বেড়ানোর ভাল লাগার মুহূর্তগুলো সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিতে ইচ্ছে করে, অথচ দীর্ঘ ভ্রমণকাহিনি লেখার সময় নেই? বেড়িয়ে এসে আপনার অভিজ্ঞতাগুলো যেমনভাবে গল্প করে বলেন কাছের মানুষদের - ঠিক তেমনি করেই সেই কথাগুলো ছোট্ট করে লিখে পাঠিয়ে দিন ছুটির আড্ডায়। লেখা পাঠানোর জন্য দেখুন এখানে। লেখা পাঠাতে কোনরকম অসুবিধা হলে ই-মেল করুন - admin@amaderchhuti.com অথবা amaderchhuti@gmail.com -এ।

 

 

হলং-এ দুরাত্তির

বাপ্পাদিত্য বর্মন

'জঙ্গলের মধ্যে এক হোটেল'। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি গল্প আছে। হলংকে দেখে প্রথমবার ডুয়ার্সে গিয়ে আমার সেই রকম মনে হয়েছিল। আর এইখানে থাকার একটি ইচ্ছা কলেজ পড়ার সময় থেকেই ছিল। সুতরাং সুযোগের অপেক্ষাই ছিলাম। সেই কাঙ্খিত বুকিং পাওয়া গেল অক্টোবর ২০১৮ পুজোর ঠিক পর পর। দুই রাত্রির জন্য দুটি ঘর বুক করা হল।
উত্তরবঙ্গের জলদাপাড়া জঙ্গলে হলং এর অবস্থান। জলদাপাড়ার চেকপোস্টে পৌঁছে যাবতীয় সই সাক্ষর করে গাড়ি ছাড়ার অনুমতি পাওয়া গেল। এন এইচ থার্টি ওয়ান সি (NH31C) থেকে জঙ্গলের মধ্যে ৬ কিমি ভেতরে হলং বাংলো। প্রবেশ পথেই দেখা গেল বড় একটা সম্বর হরিণ। নিরিবিলিতে ঘাস খাচ্ছিল। আমাদের গাড়ির আওয়াজে রাস্তা পার হয়ে গেল। আর একটু এগিয়ে জোড়া হাতি। মালঙ্গি ও চম্পাকলি। এরা কুনকি হাতি। অবশেষে কাঠের ঘরে পুরোপুরি আধুনিক সুযোগ সুবিধা যুক্ত হলং বাংলো। বাংলোর সামনে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে হলং নদী। নদীর ওপারে আছে সল্ট পিট। এখানে পশুরা লবণ খেতে আসে। সেইখানে দাঁড়িয়ে আছে বড় দাঁতাল হাতি। সল্ট পিটে সর্বক্ষণ হরিণ এবং ময়ূরের দল ঘুরে বেড়াচ্ছে।

সন্ধ্যায় চারদিকের নিস্তব্ধতার সঙ্গে চাঁদের আলো এক মায়াবী পরিবেশের সৃষ্টি করল। সার্চলাইট জ্বালিয়ে দেওয়া হল সেই আলোতে প্রাণী দেখার জন্য। সল্ট পিটে সন্ধ্যেতেই হাজির একটা গণ্ডার। সঙ্গে বেশ কিছু বাইসন। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গলের শব্দ অদ্ভুত থেকে অদ্ভুতে পরিণত হতে লাগল।

হলং-এ আছে ভিউ রুম। ভিউ রুম থেকে সামনের জঙ্গল এবং সল্ট পিট পুরোপুরি দেখা যায়। এখানে রাতের খাবার সময় সাড়ে আটটা। জঙ্গলের মধ্যে মোবাইলের নেটওয়ার্ক খুবই ক্ষীণ। খাওয়ার পরে নিচের নুড়িবাঁধানো পথে মোবাইলের চেষ্টা করার সময় ঘটে গেল অবাকরা কাণ্ড। হঠাৎ দুইজন কর্মী আমাকে হাত ধরে তুলে নিয়ে ঢুকিয়ে দিলো বারান্দায়। দেখি আমার পিছনে একটা গণ্ডার আপন মনে ঘাস খাচ্ছে। প্রায় দুঘন্টা বাংলোর লনের ঘাস খাওয়ার পর সেটা পিছনের জঙ্গলে অদৃশ্য হল। সারারাত্রি জেগে চলল সার্চলাইট জ্বেলে সল্ট পিট দেখা। দেখা গেল পনেরো-ষোলোটা হাতির দল। পরের দিন সকালে এলিফ্যান্ট রাইড। ভোর সাড়ে পাঁচটা, সাড়ে ছটা এবং সাড়ে সাতটা এই তিনটে সময়ে রাইড হয়। বাংলোর গেট থেকে হাতির পিঠে চড়তে হয়। একটি হাতির পিঠে চারজন। হাতির কানের পিছনে পা দিয়ে আঘাত করে অসামান্য দক্ষতায় মাহুতরা আমাদের নিয়ে চলল গভীর থেকে গভীরতর জঙ্গলের মধ্যে। যাওয়ার পথে দেখাতে লাগলো হাতিদের প্রিয় ঘাস, বিভিন্ন গাছ, ফল ইত্যাদি।

এক ঘন্টা হাতির পিঠে চড়ে ঘোরায় দেখা গেল নদীতে একটা গণ্ডারের ডুবে থাকা, একদল হরিণ, ময়ূর। তারপর সারাদিনে হলং নদীর বাঁধানো সিঁড়িতে বসে অগণিত ময়ূর, হরিণ, বাইসন, পায়রা, নাম অজানা পাখি দেখে কেটে গেল।

সেটা ছিল কোজাগরি পূর্ণিমার রাত। গতদিনের মত একটা গণ্ডার সন্ধ্যা হতে না হতেই হাজির বাংলোর ঘাস খাওয়ার জন্য। ঠিক আমাদের জানলার নিচে তার ঘাস খাওয়ার মসমস আওয়াজ যেন বাংলোর সন্ধ্যার নীরবতাকে টুকরো টুকরো করে ভেঙে দিচ্ছিল। পূর্ণিমার স্বচ্ছ আলোয় হালকা শীতে জানলা থেকে সমগ্র এলাকা যেন অদ্ভুত মায়াবী অরণ্যে পরিণত হল। নিজেকে কোলাহলপূর্ণ পৃথিবী থেকে বহুদূর গ্রহের একজন বলে মনে হচ্ছিল।

পরের দিন সকালে আমাদের ফেরার পালা। সকালে দেখা গেল ছোট হলং নদী পেরিয়ে একটা গণ্ডার যেন আমাদের বাংলোয় আসার চেষ্টা করছে। কোন কারণে মনের ভুলে শেষপর্যন্ত অন্য দিকের জঙ্গলে ঢুকে গেল। সে যেন আমাদের বিদায় জানিয়ে গেল।
হলং-এ ঘর আছে মোট আটটি। এর মধ্যে পাঁচটি ঘর সাধারণ ট্যুরিস্টদের জন্য বুকিং দেওয়া হয়। www.wbtdcl.com -এর মাধ্যমে একমাস আগে বুকিং দেওয়া হয়। হলং-এর বুকিং ক্যানসেল করা যায় না এবং কোনোরকম ডিসকাউন্ট দেওয়া হয় না। বৃহস্পতিবার হলং বন্ধ থাকে। এখন হলং-এর নন এসি রুমের ভাড়া ট্যাক্স ছাড়া আড়াই হাজার টাকা। এছাড়া ব্রেকফাস্ট, সন্ধ্যের চা এবং ডিনারসহ জনপ্রতি চারশ টাকা। এলিফ্যান্ট রাইড জন প্রতি আটশ টাকা। বাংলোর চেকইনের সময়ই রাইডের ফর্ম ফিলআপ করে নেওয়া হয়। হলং-এ আছে দুটি ভিউ রুম। ঘরে বসেই সল্ট পিটের নুন খেতে আসা বন্যপ্রাণীদের উপভোগ করা যায়। আগে আসার ভিত্তিতে ভিউ রুম দেওয়া হয়।
এখান থেকে ঘুরে দেখা যায় চিলাপাতা জঙ্গল, খয়েরবাড়ি বন্যপ্রাণী উদ্ধার কেন্দ্র, টোটোপাড়া, তিস্তা ব্যারেজ ইত্যাদি।


পেশায় শিক্ষক বাপাদিত্য বর্মনের নেশা ভ্রমণ।

 

