একটি চাদরাবৃত অভিজ্ঞতা
অভিষেক মারিক
সবে রাত আটটা বাজে। অফিসবাস তখন নিউটাউন এলাকার ঝকঝকে পিচের রাস্তা দিয়ে রীতিমতো উড়ে চলেছে। বাহারি রঙিন আলোয় চোখ ঝলসে যায়। উড়ন্ত বাস সিটি সেন্টার টু-এর সামনে এসে স্তব্ধ হয়ে গেল। মেট্রো রেলের কাজ চলছে। সারা রাস্তা জুড়ে পিলপিল করছে গাড়ি। শম্বূকগতিতে চলা ছাড়া গতি নেই। ঝাঁ চকচকে সিটি সেন্টার আসন্ন প্রজাতন্ত্রদিবসের আলোকে সেজে উঠেছে। প্রচুর লোকের সমাগম। লোভনীয় খাবারের সম্ভার, জামাকাপড়ের আকর্ষণীয় বিপণি। তথাকথিত উচ্চমানের জীবনযাত্রার নিদর্শন।
পিছনের সিট থেকে জনৈক সহযাত্রী (সহকর্মীও বটে) সারারাজ্যের বিরক্তি উজাড় করে বললেন, "আর পারা যায়না! প্রতিদিন সেই একই গল্প! অফিস থেকে বাড়ি যেতে যেতেই দুঘণ্টা কাবার। কোথাও রাস্তা খুঁড়ে রাখছে, কোথাও মিনিটে মিনিটে আটকে দিচ্ছে! ট্র্যাফিক সিস্টেম পুরো ওয়ার্থলেস! দিনে দিনে শহরটা যেন নরক হয়ে যাচ্ছে!"
একমাস আগে হলেও হয়ত যোগাযোগব্যবস্থার প্রতি ক্রুদ্ধ সহযাত্রীর এই বিষোদ্গারে আমিও সামিল হতাম। কিন্তু এবার তা পারলাম না। গত সপ্তাহের অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা দৃষ্টিভঙ্গিটাই পাল্টে দিয়েছে। সত্যি স্থানবিশেষে মানুষের চিন্তাভাবনায় কতই না পরিবর্তন আসে! কোথাও হাজার সুবিধা পেয়েও মানুষের ক্ষোভের কোনো অন্ত নেই, কোথাও আবার কিছুই না পেয়ে মানুষের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। ইটপাথরের হাইটেক জঙ্গল ছেড়ে চিন্তাভাবনারা ডানা মেলে উড়ে গেল প্যাস্টেলরঙিন পর্বতসমূহের মাঝে ছড়ানো শুভ্রশীতল চাদরের ওপরে দিয়ে কাঠের স্লেজগাড়ি বয়ে নিয়ে চলা জাঁসকারী মানুষগুলোর কাছে।
তিনদিন হয়ে গেছে লেহ এসেছি। মধ্য জানুয়ারির হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডাটায় এখনও পুরোপুরি মানিয়ে নিতে পারিনি। দিনের বেলা মাইনাস দশ ডিগ্রি আর রাতের দিকে তাপমাত্রার পারদ গড়ে মাইনাস চব্বিশে নেমে যাচ্ছে। আগেরদিন ভোররাতে তো মাইনাস আটাশে নেমেছিল। হোটেলের রুমহিটার ছিল তাই রক্ষে। কিন্তু এরপর কী যে হবে কে জানে! আমাদের ট্রেক শুরু হবে কাল থেকে। এই ঠাণ্ডায় খোলা আকাশের নিচে তাঁবুর ভিতরে বেঁচে থাকব তো! ট্রেকলিডার রজত বলেছেন কম করে চারটে আপার লেয়ার, দু-তিনটে লোয়ার লেয়ার ও দুটো মোজা অবশ্যই পরতে। মাথা, হাত, কান, মুখ, নাকও যতটা সম্ভব যেন ঢাকা থাকে। রজতের কথা মত আমরা দুদিন আগে লেহ থেকেই ড্রেস রিহার্সাল শুরু করে দিয়েছিলাম। আজকের পরে পাঁচদিন থাকবে না কোনো রুমহিটার, রাতে শোয়ার নরম গদি, ননভেজ খাবার, ইন্টারনেট বা মোবাইল পরিষেবা। তাই হোটেলের ওয়াই-ফাইয়ের সদ্ব্যবহার করে পেটপুরে মুরগির ঝোল সাঁটিয়ে হিটারের উষ্ণতা মেখে বিছানায় প্রায় মিশে গেলাম। গত পাঁচবছর ধরে দেখে চলা স্বপ্নকে অবশেষে বাস্তবায়িত করার পালা। ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া চাদরসদৃশ জাঁসকার নদীর বুকে পা রাখার স্বপ্নকে পূরণ করার পালা।
