ধারাবাহিক ভ্রমণকাহিনি - প্রথম পর্ব
কেদার ভ্রমণের বুকলেট
অভিষেক ব্যানার্জি
~ কেদারের আরও ছবি ~
#যা_দেখি_তাই_লিখি
#পর্ব_১
#রাজধানী_এক্সপ্রেস
#যাত্রা_শুরু
দু'বছর পর আবার রাজধানী চাপলাম। কায়দাকানুন পাল্টেছে অনেক। ছ'জন মিলে ল্যাদ খাচ্ছিলাম,সাথে নিজেদের খিস্তিও। ছ'টা বার্থ আমাদের। পাশের সাইড লোয়ারে এক ভদ্রলোক। অবাঙালি। পুরোদস্তুর খানদানি মুসলমান যাকে বলে। ইন্দ্র নাম দিল তার শাজাহান। তিনি দিব্যি খাওয়ার সময় খেলেন, বাকি সময় ঘুমোলেন আর সকালে উঠে উর্দু রাকাত শুনলেন মোবাইলে। সাইড আপারের ছেলেটি কমবয়সী। তালগাছ লম্বা। কিন্তু ওর ডবল ওজনের দুটো ট্রলি। রাখার জায়গা পায়নি। সিটের তলা ভর্তি। চ্যানেলে রাখার জন্য জাম্বো সাইজের গম্ভীর টিটির কাছে উত্তাল খিস্তি খেয়ে শেষে নিজের বার্থে তুলে দ-এ কমা হয়ে শুল। আমরাও ক'হাত টোয়েন্টি নাইন খেলে বোর হয়ে গেলাম। জয়দীপ আমাকে ব্রিজ শেখানোর ব্যর্থ চেষ্টায় বিফল হয়ে বউকে ফোন করায় মন দিল। রাতে ননভেজ খানা অর্ডার দেওয়া হয়েছে। সন্ধ্যের স্ন্যাক্স-এ একটা কাপকেক, একটা ছোট পপকর্ণের প্যাকেট আর একটা তেলতেলে সিঙ্গাড়া জুটেছিল। সঙ্গে চা। মাঝখানে বিখ্যাত কাঠি আর স্যুপ উধাও। আটটায় ডিনার দিল। খিদে নেই। সাড়ে আটটা নাগাদ এবার না খেলে রুটি চামড়া হয়ে যাবে ভেবে শুরু করলাম। মন্দ না হলেও রাজধানীসুলভ নয়। খানতিনেক রুটি, ডাল, আলু-গাজর-বিন-মটরশুঁটি ভাজা, প্লেন ভাত আর চিকেন কষা। আর প্যাকেটের আচার। ওহ, টক দইও ছিল। পরে ন'টা নাগাদ এককাপ করে ভ্যানিলা আইসক্রিমও জুটল।
সকালে ব্রেড ওমলেট আর চা খেয়ে পঞ্চান্ন মিনিট লেট করে আপাতত দিল্লি। ওয়েটিং রুম। আবার ট্রেন সাড়ে তিনটেয়, দেরাদুনের জনশতাব্দী। গন্তব্য হরিদ্বার।
#যা_দেখি_তাই_লিখি
#পর্ব_২
#ওয়েটিংরুম
#হঠাৎ_দেখা_আগন্তুক
ওই যে কথায় আছে না কার সঙ্গে কখন কীভাবে দেখা হয় কেউ জানে না। তো ওয়েটিং রুমে ওয়েট করতে করতে আগের পর্ব শেষ করেছিলাম। তারপর হল জল পর্ব। সৌনিপ আর আমি দুজনে গিয়ে ওয়াটার ATM থেকে পাঁচ টাকা লিটার জল ভরে আনলাম। তারপর সে, জয়দীপ, ইন্দ্র আর দেবজিৎ গেল যন্তরমন্তর দেখতে। আমি আর সুদীপ রইলাম ব্যাগ পাহারায়। বেজায় ভিড় এসি ওয়েটিং রুমে। বাচ্চা কাঁদে,সদ্যকিশোরী হাফপ্যান্ট পরে ন্যাকামি করে মায়ের সঙ্গে,দুজন এসে মেঝেয় চাদর পেতে আরেকটা গায়ে চাপিয়ে মাথামুড়ি দিয়ে ঘুমোতে শুরু করে। টয়লেটের পাশে বসে একজন দিব্যি ল্যাপটপে পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশন বানায়,এক বৌদি আরেক দাদার সঙ্গে আমার বর খাবার আনতে গেছে এক্ষুনি আসবে এই সিটে বসবেন না বলে ঝামেলা লাগায়,আর তার বর তাড়াতাড়ি করে খাবার আনতে গিয়ে পাশের লোকের ট্রলিতে হোঁচট খেয়ে ডাল ফেলে দেয় মেঝেয়। এইসব দেখতে দেখতে সময় কাটে। ওরা এসে যায়। পালা করে খেতে যাই। জঘন্য ১ নং প্ল্যাটফর্মের খাবার জায়গাটা। কোনমতে তিনটে রুটি ডাল, আলুর তরকারি আর শাহী পনীরের নামে ঝোলে তাকিয়ে থাকা কাঁচা পনীর খেয়ে ফিরে আসি।
হঠাৎ টুং করে মেসেঞ্জারে মেসেজ রুমাদির। ওরা ঋদ্ধর সাথে বাগিনী ট্রেক করে ফিরছে। ঋদ্ধরা আগেই ফিরছে দুনে। রুমাদিরা দিল্লি হয়ে। দেখা হল। নাকতলা-গড়িয়ার প্রতিবেশীর দেখা হাজার কিমি দূরে। অবাক করল কুঁচো বন্দুকবাজ স্মার্ট ছানাটি। তার সোজাসুজি প্রশ্ন - তোমার নাম কী? আমরা বাগিনী গেছিলাম। আমরা কেদার যাচ্ছি শুনে সে বলল গত বছরই ঘুরে এসেছে। তাই তাকে কোলে নিয়ে চারপাক ঘুরিয়ে দিলুম। কী ভালো লাগে এই কুঁচোগুলোকে দেখলে। একটা ঈদের চাঁদ যেন আস্তে আস্তে এগোচ্ছে পূর্ণিমার দিকে। হ্যাটস অফ অগ্নিম, হ্যাটস অফ কমা তোকে, তুই বড় হয়ে দাঁড়ি হ', আশীর্বাদ করি।
তারপর আর কী। লাগেজ টেনে ১ থেকে ১১ নম্বরের দিকে যাত্রা। জনশতাব্দী ধরা আর মাত্র আধাঘন্টা লেটে হরিদ্বার। হোটেলে একটু ল্যাদ আর বেরিয়ে রুটি তরকারি গিলে আজকের মত ইতি। কাল ভোরে রওনা গৌরীকুণ্ডের উদ্দেশ্যে।
জয় কেদার!!
"এখানে ওখানে পড়ে থাকে মুহূর্তেরা
নুন ছিটিয়ে চেখে নেয়া ধুধু,
আমার তোমার পা আঁকা রাস্তায়
দায় আছে ছায়া ধরার শুধু।"
#যা_দেখি_তাই_লিখি
#পর্ব_৩
#মিসিং_ডায়রি
#বড়া_লেট_হো_গিয়া_সাহাব
"ম্যায় দুনিয়া ভুলা দুঙ্গা তেরি চাহত মে..."
ভান্ডারীজির মিউজিক সিস্টেমে গাঁতিয়ে বাজছে শানুদা। সুদীপ পেনড্রাইভ বাড়িয়ে দিতেই মুচকি হেসে উনি বললেন "ইয়েওলা আচ্ছা হ্যায়"। নর্থইন্ডিয়ায় এসে নিরিমিষ খেয়ে মুখ পচে যাওয়ায় শ্রীনগর ঢোকার মুখে আমরা ধোসা খেলাম ব্রেকফাস্টে। আজ পালা নেমে যাওয়ার হরিদ্বারে। আপাতত গন্তব্য দেবপ্রয়াগ হয়ে হৃষিকেশ। একটু সময় কাটিয়ে ব্যাক টু প্যাভিলিয়ন। অনেক কথা বলার। পরে বলছি এক এক করে।
#যা_দেখি_তাই_লিখি
#পর্ব_৪
#রইল_ঝোলা_চলল_ভোলা
বহুদিন পর পাহাড়ে বেরিয়েছি। দিলে গরম ডালমুট ভাজা খাওয়ার আনন্দ। সকালে কুত্তাশোঁকা ভোরে কালি চা খেয়ে যাত্রা শুরু করেছি। বোলেরো বলের মত (ঠিকই লিখলাম) এগিয়ে চলেছে ভান্ডারীজির হাত ধরে। দেখতে দেখতে হৃষিকেশ পার। রাস্তায় চারধাম প্রজেক্টের কাজ চলছে। ফোরলেন হাইওয়ে হবে। গাড়ি সব উড়বে সঙ্গে আমরাও।
ব্যাসীর একটু আগে একটা ব্রেক। একটা মনমাতানো ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে, সঙ্গে গরম মধুর মত সূর্য। আরেকটু এগিয়ে ভান্ডারীজি গাড়ি থামালেন যে রেস্টুরেন্টে খাওয়ার জন্য, দেখেই আমি আর ইন্দ্র লাফিয়ে উঠলাম। গতবার পাঙ্গারচুলা করার সময় এটাতেই খেয়েছিলাম। পুরানি ইয়াদেঁ তাজা হো গয়ি। সঙ্গে হো গয়ি বেশ কিছু সেলফি। একটা সাউথের বয়স্কদের টিম খাচ্ছিল। তার লিডার ভদ্রলোকের ভুঁড়ির কাছে আমার ভুঁড়ি ব্রণের চেয়ে বেশি কিছু না। আমার পাশের টেবিলে বসে চার পিস ভেজ ক্লাব স্যান্ডউইচ, চারটে পুরী, একটা আলুর পরোটা, দুটো ডিমের ওমলেট আর এক কাপ কফি খেয়ে উঠলেন।
আরেকটু এগোতে এল দেবপ্রয়াগ। আমাদের মধ্যে দেবজিৎ এই প্রথম আসছে উত্তরাখণ্ড। ওকে দেখে হিংসে হচ্ছিল। ও প্রথম দেবভূমির হাওয়া মাখছে। প্রথম দেখছে অনেক নীচের শ্যাওলাপড়া কাঠের জ্বালদেওয়া ধোঁয়া কুন্ডলি পাকিয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে সবুজের গায়ে। প্রথম নিচ্ছে দেবভূমির গন্ধ। অবাক চোখে জানালার বাইরে তাকিয়ে বারবার বলছে "হেব্বি ভাই হেব্বি"। আর আমরা পারলেই ওর পিছনে যে যার মত জ্ঞানভর্তি মিসাইল গুঁজে দিচ্ছি আর খিস্তি খাচ্ছি। এই করতে করতে এল রুদ্রপ্রয়াগ। এখানে লাঞ্চ করে আবার গাড়িতে উঠলাম। দুপুর গড়িয়ে আসছে আস্তে আস্তে। বাইপাসের ধুলো মাখতে মাখতে এগিয়ে চললাম শোনপ্রয়াগের দিকে।
গুপ্তকাশীকে বিদায় জানিয়ে যখন শোনপ্রয়াগের দিকে এগোচ্ছি ডানদিকে কেদারশৃঙ্গ উঁকি দিল। ঠান্ডা বাড়ছে। আলো কমছে। যত আলো পড়ে আসে তত মায়া বাড়ে হিমালয়ের। ফুলহাতা সোয়েটার আর উত্তরাখণ্ডি শাড়িপড়া হাজার বলিরেখার কোনো মহিলা কাপড় তুলে নিয়ে যাচ্ছে ঘরে, হেডলাইট জ্বলতে শুরু করেছে গাড়ির। শোনপ্রয়াগের একটু আগে হঠাৎ গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল।
সামনে বিরাট এক জেসিবি ধসে যাওয়া পাথর তুলছে ট্রাকে। পনেরোমিনিট পর রাস্তা ক্লিয়ার হল। আমরা এগোলাম শোনপ্রয়াগের দিকে। গৌরীকুণ্ড যাওয়ার শেষ জিপ পাবো কিনা ভাবতে ভাবতে অন্ধকারকে কোলে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়া জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে রইলাম চলন্ত গাড়ির জানলা থেকে। ভান্ডারীজির মিউজিক সিস্টেমে তখন বাজছে..."আজ ফির তুমপে প্যার আয়া হে/ বেহদ অর বেশুমার আয়া হে..."
"তোমার নির্লিপ্ত তাকিয়ে থাকাটা দিও
আমি আমার জানলা তোমায় দেব,
বিনিময় প্রথায় দেনা পাওনা চলুক
যতদিন না দেখার ভারসাম্য হয়।"
#যা_দেখি_তাই_লিখি
#পর্ব_৫
#এবার_কান্ড_কেদারনাথে-১
#ভুঁড়ি_হাঁটু_চচ্চড়ি-১
তো অন্ধকারের মুখে মুখে আমরা পৌঁছলাম শোনপ্রয়াগ। ২০১১তে দেখা শোনপ্রয়াগের সঙ্গে এর কোন মিল নেই। মাঝে ফাটাতে গাড়ি দাঁড় করিয়ে কেদারনাথ এর ফ্রি পারমিশন করিয়ে নেয়া হয়েছে। QRকোড দেওয়া যাত্রী ইনফো এখন সরকার থেকে রাখা হয়, সঙ্গে গাড়ির নাম্বারও। যাতে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে প্রশাসন বুঝতে পারে। একটা আইডি কার্ড লাগে শুধু। যদিও এই কার্ড গোটা যাত্রাপথে কোথাও দেখতে চাওয়া হয় না।
ভান্ডারীজি একে একে আমাদের ধূলিধূসরিত স্যাক নামিয়ে রাস্তা দেখিয়ে দিলেন। এরপর জনপ্রতি কুড়ি টাকা সরকারি ভাড়াওলা ট্যাক্সি ধরে গৌরীকুণ্ড যেতে হবে। এদিকে কারেন্ট অফ। অন্ধকার কানের কাছে ফিসফিস করে বলছে তোরা যেতে পারবি না। এখানেই থাকা করিয়ে তোদের কাল লেট করাব, একদিন খাবো। আমরা তার কুৎসিত ভয় দেখানোকে ইগনোর করে এগিয়ে গেলাম একমাত্র দাঁড়িয়ে থাকা বোলেরো ট্যাক্সির দিকে। আমরা ছ'জন ছাড়াও আরো পাঁচজন লোক। জায়গা নেই। তবু ড্রাইভার বলেই যাচ্ছে হো জায়েগা। একে একে সবাই বসে পড়ল। পিছনে চার জন,মাঝে আমাদের চার জন তবু বাকি তিন। সামনে তিন প্লাস ড্রাইভার। দুই হুমদো বসে গেল সামনে। আমাকে বলে ড্রাইভারের পাশে বসতে। আমি বসলাম ড্রাইভারের সিটেই। ড্রাইভার অটোর মত বোলেরো চালাবে ভেবেছিল কিনা জানিনা, বসে দেখে তার দোকান আঁটছে না আর দরজাও লাগছে না। অগত্যা জোর করে এক লোকালকে নামিয়ে দিল। আমি বসলাম গিয়ার হ্যান্ডেলের দুদিকে পা করে। ৫ কিমি দূরত্ব নির্বিঘ্নে পৌঁছে গেলাম। তারপর একটা জবরদস্ত উঁচু সিঁড়ি টপকে প্রায় একখানা অ্যাক্লিমাটাইজেশন হাঁটা দিয়ে জি এম ভি এন (গাড়োয়াল মণ্ডল বিকাশ নিগম)-এর গেস্টহাউসের সুন্দর কামরায় সেঁধিয়ে গেলাম। কাল থেকে হাঁটা শুরু।
ঠান্ডা মাঝারি থেকে কড়ার দিকে। ১০ কি ১১℃ হবে। জমজমাট গৌরীকুণ্ড এখন আগের দিনের ছায়া শুধু। ছেড়ে আসা সাপের খোলসের মত পড়ে আছে। ভিড় নেই। কারো তাড়াও নেই। রাতে রুটি ডাল আর গ্যাস হবার ভয়ে ফুলকপি না নিয়ে লাউয়ের অখাদ্য ঘ্যাঁট খেয়ে স্যাক গুছাতে বসলাম। ছোট ব্যাগে অদরকারি জিনিস রেখে ক্লোকরুমে দেওয়ার ব্যবস্থা করে শুতে গেলাম। উত্তেজনায় ঘুম আসছে না। হাহা হিহিও চলছে। সঙ্গে পিছনে লাগাও। জানলার কাচ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে কনডেন্সড ভেপার। আমাদের মনও ভেপোরাইজড হচ্ছে ধীরে ধীরে। কাল আবার হাঁটব স্বপ্নের পথে বছর সাতেক পর। চোখ গড়িয়ে নেমে আসছে ঘুমের খিদে,শুয়ে পড়লাম এগরোলের মত কম্বল জড়িয়ে।
সকাল হল সকালের মতোই অ্যালার্মের শব্দে। ভোর ছ'টায় বেরোনো ঠিক হয়েছিল। বেরোলাম ৬.২৫-এ। রোদ তখনো মাটি ছোঁয় নি। আমরাও আলাভোলা সকালের ঠান্ডা মাখতে মাখতে এগিয়ে চললাম সিঁড়ি ভেঙে। রাস্তার ধুলো,পড়ে থাকা পাতা, চা দোকানের ত্রিপল,সাইনবোর্ড,খাবার কুড়োতে বেরোনো কুঁচো পাখির দল, খচ্চরের শুকনো গু,স্যাঁতসেঁতে পাথর,শিশিরে চোবানো ঘাস,ঘন্টা বাজিয়ে পাশ কাটানো খচ্চর আর একটানা ধুপধুপ শব্দকরা পায়ের আওয়াজ আমার সঙ্গে চড়াই ভাঙতে লাগল। কান ঘেঁষে এক পশলা রোদ বেরিয়ে গেল একটা বাঁক ঘুরতেই। অনেক হাঁটা বাকি। এখন এই অব্দি থাক নাহয়।
"হোক নাহোক রোদের স্বয়ম্বর
আমাদের পিঠ পাতাই থাক,
নামের সাথে তুলনা হোক সকালের
কিছু না পাওয়া পাওয়া পাক।"
#যা_দেখি_তাই_লিখি
#পর্ব_৬_এর_পর_যা_হয়_তাই
#এবার_কান্ড_কেদারনাথে_২
#ভুঁড়ি_হাঁটু_চচ্চড়ি_২
"যেভাবে জলদি হাত মেখেছে ভাত
নতুন আলুর খোসা আর এই ভালোবাসা..."
গুনগুন করতে করতে এগোচ্ছি। ছ'জন নিজের মত হাঁটছি। ঠান্ডা ভালোই। আলগা শিমুলতুলোর মত রোদ উড়ে বেড়াচ্ছে পাতার ফাঁক দিয়ে। খবর ছিল আগের দিন দুপুরেই কেদারে "ভারী বরফ বারি হুই হে"। তাই রিস্ক নেওয়া যায়নি। আমি চলেছি সবার শেষে। হাঁফাতে হাঁফাতে। সকালের বাতাসে অক্সিজেন একটু কম। তাছাড়া অভ্যেসমত ছবিতোলা আর ল্যাদখাওয়া দুটোই আছে। সঙ্গে মাঝে মধ্যে মুখে চালান হচ্ছে প্রিয় ম্যাংগোবাইট। শুধু চা খেয়ে বেরোনো হয়েছে। সামনে জঙ্গলচটি। গৌরীকুণ্ড থেকে চার কিমি। ওখানে হবে ব্রেকফাস্ট। সুন্দর একটা ওয়াটারফলস পেরোলাম। সাইনবোর্ডে লেখা "কৃপয়া রুক কর প্রকৃতি কা আনন্দ লিজিয়ে"। লোকজনকে বলেও দিতে হয় শুধু হেঁটো না, সঙ্গে দেখোও! ভালো লাগল। একটু এগিয়ে চড়াইশেষে সামান্য সমান রাস্তা পেয়ে মনটা নেচে উঠল। একটানা চড়াই উঠতে কার ভালো লাগে? তার ওপর এই পাথরের রাস্তায়। দিওয়ালির আলোর মত গাছ ছুঁয়ে রেখেছে এপারের পাথরের গা। বেশ একটা ক্যালিডোস্কোপমার্কা প্যাটার্ন হয়ে আছে রাস্তার ধুলোয় রোদ-ছায়ার। নিঃশ্বাসের জলীয়বাষ্প লম্বা রোদের ফালি পেয়ে একপশলা ধোঁয়া হয়ে জাতে উঠে যাচ্ছে মাঝে মাঝে। পাশ দিয়ে একটা খচ্চরচাপা টিম গেল "জয় কেদার" বলতে বলতে। সামনেরটায় বাবার সামনে বসে বছরদুয়েকের এক খুদে। তাকে বেড় দিয়ে কাপড় দিয়ে বাঁধা আছে বাবার কোমরের সাথে। সে দুলতে দুলতে ঘুমোচ্ছে। গালগুলো লালচে হয়ে আছে ঠান্ডায়। একমুহূর্ত দাঁড়ালাম। যেতে দিলাম। তারপর জল খেয়ে, যেতে হবে-কে টুপিতে ভরে মাথায় চড়িয়ে এগোতে শুরু করলাম। জঙ্গলচটি আর আধা কিমি।
আমি যখন পৌঁছলাম জয়, সৌনিপ, সুদীপ-রা আগেই বসে ছিল একটা চা দোকানে। গরম গরম টম্যাটো ম্যাগির অর্ডার দেয়া হল। জয় ম্যাগি খায় না। ওর নিজের ইপ্পি ছিল। দোকানদার হাসিমুখে সেটাই বানিয়ে দিল ওকে। আমরা ঝাঁপিয়ে পড়লাম গরম ঝোল ঝোল ম্যাগির উপর। ওখানেই আলাপ হল আরো বাঙালি কয়েকজন টিমের সঙ্গে। এই সময় বাঙালি ছাড়া বড় একটা কেউ যায় না কেদারনাথ। যে যার মত সময়ে উঠে পড়ল। ট্যুরের ক্যাশিয়ার আমি। দাম মিটিয়ে স্যাক কাঁধে নিলাম। পরবর্তী গন্তব্য ভীমবালি। এখান থেকে আরো ২ কিমি।
নতুন রাস্তা বেশ ভালোভাবেই বানানো। মোটামুটি ২০০ মিটার অন্তর বসার জায়গা আর শেডদেওয়া রেনশেল্টার। তবে রাস্তার চড়াই বেড়েছে। ডানদিকে মন্দাকিনীর দিকে তাকালেই ভয় লাগে। চারিদিকে ধ্বংসের চিহ্ন এখনো বেশ স্পষ্ট। গৌরীকুণ্ডে খাবার দোকানে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি ওখানকারই বাসিন্দা এবং বন্যার সময় ওখানেই ছিলেন। সেসব বলার সময় চোখ মাটির দিকে চলে গিয়েছিল। হয়ত কোনো চিকচিকে পারদের ব্যর্থ দীপ্তি লুকোতে চেয়েছিলেন। জানি না। ঘোড়াওলাদের তেমন দৌরাত্ম্য নেই। তবে মাঝে মাঝেই পেরিয়ে যাওয়ার সময় আওয়াজ আসছে "দাদা ঘোড়া লেঙ্গে আগে বহুৎ চড়াই হে"। আমরা তেজের সঙ্গে না বলছিলাম। তখনও কি জানতাম চড়াই এর বহর! চড়াই যে চড় মেরে কনফিডেন্সের কুলকুচি করে দেবে কে জানত।
গল্প করতে করতে যাচ্ছি। সেলফি, রাস্তাফি, খাদ-ব্রিজ-নদী-গাছপালা-কেদার শৃঙ্গ-ফি সবই চলছে। কুঁচো কুঁচো পাখি (মনে হল হিমালয়ান সানবার্ড, ভুল হলে কেউ শুধরে দেবেন) বেশ আনন্দে ডাকছে। আমরা যখন ভীমবালি পৌঁছলাম জয় আর সৌনিপ এগিয়ে গেছে। ইন্দ্র দেখি একটা দোকানে বসে রুটি তরকারি খাচ্ছে। আমাদেরও বলল। আমরা শুধু চা খেলাম। এরপর একটা ব্রিজ পেরিয়ে নদীর ওপারে যেতে হবে। তারপরই শুরু পিছনফাটানো চড়াই। ডানদিকে রাস্তা দেখা যাচ্ছে। উত্তুঙ্গ চড়াই। দেখে মনে হচ্ছে অদ্দুর উঠতে হবে? একটু এগোতেই এক মধ্যবয়স্ক বাঙালি দাদার সঙ্গে দেখা। সামনে দুটো ব্রিজ। একটা একটু এগিয়ে আরেকটা সামনে। উনি বললেন যদি দূরের ব্রিজটা ধরা হয় তাহলে রাস্তা একটু খারাপ আর চড়াই বেশি কিন্তু প্রায় ২ কিমি মত রাস্তা কম। আর সামনেরটায় চড়াই কম রাস্তা প্লেন কিন্তু বেশি হাঁটতে হবে। আমরা ঠিক করলাম চড়াই হোক কিন্তু বেশি হাঁটব না। সুতরাং দ্বিতীয় ব্রিজ। পেরিয়েই শুরু হল জিভবেরোনো চড়াই। সিঁড়ি ভাঙাটা বেশি কষ্টের। পায়ে চাপ পড়ে খুব। আস্তে আস্তে থেমে থেমে উঠতে লাগলাম। এখান থেকে লিনচোলি ৪.৫ কিমি। মনে হতে লাগল দিল্লি অনেক দূর। কেদার তখনও প্রায় ১১ কিমি।
ধুঁকতে ধুঁকতে ২ কিমি এলাম। একটা বাঁক ঘুরতেই সামনে দেবদূতের মত হাজির হল কালিকমলি-র ফ্রী চায়ে কি দুকান। পয়সা না দিয়েও গরম জল, চা, ছোলাভাজা, লেবু লজেন্স, বিস্কুট, বুরহান্স(ওদের উচ্চারণে)এর শরবত (রোডোডেনড্রনের) পাওয়া যায়। আমরা মুখ ধুয়ে ছোলাভাজা আর চা খেয়ে একটু বসে আবার এক গ্লাস করে শরবত খেলাম। ষাট টাকা এমনি দানবক্সে দিয়ে চাঙ্গা হয়ে আবার স্যাক কাঁধে নিলাম। এবার একেবারে লিনচোলি। বেলা বাড়ছে। সাড়ে এগারোটা বাজে। বেশি দেরি করলে ওয়েদার খারাপ হওয়ার ভয়। তাড়াতাড়ি পা চালাল সবাই। আমি পিছনে পিছনে আস্তে আস্তেই যেতে থাকলাম। পা অল্প ব্যথা করছিল। ভিতরে সব ঘামে ভেজা। টুকটুক করে এগোতে এগোতে লোয়ার লিনচোলি দেখা গেল। একটা কর্নার বেঞ্চে বসলাম। সামনে রাস্তার কাজ হচ্ছে। একজন বিশাল হাতুড়ি দিয়ে উমফঃ উমফঃ জাতীয় শব্দ করে পাথর ভাঙছে। আমি সিঁড়ি আর সে পাথর। দুটো ভাঙায় ঘাম একই কিন্তু শ্রম এক নয়,পাথেয় এক নয়,উপায় এক নয়...এক নয় জীবনটাও। যে পথে আমরা যাব ট্রেকার হয়ে সেই পথটাও বানাবে কয়েকটা জীবনের কারিগর। কাগজের দাম সব সময়েই মাটির চেয়ে বেশি।
থেমে গেলে হয় না। গতিময়তাই সব। গা ঝাড়া দিয়ে উঠলাম। পা ব্যথা, শ্বাসের তীব্রতা সবকিছুকে উপেক্ষা করে এগোচ্ছি। লিনচোলি দেখা যাচ্ছে। পৌঁছে গেলাম জি এম ভি এন। স্যাক নামানোয় স্বস্তি। হাতমুখ ধুয়ে টয়লেট করে খেতে বসলাম। ডাল ভাত রুটি তরকারি খেয়ে রোদে একটু গা এলিয়ে দিলাম। বেশ ভালো লাগছিল। আর মাত্র ৪ কিমি বাকি। যদিও শুনেছি এবার চড়াই আগের চেয়েও বেশি। জি এম ভি এন-এর একজনকে জিজ্ঞেস করতে বললেন "আরে হম লোগ তো এক ঘনটে মে চড় যাতে হে, আপলোগ দো ঘন্টা মানকে চলিয়ে।" মনে ফুর্তি খেলে গেল। আহা আর মাত্র দু'ঘন্টা, তাহলেই দেখা মিলবে তাঁর। এতদিন পর। বুকে শিবজির ডুগডুগি নিত্য করতে শুরু করল। তখনও কি জানতাম খেল অভি বাকি হে।
"খানিকক্ষণের গল্প কালকে শুনো
আজ সময় খবর নেবার,
ভালো আছে সে,যে একা হয়েছিল
তোমার সঙ্গে শেষবার"?
#যা_দেখি_তাই_লিখি
#পর্ব_পৌনে_৭
#এবার_কান্ড_কেদারনাথে_৩
#ভুঁড়ি_হাঁটু_চচ্চড়ি_৩
#The_Golden_Moment
প্রথমেই বলে নি। ব্যাপারটা আর লাইভ নেই। Deferred live বা Exclusive বা পরের দিনের বাসি লুচি বলা যেতে পারে। ভুঁড়ি একটুও না কমার দুক্ষু নিয়ে কলকাতা ল্যান্ড করেছি আজ কালকের বাসী রাজধানীতে। সে পরের গপ্প, পরেই হবেখন। এখন যেটা চলছিল চলুক। এটা এখন #যা_দেখেছি_তাই_লিখছি তে কনভার্ট হয়ে গেছে। ফিরভি, show must go on...
তা লিনচোলির চোলি মুক্ত হওয়ার জন্য এগোতে হল। বাতাসে খচ্চরের টাটকা+বাসি+শুকনো বিষ্ঠার মনমাতানো সুবাস। মাঝে মাঝে উল্টোদিকের হুটোপুটি করে দৌড়ে আসা খচ্চরবাহিনী সামলাতে ইন্দ্র রাহ-রাহ-জাহ-জাহ-হুরররররাআআআহহহ জাতীয় শব্দ করছে। তাতে কখনও কাজ হচ্ছে কখনও খচ্চর খচড়ামি করে আরও গা ঘেঁষে ছুটছে। আমরাও একটু থামার অজুহাত পেয়ে যাচ্ছি। ফাটানো চড়াই, কোন মা বাপ নেই। আমি অনুরোধ করছি যারা হেঁটে যাবেন তাঁরা হাল্কা ওজন নেবেন। একটু হাঁটার পর আমি যথারীতি পিছিয়ে পড়েছি। সামনে শুধু দেবজিৎ আগের বাঁকে ওপরে। হঠাৎ ডান পায়ের কাফ মাসলে খুব জোর ক্র্যাম্প ধরল। খুব ঘাম হচ্ছিল শরীর থেকে বেরোনো জল খেয়ে পোষানো যায়নি। পা ধরে দাঁড়িয়ে পড়লাম। ওকে বললাম এগিয়ে যেতে। এইজন্য মেডিক্যাল বক্স আমি নিজে ক্যারি করি। আস্তে আস্তে পা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে উল্টোদিকে টান দিয়ে আর মেসেজ করে ক্র্যাম্প ঠিক করলাম। একটু দাঁড়িয়ে জল খেয়ে ভলিনি স্প্রে করে আবার উঠতে থাকলাম ভয়ানক চড়াই। এখানে অনেকের মনে হতে পারে কেদারনাথেই এই, এ ট্রেক নিয়ে বিরাট বিরাট বুলি ঝাড়ে? তাঁদের উইথ ডিউ রেসপেক্ট বলছি কার কোন্ ট্রেকে কী হয় কেউ বলতে পারেনা। আমি শেষপর্যন্ত চেষ্টা করি কমপ্লিট করার, এটাই আমার কাছে অনেক।
একটু লেংচে একটু থেমে এগোচ্ছি। বেলা পড়ে আসছে। ওপরে ওঠার কোনও বিরাম নেই। বন্ধুরা বলছে ঘোড়া নিয়ে নে। কিন্তু আমি অনড়। হেঁটেই উঠব। হাল সবারই কম বেশি খারাপ। ইতিমধ্যে হঠাৎ সুদীপের জুতোর সোল খুলে হাঁ। ফেভিকুইক বের করে দেখা গেল ওই ঠাণ্ডায় জমে গেছে। দেবজিতের কাছে নাইলন দড়ি ছিল। ওটা দিয়ে বাঁধা হল কোনমতে। এতে ওরও স্পিড গেল কমে। আমরা তিনজন একসঙ্গে হাঁটতে লাগলাম। জল খেতে খেতে তিনজনেরই স্টক প্রায় শেষ। সৌনিপ, জয় আর ইন্দ্র এগিয়ে গেছে। মাথা নীচু করে শুধু সামনের পাঁচফুট রাস্তার দিকে তাকিয়ে এগোতে থাকলাম। এটা আমি করি যখন হাঁটাটা একঘেয়ে হয়ে যায়, হ্যাঁ, যতই আমরা স্বীকার না করি, একটা সময় কিন্তু এটা হয়।
ঠান্ডা বাড়ছে। ঝিমিয়ে আসছে বিকেল। শনিবারের বারবেলায় বেরোতে বারণ করা মায়ের মত চৌকাঠ আগলে দাঁড়িয়ে আছে কেদারশৃঙ্গ। ঝিমিয়েপড়া মনের কোণে একটাই ভরসা অপুর মত উঁকি দিচ্ছে জানলায়, পৌঁছতে হবে, ছুঁতে হবে কেদারজিকে। আর ২ কিমি বাকি কেদারনাথ। একটা আনন্দ আবার ফিরে আসছে, ফিতে দিয়ে মাপলে সেই নরম হাতটা দুবার ধরার সমান হবে। সামনে 'ঘোড়া পড়াও', যতদূর মনে হয় ঘোড়ার পথ এখানেই শেষ। কেদার বেসক্যাম্পের শুরু আরেকটু এগিয়েই। হঠাৎ ফোন এল সুদীপের। সৌনিপ! জয়ের একটু মাথা ভার হয়েছে। তাই মেডিক্যাল চেকআপ পয়েন্টে ঢুকে ডাক্তার দেখিয়েছে। উনি বলেছেন একটু বেশি জল খেয়ে রেস্ট নিয়ে এগোতে আর কেদারেই হসপিটালও আছে তাই ভয়ের কোনও কারণ নেই। এর মধ্যেই আমরাও পৌঁছে গেলাম। দেখলাম বিশেষ কিছু ভয়ের নেই। আবার শুরু এগোনোর। সামনে কেদারনাথ দেখা যাচ্ছে।
আলো পড়তে পড়তে যখন শেষমুহূর্তে মাকড়সার ঝুলে একটু দোল খেয়ে সময় কাটিয়ে নেয়, ঠিক সেরকম সময় আমরা পৌঁছে গেলাম জি এম ভি এন-এ। শেষ একটাই রুম ছিল আটজনের ডর্ম। ইন্দ্রের ম্যানেজের ঠেলায় ম্যানেজার আমাদের পুরো রুমটাই দিয়ে দিল। বাঙ্কবেডের রুম। দুটো দুটো করে বাঙ্ক। কটেজের নাম 'স্বর্গারোহিনী'আর রেস্টুরেন্টের নাম 'অন্নপূর্ণা'। কটেজের ছাদের কার্ণিশের ঠিক নীচে মাটিতে একতাল করে বরফ জমে আছে। ক্লান্ত পায়ে নিজেদের রুমে ঢুকলাম রীতিমত ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে। রুমের ভিতরটা গরম। টয়লেট একটাই, তবে পরিষ্কার, সুন্দর। ওরা বলে দিয়েছিল কল বন্ধ না করতে তাহলে জল জমে যাবে,অগত্যা বালতি উপচে পড়লেও জল চালুই থাকল।
আমাদের মধ্যে সৌনিপ সবচেয়ে ফিট। সবাই এখানে ব্যথা,ওখানে যন্ত্রণা, মাথা টিসটিস, গা ঢিসঢিস, হাত নিসপিস, কেস জন্ডিস করলেও সে দিব্যি মজায় আছে। আমরা কী কী চাপাব ভাবছি আর সে কখন বেরিয়ে মন্দিরে যাবে আর কে কে যাবে তাই নিয়ে ব্যস্ত। আমাদের চেঞ্জকরা শেষ হওয়ার আগেই বাইরে থেকে আওয়াজ দিল, "কাকারা বাইরে আয়, যা দেখতে এসেছিস দেখে যা!" আমরাও ছুটলাম ক্যামেরা হাতে। বাইরে বেরিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম! শেষবিকেলের ছেঁড়া আলোয় কেদাররেঞ্জ মাখামাখি। এই তাহলে সেই বিখ্যাত "গোল্ডেন মোমেন্ট অফ কেদার"! এই অপূর্ব রঙছবির বর্ণনা দেবার ভাষা আমার জানা নেই।
উজবুকের মত ফ্যাকাশে ভ্যাবলা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম ওই সিডাকটিভ, আই-অরগ্যাজমিক দৃশ্যের দিকে। প্রথমে ভুলে গেছিলাম ছবি তুলতে। তারপর আর শাটার থামেনি কিছুক্ষণ। ভাই আর কয়েকজন প্রিয় বন্ধুকে ভিডিও কল করে দেখালাম, কেউ কেউ ফোন রিসিভ না করায় দেখতে পেল না। দেখাদেখি আর মাখামাখি শেষ হবার নাম নেই। এতদিন পর পাহাড়ে গিয়ে আদর শেষ হতেই চায় না! এমনি করেই ঝুপ করে পোড়া নিভন্ত দেশলাইকাঠির মত লাল থেকে কালো হয়ে সন্ধে নামল কেদারক্ষেত্রের বুকে। সঙ্গে সঙ্গে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে তেড়ে এল ঠান্ডা। চা খেতে গিয়ে ডিসপ্লে বোর্ডে দেখলাম তাপমাত্রা -১℃।
ওরা বলছিল আরতি দেখতে যাবে। আমার একটুও শক্তি ছিলনা। পায়েও ব্যথা খুব। তবুও একটু গেলাম। মন্দাকিনী আর কেদার-সরস্বতীর মিলনস্থলে একটা ঘাট বানানো হয়েছে। ওখান থেকে আমি আর সুদীপ ফিরে এলাম। ভীষণ ঠান্ডা লাগছিল। ফিরে দেখি একটা শেডের নীচে জি এম ভি এন-এর লোকেরাই আগুন জ্বালিয়ে বসে গল্প করছে।
আমরাও চেয়ার নিয়ে জুটে গেলাম। বেশ আরাম হল কাঠকয়লায় লালচে আগুনের নেশায় গা সেঁকে। তাপমাত্রা তখন নেমে -৩℃। ওরা ফিরল পৌনে আটটা নাগাদ। তারপর খাওয়া - রুটি তরকারি,ডাল। গরম জল ভরে নিয়ে বোতল চালান করে দিলাম জ্যাকেটের ভিতরে। রুমে ফিরে শোবার পালা। একটা কম্বল আর একটা ভীমশিলার মত ভারী লেপ। দুটোই চাপা দিয়েও প্রথমে ঠাণ্ডা কাটছিল না। বিছানা বরফজলের মত ঠান্ডা। এপাশ ওপাশ করছি। ঘুমের নাম গন্ধ নেই। বুকে কয়েক মণ চাপানো আছে যেন। এদিক ফিরলে ওদিক জমে বরফ। দোকান বাঁচাই নাকি স্থায়ী আমানত বুঝে পাচ্ছিনা। এদিকে পাশের ঘর থেকে ঘোঁড়ৎ-ফুই-ফুই-ফুই শোনা যাচ্ছে সুদীপের। আর উপরের বাঙ্কে সৌনিপ পাশ ফিরলেই ক্লিনিচ-ক্ল্যাং-খেয়াং করে লোহার বাঙ্ক নড়ছে। নীচে জয়ের ভ্রূক্ষেপ নেই। ঘাড় কাত করে মাথায় টুপি পরে বটগাছের ডালের মত ঘুমোচ্ছে। আমার বগলের তলা দিয়ে গলে জলের বোতল খালি মেঝেয় গড়াচ্ছে আর আমি তুলছি। এই করতে করতে বাঙালি লড়াইয়ে হেরে চোখ বুজেছে কখন খেয়াল নেই।
"নক্ষত্র জানে সে যখন নিভে যাবে
তখনও কেউ না কেউ দূর থেকে দেখবে
সে জ্বলছে দাউ-দাউ করে,
আসলে নেভাগুলো কেউ দেখতে চায়না...।"
#যা_দেখি_তাই_লিখি
#পর্ব_আহ্লাদে_৮
#হাঁটু_ভুঁড়ি_চচ্চড়ি_৪
#কেদারনাথ
#ফিরব_বললে_ফেরা_যায়_নাকি
"So if you're feeling lonely, don't
You're the only one I'll ever want
I only want to make it good
So if I love you, a little more than I should
Please forgive me, I know not what I do
Please forgive me, I can't stop loving you..." -ব্রায়ান অ্যাডামস
আজ ট্রেনে আসতে আসতে গানটা শুনছিলাম হেডফোনে। যতবার শুনি হাত পা অসাড় হয়ে যায় এক অদ্ভুত গাঢ় অনুভবে। এমন করে কেউ ভালোবাসতে পারে? পারে হয়ত। ভালোবাসার কোনও খোদাই করা মহাকাব্য নেই। তবু কিছু ভালোবাসা ছুঁয়ে থাকে সারাজীবন। হয়তো তারাই ঘুম ভাঙিয়ে দেয় ঠিক সময়ে, ঘুমের আধবোজা হাত অ্যালার্ম স্নুজ করে দিলে। এই বাঙালি তখন সেদিন অনেক কষ্টে ঘুমের তলানিতে হাবুডুবু। সকালে উঠে মহাদেবকে ছোঁয়ার কথা আছে। পুজো দিয়ে নেমে যাওয়া আছে গৌরীকুণ্ড অবধি। সে এক হাঁটুভাঙা কসরৎ। তবু উপায় নেই। নামতেই হবে। এরপর মদমহেশ্বর আছে। উঠে পড়লাম সাড়ে চারটেয়। লেপ থেকে বেরোতেই হিংস্র ঠান্ডা গিলে খেতে এল। পরিষ্কার হয়ে মোটামুটি ভালো জামাকাপড় পরে তৈরি হলাম। একে একে ঘোড়ৎ ফু'রা উঠল। সৌনিপ এর মধ্যেই একবার বেরিয়ে আওয়াজ দিয়েছে। বেশ মোটা করে অ্যান্টিঠান্ডা মাল চাপিয়ে বাইরে গেলাম। ঠান্ডা হাওয়ায় গাল কেটে যাচ্ছে। নাকের ডগা অনুভূতিশূণ্য। কিন্তু ওই অপার্থিব আধআলোয় কেদাররেঞ্জকে দেখে ভবা পাগলা হয়ে গেলাম। ভাপ দিয়ে চশমা পরিষ্কার করার আগের কাচের মত আকাশ। পুবদিক আড়মোড়া ভাঙছে। সকালের বাসি চুমুর দিনগলানো ভালোবাসার মত গন্ধ বাতাসে। সাদা কালোর দাবার বোর্ড আস্তে আস্তে রং মাখছে। হাজার বাঁশপাতার খসখসানি মনেকরানো আধপাগল হাওয়া কাঁপাচ্ছে মন আর তনু। আমরা দুজন অবাক বিস্ময়ে আলোর বিজয় উৎসব দেখার অপেক্ষায় আছি।
সৌনিপ ফোন করে জানাল ভিড় কম। আমরা দৌড়লাম। টাকাপয়সা ইত্যাদি সঙ্গে করে নিয়ে আবার চললাম মন্দিরের দিকে। ইন্দ্র আগেরদিন মহাকাল বাবা নামে একজন পুরোহিত ঠিক করে রেখেছিল। অতঃপর পুজোর সামগ্রী কেনা এবং লাইনে দাঁড়িয়ে পুজো দেওয়া। আবার সেই মন অবশকরা অনুভূতি ফিরে পাওয়া মহাদেবকে ছুঁয়ে। এই মন্দির ঘোর নাস্তিকেরও বুক কাঁপিয়ে দেবেই দেবে। একবুক ভালোলাগা নিয়ে মন্দির পরিক্রমা করা হল পাঁচবার। এবার নামার পালা।
মন্দির চত্বর এখন এখন এক খোলা চাতালের মত। ওখান থেকে নেমে আলুর পরোটা/রুটি/লুচি যে যেমন পারল খেয়ে গেস্ট হাউসে ফিরলাম। ধরা আছে পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ ঘন্টা লাগবে নামতে কারণ সবারই পায়ে বেশ ব্যথা। সাড়ে দশটায় বেরোনো টার্গেট থাকলেও এগারোটা বেজে গেল। ছোটবেলায় আমরা একটা গজা খেতাম যার নাম ছিল 'দাঁতের লড়াই'বা আমরা বলতাম 'মদন কটকটি'। চিবোতে দাঁত খুলে যেত। এখানে হল হাঁটুর লড়াই। একটা করে অসমান সিঁড়ি নামি আর হাঁটু কটকট করে ওঠে। তার উপর বেল্লিক ভুঁড়ি। নামছি। বাঁক ঘুরছি আর অবাক হয়ে দেখছি প্রতি বাঁকে এক নতুন রূপ। ছবি তুলে পোষাচ্ছে না, যেমন পোষায় না ভালো জাতের মটন বিরিয়ানি খেয়ে।
আধময়লা তারজালির মত পথে পড়ে আছে রোদ ছায়া। যেমন খুশি কুড়িয়ে নাও। ইচ্ছে না হলে পাশ কাটিয়ে যেতে পারো। অনেকে উঠে আসছে। কারো মুখে প্রত্যয় কারো মুখে দুশ্চিন্তা। যারা ঘোড়ায় উঠছে তারাও ভয়ে,এই বুঝি পড়ে গেল। চড়াই উৎরাই দুটোই বেশ খাড়া। লিনচোলি এসে গেলাম ঘন্টা দুয়েই। আরেকটু নেমে চা খেতে বসা হল। ওখানেই ডিসাইড করা হল মদমহেশ্বর না করে তুঙ্গনাথ করা হবে। এদিকে শোনা গেল তুঙ্গনাথ মন্দির হয়তো বন্ধ। তাতে কী, ট্রেকটা করা হবে এটাই ঠিক হল। একটানা অনেকটা নেমে আবার পরের স্টপ সেই কালিকমলি চায়েতে। বুরহান্স পান করে চাঙ্গা হলাম। একজন চাইনিজ মহিলা একাই উঠছিলেন। ইন্দ্র তাঁকে ফ্রি ড্রিঙ্ক-এর কথা বলল। উনি দুমিনিট দাঁড়িয়ে কিছু না খেয়েই হাঁটা দিলেন। চারজন করে লেবার দুদিকে কাঁধে নিয়ে লম্বা স্টিলের ব্রিজের রডজাতীয় পার্টস বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। দেখে কষ্টও হচ্ছিল শ্রদ্ধাও। চিরকাল কিছু মানুষ সভ্যতা বয়ে নিয়ে চলেছে। তাই আমরা আছি।
আজ আমরা দ্বিতীয় রুট ধরেছি। লম্বা রাস্তাটা। বুঝলাম ভুল হয়নি। রাস্তা অনেক ভালো আর পথের সৌন্দর্য অনেক অনেক বেশি। গাছে ফল কালার্স ধরছে। আকাশের নীল দিয়ে গেঞ্জি ধোয়া যাবে। পাশ ফেরানো সিঁদুরকৌটোর মত লাল ফড়িং উড়ে বেড়াচ্ছে। জলছবি সাঁটানো অঙ্কখাতার মত ল্যান্ডস্কেপে হেঁটে চলেছি আমরা ক'জন। ভীমবালি এসে গেল। লাঞ্চ হবে। সময় কম, তাই আবার ঝোল ম্যাগি। জয় শুধু চা বিস্কিট খেল। এখন আর ৬ কিমি বাকি। সবাই বেরিয়ে পড়লাম জলদি খেয়ে। প্রায় তিনটে বাজে। বেলা পড়ে আসছে। গাছের পাতায় আলস্য ফিসফিস করতে শুরু করে দিয়েছে। আহ্নিকের জন্য তালদিঘিতে ঘটি ডুবিয়ে স্নান হয়ে গেছে তার। এবার গা মুছে উপরে উঠে আসা শুধু। জয় আগেই বেরিয়ে গেছে। সুদীপ আর দেবজিৎও লম্বা পায়ে ছুট দিয়েছে। ইন্দ্রেরও হাঁটু ভোগাচ্ছে। আমি, সৌনিপ আর ও তিনজনে আস্তে আস্তে এগোতে থাকলাম। জঙ্গল চটি পৌঁছে একটা টি আর ভলিনি ব্রেক নেয়া হল। ওদের তখন আর মাত্র ২.৫ কিমি বাকি আমাদের ৪। সন্ধে আর অপেক্ষা করতে পারছে না। তার মৈথুনে দেরি সইছে না। প্রেমিকা তমসা অপেক্ষায় তার। আমরাও যতটা পারছি জোরে হাঁটছি। দূরে যখন গৌরীকুণ্ড দেখা দিল পাহাড়ি আকাশের হ্যান্ডমেড পেপারে তখন কালো রং জল ছুঁয়ে বিস্তার নিচ্ছে দ্রুত। ঝুপ করে নিবে যাওয়া দিনান্তে ঠিক সুর কেটে যাওয়ার আগে শেষ সিঁড়ি টপকালাম গৌরীকুণ্ড জি এম ভি এন-এর। নিঃশ্বাসের সঙ্গে ঘামের টুকরো মিশে তখন ঘুরপাক খাচ্ছে মন্দাকিনীর স্রোতে।
"দাম দিয়ে কেনায় বরাদ্দ যতটা
অগোছালো আমার ইতিহাসও ততটা,
ডানদিকে থাকা হয়ত সহজ নয়
তাইতো ভয় যদি হাত বাড়াতে দেরি হয়।"
(ক্রমশ)
~ কেদারের আরও ছবি ~
জিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার টেকনিকাল অ্যাসিস্ট্যান্ট অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় কিছুদিন পাহাড়ে না গেলেই ডিপ্রেশনে ভোগেন। ট্রেকে বেরোলেই ফের চাঙ্গা হয়ে ওঠেন। কিন্তু ফিরে এসে লিখতে বসলেই আবার ল্যাদ খান। তবে এর পরেও কষ্টেসৃষ্টে যেটুকু লেখেন তা স্রেফ 'আমাদের ছুটি'-র জন্যই। বাড়িতে চমৎকার রুটি বানান। মাঝেমধ্যে রান্না করতেও ভালোবাসেন।