের প্রাচীনত্ব বিলীন। ছয় ফুট উচ্চতার রাজবল্লভী কালীবিগ্রহ শ্বেতবর্ণা, পরনে নীল সবুজ বসন, যেন দেবী রিলায়েন্স। গঙ্গামাটি দিয়ে গ্রহ নির্মিত। ত্রিনয়নী মুণ্ডমালিনী দ্বিভূজা বিগ্রহের ডানহাতে ছুরি ও বামহাতে রক্তপাত্র। কালীমূর্তির ডান পা শায়িত শিবের বুকের ওপরে এবং বাম পা বিরুপাক্ষের মস্তকে স্থাপিত। বিগ্রহটি শ্বেতকালিকা নামেও বিখ্যাত। এই মন্দির চত্বরে রাজবল্লভী দেবীর মন্দির ছাড়াও একাধিক মন্দির রয়েছে - শ্রী ত্র্যম্বকেশ্বর শিবমন্দির, শ্রী সোমেশ্বর শিবমন্দির, শ্রী রাজরাজেশ্বর শিবঃ ও শ্রী নন্দীশ্বর শিবমন্দির ও শ্রী বাণেশ্বর শিবমন্দির। সঙ্গে মূর্তিমান রসভঙ্গ ট্র্যাফিক কিয়স্কের ধাঁচের, মন্দির চত্বরের স্থাপত্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ সাযুজ্যবিহীন ভাবে একটি অর্বাচীন শিবমন্দির। আর রয়েছে মায়ের পুকুর। মন্দিরে রোজ ভোগ খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। তার জন্য সকাল আটটা থেকে দশটার মধ্যে পঁচিশ টাকা দিয়ে কূপন কাটতে হবে। ভোগ খাওয়া শুরু দুপুর দুটো থেকে।। অন্যতম শাক্তপীঠ হিসেবে পরিগণিত। আমরা যখন গেলাম তখন লোকের ভিড়ে ছয়লাপ, হইহই করে পুজো চলছে। মন্দিরের বহির্গাত্রে লোকজন তাদের ছেলেপিলের রঙিন ছবি টাঙিয়ে দিয়েছে।

রাজবলহাট মন্দিরের লাগোয়া রাজবলহাট দিঘির পাশেই মতিঝিল। পাঁচ বিঘার শতাব্দীপ্রাচীন ওই জলাশয় ব্যবহার করছিলেন আশপাশের চার -পাঁচটি মৌজার মানুষ৷ সেই জলাশয়ের সঙ্গে ডিভিসির সংযোগ রয়েছে। কিছুদিন আগেও ডিভিসির জল ওই জলাশয় দিয়ে প্রবাহিত হত। রাজবলহাটে একাধিক প্রাচীন টেরাকোটা মন্দির আছে যার মধ্যে আঠেরো শতকে তৈরি রাধাকান্ত, মতান্তরে রাধাগোবিন্দ মন্দির ও শ্রীধর দামোদর মন্দির (শেষ সংস্কার ১৪০১ বঙ্গাব্দ) দেখার মত। মন্দির দুটিই শীলবাটির শীলেদের পারিবারিক, এবং পারিবারিক বাসস্থানের মধ্যে। এখানে অমূল্য প্রত্নশালা নামে একটি সংগ্রহালয় আছে। কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও বাঙলার তালমিছরি শিল্পের জনক দুলাল চন্দ্র ভড়ের বাড়িও রাজবলহাট। রাজবলহাটের রসগোল্লা দেবপ্রতিম।

ফুরফুরা শরিফ
রাজবলহাট থেকে জাঙ্গিপাড়া হয়ে কানা দামোদর পেরিয়ে ফুরফুরা শরিফ পনের কিলোমিটার, আধ ঘণ্টার পথ। পথে পড়ল রাসপুর, ও এন জি সি এখানে তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের অনুসন্ধান চালাচ্ছিলেন, না মেলায় সব ছেড়েছুড়ে দেশ ছেড়েছেন। পড়ে আছে বাড়িঘর। মনে পড়ল গতবছর এই সময়েই অশোকনগর পুরসভার ২২ নম্বর ওয়ার্ডের বাইগাছি এলাকায় ও এন জি সির প্রাকৃতিক গ্যাস অনুসন্ধান দেখতে গিয়েছিলাম।

ফুরফুরা শরীফের হজরত দাদাপীর সাহেব ছিলেন একজন সুপ্রসিদ্ধ ইসলামি পণ্ডিত ও ধর্মগুরু। তিনি ধনী-দরিদ্র, হিন্দু-মুসলিম, জাতিধর্ম নির্বিশেষে তৎকালীন বাংলা ও অসমের বহু মানুষকে নিজের মুরিদ বা শিষ্য করেছিলেন। তাঁর দীর্ঘ আভিজাত্যপূর্ণ চেহারা ও অসাধারণ ধর্মীয় পাণ্ডিত্য সমকালীন জ্ঞানীগুণী থেকে সাধারণ মানুষদের তীব্র আকর্ষণ করত। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই মার্চ শুক্রবারে প্রায় একশ বছর বয়সে দাদাপীর সাহেব ইন্তেকাল বা দেহরক্ষা করেন। তাঁর মৃত্যুর দিনটিকে কেন্দ্র করে তাঁর সমাধি-দরগাহে প্রতিবছর বাৎসরিক উৎসব ও মেলা বসে বাংলা বর্ষপঞ্জীর ফাল্গুন মাসের ২১, ২২ ও ২৩ তারিখ। ফুরফু্‌রায় অসংখ্য ওলি, গাউস, কুতুব, আবদাল, মাওলানা, মৌলভি ও আলিমে দ্বীন সুফি সাধকের মাজার শরিফ আছে।

প্রত্যাবর্তন

ফেরার পথে ফুরফুরা শরীফ থেকে শিয়াখালা, সেখান থেকে মশাট হয়ে পুরনো রাস্তাতেই ডানকুনি। এই রাস্তাতেই কলকাতা যাওয়ার পথে ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মাইলস্টোন দেখে ইংরাজি সংখ্যা শিখেছিলেন। তাঁর স্মরণে গাড়ি থেকে নেমে কিছুটা পথ হাঁটা হল। নিবেদিতা সেতু পেরিয়ে পরিশেষে বাড়ি ।

পথনির্দেশ
কিভাবে যাবেন? হাওড়া থেকে আরামবাগ/ তারকেশ্বর/ হরিপাল/ তালপুর লোকাল ধরে হরিপাল স্টেশনে নেমে ১০ নম্বর বাসে অথবা সুকান্তপার্কগামী ট্রেকারে আঁটপুর মঠ। অথবা হরিপাল স্টেশন থেকে ৯ বা ৯এ বাসে তড়ার মোড় স্টপেজে নেমে পাঁচ মিনিট হেঁটে। ওই একই বাস/ট্রেকারে দ্বারহাট্টা (রামহাটিতলা স্টপেজ) যাওয়া যায়। কোলকাতা থেকে নিজস্ব গাড়িতে এলে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে সিঙ্গুর। সেখান থেকে বাঁদিকে ১২ নম্বর বাস রাস্তা ধরে (তারকেশ্বরমুখী) মালিয়া পার্ককে বাঁদিকে ফেলে একটু এগোলেই গোপীনগর চৌমাথা থেকে বাঁ দিকে দু কিমি এগোলেই হরিপাল। হরিপাল থেকে ৯-১০ বাস রাস্তা হয়ে আঁটপুর। আবার ডানকুনি থেকে ২৬ নম্বর বাস রাস্তা ধরে চণ্ডীতলা-মসাট-শিয়াখালা পেরিয়ে গজার মোড়। গজার মোড় থেকে বাঁ-হাতে ৯-১০ বাস রাস্তা ধরে আঁটপুর। দ্বিতীয় হুগলী সেতু পেরিয়ে বম্বে রোড ধরে সলপ। সলপ থেকে বাঁ দিকে ডোমজুড়-বড়গাছিয়া-জাঙ্গিপাড়া হয়ে আঁটপুর। এবার আপনার ইচ্ছে...

কেনাকাটা
আর হ্যাঁ! ধনেখালি তাঁতের শাড়ি কিনতে হলে দ্বারহাট্টা/আঁটপুর/রাজবলহাটে সরাসরি তাঁতির বাড়ি চলে যান,ঘরে ঘরে তাঁত চলছে, রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে শুনতে পাবেন ঘরে ঘরে তাঁত চলার টকাটক আওয়াজ। অভাবনীয় কম দামে মিলতে পারে আপনার পছন্দের গামছা বা শাড়িটি। চা মুড়িও জুটতে পারে। ধনেখালি তাঁতের আসল আঁতুড় ঘর হল রাজবলহাট।

আহার
পরিশেষে আহার। রাজবল্লভী মায়ের ভোগ বা আঁটপুর রামকৃষ্ণ মিশনের ভোগ খেয়ে নিন। মধ্যে মধ্যে নিরামিষ খাওয়া ভাল।

লেখাটির এমন নাম দেওয়ার কারণ হুগলী বলতে আমরা সাধারণত হুগলী নদীর তীরবর্তী উত্তরপাড়া থেকে বৈঁচি অবধি বুঝি, বড়জোর গুড়াপ থেকে ডানকুনি। তার পশ্চিমে বিস্তৃত যে হুগলী - তারকেশ্বর পুরশুড়া আরামবাগ খানাকুল গোঘাট... তা আমাদের কাছে অনেকখানিই অচেনা।

হিসাবশাস্ত্রের স্নাতকোত্তর শ্রী তপন পাল West Bengal Audit & Accounts Service থেকে অবসর নিয়েছেন সম্প্রতি। তাঁর উৎসাহের মূলক্ষেত্র রেল - বিশেষত রেলের ইতিহাস ও রেলের অর্থনীতি। সে বিষয়ে লেখালেখি সবই ইংরাজিতে। পাশাপাশি সাপ নিয়েও তাঁর উৎসাহ ও চর্চা। বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি এবং ইন্ডিয়ান রেলওয়ে ফ্যান ক্লাবের সদস্য শ্রী পালকে বাংলা লিখতে শিখিয়েছে 'আমাদের ছুটি'। স্বল্পদূরত্বের দিনান্তভ্রমণ শ্রী পালের শখ; কারণ 'একলা লোককে হোটেল ঘর দেয় না'।

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher