পুরীঃ বার্ধক্যের বারাণসী
তপন পাল
প্রস্তাবনা
আমার জন্ম ১৯৫৯-এর জানুয়ারিতে। ২০১৯-এ আমার ষাট পূর্ণ হল। ৩১ জানুয়ারি অফিস থেকে ফেরার পথে দপ্তরের গাড়ি ছেড়ে দিয়ে নিজের গাড়িতে ফিরছিলাম। শীতের দিন; সন্ধ্যাকেই মনে হয় নিশুতি রাত। বাইপাস দিয়ে ফিরতে ফিরতে; ১৯৮০ থেকে ২০১৯ – এক দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর যাত্রার পরিসমাপ্তিতে - নিজেকে ভারমুক্ত ও স্বাধীন মনে হচ্ছিল। মনে পড়ল, স্ত্রীর পত্রের মৃণাল তাঁর চিঠি শেষ করেছিলেন 'তোমাদের চরণতলাশ্রয়ছিন্ন' লিখে। তাঁর আত্ম-আবিষ্কারের,আত্ম-উন্মোচনের সেই শুরু। ঊনচল্লিশ বছর পর আমারও নিজেকে লাগল নিয়োগকর্তার 'চরণতলাশ্রয়ছিন্ন' – এইবার আমারও নিজেকে খুঁজে ফেরার পালা!
মৃণাল লিখেছিলেন 'তোমাদের গলিকে আর আমি ভয় করি নে। আমার সম্মুখে আজ নীল সমুদ্র,আমার মাথার উপরে আষাঢ়ের মেঘপুঞ্জ। তোমাদের অভ্যাসের অন্ধকারে আমাকে ঢেকে রেখে দিয়েছিলে।' সত্যিই তো,মৃণাল তো পুরী গিয়েছিলেন! আমিও তো যেতে পারি!! স্ত্রীর পত্রের রচনাকাল শ্রাবণ ১৩২১; একশো চার বছর আগে। এই একশো চার বছরে বিশেষ কিছুই তো বদলায়নি - সমুদ্র সেই একরকমই আছে।
আমাদের পরিবারের রেওয়াজ হল বাড়ির সুখদুঃখের সব খবর - জন্ম, পরীক্ষা পাশ, চাকুরি প্রাপ্তি, বিবাহ...,শ্রীজগন্নাথ ও তদীয় ভ্রাতাভগিনীদের সশরীরে জানানো। আমার পুত্রের বিবাহ বা আমার পৌত্রীর অন্নপ্রাশনের সময় পারিবারিক হিতৈষী শ্রীজগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রা দেবীকে নিমন্ত্রণপত্র আমিই দিয়ে এসেছিলাম; রাহাখরচসমেত। শ্রীজগন্নাথকে বলতে হয় অমুক দিনে আমার বাড়ি কাজ, অনেক লোকজন আসবে; তুমি একটু সকাল সকাল গিয়ে দেখাশোনা করো যেন কোনো গণ্ডগোল না হয়,সবকিছু ভালোয় ভালোয় মেটে। নির্দিষ্ট দিন ভোরবেলায় আমাদের পারিবারিক পাণ্ডামহারাজ মন্দিরে গিয়ে দীপ জ্বেলে শ্রীজগন্নাথকে সে কথা স্মরণ করিয়ে দেন। আমাদের বাড়িতে ওইদিন তিনটি নিরামিষ 'মিল' রান্না হয় ওনাদের জন্য।
সেইজন্যেই যখন কাগজে পড়লাম যে মুকেশ আম্বানি শ্রীজগন্নাথকে মেয়ের বিয়ের কার্ড দিতে গেছেন, এবং বলেছেন যে এটি তাদের পারিবারিক রীতি, আশ্চর্য হয়েছিলাম। শ্রী আম্বানি ও আমার মধ্যে এত মিল! আমরা দুজনে প্রায় সমবয়সী, বছর দুয়েকের ছোটবড়, আমাদের দুজনেরই পিতা প্রয়াত হয়েছেন ২০০২ এর বর্ষায়; শুধু আমার পিতা যদি ওঁর পিতার মত কিছু রেখে যেতে পারতেন! আর অবসরের খবরটাও তো শ্রীজগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রা দেবীকে দেওয়া দরকার!!
হাওড়া থেকে রাত সাড়ে দশটার সাবেকি হাওড়া-পুরী এক্সপ্রেস ধরে পরদিন সকালে পুরী: এমনটাই ইচ্ছে ছিল। অনেক অনেক বছর আগে, ধরণী যখন তরুণী ছিলেন, পুরীর সব হোটেলে চেক-ইন ছিল চব্বিশ ঘণ্টা অর্থাৎ সারাদিনে যখনই তুমি হোটেলে ঢুকবে, পরদিন সেই সময় অবধি একদিন বলে গণ্য হবে। তখন কলকাতা থেকে পুরী যাতায়াতের দুটি মাত্র রেলগাড়ি, হাওড়া-পুরী এক্সপ্রেস আর হাওড়া-পুরী শ্রীজগন্নাথ এক্সপ্রেস (হাওড়া-পুরী প্যাসেঞ্জারকে আমি সযত্নে এই হিসাবের বাইরে রাখছি)। তারা দুজনেই পুরী পৌঁছায় সকালে,পুরী ছাড়ে রাতে। দিব্যি চলছিল; তারপর রেলগাড়ির সংখ্যা,বিশেষত দিনের রেলগাড়ির সংখ্যা বাড়তে পুরীর সব হোটেলেই এখন চেক ইন সকাল সাতটা-আটটা নাগাদ। তাই এই রেলগাড়িটিই পছন্দের; দুরন্ত বা শ্রীজগন্নাথ পুরী পৌঁছান কাকভোরে; হোটেলে পৌঁছে লাউঞ্জে বসে থাকতে হয়। কিন্তু বিস্তর চেষ্টাচরিত্র করেও বাতানুকূল দ্বিতীয় শ্রেণিতে দুটি নিচের শয্যা যোগাড় করা গেল না।
অগত্যা উড়োজাহাজ। সেখানে চাইলেই পছন্দমত আসন পাওয়া যায়।
প্রথম দিন
সাতটা কুড়ির ইন্ডিগো,উড়ান সংখ্যা ৬ই ৩৭৫,বিমানপোত এয়ারবাস এ৩২০ গোত্রের,পুরী যাওয়ার জন্য এই উড়ানটি আমার ভারি পছন্দের। এক ঘণ্টায় ভুবনেশ্বর, পুরীর আমাদের পরিচিত সারথিটিকে বলা ছিল, তিনি রথ নিয়ে আমাদের প্রতীক্ষায় ছিলেন। হুশ করে দুঘণ্টায় আমরা পুরীতে, দেরি একটু হল, কারণ শ্রীমতী পাল সাক্ষীগোপাল মন্দিরে দাঁড়িয়েছিলেন।
উপকূলীয় ওড়িশার মন্দিরসমূহের পরিচালকদের দুর্বৃত্তায়ন নিয়ে কোনদিন যদি রাশভারী গবেষণাপত্র লেখা হয়, তবে তার শীর্ষের নামটি যে এই মন্দিরের হবে, তাতে আমার সন্দেহ নাস্তি। মন্দিরে ঢুকতে হলে টাকা পয়সা, ঘড়ি আংটি, হার দুল সবই খুলে গাড়িতে রেখে যেতে হয়। কিন্তু না এসেই বা উপায় কী! মন্দিরটি পুরী যাওয়ার পথে, তা সে সড়কপথে, রেলপথে বা বিমানযোগে, যেভাবেই যান না কেন! আর শ্রীক্ষেত্র অবস্থিতিতে তথা শ্রীজগন্নাথ দর্শনে যে পুণ্য অর্জিত হয়, তার হিসাব রাখেন ইনি। আপনি যে পুরী যাওয়ার নাম করে পুরীতেই গিয়েছিলেন, গোয়া বা ব্যাংককে নয়, শেষের সেদিনে সেই সাক্ষ্য দেবেন ইনি, তাই ইনি সাক্ষীগোপাল। সাক্ষীগোপাল অদর্শনে শ্রীজগন্নাথদর্শন অসম্পূর্ণ থাকে বলেই জনবিশ্বাস।
এবার একটু গালগল্প করা যাক। কবে কোন সুদূর অতীতে এক ব্রাহ্মণ পরিচারককে নিয়ে বৃন্দাবন যান তীর্থভ্রমণে। তথায় গিয়ে গুটিবসন্তে আক্রান্ত হন। পরিচারকটি সেবাশুশ্রূষা করে তাঁকে বাঁচিয়ে তোলে প্রতিদানে কৃতজ্ঞ ব্রাহ্মণ তাঁর রূপবতী কন্যার সঙ্গে পরিচারকের বিবাহের প্রতিশ্রুতি দেন। গ্রামে ফিরে সেই প্রতিশ্রুতি পালন করতে গেলে রক্ষণশীল সমাজের বাধা আসে। ব্রাহ্মণকন্যার সঙ্গে শবরসন্তানের বিবাহ হয় কী করে! শাস্ত্রে অনুলোম, অর্থাৎ উচ্চবর্ণের পুরুষের সঙ্গে নিম্নবর্ণের নারীর বিবাহের সংস্থান আছে, কিন্তু প্রতিলোম, অর্থাৎ নিম্নবর্ণের পুরুষের সঙ্গে উচ্চবর্ণের নারীর বিবাহ নৈব নৈব চ। দীন ব্রাহ্মণ বলেন, কিন্তু আমি যে কথা দিয়েছি। গ্রামের মুরুব্বিরা পাল্টা প্রশ্ন তোলেন, কোন্ সাক্ষী আছে তার!
কথা রাখতে ব্রাহ্মণ পুনরায় বৃন্দাবনে, মদনগোপালকে নিবেদন করেন তাঁর দুর্গতি। কথা দিয়ে কথা না রাখার পাপ অতীব গুরুভার। ভক্তকে সেই পাপ থেকে রক্ষা করতে মদনগোপাল ওড়িশা যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন; শর্ত, ব্রাহ্মণ আগে আগে যাবেন, মদনগোপাল পিছনে এবং কোনো অবস্থাতেই ব্রাহ্মণ ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে দেখবেন না।
পথ চলা শুরু, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। ব্রাহ্মণ শুনতে পান নিক্কণ, বুঝতে পারেন মদনগোপাল তাঁর অনুবর্তী। সহসা একদিন নিক্কণধ্বনি স্তব্ধ; কারণ বালুকাবেলায় পা বসে যাচ্ছে, নিক্কণধ্বনি হবে কী করে? তবে ব্রাহ্মণ বুঝতে পারেননি, সংশয়ে ঘাড় ঘোরাতেই মদনগোপাল প্রস্তরীভূত। বললেন আমি আর যাবোনা, তোমার গ্রামের লোকজনদের এখানেই ডেকে আনো, সাক্ষ্য দেবো। সেই থেকে সাক্ষীগোপাল, সাক্ষ্যপ্রদানকারী মদনগোপাল। আদতে উত্তরভারতের দেবতা বলেই সম্ভবত এখানকার ভোগ পুরোটাই গোধূমজাত, ধান্যজাত নয়; বিষ্ণুমন্দিরের রীতিঘরানায় যা এক বিরল ব্যতিক্রম।
গল্পটি আদতে সামাজিক উত্তরণের। ব্রাহ্মণকন্যা বিবাহ করে শবরবালকটি ব্রাহ্মণত্ব অর্জন করেন ও নব্যস্থাপিত মন্দিরের পূজারীর পদে বৃত হন। তাঁর বংশধররা আজও ওই মন্দিরের সেবাইত।
অবশেষে পুরী; নিম্নবিত্ত বাঙালির আনন্দ নিকেতন, তার সব পেয়েছির দেশ, তার স্বতঃস্ফূর্ততার উৎসমুখ। পুরীতে আমার পথে পথে পাথর ছড়ানো; পাথর স্মৃতি অর্থে। বিবাহোত্তর চৌত্রিশ বছরে এতবার এসেছি, তার স্মৃতি আক্ষরিক অর্থেই পথে পথে ছড়ানো। পথ চলতে চলতে শ্রীমতী পাল হুট করে দাঁড়িয়ে গেলেন,'মনে আছে,সেই একবার বৃষ্টি এলো, আমরা এইখানে দাঁড়িয়েছিলাম', বা 'মনে আছে, এই দোকানে একবার তুমি চা শেষ করে গেলাসের নিচে মরা মাকড়সা পেয়েছিলে', বা 'মনে আছে, এই হোটেলে আমরা একবার প্রচণ্ড ঝাল মাংস খেয়েছিলাম।'
অবস্থিতি সেই সৈকতলগ্না শতাব্দীপ্রাচীন হোটেলে। তাঁরা মহার্ঘ একটি ঘর আমাদের জন্যে রেখে দিয়েছিলেন। ঘরে ঢুকেই বিছানায়; উফ, ঠিক এইরকমই একটা জীবন তো চেয়েছিলাম; নির্দায়, নির্ভার। যেখানে নিজের মত করে বাঁচতে পারবো, দিবারাত্র পেটের চিন্তায় দিন যাবে না। আমার পিতা যদি আমার জন্য পাঁচশো বিঘা ধানজমি রেখে যেতে না পারেন, সেটি তাঁর ব্যর্থতা; আমাকে তার দায় টেনে জীবনের শ্রেষ্ঠ উনচল্লিশটা বছর গাধার খাটুনি খাটতে হবে কেন? অবসরের প্রাক্কালে কিছু শুভানুধ্যায়ী অবসরোত্তরকালীন একটি চাকরির প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন। শুনে মর্মাহত হয়েছিলাম। এনারা আমাকে কি ভাবেন! আমি কি চটকলের বদলি শ্রমিক? অর্ধেক বেতনে ঠিকে কাজ করতে যাব কেন?
স্নানাহারান্তে ভোঁসভোঁস করে নিদ্রা। কতদিন দুপুরে ঘুমোইনি গো! ঘুম থেকে উঠে, ঘরেই চা বানিয়ে খেয়ে দুজনে একসঙ্গে বেরোলাম; যদিও গন্তব্য আলাদা। শ্রীমতী পাল যাবেন মন্দিরে, ধ্বজা পরিবর্তন দেখতে; এবং যথেষ্ট আগে না গেলে পছন্দসই বসার জায়গা পাওয়া যাবে না। আমি যাবো স্বর্গদ্বার থেকে সৈকত ধরে পশ্চিমে অনেকখানি হেঁটে মোহনা। রঘুরাজপুরের কাছে ভার্গবী নদী থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে ধউদিয়া নদী সেখানে সমুদ্রসন্নিধানে। তিনি এতই হ্রস্ব যে ভূগোলবইয়েও তার নাম নেই। ভার্গবী নিজেও খুব একটা বড় নদী নয়, কুয়াখাই নদী থেকে নির্গত হয়ে চিলিকায় তার পথ চলার সমাপ্তি। নির্জন মোহনায় হাঁটুজলে নেমে ঝিনুক কুড়োতে আমার ভারী ভালো লাগে। তবে কুড়ানোর শেষে তাদের আবার সমুদ্রেই ফিরিয়ে দিই। ১৯৮৬ থেকে যিনি প্রতিবছর পুরী যাচ্ছেন, এবং ২০১৩ থেকে প্রতি মাসে, তিনি যদি কুড়ানো সব ঝিনুক বাড়ি আনেন তাহলে বাড়িতে ঝিনুকদের রেখে বাড়ির লোকগুলিকে হিমালয়ে যেতে হয়।
সেখানে ঘন্টাখানেক কাটিয়ে মন্দিরে, শ্রীমতী পাল সন্নিধানে। ধ্বজা পরিবর্তন পুরী মন্দিরের একটি রীতি। মন্দিরের শীর্ষে ছত্রিশ ফুট পরিধির অষ্টধাতুর বিষ্ণুচক্র, নীল আভাসের জন্য তার আর এক নাম নীলচক্র; শ্রীজগন্নাথ যে শ্রীমন্দিরেই আছেন লোককে তা জানাতে মন্দির প্রতিষ্ঠাকাল থেকে প্রতিদিন অপরাহ্ণে এক সেবক মন্দিরের চুড়োয় উঠে সেখানে নতুন কুড়ি মিটার দীর্ঘ ত্রিকোণ উজ্জ্বল পীতরাগ কেতন, তাইতে অলক্তরাগে শ্রীজগন্নাথের লোগো, বাঁধেন। প্রতিদিনকার পতাকা প্রতিদিন তৈরি হয়, চোল পরিবারের কোনও সাবালক পুরুষ সদস্য সব নিয়ম মেনে সকালে তা তৈরি করেন। চোল পরিবারের সদস্যরা পুরীর রাজার আদেশে বিগত আটশো বছর করে এই কাজ করে আসছেন; এ কাজে তাদের নিঃসপত্ন অধিকার। প্রতি একাদশীতে সেই সেবকের হাতে থাকে দীপ। নিরানব্বইয়ের সুপার সাইক্লোন বা তেরোর সাইক্লোন ফাইলিং এসেছে, গেছে, ধ্বজা পরিবর্তন তাতে বিঘ্নিত হয়নি। পুরী মন্দির পরিচালনার গাইডবই মদলপঞ্জীতে বলা আছে কোনও কারণে একদিন ধ্বজা পরিবর্তন না হলে প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ আঠারো বছর মন্দির বন্ধ রাখতে হবে।
