শীতে গড়পঞ্চকোট
সঞ্চিতা হোড়
শীত আসছে আসছে, কর্মক্ষেত্র নামক কুরুক্ষেত্রে পোস্টলাঞ্চের সাপ্তাহান্তিক আড্ডার টপিক হতেই পারে "চলো পালাই"। পালানোর বা পাগলামির দিনক্ষণ ঠিক করে আসছে শীতে যাওয়াই যেতে পারে "গড়পঞ্চকোট"।
হ্যাঁ, ঠিক এই সময়ে গেছিলাম দুদিনের ছুটি কাটাতে, খুব কাছেই।
গিয়ে পেয়েছিলাম ইতিহাস আর অরণ্যের এক অদ্ভুত মেলবন্ধনের রূপ। আমি জানি প্রকৃতি এই বঙ্গে অকৃপণ কিন্তু ইতিহাস কি কোনো অংশে কম!
সেই ইতিহাসের সাক্ষীর সামনে দাঁড়িয়ে আছি। খুব ভুল যদি না করি, সময়টা ১৭৪০ সালের এপ্রিল মাস। বৈশাখের দহনে প্রকৃতি ঠিক কতটা জ্বলেছিল জানিনা। তবে আমাদের গ্রামবাংলা পুড়েছিল অন্য আগুনে। যুদ্ধের আগুন, বর্গীদের আগুন। আলীবর্দি খাঁ-র সেনাবাহিনীর কাছে হার মানতে বাধ্য হলেন বাংলার তৎকালীন নবাব সরফিরাজ খাঁ। রুস্তম জঙ্গ, সরফিরাজের জামাতা, উড়িষ্যার নবাব নাজিম একটা প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেছিলেন বটে, কিন্তু তা যখন সাফল্যের মুখ দেখল না, তখন তিনি আলীবর্দি খাঁকে ঠেকাতে নাগপুরের তৎকালীন মারাঠা রাঘোজি ভোঁসলের কাছে সাহায্য চাইলেন। বোধহয় তখন ভাবতে পারেননি এতে কী হতে পারে! আজকের পাঞ্চেত বাঁধ যেখানে, সেই অঞ্চল দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে মারাঠা সৈন্যরা দলে দলে বাংলায় প্রবেশ করল আর প্রায় দশ বছর ধরে ভাস্কর পণ্ডিতের নেতৃত্বে বাংলায় শোষণ আর লুঠপাঠ চালিয়ে গেল। বর্গী অর্থাৎ মারাঠা সৈন্যদের অত্যাচার এক কলঙ্কময় অধ্যায় হয়ে দেখা দিল সোনার বাংলায়। শেষ পর্যন্ত ১৭৫১ সালে মারাঠা রাজা ও তৎকালীন বাংলার নবাবের সন্ধিপত্র সাক্ষরিত হওয়ায় এর অবসান ঘটে। এরই মাঝে কোনও এক সময় বর্গীদের আক্রমণে গড়পঞ্চকোটের পতন ঘটে। আবহমান কালের প্রবাহস্রোতে আর আমাদের অবহেলা ও অযত্নে যা এখন ধবংসস্তুপে পরিণত। তবু আজও, এখনও যা অক্ষুণ্ণ আছে তাও ফেলনা নয়।
১৭৫১-র প্রায় একশো বছরেরও বেশি সময় পরে যখন গড়পঞ্চকোটের প্রাসাদ, গড়, তথাকথিত স্থাপত্য প্রায় ভগ্নস্তূপে পরিণত, তখন মাইকেল মধুসূদন দত্তের যোগদান পঞ্চকোটের রাজার এস্টেট ম্যানেজার হিসেবে। কর্মসূত্রে খুব বেশি সময় এখানে উনি কাটাতে পারেননি শারীরিক অসুস্থতার কারণে। ১৮৭২ সালে কবি মধুসূদন অল্প সময়ের জন্য সিংহদেও রাজাদের এস্টেট ম্যানেজারের কাজ করেছিলেন। তখন রাজা ছিলেন নীলমণি সিং দেও। সেই সময় মাইকেল তিনটি চতুর্দশপদী কবিতা লিখেছিলেন-- 'পঞ্চকোট গিরি', 'পঞ্চকোটস্য রাজশ্রী' এবং "পঞ্চকোট গিরি বিদায় সঙ্গীত"।
শোনা যায় পুরুলিয়ার একজন খ্রিস্টান কালিচরণ সিংহের পুত্রসন্তানের খ্রিস্টধর্ম নেওয়ার সময় মধুসূদন ছিলেন তার ধর্মপিতা। তিনি চেষ্টা করেছিলেন প্রাচীন ইতিহাসের রক্ষণাবেক্ষণ করার কিন্তু শারীরিক কারণে সেটা সম্ভব হয়নি।
ইতিহাসের গবেষকদের মতে এই গড়পঞ্চকোটেই তিনি তার জীবনের শেষ চাকুরি করেন। কলকাতাতে ১৮৭৩ সালের ২৩শে জুন মধুসূদন দত্তের জীবনাবসান হয়।
"কোথায় সে রাজলক্ষ্মী, যার স্বর্ণ-জ্যোতি
উজ্জ্বলিত মুখ তব? যথা অস্তাচলে
দিনান্তে ভানুর কান্তি। তেয়াগি তোমায়
গিয়াছেন দূরে দেবী, তেঁই হে! এ স্থলে,
মনোদুঃখে মৌন ভাব তোমার; কে পারে
বুঝিতে, কি শোকানল ও হৃদয়ে জ্বলে?
মণিহারা ফণী তুমি রয়েছ আঁধারে।"
গড় শব্দের অর্থ দুর্গ, পরিখা। রাজবাড়ির চারপাশে খাল কেটে রাখা হতো যাতে শত্রুরা সহজে প্রবেশ করতে না পারে। দাঁড়িয়ে আছি সেই খন্ডহরের সামনে।
লোকমুখে শোনা যায়, ৯০ খ্রিস্টাব্দে দামোদর শেখর নামে এক রাজপুত রাজা এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। পরে ৯৪০ খ্রিস্টাব্দে এই রাজধানী গড়পঞ্চকোটে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। একসময় প্রাচীন তেলকূপী রাজ্যের অংশ ছিলো এই গড়পঞ্চকোট। পঞ্চকোটের রাজারা "সিংহদেও" পদবি ব্যবহার করতেন। ওখানে একটি বাচ্চা ছেলে আমাকে ওদের বাংলা বাচনভঙ্গিতে যেভাবে সিংহদেও বলল সেটা শুনতে বেশ ভালো লাগলো। প্রাচীন ইতিহাসের ভগ্নরূপ আমাদের যন্ত্রণা দিলেও সে যেন সাক্ষী জীবনের ঐতিহাসিক পরিবর্তনের। ১৬০০ সালে পঞ্চকোটের রাজা বিষ্ণুপুরের হাম্বীর মল্লের অধীনস্থ ছিলেন, তার প্রমাণস্বরূপ ১৮৬২ সালে এখানে হাম্বীর মল্লের নাম খোদাই করা দুটি শিলালেখ আবিষ্কার করেন জন বেগলার সাহেব। ১৭৫০ সাল পর্যন্ত অন্তত ৮০০ বছর নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে রাজত্ব করেছিলেন পঞ্চকোটের রাজারা।
মারাঠা বর্গীরা দশ বছর ধরে বাংলায় লুঠপাঠ ও অগ্নিসংযোগ করে সোনার বাংলাকে ছারখার করে দিয়েছিল। এই বর্গীরা গড়পঞ্চকোটের রাজবাড়ি আক্রমণ করে। রাজা তাদের ঠেকাতে পারেননি। বর্গীরা রাজপ্রাসাদে লুঠপাট করে। সেই সময় রাজার সতেরো জন রানি আত্মহত্যা করেন। পরাজিত রাজা মনের দুঃখে এখান থেকে সরে গিয়ে কাশীপুরে নতুন প্রাসাদ তৈরি করেন।
ওই তো কোনো মা যেন তার কোলের সন্তানকে সেই পরিচিত গান গেয়ে ঘুম পাড়াচ্ছেন -
"খোকা ঘুমোল পাড়া জুড়াল বর্গী এল দেশে,
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কিসে।"
সূর্য পাটে বসতে চলেছে। আকাশের আলো হালকা লালচে। গাছের মাথাগুলো বেশ কালো দেখালেও একটা নরম আলো আছে। দীপেশ এবার সিগারেট ধরাল। দিল। চারপাশে পাতলা অন্ধকার। ওই পাহাড়ের ওপর উঠতে গেলে যে ফুসফুসের জোর লাগে তা বেশ মালুম পড়ে। তখন মনে হয় বুদ্ধির গোড়ায় যত কম ধোঁয়া দিয়ে থাকা যায় ততই মঙ্গল।
কাশীপুর রাজবাড়ি গড়পঞ্চকোট থেকে আনুমানিক ৫০ কিমি দূরে। আর রাজবাড়ির কাছেই আছে কপিস্ত গার্ডেন। অনেক সময় ঝিলের পারে কুমিরের রোদ পোহানো দেখতে পাওয়া যায় শুনলাম, যদিও অন্ধকার নেমে আসাতে কোন ছবি তুলতে পারিনি।
এখানকার দরবেশ আপনার দিকে সস্নেহে তাকিয়ে আছে। মধুমেহ-এর দৃষ্টি আপনার ওপর পড়ুক আর না পড়ুক একবার দরবেশের স্নেহের পরশ জিভে না নিলে তাকে যে বড় দুঃখ দেওয়া হবে!
এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় স্টেশন আদ্রা তৈরি হয় ১৯০৩ সালে। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার এই স্টেশনটি তৈরি করেন। ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকলে এখনো মাঝে মাঝে স্টিম ইঞ্জিনের দুর্লভ দর্শন পাওয়া যায়। মাত্র তিন কিলোমিটার দূরেই একটি বড় ঝিল আছে।
সবই তো হল, কিন্তু থাকব কোথায়? উন্মুক্ত প্রকৃতি ভাল, তবে নিরাপদ তো নয়! আমাদের জন্য আছে পাঞ্চেত রেসিডেন্সি।
পশ্চিমবঙ্গ বন উন্নয়ন দপ্তরের গড়পঞ্চকোট বনবাংলো। শাল, তমাল, সোনাঝুরি, পলাশের সঙ্গে নানাধরনের নামী অনামী ফুলের গন্ধ, জঙ্গলের গন্ধ পেতে চাইলে থাকা যেতেই পারে এই বাংলোতে। দামোদর নদীর থেকে বয়ে আসা কুলকুল হাওয়া আর অরণ্যের সঙ্গে ইতিহাসের অন্যতম সাক্ষীর সঙ্গে কি কিছুটা সময় নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া যায় না!
জায়গাটা এমন কিছু দূরে নয়। আসানসোল- বরাকর পেরিয়ে কুমারডুবি। সেখান থেকে গাড়িতে মিনিট চল্লিশের পথ। কিছুক্ষণের মধ্যেই জঙ্গলে ঘেরা বনবাংলো আপনাকে স্বাগত জানাবে। অনতিদূরে আপনার দিকে রক্ষীর মত দাঁড়িয়ে আপনাকে ভরসা দিচ্ছে পাঞ্চেত পাহাড়। বাংলোয় ডরমিটরি থেকে শুরু করে এসি রুম পর্যন্ত আছে। চারিদিকে যে দূষণমুক্ত প্রকৃতির মাঝে পৌঁছানো গেল মানসিক ও শারীরিক ক্লান্তি কাটাতে, সেই বাংলোর নামেও প্রকৃতি জুড়ে রেখেছেন পশ্চিমবঙ্গের সরকার। প্রতিটা ঘরের নাম রাখা হয়েছে গাছের নামে। শাল, পিয়াল আর মহুয়ার সঙ্গে মেতে উঠেছে মন, শরীর।
"ভাঙা গড় গড়াইব, জলপূর্ণ করি
জলশূন্য পরিখায়; ধনুর্ব্বাণ ধরি দ্বারিগণ
আবার রক্ষিবে দ্বার অতি কুতূহলে।"
কবির ভাষাতে মনে মনে এটাই বলতে বলতে ফেরার সময় ভাবছিলাম ভাঙা গড় কি আমরা সত্যি রক্ষা করতে পারব! পরবর্তী প্রজন্মের কাছে কি আকর্ষণীয় হবে এই ইতিহাস!! কে রক্ষিবে এই দ্বার অতি যত্নে, ভালোবাসা দিয়ে!
গড়পঞ্চকোট ঘিরে ঘুরতে পারেন, অযোধ্যা, জয়চন্ডী পাহাড়। এই জয়চন্ডী পাহাড়েই শ্যুটিং হয়েছিল সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত চলচ্চিত্র 'হীরক রাজার দেশে'র। হোটেল থেকেই গাড়ি পেয়ে যাবেন। ভাড়া ১৬০০-২০০০ টাকা।
কিভাবে যাবেন - হাওড়া থেকে আদ্রা চক্রধরপুর, জনশতাব্দী, কোলফিল্ড ইত্যাদি ট্রেন। আসানসোল নেমে গাড়িতে মিনিট চল্লিশ।
বেসরকারি কোম্পানির হিউম্যান রিসোর্স ডিপার্টমেন্টে চাকুরিরতা সঞ্চিতা হোড় চাকরি থেকে সামান্য সুযোগ পেলেই বেড়িয়ে পড়েন প্রকৃতির কোলে একটু ভালবাসা পাওয়ার তাগিদে। কখনো একাকী, কখনো সাথীর সঙ্গে। আর এক সঙ্গী ক্যামেরা। পাহাড় হোক কিম্বা সমুদ্র, জঙ্গল অথবা গ্রাম যেখানেই সুযোগ আসে বেড়িয়ে পড়েন। ভালবাসেন সেই জায়গার মানুষজনের সঙ্গে মিশতে, লোকসংস্কৃতিকে জানতে আর স্থানীয় খাবার চেখে দেখতে।