সিন্ধুনদের এক অন্যতম উপনদী জাঁসকার। লেহ শহর থেকে কিছু কিলোমিটার দূরে নিম্মো বলে এক গ্রামের কাছে সিন্ধুর জলে মিশে যায় জাঁসকার। এই নদীর অববাহিকাই জাঁসকার উপত্যকা নামে পরিচিত। দুর্গম পর্বতের অন্তরালে স্থিত এই উপত্যকার পাদাম, লিংশেড, নেরাক গ্রামগুলো প্রায় সারা বছরই লাদাখের অন্যান্য এলাকার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে। কার্গিলের দিক থেকে পাদাম যাওয়ার একটা রাস্তা থাকলেও অতিরিক্ত তুষারপাতের কারণে অনেক সময়ই সেই রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। শীতকালে জাঁসকারের জল জমে গেলে সেই জমাট নদীখাতই হয়ে ওঠে বহির্বিশ্বের সাথে জাঁসকারী জনজাতির একমাত্র যোগাযোগের পথ। তাই জাঁসকার নদীর বরফের সাদা 'চাদর'ই স্থানীয়লোকদের কাছে জীবনধারণের পথ - রুজিরুটি, ভগবান, মা। প্রকৃতির প্রতিকূলতাকে জীবনের অনুকূলে নিয়ে আসার এক অনন্য উদাহরণ এই 'চাদর'। ঠিক কবে থেকে এই প্রথা চলে আসছে তা কেউ ঠিক মত বলতে না পারলেও স্থানীয় লোকেদের মতে এই রীতি প্রায় হাজার বছরের পুরনো। বহিরাগতরা 'চাদর' বলতে জমেযাওয়া শ্বেতশুভ্র নদীর বিস্তৃত পথ বুঝলেও লাদাখি ভাষায় এর মর্মার্থ কিছুটা আলাদা। 'চা' শব্দের অর্থ পাখি ও 'দর' শব্দের মানে বরফ। কথিত আছে হাজার হাজার বছর আগে রূপকথার এক পাখির (হিরামন পাখি নাকি!) মুখে স্থানীয়রা প্রকৃতির বানানো এই তুষারপথের কথা জানতে পারেন। সেই থেকে 'চাদর' নামে পরিচিত এই বরফের নদীপথ। যুগপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জাঁসকারী মানুষদের জীবন সংগ্রামের এই পথ পরিবর্তিত হয়েছে শহুরে লোকেদের ক্ষণিকের অ্যাডভেঞ্চার ট্রেকিংয়ে। সেই গড্ডলিকাপ্রবাহে গা ভাসিয়ে আমিও চলে এলাম রোমাঞ্চের টানে চাদরের বুকে।
আমাদের ট্রেকের যেখানে শুরু, লেহ থেকে সেখানে আসতে প্রায় দুঘণ্টা মত লাগল। পুরো রাস্তা মোটামুটি ভালো হলেও শেষের কিছু কিলোমিটার এবড়োখেবড়ো। জাঁসকার নদীর গা বেয়ে চলে যাওয়া এই রাস্তা তৈরির কাজ এখনও শেষ হয়নি। রাস্তা যেখানে গিয়ে আপাতত শেষ হয়েছে সেখানেই ট্রেকের শুরু। প্রতিবছর রাস্তা যত সামনে এগিয়ে চলবে ট্রেকের মেয়াদও তত কমতে থাকবে। এক সহযাত্রী চাদর ট্রেকের ভবিষ্যৎ নিয়ে আফসোস করলে রজত তীব্র প্রতিবাদ জানালেন। তাঁর মতে এখানকার সাধারণ মানুষের কাছে সবরকম সুযোগসুবিধা পৌঁছে দেওয়ার জন্য এই রাস্তা খুবই জরুরি। জাঁসকারী লোকেদের কাছে দুমাসের ট্রেকিং-এর সুবাদে আয়ের তুলনায় সারা বছরের সুষ্ঠ যোগাযোগ ব্যবস্থা বেশি কাম্য।
ট্রেকিং শুরুর আগে রজত সবাইকে ডেমো দিলেন চাদরের ওপরে কোথায় কীভাবে চলতে হবে। যেখানে বরফের চাদর গুঁড়ো গুঁড়ো, ওপরের আস্তরণ এবড়োখেবড়ো, সেখানে স্বাভাবিকভাবে চললেই হবে। কিন্তু চাদর বেশিরভাগ স্থানেই সম্পূর্ণ মসৃণ, একটা আইসকিউবের ওপরের তলের মত পিচ্ছিল। চলতে গেলেই চিৎপটাং হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সামনের দিকে হাল্কা ঝুঁকে পা ঘষে ঘষে নিয়ে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। অনেকটা আইস স্কেটিং করার মত আর কী!
ডেমোর পরে খেয়েদেয়ে শুরু হল চাদরে গা ভাসানোর (পড়ুন 'পা ভাসানো') পালা। আমাদের সকলের সামনে আছে বছর তিরিশের লাদাখি যুবক জাম্পেল। সে-ই আমাদের পথপ্রদর্শক, গাইড। সবার পিছনে রজত। মাঝখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা কিছু অ্যাডভেঞ্চারলোভী মানুষ। আমাদের বাবুর্চি, পোর্টার, হেল্পাররা খাওয়াদাওয়ার পরে সবকিছু গুছিয়ে আসবেন। গুটিগুটি পায়ে পেঙ্গুইনের মত চলেছি আমরা। সবাই একটু বেশিই সতর্ক হয়ে চলেছি। এই বুঝি পড়ে গেলাম। সামনে এঁকেবেঁকে চলে গেছে বরফের নদী। লাল, খয়েরি, হলুদ, কমলা, কালো, আরও কত কী রঙে সাজানো ন্যাড়া পাহাড় আকাশছোঁয়া দেওয়াল তুলে দাঁড়িয়ে আছে। তারই বুক কেটে বরফের ছুরির মত বয়ে গেছে জাঁসকার। মাঝে মাঝে এখানেসেখানে ফাটল বা গর্তের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে আসছে ফেনিল নীল খরস্রোত। পায়ের নিচে দিয়ে বয়ে চলেছে এক খরস্রোতা নদী – ভেবেই গায়ে কাঁটা দেয়।
প্রথমদর্শনের মুগ্ধতার পালা শেষ হতেই চাদর তার আসল রূপ দেখাতে শুরু করল। আরম্ভ হল পতনের অর্কেস্ট্রা। এক সহযাত্রী, তড়িৎ, গাইড জাম্পেলের কথা ঠিকমত না শুনে অন্যপথে যেতে গিয়ে চাদরের পাতলা আস্তরণে পা দিলেন। ব্যাস আর যান কোথায়! তড়িৎবাবু তড়িৎবেগে ঢুকে গেলেন জাঁসকারের বুকে! সেখানে জল ছিল কোমর অবধি, স্রোতও সেরকম নেই। ভেসে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই সেখানে নেই। তাও তড়িৎবাবু নিজেকে বাঁচানোর স্বাভাবিক তাগিদে হাতপা ছুঁড়ে উঠতে চাইলেন ও আশেপাশের কিছুটা চাদর ভেঙে ফেললেন। অবশেষে জাম্পেল ও অন্য একদলের গাইডের মাধ্যমে ওনাকে ওপরে তোলা হল। রজতের কথামত সবাই পিঠের ব্যাগেই অতিরিক্ত দুজোড়া মোজা ও প্যান্ট ছিল। তড়িৎবাবুকে তাড়াতাড়ি মুছিয়ে শুকিয়ে জামাকাপড় পাল্টে ওয়ার্মি ব্যবহার করে গরম করা হল। আধঘণ্টা বাদে যাত্রা পুনরারম্ভ হল। বাকি সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম – এবার কার পালা?
সৌভাগ্যবশত তড়িৎবাবুর মত সঙ্গিন অবস্থা বাকিদের হয়নি। তবে কম করে একবার সবারই ছন্দপতন প্রায় হয়েছে। মানুষ যে কত বিভিন্ন ভাবে বিচিত্র ভাবে পড়ে যেতে পারে তা হয়ত এই ট্রেকে না এলে জানতে পারতাম না। কেউ পিছনে উল্টে, কেউ সামনে মুখ থুবড়ে, কেউ থেবড়ে বসে, কেউ পাশে টাল খেয়ে, কেউ দু'পা ছড়িয়ে, কেউবা প্রায় ডিগবাজি খেয়ে কুপোকাত হলেন। আমিও বাকি থাকি কেন? পিছনে আসা সহযাত্রীকে অতিরিক্ত পিচ্ছিল বরফসম্পর্কে সতর্কে করতে গিয়ে নিয়েই পা হড়কে থেবড়ে বসে পড়লাম পাথরের মত বরফে। পশ্চাৎদেশ আর কোমরে এতটাই লাগল যে যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠলাম। পিছনে আসা সহযাত্রী চিন্তিত হয়ে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন ঠিক আছি কিনা। ব্যথায় টনটন করলেও নিজেকে ছোট দেখাতে নারাজ আমি 'একদম ঠিক আছি' বলে লাঠি ধরে আস্তে আস্তে উঠে বসে ধীরগতিতে চলতে থাকলাম। সেই ব্যথার রেশ দুসপ্তাহ পর্যন্ত রয়েছিল!