এই রীতিটি দর্শন নাকি পুণ্যের কাজ। আমি মন্ত্রহীনং ক্রিয়াহীনং ভক্তিহীনং অং বং চং। আমার কাছে ভগবানের চেয়ে মানুষ বেশি কৌতূহলজনক। একটি মানুষ যখন সাবলীল স্বাচ্ছন্দ্যে তরতর করে সুউচ্চ মন্দিরশীর্ষে উঠে যান, তখন দেবতার মাহাত্ন্যের চেয়ে মানুষের ক্ষমতাই আমার কাছে বেশি প্রতীয়মান হয়। তবে হিসাবশাস্ত্রের ছাত্র তো। ভাবতে চেষ্টা করছিলাম পুরীর রাজার আদেশবদ্ধ এই অধিকারের আর্থিক মূল্য আজকালকার বাজারে কত হতে পারে! নামিয়ে আনার পরে মূল পতাকা, অপরাপর পতাকা, এমনকি পতাকাখণ্ডও অতি উচ্চ মূল্যে বিক্রীত হতে দেখলাম।
দ্বিতীয় দিন।
দ্বিতীয় দিন সকালটা কাটলো মন্দিরে,পুজাআর্চায়। হিন্দু দেবলোকের সদস্য-সদস্যারা যুগলে দেখা দিতেই অভ্যস্ত; হর–পার্বতী বা লক্ষ্মী-জনার্দন যেমন। কিন্তু সখা শ্রীজগন্নাথ দেখা দেন ভ্রাতাভগিনী সমভিব্যাহারে। তাহলে একটা গল্প বলি শুনুন।
শ্রীকৃষ্ণ তখন দ্বারকার রাজা, 'অনেক তোমার টাকাকড়ি, অনেক দড়া অনেক দড়ি, অনেক অশ্ব অনেক করী - অনেক তোমার আছে ভবে'। তবু,'বেচারা রাজার ভারী দুখ'। 'দুঃখ কীসে হয়? অভাগার ভাবে জেনো শুধু নয় - যার ভাণ্ডারে রাশি রাশি সোনাদানা ঠাসাঠাসি তারও হয়, জেনো সেও সুখী নয়।।' শ্রীকৃষ্ণের অষ্ট মহিষী; ভাগবৎ পুরাণবর্ণিত রুক্মিণী, সত্যভামা, জাম্ববতী, কালিন্দী, মিত্রবিন্দা, নগ্নজিতী, ভদ্রা, লক্ষণা। তদসত্ত্বেও শ্রীকৃষ্ণ নিদ্রার ঘোরে প্রায়শই রাধা রাধা বলে কেঁদে ওঠেন। ঘুমের ঘোরে আমি কোনও মহিলার নামোচ্চারণ করলে শ্রীমতী পাল নির্দ্বিধায় আমাকে খাট থেকে ঠেলে ফেলে দিতেন। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ জগদ্ধারক, খাটও তাঁর, ভূমিও তাঁর। তাঁকে আর শয্যাচ্যুত করে কে? অথচ মহিষীরা মহাবিব্রত। তাঁরা অস্পষ্ট শুনেছিলেন শ্রীকৃষ্ণের সম্পর্কে মামী, বয়সে বড় বৃন্দাবনের আয়ানপত্নী রাধার কথা। কিন্তু তাঁর নাম শ্রীকৃষ্ণ নিদ্রাঘোরে নেবেন কেন? যুগপৎ বিরক্ত ও কৌতূহলী হয়ে তাঁরা একদিন বলরামমাতা রোহিণীকে ধরলেন। তিনি বৃন্দাবনলীলা দ্বারকালীলা উভয়েরই প্রত্যক্ষ সাক্ষী। কিন্তু সন্তানের ইন্টুমিন্টু বিবৃত করতে কোন্ জননীর ভালো লাগে? রোহিণী রাজি হলেন না। মহিষীরাও নাছোড়বান্দা – বিদগ্ধা সত্যভামার উপর ভার পড়ল রোহিণীকে রাজি করানোর।
অবশেষে জননী রোহিণী রাজি হলেন; তবে ছেলেদের সামনে নয়। বলরাম ও কৃষ্ণ যখন রাজসভায় রাজকার্যে ব্যস্ত থাকবে সেই মধ্যাহ্নসময়ে রোহিণীমাতা পুত্রবধূদের গল্প শোনাবেন। রোহিণীমাতা গল্প শুরু করলেন। পাছে বলরাম কৃষ্ণ এসে পড়ে তাই সুভদ্রাদেবীকে দাঁড় করালেন দরজা পাহারা দিতে।
সুভদ্রা দুয়ারে বসে আছেন,রোহিণীমাতা বলছেন বৃন্দাবনের দাস্য সখ্য বাৎসল্য মধুর রসের সেই অপূর্ব লীলাকথা; মহিষীরা মগ্নআকুল হয়ে শুনছেন। রাধানামের এমত মহিমা যে বলরাম ও কৃষ্ণও আর রাজসভায় বসে থাকতে পারলেন না। শ্রীকৃষ্ণ নিজেই বলেছেন 'নাহং তিষ্ঠামি বৈকুন্ঠে যোগীনাংহৃদয়ে ন চ। মদভক্তাঃ যত্র গায়ন্তি তত্র তিষ্ঠামি নারদ।।" আমি যোগীদের হৃদয়েও থাকি না,বৈকুন্ঠেও থাকি না' আমার ভক্তরা যেখানে আমার লীলাকীর্তন করে সেখানেই আমি থাকি। তাঁরা রাজকার্য ছেড়ে চলে এলেন ব্রজকথা শুনতে। সুভদ্রাদেবী তাঁদের পথ আটকালেন। সুভদ্রাদেবীর দুদিকে দুভাইয়ে দাঁড়িয়ে দরজা থেকেই তাঁরা ব্রজকথা শুনতে লাগলেন। বারোজনেই রাধাকথায় বিহ্বল। শুনতে শুনতে,ফেলে আসা সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ায়,দুভাইয়েরই ভাব উপস্থিত হল,দেখাদেখি সুভদ্রাদেবীরও। তাঁদের চোখ বড় বড় হয়ে উঠল, ঘনঘন নিশ্বাস পড়তে লাগল, মাথা সামনের দিকে ঝুঁকে গেল। দের্বষি নারদ,ওই কাজকাম না থাকলে যা হয় আর কি,ঘুরতে ঘুরতে তখন ওইখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি কাণ্ডকারখানা দেখতে দাঁড়িয়ে গেলেন। ক্রমে গল্প ফুরালো, নটেগাছটিও মুড়ালো। সব আবার আগের মত হয়ে গেল। শ্রীকৃষ্ণ বিস্মিত হয়ে বললেন- নারদ তুমি এখানে কি করে গো! নারদ তখন গদ্গদ,'আহা! কী দেখিলাম! জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না৷' ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রভু,তোমরা ভাইবোনে এবার থেকে এই রূপেই ভক্তদের দেখা দিও। আর জানেনই তো! ভগবান আবার ভক্তদের কথা ফেলতে পারেন না। ভক্তদের তিনি এতটাই ভালোবাসেন যে নিয়ম করেছেন পুরীতে অভুক্ত থেকে বিগ্রহ দর্শন করা অকাম্য। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের তৃতীয় অধ্যায়ে একটি মজার কথা আছে। অপাণিপাদো জাবানো গ্রহীতাপশ্যত্যচ ক্ষুঃ স শৃণোত্যকর্নঃ। স বেত্তি বেদ্যং ন চ তস্যাস্তি বেত্তাতমাহুরগগ্র্যং পুরুষং মহান্তম্।। - তাঁর লৌকিক হস্ত নাই,অথচ তিনি সকল দ্রব্য গ্রহণ করেন। তাঁর পদ নাই অথচ সর্বত্রই চলেন। তাঁর চোখ নাই অথচ সবই দেখেন। কান নাই কিন্তু সবই শোনেন।
বিলম্বিত প্রাতরাশের পর সমুদ্রের সম্মুখে কুড়ি টাকা ঘণ্টা দরে চেয়ার ভাড়া নিয়ে বসা; দুপুরে খেয়ে ঘুম। শ্রীজগন্নাথ মন্দির ছাড়াও পুরীতে ছোট বড়, প্রধান অপ্রধান, শাক্ত শৈব, বৈষ্ণব গাণপত্য হাজার মন্দির ছড়িয়ে। তীর্থস্থানরূপে পুরীর ক্রমবিকাশ ও সর্বজনগ্রাহ্যতা এবং শহরটির চরিত্র বুঝতে হলে সেগুলিতে একবার করে ঢুঁ মারা অত্যাবশ্যক। অপরাহ্ণে অটোয় চেপে সেই কাজে বেরিয়ে পড়া গেল।
হাসপাতাল থেকে পুরী ভুবনেশ্বর রোড ধরে আঠারোনালা সেতুর দিকে যেতে বাঁয়ে, কুমোরপাড়া এলাকায় পূর্বমুখী অলমচণ্ডী মন্দির। এই চতুর্ভুজা দুর্গাদেবী অদিশিয় অষ্টচণ্ডীর (বটমঙ্গলা,বিমলা,সর্বমঙ্গলা,অর্ধসানি,অলম্ব,দক্ষিনাকালিকা,মরীচি ও হরচণ্ডী) অন্যতমা। মন্দিরটি আকারে ছোট হলেও গুরুত্বে বড়, নবকলেবরের আগে শ্রীজগন্নাথ মূর্তি নির্মাণার্থে নীত গাছের গুঁড়িভর্তি গরুর গাড়ি এই মন্দিরের সমুখের রাস্তা দিয়েই আনা হয়। পুরীর রাজা গজপতি ও সাধু সন্ন্যাসীরা এই মন্দিরে সমবেত হয়ে সেই দারু গ্রহণ করেন। শ্রীজগন্নাথ মন্দিরের সপ্তপুরী পূজানুষ্ঠানের সঙ্গেও এই মন্দির জড়িত। সপ্তপুরী অমাবস্যার দিন শ্রীজগন্নাথমন্দির থেকে সপ্তপুরীকে এই মন্দিরে ভোগ খেতে পাঠানো হয়। মন্দির অভ্যন্তর দশমহাবিদ্যার ম্যুরালশোভিত, প্রবেশপথে নবগ্রহ।
অষ্টচণ্ডীর মতই আছেন অষ্টশম্ভু, এনারা শ্রীজগন্নাথদেবের অভিভাবক। পুরী শহরের আট দিকে বসে তাঁরা শহরকে ও শহরের অধিবাসীদের সম্ভাব্য সকল বিপদ থেকে রক্ষা করছেন। এঁরা হলেন মার্কণ্ডেশ্বর, যজ্ঞেশ্বর, নীলকণ্ঠেশ্বর, বিল্বেশ্বর, কপালমোচন, বালেশ্বর, ঈশানেশ্বর ও পাতালেশ্বর। কলিঙ্গধাঁচের ধূসর বেলেপাথরের অষ্টচণ্ডীর ছোট মন্দিরটি দশম শতকের, গোপীনাথপুরের তিয়াদিসাহি এলাকায়, নানাবিধ উপরত্নের আটরঙের আটটি শিবলিঙ্গ; কাছে একটি গণেশ মন্দির। এই মন্দিরটিতে এখন আর পূজার্চনা হয় না।
হরচণ্ডীসাহিতে যমেশ্বর মন্দির রাস্তা থেকে অনেকখানি নিচে, দুঃসাধ্য সিঁড়ি ভেঙে নামতে হয়, এবং উঠতে। অতি পুরানো মন্দির, খুব একটা জনপ্রিয় নয়। এমনিতেই নাম যমেশ্বর, লোকবিশ্বাসে মহারাজ যম ও তদীয় দূতদের এখানে ঘোরাফেরা। পারিপার্শ্বিকের পরিবেশও কিঞ্চিৎ ভুতুড়ে – মাটি থেকে অনেকখানি নিচে হওয়ায় কেমন গা ছমছম ভাব – লোকে তাই এই মন্দির এড়িয়ে চলে।
যমেশ্বর মন্দিরের পশ্চিমে অলাবুকেশ্বর। স্বয়ং রামচন্দ্র নাকি এখানে লাউ দিয়ে পুজা দেওয়ার প্রচলন করেন। অদ্যাবধি মহিলারা সন্তানকামনায় এখানে লাউ দিয়ে পূজা দেন। অলাবুকেশ্বর মন্দিরের পাশেই কপালমোচন মন্দির। পবিত্র মণিকর্ণিকা কুণ্ড তার গায়েই। সেখানে লোকনাথ মন্দির। এই লোকনাথ ব্যক্তি লোকনাথ নন, শিব লোকনাথ। ইনি, জানা গেল, আরোগ্যদায়ী।
অর্ধসানি বা মাসিমা মন্দিরটি বড়রাস্তার উপরেই। রথযাত্রার সময় শ্রীজগন্নাথ ভ্রাতাভগ্নী সমভিব্যাহারে শ্রীমন্দিরের পূর্বদ্বার থেকে যাত্রা শুরু করে গ্র্যান্ড রোড ধরে গজপতি রাজপ্রাসাদের পাশ দিয়ে তাঁর মাসির বাড়ি গুন্দিচা মন্দিরে যান। এই যাত্রাপথের ঠিক মাঝখানে,বাঁহাতে,অর্ধসানি বা মাসিমা মন্দির। ইনি শ্রীজগন্নাথ ও তদীয় ভ্রাতাভগ্নীদের আর এক মাসি; গরিব মাসি, তাই শ্রীজগন্নাথ তাকে অতিথিপরিচর্যার দায়ে বিড়ম্বিত করতে চান না। তাঁর বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় ক্ষণিকের যাত্রাবিরতি করেন; গরিব মাসিমাও রাজা বোনপোর আগমনে পরমপ্রীতা হয়ে তাঁকে পোড়া পিঠে খাওয়ান।
আঠারোনালা সেতুটি পুরীর কতিপয় ধর্মসম্পর্কহীন দ্রষ্টব্যের একটি। অদিশার সংস্কৃতি ও স্থাপত্যের ইতিহাস শহরে ঢোকার মুখের এই সেতুটির প্রতিটি ইটে বিবৃত। পঁচাশি মিটার লম্বা ও এগারো মিটার চওড়া সেতুটি মন্দুপুর জলধারার উপর গঙ্গারাজ বংশের রাজা ভানুদেব কর্তৃক নির্মিত ত্রয়োদশ শতকে। আঠারোটি খিলান সাত থেকে ষোলো ফুটের ব্যবধানে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আজও শহরবাসীর দৈনন্দিন পরিবহনের দাবি মেটাচ্ছে। এই সেতুর পাশের একটি বিন্দুতে দাঁড়ালে দূরের শ্রীমন্দিরের চূড়া দেখা যায়। চৈতন্যদেবের শ্রীক্ষেত্রবাসের প্রথম পর্যায়ে, যখনও তিনি শ্রীমন্দিরে প্রবেশাধিকার পাননি, তিনি নাকি এখানে দাঁড়িয়ে দূরের শ্রীমন্দিরের চূড়া দেখতেন, দেখে আকুল হতেন। হা কৃষ্ণ করুণাসিন্ধু দীনবন্ধু জগৎপতে। গোপেশ গোপিকাকান্ত রাধাকান্ত নমোস্তুতে।
শহরের উপকন্ঠে, জাতীয় সড়কের ওপরে ত্রয়োদশ শতকের বটমঙ্গলা মন্দির। আদিপিতা ব্রহ্মা একবার নাকি বিপুল শূন্যতার মাঝে ঘোর অন্ধকারে জ্ঞান হারিয়েছিলেন। তখন মা মঙ্গলা তাঁকে হাত ধরে শ্রীজগন্নাথের কাছে নিয়ে যান। ব্রহ্মা জ্ঞান ফিরে পেয়ে ব্রহ্মান্ডসৃষ্টিতে মনোনিবেশ করেন। ওড়িয়া ভাষায় বট শব্দের অর্থ পথ। বটমঙ্গলা অর্থাৎ পথের দেবী। ১৮৯৭-এ পুরী রেলস্টেশন চালু হওয়ার আগে পর্যন্ত পুরী যাওয়ার পথ ছিল কলকাতা–পুরী জগন্নাথ সড়ক। চৈতন্যদেব, নানক, কবীর এই পথ দিয়েই জগন্নাথদর্শনে গিয়েছিলেন। সেই যুগে পুণ্যার্থীরা শহরে ঢোকার আগে এই মন্দিরে পুজো দিতেন, দিয়ে শ্রীজগন্নাথ দর্শনে যেতেন। নবকলেবরের সময় মূর্তিনির্মাণকল্পে গাড়িভর্তি নিমকাঠ মন্দিরে আনা হয়। সেই গাড়িগুলি যাত্রাবিরতি করে এই মন্দিরে। পাশ ও অঙ্কুশধারিণী দ্বিভুজা দেবী ত্রিনেত্রা, পদ্মাসনা, স্মিতবদনা; সঙ্গে দশমহাবিদ্যা। নিচু ছাদের ছোট মন্দিরটি ভারি জমজমাট। মাথা নিচু করে ঢুকতে হল। মন্ত্রোচ্চারণ আর ঢোকার মুখে ঝোলানো অসংখ্য পেতলের ঘন্টার সম্মিলিত ধ্বনি, ধূপধোঁয়া-ফুলমালা...
মা বনদুর্গা রয়েছেন মনিকর্ণিকা সাহি রোডে; সেখান থেকে সৈকত সমান্তরাল যে রাস্তাটি পুর্বে বিস্তৃত তার নাম চক্রতীর্থ রোড। চক্রতীর্থ একটি ছোট পুকুর,তবে মাহাত্ম্যে বড়।.কাছাকাছি সোনার গৌরাঙ্গ মন্দির,তার উত্তরে চক্রনারায়ণ মন্দিরে শোভা পাচ্ছেন লক্ষ্মী-নৃসিংহ। চক্রনারায়ণ মন্দিরের পশ্চিমে দারিয়া মহাবীর মন্দিরে বসে আছেন হনুমানজি।
নরেন্দ্র সরোবরের গায়ে চারা গণেশ বসে আছেন। শ্রীজগন্নাথমন্দির নির্মাণপ্রারম্ভকালে সিদ্ধিদাতা ও বিঘ্নবিনাশক গণেশদাদার পুজার সূত্রপাত। সেই অর্থে ইনি অতিপ্রাচীন। বালুকাময় পুরীতে মস্ত পাথর খুব সুলভ নয় ফলে মনে করা যেতেই পারে যে প্রস্তরখণ্ডগুলিকে দূর থেকে আনা হয়েছিল এবং জলপথে – চিলিকা হয়ে অথবা মহানদী হয়ে নরেন্দ্র সরোবরে। ওড়িয়ায় চারা শব্দের অর্থ ফাঁস। প্রস্তরখণ্ডগুলি সম্ভবত ফাঁস বেঁধে ওপরে তোলা হত,এখনও রথযাত্রার সময় শ্রীজগন্নাথকেও ওমনিভাবেই তোলা হয়।
বালিসাহিতে পূর্বমুখী দক্ষিণাকালিকা মন্দিরে চতুর্ভুজা দক্ষিণাকালিকা মাতা শবারূঢ়া, রুধিরপানরতা। ইনি প্রভূত দাক্ষিণ্যময়ী এবং শ্রীমন্দিরের গর্ভগৃহের অধ্যক্ষা।
শ্রীজগন্নাথের মাসির বাড়ি গুন্দিচা মন্দির সুন্দরচালা এলাকায়। লোকবিশ্বাসে সুন্দরচালা বৃন্দাবনসম, এবং নীলাচল, শ্রীজগন্নাথমন্দির যেখানে,দ্বারকাসম। এটি শ্রীজগন্নাথের বাগানবাড়ি রূপেও খ্যাত, কারণ প্রাচীরবেষ্টিত মন্দিরটির অভ্যন্তরে সযত্নলালিত চমৎকার উদ্যান। ধূসর বেলেপাথরের কলিঙ্গ দেউলস্থাপত্যের মন্দিরটিতে চারটি অংশ – বিমান (মূলমন্দির), জগমোহন (দর্শনার্থীদের দাঁড়াবার জায়গা), নাটমণ্ডপ (উৎসব, আচার প্রতিপালনের স্থান) ও ভোগমণ্ডপ; সেখান থেকে একটি সরু পথ দিয়ে গিয়ে রান্নাঘর। গুন্দিচা রাজা ইন্দ্রদুম্ন্যের মহিষী, তিনিই এই মন্দির নির্মাণ করিয়েছিলেন। মতান্তরে গুন্দিচা গুটিবসন্তের স্থানীয় লৌকিক দেবী। শ্রীজগন্নাথ এই মন্দিরে পশ্চিমদ্বার দিয়ে প্রবেশ করেন ও পূর্বদ্বার দিয়ে নির্গত হন। রথযাত্রার নয়দিন ব্যতিরেকে সারা বছর মন্দিরটি ঘুমিয়ে থাকে, এবং এখানকার পাণ্ডা মহারাজরা টাকাপয়সার জন্য দর্শনার্থীদের চূড়ান্ত অপদস্থ করতে থাকেন। শ্রীজগন্নাথমন্দিরের সেবাইতরা দইতা, কিন্তু এখানে ব্রাহ্মণরাই মন্দির পরিচালনা করেন। রথযাত্রার পূর্বদিন থেকে পুনর্যাত্রা অবধি, এই দশদিন এই মন্দির জেগে ওঠে, গুন্দিচা মার্জনা (চৈতন্যদেব প্রবর্তিত রথযাত্রার পূর্বদিন), হেরা পঞ্চমী (রথযাত্রার পঞ্চম দিন), দক্ষিণ মোড় (রথযাত্রার ষষ্ঠ দিন), রাসলীলা (রথযাত্রার ষষ্ঠ থেকে নবম দিন), সান্ধ্যদর্শন (পুনর্যাত্রার পূর্বদিন) ইত্যাদি নানাবিধ অনুষ্ঠান হয়। শ্রীচৈতন্যদেব নাকি এই মন্দিরেই অপ্রকট হয়েছিলেন, এবং কথা দিয়েছিলেন যে প্রতি বছর রথযাত্রায় তিনি গুন্দিচা মন্দিরে অবতীর্ণ হবেন। সেই বিশ্বাসে বঙ্গীয় বৈষ্ণবরা রথযাত্রায় দলে দলে এই মন্দিরে আসেন। 'অদ্যপি সেই লীলা করে গোরা রায়, কোন কোন ভাগ্যবানে দেখিবারে পায়।'
গুন্দিচা মন্দিরের পাশেই দশাবতার মন্দির। অক্লেশ-কেশব, মুগ্ধ-মধুসূদন, স্নিগ্ধ-মধুসূদন-এর কবি জয়দেব নাকি এখানে থাকতেন। গুন্দিচা মন্দিরের পশ্চিমে সিদ্ধ মহাবীর হনুমানের ছোট মন্দির। কবি তুলসীদাস নাকি এখানে থাকতেন।
গুন্দিচা মন্দিরের প্রাকারের উত্তরপূর্বে ত্রয়োদশ শতকের নরসিংহ মন্দির; পুরীর সর্বাপেক্ষা প্রাচীন বৈষ্ণব ধর্মস্থানরূপে খ্যাত। রাজা ইন্দ্রদুম্ন্য নারদমুনির সহায়তায় এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ও একশত অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পন্ন করেছিলেন; তাই এই মন্দিরের আর এক নাম যজ্ঞ-নরসিংহ মন্দির। তবে সাত্ত্বিক বৈষ্ণবজন কিভাবে একশো ঘোড়ার মৃত্যুর কারণ হলেন ও তার জন্য তাঁদের কোনো অনুতাপ অনুশোচনা অপরাধবোধ হয়েছিল কিনা তা জানা গেল না। নরসিংহ হাঁটু মুড়ে বসা, নরসিংহের উপরের ডানহাতে চক্র, উপরের বামহাতে শঙ্খ, নিচের দুইহাত হাঁটুর উপর প্রসারিত। বামে লক্ষ্মীদেবী। বেদীতে গরুড়। এই মন্দির শ্রীজগন্নাথ মন্দিরের সাথে নানা ক্রিয়াকলাপে সম্পৃক্ত। শ্রীজগন্নাথকে প্রদত্ত মালা, ফুল এই মন্দিরে নীত হয়। নবকলেবরের সময় মূর্তিনির্মাণ প্রক্রিয়ায় এই মন্দিরের সহযোগ থাকে।
শ্রীজগন্নাথ মন্দিরের দু'কিলোমিটার দূরে, দণ্ডিমালাসাহিতে পঞ্চদশ শতকের ষোড়শ ঘাটের নরেন্দ্র সরোবর, জল রাস্তা থেকে প্রায় দশ ফুট নিচে। সরোবরের কেন্দ্রস্থলে শ্রীজগন্নাথদেবের চন্দনমণ্ডপ। সেই সুবাদে চন্দনসরোবর নামে খ্যাত। পুরীর পঞ্চতীর্থের অন্যতম এই সরোবর। বাকিরা হলেন সমুদ্র, গুন্দিচা মন্দিরের নিকটবর্তী ইন্দ্রদ্যুম্ন সরোবর, মণিকর্ণিকা, মার্কণ্ড সরোবর ও শ্বেতগঙ্গা ।
শ্যামাকালীচক থেকে তিয়াদিসাহি যেতে পূর্বমুখী শ্যামাকালীমন্দির। পুরীর সর্বাপেক্ষা প্রাচীন এই কালীমন্দিরে আসীনা চতুর্ভুজা শ্যামাকালী, দশমহাবিদ্যার প্রথমা। চতুর্ভুজা বিমলা ও সর্বমঙ্গলা দেবীর বামে। ইনি পুরীর রাজপরিবারের কুলদেবী, তাই দেবীর বেদীতে রাজচিহ্ন প্রোজ্জ্বল। অদ্যাবধি, পুরীর নতুন রাজা অভিষেকের পর সর্বপ্রথমে এই মন্দিরে আসেন আরাধনার্থে। ল্যাটেরাইটের মন্দিরটি পুরীর রাজপরিবারের প্রত্যক্ষ পরিচালনাধীন।
সপ্তমাতৃকা - ব্রাহ্মী, মহেশ্বরী, অন্দ্রি, কৌমারী, বৈষ্ণবী, বরাহি ও চামুণ্ডা - থাকেন মার্কণ্ড সরোবরে। বৈষ্ণবীয় পুরীতে শাক্ত দেবীদের আধিপত্য মনে করিয়ে দেয় পুরী একান্নপীঠের অন্যতম শাক্ততীর্থ। এখানকার অধিষ্ঠাত্রী দেবী বিমলা, তিনি শ্রীজগন্নাথদেবের জ্যেষ্ঠভ্রাতা বলভদ্রের স্ত্রী,সেইসূত্রে শ্রীজগন্নাথদেবের বৌঠান। অথচ শাক্তমতে বিমলাদেবীর ভৈরব শ্রীজগন্নাথদেব। অদিশার এক বাসচালক বাবুঘাটে আমাকে একবার বলেছিলেন,'জানো তো! একান্নপীঠের মধ্যে চারটে মহাপীঠ।' 'তাই নাকি! কোন কোনটে গো'! 'তোমাদের কালীঘাট, অসমের কামাখ্যা, পুরীর মা বিমলা, আর তারাতারিণী'। 'ও! জানো তো! তারাতারিণী অনেক বছর আগে একবার গিয়েছিলাম,আবার যেতে ইচ্ছে করে,কিন্তু যাওয়া আর হয়ে ওঠে না।' প্রত্যুত্তরে সে এক অদ্ভুত গল্প শুনিয়েছিল। 'জানো! অদিশার সব বাসমালিক,সব বাসকর্মচারী তারাতারিণীর ভক্ত। তোমার পুজো পাঠাবার থাকলে এই বাবুঘাটে এসে,অদিশার যেকোনো বাসড্রাইভারের হাতে নারকোল আর টাকা দিয়ে দেবে। নিশ্চিন্ত থাকো, দশটা বাসড্রাইভারের হাত ঘুরে তোমার পুজো ঠিকই ঠিক জায়গায় পৌঁছে যাবে'।
হরচণ্ডসাহিতে টোটা গোপীনাথের মন্দির, চৈতন্যদেবের অন্তর্ধানরহস্যের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে বাঙালির সর্বাপেক্ষা প্রিয় কন্সপিরেসি থিয়োরির পীঠস্থান। অনেকখানি জায়গা জুড়ে বিস্তৃত অঙ্গন, মস্ত নাটমণ্ডপ, তার ভিতরের দেওয়াল ও ছাদ ফ্রেস্কোশোভিত। বাইরের দেওয়ালে চৈতন্যদেবের জীবনের প্রধান ঘটনাসমূহ ম্যুরালে বিবৃত। টোটা গোপীনাথ মাঝে শোভা পাচ্ছেন,বামে ত্রিভঙ্গা শ্রীরাধিকা বীণাবাদনরতা,দক্ষিণে বংশীবাদিকা ললিতাক্ষী; এবং দুজনেই কৃষ্ণা। বামের বেদিতে শোভা পাচ্ছেন বলরাম, সঙ্গে বামে রেবতী, দক্ষিণে বারুণী। ডাইনের বেদিতে শোভা পাচ্ছেন গৌরাঙ্গদেবের পিতামহ নীলাম্বর চক্রবর্তীর ভ্রাতুষ্পুত্র মামু ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত গৌর-গদাধর ও শ্রীশ্রীরাধা-মদনমোহন। সকাল সাতটায় গেলে, পুরোহিত মশাইকে যথাযথভাবে বলতে পারলে, তিনি আপনাকে গোপীনাথ বিগ্রহের ডান হাঁটুর নিচে একটি স্বর্ণালী দাগ দেখাবেন। মহাপ্রভু ওই ছিদ্রপথে টোটা গোপীনাথ বিগ্রহে বিলীন হয়েছিলেন, এমনটিই জনশ্রুতি। কৃষ্ণবিরহকাতর চৈতন্যদেব কৃষ্ণ-অন্বেষণে মাটি খুঁড়তে আরম্ভ করলে কৃষ্ণ স্বয়ং সেখানে চলে আসেন। চৈতন্যদেব মাটির নিচে পাওয়া বিগ্রহের নামকরণ করেন গোপীনাথ, এবং বাগানের মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল বলে টোটা, উদ্যানের ওড়িয়া প্রতিশব্দ। চৈতন্যদেব গদাধর পণ্ডিতকে ক্ষেত্র সন্ন্যাসপ্রদান করেন, যাতে গদাধর পণ্ডিত ওইখানে বসবাস করে টোটা গোপীনাথের পরিচর্যা করতে পারেন।
গোপীনাথ এখানে দণ্ডায়মান নন, ব্যতিক্রমীভাবে উপবিষ্ট। এ নিয়েও গল্প; আদিতে গোপীনাথ দণ্ডায়মানই ছিলেন, তারপর গদাধর পণ্ডিত কালক্রমে বৃদ্ধ হলেন, তখন তিনি আর দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দণ্ডায়মান গোপীনাথকে মালা পরাতে পারেন না। গোপীনাথ নাকি আবার ভক্তের কষ্ট সইতে পারেন না। তাই,গদাধর পণ্ডিতের সুবিধার জন্য, তিনি ধপ করে বসে পড়লেন।
বিকালে আবার সমুদ্রের সম্মুখে।
তৃতীয় দিন।
আমাদের বিশ্বস্ত সারথির সঙ্গে বেরিয়ে পড়া সকাল সকাল। ঊনবিংশ শতকের বাঙালি যুবক কাজের খোঁজে পশ্চিমে যেতেন। আমার নিজেরই বড়জ্যাঠা ম্যাট্রিক দিয়ে চলে গিয়েছিলেন জামালপুরে, সে আজ থেকে একশো বছর আগের কথা। তারপর সেখানেই প্রবাসী বাঙালি বড়বাবুর মেয়েকে বিবাহ করে সেখানেই স্থিতি। তাঁর ভাইপো আমি, আমারও তাই পশ্চিমে যেতে সাধ।
প্রথম গন্তব্য অলরনাথ। স্নানযাত্রার পর শ্রীজগন্নাথ অসুস্থ হয়ে পড়েন তাঁর জ্বর আসে। রাজবৈদ্য তাঁর চিকিৎসা করেন। অসুস্থতার এই পর্যায়টি 'অনসর'নামে পরিচিত। এই সময় ভক্তেরা দেবতার দর্শন পান না। তাঁদের দর্শনের জন্য বিগ্রহের পরিবর্তে মূল মন্দিরে তিনটি পটচিত্র রাখা হয়। এই সময় ভক্তেরা ব্রহ্মগিরিতে অলরনাথ মন্দিরে যান। তাঁরা বিশ্বাস করেন, অনসরপর্যায়ে জগন্নাথ অলরনাথ রূপে অবস্থান করেন। রাজবৈদ্যের আয়ুর্বৈদিক 'পাঁচন' খেয়ে একপক্ষকালের মধ্যে সুস্থ হয়ে ওঠেন। তারপর তিনি প্রমোদভ্রমণে মাসির বাড়ি যান।
এটি মূলত বিষ্ণুমন্দির। সত্যযুগে, বলা নেই কওয়া নেই, মহর্ষি ব্রহ্মা এখানকার পাহাড়ের উপরে বিষ্ণুর স্তবস্তুতি শুরু করে দেন। বিষ্ণু,ওই আর কি,বার খেয়ে..., মহর্ষি ব্রহ্মাকে তিনি পাহাড়চূড়ায় গরুড়সহ বিষ্ণুমূর্তি স্থাপনের অনুমতি দেন; এই বিষ্ণুমূর্তিই অলরনাথ। মহর্ষি ব্রহ্মা এই পাহাড়ে বিষ্ণুকে তুষ্ট করেছিলেন বলে পাহাড়ের নাম হয় ব্রহ্মগিরি। রাজস্থানের আলোয়ারের রাজা সম্ভবত এই মন্দিরপ্রতিষ্ঠা করেন; সেইসূত্রে বিষ্ণু এখানে আলোয়ারনাথ বা অলরনাথ। প্রথাগত চতুর্ভুজ বিষ্ণুমূর্তি, সঙ্গে গরুড় তো আছেনই, আর আছেন দুই কৃষ্ণজায়া, রুক্মিণী আর সত্যভামা। মন্দিরের পিছনের চন্দনসরোবরে চন্দনযাত্রা হয় বছরে একুশ দিন।
গল্প বলে অনসরকালে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু প্রভু জগন্নাথের দর্শন না পেয়ে আকুল হয়ে পড়েন। শ্রীজগন্নাথ তাকে জানান, অনসরকালে তিনি ব্রহ্মগিরির অলরনাথ মন্দিরে বিশ্রাম করেন। তদনুযায়ী, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এখানে এসে শ্রীজগন্নাথদেবের দর্শন পান। বিগ্রহকে সাষ্টাঙ্গ প্রণামকালে তাঁর করুণায় শিলা বিগলিত হয়, হয়ে দেহচ্ছাপ সেই শিলায় উৎকীর্ণ হয়ে যায়। পাণ্ডামহারাজরা খুব গর্বের সঙ্গে সেই দেহচ্ছাপ দর্শনার্থীদের দেখান; দেখিয়ে দক্ষিণা দাবি করেন। এখানকার ক্ষীরভোগ সত্যিই দেবভোগ্য। পুরীর শ্রীমন্দিরে প্রভু জগন্নাথকে যা যা ভোগ দেওয়া হয়, অনসরকালে অলরনাথজিউকেও তাই তাই ভোগ দেওয়া হয়। অনসরকালে অলরনাথজিউকে দর্শন করলে পাপমুক্ত তো হবেনই,পুনর্জন্মও সম্ভবত আর হবে না।
পুরীর সাতাশ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে, ভার্গবী নদীর মোহনায় একটি বালি পাথরের টিলার টঙে পূর্বমুখিন বলিহারিচণ্ডী বা হরচণ্ডী মন্দির। দেবী এখানে অষ্টভুজা মহিষাসুরমর্দিনী; নাবিক, নৌকা ও মৎসজীবীদের রক্ষয়িত্রী – সোনার বঁটির উপর উপবিষ্টা। মহানবমীর দিন শ্রীজগন্নাথ মন্দিরের পূজা এই মন্দিরে পাঠানো হয়। দেবী নাকি রোজ রাত্রে ঘুরতে বেরোন। বালুকাময় ঢেউখেলানো প্রান্তর, বড় বড় গাছ, লোকালয়হীনতা সেই বিশ্বাসকেই পরিপুষ্ট করে। কিছুটা দূরে কালীমন্দির, খুব কম লোকই সেখানে যান।
যখন লোক এসে গাড়ির পার্কিং ফি চাইল, মন্দির ও তৎসংলগ্ন ভুমির 'ডেভেলপমেন্ট'-এর জন্য, আমি চমকে উঠলাম। আবার 'ডেভেলপমেন্ট'? ওদের উন্নয়নের ধারণা তো সবুজ নষ্ট করে ইট গাঁথা, পর্যটকদের মন যোগাতে গ্রামীণ মানুষের আত্মসম্মানের অবমূল্যায়ন, মন্দিরের এই প্রশস্ত পরিবেষ্টনীকে চিৎকার কোলাহল দালালে ভরিয়ে তোলা! ভয়াল দেবীদের উন্নয়ন পরবর্তী ভবিতব্য তো আমরা ঘরের কাছের বর্গভীমায় দেখেছি – কোথায় সুবোধ ঘোষ কথিত কালাপাহাড়ের ভীতি-উদ্রেককারী দেবী, আর কোথায় বাজারের মধ্যে আসীনা গৃহপালিতা দেবী!
মন্দিরের স্বল্প দূরত্বে একটি বালিয়াড়ি পেরিয়ে বলিহারিচণ্ডী সৈকত, নির্জন, কুমারী, জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। অত্যুৎসাহী যুবকবৃন্দ পুরীর মোহনা থেকে হেঁটে হেঁটে এখানে আসেন।
সেখান থেকে সতপদা। দিনটি চমৎকার। আকাশ সমুদ্রের মত নীল, তাপমাত্রা না গরম না ঠাণ্ডা – যদিও উত্তুরে হাওয়া মাঝে মাঝে জানান দিচ্ছে। ফিন এয়ারের হেলসিঙ্কি সেবু উড়ানটি ঊনত্রিশ হাজার ফুট উপরে চমৎকার দুটি সাদা রেখা টেনে গ্যাছে, তাইতে আকাশকে ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে। বস্তুত, গন্তব্যে পৌঁছানোর চেয়ে চলতেই আমার বেশি ভাল লাগে, বিশেষত অদিশার রাস্তায়। এই সমুদ্র তো এই পাহাড়, এই ধানক্ষেত তো এই জঙ্গল, এই গ্রাম তো এই বাজার, এই রেলগাড়ি তো এই পাখির দল। সতপদা চিলিকার সমুদ্রমুখের নিকটবর্তী এক পার্শ্ববিন্দু, ডলফিন দর্শনের জন্য সমধিক প্রসিদ্ধ। দেখতে হলে নৌকা চেপে রাজহংস দ্বীপে যেতে হয়। আমাদের শুশুক দেখার আগ্রহ একদমই নেই; আমরা দেখতে এসেছি নিসর্গ, জল, গাছপালা।
এখান থেকে চার ঘণ্টার নৌকাযাত্রায় নলবন পাখিরালয়। তবে তার আগে অন্য কাজ আছে। সারথি মহোদয় এখানকার পান্থনিবাসে জানিয়ে দিয়েছিলেন আমরা দুপুরে কী কী খেতে চাই। তদনুযায়ী কচ্ছপের মাপের কাঁকড়া ও হাঙরের মাপের পারশে মাছ অহল্যার মত আমাদের প্রতীক্ষায় ছিলেন। তাঁদের প্রতি সুবিচার করে, আমরা নলবন পাখিরালয়ে। শীতের শেষ, জল নেমে গিয়ে কাদাচর (mudflats) উন্মুক্ত – সেখানে পরিযায়ী পাখির মেলা; চঞ্চলতা, অস্থিরতা, কোলাহলে দিগন্ত পরিব্যাপ্ত।
মাণিকপাটনার ভবকুন্ডলেশ্বর মন্দিরটি দহিখিয়ায়। সেখান থেকে মংলাজোড়ি।
একসময় মংলাজোড়ির লোক পরিযায়ী পাখিদের দেখলেই ধরে বেচে দিত; লোকে তাই কেটে খেত। এভাবেই চলছিল,পাখিরাও মুখ ফেরাচ্ছিল। পেট আর চলে না। এমনসময়ে নন্দকিশোর ভুজবল আর পূর্ণ বেহেরার নেতৃত্বে গ্রামের মানুষ পেটের দায়ে পাখিদের প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়ান। এভাবেই আজ মংলাজোড়ি আদিগন্ত পেরিয়ে আসা পাখিদের বাঁচায়; আজ তাদের পর্যটনকেন্দ্রে 'জগত করে যাওয়া আসা।' মংলাজোড়ি খুঁজে পেয়েছে বিকল্প রুটিরুজির পথ। সেই পাখি শিকার করা লোকগুলোই এখন পর্যটকদের নৌকায় জলে জঙ্গলে ঘুরিয়ে পাখি দেখায়, পাখিদের বংশবিস্তারের জন্যে নিরিবিলি ছাউনি তৈরি করে,২০১২ সালে আর বি এস আর্থ হিরো অ্যাওয়ার্ড এবং ২০১৪ সালে ইন্ডিয়া বায়োডাইভার্সিটি অ্যাওয়ার্ড রানার আপ পুরস্কার পেয়েছেন এঁরাই। মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ। যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্ – যে কথামাত্র নয়, এক জীবনদর্শন, তার জাজ্বল্যমান উদাহরণ মংলাজোড়ি।
মংলাজোড়ি সতপদার বিপরীতে, চিলিকার উত্তরতটে, এক ছোট্ট গ্রাম – জলাভূমিতে বছরে নানা প্রজাতির তিনলক্ষ পাখি আসার সুবাদে অধুনা পাখিদের স্বর্গ নামেই সমধিক প্রসিদ্ধ। দশ বর্গকিলোমিটার মত মিষ্টি জলের জলাভূমি প্রবাহদ্বারা চিলিকার অগভীর ব্র্যাকিশ ওয়াটার (লোনা জল ও মিষ্টি জলের মধ্যবর্তী জল, প্রধানত মোহনা ও বদ্বীপ এলাকায়) এর সঙ্গে যুক্ত। জলাভূমি গুল্মময়, মধ্যে মধ্যে শরজাতীয় লম্বা ঘাস – পক্ষীবসতির আদর্শ জায়গা। আর পাখিই বা কত রকমের...। দেখে দেখে শেষ হয় না।
কিন্তু ফেরার তাড়া! নৌকাবিহারের পর গ্রামটিকে একটু ঘুরে দেখা। চৈত্রমাসে অনুষ্ঠিত এখানকার দণ্ডযাত্রা অতিখ্যাত। এই প্রথা গঞ্জামের তারাতারিণী মন্দিরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। পাইক আখড়া এখানকার আর এক লোকনৃত্য। পতিতপাবন মন্দির, গুপ্তেশ্বর মন্দির, নীলকণ্ঠেশ্বর দেবমন্দির, মঙ্গলা মাতা, ব্রাহ্মী মাতা, বালিমাঝি মাতা ও তারা মাতার মন্দির; আর নৌকানির্মাণ পদ্ধতি দেখে পুরী।
চতুর্থ দিন।
১৯৮০তে চাকরিতে ঢোকার পর আমার প্রথম পোস্টিং মালদায়। মালদা তখন অতি দুর্গম, যোগাযোগ বলতে হপ্তায় তিনদিন গৌড় এক্সপ্রেস। অন্য যে কটি রেলগাড়ি চলত,যথা দার্জিলিং মেল,কামরূপ এক্সপ্রেস,হাওড়া নিউ বঙ্গাইগাঁও জনতা এক্সপ্রেস,হাওড়া নিউ জলপাইগুড়ি ফাস্ট প্যাসেঞ্জার - তারা উভয়দিকেই মালদা পৌঁছতেন বেয়াড়া সময়ে, কোটাও ছিল অত্যল্প, ফলে কখনই টিকিট পাওয়া যেত না; বিকল্প রাতভর বাসযাত্রা; সেটিও খুব সুখকর নয়। বিচ্ছিন্নতার অন্তরালে সে এক অভূতপূর্ব অশ্রুতপূর্ব স্বাধীন জীবন – স্বোপার্জিত পয়সা, ইচ্ছা হলেই রিক্সা চড়তে পারি, বাবার শাসন নেই, বাবার বয়সী অগ্রজ সহকর্মীরা বন্ধুসম – যাবতীয় বদবুদ্ধির উদ্গাতা। আমার সেই বাধাবন্ধনহীন, গ্রন্থিবিহীন জীবনের কিছু তথ্য কিভাবে যেন সাড়ে তিনশো কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে বাবার কানে পৌঁছেছিল। তারপর বাবা আমাকে চিঠিতে লিখেছিলেন যে মানুষের জীবনে দুবার অনেক বন্ধু জোটে, প্রথম, যখন সে চাকরিতে ঢোকে; দ্বিতীয়, যখন সে চাকরি থেকে অবসর নেয়।
ঠিক কথা! তবে চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার সময়ে আর একটা ঘটনা ঘটে, লোকে জীবনে প্রথমবার কিঞ্চিৎ পয়সার মুখ দেখে, নিজেকে সচ্ছল বলে ভাবতে শেখে। সারাজীবন পিপীলিকার পশ্চাদ্দেশপেষণপূর্বক জীবননির্বাহ করিতে করিতে সহসা টাকার স্রোতে ভাসিয়া যায়। আমরা এমনই এসে ভেসে যাই - আলোর মতন, হাসির মতন, কুসুমগন্ধরাশির মতন, হাওয়ার মতন, নেশার মতন ঢেউয়ের মতো ভেসে যাই।
সদ্যলব্ধ সচ্ছলতায় কিঞ্চিৎ কেনাকাটা হল।
পঞ্চম দিন।
প্রত্যাবর্তন। এবারে আমাদের যাত্রা ১৮৪১০ পুরী-হাওড়া শ্রীজগন্নাথ এক্সপ্রেসে। এই গাড়িটি সময় বেশি নেয়, তথাপি সুবিধাজনক সময়ের জন্য এটি আমার প্রিয় রেলগাড়ি। ২০১৩ – ২০১৬ আমার অফিস ছিল হাওড়ায়,হাওড়া স্টেশন থেকে সাত মিনিটের হাঁটাপথে। তখন হামেশাই অফিস ছুটির পর সন্ধ্যে সাতটায় এই গাড়িটি ধরে পরদিন সকালে পুরী। আবার ফেরার পথে রাত সাড়ে দশটায় এই গাড়িটি ধরে পরদিন সকাল আটটায় হাওড়া। অফিসেই স্নানাহার। তারপর সারাদিন কাজ করার সময়েও চোখে ঊর্মিমালা, শ্রবণে দূরাগত সমুদ্রের কলতান।
বাঁধাছাঁদা সেরে নৈশাহার। হোটেলের ঘরভাড়ার পুরোটাই আগেই দেওয়া ছিল। হোটেল ছাড়ার সময় বিল মেটানো বলতে শুধু খাবারের দাম। হোটেলশিল্পের বোধহয় নিজস্ব কোনো হিসাব আছে, যে খাবারের বিল ঘরভাড়ার চেয়ে বেশি হবে,বা সমান হবে,বা অর্ধেক হবে। আমাদের চারদিনের খাবারের (প্রাতরাশ, মধ্যাহ্নভোজ একদিন বাদে,ও নৈশাহার) বিল আমাদের চারদিনের ঘরভাড়ার বিলের সমান বা অর্ধেক তো নয়ই। এমনকি সিকিও নয়। তাইতে বিল গ্রহণকারীর ধারণা হল কিছু পদ বোধহয় বিল থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছে। ফেব্রুয়ারির মনোরম তাপমাত্রাতেও তিনি দরদর করে ঘামতে লাগলেন, এখানেওখানে ফোন করতে লাগলেন, খচাখচ কিবোর্ড টিপতে লাগলেন, আমাদের বসিয়ে রাখার জন্য দুরন্ত ক্ষমাটমা চেয়ে নরম পানীয় অবধি খাইয়ে দিলেন। আমরা দুজনে যে প্রতিরাতে দুটি রুটি, একবাটি ডাল আর একটা স্যালাদ খেয়েছি, সেটি উনি বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। দুপুরের খাবারও তথৈবচ, একদিন মোটে মাছ খেয়েছি।
হোটেলের পিছনে দৃশ্যমান - জগন্নাথ মন্দিরের আলোকিত চূড়া ও সমুখের চিরচঞ্চল বারিধিকে প্রণাম জানিয়ে, স্টেশন। এবারের যাত্রাবিরতি সাঁতরাগাছিতে; তখন সবে সকাল সাড়ে সাতটা। শাড়ি হাঁড়ি, খাজা গজা, লাঠি কাঠি - সকল লটবহর নিয়ে গাড়িতে, এবং পরিশেষে বাড়িতে।
কৃতজ্ঞতাঃ
• স্ত্রীর পত্র – রবীন্দ্রনাথ।
• নরসিংহ পাণ্ডা মহারাজ।
• শরৎ - আমাদের সারথি।
• Flightradar 24
হিসাবশাস্ত্রের স্নাতকোত্তর শ্রী তপন পাল West Bengal Audit & Accounts Service থেকে অবসর নিয়েছেন সম্প্রতি। তাঁর উৎসাহের মূলক্ষেত্র রেল - বিশেষত রেলের ইতিহাস ও রেলের অর্থনীতি। সেবিষয়ে লেখালেখি সবই ইংরাজিতে। পাশাপাশি সাপ নিয়েও তাঁর উৎসাহ ও চর্চা। বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি এবং ইন্ডিয়ান রেলওয়ে ফ্যান ক্লাবের সদস্য শ্রী পালকে বাংলা লিখতে শিখিয়েছে 'আমাদের ছুটি'। স্বল্পদূরত্বের দিনান্তভ্রমণ শ্রী পালের শখ; কারণ 'একলা লোককে হোটেল ঘর দেয় না'।