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

বনশঙ্করী আম্মার মন্দির দর্শন

তড়িৎ সাধু

কর্ণাটক বেড়াতে এসে গত পরশু থেকে হসপেটের একটা হোটেলে আছি। গতকাল সারাদিন হাম্পি ঘুরেছি। আজ সকালে স্নান সেরে হোটেলের নিচের তলার ক্যান্টিনে ধোসা, ইডলি ও কফি সহযোগে ব্রেকফাস্ট সেরে বাইরে এসে দেখলাম আমাদের গাড়ি হাজির। ইব্রাহিম তার সাদা রাজহাঁস-এর মত ইন্ডিগো গাড়িটা মোছামুছি করছে। খুব যত্নে রেখেছে গাড়িটাকে। আমরা দেরি না করে বেরিয়ে পরলাম।
আজ প্রথমে যাবার কথা বাদামি। গাড়ি চলতে শুরু হতেই ইব্রাহিমেরও কথা শুরু হয়ে যায়। ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে কথাবার্তা বলে ও। অবশ্য আমাদের হিন্দি ইব্রাহিমের থেকেও খারাপ। অসুবিধা হয় না। আজ পৌষ সংক্রান্তি,ইব্রাহিম বলতে থাকে 'বাদামি যাবার আগে বনশঙ্করী আম্মার মন্দির ঘুরে চলুন। এখন রথের মেলা চলছে। পুজোয় খুব ধুমধাম। আপনাদের ভালো লাগবে।' আমাদের রাজি না হওয়ার কোনো কারণ নেই। বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর গাড়ি মূল রাস্তা ছেড়ে অপেক্ষাকৃত সরু জঙ্গলের রাস্তা ধরল, ছেঁড়া ছেঁড়া জঙ্গল,পরক্ষণেই পৌঁছে গেলাম মন্দিরের কাছাকাছি। প্রচুর লোকসমাগম হয়েছে। পার্কিং পেতে অবশ্য অসুবিধা হল না।

সামান্য হেঁটে মন্দিরের সামনে এসে পড়লাম। মন্দিরের উল্টোদিকে রাস্তার অপরপাড়ে বড়ো বাঁধানো জলাশয় হারিদ্রা তীর্থ। জলাশয়ের তিনদিকে বাঁধানো সিঁড়ি নেমে গেছে জল পর্যন্ত। চারদিক খুব একটা পরিছন্ন নয়, লোকজন স্নান করছে, কাপড় কাচছে। স্নানাদি সেরে পুজো দিতে চলেছে লোকজন। প্রবেশপথের দুপাশে পুজোর সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে। চূড়ো করে সাজানো রয়েছে নানারঙের আবির। অনেক দোকানির মাথায় মুসলমানি টুপি দেখে একটু খটকা লাগল। পরে ইব্রাহিমের সঙ্গে কথা বলে জেনেছিলাম পূজার সামগ্রী বিক্রি করে যারা, তাদের অধিকাংশই মুসলমান।

বাইরে জুতো রেখে মন্দিরচত্ত্বরে প্রবেশ করলাম। প্রবেশপথের দুপাশে সুউচ্চ বাতিস্তম্ভ। সামনে একটি উঁচু ধাতবনির্মিত স্তম্ভ। চত্ত্বরে ভক্ত দর্শনার্থীদের ভীড়। ভাষার সমস্যা সত্ত্বেও দুয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে কিছু তথ্য সংগ্রহ করলাম। অষ্টাদশ শতকে মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল। বনশঙ্করী মাতা দেবী পার্বতীর একটি রূপ। অষ্টভুজা সিংহবাহিনী অসুরনিধনরতা। এখন বনশঙ্করী যাত্রা উৎসব চলছে। বাইরে রথ সাজানো হয়েছে। দেবী রথে গ্রাম প্রদক্ষিণ করবেন। প্রচন্ড ভিড়ে মন্দিরের ভিতর দেবীদর্শন করা গেল না।

হঠাৎ দেখতে পেলাম কয়েকজন গান্ধীটুপি পরিহিত লোক সুসজ্জিত দোলা কাঁধে ফুলেঢাকা দেবতাকে নিয়ে স্নান যাত্রায় চলেছে। মন্দিরচত্ত্বর ঘুরে বাইরে এলাম। রাস্তা ধরে কিছুটা যেতেই সুসজ্জিত বিশাল রথটি নজরে এল। চল্লিশ ফুটেরও বেশি উঁচু রথটির মাথায় রংবেরঙের পতাকা উড়ছে। রথটি খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। এদিকটায় এখনো বিশেষ ভিড় নেই। আর দেরি না করে এবার পার্কিংয়ের দিকে পা চালালাম। গন্তব্য বাদামি গুহা।

 

 

প্রেসিডেন্সি কলেজের উদ্ভিদবিদ্যার প্রাক্তন অধ্যাপক তড়িৎ সাধু ভালোবাসেন বেড়াতে। ইদানীং সেইসব ভ্রমণের স্মৃতি বিভিন্ন ভ্রমণপত্রিকার জন্য লিখে ফেলছেন ল্যাপটপ-কিবোর্ডে আঙুল চালিয়ে।

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher