আনদং: কোরিয়ান ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির পীঠস্থান

সম্পত ঘোষ, সায়ন্তিকা ঘোষ

 

বেড়াতে নয়, কর্মসূত্রেই আসা দক্ষিণ কোরিয়ার গিয়ংসাংবুক প্রদেশের (Gyeongsangbuk province) অন্তর্গত ছবির মতন এই আনদং (Andong) শহরে। কাজের তাগিদে হঠাৎই এসে পড়া ঘর ছেড়ে অনেক দূরে একটা অজানা অচেনা দেশের কোনো এক শহরে আর তারপর কেটে যাওয়া দীর্ঘ কয়েকটি বছর, একদা অচেনা এই শহরটির সঙ্গে নিজের অজান্তেই কখন যে জড়িয়ে পড়েছি ভালোবাসায়, কখন যে বাঁধা পরে গেছি একাত্মতার সূত্রে তা জানিনা।
নাকদং (Nakdong) নদীর দুই তীরে গড়ে ওঠা প্রায় পৌনে দু'লক্ষ মানুষের বাসভূমি এই শহরটি দক্ষিণ কোরিয়ার ঐতিহ্য আর সাংস্কৃতিক রাজধানী (Capital of Korean Spirit) বলেই পরিচিত। খ্রিঃপূঃ ১ সালে জিনহান (Jinhan) জনজাতি এই শহরটির পত্তন করে এবং শহরটির নামকরণ করে 'গোছ্যাং' (Gochang) যা পরবর্তীকালে সিল্লা (Silla kingdom) রাজবংশের অধীনে আসে। ৯৩০ খ্রিস্টাব্দে 'হুব্যাকজে' (Hubaekje) আর 'গোরীয়' (Goryeo) দের যুদ্ধে জয়ী হয়ে গোরীয় সেনা গোছ্যাং দখল করে আর শহরটির নতুন নামকরণ করে আনদং। পরবর্তীকালে আনদং-এ কনফুসিয়ানিজম প্রসার লাভ করে যা এই শহরটিকে একটি ঐতিহ্যশালী সাংস্কৃতিক আর শিক্ষার পীঠস্থানে পরিণত করে। কনফুসিয়ানিজম হল জীবনধারণের মানবতাবাদী একটি ধর্ম বা দর্শন যা প্রত্যেক মানুষকে তার মানবধর্ম বা মানবিকতাকে উপলব্ধি করতে শেখায় এবং নিজের চিন্তাশক্তির মাধ্যমে সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছতে (যাকে 'Tian' বা স্বর্গ বলা হয়ে থাকে) সাহায্য করে। চৈনিক দার্শনিক কনফুসিয়াস (খ্রিঃপূঃ ৫৫১ থেকে ৪৭৯) এই চিন্তাধারার প্রবর্তক আর তাঁরই নামানুসারে এই দর্শনের নাম কনফুসিয়ানিজম (Confucianism) ।
শিক্ষাই মানবতা বোধের উন্মেষ ঘটায় আর মানুষকে শ্রেষ্ঠ জীবরূপে প্রতিষ্ঠা করে, আর তাই আমরা আমাদের যাত্রা শুরু করলাম আনদং-এর একবারে পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত 'হাওয়ে লোক-গ্রাম' (Hahoe Folk village) এ শহরের প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান 'বিয়ংসান সুওন কনফুসিয়ান শিক্ষাকেন্দ্র' (Byeongsan Seowon Confucian Academy) থেকে। আনদং শহরের ডাউনটাউন থেকে হাওয়ে গ্রাম যাওয়ার বাস (৪৬ নং রুট) পাওয়া যায়। এর মধ্যে তিনটি (দিনের তিনটি নির্দিষ্ট সময়ে) বিয়ংসান সুওন হয়ে হাওয়ে গ্রামে যায়, অন্য বাসগুলি শুধু হাওয়ে পর্যন্তই যায়। বিয়ংসান সুওন ওদেশের ৪৭ টি কনফুসিয়ান স্কুলগুলির অন্যতম আর আনদং শহরের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য । 'সুওন' (Seowon) কথাটির অর্থ স্থানীয় ব্যক্তিগত বিদ্যালয় (Local Private School)। প্রথমে এই স্কুলটি পুংসান-হাইওন (Pungsan-hyeon)-এ অবস্থিত ছিল এবং পরিচিত ছিল 'পুংগাক-সোদাঙ' (Pungak –Seodang) নামে। পরবর্তীকালে ১৫৭২ খ্রিস্টাব্দে পন্ডিত সিও-রয়্যু (Seoae Ryu/ Seong-nyong Yu - ১৫৪২-১৬০৭ খ্রিস্টাব্দ) সেখান থেকে সরিয়ে এনে বর্তমানস্থানে প্রতিষ্ঠা করেন। ১৬০৭ খ্রিস্টাব্দে পন্ডিত সিও-র মৃত্যুর পর, ১৬১৩ খ্রিস্টাব্দে স্থানীয় কনফুসীয় সমাজ (যাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য জিওং গিয়ংসে (Jeong Gyeongse)) এটিকে পন্ডিত সিও-রয়্যু এবং তাঁর শিক্ষার স্মৃতিরক্ষার্থে উৎসর্গ করেন। ১৬১৪ খ্রিস্টাব্দে এর নাম পরিবর্তিত হয়ে হয় বিয়ংসান সুওন।

সুপ্রাচীন এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করলে প্রথমেই চোখে পড়বে 'মানদেরু' পটমণ্ডপ (Mandaeru Pavilion), এখানে প্রায় ২০০ জন শিক্ষার্থীর একসঙ্গে বসার, অধ্যয়ন করার, বক্তব্য রাখার বন্দোবস্ত ছিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অন্যতম প্রধান অংশগুলি 'ইপগ্যদং' (Ipgyodang), 'দংজে' (Dongjae), 'সজে' (Seojae) এবং 'জেওংন্যদে' (Jeongnyodae) ইত্যাদি নামে পরিচিত। স্থানীয় পরিবহনের বাসে এলে মাত্র দশ মিনিট সময় পাওয়া যায় জায়গাটি ঘুরে দেখার জন্যে যা একেবারেই যথেষ্ট নয় আবার পরবর্তী বাসের জন্য অপেক্ষা করতে হয় দীর্ঘ সময়, কাজেই পায়ে হেঁটে হাওয়ে গ্রাম যাওয়াটাই সুবিধাজনক হবে।

বিয়ংসান সুওন থেকে ৩.৯ কিলোমিটার পাহাড়ের গা বেয়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ট্রেক করে পৌঁছনো যায় হাওয়ে গ্রাম। পথে দেখা মিলল এলকের (Elk - হরিণ জাতীয় একটি প্রাণী), চোখের নিমেষে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উধাও হয়ে গেল, কানে এল নাম না জানা অসংখ্য পাখিদের কল কাকলি, দেখাও পেলাম কয়েকটিকে তবে ওরা সবাই খুব ব্যস্ত, আমাদের দেখার সময় ওদের নেই।

চলতে চলতে কখন যে পায়ের তলার মাটির রঙ গাঢ় লাল হয়ে গিয়েছে, যখন খেয়াল হল দূরে দেখা যাচ্ছে হাওয়ে গ্রাম। রয়্যু বংশের উত্তরসূরীদের বাস ছিল এই হাওয়ে গ্রামে। অনেক স্বনামধন্য পন্ডিত জন্মগ্রহণ করেছেন এই গ্রামে। হাওয়াসান (Hwasan) পাহাড়ের পাদভূমিতে অবস্থিত এই গ্রামটি নাকদং নদী দিয়ে ঘেরা আর সেই থেকেই এর নাম হয়েছে হাওয়ে (Hahoe) যার অর্থ 'নদী দিয়ে ঘেরা গ্রাম'। ইংল্যান্ডের মহারানী এলিজাবেথ ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২১ এপ্রিল গ্রামটি পরিদর্শন করেন। ২০১০ খ্রিস্টাব্দের ৩১ জুলাই হাওয়ে লোক-গ্রাম ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের মর্যাদা পায়।

ঐতিহ্যপূর্ণ কোরিয়ান ঘর (Traditional Korean House) 'হানক' (Hanok) নামে পরিচিত। পাথরের বুনিয়াদের উপরে কাঠের স্তম্ভ, কাঠের মেঝে যা 'মারু' (Maru) বলে পরিচিত, পোড়া মাটির টালির বা খড়ের চাল এবং দরজায় 'হানজি' (Hanji- মালবেরি গাছের ছাল থেকে প্রস্তুত কাগজের ব্যবহার - এগুলিই হলো 'হানক'-এর বৈশিষ্ট্য। 'হানজি'-র ব্যবহার মূলত এর খুব ভালো অন্তরণ (insulation) বৈশিষ্ট্য আর স্বচ্ছতার জন্যে হত, ঘর গরম রাখার পাশাপাশি সূর্যের আলো ঘরে প্রবেশ করতে পারত আবার কাগজে অনেক বায়ুছিদ্র (air hole) থাকার জন্যে বায়ুচলাচলে (ventilation) সাহায্য করত। সোনালি হলুদ রঙের খড়ের ছাউনি মনে করিয়ে দিলো আমাদের গ্রামবাংলার কথা, বেশ সাদৃশ্য রয়েছে। নদীকে ডানদিকে রেখে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম, এখন শীতকাল, তাপমাত্রা শূন্যের নীচে, আর্দ্রতা অনেক কম, ফসল উঠে গেছে চাষের জমি এখন শূন্য। একটু পরেই আমরা প্রবেশ করলাম গ্রামের প্রথম পাড়াতে। বিশালাকার প্রাচীর বেষ্টিত বৃহদাকার মূল ফটক দ্বারা সুরক্ষিত বাড়িগুলি দেখে ধারণা হয় যে গ্রামের অধিবাসীরা বেশ অভিজাত ছিলেন। এখানে রয়েছে 'হাদং' আবাস (Hadong residence), 'নামছন' আবাস (Namchon residence), 'জুইল' আবাস (Juil residence), 'বাকছন' আবাস (Bukchon residence), 'ইয়াংজিন' আবাস (Yangjin residence), 'ছুঁঘ্য' আবাস (Chunghyo residence) এবং 'জাকছন' আবাস (Jakcheon residence) । পন্ডিত Ryu-র বাড়িটিও খুব যত্ন সহকারে সংরক্ষিত আর তার পাশেই রয়েছে একটি মিউজিয়াম যেখানে রাখা রয়েছে প্রাচীন হাতে লেখা পুঁথিপত্র ইত্যাদি।

এখানে মহারানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ তাঁর হাওয়ে গ্রাম দর্শনের স্মৃতিরক্ষার্থে একটি ফার গাছ রোপণ করেছিলেন। কোরিয়ার সংস্কৃতিতে পাইন আর ফার গাছের গুরুত্ব অনেক। এলোমেলোভাবে ঘুরতে ঘুরতে আমরা এসে পড়লাম 'সামসিন' (Samsin) গাছের সামনে। আরাধ্য দেবী 'সামসিন'-এর নামানুসারে এই গাছটির নাম দেওয়া হয়েছে। পরে জেনেছি দেবী সামসিন বিবাহিত মেয়েদের মাতৃত্বের মনোবাসনা পূর্ণ করার দেবী যা বৃক্ষের আকারে গ্রামের মধ্যবর্তী স্থানে প্রতিষ্ঠিত। আজও বিভিন্ন স্থানীয় মানুষ, পর্যটক মনের ইচ্ছে কাগজে লিখে গাছের চারিধারে বাঁধা খড়ের দড়িতে আটকে দিয়ে যান। কাগজ আর কলম রাখা আছে একপাশের একটা ছোট্ট ডেস্কে।

চলতে চলতে কিছু জায়গায় রাখা বিশালাকার পোড়ামাটির জার দৃষ্টি আকর্ষণ করল, একটার ওপর একটা জার রাখা আবার কখনোবা আলাদা আলাদা রাখা জারগুলি আসলে সয়াবিন সিদ্ধ করা এবং সংরক্ষণের ব্যবহৃত হত। প্রায় ছ'শ বছরের প্রাচীন সয়াবিন ফার্মেন্টেশনের পদ্ধতি সংরক্ষণ করা হয়েছে এই গ্রামে। 'দেনজং' (Doenjang) কথাটির অর্থ হল 'ফার্মেন্টেড সয়াবিন পেস্ট'। আর একটি উল্লেখযোগ্য জিনিস হল 'মেজু' (Meju), এর অর্থ গেঁজানো সয়াবিনের খণ্ড। গ্রামের মধ্যে দু-এক জায়গায় দেখলাম পসরা সাজিয়ে বসেছে বিকিকিনির দোকান, স্থানীয় ঐতিহ্যের বিভিন্ন নিদর্শন প্রধানত মুখোশ, কাঠের তৈরি চামচ, রান্নার সরঞ্জাম, রুমাল, ব্যাগ ইত্যাদি। বিয়ংদে খাত (Buyongdae Cliff), নদীতীরবর্তী বালির সৈকত আর পাইন গাছের সারি ঠিক যেন ছবির মতন পরিদৃশ্যমান করে তুলেছে গ্রামটিকে।

আমাদের পরবর্তী দ্রষ্টব্য হাওয়ে-দং মুখোশ সংগ্রহশালা (Hahoe-Dong Mask Museum)। হাওয়ে গ্রামের সামনে থেকে শাটল বাসে করে পৌঁছে যাওয়া যায় অনতিদূরের হাওয়ে-দং মুখোশ সংগ্রহশালাতে। আনদং-এর অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঐতিহ্য হল এই মুখোশ বা মাস্ক, আর সেই সঙ্গে মুখোশনৃত্য এবং নাটক। প্রধানত অল্ডার (Alder) গাছের কাঠ দিয়ে তৈরি হয় এই মুখোশগুলি।

জানা যায় ১২ খ্রিস্টাব্দে কোরিয় (বা গোরীয়) রাজবংশের সময়ে Huh Doryong প্রথম এই মুখোশগুলি তৈরি করেন। মূলতঃ চোদ্দটি ভিন্ন ধরনের মুখোশ ছিল গোড়ায়, যার মধ্যে তিনটি মুখোশ (Chongak বা বিবাহের বর, Byulchae and Ttuckdari-t'al) হারিয়ে যায়, বাকি এগারটি মুখোশকে ('Imae' বা বোকা, 'Ch'oraengi' বা দ্রুত নির্বোধ হস্তক্ষেপকারী, 'Kakshi' বা বিবাহের কনে, 'Chuji' বা সিংহ, 'Paekchong' বা কসাই, 'Halmi' বা বৃদ্ধা বিধবা, 'Chung' বা বৌদ্ধ সাধু, 'Yangban' বা অভিজাত, 'Sonbi' বা পন্ডিত এবং 'Pune' বা ছেনাল নারী) কে জাতীয় সম্পত্তির মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। লক্ষ্য করলাম এদের মধ্যে Yangban খুব প্রচলিত। মুখোশগুলির উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল যে এগুলো আনন্দ, পরিতোষ, ক্রোধ আর দুঃখের প্রকাশ করে। শুনলাম রাজার সামনে এই মুখোশ পরে নৃত্যনাট্য (মূলতঃ সামাজিক প্রেক্ষাপটের উপর আধারিত) পরিবেশিত হত, পূর্বোল্লেখিত চারটি আবেগের মধ্যে কোনটি দৃষ্টিগোচর হবে তা রাজার প্রজ্ঞার উপর নির্ভর করতো। মুখোশনৃত্য যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল তা বলাই বাহুল্য।

সংগ্রহশালার প্রবেশের মুখেই দেখলাম পৃথিবীর একটি বিরাট মানচিত্র যাতে বিভিন্ন দেশের মুখোশগুলির উল্লেখ রয়েছে। এরপর ভিতরে প্রবেশ, বিভিন্ন দেশের, ভিন্ন ভিন্ন জনজাতির কৃষ্টি আর জীবনের গল্পের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎই চোখ টানল ভারতের মুখোশ প্রদর্শনীতে, আমাদের পশ্চিমবঙ্গের ছৌ নাচের মুখোশও রয়েছে। মনটা একটা অজানা আনন্দে ভরে উঠল। প্রতি বছর আনদং-এ মাস্ক ডান্স ফেস্টিভ্যাল অনুষ্ঠিত হয়, সারা পৃথিবী থেকে বিভিন্ন নৃত্যগোষ্ঠী সেখানে অংশ গ্রহণ করে, দিনদশেক ধরে চলে বিভিন্ন দেশের মুখোশের আর মুখোশনৃত্যের প্রদর্শনী। ঐতিহ্যের সংরক্ষণ করার উদ্দেশ্যে প্রাচীনের সাথে বর্তমানের মেলবন্ধনের বিষয়টি সত্যিই শিক্ষণীয়। এবার ফিরতে হবে। বেলা পড়ে এসেছে।
পরেরদিন ঘুম ভাঙল খুব ভোরবেলা। আজ আমরা যাবো আনদং লোক-সংগ্রহশালা (Andong Folk Museum)। ভাষা বাধা হওয়ার কারণে সংগ্রহশালার যাওয়ার বাসের পথটা ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। সময় নষ্ট না করে ট্যাক্সি ধরে রওয়ানা দিলাম গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। নাকদং-কে সঙ্গী করে বাঁধ পেরিয়ে এসে পৌঁছলাম আনদং ফোক মিউজিয়ামে, পৌঁছতে সময় লাগল মাত্র পনের মিনিট। নাকদং দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধান সাতটি নদী যথা হান (Han), নাকদং (Nakdong), ইমজিন (Imjin), ইয়ংসং (Yeongsang), ভুখান (Bhukhan), হানটান (Hantan), এবং গিউম (Geum)-র মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য। আগেই বলেছি যে এই নাকদং কে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে আমাদের শহরটি। টিবেক (Taebeak) পর্বত থেকে উৎপন্ন হয়ে প্রায় ৫২৩ কিলোমিটার অতিক্রম করে নাকদং পতিত হয়েছে কোরিয়ান স্ট্রেটে। দীর্ঘ ইতিহাসের সাক্ষী বহন করে চলেছে নাকদং, মানব সভ্যতার নানান উত্থান-পতনের সাক্ষ্য বহন করে আজও সে মাতৃস্বরূপা, শস্যশ্যামলা অববাহিকা তাঁর আশীর্বাদধন্য আর অববাহিকার বসতির পানীয় জলের উৎসও এই নদী। শুনেছি নাকদংয়ের অববাহিকায় বেশ কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন মিলেছে মূলত নিওলিথিক সময়কার। প্রাচীনকালে সিল্লা, গোরীয় এমনকি জোসেওন রাজত্বের সময়কালে গিয়ংসাং অঞ্চলে পণ্য, বিশেষ করে তাজা সামুদ্রিক খাদ্য, মাছ (ম্যাকারেল) ইত্যাদি পরিবহন করা হত এই নদীপথে। সড়কপথে অনেক সময় লাগার কারণে মাছগুলি শুকিয়ে বা লবনাক্ত করে আনতে হতো, অন্যথায় পচন ধরত গন্তব্যে পৌঁছনোর আগেই, তাই নদীপথই ছিল ভরসা।

আজকের দিনটা ভীষণ সুন্দর, জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি, এই সময়ে তাপমাত্রা শূন্যের নিচেই থাকে। চারপাশ সাদা বরফের আচ্ছাদনে আবৃত, তুলোর মতন বরফ পড়েই চলেছে ক্রমাগত। দক্ষিণ কোরিয়ার সাংস্কৃতিক পীঠস্থান আনদং-এ ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে ঐতিহ্যশালী এই সংগ্রহশালাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রবেশ পথের বাম হাতেই রয়েছে বিশ্রাম করার জায়গা। যারা বাড়ি থেকে ছুটি কাটাতে বেরিয়েছেন তারা কিছুটা সময় বিশ্রাম করেও যেতে পারেন, আর কচিকাঁচাদের জন্য রয়েছে সুন্দর পার্ক, অত্যন্ত সুপরিকল্পিত। উন্নত এই দেশে প্রত্যেকটি প্রবেশপথের পাশেই রাখা থাকে দর্শনীয় স্থানটির একটি মানচিত্র এবং স্থানটি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যবিবরণী, এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মানচিত্রে চোখ রেখে এবার চললাম সংগ্রহশালার দিকে। সংগ্রহশালার দ্বিতল বাড়িটি সৃষ্টিশৈলীর আরেকটি নিদর্শন যা সম্পূর্ণভাবে এদের ঐতিহ্যকে সাক্ষাৎ করায়। সংগ্রহশালার টিকিটঘরটি বন্ধ, আমরা জেনে গিয়েছিলাম যে প্রবেশমূল্য দিয়ে প্রবেশ করতে হবে; মুহূর্তের জন্যে একটু হতাশ লাগছিল ঠিক তখনই ভিতর থেকে একজন মহিলা বেরিয়ে এলেন অভ্যর্থনার জন্য।
অতিরিক্ত শীতের জন্যে এখানে সাধারণত ভবনগুলোর প্রবেশপথে দুটি কাচের দরজা থাকে। বাইরে থেকে প্রবেশের প্রথম দরজাটি একটু মোটাধরণের কাচের তৈরি আর পরবর্তীটি অপেক্ষাকৃত পাতলা কাচের। প্রথম দরজাটি ঠেলে দ্বিতীয়টির সামনে উপস্থিত হওয়ামাত্র সেন্সর আমাদের উপস্থিতি সনাক্ত করে দরজা খুলে দিল। বিশাল বড় হলঘরের বাঁদিকে রাখা সংগ্রহশালাসম্বন্ধীয় বইপত্র আর ডানদিকে রয়েছে অভ্যর্থনা বা তথ্যকেন্দ্র। ইংরেজি ভাষায় কোনো বই খুঁজে পেলাম না, বেশিরভাগই কোরিয়ানে লেখা, তাছাড়া জাপানি বা চিনা ভাষাতেও কিছু বই রয়েছে। সংগ্রহশালার অভ্যন্তরে ছবি তোলার নিষেধাজ্ঞা আছে কাজেই এই পর্বের ছবিরহিত বিবরণ তুলে ধরার চেষ্টা করলাম। মূল কক্ষের প্রবেশদ্বারের ডান দিকেই রয়েছে বহু প্রাচীন একটি প্রস্তরফলক, ফলকের গায়ে লেখা রয়েছে ইতিহাস। ক্রমে ক্রমে সুন্দর কাচের আবরণে সংরক্ষিত এদের জীবন ঐতিহ্য দেখতে দেখতে চললাম।
জীবনধারার বিভিন্ন পর্ব তুলে ধরা হয়েছে প্রদর্শনীতে। প্রথমেই নজরে পড়ে একটি শিশুর একবছরের জন্মদিন পালন। নানাবিধ খাবারের সঙ্গে রয়েছে তীর-ধনুক, পড়াশোনা করার জন্য কালি-পাথর (Ink stone), কলম এবং কাগজ। পরবর্তী পর্যায়ে যখন শিশুটি ধীরে ধীরে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠে (সাধারণত পনেরো থেকে কুড়ি বছর বয়সের) আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়ার প্রচলন ছিল যা 'গ্বানর‍্যে' (Gwanrye; ছেলেদের ক্ষেত্রে) অথবা 'গ্যেরে' (Gyerae; মেয়েদের ক্ষেত্রে) নামে পরিচিত। এই সময় নব্য যুবকের নতুন নামকরণের প্রথাও প্রচলিত ছিল। বিবাহ সামাজিকভাবে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান এবং জীবনের অন্যতম মুখ্য অনুষ্ঠান বলে বিবেচিত হতো। বিবাহের অনুষ্ঠান 'হনর‍্যে' (Honrye) নামে পরিচিত। বিবাহের সমগ্র প্রক্রিয়াটি ছয়টি পর্যায়ে সম্পন্ন হত যথা 'উইহন' ('Uihon' বা পাত্রীর বাড়িতে বিয়ের জন্য নিবেদন করা এবং সম্মতি পাওয়া), 'নাপছে' ('Napchae' বা পাত্র পাত্রীর বাড়িতে জন্মের ছক আদানপ্রদান করা), 'ইয়েওঙ্গিল' ('Yeongil' বা বিবাহের দিন স্থির করা), 'নাবপে' ('Nabpae' বা বিবাহের পত্র আদানপ্রদান করা এবং উপহার আদানপ্রদান করা), 'ছিনইয়উং' ('Chinyoung' বা পাত্রীকে সামনে থেকে দেখা) এবং 'দের‍্যে' ('Daerye' বা বিবাহের দিনের অনুষ্ঠান)। পরবর্তী পর্যায়ে আসে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া (Funeral Rites) যা 'সাংর‍্যে' (Sangrye) নামে পরিচিত। এঁদের পূর্বপুরুষের মতে সন্তানোচিত ভক্তি (Filial Piety) জীবনের সবরকমের শিষ্টাচারের ভিত্তি। পিতামাতার জীবিতাবস্থায় অথবা মৃত্যুর পরে তাঁদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে সন্তানসন্ততিরা এই অনুষ্ঠান পালন করে থাকেন। পরিশেষে পূর্বপুরুষদের আত্মার উদ্দেশ্যে যে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হত তাকে 'জের‍্যে' ('Jerye') যার অর্থ পূর্বপুরুষের আচার বা (Ancestral rites) বলা হয়। পূর্বপুরুষের আত্মার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ফল, ভাতের তৈরি কেক ইত্যাদি নানাবিধ খাদ্যসামগ্রী প্রদান করা হয়ে থাকে, আজও এই প্রথা অনেকাংশে প্রচলিত আছে। প্রদর্শনীতে রয়েছে জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের কক্ষ যেমন বিবাহিত নারীর কক্ষ, পুরুষের কক্ষ, আলাপ আলোচনার কক্ষ ইত্যাদি।
মূল প্রদর্শনীভবন থেকে বেরিয়ে নাকদং নদীর পাশে রয়েছে পুরাতন বাড়ির প্রদর্শনী, এগুলি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য (Cultural Heritage) বলে বিবেচিত হয়। পুরোনো গন্ধ গায়ে মেখে আমরা চললাম 'উলর‍্যংগ্যয়' সেতু (Wolryeonggyo বা Wolryeong bridge)-র দিকে। পবিত্র ভালোবাসার সম্মানরক্ষার্থে নির্মিত নাকদং নদীর উপর কাঠের তৈরি এই সেতুটি ৩৮৭ মিটার লম্বা আর ৩.৬ মিটার চওড়া। ব্রিজের মাঝখানটায় রয়েছে বিশ্রামস্থল। রাতের বেলায় রংবেরঙের নানান আলোতে সুসজ্জিত হয়ে ওঠে উলর‍্যংগ্যয়, তবে এবার আর সেটা দেখা হবে না, তাপমাত্রা প্রায় মাইনাস ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ফিরতে হবে কিন্তু তার আগে চাই কফি, কাজেই সামনের কফির দোকানে একটু বসা আর তারপর বাড়ি ফেরা।


ভূ-তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেন সায়ন্তিকা ঘোষ, সুযোগ পেলেই পাহাড়ের হাতছানিতে মন্ত্রমুগ্ধের মতন সাড়া দেন। ভালোবাসেন রান্না করতে আর ফটো তুলতে। সম্পত ঘোষ আগ্রহী বিভিন্ন জনজাতির জীবন আর জীবিকা বিষয়ে জানতে। ভালোবাসেন সাইকেল চালাতে, বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান করতে আর প্রবন্ধ পড়তে।

  

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher