দুচাকায় গুরুদোংমার
গৌতম দে
নতুন মোটরবাইক কেনার পর যে অন্যরকম একটা স্পোর্টস-এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাব সেটা কখনোই ভাবতে পারিনি। বাইকিং এখন অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস হিসেবে যথেষ্ট জনপ্রিয়। আমাদের একটা ছোট্ট দল আছে। তাদের সঙ্গে দুজায়গায় বাইকে ঘুরে আসার পর স্পোর্টসটা ভীষণ ভালো লেগে গেল। তাই যখন ঠিক হল পরবর্তী গন্তব্য উত্তর সিকিমের গুরুদোংমার লেক, একপায়ে রাজী হয়ে গেলাম।
গুরুদোংমার লেক - উত্তর সিকিমে মোটামুটি ১৭,৮০০ ফিট উচ্চতায় অবস্থিত। এতটা উচ্চতায় লেকটা বছরের বেশির ভাগ সময়ে বরফেই ঢাকা থাকে। খারাপ রাস্তা আর বাতাসে অক্সিজেনের মাত্রা - এই দুইয়ে মিলে লেকটাকে দুর্গম করে রেখেছে। অত্যধিক ঠাণ্ডা পরিস্থিতি আরো সঙ্গীন করে তোলে।
প্রথম বাধাটা এল বাড়ি থেকে। এই বয়সে বকাবকি করা যায় না। তাই চললো সেন্টিমেন্টাল অত্যাচার। এরপর যত লোকে জেনেছে তাদের অধিকাংশই নিরুৎসাহ করেছে। সব বাধা অতিক্রম করে শুভযাত্রার দিন ঠিক হলো সাতই মে। ব্যাগপত্র বাঁধাছাঁদা সেরে শুরু হলো যাত্রা। পূর্বনির্ধারিত সূচি অনুযায়ী আমরা পাঁচজন মিলিত হলাম ডানকুনিতে। ঘড়িতে তখন রাত আড়াইটে। আধঘন্টা বাইক চালানোর পর ঘুমে চোখ খুলে রাখাটাই একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিল। হাইওয়ে ড্রাইভিংয়ে সবচেয়ে বেশি বিপদ হয় এই ঘুমের জন্য। একটু থেমে চোখেমুখে জল দিয়ে নেওয়া হল। বর্ধমান যখন পৌছালাম তখন চারটে বাজে। ভোরের আলো সবে ফুটবে। সামান্য চা-পান, তারপর আবার ক্লাচ-গিয়ার। এবার ন্যাশনাল হাইওয়ে ছেড়ে আমরা স্টেট হাইওয়ে ধরলাম। সুন্দর পিচঢালা রাস্তা, তার দুপাশে ধান ক্ষেত। ভোরের সূর্য প্রথম কিরণ দিয়ে গুডমর্নিং জানাল। অসাধারণ অভিজ্ঞতা। মাঝে মাঝে সাময়িক বিশ্রাম। আবার এগিয়ে চলা। ফারাক্কা যখন পৌঁছলাম তখন বেলা এগারোটা। এখানে লম্বা একটু বিশ্রাম। প্রাতরাশ সারা হল। বেলা যত বাড়ছে গরম প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে। কিলোমিটারের পর কিলোমিটার রাস্তা, একটার পর একটা মাইলস্টোন, একটার পর একটা গ্রাম, জনপদ। আস্তে আস্তে বোরিং লাগছিল। অতএব আবার বিশ্রাম। এবার কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে নেওয়া। "Riders on the storm" শুনতে শুনতে আবার পুরোনো উৎসাহ ফিরে এল। ডান কব্জিতে ছোট্ট মোচড়, বাইক আবার ৯০কিমি স্পিডে হাওয়া কাটতে লাগল। অনেক কষ্ট সহ্য করে, অনেক খারাপ রাস্তা পেরিয়ে যখন শিলিগুড়ি ঢুকলাম তখন রাত নয়টা। শরীরের শেষ ইচ্ছাশক্তিটাও যেন নিংড়ে দিয়েছি। আজ শিলিগুড়িতে রাত্রি যাপন।
পরদিন সক্কাল-সক্কাল যাত্রা শুরু। গন্তব্য সিকিমের রাজধানী গ্যাংটক। শিলিগুড়ির ভীড় ছাড়িয়ে রাস্তা যখন সেবক জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পাহাড়ে উঠতে লাগলো মনে হলো এই তো জীবন। লুকিং গ্লাসে পিছনে ফেলে আসা সবুজ জঙ্গল আর তার ফাঁকে টুকরো টুকরো নীল আকাশ। এই অভিজ্ঞতা শুধুই অনুভব করতে হবে। ভাষায় বলে বোঝানো ভারী কঠিন। কিন্তু আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তায় খুব মনোসংযোগ দরকার বাইক চালাতে গেলে। বারবার মনে রাখতে হচ্ছে এটা কোনো ভিডিওগেম নয়। এখানে জীবন কয়েক ইঞ্চি ভুলও শুধরানোর সুযোগ দেবে না। তাই সাবধান। গ্যাংটক পর্যন্ত রাস্তা বেশ ভালো। দুপুর বারোটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম হোটেলে। অনুমতিপত্র জোগাড় করতে যাওয়া হলো ট্যুরিজম অফিসে। বিকালে বেরোনো হল রুমটেক মনেস্ট্রি দেখতে।
পরদিন আমরা প্রবেশ করব উত্তর সিকিমে। ওদিকের রাস্তা অত্যন্ত খারাপ। অনবরত ধ্বস আর বৃষ্টি রাস্তার অবস্থা বেহাল করে দিয়েছে। যাত্রাপথে বর্ণনা করার মতো কিছুই নেই। শুধুই খারাপ রাস্তা। সন্ধ্যে ছয়টা নাগাদ পৌঁছানো গেল লাচেন গ্রামে। প্রথমবার যখন এই গ্রামে গাড়িতে করে এসেছিলাম, লাচেন সুন্দর ছোট্ট ছবির মতো একটা গ্রাম ছিল। ইদানীং ভুরিভুরি হোটেল গ্রামটাকে একটা ঘিঞ্জি জনপদ করে তুলেছে। তেমন কিছুই করার নেই এখানে। দশহাজার ফিটের উপরে রাত্রে ঠাণ্ডাও বাড়ছে। কাল অনেক ভোরে আমরা শুরু করব। তাই তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়া হল।
ঘড়িতে তখন রাত দুটো। অ্যালার্মে ঘুম ভেঙে গেল। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নিলাম। আজ সঙ্গে লাগেজ নিতে হবে না। কারণ আমাদের আবার এখানেই ফিরতে হবে। ঠিক রাত সাড়ে তিনটেতে পাঁচজন চারটে রয়্যাল এনফিল্ডে যাত্রা শুরু করলাম। রাস্তায় কোনো আলো নেই, তার ওপরে আলগা পাথরে ভর্তি। খুব সাবধানে আস্তে-আস্তে বাইক উপরে উঠতে লাগল। ঠাণ্ডায় হাত জমে যাচ্ছে। শরীরের যেখানে আবরণ নেই সেখানটায় যেন অবশ হয়ে আসছে। প্রচন্ড কষ্ট সহ্য করে যখন থাঙ্গু-তে পৌঁছলাম তখন সবে ভোরের আলো ফুটছে। দোকানে ঢুকে গরম চা খেয়ে শরীরের লীনতাপটা আবার ফিরে এল।
আধঘন্টা বিশ্রামের পর আবার শুরু করা গেল। এবার রাস্তা যেমন চড়াই তেমনি খারাপ। চারিদিকে স্বর্গীয় নৈসর্গিক দৃশ্য। কিন্তু মনভরে উপভোগ করতে পারছিনা। দু-চারবার নিশ্চিত পতন সামলে পৌঁছলাম গুরুদোংমার যাওয়ার পথে শেষ আর্মি চেকপোস্টে। উচ্চতা ১৫,০০০ ফিট। এখানে আর্মি পরিচালিত একটা ক্যান্টিন আছে। নামটা বেশ সুন্দর। "Cafe 15000 ft"। হঠাৎ আমাদের মধ্যে একজনের বেশ শরীর খারাপ শুরু হল। এই শরীর খারাপের লক্ষণ এখানে খুব স্বাভাবিক। এতটা উচ্চতা আর বাতাসে অক্সিজেন-এর পরিমাণ এতই কম, যে শরীরের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া বেশ কঠিন। কোনোরকমে তাকে সুস্থ করে, উৎসাহ দিয়ে আবার আমরা যাত্রা শুরু করলাম।
এখন ভৌগোলিক পরিবেশ পুরো বদলে গেছে। চারিদিকে শুধু মরুভূমির মতো পাহাড়। গাছপালার কোনো চিহ্ন নেই। তার মাঝখান দিয়ে সুন্দর পিচঢালা রাস্তা। এই মনোরম পরিবেশের মধ্য দিয়ে ১৪ কিমি যাওয়ার পর আমাদের ডান দিকের পাহাড়ে উঠতে হবে। সোজা রাস্তাটা চলে গেছে চোলামু লেক-এর দিকে যেখানে সাধারণ নাগরিকের প্রবেশ নিষেধ। পাহাড়ের ঢালে আবার খারাপ রাস্তা। তার মাঝে প্রচন্ড ঠাণ্ডা আর অক্সিজেনের অভাবে বাইক বারবার ইস্তফা দিচ্ছে। এরকম অবস্থায় অনেক চেষ্টা করেও নিজের পড়ে যাওয়াটা আটকাতে পারলাম না। তবে আমি ভাগ্যবান যে এখানে কোনো খাদ নেই আর আমার পায়ে গার্ড পড়া ছিল। যাই হোক, অবশেষে ধুঁকতে ধুঁকতে পৌঁছালাম লেকের ধারে। যাকে দেখতে এতদূর আসা সেই পবিত্র লেকের শোভা অপূর্ব। সত্যি মনে হচ্ছিল যে কিছু একটা অর্জন করেছি। দুই হাত আকাশের দিকে তুলে একটু সেলিব্রেশন হলো। মনে হলো ল্যাদখাওয়া বাঙালিও পারে অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসে সাফল্য পেতে। লেকের ধারে নেমে জল মাথায় ছুঁয়ে কিছুটা পাপস্খলন করা গেল।
ফেরার পথে শুরু হলো তুষারপাত। চারিদিক দশ মিনিটের মধ্যে সাদা হয়ে গেল। এরমাঝে বাইক চালানো যেন অসম্ভব হয়ে উঠলো। কয়েক হাত দূরের জিনিসও দেখা যাচ্ছে না। তার উপর ঠাণ্ডাও বেড়ে চলেছে পাল্লা দিয়ে। কোথাও যে দাঁড়াব তারও উপায় নেই। কোনোরকমে পৌছালাম থাঙ্গুতে। ততক্ষণে তুষারপাত থেমেছে। তারপর ধীরেধীরে নেমে চলা লাচেনের উদ্দেশ্যে। সঙ্গে থাকলো এমন এক স্মৃতি যা নিয়ে হয়ত গর্ব করা চলে।
নেটওয়ার্ক সিকিউরিটি প্রফেশনাল গৌতম দে বর্তমানে লিনডে-তে কর্মরত। স্বল্পপরিচিত জায়গায় ঘুরে বেড়ানোটাই নেশা। ভালোবাসেন ট্রেক করতে ও মোটরবাইক চালিয়ে ঘুরে বেড়াতে।