বান্দরবানের পাহাড়ে বর্ষা অভিযান

এ.এস.এম. জিয়াউল হক


ঈদের ছুটিটা কোথায় কাটাবো চিন্তা করতে করতেই মাথায় আসল বান্দরবানের কথা। বর্ষার সময় জুমের মৌসুমে পাহাড় এখন পুরো সবুজ। যদিও ঈদ পরিবারের সঙ্গে কাটাতে পারবোনা ভাবতেই মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল, কিন্তু সবুজের টানও তো উপেক্ষা করতে পারছিনা। অতএব আগস্টের ২৬ তারিখ রাতের বাসে টিকেট কেটে ফেললাম। আমরা পাঁচজন, একজন আবার চট্টগ্রাম থেকে দলের সঙ্গে যোগ দিবে। ঈদের মৌসুম বিধায় ৩১ তারিখে ঢাকায় ফিরবার টিকেটও আগে থেকেই করে ফেললাম।
বাস ছাড়ল এক ঘন্টা দেরীতে। আমাদের ট্রেকিং রুট আগে থেকেই নির্ধারণ করা, এমনকি চার দিনের কোন রাত কোন উপজাতি পাড়ায় কাটাবো, তাও আগে থেকে ঠিক করা। তাই সবকিছু সময়মত হওয়াটা গুরুত্ত্বপূর্ণ। এক ঘন্টা দেরীতে যাত্রা শুরু করাতে তাই প্রথমেই একটু ভড়কে গেলাম। তার ওপর পথে জ্যামে পড়ার সম্ভাবনা তো আছেই।
চট্টগ্রাম হয়ে বান্দারবান আমরা সময়মতই পৌঁছে গেলাম। ভাগ্য ভালো, পথে কোনও জ্যামেই পড়তে হয়নি। বান্দারবান পৌঁছেই সোজা চলে গেলাম রুমা বাস স্ট্যান্ড। সেখানে দেখা হল আমাদের চট্টগ্রামের সহযোগী অনন্ত-র সঙ্গে। ও একদিন আগেই বান্দারবান চলে এসেছে। তাড়াহুড়ো করে বাসে উঠে পড়লাম। দুপুর তিনটের ভিতরে রুমা বাজার পৌছতে হতে হবে, না হলে আর্মিরা রুট পারমিট দিবেনা পরবর্তী গন্তব্যের জন্য। বাসে পরিচয় হল এক দম্পতির সঙ্গে, তাঁরা প্রথমবার বান্দারবান এসেছেন। কোথায় যাবেন, কিছুই জানেননা। আমাদের সঙ্গে বাসে উঠে পড়লেন তাঁরাও।
বাস রুমা গ্যারিসন পৌঁছতে দুপুর দুটো। সেখান থেকে আবার চাঁদের গাড়ি করে যেতে হবে রুমা বাজার। আমাদের দুর্ভাগ্য রুটের গাড়ি ছেড়ে গেছে একটু আগে। বাধ্য হয়ে যখন হেঁটে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম তখনই দেখি বাসের সেই দম্পতি একটা চাঁদের গাড়ি রিজার্ভ করে ফেলেছেন। লিফট চাওয়ার আগেই তাঁরা আমাদের গাড়িতে উঠে পড়তে বললেন। বলামাত্রই আমরা আর সঙ্গে ঢাকা থেকে আসা আরও তিন জনের একটি দল উঠে পড়ল। আধা ঘন্টার মধ্যেই আমরা রুমা বাজার পৌঁছে গেলাম। আমাদের পরবর্তী কাজ গাইড ঠিক করা আর আর্মি ক্যাম্পে রিপোর্ট করা। বাজারে দেখা হয়ে গেল পূর্বপরিচিত নির্ভরযোগ্য গাইড আপেল-এর সঙ্গে। ওর অবশ্য আগে থেকেই অন্য ট্যুরিস্টদল ঠিক হয়ে থাকার জন্য আমাদের সঙ্গে যেতে পারলো না। তবে ওর পরিচিত বম ছেলে কাপখুম-কে ঠিক করে দিল আমাদের গাইড হিসেবে। খাওয়া দাওয়ার কথা ভুলে ছুটলাম আর্মি ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে। সেখানে রিপোর্ট করে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য বগা লেক। এখানেও জীপ রিজার্ভ করতে হবে। ওই দম্পতি আর ভিতরে যাওয়া সমীচীন মনে করলেন না। তাঁরা রুমা বাজার থেকে রিজুক ঝরনা দেখে ঢাকায় ফিরবেন। তাঁদেরকে বিদায় দিয়ে আপেলের দল সহ আমরা একটা জীপ ঠিক করলাম। ঢাকা থেকে আসা অন্য তিনজনের দলটা ঝিরি পথে বগা লেক যাবে। অতএব তারাও বিদায় নিল।

বগালেকের রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ। বিশেষ করে বর্ষার সময় জীপ একদম লেক পর্যন্ত যায়না। বগা পাহাড়ের নিচে নামিয়ে দেয়। ফোর হুইল ড্রাইভের ঝাঁকুনি আর সামনের খাড়া রাস্তা দিয়ে ওঠা-নামার ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে হৃৎপিণ্ড হাতের ভিতর নিয়ে আমরা বগা পাহাড়ের নিচে পৌঁছলাম। এখান থেকে ৪০০ ফিট ওপরে হেঁটে উঠতে হবে। দেরী না করে সবাই একটা বাঁশ নিয়ে রওনা হলাম। অনেকদিন পর ট্রেকিংয়ে এসে খাড়া পাহাড় বেয়ে ওপরে উঠতে আমাদের সবারই জিভ বেরিয়ে গেল। কিন্তু পাহাড়ের ওপর থেকে পুরো বগা লেকের দৃশ্য দেখে সবাই ক্লান্তি ভুলে গেলাম।
এখানে আবার আর্মি ক্যাম্পে রিপোর্ট করে চললাম রাতের আশ্রয়ের সন্ধানে। বগা লেকে এখন অনেকগুলো ইকো কটেজ হয়েছে। লেকের পাড়ে একটা কটেজ খুব পছন্দ হল। সেখানে ব্যাগপ্যাক রেখে কটেজের মালিককে খাবার রান্না করতে বলেই ছুটলাম লেকের উদ্দেশ্যে। ঠাণ্ডা পানিতে অনেকক্ষণ গোসল করে সারা দিনের ক্লান্তি ভুলে গেলাম। কটেজে ফিরেই ছুটলাম খাওয়ার জন্য। এত ক্ষুধার্ত ছিলাম যে সামান্য আলু ভর্তা, ডিমভাজি আর জুমের চাল দিয়েই কয়েক প্লেট ভাত খেয়ে ফেললাম।
সন্ধ্যায় আপেলসহ গেলাম পাশের ছোট একটা পাহাড়ে। সেখান থেকেও পুরো বগালেকের দৃশ্য দেখা যায়। রাতে ফিরেই তাড়াতাড়ি বিছানায় গেলাম। তার আগে লেকের পাড়ে কটেজের বারান্দায় কিছুক্ষণ আড্ডা দিতে ভুল হলনা।

পরদিন খুব ভোরেই উঠে পড়লাম। ইচ্ছা ছিল পাঁচটার ভিতর বেরোনোর, কিন্তু হালকা কিছু খাবার খেতে খেতে ছটা বেজে গেল। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য সরকারিভাবে স্বীকৃত বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পাহাড় চূড়া কেওক্রাডং। সমুদ্র সমতল থেকে এর উচ্চতা ৩২৩৫ ফিট। বগা লেক থেকে কেওক্রাডং-এর পথ পুরোটাই ওপরদিকে ওঠা। মাঝে অল্প কিছু সমতল রাস্তা আছে। শীতের সময় এই রাস্তাতে জীপ নিয়েও আসা যায়, সেই রাস্তা ধরেই আমরা এগোচ্ছি। যেতে যেতে চিন্তা করছিলাম, প্রথম যখন এদিকে কোনও রাস্তা ছিলনা, সার্ভেয়াররা যখন বাঁশ কেটে কেটে পথ করে নিতেন পাহাড়ের উচ্চতা মাপার জন্য, তখন তাঁদের কতটা কষ্ট হত, তার ওপর বন্য জানোয়ারের আক্রমণের ভয় তো ছিলই।
যাই হোক, হয়তো তাঁদের কাছ থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে একসময় আমরা চিংড়ি ঝরনা পৌঁছে গেলাম। ঝরনাটি পাহাড়ের ওপর থেকে বেয়ে এসে ঝিরিতে পড়েছে। কেওক্রাডংযাত্রীদের পানির প্রধান উৎস এই ঝরনাটি। এখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম আমরা। আমি, শুভ আর অনন্ত পাথর ডিঙিয়ে ঝরনার একদম নীচে চলে গেলাম। ঝরনার ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করে নিলাম।
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য দার্জিলিং পাড়া। কেওক্রাডং এর একদম নিচেই এই বম পাড়ার অবস্থান। পথে কয়েক জায়গায় বিশ্রাম নিয়ে আমরা দার্জিলিং পাড়া পৌঁছলাম। সঙ্গে করে আনা ছোট পেনি স্টোভে কফি বানাতে বসলাম। প্রচণ্ড বাতাসে অনেককষ্টে কফি বানালাম। সব ক্লান্তি দূর করে দিল কয়েকচুমুক কফিতে। এরপর সোজা কেওক্রাডং চূড়ার দিকে হাঁটতে শুরু করলাম আমরা।

কেওক্রাডং চূড়ায় পৌঁছে অভিভূত হয়ে গেলাম। সামনের দিগন্তবিস্তৃত পাহাড় চূড়া আর অনেক নিচের মেঘের আনাগোনা দেখতে খুবই ভালো লাগছিল। কয়েকবার মেঘ এসে আমাদের ভিজিয়ে দিয়ে গেল। তার ওপরে রয়েছে বাতাস। ঠাণ্ডায় কাঁপতে থাকলাম।

জুমচাষের মৌসুমে চারদিক একদম সবুজ। ওপর থেকে দেখা যাচ্ছে নিচের দার্জিলিং পাড়া, পাসিং পাড়া, অনেক দূরের সুনসান পাড়া, সাইকত পাড়া। এখানে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে সামনের দিকে রওনা দিলাম। এবার আমাদের নামতে হবে। তাই কিছুটা প্রশান্তি ছিল মনে। পরবর্তী গন্তব্য বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু গ্রাম পাসিং পাড়া।

পাহাড়ের একটি উপত্যকায় গ্রামটি অবস্থিত। কয়েকঘর উপজাতির বাস। সামনে আদিগন্ত পাহাড়চূড়া আর রয়েছে প্রচণ্ড বাতাস। এক কাপ চা খেয়ে আমরা সামনের দিকে হাঁটতে থাকলাম। পাড়ার সঙ্গেই রয়েছে একটি স্কুল। সামনে ছোট মাঠ। চারপাশে পাহাড় আর এর ঠিক মাঝখানে এমন একটি স্কুল দেখে আমারই ইচ্ছা করছিল স্কুলে ভর্তি হয়ে যেতে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আগ্রহ নিয়ে দেখছে আমাদের। সঙ্গে করে আনা চকলেট দিলাম ওদের। লাজুক ভঙ্গিতে সেগুলো নিল। ইচ্ছা করছিল পাসিং পাড়াতেই আজ রাতটা কাটিয়ে দিই, কিন্তু রুটপ্ল্যান বিবেচনা করে আর ঈদের মৌসুমের পর্যটকদের ভিড় এড়ানোর জন্য রওনা দিলাম জাদিপাই পাড়ার উদ্দেশ্যে।
জাদিপাই পাড়ায় আসার উদ্দেশ্য হচ্ছে জাদিপাই ঝরনা। অনেকের মতে এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর ঝরনা, আর বর্ষায় এর আসল সৌন্দর্য ফুটে উঠে। আমাদের এবারের ভ্রমণের অন্যতম উদ্দেশ্য বর্ষায় এই ঝরনার রূপ দেখা।
জাদিপাই পাড়াতে এক আদিবাসী পরিবারের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করা হল। জুমে আদার চাষ করে এই পরিবারের কিছু টাকা লাভ হয়েছে, সেখান থেকেই কাঠের এই নতুন বাড়িটি করেছে তাঁরা।
ব্যাকপ্যাক রেখে ছোট ডে-প্যাক, শুকনো খাবার, পানি আর কিছু কলা সঙ্গে নিয়ে আমরা রওনা দিলাম জাদিপাই ঝরনার উদ্দেশ্যে। পাড়া থেকে একঘণ্টার হাঁটাপথ। আগের রাতে বৃষ্টি হওয়ায় রাস্তা কিছুটা পিচ্ছিল। খুব সাবধানে আস্তে আস্তে আমরা খাড়া পথ বেয়ে নামতে থাকলাম। হাঁটতে হাঁটতে একসময়ে একটা ভুট্টার ক্ষেতে পৌঁছলাম। এখান থেকে সামান্য ওপরে উঠেই জাদিপাই-এর সবচেয়ে বিপদজনক রাস্তা শুরু। ঝুরঝুরে মাটি দিয়ে খাড়া নামতে হবে অনেকখানি রাস্তা। সামান্য পা পিছলালেই অনেকখানি পথ গড়িয়ে পরতে হবে। ইরাজ ভাই একদম শেষ পর্যন্ত এসেও নিচের অংশটুকু আর নামলেন না।

ঝরনার নীচে এসেই চোখ জুড়িয়ে গেল। অনেক ছবি দেখেছি জাদিপাইয়ের, কিন্তু ইরাজ ভাই-এর কথাটাই সত্যি মনে হল, "ছবি মিথ্যে কথা বলে।" কী তার বিশালত্ব, আর কী তার গর্জন! বর্ষার সময়ে জাদিপাই-এর এই রূপ আর শীতের সময়ে তার শুষ্কতা ভাবলে অবাক হতে হয়। বাতাসের প্রচণ্ড তাণ্ডবে ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে মনে হচ্ছিল কোনও একটা টর্নেডোর মাঝখানে এসে পড়েছি, এখনই উড়িয়ে নিয়ে যাবে!

পানির ছিটের জন্যে ক্যামেরা বের করতে পারছিলাম না। অনেক কষ্টে কিছু ছবি তোলা হল। গোসল করতে করতে ঝরনার একদম নীচে চলে এলাম। হঠাৎ দেখি, ঝরনার ডানপাশের বেশ কিছু অংশ পানির চাপে মাটিসহ ধ্বসে পড়ল। বেশীক্ষণ আর পানিতে থাকার সাহস করলাম না। ওপরে উঠে একটা শুকনোমত জায়গায় সঙ্গে করে আনা বিস্কিটের প্যাকেট শেষ করলাম। এবার ফিরবার পালা। হাচড়েপাঁচড়ে ওপরে উঠে এসে পুনরায় জাদিপাই পাড়ার উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করলাম। আসার সময় নামার রাস্তা ছিল, এবার পুরোটাই খাড়া রাস্তা। বিশ্রাম নিতে নিতে পাড়ায় এসে পৌঁছলাম।
গোসল করে, খাওয়াদাওয়া করে বিকেলবেলাটা অলসভাবেই কাটল। পাড়ার গির্জার গেটে বসে দিগন্তজোড়া পাহাড় আর মেঘের আনাগোনা দেখলাম। রাতের খাবার খেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। রাতের খাবার ছিল কচি বাঁশের তরকারি, বাঁশকোড়ল, বাঁশের স্যুপসহ স্থানীয় খাবার।
পরদিন ঈদের দিন। খুব ভোরবেলা উঠে রওনা দিলাম সুনসান পাড়ার উদ্দেশ্যে। এখানেও খাড়া পাহাড় বেয়ে নামতে হবে। রাস্তাও আগের দিনের চেয়ে অনেক সরু আর পিচ্ছিল। কিছু কিছু জায়গায় খাড়া ঢাল নেমে গেছে কয়েকশ ফুট। পা পিছলালেই আর দেখতে হবেনা। যাই হোক, নিরাপদেই আমরা পাড়ায় চলে আসলাম। কাপখুম গ্রামের কারবারীর ঘরে আমাদের থাকার ব্যাবস্থা করল। ব্যাকপ্যাক রেখেই গামছা আর বাঁশ নিয়ে আমরা রওনা দিলাম আরেকটি ঝরনার উদ্দেশ্যে। বম ভাষায় এর নাম 'তুব্লং', এটি বাংলাদেশের একমাত্র ডাবল ফলস, মানে পাশাপাশি দুইটি ঝরনা একসঙ্গে বয়ে চলেছে। রেমাক্রি খাল আর রুমা খাল থেকে এই ঝরনাদুটির উৎস। পাড়া থেকে এক ঘন্টার রাস্তা। কাপখুমসহ আমরা তিনজন রওনা দিলাম ঝরনায়। বাকি দুজন কারবারীর বাসায় থেকে গেল, পায়ে ব্যথার জন্যে। জুম-এর রাস্তা ধরে আমরা এগিয়ে গেলাম ঝরনার উদ্দেশ্যে। এই বছর এই এলাকায় জুম চাষ হওয়ার জন্যে রাস্তা মোটামুটি পরিষ্কার। অন্যথায় গতবছর পর্যন্ত এখানে আসতে হলে বড় বড় শনক্ষেতের ভিতর দিয়ে আসতে হত, শনের কাঁটায় শরীরে ক্ষতের সৃষ্টি হত। নিরাপদেই আমরা ঝরনার কাছে চলে এলাম।

ওপর থেকেই শোনা যাচ্ছিল ঝরনার গর্জন। নিচে নেমে তুব্লং-এর রূপ দেখে আবারও আমরা মুগ্ধ। পানিতে নেমে পড়লাম। বুকসমান পানি, কিন্তু দুটি ঝরনার মিলিত স্রোতে দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছিল না। বাঁশ গেঁথে গেঁথে সামনে গেলাম। ঝরনার নিচে প্রচন্ড স্রোত, গর্জন আর ঠাণ্ডার কাঁপুনি বুকে ভয় ধরিয়ে দেয়। তার ওপর একটু পরপর বাতাস এসে পানির আন্দোলন আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।

অনেক কষ্টে আমি আর শুভ ঝরনার পানির মূল প্রবাহের ভিতরে ঢুকে গেলাম। এখানে ছোট একটি গুহামত, পানি আমাদের মাথার ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাতাসের তাণ্ডবে পানি আস্তে আস্তে বাড়তে থাকল। একটা পর্যায়ে সামনের সবকিছু ঘোলা হয়ে গেল। অনেক কষ্টে আবার বাঁশের সাহায্যে মৃত্যুগুহা থেকে বের হয়ে আসলাম। বিপদ এখানেই শেষ নয়, তীরে ফিরবার সময়, শুভ হঠাৎ করে পানিতে তলিয়ে গেল। ওকে উদ্ধার করতে যেয়ে নিশিতারও একই অবস্থা। অনেক কষ্টে তীরে ফিরল ওরা। পরে আবিষ্কার করলাম যে জায়গাটিতে ওরা ডুবেছিল, দুটি ঝরনার পানির স্রোত ঠিক ওখানটাতেই মিলিত হচ্ছে, ফলে জায়গাটিতে একটা ঘূর্ণির মত সৃষ্টি হয়েছে। পরবর্তীতে বর্ষায় যারা এখানে যাবেন, এই জায়গাটি থেকে সাবধান।
এবার ফিরবার পালা। শেষবারের মতো দুর্গম ঘন জঙ্গলের মধ্যে প্রবাহিত ঝরনাটির দিকে তাকিয়ে ফেরার রাস্তা ধরলাম আমরা। সুনসান পাড়ায় ফিরে এসে খাবার ব্যবস্থা করতে গিয়ে দেখি কারবারীর বাড়িতে শামুক ছাড়া আর খাওয়ার তরকারি নেই। ঈদের দিন শুধু শামুক খেয়ে থাকবো ভাবতেই সঙ্গে করে আনা প্যাকেট ন্যুডুলস আর স্যুপ রান্না করা হল। রাতে যেভাবেই হোক, একটা মুরগির ব্যবস্থা করতে হবে ভেবে খেয়ে নিলাম।

ওইদিন আমাদের শিডিউলে আরও একটি ঝরনা, জিংসিয়াম সাইতার এবং রুমানা পাড়ার বাদুড় গুহা দেখার কথা থাকলেও আবহাওয়া এবং বাকি দুজনের পায়ের ব্যথার কথা চিন্তা করে ইচ্ছাটা বাদ দিতে হল। মনে মনে একটু আক্ষেপ থেকে গেল, এতদূর এসে এই সামান্য রাস্তাটা আর যাওয়া হলনা। কিন্তু সামগ্রিকভাবেই সবসময় দলের কথা চিন্তা করতে হয়।
রাতে কাপখুম একটি মোরগের ব্যবস্থা করে ফেলল। বনমোরগ আর দেশি মোরগের মিশ্রণ বলা যায় একে। আমাদেরকেই জবাই করতে হল, কারণ উপজাতিরা জবাই করতে জানেনা। নিশিতা গেল রান্না করতে। ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করতে করতে খেতে বসলাম। কিন্তু দুই হাত দিয়ে টেনেও এর মাংস ছেড়া যাচ্ছেনা। পাহাড়ি মোরগের এমনই জীবনীশক্তি। কয়েকঘন্টা চুলায় না রাখলে এই মাংস খাওয়া কষ্টকর। যাই হোক, আলু ভর্তা, ডাল আর মাংসসহ ঈদের রাতের খাবারটা সেদিন খারাপ হল না। কারবারীর পরিবারসহ সকলে একসঙ্গেই খেয়ে নিলাম।

পরদিন ফিরে যেতে হবে। ভোরবেলা উঠে পাসিং পাড়ার দিকে রওনা দিলাম। এবার সেই খাড়া পথে বেয়ে উঠতে হবে। সঙ্গে করে আনা শুকনো খাবার আর পানি খেয়ে আমরা উঠতে থাকলাম। পাসিং পাড়ায় পৌঁছে পরবর্তী লক্ষ্য ঠিক করতে বসলাম। আমাদের হাতে দিনের অফুরন্ত সময় বাকি আছে এখনো। তাই পাসিং পাড়ায় রাতে থাকার ইচ্ছা থাকলেও আমরা রওনা দিলাম কেওক্রাডং-এর উদ্দেশ্যে। বগালেক অবধি নেমে ঝিরিপথে রুমা যাওয়া আমাদের উদ্দেশ্য। পথে বগামুখ পাড়ায় কারবারীর বাড়িতে রাতে থেকে যাব। খুব দ্রুতই বগালেক নেমে এলাম। লেকে আবার গোসল করে জিম্মুলিয়ান দা'র দোকানে দুপুরে খেয়ে নিলাম। পুনরায় গির্জার পাশের রাস্তা ধরে রওনা দিতে যেয়েই অনন্তর পায়ে ব্যথা চরমে উঠল। বেচারা হাঁটতেই পারছে না। এদিকে বগালেকে ওইদিন রাতে থাকার কোনও ইচ্ছা নেই আমাদের কারও। ঈদের পরদিন হওয়ায় দলে দলে পর্যটক আসবে ওইদিন। আর এই একটা জিনিস পুরো অভিযানে এড়িয়ে এসেছি। কিন্তু এখন অবস্থা দেখে আর কিছুই করার থাকল না। বাধ্য হয়েই সিয়াম দিদির একটা কটেজ ভাড়া নিলাম। আবারও আক্ষেপ কাজ করছিল আমার, কিন্তু দলের স্বার্থের কথা চিন্তা করে মন খারাপ করলাম না। ভবিষ্যতে আরও অনেকবার আসতে পারবো বগালেকে, কিন্তু পথে একটা বিপদ হলে তখন কি হত?
অনন্তকে বিশ্রামে রেখে বিকেলে আপেলের দল সহ আমি আর শুভ গেলাম পাশের একটা জুম-এর পাহাড়ে। দুপুরে ভরপেট খাওয়ার পর খাড়া পাহাড় বেয়ে উঠতে কষ্ট হয়ে গিয়েছিল আমাদের। কিন্তু ওপরে উঠে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। পুরো বগালেক এখান থেকে দেখা যাচ্ছিল, আর সঙ্গে রয়েছে বাতাস। লেকের পাড়ে পর্যটকদের বারবিকিউ পার্টি আর গানবাজনার উৎপাত থেকে বাঁচার জন্য এটা একটা মোক্ষম জায়গা।
সন্ধ্যা পর্যন্ত এখানে থেকে আমরা নেমে আসলাম। রাতে আবার লেকের ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করলাম আমি। রাতের খাবার ছিল গরুর মাংস। পেট ভরে খেয়ে ঘুম দিলাম।
পরদিন সকালে উঠে আর্মি ক্যাম্পে রিপোর্ট করে আগের দিন ঠিক করে রাখা জীপে রুমা পৌঁছে গেলাম। সেখানে পুনরায় আর্মি ক্যাম্পে রিপোর্ট করতে গিয়ে দেখা হয়ে গেল মাসুদ ভাইদের সঙ্গে। তাঁরা পুকুরপাড়া-রাইক্ষ্যাং আর ডুমলং পাহাড় যাচ্ছেন। মনের ভিতর তাঁদের সঙ্গে যোগ দেয়ার ঈষৎ একটা ইচ্ছা জাগতেই আবার নিভিয়ে দিলাম। বান্দারবানে একবার এসে কখনো সাধ মেটে না। আরও বহুবার আসতে হবে ভালোবাসার এই পাহাড়ের মাঝে। প্রতিবার ভিন্নরকম অভিজ্ঞতা সঙ্গে করে নিয়ে যাব।

কিভাবে যাবেনঃ
ঢাকা থেকে ইউনিক, শ্যামলীসহ আরও অনেক বাস সরাসরি বান্দারবান যায়। বান্দারবান থেকে চাঁদের গাড়ি বা বাসে করে রুমা বাজার পৌঁছে সেখান থেকে পুনরায় জীপে করে বা ঝিরি পথ দিয়ে হেঁটে বগালেক পৌঁছে যেতে পারেন। বাকি পথটুকু হেঁটেই যেতে হবে। থাকা এবং খাওয়া মিলে যেকোনো পাড়ায় জনপ্রতি ২০০ টাকা করে। কিছু কিছু পাড়ায় খুশি হয়ে আপনি যা দেবেন, তাই নেবে। কিন্তু তাই বলে ওদেরকে অসম্মান করবেন না, ন্যায্য মূল্য দেবেন। পলিথিন বা পরিবেশের ক্ষতি করে এমন যেকোনো জিনিস সঙ্গে করে আনবেন না। সম্ভব হলে বেশি করে চকলেট নিয়ে যাবেন, আদিবাসী বাচ্চারা খুব পছন্দ করে, এতে ওদের সঙ্গে আপনার সম্পর্কটা ভালো হয়ে যাবে। অবশ্যই খুচরো টাকা নিয়ে যাবেন, সম্ভব হলে নতুন টাকার নোট। চার-পাঁচজনের দল হলে জনপ্রতি ৫০০০ টাকার মধ্যে ঘুরে আসা সম্ভব। দল আরও বড় হলে খরচ আরও কমে যাবে।

 

এ.এস.এম. জিয়াউল হক-এর স্বপ্ন পৃথিবীটাকে ঘুরে দেখার। পাশাপাশি ভালোবাসেন বিভিন্ন ধরনের মানুষের জীবনধারণ দেখার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher