মুন্সিয়ারিতে সোনাঝরা বিকেল

অরিন্দম পাত্র


~ মুন্সিয়ারির আরও ছবি ~

ছোটো থেকে খুব বেশি কোথাও যাওয়ার সুযোগ হয়নি নানা কারণে। পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকাটা যেমন একটা কারণ তেমনি আবার আমার বাবা বেড়াতে যেতে খুব একটা পছন্দ করতেন না। এখনো করেন না। কিন্তু আমি ছোট থেকেই পাহাড়ের স্বপ্ন দেখতাম। একটু বড় হয়ে পড়াশোনার চাপ কমলে বিভিন্ন ট্রাভেল ম্যাগাজিন বা বইপত্র পড়তাম। এইসব ঘেঁটেই মুন্সিয়ারির প্রতি একটা অদ্ভুত দুর্বলতা জন্মেছিল। কেন জানিনা মনে হত কোনোদিন সুযোগ পেলে মুন্সিয়ারি যেতেই হবে!
তা আজ সেইদিন উপস্থিত। চকৌরি থেকে ৯০ কিমি পথ পাড়ি দেওয়া শুরু হল আমাদের। সুদীর্ঘ পথ। ক্লান্তি ক্রমশ চেপে বসছে শরীরে। শুধু মনের উত্তেজনা সম্বল করে চলেছি। একটাই কথা ভাবছি শুধু যে মুন্সিয়ারি পৌঁছাতে পারলেই আজ আর আগামীকাল বিশ্রামের সুযোগ পাব।
তবে মুন্সিয়ারিতে পৌঁছানোর পথ কিন্তু সহজ রাস্তা নয়! খুব আঁকাবাঁকা, খুব সঙ্কীর্ণ আর বিপদসঙ্কুলও বটে!! মাঝেমধ্যেই রাস্তা ভাঙ্গাচোরা, সারাইয়ের কাজ চলছে। বেশ কয়েকটা ঝরনার দেখা পেলাম - নিরন্তর পাহাড়ের মাথা থেকে ঝরে পড়ছে আর তিরতির করে রাস্তা ডুবিয়ে পাশের খাদে মিলিয়ে যাচ্ছে। এক জায়গায় খুব সুন্দর নাম-না-জানা একটা জলপ্রপাত দেখলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম বিরথি! কিন্তু ড্রাইভার বললেন, এ বিরথি নয়। বিরথির দেখা মিলল আরও ঘন্টাদেড়েক পরে। রাস্তার পাশেই বড় বোর্ডে লেখা "বিরথি ওয়াটার ফলস"!
গাড়ি থেকে নামলাম হাত-পায়ের জং ছাড়াতে ছাড়াতে। সারা গায়ে প্রচন্ড ব্যথা! তবে মুন্সিয়ারি আর খুব বেশি দূরে নেই। আর মাত্র ৩২ কিমি রাস্তা বাকি। পাশেই কয়েকটা চা, কফি আর ম্যাগির দোকান। ছেলের খুব খিদে পেয়েছিল, ওরা দুজনে দোকানে বসে চা আর ম্যাগি অর্ডার করল। দোকানদারকে জিজ্ঞেস করে জানলাম যে পাশেই যে খাড়াই সিঁড়ি উঠে গেছে ওটা ধরেই পৌঁছে যেতে হবে বিরথির পাদদেশে।
রাস্তা থেকেই যদিও বিরথির গর্জন শোনা যাচ্ছে। কিন্তু তার কাছে পৌঁছাতে গেলে চড়তেই হবে ওই খাড়া সিঁড়ি। ওদের দোকানে বসতে বলে শুরু করলাম পাহাড় চড়া!!
খুব খাড়াই সিঁড়ি। প্রায় সত্তর-আশিটা সিঁড়ি ভেঙে মাঝপথ অবধি এলাম। আরো অনেক রাস্তা বাকি, তবে গিয়ে বিরথির কাছে পৌঁছতে পারব।
কিন্তু শক্তি প্রায় নিঃশেষ, পিঠের ব্যাগটা দ্বিগুণ ভারী মনে হচ্ছে। হাঁফ ধরছে খুব। খানিক বিশ্রাম নিয়ে ফের ওঠার চেষ্টা করেও রণে ভঙ্গ দিতে হল! সকাল থেকে পেটে দানাপানিও কিছু পড়েনি। তাই আর ওপরে ওঠার চেষ্টা থেকে বিরত থাকলাম।

মাঝপথ থেকেই দুর্দমনীয় বিরথির কয়েকটা ছবি তুলে ফেরত আসতে হল। নানা অ্যাঙ্গেলে বিরথির ছবি তুললাম। অনেক উঁচু থেকে বিরথির ওই নীচে ঝাঁপিয়ে পড়ার দৃশ্য দেখতে বেশ ভাল লেগেছিল। এরপর নীচে নামার পালা। সাম্প্রতিক সিকিম ট্রিপে বেশ ক'টা দুর্ধর্ষ ওয়াটার ফলস দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল - বচ্চন ফলস, নাগা ফলস ইত্যাদি। কিন্তু বিরথির সৌন্দর্য একটু যেন আলাদা! মনে থাকবে চিরকাল। বিরথিতে একটা কে এম ভি এন লজও আছে শুনেছি। যদি পারি কখনো পরে এসে থাকব, এই ভেবে মুন্সিয়ারির লাস্ট ল্যাপের জন্য নিজেদের রেডি করে গাড়িতে উঠে বসলাম। আমার সঙ্গী দুজন এই আধঘন্টার বিশ্রাম আর খাওয়াদাওয়া পেয়ে আপাতত চাঙ্গা!
শুনেছিলাম পথে পেট্রলপাম্প খুব বেশি নেই। ড্রাইভার রাজকুমার ভাইকে বলাতে উনি বললেন, চিন্তা করবেন না। তেল আপাতত যা আছে, ভালই চলবে গাড়ি। মুন্সিয়ারিতে একটা পাম্প আছে, ওখান থেকেই তেল নিয়ে নেওয়া যাবে।
দেখতে দেখতে চলে এলাম আমাদের গন্তব্য মুন্সিয়ারির হোটেল বালা প্যারাডাইজ। দোতলা ছোট্ট হোটেল, কিন্তু বেশ ছিমছাম আর পরিষ্কার। রিসেপশনে ফর্মালিটিজ মিটিয়ে ঘরে ঢুকলাম। দোতলায় ঘর। ঘরে ঢুকেই দেওয়ালজোড়া বড় জানালা। রুমবয় লাগেজ দিয়ে গেল আর বলে গেল ওই জানালা দিয়েই দেখা যাবে তাঁকে!! আমার স্বপ্নের পঞ্চচুল্লি। যাকে দেখতে এত দূর ছুটে আসা মুন্সিয়ারিতে! যাকে এর আগে শুধু পত্রিকার পাতাতেই ছবিতে দেখেছি, আর দেখেছি বিনসর যাওয়ার পথে এক ঝলক, তাও স্থানীয় একজন মানুষ চিনিয়ে দিয়েছিলেন বলে।
আজ কি তার দেখা পাব? আকাশ কিন্তু মেঘে ঢাকা। আর আকাশের একদিকটা কিরকম কালো হয়ে আসছে যেন! হাতে ঠিক দু'দিন। দেখা যাক কী হয়। আপাতত এগিয়ে গেলাম টেলিফোনের দিকে, রুমসার্ভিসে ফোন করতে হবে। বড্ড খিদে পেয়েছে।
আকাশ কালো করে এসেছে, ঘন মেঘ জমেছে দূরদিগন্তে। হোটেলের ঘরে বসে ভাবছি যে, আজ আর হয়তো বাইরে বেরোনো যাবেনা। মনে তবু একটা ক্ষীণ আশা ছিল যে পাহাড়িয়া মেঘ-বৃষ্টি তো, যদি কেটে যায় দুর্যোগ!
অলসভাবে বসে না থেকে চলে গেলাম হোটেলের ছাতে। ছাদটা বেশ সুন্দর, ছাউনি দেওয়া। ভিজে যাওয়ার আশঙ্কা নেই। পুরো মুন্সিয়ারি টাউনটাকেই পাখির চোখে দেখতে পাচ্ছিলাম। দূরের পাহাড়ের মাথায় কালো মেঘের আস্তরণ ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছে। পঞ্চচুল্লি এখনো অদৃশ্য।

হঠাৎ কথা নেই, বার্তা নেই কোথা থেকে দমকা হাওয়া আর বৃষ্টি এসে গেল। ছাদের মাথায় শেড থাকায় ভিজে গেলাম না। বৃষ্টি চলল খুব বেশি হলে দশ মিনিট। পাহাড়ের বৃষ্টি এরকমই হয়। হঠাৎ আসে, হঠাৎ যায়।
বৃষ্টি থামতেই অবাক চোখে দেখলাম, সে এক অদ্ভুত দৃশ্য!! এক পাহাড় থেকে আর এক পাহাড় পর্যন্ত বিস্তৃত বড় একটা ধনুকের মতো লম্বা এক রামধনু! স্বর্গীয় সেই শোভা দুচোখ ভরে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করলাম। মনে মনে অনুভব করলাম যে ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন। এই হঠাৎ ঘনিয়ে আসা মেঘ আর বৃষ্টির জন্য মন খারাপ করছিলাম, কিন্তু তা নাহলে এই অপার্থিব দৃশ্য কি আর দেখতে পেতাম!?

যাইহোক,দুর্যোগ আপাতত কেটেছে। তবে আকাশ পুরোপুরিভাবে মেঘমুক্ত নয়। বিকেল পড়ে আসছে। তাই ছাতা আর বর্ষাতি নিয়ে চল্লাম নন্দাদেবী মন্দিরের উদ্দেশ্যে।
মন্দিরে যাওয়ার রাস্তায় মুন্সিয়ারির পেট্রলপাম্প। একদম ট্যাংক ফুল করে তেল নিয়ে নেওয়া হল, সেই তেলে আমরা দুদিন পরে কৌশানি অবধি চলে যেতে পেরেছিলাম নিশ্চিন্তে। পাম্প পেরিয়ে মন্দির যাওয়ার রাস্তাটা বেশ বেয়াড়া আর এবড়োখেবড়ো। কয়েকবার গাড়ির তলা অবধি ঠেকে গেল। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই মন্দির প্রাঙ্গণে চলে এলাম।
গাড়ি পার্ক করে অল্প কয়েক ধাপ সিঁড়ি ভেঙ্গে চলে এলাম নন্দাদেবী মন্দিরপ্রাঙ্গণ। ঢোকার মুখেই টিকিট কাউন্টার। মাথাপিছু কুড়ি টাকার টিকিট কাটা হল, বাচ্চাদের প্রবেশমূল্য নেই। তবে এই টিকিটের বৈধতা বারো ঘন্টা অবধি। কাউন্টারের বাচ্চা ছেলেটি বলল, আগামীকাল সকাল সকাল এলেও ওই টিকিট দেখিয়েই প্রবেশ করা সম্ভব হবে।
গুটিগুটি পায়ে আমরা চারজন প্রবেশ করলাম মন্দিরপ্রাঙ্গণে। আমাদের তিনজনের সাথে রাজকুমারও এসেছে। ও বেচারি গাড়ি চালিয়ে চালিয়ে খুব ক্লান্ত। কিন্তু ঘোরার উৎসাহে ভাঁটা পড়েনি। প্রায়ই মোবাইল ক্যামেরায় ছবি তুলছে আর আমাকে দিয়ে নিজের ছবি তোলাচ্ছে। নন্দাদেবী মন্দিরের পরিবেশটা এতটাই অবিশ্বাস্যরকমের সুন্দর যে না দেখলে বোঝানো মুশকিল!! বিশাল আয়তনের ফাঁকা সবুজ তৃণভূমির ওপরে এই মন্দির অবস্থিত। পিছনে অতল খাদ আর তার ওপারেই এই মুহূর্তে অর্ধেকটা মেঘের আস্তরণে ঢেকে বিরাজমান আমাদের সবার প্রিয় পঞ্চচুল্লি। আকাশে এখনো মেঘ আছে, তবে বৃষ্টি হচ্ছে না আর বেলাশেষের সূর্য হেলে পড়ছে ধীরে ধীরে। আলো কমে আসছে। সেই সোনালি আলো আস্তে আস্তে মন্দিরের পেছনের পাহাড়ে পড়ে চারিদিক রাঙা করে তুলছে। কিন্তু পঞ্চচুল্লিকে আলোকিত করতে পারছে না সেই আলো। আধো মেঘে ঢাকা পঞ্চচুল্লি যেন অবগুন্ঠনে ঢাকা নববধূ! তবে তার অবয় কিন্তু দিব্যি বোঝা যাচ্ছে মেঘের আড়াল ফুঁড়ে মাঝেমধ্যেই।
"আপনারা বাঙালি?" পঞ্চচুল্লির স্বর্গীয় দৃশ্য দেখতে দেখতে এত বিমোহিত হয়ে পড়েছিলাম যে হঠাৎ করে কথাটা কানের কাছে শুনে চমকে উঠেছিলাম। তারপর খেয়াল হল, এই বিদেশবিভূঁইয়ে এরকম সুন্দর করে বাংলা কে বলে উঠল!
পাশেই দাঁড়িয়ে মিলিটারিধাঁচের পোশাক পরে এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক। মিটিমিটি হাসছেন আমাদের দেখে। আলাপ করলাম ওনার সাথে, এই মন্দির প্রাঙ্গণের কেয়ারটেকার উনি। পাশেই ছোট ঘরে ওঁর বাস। জিজ্ঞেস করলাম এত সুন্দর বাংলা শিখলেন কোথায়? মনে পড়ে গেল পাতাল ভুবনেশ্বরের বাইরের মন্দিরের পূজারীজির কথা! তাঁর পরিষ্কার বাংলার জন্য দায়ী ছিলাম আমরা অর্থাৎ বাঙালি টুরিস্টরা। তবে ইনি জানালেন আর্মিতে কাজ করার সুত্রে বেশ কয়েক বছর উনি কাটিয়ে গেছেন কোলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে। সেই থেকেই বাংলা বোঝেন ভালোমতই আর বলেনও ভাঙা ভাঙা, কিন্তু কাজ চলে যায়!
অনেক কথা হল ওঁর সঙ্গে। কথায় কথায় জানালেন যে মুন্সিয়ারিকে পর্যটকদের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য অনেক উদ্যোগ নেওয়া যায় বা উচিত যেদিকে স্থানীয় প্রশাসন মন দিচ্ছেন না! খালিয়া টপ অবধি একটা রোপওয়ের বন্দোবস্ত হলে মন্দ হত না।
এইসব নানা কথার মাঝে বেলা গড়িয়ে আঁধার নামতে চলল। চারিদিকের পরিবেশ তখন অদ্ভুত সুন্দর আর মোহময়ী! মন্দিরের পেছনের বিস্তীর্ণ সবুজ বুগিয়ালে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকা রকি-র (কেয়ারটেকারের পোষ্য সারমেয়) মত পঞ্চচুল্লিও তখন যেন ঘুমের দেশে হারিয়ে যাওয়ার তোড়জোড় শুরু করেছে। মন্দিরের আলো জ্বলে উঠেছে এক এক করে।
কেয়ারটেকার মহাশয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরাও হোটেলপানে ফিরে চললাম। রাজকুমারকে বললাম আগামীকাল সকালে আর একবার কি আসা যায় এখানে? রাজকুমার বললেন, নো প্রবলেম স্যারজি! আপনি যখন বলবেন তখনই বেরোব!

মনে মনে ভাবলাম, দেখি আগামীকাল যদি হোটেলে রুমের জানালা দিয়েই আরও ভালোভাবে পঞ্চচুল্লি দেখা যায় তো ভালোই হয়। তবে সেই রাতেই রুমের জানালাটা একটু অন্যভাবে ব্যবহার করেছিলাম - চাঁদের আলোয় আলোকিত পঞ্চচুল্লি দেখার জন্য।
ঘড়িতে রাত বারোটা পেরিয়ে গেছে। তারিখ ক্যালেন্ডারে ২৬ পেরিয়ে ২৭-এ অক্টোবরে পা রেখেছে। সবাই ঘুমে অচেতন। কিন্তু আমি সারাদিনের ক্লান্তি আর পরিশ্রম ভুলে ঠায় দাঁড়িয়ে আছি হোটেলের ঘরের জানালার একপাল্লা খুলে ক্যামেরা নিয়ে। উদ্দেশ্য চাঁদের আলোয় পঞ্চচুল্লির ছবি তোলা।
দিনদুয়েক আগেই কোজাগরী পূর্ণিমা গেছে, সেদিন ছিলাম বিনসরে। আজ মুন্সিয়ারি এসে পৌঁছেছি চৌকরি হয়ে। সন্ধ্যা পর্যন্ত কাটিয়েছি নন্দাদেবী মন্দিরপ্রাঙ্গণে। রাতে এখন চেষ্টা চালাচ্ছি জ্যোৎস্নালোকিত পঞ্চচুল্লিকে ক্যামেরাবন্দী করার।
এইধরনের ছবি তুলতে একটি ট্রাইপডের ব্যবহার অত্যাবশ্যক। কিন্তু হোটেলের ছোট্ট ঘরে তা অসম্ভব। অগত্যা দুরুদুরু বক্ষে সাধের ক্যামেরাটিকে দোতলার জানালার একচিলতে সরু চৌকাঠে বসিয়ে চেষ্টা করলাম ছবি তোলার। ছবিটা সেরকম ভাল আসেনি। তবু সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যা পাওয়া যায় তাই নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হল।

ভোর ছ'টার একটু আগে ঘুম ভেঙ্গে গেল মোবাইল ফোনের রিংটোনের আওয়াজে। রাজকুমার ঠিক রেডি হয়ে ফোন করছেন আমায়। ওঁর কাছ থেকে দশ মিনিট চেয়ে নিয়ে দ্রুত রেডি হয়ে গরম জামা চাপিয়ে আর ক্যামেরা নিয়ে দে দৌড়। আবার যাব নন্দাদেবী মন্দিরে।
ভোরে মন্দিরপ্রাঙ্গণ একদম ফাঁকা। দু-একজন এসেছেন ভোর ভোর দেবী দর্শন করতে। ভোরের টাটকা বাতাস বুক ভরে টেনে নিলাম ভেতরে,সে এক গভীর প্রশান্তির আশ্বাস এনে দিল যেন। পঞ্চচুল্লি আজ ঝকমক করছে,ধীরে ধীরে ভোরের আলো পড়ছে পঞ্চচুল্লির পাঁচ মাথায়! স্বর্গীয় পরিবেশ! দুরকম পরিবেশের সাক্ষী হওয়া গেল - গতকাল সাঁঝবেলার নন্দাদেবী মন্দির প্রাঙ্গণ আর আজ স্নিগ্ধ ভোরবেলার মনোরম মন্দির প্রাঙ্গণ। দুইই সমান প্রিয় লাগল আমার কাছে।
তবে আজ আর কেয়ারটেকার দাদার দেখা পেলাম না। ঘন্টাখানেক কাটিয়ে আর অনেক অনেক ছবি তুলে রাজকুমারকে নিয়ে ফিরে এলাম হোটেলে। কথা হল যে আবার বেরোব সকাল দশটা নাগাদ। গন্তব্য দারকোট গ্রাম।
অনেক আগেই শুনেছিলাম দারকোট গ্রামের কথা, শুনেছিলাম মানে পড়েছিলাম বিভিন্ন ট্র্যাভেল ম্যাগাজিনে। মুন্সিয়ারিতে অবস্থিত এই গ্রাম প্রসিদ্ধ ঘরে ঘরে হাতে ও মেশিনে বোনা শীতবস্ত্রের জন্য। তাও আবার ভেড়া ও বিশেষ করে খরগোসের লোম দিয়ে!
মুন্সিয়ারিতে দ্বিতীয় দিন সকালে তাই ঠিক করেছিলাম দারকোট গ্রাম দর্শনে যাব। সেইমত সকালে প্রাতঃরাশ সেরে বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের ৭-৮ কিমি উৎরাই নামতে হবে। রাস্তা প্রচন্ড খারাপ,জায়গায় জায়গায় সারাইয়ের কাজ চলছে, ধ্বসের পাথর সরিয়ে। সঠিক লোকেশন জানিনা, ড্রাইভারদাদা মানুষজনকে জিজ্ঞেস করতে করতে চললেন।
প্রায় আধঘন্টাটাক পরে এসে পৌঁছলাম দারকোট গ্রাম। বড় রাস্তা থেকে প্রায় পঞ্চাশ-ষাট ধাপ সিঁড়ি নেমে গেছে নীচে গ্রামের দিকে। রয়েছে দুর্গামন্দির। কিছুটা নেমে একটি বাড়িতে প্রবেশ করলাম। গৃহকর্ত্রী বারান্দায় উপস্থিত ছিলেন। আমাদের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে বুঝতে পারলেন আমরা পর্যটক। আপ্যায়ন করে ভিতরে বসালেন।

