মুর্শিদাবাদ - মালদা ভ্রমণ
শীলা চক্রবর্তী
~ মুর্শিদাবাদের আরও ছবি ~ গৌড়ের আরও ছবি ~
সিরাজ-আলিবর্দির দেশে যাবার অনেকদিনের ইচ্ছের ডানাটা মেলেই দিলাম এবার। শিয়ালদা থেকে বেলা বারোটা চল্লিশের লালগোলা এক্সপ্রেস ধরেছিলাম। ট্রেন বহরমপুর পৌঁছাল সন্ধে সাড়ে পাঁচটায়, সময়মতই। পরের দিন বেরিয়ে পড়লাম শহর লালবাগ দেখতে, টুকটুক (টোটো)রিজার্ভ করে। বহরমপুর ছোটো শহর, মোটামুটি সাজানো গোছানো,জমজমাট। প্রচুর নাতিপ্রশস্ত রাস্তাঘাট, নীল সাদা টুনি জড়ানো বাতিখাম্বায় সাজানো গঙ্গার সব ঘাট, লালদিঘি এলাকাটাও বেশ সুন্দর, সেসব দেখছিলাম যেতে যেতেই। প্রচুর পুরোনো বাড়িঘর এখানে সেখানে।
হাজারদুয়ারি ও ইমামবাড়া :-
গঙ্গা পেরিয়ে যেতে হবে লালবাগ। এদিন প্রথমেই গেলাম হাজারদুয়ারি। প্রচুর ঘোড়ারগাড়ি, এক্কা চোখে পড়ে ইতস্তত,সেইসঙ্গে ঘোড়ার বিষ্ঠার গন্ধ। প্রবেশপথের বাইরে বিকিকিনির কিছু দোকান, প্রচুর লোকসমাগম। পনেরো টাকা টিকিটের দাম, ফোনসহ ভেতরে প্রবেশ নিষেধ, ফোন জমা রাখতে হবে বাইরে। ভেতরে ছবি তোলা যাবেনা। সামনেই বিরাট ইমামবাড়া, বন্ধ পড়ে আছে, খোলে কেবল মহরমের সময়। নামাজ পড়া হয়। গার্ডকে বলেকয়ে টুক করে ভেতরে ঢুকে পড়লাম, ভেতরে আরেকটি ভবন, প্রশস্ত চত্বর, সুন্দর সব স্থাপত্যের থামে মোড়া। অবিলম্বেই গার্ডেরা বেরোনোর জন্য তাড়া দিলেন, বেরিয়ে এলাম।
হাজারদুয়ারির বাড়িটায় আসল নকল মিলিয়ে হাজারখানেক দরজা আছে,যেকারণে নাম হাজারদুয়ারি। নবাবি আমলের ব্যবহৃত প্রচুর জিনিস নিয়ে প্রদর্শনশালাটি তৈরি। বিরাট বিরাট থাম, বারান্দা, বাতিস্তম্ভ দিয়ে গোটাটা সাজানো। প্রথমেই রয়েছে আর্মারি বা অস্ত্রাগার। দুটি বিশাল গ্যালারি নিয়ে তৈরি। অযত্নে অবহেলায় আটানব্বই ভাগই চুরি হয়ে গেছে শুনলাম!এখানে যে কতরকম অস্ত্র রয়েছে!!পাতলা,সরু সব পারসিক তরবারি,জার্মান তরবারি,ইংলিশ তরবারি,সূঁচালো তরবারি,বেঢপ চ্যাটালো ভারি তরবারি -একটা দিক ভোঁতা, অন্যদিকটা ধারালো... রয়েছে সিরাজ-উদ-দৌলার ব্যবহৃত তরবারি, নবাবি আমলে ব্যবহৃত লিপিখচিত,সোনারূপাখচিত তরবারি,তাদের সব হাতলের কী বাহার!!আর ছোটো খঞ্জরই বা কতো!সর্পিল আঁকাবাঁকা খঞ্জর,সূঁচালো খঞ্জর, দুমুখো খঞ্জর... তাদের বাঁটগুলো সব রূপা,হাতির দাঁত,পশুর শিং এসব দিয়ে তৈরি। গণ্ডারের চামড়ার সব ঢাল রয়েছে,কারুকাজ করা। রয়েছে পুরনো আমলের গাদা বন্দুক থেকে বিদেশি হালকা রাইফেল,ডবল থেকে চারটে ব্যারেল। পিস্তলই বা কতো রকমের,বড়ো বাঁকানো নল,ছোটো হালকা, গুলিও রয়েছে হরেক মাপের। রয়েছে গুলি রাখার ধাতব ও হাতির দাঁতের বাক্স, বারুদ রাখার চামড়ার থলি,বন্দুক পিস্তল সব পরিষ্কার করার সরঞ্জাম। একধরনের অস্ত্র দেখলাম,নাম জমধর,লম্বা ডাঁটা,অনেকটা জাঁতির মতো দেখতে। এছাড়া রয়েছে দুটি নবাবি সিংহাসন,ওপরে চাঁদির কারুকাজকরা ঝালর,ঘরজোড়া প্রাচীন ঝাড়বাতি। রয়েছে প্রচুর হাওদা, রূপার, হাতির দাঁতের কাজ করা। রয়েছে আর্ট গ্যালারি, তাতে নবাবের পরিবার ছাড়াও বিদেশি শাসক ও তাদের পরিবারের ছবি আছে। এছাড়া নবাবের ব্যবহৃত ফিটন গাড়ি, ঢাকা ও হুডখোলা, শয্যা, টানা পাংখা, গড়গড়া, ফরাস রয়েছে। টেবিল, সোফা ইত্যাদি আধুনিক আসবাবও রয়েছে, রয়েছে বিশাল বিশাল দেয়ালজোড়া বেলজিয়াম কাঁচের আয়না, সদ্যনতুনের মতো ঝকঝক করছে। রূপাবাঁধানো ড্রেসিংটেবল, অদ্ভুত এক জাদু আয়না যাতে দুনিয়ার লোকের মুখ দেখা গেলেও হাজার চেষ্টা করেও দেখা যাবেনা কেবল নিজের মুখ। রয়েছে নবাবদের শিকারকরা বিশাল কুমির, স্টাফকরা পাখপাখালি, চমৎকার সব কাটগ্লাস ও চিনেমাটির নবাবি আসবাব।
কেবল হাজারদুয়ারিতেই এতকিছু, এটি দেখতেই কয়েক ঘন্টা লেগে যায়। আর যেটা না বললেই নয়,তা হল গাইডদের অত্যাচার,সবখানেই গাইড নেওয়ার আবদার। মূলত কিছুই জানেননা এঁরা। এঁদের থেকে সাবধান থাকতে পারলে খুব ভালো হয়।
কাঠগোলা বাগান :-
কাঠগোলা বাগানের বিস্তৃত এলাকার বিশাল দেউড়ি পেরিয়ে ঢুকতেই ছায়াঢাকা অঞ্চল,প্রচুর গাছ শাখাপ্রশাখা বিছিয়ে সূর্যের লাল চোখ আড়াল করে রেখেছে। দুপাশে বিশাল দুই ঘোড়সওয়ার রাজপু্রুষের মূর্তি। তিনতলা মূলভবনটিতে একটি প্রদর্শনশালাসহ ভেতরে রয়েছে প্রাচীন মন্দির,গোপন সুড়ঙ্গপথ,ছোটো একটি চিড়িয়াখানা। বিশাল একটি পুকুর, তার বাঁধানো ঘাট নেমে গেছে ধাপে ধাপে রাস্তা থেকে,ঘাটের ধারে অসংখ্য মাছ কিলবিল করে পর্যটকদের ছড়িয়ে দেওয়া বিস্কুটের গুঁড়ো খেতে ব্যস্ত। রয়েছে একটি উঁচু, ধাপওয়ালা, নাতিপ্রশস্ত খোলা চত্ত্বর, চারপাশে বসবার আসন সংবলিত। কানাতের আচ্ছাদনের নীচে বসে তার তলায় বাঈজিদের নাচ উপভোগ করতেন রাজারাজড়ারা, ইংরেজ অতিথিসহ। রয়েছে বেশকিছু ফোয়ারা, তাদের থামের ওপর মূর্তির কারুকাজ, বাগানে রয়েছে শ্বেতমর্মরের পরীর মূর্তি, এছাড়া ইতস্তত আরো অনেক মূর্তি রয়েছে বাগান জুড়ে।
মন্দিরের এলাকাটি নিচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, থাম দেওয়া প্রবেশদ্বার, সামনে বাঁধানো চত্বর। ভেতরের বারান্দাটি মোটামুটি চওড়া। বারান্দা ও মেঝে সাদাকালো পাথরের, ঝকঝকে। ভেতরে জগদ্ধাত্রী, শেরাওয়ালী, রাধাকৃষ্ণসহ প্রচুর ছোটোবড়ো পাথরের মূর্তি রয়েছে মূলমন্দির ছাড়াও ঘেরা বারান্দার কুলুঙ্গিতে। দরজার ওপরে রঙিন বেলোয়ারি কাচের কারুকাজ, রয়েছে কাটগ্লাসের বেশকিছু ঝাড় ও বাতিদান। একটি বিশেষভাবে নির্মিত সাদা রঙের কাচঘেরা বাতি রয়েছে যেটি মন্দিরের ঠিক মাঝখানে লাগানো, তার সামনে এসে দাঁড়ালে ওতে ছায়া পড়ে, ফলে পেছন ফিরে বসে বা দাঁড়িয়েও বোঝা যায় কেউ এসেছে বা আসছে। সম্ভবত সতর্কতাবশত এটি লাগানো হয়েছিল।
মূলভবনটির ভেতরে ও বাইরে প্রচুর আসবাব দিয়ে সাজানো। বাইরে বিশাল দুটি ডাইনিং টেবিল-চেয়ারসহ। ছোটোবড়ো পালকি,ভেতরে ঢুকেই বিশাল হলঘরটিতে দেওয়ালের রাজকীয় কারুকাজ চোখ টানে। ঘন নীলের ওপর সোনালি কাজ, সঙ্গে মানানসই রঙিন জালি ও ভারী পরদা, দেয়ালজোড়া বেলজিয়াম কাচের বিশাল সব আয়না, ঝাড়বাতি, সোফাসেট, টেবিল। সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়েও রয়েছে পুরনো ধাঁচের আলনা, ড্রেসিংটেবল, কারুকাজকরা ভারি ফ্রেমের আয়না, বাহারি নকশাকরা পায়ার ছোটোছোটো টুল ইত্যাদি। দোতলায় রয়েছে কাঠের আলমারি, ছোটোছোটো আয়না বসানো, ঘোরানো ডিজাইনের ছত্রি বসানো, ওঠবার জন্য কাঠের সিঁড়ি লাগানো উঁচু পালঙ্ক, ওপরে ফিনফিনে জালির মশারি, টানা পাখা। একটি ঘরে ঘরজোড়া গদির ফরাস পাতা। সম্ভবত বসে নাচ দেখার জন্য ব্যবহৃত হত। দুদিকে দুটো চওড়া বারান্দা রয়েছে। পিছনের ঘেরা, চিকদেওয়া বারান্দাটিতে দাঁড়ালে রাস্তা অবধি দেখা যায়। বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে সবুজ আর সবুজ। লনের কেয়ারি করা গাছ জুড়ে আছে বাগানের অনেকখানি এলাকা। শান্ত সুন্দর পরিবেশে পাখিদের কলকাকলি ভেতরটা নিমেষে জুড়িয়ে দেয়। সামনের বারান্দাটি জাফরিকাটা কাজের লোহার রেলিংঘেরা, সেখানে দাঁড়ালে ভেতরের অনেকটা চোখে পড়ে সামনের মাছেভরা পুকুরটিসহ। তিনতলায় বিশাল ছাদে রয়েছে একটি নিশানস্তম্ভ। ভেতরে বেশকিছু বইয়ের আলমারি, চিনেমাটির বাহারি পুরনো সব ঢাকা বড়ো পাত্র ইত্যাদি রয়েছে।
জগৎশেঠের বাড়ি :-
জগৎশেঠের বাড়িটিতেও রয়েছে একটি প্রদর্শনশালা। বাড়ির সামনেই একটি বড়ো ঘেরা জলাশয়, তার মাঝখানে শোভা পাচ্ছে একটি শ্বেতমর্মরের নগ্নিকা নারীমূর্তি। পাশেই রয়েছে জৈন মন্দির, সেখানে রয়েছে মহাবীরসহ অন্যান্য জৈন তীর্থঙ্করদের মূর্তি। হিন্দু দেবদেবীর মূর্তিও রয়েছে লক্ষ্মী, মনসাসহ। রয়েছে দুটি গোপন সুড়ঙ্গপথ। ঢুকতেই গা ছমছম করে ওঠে, নীচু ও চাপা। ভেতরে রয়েছে ছোটখাট এক অস্ত্রাগার। রয়েছে তরবারি, ঢাল, খঞ্জর, বন্দুক, পিস্তল, জমধরসহ পেতলের বেশ বড়োসড়ো এক কানকাটা কাঁচি, ব্যবহৃত হত বিজিত শত্রু বা অপরাধীর কান কেটে নিতে।
অপর সুড়ঙ্গটিতে রয়েছে জগৎশেঠের কন্যা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যাদের ব্যবহৃত বহুমূ্ল্য সব শাড়ি,পানদান,পালঙ্ক জলচৌকি, সিন্দুকসহ নানা আসবাব, কুলদেবী লক্ষ্মীর মূর্তি, পাথর ও চিনেমাটির বাসনকোসন ইত্যাদি। মূল প্রদর্শনশালায় রয়েছে প্রাচীন কারুকাজকরা পালঙ্ক যাতে জগৎশেঠ শয়ন করতেন,তার চারটি পায়া হল চারটি কাঠের পুতুল। রয়েছে শৌখিন সব কাটগ্লাসের ও চিনেমাটির বাসনপত্র, আধুনিক কাটলারিসেট অবধি। গদিআঁটা সোফাসেট, শ্বেতমর্মরের বাহারি গোলটেবল যার পায়া এক নগ্ন নারীমূর্তি, একটি ছোটো গ্রন্থাগার। রয়েছে জগৎশেঠের ব্যবহৃত বর্তমানে শতছিন্ন পোষাক, জুতো, পাগড়ি। স্ফটিকপাথর, জল গরম করার পাত্র, নবাবি আমলের মুদ্রা, ধাতব ও পাথরের বাসনকোসন ইত্যাদি।
নশিপুর রাজবাড়ি :-
ঐতিহাসিক নশিপুর রাজবাড়িতে রয়েছে প্রচুর দেবদেবীর মূর্তি। একতলার বিশাল "L" আকৃতির দালানটির দেওয়াল জুড়ে অনেকগুলো কুলুঙ্গি। তাতে রামসীতা, হনুমান, রাধাকৃষ্ণসহ অনেক পাথরের দেবদেবী মূর্তি শোভা পাচ্ছে। মূল মন্দিরেও রয়েছে একাধিক মূর্তি। দোতলায় রয়েছে রাজপরিবারের সদস্যাদের ব্যবহৃত শাড়ি, টিনের পাতে এমবসকরা দেবদেবীর ছবি,পেতলের সব মাঝারি মাপের মূর্তি - নাড়ুগোপাল, রাধাকৃষ্ণ, দুর্গা ইত্যাদি। স্নানের জন্য সিমেন্টের বাথটব, বিশাল বড়ো গ্র্যান্ডফাদার ক্লক, লোহার ও কাঠের সিন্দুকসহ রাজপরিবারের ব্যবহৃত আসবাবপত্র রয়েছে।
কলিজাখাকি বেগমের সমাধি :-
কলিজাখাকি বেগম বলে কথিত আজিম-উন-নিসার সমাধিক্ষেত্রটি বেশ বড়ো এলাকা নিয়ে। প্রবেশ করতে হয় দেউড়ি পেরিয়ে। ভেতরে কেয়ারিকরা গাছ পথের দুধার দিয়ে চলে গেছে। ডানদিকে একটি লোহার শিকঘেরা আধো অন্ধকার জায়গায় বেগমের সমাধিটি, সামনে কয়েন ছড়িয়ে গেছে দর্শনার্থীরা। বেগমের মৃত্যু ঘিরে যে মিথটি প্রচলিত তা হল,মুর্শিদকুলি খাঁর এই কন্যা একবার কঠিন অসুখে আক্রান্ত হন। হেকিমরা নিদান দেন রোজ একটি শিশুর কলিজা খেলে তবেই বেগম আরোগ্যলাভ করবেন। রোজ একটি করে শিশু অপহরণ ও হত্যা করতে থাকল বেগমের গোপন অনুচররা। বেগম শিশুর কলিজা খেয়ে সুস্থ তো হয়ে উঠলেন, কিন্তু ছাড়তে পারলেন না সুস্বাদ নরমাংসের লোভ। কলিজা খাওয়া চলতে থাকল। অভিহিত হলেন কলিজাখাকি নামে। শিশু অপহরণের খবর পৌঁছলো তাঁর পিতা নবাবের কানে, ধরা পড়লেন বেগম। শাস্তি হিসেবে জীবন্ত কবরে দাফন করা হল তাঁকে। এখনো তাঁর পরিচিতি কলিজাখাকি বেগম নামেই।
মীরজাফরের বাড়ি ও নিমকহারামের দেউড়ি এবং পারিবারিক সমাধিক্ষেত্র :-
ইংরেজ-আশ্রয়ী বাংলার প্রথম নবাব, সৈয়দ জাফর আলি খান অর্থাৎ মীরজাফরের বাড়িটিতে এখন পর্যটক প্রবেশ নিষেধ। ভেতরে একটি ছোটো ইমামবাড়া রয়েছে যেটি কেবল বৃহস্পতিবার খোলা থাকে। ইমামবাড়ার ভেতরে রয়েছে হজরত ইমাম হোসেনের কবরের একটি জারিহ্ যা কারবালা থেকে আনা হয়েছিল। প্রবেশপথ তথা বিশাল দেউড়ির লোহার দরজাটি খোলাই থাকে। তার নাম মীরজাফরের দেউড়ি। পলাশীর যুদ্ধে মীরজাফরের ভূমিকার পরে মানুষের মুখে মুখে এটির নাম হয়ে যায় "বিশ্বাসঘাতকের দেউড়ি"। এর অনতিদূরে রয়েছে মীরজাফরের পারিবারিক সমাধিক্ষেত্র। পাঁচিলঘেরা,খুব বিস্তৃত নয়। কবরগুলি সাধারণভাবে বাঁধানো, আড়ম্বরহীন। তার মধ্যে মীরজাফরের কবরটি একটু বিশেষভাবে মার্বেলের ফলক দিয়ে বাঁধানো,চিনতে অসুবিধে হয়না।
কাটরা মসজিদ :-
কাটরা মসজিদের এলাকাটি বেশ বিস্তৃত। ঢাকার করতলব খাঁ মসজিদের অনুকরণে এ মসজিদটি নির্মিত হয়। মাদ্রাসা হিসেবেও ব্যবহার হত এটি। দুদিকে দুটি সুউচ্চ মিনার, নীচু নির্মাণের মাথায় অনেকগুলো গম্বুজ। ওপরের গম্বুজ ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে মাথার দিকটা ভেঙে গিয়েছে। মসজিদের ভেতরে দুপাশে ছোটো ছোটো নানা আকৃতির প্রকোষ্ঠ রয়েছে। সবুজ গালিচার মতো ঘাসেঢাকা চত্বর থেকে ধাপে ধাপে সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরে। সেখানে আরেকটি ছড়ানো চত্বর, ছোটো ছোটো প্রকোষ্ঠে ঘেরা। পিছনে একটি কেয়ারিকরা বিস্তৃত বাগান রয়েছে। এই মসজিদের প্রবেশ তোরণের নীচেই সমাধিস্থ রয়েছেন মসজিদনির্মাতা নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ। তিনি এই জীবদ্দশাতেই মসজিদ প্রাঙ্গণেই সমাধিস্থ হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন বলে কথিত আছে।
জাহানকোষা কামান :-
লালবাগের আরেক দর্শনীয় বস্তু মুঘল সম্রাট শাহজাহানের আমলে তৈরি জাহানকোষা কামানটি বাঙালি কারিগর জনার্দনের ধাতুবিদ্যায় পারদর্শিতার নিদর্শন। সাত মিটার দীর্ঘ এই কামান বহু যুদ্ধে ব্যবহার হয়েছে। জাহানকোষা শব্দের অর্থ "বিশ্বজয়ী"।
খোশবাগে নবাব পরিবারের সমাধিক্ষেত্র :-
লালবাগ দর্শনের পর্বশেষে গঙ্গার ঘাট পেরিয়ে খোশবাগে যাওয়া গেল নবাব পরিবারের সমাধিক্ষেত্রে। বেশ সাজানো গোছানো জায়গাটি। নবাব পরিবারের সদস্যদের অনেক সমাধি রয়েছে ছড়িয়েছিটিয়ে। নাতিবৃহৎ প্রবেশদেউড়িটি পেরিয়ে ভেতরে কেয়ারকরা বাগান, তার মধ্যে রয়েছে অনেক কবর। এর মাঝেই রয়েছে নবাবের বিশ্বস্ত গোলাম হোসেনের কবর। ডানপাশে নতুন করে ঘিরে দেয়া হচ্ছে অনেক কবরের জায়গা। সেটি পেরিয়ে নীচু পাঁচিলঘেরা বাঁধানো চত্বরটিতে শায়িত নবাব পরিবারের সদস্যারা। সিরাজজননী আমিনা বেগম, খালাআম্মা ঘসেটি বেগমের কবর দুটি পাশাপাশি, এছাড়া আরো কয়েকটি কবর রয়েছে। চত্ত্বরটি পেরিয়ে একটি মর্মরে বাঁধানো দালান, তার একেবারে মধ্যস্থলে উঁচু উঁচু তিনটি ধাপসংবলিত কবরে শায়িত নবাব আলীবর্দি খাঁ। বাঁদিকেই অপেক্ষাকৃত নীচু অনাড়ম্বর কবরে শায়িত তাঁর আদরের নাতি বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব। মাথার কাছে একটি মার্বেল ফলক, আরবী হরফে লেখা, সেইটি দেখেই চিনে নেয়া যায় নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার কবরটি। তাঁর কবরের বামপাশে বেগম লুৎফ-তুন-নিসার কবর। বাবা-মায়ের পায়ের দিকের কবরটি কন্যা জহরৎ-উন নিসার। দালানটি পেরিয়ে একটি মসজিদ রয়েছে।
ওলন্দাজ সমাধিক্ষেত্র :-
কাশিমবাজার ছোটো রাজবাড়ি যাওয়ার পথের ধারেই রয়েছে ওলন্দাজদের সমাধিক্ষেত্র। অনতিদূরে কল্কাপুর নামে স্থানে ছিল ওলন্দাজদের কারখানা। কারখানাটি নষ্ট হয়ে গেলেও রয়েছে ওলন্দাজদের সমাধিক্ষেত্রটি। সব মিলিয়ে তেতাল্লিশটি কবর রয়েছে এই সমাধিক্ষেত্রে। লালচে রঙের সমাধিগুলি কোনো কোনোটি সুউচ্চ ও চূড়াকৃতি,কোনোটি গোল গম্বুজাকৃতির,দ্বিতলসম উচ্চতা,নীচে রয়েছে একাধিক আর্চসহ খোলা চত্ত্বর,কোনোটি সাধারণভাবে বাঁধানো। অনেকগুলো সমাধির গায়ে প্রাচীনতার ছাপ, শ্যাওলার দাগ,ক্ষয়ের চিহ্ন,সংস্কারের কাজ চলছে কোনো কোনোটির। একটি সমাধি বিশাল গম্বুজাকার,সাদা,সুন্দর কারুকাজ করা থাম,সম্ভবত কোনো উচ্চ পদাধিকারীর সমাধি হবে সেটা। ভেতরে রয়েছে যত্নে সাজানো ফুলের বাগান, ঘাসেঢাকা জমি। কোথাও কবরের ধারে বসে আড্ডা জমিয়েছে তরুণদের দল।
কাশিমবাজার ছোটো রাজবাড়ি :-
কাশিমবাজার ছোটো রাজবাড়ির পরিধি সুবিশাল। এটি বেশ জনপ্রিয় ভ্রমণস্থান,কিন্তু সেদিন এখানে লোকসমাগম বেশ কম। রাজবাড়ির ভবনটি তালাবন্ধই থাকে,একজন কর্মচারীকে ডেকে এনে চাবি দেওয়া হল। তালা খুলে সেই প্রৌঢ়া ভদ্রমহিলাই আমাদের রাজবাড়ি ঘুরিয়ে দেখালেন। এটাসেটা বলে দিচ্ছিলেন,গাইডের মত। এখানে কোনো গাইডের উৎপাত দেখা গেল না, নিরাপত্তাব্যবস্থারো কোনোরকম বাড়াবাড়িও নয়। অপর কোনো দর্শনার্থী চোখে পড়ল না।
এই ঐতিহাসিক রাজবাড়িটির পত্তন করেন দীনবন্ধু রায়। এঁদের আদি পদবী ছিল চট্টোপাধ্যায়। রাজা আদিশূর কান্যকুব্জ থেকে বেদপাঠের জন্য যে পাঁচজন ব্রাহ্মণকে নিয়ে এসেছিলেন, দক্ষ ছিলেন তাঁদের অন্যতম। এই দক্ষের বংশের বাইশতম বংশধর ছিলেন দীনবন্ধুর পিতা অযোধ্যারাম রায়। অযোধ্যারাম তাঁর অসামান্য মেধার জন্য নবাব নাজিমের নিকট হতে রায় খেতাব লাভ করেন। দীনবন্ধু ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির কাশিমবাজার রেশমকুঠির দেওয়ান ছিলেন। তিনিও নবাব সরকারের কাছ থেকে খেলাত ও রৌপ্যমণ্ডিত ছড়ি ব্যবহারের অনুমতি পেয়েছিলেন। এখন এঁদের উত্তরসূরীরা কলকাতায় থাকেন, উৎসব-পার্বণে একত্রিত হন এখানে।
রাজবাড়ির বাইরেটা খুব সুন্দর এবং সযত্নরক্ষিত। বিশাল গেট এবং দেউড়ি পার করে সুবিশাল ঘাসেঢাকা উঠোন। ঠিক মাঝখানে গোল এলাকা নিয়ে বাহারি চেন দিয়ে ঘেরা কেয়ারিকরা সব ঝোপের মতো গাছ। মাঝে মাঝে বিশাল দেবদারু। ঢুকে বাঁদিকে রয়েছে প্রশস্ত শ্বেতমর্মরে বাঁধানো চত্বর। চারদিকে বেশকিছু জোড়া থামের মাথায় বাহারি ফুলের টব। সামনের থামের মাথায় বাতিস্তম্ভ। মাঝখানে পাঁচটি ছোটো স্তরবিশিষ্ট ফোয়ারা। এছাড়া বিশাল আঙিনার চৌহদ্দি জুড়ে ছড়ানো রয়েছে বাতিস্তম্ভ, শ্বেতমর্মর মূর্তি, দুষ্প্রাপ্য সব গাছপালা। ডানদিকে প্রাসাদের চূড়াকৃতি মিনারের গায়ে রয়েছে বিশাল ঘড়ি। মুখে মুখে এটির নাম ঘড়িঘর। উঠোনের হাতার মধ্যেই রয়েছে শিবমন্দির,চারধারে চারটি ছোটো এবং মাঝখানে একটি চূড়াবিশিষ্ট পঞ্চরত্ন মন্দিরটি শ্বেতশুভ্র,ভেতরে শিবলিঙ্গ রয়েছে। প্রাসাদের মূল প্রবেশদ্বারের ওপরে রয়েছে গাঢ় সবুজ রঙের ওপরে সোনালি রঙের দুটি সিংহের মনোগ্রাম।
রাজবাড়ির ভেতরে ঢোকার আগেই চলে গেলাম পেছনদিকটায়, বিশাল দিঘি মজে আছে,গরুও চরছে ভেতরে। ছোটো একটি জলের ডোবার মতো অবশ্য আছে - ঘন শ্যাওলায় ঢাকা,স্মৃতির মতই। বাঁধানো ঘাটের জাঁকজমক একসময়ে দেখার মতোই ছিল বোঝা যায়। ধাপে ধাপে চওড়া সিঁড়ি নেমে গেছে অনেকটা গভীরে। ওপরে ঘাটের দুধারে কারুকাজ করা প্রশস্ত সুন্দর বিশ্রম্ভালাপের জায়গা রয়েছে। দিঘির পাড়েই রয়েছে বিশাল প্রাচীন নাগকেশর গাছ, প্রচুর ফুল ফুটে আছে, গাঢ় গোলাপি রঙের পাপড়ির ভেতরে সোনালি গর্ভমুণ্ড।
রাজবাড়ির অভ্যন্তরের ঘেরা চত্বরে চারটি করে মোট ষোলোটি থাম রয়েছে চার পংক্তিতে, অতি সুন্দর দেখতে। তার তিনদিক ঘিরে মূল প্রাসাদ, শ্বেতশুভ্র, বাহারি সিঁড়ি উঠে গেছে দুদিক দিয়ে। বারান্দার ওপরে রয়েছে মিহি কারুকাজ, জাফরিকাটা। চিক দিয়ে ঘেরা বারান্দার উপরিভাগ।
দরবার কক্ষটির আভিজাত্য খুবই নয়নাভিরাম। দ্বিতল দরবারটি লম্বাটে ও ছড়ানো, দুধারে মোটা থামযুক্ত আর্চ রয়েছে। রয়েছে শ্বেতমর্মরের আধারের ওপর সুন্দর সব ভারি বিশাল রঙিন পাথরের ফুলদানি। দরবারেরই একধারে রয়েছে বৈঠকখানা। ভারি কাঠের মোট ষোলোটি গদিআঁটা আধুনিক ধাঁচের চেয়ারসহ বিশাল টেবিল, পায়ায় সুন্দর কারুকাজ, সব সাদা কাপড় এবং মোটা পলিথিন দিয়ে ঢাকা। অনেকগুলো পায়রা সেখানে বাস করছে দেখা গেল।
এই রাজবংশের গৃহদেবতা মদনগোপাল। ভেতরে রয়েছে তাঁর মন্দির। কাশিমবাজার রাজবাড়ির পুজোপার্বণ এবং অতিথি আপ্যায়নের ইতিহাস সুপ্রসিদ্ধ। দালানের ভেতরে রয়েছে বালগোপালের বিশাল মূর্তি। ঘনশ্যাম বর্ণের শিশু গোপাল হাঁড়ি থেকে ননী খেতে ব্যস্ত, হাতমুখে ননী মাখামাখি। একটি কাঁচের বাক্সের মত আবরণের মধ্যে মূর্তিটি বসানো, সম্ভবত সুরক্ষার কারণে।
ভেতরের উঠোনের মাঝখানে বাঁধানো তুলসীমঞ্চ, ওধারে লম্বা দালানে সিঁদুরের স্বস্তিশোভিত বিশালাকৃতির বাটনাবাটা শিলনোড়া, বিশাল চন্দনপাটা, পুজোর প্রচুর বাসনকোসন ইত্যাদি রয়েছে। প্রত্যহ মদনগোপালের সেবার পর এই লম্বা দালানটিতে বিখ্যাত পংক্তিভোজনের পাত পড়ত, প্রচুর লোকসমাগম হত। একটি বোর্ড দিয়ে দালানটির গায়ে পংক্তিভোজনের দালান বলে লেখা আছে। ভেতরের প্রশস্তঘরটিতে ভোগের রান্নাবান্না হত। এখন সেখানে আসন্ন কার্তিকপুজোর আয়োজন চলছে,মূর্তি গড়া হচ্ছে।
কাশিমবাজার ছোটো রাজবাড়ির দুর্গাপুজো এতদঞ্চলে বিখ্যাত। ঠাকুরদালানটি বেশ বড়ো। বিশাল চত্ত্বরের চারদি মোটা মোটা কারুকাজকরা থামে ঘেরা। ঠিক মাঝখানটিতে সাদাকালো চৌখুপির ওপর বসানো পেল্লায় পেতলের ঘট,পেতলের ডাবসহ। ধাপে ধাপে সিঁড়ি বেয়ে উঠে মূল ঠাকুরদালান। বারান্দার দুধারে দাঁড়ে বসানো দুটি নকল শুকসারি। লাল এবং নীল রঙের। দুর্গামূর্তি যেখানে রাখা হয় তার মাথায় চাঁদোয়া টাঙানো,সাদার মধ্যে লাল নীল হলুদ রঙের সূতো দিয়ে অপরূপ কারুকাজকরা,চারধারে ঝোলানো ঝালর। পেতলের বিশাল প্রদীপ রয়েছে, নিত্য সন্ধ্যাদীপ জ্বালানো হয়।
সংগ্রহশালার ভেতরটা ঠাসা পুরনো আমলের জিনিসপত্রে। রঙবেরঙের বেলোয়ারি কাঁচ লাগানো পালকি রয়েছে, এতে করে নাকি রানিরা যাতায়াত করতেন। রাজবংশের লোকেরা বেশ শৌখিন ছিলেন বোঝা যায়,কার র্যালিতে অংশ নিতেন, বিজয়ীর স্মারকসম্মান সাজানো রয়েছে। রাজবংশের এক দম্পতির বিবাহের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে কবিকে ফরমায়েশ করে লেখানো কবিতা দম্পতির ছবিসহ বাঁধানো রয়েছে, দেওয়ালে টাঙানো। বারান্দায় ওপর থেকে নীচ অবধি লম্বা রঙিন পট টাঙানো, অনেকটা কালীঘাটের পটের আদলে। তাতে শ্রীকৃষ্ণের লীলার বিভিন্ন ঘটনা চিত্রিত রয়েছে। খাবার ঘরটি বেশ সুন্দরভাবে সাজানো। জমকালো ভারি কাজের কাঠের চেয়ার টেবিল, স্কাইলাইট দিয়ে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা, ওপরে ঝোলানো পাখাগুলোর গায়েই চারটে করে ছোটো শেডের মধ্যে আলো ঝোলানো রয়েছে। ওপর থেকে ঝালর লাগানো হাতে টানা পাখাও রয়েছে, ছাদের এধার থেকে ওধার অবধি।
এছাড়া রয়েছে বিশাল ভারি কাঠের কাজের ছত্রি লাগানো পালঙ্ক, সোফা, চেয়ার টেবিল, পুরনো আমলের ড্রেসিং টেবল। রয়েছে রূপাবাঁধানো গড়গড়া, আলনায় সূক্ষ্ম কাজের সব ভারীভারী শাড়ি, কোট ও টুপি রাখবার স্ট্যাণ্ড, দেয়ালে হাতেআঁকা সুন্দর সব ছবি, কাঠের হরিণের শিংওলা মাথা, ডোকরার মানুষ মডেল ফ্রেমে বাঁধানো, কাঠের ভারী ছোটো সিন্দুক,সাজানোগোছানো কাছারিঘরে রয়েছে চেয়ার টেবিল থেকে পুরনো আমলের ক্যাশবাক্স অবধি। চানঘরে রাখা আছে বিশাল বাথটব। রয়েছে চিনেমাটির পুরনো জলের ফিল্টার, বিলিতি কোম্পানির নামখোদাই করা। রয়েছে বিশাল দাবার বোর্ড, তার ঘুঁটিগুলো সব ইয়াব্বড়ো একেকখানা হাতি ঘোড়া মানুষ। রয়েছে নাচঘরও, সেখানে ফরাস পাতাও আছে, শুধু নাচ এখন স্মৃতি।
মালদহ (গৌড়) :-
বাংলার প্রাচীন রাজধানী গৌড় ইতিহাসসমৃদ্ধ বহু স্থাপত্যে ভরপুর। যাবার আগে অনেকেই নিরুৎসাহিত করেছিলেন, শুধু কিছু ভাঙাচোরা ইট, ঘুরে এসে আফসোস ছাড়া কিছুই হবেনা ইত্যাদি, কিন্তু ওই ভাঙা ইটগুলোর মধ্যে অতীতের গন্ধ খুঁজতেই তো পাড়ি দেওয়া!
মদনমোহন মন্দির :-
প্রথমেই যাওয়া গেল গৌড়ের প্রসিদ্ধ মদনমোহন মন্দিরে। এখানের মেলা খুব বিখ্যাত, মেলার সময় প্রচুর জনসমাগম হয় দেশবিদেশ থেকে। মদনমোহনের মন্দির বেশ কারুকাজ করা,সামনে নাটমন্দির,বাইরে শ্রীচৈতন্যের বিশাল উদ্বাহু মূর্তি আর প্রাচীন কদমগাছ, নাম কেলিকদম্ব। ১৫১৫ খ্রীস্টাব্দে চৈতন্য এই স্থানে অবস্থান করেছিলেন এবং এই গাছের ছায়ায় বসে ভক্তদের উপদেশ বিতরণ ও নামগান করেছিলেন। সেই থেকেই এই গাছটি বিশেষ হয়ে উঠেছে ভক্তদের চোখে।
বড়োসোনা মসজিদ (বারদুয়ারি) :-
এরপরের দ্রষ্টব্য বড়োসোনা মসজিদ। বিশাল এলাকা নিয়ে মসজিদটির অবস্থান। নির্মাণকাল ১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দ, সুলতান নসরত খাঁ-এর আমলে নির্মিত। এর আরেকটি নাম বারোদুয়ারি যা লোকমুখে বারদোয়ারি বলে প্রচলিত, কারণ এই মসজিদটির মোট বারোটি দরজা বা দুয়ার ছিল, বর্তমানে যদিও এগারোটি দরজাই পরিলক্ষিত হয়। মসজিদটির চারধারের বারান্দায় কারুকার্যময় খিলানের উপস্থিতি, ভেতরের তিন খিলানের ওপরের গম্বুজটি এখন আর নেই। এই গম্বুজটির সোনালি চিকণ কারুকার্যের জন্যই মসজিদের নাম হয়েছি বড়োসোনা মসজিদ। এর উত্তর দিকে মহিলাদের জন্য পৃথক একটি প্রকোষ্ঠ ছিল, দক্ষিণপূর্বে মুয়াজ্জিনের আজান দেওয়ার প্রকোষ্ঠ, দুটোই এখন ধ্বংসাবশেষ। তিনটি তোরণের মধ্যে একটিই কেবল অক্ষত। বড়োসড়ো ধ্বংসস্তুপের মধ্যে ইতস্তত পড়ে থাকা খিলানগুলির কারুকাজ চোখ টানবে।
সেলামি দরওয়াজা :-
পরবর্তী দ্রষ্টব্য দাখিল বা সেলামি দরওয়াজা। সুলতান বারবক শাহের আমলে এটি নির্মিত, নির্মাণকাল ১৪২৫ খ্রিস্টাব্দ। এটি গৌড় দুর্গের উত্তরদিকের প্রধান প্রবেশপথ ছিল। এখান থেকে কামানের গোলাবর্ষণ করে সম্মান জানানো হত বলে এর নাম সেলামি দরওয়াজা। এই স্থাপত্যটিতেও রয়েছে থাম, দেওয়ালে ও খিলানে চমৎকার সব কারুকাজ।
ফিরোজ মিনার :-
এরপর ফিরোজ মিনার। এটির নির্মাণকাল আনুমানিক ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দ,নির্মাতা সঈফ উদ্দিন ফিরোজ,হাবশী এই সুলতান সিংহাসনে আরোহণ করেন সুলতান বারবক শাহকে হত্যা করে। প্রায় ছাব্বিশ মিটার উচ্চতা এই মিনারের। ভেতরে রয়েছে মোট তিয়াত্তরটি সোপান। মিনারের অভ্যন্তরে অবশ্য প্রবেশ নিষেধ। সামনে একটি পুকুর রয়েছে।
কদম রসুল মসজিদ :-
পরবর্তী দ্রষ্টব্য কদম রসুল মসজিদ। এটিও সুলতান নসরত শাহের আমলে নির্মিত। নির্মাণকাল ১৫৩১ খ্রিস্টাব্দ। নবী মোহাম্মদের পায়ের চিহ্নসংবলিত একটি পাথর এই স্থানে রক্ষিত ছিল, এই কারণেই নামকরণ কদম রসুল মসজিদ। চতুষ্কোণ এক গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটির পশ্চাৎভাগে একটি ছোটো কবরস্থান রয়েছে। মূল মসজিদের প্রবেশদ্বারের পাশেই একটি আরবী লিপিফলক, সেটি খোদ মদিনা থেকে আনা হয়েছে বলে কথিত। ভেতরে নাতিপ্রশস্ত চাতাল, মসজিদগৃহের চারধারের বারান্দা পেরিয়ে পদচিহ্নের পাথর রাখার ঘরটি। এখানেই রয়েছে মোঘল সম্রাট অওরঙ্গজেবের সেনাপতি দিল্ওয়ার খাঁ-এর পুত্র ফতেহ্ খাঁ-এর সমাধি। কথিত আছে, সুলতান সুজাকে বিদ্রোহ করার পরামর্শ দেবার অপরাধে পীর শাহ্ নিয়ামত্উল্লাহকে হত্যা করার জন্য সম্রাট ফতেহ্ খাঁকে পাঠান, গৌড়ে পৌঁছে ফতেহ্ খাঁ এই স্থানেই রক্তবমন করে মারা যান। সমাধিগৃহটি উত্তল ছাদবিশিষ্ট শৈলীতে তৈরি।
চিকা /চামকান মসজিদ :-
এরপরের গন্তব্য অদূরের চিকা বা চামকান মসজিদ,নির্মাণকাল ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দ। এককালে এর ভিতরে বহু চামচিকার বাস থাকায় নাম হয়েছে চিকা মসজিদ। এক গম্বুবিশিষ্ট এই গৃহটিকে মসজিদ বলা হলেও, কথিত আছে এটি সুলতান হুসেন শাহের আমলে কারাগার হিসেবে ব্যবহৃত হত। হিন্দু মন্দির থেকে আনীত বহু কারুকাসংবলিত পাথর এটির নির্মাণকাজে ব্যবহৃত হয়। মূল গৃহটির বাঁদিকে অদূরেই রয়েছে এক গম্বুজবিশিষ্ট নাতিবৃহৎ কারাগারগৃহটি। একটি খিলানে কাজকরা পাথরের থাম রয়েছে সামনেই, তাতে ফুল পাতা, মানুষের অবয়বসহ অসাধারণ সূক্ষ্ম সব কারুকার্য খচিত আছে। গৃহটিতে পরিলক্ষিত হয় সুন্দর সব রঙিন মিনাকারী পাথরের কারুকাজ, গোল পাতলা প্রাচীন ইটের ব্যবহার, থাম ও দেওয়ালের নয়নলোভন সৌন্দর্য। ভিতরে প্রবেশ নিষেধ।
লুকোচুরি দরওয়াজা :-
অদূরেই রয়েছে লুকোচুরি দরওয়াজা। নির্মাণকাল ১৬৫৫ খ্রিস্টাব্দ, নির্মাতা শাহ্ সুজা। এটি গৌড় দুর্গের পূর্ব দিকের প্রধান দরজারূপে ব্যবহৃত হত। উপরিভাগ ব্যবহৃত হ নহবতখানা হিসেবে। এছাড়া কথিত আছে দ্বিতল,বহু ছোটো প্রকোষ্ঠ সংবলিত এই স্থানটিতে নবাব তাঁর বেগমদের নিয়ে লুকোচুরি খেলতেন।
লোটন মসজিদ :-
পরবর্তী গন্তব্য লোটন মসজিদ। নির্মাণকাল ১৪৭৫ খ্রিস্টাব্দ,নির্মাতা শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহ্। এই মসজিদকে ঘিরে অনেক কথাকাহিনি প্রচলিত বলে শোনা গেল। একগম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটির নির্মাণশৈলী অসাধারণ। এর দেওয়াল, থাম, খিলান, ভেতরের গম্বুজমধ্যস্থ চিকণ সব কারুকার্য এক কথায় অনন্য। দেওয়ালের বাইরের প্রকোষ্ঠগুলির সূক্ষ্ম ফুল পাতা লতার কারুকাজ, রঙিন মিনাকারির পুরনো সব পাতলা গোল ইটের কাজ, থামের অঙ্গসজ্জা পুরোটাই নয়নাভিরাম। বৃহস্পতিবার ছাড়া বাকি দিনে ভেতরে প্রবেশ নিষিদ্ধ।
অজানা মণিমুক্তো :-
সবশেষে পথিপার্শ্বে দুটি মসজিদ দেখা হল যাদের নাম পরিচয় জানা গেল না। একটি মসজিদের সামনের প্রশস্ত চত্ত্বরে দুটি কালো পাথরে বাঁধানো কবর রয়েছে, রেলিংঘেরা। মূল মসজিদটির ছাদ সম্পূর্ণ ভাঙা, মোট তিনটি গম্বুজ ছিল সে আভাস স্পষ্ট, চারটি কারুকাজকরা থাম দাঁড়িয়ে আছে। বাইরের দেয়ালে সূক্ষ্ম ফুল পাতার কাজ রয়েছে। ভিতরে মাঝারি আকারের দেয়াল প্রকোষ্ঠ রয়েছে,এখনো তার সৌন্দর্য অটুট। পাশেই লাগোয়া একটি মৌচাক, মৌমাছির অবাধ যাতায়াত ভিতরে। দুটি মসজিদের হালই মোটামুটি একরকম।
গঙ্গার ঘাট :-
এছাড়া ইতিউতি ছড়িয়ে গঙ্গার ঘাট রয়েছে অনেকগুলো। সন্ধ্যের মুখে বাঁধানো সিঁড়িতে গিয়ে বসলে সূর্যাস্তের মোহন রঙ চোখ জুড়িয়ে দেবে। দুএকটি ঘাটে ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে ওপরে খোলা চত্বরে বসে নদীর সৌন্দর্য দেখার ব্যবস্থাও রয়েছে।
বিশেষত্ব :-
সংগ্রহে রাখা যেতে পারে মুর্শিদাবাদ সিল্ক, খাগড়ার সুবিখ্যাত কাঁসার বাসন। আর চাখতে ভুল করলে চলবেনা লালবাগের প্রসিদ্ধ ছানাবড়া ও পোস্তদানাদছড়ানো ক্ষীরকদম। মুর্শিদাবাদে গ্রামের মাটির গন্ধমাখা আলকাপ গানের আসর বসে বিভিন্ন জায়গায়, মূলত বিশ্বকর্মা পুজো থেকে কার্তিকপুজো অবধি। তবে গ্রামের দিকে গেলে গান শুনে আসা যাবে সবসময়েই।
~ মুর্শিদাবাদের আরও ছবি ~ গৌড়ের আরও ছবি ~
শীলা চক্রবর্তীর জন্ম বাংলাদেশের খুলনায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের স্নাতক। মহাত্মা গান্ধী বিশ্ববিদ্যানলয় থেকে অপরাধ আইনে স্নাতকোত্তর। প্রয়াগ এলাহাবাদ সঙ্গীত একাডেমি থেকে ধ্রুপদী সঙ্গীতে স্নাতক। পেশায় আইনজীবী। ভালবাসার জায়গা গান, কবিতা, নাটক, লেখালিখি। বেড়াতে ভালবাসেন। দীর্ঘদিন ধরে লেখালিখির যুক্ত রয়েছেন। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়।