ওলন্দাজদের দেশে
পরাগ রঞ্জন দত্ত
৮ আগস্ট, প্যারিস, ২০১২ - খুব ভোরে উঠতে হল। আজ আমরা দুটো দেশ পার হয়ে যাব। এপর্যন্ত পড়ে অনেকের মনে হতেই পারে এ নিছক বানিয়ে বলা নয়তো! সবিনয়ে জানাই একেবারই তা নয়। ইউরোপের অনেক দেশ আয়তনে এতই ছোটো যে প্যারিস থেকে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলস হয়ে আজই নেদারল্যান্ডসের আইন্ডহোভেন পৌঁছাব। আজ সকালবেলা প্যারিস-এর কী রূপ দেখছি! নির্মেঘ নীল আকাশ, লন্ডনের মত ঝিরিঝিরি বৃষ্টি উধাও। ব্রেকফাস্টের পর খুব তাড়াহুড়ো করতে হল। কোচ ছাড়ার অল্প পরেই ফ্রান্সের কান্ট্রিসাইডের সৌন্দর্য চুটিয়ে উপভোগ করছি। সুন্দর সব পাইন বন আর ছোটো ছোটো নদী আমাদের সঙ্গী। প্যারিস থেকে চার ঘন্টার পথ পেরিয়ে ব্রাসেলস পৌঁছে মনে হল যেন এক ঘুমন্ত শহরে প্রবেশ করলাম। ব্রাসেলস ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনের সদর দপ্তর। ব্রাসেলস পৌঁছে চলে এলাম এক ভারতীয় রেস্তোঁরায়, সেখানে আমাদের লাঞ্চের ব্যবস্থা।
ব্রাসেলস ওরিয়েন্টেশন ট্যুর সেরে হালকা বৃষ্টির মধ্যে স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ছটা নাগাদ আইন্ডহোভেন-এর উদ্দেশে রওয়ানা দিলাম। শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে মিনিটকুড়ির দূরত্বে ভেলদোভেনে NH Koningschof হোটেল আমাদের দুরাতের আস্তানা। চারদিক পাইন বনে ঘেরা এক সবুজের সমুদ্রের মাঝে বিশাল প্রপার্টি নিয়ে এই হোটেল। এক গভীর বনের মধ্যে যেন হোটেলটা। ইউরোপে আর কোথাও এমনটি পাইনি। ইউরোপের বিখ্যাত কনফারেন্স হোটেল এই Koningschof। আমরা এখন পশ্চিম ইউরোপের নিচু জমির অঞ্চলে। আক্ষরিক অর্থে নেদারল্যান্ড মানে লো কান্ট্রি। হল্যান্ড বা নেদারল্যান্ডসের লোকদের বলা হয় ডাচ। আমরা ওলন্দাজও বলি কখনো। এই দেশ বিখ্যাত টিউলিপ ও উইন্ডমিল-এর জন্য। দেশের প্রায় কুড়ি শতাংশ এলাকা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে নিচে আর চল্লিশ ভাগ অঞ্চলই সমুদ্র থেকে মাত্র এক মিটার ওপরে। আইন্ডহভেনের নাম এলেই মনে পরে যায় ফুটবল ক্লাব পি.এস.ভি.আইন্ডহোভেনের নাম, যার আদ্যাক্ষর পি এসেছে বিখ্যাত মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি ফিলিপসের নাম থেকে, যার সূচনা হয়েছিল ১৮৯১ সালে আইন্ডহোভেনে জেরার্ড ফিলিপস-এর হাত ধরে।
দুটো দেশ পার হয়ে এসেছি। ক্লান্তিতে বিপর্যস্ত। টেবিলে কমপ্লিমেন্টারি চা-কফি রাখা আছে। হাতে সময় কম তাই একটু বিশ্রাম নিয়ে ব্রাজিলিয়ান কফিতে চুমুক দিতেই সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল । এরপর সোজা চলে গেলাম ডাইনিং হলে। অনেক খাবারদাবারের মাঝে দেখি এককোণে ট্রেতে সিঙ্গাড়াও আছে। ট্যুর ম্যানেজারকে ডেকে বলি এই বিদেশে সিঙ্গাড়া কে বানালো? বললেন, দাঁড়ান একটু। পাঁচ মিনিট বাদেই এক ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন আপনাদের আজকের সন্ধ্যার শেফ। মনে পরে গেল ট্যুর অপারেটর বলেছিল বটে ইউরোপে বিশুদ্ধ ভারতীয় খাবার পাবেন। সত্যিই তো তাই!
পরদিন সকাল সাড়ে ছটায় উঠে পড়লাম। এক কুয়াশামাখা সকাল। আজ দিনভর ঠাসা প্রোগ্রাম। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে আটটার মধ্যে বেরোতে হবে। চারদিক কেমন যেন নিস্তব্ধ। অজানা পাখির কিচির মিচির শুনতে পাচ্ছি। পাইন ও নাম না জানা গাছের ফাঁকে ফাঁকে সূর্যের নরম আলো ছড়িয়ে পড়েছে শিশিরভেজা ঘাসের ওপর। এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। স্নান সেরে চলে এলাম ডাইনিং হলে। এখানে এক বাঙালি পরিবারের সঙ্গে বেশ জমাটি গল্প হল। এঁরা এক এন আর আই গ্রুপের সঙ্গে আমাদের ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে একই ট্যুর করছেন। ভদ্রলোক কলকাতার তবে বর্তমানে আমেরিকার বোস্টনে থাকেন, অঙ্কের প্রফেসর। ব্রেকফাস্টের পর এক অপূর্ব পরিবেশে ফটোসেশনের পর সবাই বাসে উঠে বসলাম। আজ চলেছি আমস্টারডামের পথে। তার আগে দ্য হেগ দেখব। আমাদের দুর্ভাগ্য যখন হল্যান্ড ট্যুর করছিলাম তখন আমস্টারডামের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত লিসে (Lisse) শহরের পৃথিবীবিখ্যাত Keukenhof ফ্লাওয়ার গার্ডেন জনসাধারণের জন্য বন্ধ হয়ে গেছিল। আশি একর জায়গা নিয়ে নার্সিসাস, ড্যাফোডিল ও টিউলিপ ফুলের সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল ভীষণ। মে মাসের পর এলে প্রকৃতির এই রূপ আর উপভোগ করা যায়না। Keukenhof দেখতে না পাওয়ার ব্যথা নিয়ে আমরা দ্য হেগ এর পথে রওয়ানা দিলাম।
পথে টিপিকাল ডাচ কান্ট্রিসাইড দেখতে পাব ভেবেই উত্তেজনা অনুভব করছি। আমি ঠিক ড্রাইভারের পেছনের সিটে গিয়ে বসি যাতে ভালো ভিডিও ও স্টিল ফটো তুলতে পারি। কোচ কাপ্টেন লিয়ান্দ্র জিপিএস সেট করে নিয়েছে। বাস চলতে শুরু করলো সেই নির্দেশে। কিছুদূর যাওয়ার পর রাস্তার দুধারে লম্বালম্বি ভাবে কিছু প্লেক দাঁড় করানো দেখে ট্যুর ম্যানেজারকে জিগেস করি ওই বস্তুগুলো কী? উত্তর শুনে হতভম্ব হয়ে গেলাম। এগুলো নাকি সাউন্ড অ্যাবজরভার-এর কাজ করে। হাইওয়ে দিয়ে চলা সমস্ত ট্রাফিকের শব্দ শুষে নেয়, যাতে বসতি এলাকার লোক শব্দদূষণের শিকার না হয়। ভাবছিলাম আচ্ছা আমাদের দেশে এরকম হতে পারেনা! প্রায় দেড় ঘন্টা পর মিউজ (Meuse) নদীর ওপর ব্রিজ পার হয়ে ইউরোপের বৃহত্তম বন্দর শহর রটারডামে প্রবেশ করলাম। রটারডাম ১৯৬২ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত পৃথিবীর ব্যস্ততম বন্দর ছিল। কোচের এলসিডি স্ক্রিনে তখন সব পুরনো দিনের হিন্দি গানের ভিডিও চলছে। আর আধ ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যাব দ্য হেগ যেখানে ডাচ সরকারের প্রধান কার্যালয় ও পার্লামেন্ট অবস্থিত, আর রানি বিয়াট্রিক্স-এর প্রাসাদ। এই শহরেই পাঁচটি আন্তর্জাতিক কোর্ট রয়েছে যার মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিস একটি।
প্রথমেই যাওয়া হল ' Modurodom' মানে 'Hollandin Miniature' দেখতে। এখানে হল্যান্ড-এর অনেক ট্রেডমার্ক যেমন উইন্ডমিল, বাঁধ, রাজপ্রাসাদ ইত্যাদির ক্ষুদ্র সংস্করণ সাজানো আছে। মনে হচ্ছিল যেন লিলিপুটদের দেশে আছি। আর আমরা সব এক একজন গালিভার। সেখানে একঘন্টা কাটিয়ে রওয়ানা দিলাম এক চীজ তৈরির ফ্যকট্রির উদ্দেশ্যে। এখানে বিভিন্ন ধরনের চীজ কিভাবে তৈরি হয় দেখানো হল। বিভিন্ন ধরণের কয়েক টুকরো মুখে দিয়ে মনে হল বড় বেশি নোনতা। হল্যান্ডের চীজ জগতবিখ্যাত শুনেছি তবে মুখে দেবার পর হলফ করে বলতে পারি আমাদের দেশীয় চীজ অনেক ভালো। এরপর চীজ ফ্যাকট্রির উল্টোদিকে ছোট্ট একটা ঘরে আমাদের লাঞ্চব্রেক হল। লাঞ্চ টেবিলে কিছু আশ্চর্য মেনু অপেক্ষা করছিল, যার ভেতর অন্যান্য খাবারের মধ্যে পুরি, রায়তা ও ম্যাংগো জুস দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।
লাঞ্চের পর এই দেশের এক আইকনিক ল্যান্ডমার্ক - উইন্ডমিল দেখতে চললাম আমরা। এক অত্যন্ত সরু রাস্তা ধরে কোচ চলছে। বাঁদিকে সবুজ গমের খেত, অপূর্ব সুন্দর ছোটো ছো্টো কটেজ, সরাইখানা, কাঁচের মত টলটলে জলে ভরা খাল, বিখ্যাত ডাচ ব্রিডের গরু চড়ছে মাঠে। ওই সরু রাস্তায় ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সাইকেল নিয়ে যাতায়াত দেখতে দেখতে বিভোর হয়ে গিয়েছিলাম। এত সবুজ ইউরোপে আর কোথাও দেখিনি। কিছুটা যাবার পর দূর থেকে বাঁদিকে দেখতে পেলাম চারদিকে যেন সবুজের মেলা। তার মাঝে এক উইন্ডমিল, যা দেখার সাধ ছিল মনে সেই কবে থেকে। সেই কবে স্কুলে পড়া চার্লস ম্যাকের 'দ্য মিলার অফ দ্য ডি' কবিতার একটা লাইন মনে পরে গেল যেখানে মিল মালিক বলছে - I envy nobody - no, not I - And nobody envies me। চারিদিকে সবুজ খেত আর জলাজমিপরিবৃত মিলের পাশে দাঁড়িয়ে এই কথা তো বলা যেতেই পারে। এক প্রশান্তি চারদিকের আকাশে বাতাসে। উইন্ডমিলের সামনে ফটোসেশন-এর জন্য বেশ কিছু সময় দেওয়া হল আমাদের। বেশ একটা রোমাঞ্চ হচ্ছিল, এরকম পরিবেশে ছবি তুলে খুব আনন্দ পেলাম। এখান থেকে আমরা টিপিকাল ডাচ উডেন শ্যু ফ্যাকট্রি দেখতে যাব। শ্যু ফ্যাকট্রিতে হাতেকলমে দেখানো হল কী করে কাঠের জুতো বানানো হয়। জেনেছিলাম এই জুতোর নামে ক্লগ (clogs) । মহিলারা নাকি এই জুতো খুব ব্যবহার করেন আর মাঠে কৃষিকাজে এগুলো খুব উপযোগী।
জুতোর কারখানা দেখে আমস্টারডামের পথে রওয়ানা দিলাম। মাঝে মাঝেই জলাজমিবেষ্টিত ছবির মত সুন্দর সুন্দর সব বাড়ি আর বাড়ির পাশে সুদৃশ্য নৌকা বাঁধা। আমস্টারডাম পৌঁছে বাস আমাদের নামিয়ে দিল এক জায়গায় যেখান থেকে ক্যানেল ক্রুজ শুরু হবে। এই ক্যানেল ক্রুজ না করলে আমস্টারডাম দেখাটাই অসুম্পূর্ণ থেকে যাবে। আমাদের ট্যুর ম্যানেজার ক্রুজ-এর টিকেট সংগ্রহ করতে গেলে আমরা কজন উল্টোদিকের রাস্তায় হাঁটতে লাগলাম আর তখনই নজরে এলো পৃথিবীবিখ্যাত ডাচ বিয়ার কোম্পানি Heineken International Lager বিয়ার-এর এক আউটলেট। এই Heineken এক জগতবিখ্যাত ডাচ ব্রুয়ারি এবং অনেক বিখ্যাত স্পোর্টিং ইভেন্ট, যেমন উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ও পৃথিবীর নানা দেশে প্রথম সারির টেনিস টুর্নামেন্টের প্রধান স্পনসর।আমস্টারডাম শহরে ঢোকার পর মনেই হয়না এই শহরটা জলবেষ্টিত। আমস্টারডামকে ল্যান্ড অফ থাউজেন্ড ব্রিজেস বলা হয় কারণ এখানে অজস্র ছোটো ছোটো ব্রিজ আছে। এই শহরের প্রাণস্পন্দন বুঝতে গেলে জলবিহার যে অপরিহার্য তা বুঝতে পেরেছিলাম সেই ক্যানেল ক্রুজে, এক লাইফটাইম এক্সপেরিয়েন্স হয়ে থাকবে সেটা। নির্দিষ্ট সময়ে আমাদের বোট এলে সবাই উঠে পড়লাম। ক্যানেল-এর দুপাশেই প্রচুর সাইকেলস্ট্যান্ড, সেখানে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা সব বসে। অপূর্ব সব বাড়ি, ব্যালকনিতে ফুলের মেলা, হোটেল ও দোকানপাট সব মিলিয়ে এক সুন্দর কোলাজ তৈরি করেছে। আমস্টারডামকে দ্য মোস্ট বাইসাইকেল ফ্রেন্ডলি সিটি বলা হয়। একটা সময় ছিল যখন এই শহরের অনেক জায়গায় গাড়ির প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। ক্রুজে ইংরেজি ও ডাচ ভাষায় প্রি-রেকর্ডেড কমেন্ট্রি চলছে। ক্যানেলের জলে রাজহাঁস ভাসছে, ছোটো ছোটো সুদৃশ্য সব কাঠের বাড়ি জলের ওপরেই, বারান্দায় নানারকম রঙিন ফুলের টব। তবে আমাদের দেখা হবেনা অ্যান ফ্রাঙ্ক মিউজিয়াম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন হিটলারের নাজি বাহিনী হল্যান্ড দখল করে নিয়ে ইহুদিদের ওপর শুধু অমানবিক অত্যাচারই করছিলনা, পোল্যান্ডের কুখ্যাত আউসউৎজ (Auschwitz) ক্যাম্পের গ্যাস চেম্বারে চালান করে দিচ্ছিল। ওই সময় চোদ্দ বছরের একটি ইহুদি মেয়ে, অ্যান ফ্রাঙ্ক ও তার পরিবারের লোকজন নিজেদের বাঁচাতে এক গোপন কুঠুরিতে আশ্রয় নেয় আর গোপন কুঠুরি থেকে দেখা এই অমানুষিক বর্বরতা ডায়েরির পাতায় পাতায় লিপিবদ্ধ করে গিয়েছিল। ওই ডায়েরি যখন Diary of a Young Girl (Het Achterhuis) হয়ে ১৯৫২ সালে প্রকাশিত হয়, আলোড়ন পরে গিয়েছিল পৃথিবীজুড়ে। সমালোচকরা প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছিলেন একরত্তি মেয়ের সেই সৃষ্টি। আমস্টারডামে আমরা আরো দেখতে পাইনি বিশ্ববিখ্যাত দুই কৃতী ডাচ শিল্পী ভ্যান গগ ও রেমব্রাণ্টের পেইন্টিং, তাঁদের নামে দুটো মিউজিয়াম আছে এই শহরে। ভ্যান গগ প্রায় ন'শ টি চিত্র এঁকে গেছেন যার মধ্যে স্টারি নাইট, সানফ্লাওয়ার, আইরিসেস, পপিজ, হুইটফিল্ড উইথ কর্নস বিখ্যাত। প্রায় ঘন্টাখানেকের ক্যানেল ক্রুজের রোমাঞ্চ উপভোগ করে ফিরে চললাম আইন্ডহোভেন।
শিলং-এর সেন্ট এডমন্ডস কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক পরাগরঞ্জন দত্ত ভালোবাসেন বেড়াতে।