তবে ঘনঘন পতনও আমাদের আটকাতে পারেনি। মন্থরগতিতে হলেও এগিয়ে চললাম। উঁচু পাহাড়েরা বেশিরভাগ স্থানেই সূর্যালোক আটকে রেখেছে। তার সঙ্গে পাহাড়ের মাঝখান থেকে বয়ে আসছে হাড়জমানো ঠাণ্ডা হাওয়া। দিনের বেলা তাপমাত্রা মাইনাস পনেরোর কাছাকাছি। যতক্ষণ চলতে থাকছি সেরকম ঠাণ্ডা লাগছে না। কিন্তু দুমিনিট দাঁড়িয়ে গেলে পায়ের হাল্কা ঘাম জমে বরফ হয়ে গিয়ে পায়ের আঙুল অবশ করে দিচ্ছে। কোথাও বিশ্রাম করতে হলেও এক জায়গাতে দাঁড়িয়েই তাই ক্রমাগত 'লেফটরাইট' করে যেতে হচ্ছে। অল্প হলেও কিছু জায়গাতে সূর্যের আলো পাওয়া গেল। সাদা বরফ আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে চোখ ঝলসে দেয়। সানগ্লাস ছাড়া গতি নেই সেখানে।
চাদর আমাদের প্রতি মুহূর্তে অবাক করে চলেছে। কোথাও কংক্রিটের মত বরফের চাঁই, কোথাও নীলাভ পাতলা স্তর, কোথাও স্বচ্ছ কাঁচের মত বরফের নিচে দৃশ্যমান নদীর বুকের নুড়িপাথর, তো কোথাও নদীর জমে যাওয়া ঢেউ। কোথাও চাদর এতটাই জমাট বাঁধা যে নদী বলে মনেই হয়না। দুই পাহাড়ের মাঝে বরফঢাকা জমি যেন। কোথাও নদীর দুপারের কেলাসিত বরফের পুরু আস্তরণের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে চঞ্চলা ভয়ংকর জলের ধারা। কোথাও আবার চাদরের চিহ্নমাত্র নেই। পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে যাওয়া ছাড়া পথ নেই। নুড়িপাথরময় পাহাড়ের বুকে সবুজের দেখা পাওয়া যায়না। একদম শিখরের দিকে পবিত্র জুনিপার গাছের বিচ্ছিন্নভাবে দেখা মিললেও পাহাড়ের দেহ সম্পূর্ণ নগ্ন। তাই গাছের শেকড়বিহীন আলগা মাটিতে সাবধানে চলতে হয়। পা হড়কে যাওয়ার ভয় থাকে। আর এখানে পড়ে যাওয়া মানে বরফগলা নদীর বুকে সমাধি। জলের টানে বরফের মোটা চাতালের নীচে একবার চলে গেলে জীবনদীপ ওখানেই নির্বাপিত হবে।
প্রায় সাড়ে তিনঘণ্টা চলার পরে প্রথম রাতের ক্যাম্প সোমোতে এসে পৌঁছলাম। নদীর বাঁপাশে পাহাড়ের ঢালে আমাদের ক্যাম্পসাইট। পৌঁছে দেখি অবাক কাণ্ড। আমাদের ক্যাম্পগুলো ইতিমধ্যে টাঙানো রয়েছে। আমাদের সাহায্যকারী দল আমাদের জন্যে গরম চা-স্ন্যাক্সের ব্যবস্থা করে রেখেছেন। পান করার গরম জলও রেডি। এঁরা সবাই আমাদের পিছনে ছিলেন। কখন কী করে অতিক্রম করে চলে এলেন বুঝতেই পারিনি। সাহায্যকারী দলের সবাই স্থানীয় জাঁসকারী বা লাদাখি। পথে অনেক স্থানীয় লোকেদের সঙ্গে দেখা হল - কাঠের ছোট্ট স্লেজগাড়ি করে মাল বয়ে নিয়ে আসছিলেন তাঁরা। অসহ্য ঠাণ্ডা ও কঠোর পরিশ্রমের মধ্যেও অপরিচিত বহিরাগতদের দেখে 'জুল্লে' বলে সৌজন্য দেখাতে ভোলেননি। লাদাখি ভাষায় 'জুল্লে' শব্দের অর্থ 'নমস্কার'। উত্তেজনার বসে আমরা এটাই ভুলে গেছিলাম কে আমাদের রাতে খাবার বানিয়ে দেবে, বাসন মাজবে, জল গরম করবে, ক্যাম্প টাঙাবে। এঁরা কিন্তু নিজেদের দায়িত্বে অবহেলা করেননি। প্রতিকূল পরিবেশেও আমাদের যাতে অসুবিধা না হয় তার জন্য আপ্রাণ খেটে চলেছেন।
রজতের আদেশানুসারে ক্যাম্পে এসেই আগে মোজা পালটে নিলাম। স্যুপ, রুটি তরকারি উদরস্থ করে তাড়াতাড়ি স্লিপিং ব্যাগের উষ্ণতায় আশ্রয় নিলাম। জাম্পেলের কথামত গামবুটজোড়াকে মাথার বালিশ বানিয়ে দেখলাম বেশ আরামের। বাইরের তাপমাত্রা তখন প্রায় মাইনাস একুশ। তবে এক ক্যাম্পে তিনজন একসঙ্গে শোয়াতে রাতে সেরকম ঠাণ্ডা লাগল না।
দ্বিতীয় দিন প্রাতরাশ সেরে সকাল নটার মধ্যে সবাই বেড়িয়ে পড়লাম পরবর্তী ক্যাম্প টিব গুহার উদ্দেশ্যে। সকালবেলা স্লিপিং ব্যাগের ওম ছেড়ে বাইরের ফ্রিজারে পা রাখা অত্যন্ত দুষ্কর হচ্ছিল। তবে এই ঠাণ্ডায় কাঁপুনির চেয়েও ভয়ংকর প্রাতঃকৃত্যের ভাবনা। শহুরে শৌখিন মানুষদের রাজ্যের জামাকাপড় চাপিয়ে গর্তোখোঁড়া পিট টয়লেটে গিয়ে বসতে গেলে যে কি সাংঘাতিক মানসিক ও শারীরিক দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় তা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। জল ব্যবহারের তো প্রশ্নই নেই, কাগজই একমাত্র ভরসা। কিছুটা পরিষ্কারপরিছন্নতার জন্য যে সিক্ত টিস্যু (Wet Tissue) ব্যবহার করব তারও উপায় নেই। সে বান্দা তো জমে পাথর! আমাদের সাথে থাকা স্থানীয় মানুষগুলোর এইসব নিয়ে কোনো ভাবনাই নেই। এইসব তাঁদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে – প্রাত্যহিক জীবনের অঙ্গ।
আজ সকাল থেকেই আকাশের মুখভার। কালকের ঝকঝকে আকাশ আজ মেঘাছন্ন। রজত ও জাম্পেলের মাথায় ভাঁজ। চাদর চলাচলের যোগ্যভাবে জমে থাকার জন্য পরিষ্কার আকাশ খুবই দরকার। তাই বুকে আশঙ্কা নিয়েই এগিয়ে চললাম। আজকের প্রেক্ষাপট যেন আরও বেশি নাটকীয়। অর্ধেক ও পূর্ণ জমে যাওয়া কিছু জলপ্রপাত, বিস্তৃত এলাকা ছেড়ে হঠাৎ করে খুব সরু নদীখাতে ঢুকে পরা, দুরন্তবেগে ঢালের দিকে বয়ে চলা নদীর পাশের পাহাড়ে দড়ি বেয়ে সন্তর্পণে এগোনো, গ্লাস সারফেসের মত চাদরের পাশে শান্ত নীল ধীরগতিতে বহমান ধারায় বরফের চাঁইদের ভেসে চলা – প্রকৃতির ভয়ংকর সুন্দর রূপ কি একেই বলে?!
পথ চলতে চলতে শুরু হল তুষারপাত। প্রথম প্রথম খুব হাল্কা ভাবে হলেও একসময় খুব বেশিই পড়তে থাকল। খয়েরি পাহাড়ে যেন কেউ ধীরে ধীরে চকের গুঁড়ো ছড়িয়ে দিচ্ছে। হোটং বলে একটা জায়গায় এসে আমরা সবাই দাঁড়ালাম। সামনে চাদরের স্তর একটু গলে গেছে। গোড়ালির একটু ওপর পর্যন্ত জল উঠছে। যদিও গামবুট পরে থাকায় পা ভিজে যাবেনা এই জলে। কিন্তু রজত স্থানীয় লোকেদের সাথে পরামর্শ করে আগে না যাওয়ার ফয়সালা করলেন। কারণ আজকের খারাপ আবহাওয়ায় চাদর আরও গলে যাবে তাতে ফেরত আসা মুশকিল হবে। এই ঠাণ্ডায় কোথাও আটকে গেলে আর বাঁচায় কে! তাই হোটংয়েই ক্যাম্প করা হবে স্থির হল। আমাদের সঙ্গে একটি দল ছাড়া বাকিরা সামনে এগিয়ে গেল ওই জলের মধ্যে দিয়েই। তাতে আমাদের দলের কেউ কেউ একটু ক্ষুব্ধ হলেন। তাঁদের ধারণা আমরাও পারলে এগিয়ে যেতে পারতাম। রজত তাঁদের আশ্বস্ত করলেন কালকে আবহাওয়া ঠিক হলে চাদর আবার জমে গেলে আমরা সামনে অবশ্যই যাব।
যাইহোক যতক্ষণে ক্যাম্প লাগানো হচ্ছে আমরা পাহাড়ের গায়ে এক গুহাতে আশ্রয় নিলাম। যখন চাদরে চলা শহুরে মানুষদের রোমান্টিসিজমে পরিণত হয়নি, যখন চাদর মানেই ছিল শুধুমাত্র জীবন সংগ্রাম, জাঁসকারী মানুষেরা তখন এইসব গুহা রাত্রিবাসের জন্য ব্যবহার করতেন। ক্যাম্পের চেয়ে বেশি আরামদায়ক এই গুহাগুলো। এখনো ট্রেকিংয়ের সময় বাবুর্চি, পোর্টার, হেল্পাররা এইসব গুহাতেই রাত কাটান। আমাদের পোর্টাররা যে গুহা দখল করেছিলেন সেখানেই আমরা সবাইও সেঁধিয়ে গেলাম। কাঠের আগুনে হাত-পা সেঁকতে সেঁকতে তাঁদের সঙ্গে গল্প জুড়লাম। আমাদের সামনেই কথা বলতে বলতে তাঁরা চা বানালেন, রান্না করলেন, জল গরম করলেন। আমরা বসে থাকাতে তাঁদের কাজে অনেকটাই ব্যাঘাত ঘটছিল। কিন্তু কোনো বিরক্তির প্রকাশ নেই। বরং হাসিমুখে, মজা করে, গান গেয়ে সময় কাটিয়ে দিলেন। জ্বালানি শেষ হলে শুকনো কাঠের যোগান দিলেন যাতে আমরা দেহ উষ্ণ রাখতে পারি। এই অঞ্চলে গাছপালা সেরকম নেই। আর লেহ থেকে বয়ে বয়ে প্রচুর কাঠ ট্রেকে আনাও সম্ভব নয়। এই কাঠ পেতে পাহাড়ের ওপরে উঠতে হয়। কখনো কখনো একবস্তা কাঠ যোগাড় করে আনতেই তিন চার ঘণ্টা লেগে যায় তাও সব কাঠ শুকনো পাওয়া যায় না। কথাটা হাসিমুখে জানালেন আমাদের এক পোর্টার। সামনে জ্বলতে থাকা কাঠগুলোর দিকে চেয়ে নিজেদেরকেই অপরাধী মনে হল। হয়ত এই কষ্টার্জিত কাঠ ঠাণ্ডার হাত থেকে বাঁচতে তাঁরা রাতের বেলা গুহার মুখে জ্বালাতেন। কিন্তু আমরা একটু আগুন চাইতে হাসিমুখে আমাদেরকেই দিয়ে দিয়েছেন জ্বালানিগুলো। সত্যি মানুষগুলো কতই না সরল! প্রকৃতির প্রতিকূলতার সাথে কি মানবমনের সারল্য বৃদ্ধি পায়? নাহলে জীবনযাত্রার হাজার সুযোগসুবিধা উপভোগ করেও আমরা শহরবাসীরা এত জটিল কেন?
আগুনের স্পর্শ থেকে বাইরে আসতেই কেঁপে গেলাম। দেহ গরম করতে সবাই মিলে এক অভিনব পথ বের করলাম – চাদরের ওপরে নৃত্য। গুঁড়ো গুঁড়ো তুষার চাদরের ওপরে পরে থাকাতে বরফের পিচ্ছিলতা অনেকটা কমে গেছে। নাচতে গিয়ে কেউ আর ডিগবাজি খেল না। নৃত্যচর্চা শেষ হতেই রাতের খাবারের ডাক পরে গেল। খেয়েদেয়ে এবার রাতকাটানোর পালা। তুষারপাতে ক্যাম্পের অনেকটা বরফে ঢেকে গেছে। ভিতরে ক্যাম্পের গায়েও ফ্রস্ট জমে গেছে। প্লাস্টিকের বোতলের জলও অর্ধেক জমে গেছে। তবে মেঘলা আবহাওয়ার জন্য ঠাণ্ডা অনেক কম লাগছে। পরেরদিন সামনে এগিয়ে যেতে পারব কিনা ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম।
ঘুম ভাঙল একদম সকাল ছটা নাগাদ। দিনের আবছা আলোয় দেখলাম আগের দিনে টানা তুষারপাতে পাহাড়ও চাদর প্রায় একাকার হয়ে গেছে সাদা রঙে। সামনে এগিয়ে চলার পথের দিকে তাকিয়ে চক্ষু চড়কগাছ! সামনে চাদর বলে আর কিছু নেই। বরফের স্তর গলে জল বইছে। পা ডোবালেই জল হাঁটুর ওপরে চলে যাবে। গামবুটের ভেতরে ঢুকে যাবে। জাম্পেল একটু এগিয়ে দেখে এলেন আগেও একই রকম অবস্থা। আশপাশের পাহাড় এতটাই খাড়া যে তার ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া শহুরে মানুষের কাজ নয়। আমরা অপেক্ষা করলাম উল্টোদিকে দিয়ে কেউ আসে কিনা দেখার জন্য। বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তাহলে ধারণা পাওয়া যাবে।
প্রায় আধঘণ্টা বাদে এক যাত্রীদলের দেখা পাওয়া গেল। পোর্টার-গাইড ছাড়া দলে ছ-সাতজন লোক। প্রত্যেকের ট্রাউজার হাঁটুর অনেকটা ওপরে তোলা, প্রায় কাছা পরার মত অবস্থায় রয়েছে। পায়ে গামবুট, কিন্তু জেনেছিলাম কেউই মোজা পরে ছিলেন না। গাইড নানান উত্তেজক কথা বলে সমানে উৎসাহিত করছেন। কিন্তু দলের কাউকে দেখেই মনে হচ্ছে না তারা খুব একটা উৎসাহিত বোধ করছেন। সবার মুখ বিবর্ণ, বিভীষিকাময়। জল ঠেলে আমাদের ক্যাম্পের কাছে পাথুরে জমিতে আসতেই শুরু হল দহরম মহরম। দলটির এক বিদেশি জুতো খুলে উদ্ভ্রান্তের মত দৌড়াতে লাগলেন। 'ফায়ার''ফায়ার' করে চীৎকার করতে লাগলেন। তাড়াতাড়ি তাঁকে গুহার ভিতরে এনে আগুনের কাছে বসানো হল। বাকিরা ঠাণ্ডায় ঠকঠক করে কাঁপছেন। কেউ কেউ ঠাণ্ডা সহ্য না করতে পেরে কাঁদতে লাগলেন। আমাদের দলের স্থানীয়রা এগিয়ে গেলেন সাহায্য করতে। হাত-পা ঘষে দিলেন, গরম জলের জোগান দিলেন। সবাইকে বলা হয়েছিল জল থেকে বেরিয়েই যেন গামবুট খুলে পা ভালো করে মুছে মোজা পরে নেন। সবাই তা করলেও একজন সঙ্গে সঙ্গে গামবুট খোলেননি। পাঁচ-দশ মিনিট পরে খোলার চেষ্টা করতে গেলে সে জুতো আর পা থেকে বেরোয় না। ঠাণ্ডা জল পায়ের ভেতরে জমে পা আটকে দিয়েছে। আরো দু'জন মিলে প্রায় অনেকক্ষণ ধরে টেনে প্রায় যুদ্ধ করে সেই জুতো বার করলেন। এইসব কিছু দেখার পরে আমাদের সকলের সামনে টিবগুহার দিকে যাওয়ার ইচ্ছেটাই চলে গেল। যাত্রীদলটির গাইড জানালেন যে ওঁরা আগের রাতে হোটং থেকে মাত্র একশো মিটার এগিয়েই ক্যাম্প করেছিলেন। এইটুকু রাস্তা আসতেই এরকম অবস্থা! না জানি সামনে আর কী কী চমক অপেক্ষা করতে পারে! আমরা তাই টিব হয়ে আমাদের এই ট্রেকের গন্তব্য নেরাক জলপ্রপাত যাওয়ার আশা পরিত্যাগ করে আবার সুমোর দিকেই যাওয়া শ্রেয় মনে করলাম।
ব্যাগ গুছিয়ে যে পথে এসেছি সেই পথেই আবার চলা। সামনে না যেতে পারায় মনটা একটু খারাপ ছিল। কিছুদূরে গিয়ে যদিও সেটা উধাও হয়ে গেল। তীব্র আলোতে তুষারাবৃত পাহাড়-নদী ঝকঝক করছে। গাঢ় নীল আকাশে এক ফোঁটাও মেঘ নেই। রজত বললেন এইরকম পরিবেশে রাতের বেলা ভালো চাদর তৈরি হয়। আমাদের আর সে নিয়ে ভেবে আপাতত লাভ নেই। ফিরতি পথে অনেক যাত্রীদলকে দেখলাম সামনে এগিয়ে চলেছেন। তাঁরা কী করে যে গন্তব্যে পৌঁছবেন ঈশ্বরই জানেন।
গুঁড়ো বরফে পিচ্ছিলতা কমে যাওয়ায় পথ চলতে কোনো কষ্টই হল না। এই একদিনেই চাদর অনেকটা বদলে গেছে। কোথাও ভেঙে যাওয়া বরফ আবার জোড়া লেগেছে। কোথাও আবার আগেরদিনের হেঁটে আসা পথের কোনো চিহ্নই নেই। বরফ গলে জলের ধারা বইছে।আমাদের সঙ্গে সেরকম কাউকে ফিরতে দেখলাম না। ফাঁকা পথে অন্তহীন পাগলামি, লাফালাফি, নাচানাচি করলাম। কনকনে ঠাণ্ডা জলে চুমুক লাগাতেও ছাড়লাম না। এত কিছুর পরেও দুপুর একটার মধ্যে সুমোতে পৌঁছে গেলাম। সময় কাটাতে জাম্পেল আমাদের পাহাড়ের ভিতরে নিয়ে গেলেন। ক্যাম্পের সামনে বয়ে চলা ছোট্ট ঝোরাকে অনুসরণ করতে করতে চড়াইয়ের পথে চললাম। এ যেন এক নতুন দুনিয়া! চারদিকে খয়েরি-হলুদ পাহাড় দিনের শেষ আলোকে যেন আগুনরঙা! মাঝখানে অনেকটা কড়াইয়ের মত ছোট উপত্যকায় আমরা। দূরে পাহাড়ের ওপরে ধরাছোঁয়ার বাইরে জুনিপার গাছের সারি। নিচে বুনো গাছেরা ইতস্তত ছড়িয়ে আছে। পাহাড়ি ঝোরার হাল্কা মৃদু শব্দ। কোথাও কোথাও পথ না থাকায় ঝোরা পার করে যেতে হচ্ছে। সেই ঝোরা এক জায়গায় এসে আধা জমে থাকা ছোট জলপ্রপাতের চেহারা নিয়েছে। আশেপাশে আর কেউ নেই। শুধু আমরা ক'জন যেন হাজার প্রতিকূলতা পেরিয়ে এসেছি রোমাঞ্চ উপন্যাসের পাতা থেকে উঠে আসা এক বিচিত্র দেখে গুপ্তধনের সন্ধানে। ভেবেই গায়ে কাঁটা দেয়।
সুমো অভিযান শেষে ক্যাম্পে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। আগুনের ধারে গল্প আর গান করতে করতে রাত নেমে এল। জ্যোৎস্না আজকে ফেটে পড়ছে, টর্চেরও দরকার পড়ছে না। চাঁদের আলোয় চাদর যেন অপার্থিব! সেই রূপ অবর্ণনীয় – স্মৃতিতে বেঁচে থাকবে চিরন্তন।
আহার সেরে ক্যাম্পে শুয়ে ভাবলাম আজও ভালোই ঘুম হবে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই ঘুম ভেঙে গেল কাঁপুনিতে। সারা শরীর গরম, কিন্তু পায়ের আঙুল জমে বরফ। চারটে মোজা পরে পায়ে পা ঘষেও কোনো লাভ হল না। অগত্যা কাঁপুনি সহ্য করা ছাড়া রাস্তা নেই। আমার পাশে শোওয়া সহযাত্রীও কাঁপছেন। চেক করে নিলাম ক্যাম্পে কোথাও ফাঁকফোকর আছে নাকি যেখান থেকে ঠাণ্ডা হাওয়া ঢুকতে পারে। কিচ্ছু নেই। তাহলে কেন? হঠাৎ রজতের কথাটা মনে পড়ল। পরিষ্কার আকাশে চাদর জমে ভালো। সেই পরিষ্কার আকাশ আমাদেরকেও জমিয়ে দিচ্ছে। সকাল পর্যন্ত বাঁচব কি?
কাঁপতে কাঁপতে কোনোমতে বেঁচে গেলাম। সকালে জানতে পারলাম আগেরদিন রাতে সবারই একই অবস্থা হয়েছিল। তাপমাত্রা ছিল মাইনাস পঁচিশের কাছাকাছি। আজকেও বেশিদূর চলার নেই। আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল যেখান থেকে সেখানেই আজকের ক্যাম্প। আকাশ পরিষ্কার থাকলেও অনেক জায়গায় চাদর খুবই পাতলা হয়ে এসেছে। সাদা বরফের জায়গায় পাতলা নীলাভ বরফের স্তর দেখা যাছে। জাম্পেল বলল চাদর আর বেশিদিন থাকবে না। ফেব্রুয়ারির শুরু থেকেই ভাঙতে শুরু করে দেবে। এ বছরের মত ইতি হবে চাদর ট্রেকের। ক্যাম্পে ফিরে রজত জানালেন টিব গুহার ওখানে প্রায় একশ ত্রিশজন আটকে গেছেন চাদর অনেকটা গলে যাওয়ায়।
যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম সেখানেই আজকে ক্যাম্প। চাদরের বুকে আজকেই অন্তিম দিন। না জানি পরে আবার আসতে পারব কিনা! শেষ মুহূর্তটুকু উপভোগ করার সময়। পরেরদিন সকালে ফেরার গাড়ি ধরার আগে জাঁসকারের ঠাণ্ডা জলে একবার ডুব না দিলেই নয়। সবাই মিলে সেই প্ল্যানই করছি চা-মুখরোচকের সাথে। তখনই আমাদের রাঁধুনি-পোর্টার-হেল্পাররা একটি ট্রেতে সবার জন্য নিয়ে এলেন জুনিপার গাছের সুগন্ধি পাতা। জুনিপার স্থানীয় মানুষদের কাছে এক অতি পবিত্র গাছ। ধুপগাছ নামেও পরিচিত এই গাছের পাতা বৌদ্ধরা ঘরে বা বৌদ্ধমন্দিরে জ্বালিয়ে থাকেন সুগন্ধী ধোঁয়ার জন্য। ঘরে আসা অতিথিকে জুনিপারের পাতা দেওয়ার অর্থ তার মঙ্গলকামনা করা।
কোনো ভেদাভেদ না রেখে আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে বসলাম। জাঁসকারী মানুষগুলোর জীবনসংগ্রামের গল্প শুনলাম। তাঁরা কীভাবে কষ্ট করে জীবনযাত্রার রসদ সংগ্রহ করেন, ঠাণ্ডার সঙ্গে যুদ্ধ করেন। পড়াশুনা করে অবস্থার উন্নতি করতেও তাঁদের প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হয়। অনেক আবার সিয়াচেনে গাইড হিসাবেও কাজ করেছেন কয়েকমাস। সেখানে মোটা টাকার হাতছানি আছে। কিন্তু পরিবার, বাড়িঘর, পরিবেশ ছেড়ে কেউই বেশিদিন থাকতে চান না। সে যতই ভাঙাচোরা ঘরই হোক বা যত প্রতিকূল পরিবেশই হোক।
সারা যাত্রাপথে একজন মাঝবয়সী খর্বাকার জাঁসকারী পোর্টার আমাদের মাতিয়ে রেখেছিলেন। তাঁর নাম থিল্লে। অন্য স্থানীয়রা যেখানে বহিরাগতদের সঙ্গে কথা বলতে লজ্জা পেতেন সেখানে থিল্লে খুব সহজেই আমাদের সাথে মিশে যেতেন, ইয়ার্কি-খুনসুটি করতেন, নাচগানে ভরিয়ে দিতেন। রজতের সঙ্গে তাঁর খুব ভাব। সন্ধ্যার আসরে রজত থিল্লেকে বললেন, "চল্, আমারসঙ্গে আমার বাড়ি মানালিতে চল্।"
থিল্লে হেই হেই করে বলে উঠলেন, "না না, আমি জাঁসকার-লাদাখ ছেড়ে কোথাও যাবনা। এখানেই ঠিক আছি।"
রজত অবাক হলেন, "কেন? আরামসে থাকতে পারবি ওখানে।"
থিল্লে কাঁচুমাচু মুখে বললেন, "ওখানে সবকিছুই কেমন যেন জটিল। আমার এখানেই ভাল।"
গাড়ির হর্নে ঘোর ভাঙল। বাস চিনারপার্ক অতিক্রম করে হলদিরামের দিকে এগোচ্ছে।
কলকাতার বাসিন্দা আই.টি. প্রফেশনাল অভিষেক মারিক ভালোবাসেন বেড়াতে। মূলতঃ ট্রেকিং। ভারতের বিভিন্ন জায়গায় তো বটেই, এমনকি বিদেশেও। নির্জন শান্ত পাহাড়ি পরিবেশ আর সেখানকার সরল মানুষজন তাঁকে আকর্ষণ করে। সেই টানেই বারবার ছুটে যান হিমালয়ে। এর পাশাপাশি স্থানীয় খাবার চেখে দেখতেও তিনি উৎসাহী। খাওয়া ছাড়া বেড়ানোর মানে আছে নাকি?