বারান্দায় সেলাইমেশিন দেখতে পেলাম। কথা বলে জানলাম এখানে প্রায় প্রতিঘরেই এই কাজ হয়। বিভিন্ন দূরবর্তী স্থানেও এসব শীতবস্ত্র রপ্তানি হয়। এটিই এঁদের অন্যতম জীবিকা।
বারান্দায় তেল মেখে স্নানের প্রস্তুতি নিচ্ছিল ওঁর ছোট্ট নাতি। তার বেশ কিছু ছবি তুললাম। ভিতরের ঘরে বসে এরপর উনি দেখালেন নানারকম শীতপোষাক - শাল, চাদর, টুপি ইত্যাদি। বেশিরভাগই খরগোস ও ভেড়ার লোম দিয়ে তৈরি। ছেলের জন্য খুব শখ করে একটি খরগোসের লোমের টুপি কিনলাম, অবশ্যই দামে পোষাল তাই! আর বাদবাকি জিনিসের দাম প্রচুর!
কেনাকাটা সেরে ওঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে আর একটু নীচে নেমে দারকোট গ্রামের দুর্গামন্দির দেখে ফিরে চললাম। এরপর ট্রাইবাল মিউজিয়াম দেখে হোটেলে ফেরা ও দ্বিপ্রাহরিক লাঞ্চ সারা।
আজ বিকেলে পুরোপুরি বিশ্রাম। আমাদের মুন্সিয়ারি সফর শেষের পথে। এতদিন স্বপ্ন দেখে এসেছি যে দুটো সোনালি দিনের আজ সেই দিনদুটো শেষ হতে চলেছে। অনেক ছোটাছুটি হল এই দুদিন। বিকেলে বালা প্যারাডাইজ হোটেলের ছাতে বসব মুখোমুখি - শুধু আমি আর মুন্সিয়ারি। আর কেউ না। ছেলে আর ছেলের মা এখন ভাতঘুমে ব্যস্ত। ভালই হয়েছে, কেউ আর আমাদের বিরক্ত করবেনা। মুন্সিয়ারির রূপ, রস, স্বাদ, গন্ধ আহরণ করব আজ প্রাণ ভরে। অদ্ভুত ছিল সেই বিকেলটা! প্রকৃতি সেদিন যেন সোনালি আলোর স্পর্শ দিয়ে মুন্সিয়ারিকে সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে দিয়েছিল! মুন্সিয়ারি যেন হয়ে উঠেছিল সোনার শহর এল ডোরাডো!! সোনাঝরা সেই বিকেলবেলার কথা চিরকাল মনে থাকবে আমার। তবে বিকেলে আর দেখা পেলাম না পঞ্চচুল্লির। মেঘের আড়ালেই রইল সে!

আগামীকালের গন্তব্য কৌশানী, মনকে বোঝালাম সকালটা তো রয়েইছে বেরোনোর আগে অবধি। পঞ্চচুল্লির সঙ্গে এবারের মত শেষ দেখাটা হয়েই যাবে।
শেষ দেখাটা হল পরের দিন, এমনভাবে মন ভরিয়ে দিল, যা বলে বোঝানো যাবে না!! ভোরে জানালা খুলে দেখলাম পঞ্চচুল্লির পাঁচমাথা সূর্যের প্রথম কিরণ লেগে যেন আগুন জ্বলে উঠেছে! ঠিক যেন পাঞ্চালী রান্না চাপিয়েছেন তাঁর পঞ্চস্বামী পঞ্চপান্ডবের জন্য।

সেই দৃশ্য মানসপটে আজও অমলিন।

~ মুন্সিয়ারির আরও ছবি ~

 

পেশায় চিকিৎসক (নাক কান ও গলা বিশেষজ্ঞ) অরিন্দম পাত্রের নেশা ছবি তোলা। এছাড়াও দেশের মধ্যে নানা জায়গায় ভ্রমণ করা তাঁর আর এক শখ।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher