গিয়ংজু : সিল্লা রাজত্বের অন্দরে

সম্পত ঘোষ

 

সময় প্রবহমান, কোনও বাঁধন সে মানে না, কোনও আবেগ তাকে বিচলিত করে না, আর তাই আজকের মহানগরী কালেরই নিয়মে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, তার বাহ্যিক জৌলুশ হারিয়ে ফেলে ইতিহাসে পর্যবসিত হয়, সেই ইতিহাসের পাতাগুলো স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে কিনা তার বিবেচনার ভার থাকে আগামী প্রজন্মের উপরে। আমাদের গন্তব্য গিয়ংজু (Gyeongju), সিল্লা রাজত্বের (Silla dynasty, খ্রি:পূ: ৫৭ থেকে ৯৩৫ খ্রিস্টাব্দ) রাজধানী এই শহর একদা বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম মহানগরী বলে বিবেচিত হতো। সময়ের গতিপথে কখনও তার ওপর মোঙ্গোল আক্রমণের কালো মেঘ ঘনিয়ে আসে, কখনও জাপানি আক্রমণে রক্তস্নাত রণক্ষেত্রে পরিণত হয় এই নগরী, আবার কখনও নব্য কনফুসিয়াসিজম-এর আঘাতে আহত হয় প্রাচীন ঐতিহ্য। বিদেশী শক্তি পরাধীন করতেই পারে, শক্তির দম্ভে আর আদিম প্রবৃত্তিতে বিজিতকে লাঞ্ছিত করতেও সে কুন্ঠিত হয়না, লুন্ঠিত হয় পার্থিব সম্পদ আবার নতুনের আহ্বানে আর অহমিকায় পদদলিত হয় পুরাতন সংস্কার - এই সবকিছুর-ই সাক্ষ্যবহন করে চলেছে গিয়ংজু। আনদং (Andong) থেকে গিয়ংজু সারাদিনে বেশ কয়েকটি বাস চলে, প্রথম বাস নয়টা পঞ্চাশ মিনিটে। প্রায় এক ঘন্টা চল্লিশ মিনিটের পথ অতিক্রম করে যখন গিয়ংজু পৌঁছলাম তখন সাড়ে এগারোটা, বেশ খিদে পেয়েছে। আনদং থেকে দেগু (Daegu) হয়েও গিয়ংজু আসা যায় তবে অধিক দূরত্বের কারণে সময় বেশি লাগে। বাস টার্মিনালের ভিতরেই দু-তিনটে দোকান আছে, তারই একটাতে দুটো 'এমুগ' ('Eomug', একটি কোরিয়ান শব্দ যার অর্থ মাছ দিয়ে প্রস্তুত রুটি বা কেক) আর স্যুপ দিয়ে দ্বিপ্রাহরিক আহার সারলাম। আন্তর্নগর বাস প্রান্তিকের (Inter-city Bus Terminal) বাইরে রাস্তাটা পেরোলেই স্থানীয় বাসের অপেক্ষাকেন্দ্র। আমরা পুরোটাই জনপরিবহণের ওপর নির্ভরশীল কারণ সেটা অনেক বেশি সহজ আর অর্থসাশ্রয়ী। এর আরও একটা সুবিধা আছে, কোনো শহরকে ভালো ভাবে চিনতে জানতে বেশ সুবিধা হয়, অনেক বেশি সুযোগ থাকে মানুষের সঙ্গে ভাববিনিময়ের।
পূর্বে ম্যংবালসান (Myonghwalsan, কোরিয়ান শব্দ 'সান' কথাটির অর্থ পর্বত), পশ্চিমে সন্দসান (Sondosan), উত্তরে কুমগাংসান (Kumgangsan) আর দক্ষিণে নামসান (Namsan), চর্তুর্দিকে পর্বতবেষ্টিত অতীতের মহানগর 'সেওরাবেওল' (Seorabeol) বর্তমানে শহুরে-গ্রাম্য সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা গিয়ংজু শহর প্রায় আড়াই লক্ষাধিক মানুষের বাসভূমি। ইতিহাস পর্যবেক্ষণে সময়ের পর্যায়ক্রমের ভূমিকা অপরিসীম আর তাই সময়কে অনুসরণ করে আমাদের প্রথম গন্তব্য 'বুলগকসা বৌদ্ধ মন্দির' (Bulguksa Temple)।

৫৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সারো (Saro) উপজাতীয় পাক হায়েকজেওসা (Pak বা Park Hyeokgeose) সিল্লা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। পরবর্তী উনবিংশতম রাজা নুলজি (Nulji) -র সময়কালে এই অঞ্চলে বৌদ্ধধর্ম প্রচারলাভ করে। ৫২৮ খ্রিষ্টাব্দে রাজা বেওফেউং (Beopheung বা Beobheung) -র সময়কালে তোহামসান (Tohamsan) পর্বতের দক্ষিণ-পশ্চিম ঢালে প্রতিষ্ঠিত হয় বুলগকসা বৌদ্ধ মন্দির। জানা যায় সেই সময় এটি 'হাওমপুলগকসা' (Hwaompulgoksa) বা 'পপন্যুনসা' (Popnyunsa) নামে পরিচিত ছিল। পরবর্তী সময়ে রাজা গিয়ংদক (Gyeongdeok) -র রাজত্বকালে মন্ত্রী কিম তে-সং (Kim Tae-seong বা Gim Dae-seong, এদেশে প্রথমে পারিবারিক নাম এবং পরে প্রদত্ত নাম বলা রীতি) মন্দিরটি পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং সম্প্রসারণ করেন। ৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রায় আশিটি কাষ্ঠনির্মিত মন্দির ভবন নিয়ে গড়ে ওঠা মন্দিরটির নামকরণ হয় 'বুলগকসা' যার আক্ষরিক অর্থ 'বুদ্ধের দেশ' অথবা শান্তির ভূমি যেখানে মানুষ প্রাচুর্য আর আনন্দে বসবাস করেন।
১১ নং রুটের বাসে চড়ে পাহাড়ের পাদদেশে নামলাম, রাস্তা পার হয়ে রয়েছে তথ্যকেন্দ্র। অধিকাংশ তথ্যপুস্তিকা কোরিয়ান ভাষায়, কিছু চাইনিজ কিংবা জাপানিজ ভাষায়ও রয়েছে। পাহাড়ের গা বেয়ে রাস্তা উঠে গেছে মন্দিরপ্রাঙ্গণের উদ্দেশ্যে, সে পথ অনুসরণ করে চারপাশের অপূর্ব সুন্দর প্রকৃতিকে অনুভব করতে করতে পৌঁছলাম মন্দিরের মুখ্য প্রবেশপথে। প্রবেশপথের ডানদিকে রয়েছে টিকিট বিক্রয়কেন্দ্র আর বামপার্শ্বে মন্দিরটির মানচিত্র আর বিবরণী, দেখলাম একটি পর্যটকের দলকে গাইড বিশদে ব্যাখ্যা করেছেন। প্রবেশমূল্য পাঁচ হাজার কোরিয়ান 'ওন' (won), টিকিট নিয়ে মুখ্য প্রবেশপথ 'ইলজুমুন' দ্বারে (Iljumun Gate) টিকিট পরীক্ষা করে ভিতরে প্রবেশ করলাম।

এই প্রবেশদ্বারটি কিন্তু ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে মন্দিরটির পুনঃনির্মাণের সময়ে নির্মিত। মূলমন্দিরে প্রবেশের বেশ কিছুটা পূর্বেই এই দ্বারটি, জোসেওন রাজত্বের (Joseon Dynasty) নির্মাণশৈলীকে অনুসরণ করেই এই প্রবেশদ্বারের স্থাপনা। ইতিহাসকে কী সুন্দরভাবে সংরক্ষণ করা হয় এ দেশে ! কিছুটা রাস্তা অতিক্রম করে পৌঁছলাম 'চন্বাংমুন' (Chonwangmun) প্রবেশদ্বারে।

এই প্রবেশদ্বারটি কিন্তু ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে মন্দিরটির পুনঃনির্মাণের সময়ে নির্মিত। মূলমন্দিরে প্রবেশের বেশ কিছুটা পূর্বেই এই দ্বারটি, জোসেওন রাজত্বের (Joseon Dynasty) নির্মাণশৈলীকে অনুসরণ করেই এই প্রবেশদ্বারের স্থাপনা। ইতিহাসকে কী সুন্দরভাবে সংরক্ষণ করা হয় এ দেশে ! কিছুটা রাস্তা অতিক্রম করে পৌঁছলাম 'চন্বাংমুন' (Chonwangmun) প্রবেশদ্বারে। এটিই মূলমন্দিরের প্রবেশের মুখ্যদ্বার যার অভ্যন্তরে অধিষ্ঠান করছেন মন্দিরের চতুর্দিকের রক্ষাকর্তা চারজন দেব। প্রাচীন ভারতীয় ধর্মীয় বিশ্বাস আর সংস্কৃতি থেকে উঠে আসা এই চারজন দেব চরিত্র। ভারতীয় ধারণা থেকে সৃষ্ট দেবগণের বহিরঙ্গে রয়েছে এদেশীয় শৈল্পিক চেতনা। দেখলাম এদেশীয় পর্যটকেরা প্রত্যেকেই হাতজোড় করে মাথা নিচু করে দেবতাদের প্রণাম করে মন্দিরে প্রবেশ করছেন।

ভিতরে প্রবেশের পর ডানদিকে রয়েছে স্মারকদ্রব্যের পসরা আর পানীয়ের ভেন্ডিং মেশিন। সামনেই 'পম্যংনু' (Pomyongnu Pavilion) পটমণ্ডপের প্রবেশপথ, বিশাল সিঁড়ি উঠে গেছে। গ্রানাইট প্রস্তরের নির্মিত আঠারোটি সিঁড়ি নিয়ে তৈরি 'চোঙ্গুন্য' ('Chongungyo') যার অর্থ নীল মেঘের সেতু, ভূমি থেকে মন্দিরে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে এটিকে 'সেতু' বলা হয়েছে বলেই বোধহয়) সোজা 'তিউংজন' (Taeungjon) ভবনের সম্মুখে পৌঁছে দেয়, আর পাশে ষোলোটি সিঁড়ি নিয়ে নির্মিত 'পিগুন্য' ('Paegungyo', যার অর্থ মেঘের সেতু) ভবন বা মূল মন্দিরের প্রাঙ্গণে উপস্থিত হয়। তবে এগুলি আজ সংরক্ষিত, ব্যবহার করা হয়না।

ডানপাশের রাস্তা দিয়ে উঠে গিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতে হয়। প্রবেশের পরই চোখে পড়বে মন্দিরপ্রাঙ্গণে অবস্থিত দুটি প্যাগোডা যথাক্রমে 'শাক্যটপ' (Seokgatap) প্যাগোডা আর 'ডাবটাপ' (Dabotap) প্যাগোডা। উচ্চতায় ৮.২ মিটার প্রস্তরনির্মিত ত্রিস্তরীয় 'শাক্যটপ' প্যাগোডা-র নামকরণ 'শাক্যমুনি' (Sakyamuni)-র অনুসারে হয়েছে। 'শাক্যটপ'-র পাশে অবস্থিত 'ডাবটাপ' প্যাগোডাটি উচ্চতায় ১০.৪ মিটার। ৭৫১ খ্রিষ্টাব্দে রাজা গিয়ংদক-এর রাজত্বকালে প্রস্তরনির্মিত প্যাগোডাটি 'প্রভুত্বরত্ন বুদ্ধ'-র উদ্দেশ্যে সমর্পিত। সামনেই 'তিউংজন' ভবন, মূল মন্দির। মন্দিরের ভিতরে রয়েছে বিশালাকার শাক্যমুনি, অবিনশ্বর আত্মার অভিপ্রয়াণ এবং শরীরধারণ-কে শৈল্পিক চেতনার সঙ্গে মিশিয়ে এখানে তিনটি বুদ্ধের অবস্থান প্রদর্শিত, আর তাঁদের দুদিকে রয়েছেন ভগবান বুদ্ধের দুই শিষ্য কাশ্যপ আর আনন্দ। মন্দিরের অভ্যন্তরের ছবি তোলা নিষিদ্ধ, তাই সেটা মানস চিত্রপটে সযত্নে রেখে দিলাম আর মন্দিরের ভিতর প্রবেশ করে ভগবানের আশীর্বাদ প্রার্থনা করলাম। 'তিউংজন' ভবনের পরেই অবস্থিত 'মুসলজন' (Museoljeon) ভবনটি। এটি মূলত বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের আলাপ-আলোচনা আর বক্তব্য রাখার স্থান। জানা যায় রাজা মুন্মু (Munmu) এই ভবনটি প্রতিষ্ঠা করেন এবং বৌদ্ধ সন্ন্যাসী উইসাং (Uisang) সহ দশজন বৌদ্ধভিক্ষু বা সন্ন্যাসীকে এস্থানে নিয়মিত বৌদ্ধ দর্শন ও ধর্মের ওপরে আলোচনা ও বক্তব্য রাখতে অনুরোধ করেন। 'মুসলজন' ভবনের পশ্চাতে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেলে দেখা পাওয়া যায় অপেক্ষাকৃত ছোট দুটি মন্দির ভবন যথাক্রমে 'ক্বানুমজন' (Gwon-eum-jon) এবং 'বিরোজন' (Bi-ro-jon) ভবন নামে পরিচিত। 'ক্বানুমজন' ভবনে দেবী অবলকিতেশ্বরা বোধিসত্ত্ব পূজিত হন। ধর্ম আর শান্তির বাণী আজও উচ্চারিত হয় পাহাড়ের কোলে শায়িত মন্দিরের প্রতিটি কোণে। এই মন্দিরটি ১৫৭৩ খ্রিষ্টাব্দে জাপানি আক্রমণের সময় সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয় এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অংশকে পুনর্নির্মাণ করা হয়। প্রায় দুইশত বৎসর বিদেশী শক্তির হাতে পরাধীন আমার মতন ভারতীয় সহজেই অনুভব করতে পারে বিদেশী শক্তির পরাক্রম প্রদর্শনের পথকে কিন্তু সেই পরাক্রম কালের নিয়মে অনন্তস্থায়ী হয়না, সে বিলুপ্ত হয়, অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পরে, নৃশংসতা আর অমানবিকতার প্রতীকরূপে ঘৃণা আর উপেক্ষিত হয় আর যাকে সে বিধ্বস্ত করেছিল সে বাহ্যিক ধ্বংসের পরেও শান্তির বাণী প্রচার করে, চিরকালীন প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকে। সেই শান্তির বাণীকে হৃদয়ের অনুভূতি দিয়ে অনুভব করে ফিরে এলাম পাহাড়ের পাদদেশে।
জানা যায় ১২ খ্রিস্টাব্দে কোরিয় (বা গোরীয়) রাজবংশের সময়ে Huh Doryong প্রথম এই মুখোশগুলি তৈরি করেন। মূলতঃ চোদ্দটি ভিন্ন ধরনের মুখোশ ছিল গোড়ায়, যার মধ্যে তিনটি মুখোশ (Chongak বা বিবাহের বর, Byulchae and Ttuckdari-t'al) হারিয়ে যায়, বাকি এগারটি মুখোশকে ('Imae' বা বোকা, 'Ch'oraengi' বা দ্রুত নির্বোধ হস্তক্ষেপকারী, 'Kakshi' বা বিবাহের কনে, 'Chuji' বা সিংহ, 'Paekchong' বা কসাই, 'Halmi' বা বৃদ্ধা বিধবা, 'Chung' বা বৌদ্ধ সাধু, 'Yangban' বা অভিজাত, 'Sonbi' বা পন্ডিত এবং 'Pune' বা ছেনাল নারী) কে জাতীয় সম্পত্তির মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। লক্ষ্য করলাম এদের মধ্যে Yangban খুব প্রচলিত। মুখোশগুলির উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল যে এগুলো আনন্দ, পরিতোষ, ক্রোধ আর দুঃখের প্রকাশ করে। শুনলাম রাজার সামনে এই মুখোশ পরে নৃত্যনাট্য (মূলতঃ সামাজিক প্রেক্ষাপটের উপর আধারিত) পরিবেশিত হত, পূর্বোল্লেখিত চারটি আবেগের মধ্যে কোনটি দৃষ্টিগোচর হবে তা রাজার প্রজ্ঞার উপর নির্ভর করতো। মুখোশনৃত্য যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল তা বলাই বাহুল্য।

এখান থেকে ১২ নং রুটের বাসে চললাম 'সক্কুরাম' গুহা (Sokkuram Grotto) দেখতে, ভগবান বুদ্ধের উদ্দেশ্যে প্রার্থনাহেতু নির্মিত এই গুহা। তহামসান পর্বতের পাথর কেটে এই গুহা নির্মাণ ৭৫১ খ্রিষ্টাব্দে রাজা গিয়ংদক -র আমলে মন্ত্রী কিম তে-সং-র তত্ত্বাবধানেই শুরু হয় যদিও এটির সম্পূর্ণ নির্মাণ কিম তে-সং দেখে যেতে পারেননি। তাঁর মৃত্যুর (৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দ) কয়েরবছর পর গুহাটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়। গুহার মধ্যে রয়েছে ভগবান বুদ্ধের এবং বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন দেবগণের পাথরের খোদিত মূর্তি। গুহামন্দিরের প্রধান শাক্যমুনির মূর্তিটি উচ্চতায় ১৬ ফুট, পদ্মের ওপর ভগবান বুদ্ধ পদ্মাসনে বিরাজমান। কোরিয়ার তিন রাজবংশের শাসনকালের স্মৃতিকথা 'সামগুক ইয়ুসা'-য় বুলগকসা মন্দির আর সক্কুরাম গুহা মন্দির নির্মাণের কাহিনী বর্ণিত রয়েছে। জানা যায়, গিয়ংজু-র সীমান্ত অঞ্চলে মরিয়াং-রি নামক স্থানে কিম তে-সং নামের এক দরিদ্র ব্যক্তি তাঁর মায়ের সঙ্গে বসবাস করতেন। প্রতিবেশীর জমিতে চাষের কাজ করেই কোনোরকমে তাঁদের জীবননির্বাহ হত। একদিন এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর কাছে তে-সং শুনতে পান যে 'তুমি ভগবান বুদ্ধকে যতটা দান করবে, ভগবান তাঁর দশ হাজার গুণ ফিরিয়ে দেবেন'। ধার্মিক তে-সং ধানের একটি ছোট আবাদি জমি ভগবানের উদ্দেশ্যে দান করেন, এই ছোট চাষের জমিটি তিনি তাঁর মালিকের থেকে পেয়েছিলেন। এর কয়েক মাসের মধ্যেই তে-সং যখন মৃত্যুমুখে পতিত হন, তৎকালীন মন্ত্রী কিম মুন-ইয়াং একটি আকাশবাণী শুনতে পান, আকাশবাণীটি বলে যে মরিয়াং-রি অঞ্চলের বাসিন্দা কিম তে-সং তাঁর পরিবারে জন্মগ্রহণ করবেন। অনতিকালের মধ্যেই কিম মুন-ইয়াং-র স্ত্রী গর্ভবতী হন এবং এক পুত্রসন্তানের জননী হন। আকাশবাণীটি স্মৃতিতে রেখে শিশুটির নামকরণ করা হয় কিম তে-সং এবং তাঁর পূর্বজন্মের মা কে আমন্ত্রণ করে শিশু তে-সং-র দেখভালের জন্যে নিয়ে আসা হয়। বড় হয়ে কিম তে-সং একজন ধর্মনিষ্ঠ মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। বলাই বাহূল্য যে তিনি আর্থিক দিক থেকে স্বচ্ছল ছিলেন এবং মন্ত্রীপদাসীন হয়েছিলেন। কিম তে-সং তাঁর দুই মাতা পিতার স্মৃতিরক্ষার্থে ভগবান বুদ্ধের উদ্দেশ্যে বুলগকসা মন্দির আর সক্কুরাম গুহা নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন।
কাহিনিটি সত্যিই খুব হতবাক করেছিল কারণ দক্ষিণ কোরিয়ার এই কাহিনিটির সঙ্গে ভারতীয় ভূখণ্ডের সম্রাট অশোকের ঘটনার সাদৃশ্য পাওয়া যায়। প্রচলিত আছে যে সম্রাট অশোক তাঁর পূর্বজন্মে বাল্যাবস্থায় ভিক্ষু গৌতমকে কিছু মাটি (যা দিয়ে সে খেলছিল) ভিক্ষা প্রদান করেন, অত্যন্ত খুশি হয়ে গৌতম তাঁর ভিক্ষু সাথীদের বলেন যে এই বালক পরবর্তী জন্মে এক সুবিশাল ভূখণ্ডের অধিপতি হবে। এটি প্রচলিত কাহিনি মাত্র, তবে আশ্চর্য হলাম কাহিনিদ্বয়ের সাদৃশ্য দেখে।

এবার ফেরা, প্রথমে ১২ নম্বর বাসে বুলগকসা, সেখান থেকে আবার ১১ নম্বর বাস ধরে পরবর্তী গন্তব্য 'ডংগুঙ' প্রাসাদ ('Donggung Palace' যেটি ছিল রাজকুমারের প্রাসাদ; কোরিয়ান শব্দ 'Dong' কথাটির অর্থ 'পূর্ব' আর 'Gung'-র অর্থ 'প্রাসাদ' অর্থাৎ 'ডংগুঙ'-র আক্ষরিক অর্থ পূর্বের প্রাসাদ) আর 'উলজি' জলাশয় (Wolji Pond)।

অবিভক্ত সিল্লা সাম্রাজ্যের অন্যতম প্রধান প্রাসাদ এটি। 'সামগুক সাগি' ('Samguk Sagi' কোরিয়ার তিন রাজত্বের যথা সিল্লা, গোগরীয় এবং ব্যাকজে-র ঐতিহাসিক দলিল) থেকে জানা যায় রাজা মুন্মু তাঁর শাসনকালের ১৪তম বৎসরে ৬৭৪ খ্রিষ্টাব্দে 'উলজি' জলাশয়টি খনন করান এবং এই জলাশয়টিকে কেন্দ্র করে ৬৭৯ খ্রিষ্টাব্দে 'ডংগুঙ' রাজপ্রাসাদটি স্থাপন করেন। প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য থেকে জানা যায় এখানে সর্বমোট ছাব্বিশটি বৃহৎ ভবন এবং কিছু ক্ষুদ্র স্থাপত্য ছিল। তিনটি ভবনকে সংরক্ষণ করা হয়েছে, অবশিষ্ট তেইশটি ভবন আজ ভূমির অভ্যন্তরে প্রোথিত। একটি ভবনে পুরাতাত্ত্বিক বিভিন্ন নিদর্শনের প্রদর্শনী রয়েছে। সেখানে রয়েছে বিশালাকায় ঐতিহাসিক প্রাসাদটির একটি সংক্ষিপ্ত প্রতিমূর্তি। পাথর, পোড়া মাটি এমনকি ধাতুর ব্যবহারের উল্লেখযোগ্য নিদর্শন পাওয়া যায়। ওককাষ্ঠনির্মিত একধরণের বাদ্যযন্ত্র, কাচ আর প্রাণীর হাড়ের তৈরী অলংকার প্রভৃতি রাখা রয়েছে প্রদর্শনীতে। রাতের বেলায় 'উলজি' সেজে ওঠে রঙবেরঙের আলোর সাজে, কিন্তু ফিরতে হবে, আনদং যাওয়ার শেষ বাস সন্ধ্যে সাতটায়। অতএব এবারকার মত এখানেই বিদায় নিতে হবে।



গবেষণাগারে কাজের থেকে অব্যাহতি পেলেই সম্পত ঘোষ বেরিয়ে পড়েন নতুন কিছুর খোঁজে। সাইকেল চালানোটা খুব মিস করি, আজকাল হয়ে ওঠেনা, বই পড়া আর বেড়ানোর পরিকল্পনা করাটা চালিয়ে যাচ্ছেন।

  

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher