মহাবালেশ্বর ও টাপোলা
সমীরন সেন চৌধুরী
সকাল ছটায় নিশিজাগা বাসটা যখন মুম্বাই থেকে এসে দাঁড়াল মহাবালেশ্বরে, মার্চমাসের সকালের সূর্য তখনও নিদ্রামগ্ন। শেষরাতের হিম গায়ে মেখে গুটিকয়েক ট্যাক্সিচালক স্ট্যান্ডে যাত্রী ও ভোরের প্রতীক্ষায়। হোটেলের নাম বলতেই বয়স্ক এক চালক এগিয়ে এসে হাতের মালপত্র নিয়ে এগোলেন গাড়ির দিকে।
দুদিনের পড়ে পাওয়া ছুটিতে আমরা দুজনায় এসে পড়েছি সহ্যাদ্রি পর্বতমালার এই শৈলশহরে। ৪৫০০ ফুট গড় উচ্চতায় মার্চের্ প্রথমে আবহাওয়া ভারী মনোরম - হাল্কা শীত, গরম নেই। চারিদিক উপত্যকায় ঘেরা মহাবালেশ্বর ব্রিটিশ রাজত্বে ছিল বম্বে প্রদেশের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী। চিরহরিৎ অরণ্যে মোড়া ছবির মত সুন্দর, ছোট্ট এই শহরটি - ঝরনা, লেক ও জলপ্রপাতে ঘেরা।
হোটেলে চেক-ইন করে উপমা, স্যান্ডউইচ ও কফি সহযোগে প্রাতরাশ সেরে বেরিয়ে পড়া গেল সাদিক ভাইয়ের ইন্ডিকায় সওয়ার হয়ে। এ যাত্রায় তিনিই আমাদের ট্যুরগাইড-কাম-চালক। মারাঠা টানের হিন্দিতে বললেন, "প্রথমদিন মহাবালেশ্বর ঘুরে নিন। কাল নিয়ে যাব "টাপোলা"। কাশ্মীর তো দেখেছেন, আমাদেরও আছে "মিনি কাশ্মীর"।
প্রথমেই পৌঁছলাম বীণা লেকে। ১৮৪২ সালে সাতারার মহারাজা পাহাড় ও সবুজে ঘেরা নীল জলের এই লেকটির পত্তন করেন, যা পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণ। বোটিং-এরও ব্যবস্থা আছে, চাইলেই ভেসে পড়া যায় মনের মানুষটির সঙ্গে। পরের গন্তব্য "কেটস পয়েন্ট", এখান থেকে পাঁচ কিমি দূরে, অসাধারণ একটি ভিউপয়েন্ট। নীচে খাদের দিকে তাকালে নজরে আসে কৃষ্ণা নদীর উপর ধুম ড্যাম।
একই জায়গায় দেখে নিলাম "নিডল হোল পয়েন্ট" আর "ইকো পয়েন্ট"। প্রকৃতির খেয়ালে পাহাড়ের কোলে একটি পাথর ঠিক নিডল হোলের মতো দেখতে| আবার সবটা মিলিয়ে দেখলে ঠিক যেন হাতির শুঁড়। যেকোনো ভ্রমণ পত্রিকায় মহাবালেশ্বরের প্রচ্ছদচিত্র হিসাবে এই ছবিটিই দেখা যায়। ইকো পয়েণ্টে প্রিয়জনের নাম ধরে ডাকলে পাহাড় তা প্রতিধ্বনিত করে। প্রচুর ছোটো বড় বাঁদরে ভরা জায়গাটা।
এবারে চললাম স্ট্রবেরি গার্ডেন। মহাবালেশ্বরে প্রচুর ফলে – স্ট্রবেরি, গুসবেরি আর কর্ন। থোকা থোকা লাল স্ট্রবেরিতে ভরা লতানে গাছের বাগান দেখে ঢুকে পড়লাম সংলগ্ন কাফেটিতে। অর্ডার করলাম কর্ন প্যাটি ও স্ট্রবেরি ক্রিম। নরম-গরম প্যাটি ভাঙতেই মুখে পড়ল কচি কর্নের সিদ্ধ করা, মশলায় জারানো দানা। অপূর্ব তার সুঘ্রাণ। চামচ দিয়ে কেটে মুখে তুললাম মিস্টি স্ট্রবেরির টুকরোয় ভরা ফ্রেশ ক্রিম আর আইসক্রিমের পরতে সাজানো ঘন পানীয়। দামও সাধ্যের মধ্যেই।
এবারে জঙ্গলের রাস্তা ধরে পাহাড় টপকে চললাম অন্য এক পাহাড়চূড়ায়। এখানে দেখলাম আর্থার সিট। প্রায় ৪৮০০ ফুট উচ্চতায় পাহাড়চূড়াকে কেটে ঠিক যেন একটি ব্যালকনি তৈরি করা হয়েছে। শেষপ্রান্তে দাঁড়ালে মনে হয় যেন শূন্যে ঝুলে আছি। চারিধারে অতলস্পর্শী খাদ। বহু নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে নীল জলের ধারা - সাবিত্রী নদী। দক্ষিণদিকের রকের সাথে মিল খুঁজে পাওয়া যায় "গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন অব কলোরাডো"-র।
পাশাপাশি আছে ম্যালকম পয়েন্ট, টাইগার স্প্রিং, হান্টার পয়েন্ট ইত্যাদি। দেখা শেষ হলে উঠলাম গাড়িতে। এবারে শেষ দ্রষ্টব্য লডউইক পয়েন্ট, এলিফ্যান্ট হেড পয়েন্ট ও বম্বে পয়েন্ট (সানসেট পয়েন্ট)। এখানে একটু চড়াই-উৎরাই রাস্তায় হাঁটা আছে - প্রায় দুকিমি। হাঁটতে আলস্যি? কুছ পরোয়া নেই। ওই তো একজোড়া ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে। দক্ষিণা গুণে দিলেই মারাঠা সহিস হাজির হবে হাসিমুখে। বেলা কি ফুরিয়ে আসছে? একটু পা চালিয়ে চললাম। টাইগার হিলের সূর্যোদয় ও মহাবালেশ্বরের সূর্যাস্ত, কোনোটাই মিস্ করার নয়। দুজনায় চুপটি করে বসে দেখলাম শেষবেলার কমলা আলোয় চরাচর কেমন মায়াবী হয়ে উঠেছে! খুব ভাললাগার মুহূর্তগুলোয় কি একচিলতে বিষণ্ণতাও ছুঁয়ে যায়?
ফেরার পথে নেমে পড়লাম শহরের কেন্দ্রস্থলে শপিং এলাকায়। অনেকটা ম্যাল রোডের ধাঁচে এক কিমি রাস্তা জুড়ে আলো ঝলমলে, রকমারি পশরার দোকান্। কিছু কেনার না থাকে, উইন্ডো শপিং করা যায়। ছোট বড় অসংখ্য কাফে, রেস্টুরেন্টে সেরে নেওয়া যায় নৈশাহার, তবে কেন জানি না অধিকাংশই "বিশুদ্ধ শাকাহারী"!
দ্বিতীয়দিনে সকাল সকাল চললাম সাতাশ কিমি দূরে "টাপোলা" বা "মিনি কাশ্মীর"। কী আছে দেখবার? পাহাড় আছে, জঙ্গল আছে, আর আছে কোয়েনা ও সলসি নদীর সঙ্গমস্থল - যা শিবসাগর লেক নামে খ্যাত। প্রায় পঞ্চাশ কিমি জুড়ে এই লেকের ব্যাপ্তি। আছে রকমারি জলক্রীড়ার আয়োজন। পথে দু বার গাড়ি দাঁড়াল। প্রথমটি শ্যুটিং পয়েন্ট, বলিউডের বহু ছবির "লোকেশন" এই জায়গা। দ্বিতীয়টি ভিউ পয়েন্ট - এখান থেকে কোয়েনা নদীর এঁকেবেঁকে চলার যে দৃশ্য, তা মনে গেঁথে থাকে সারাজীবন।
টাপোলায় পৌঁছে দুজনায় ভেসে পড়লাম মনপবনের নাও-য়ে! নীল জলের বুকে গাঙচিলের মাছশিকার দেখতে দেখতে পার হয়ে গেলাম ছোটো ছোটো দ্বীপ। পছন্দ হলে নেমে পড়া যায় কোনো একটিতে। জলের সঙ্গে সেলফি তুলে আবার নাও ভাসানো যায়। পার হয়ে গেলাম লেকের ধারে ছবির মতো সাজানো রিসর্টগুলি। ঘন্টা দুয়েক কাটিয়ে এবার ফেরার পালা। পথে খাদের কিনারে এক নির্জন ধাবায় বসে গুজরাটি থালি দিয়ে সেরে নিলাম লাঞ্চ। ফেরার পথে দেখে নিলাম লিঙ্গমালা ওয়াটারফলস্। মার্চমাসে জলের ধারা একেবারেই ক্ষীণ, তবে বর্ষায় ভরভরন্ত। হাতে আর একটা দিন থাকলে ঘুরে আসা যেত পঞ্চগণি বা প্রতাপগড় ফোর্ট।
সন্ধ্যার আগেই শেষবারের মতো নেমে পড়লাম ম্যাল রোডে, বাড়ির জন্য কিনে নিলাম "গুসবেরি জেলি লজেন্স" আর "স্ট্রবেরি চিকি"।
পরেরদিন সকাল নটায় ফেরার বাস। মনটা ঈষৎ ভারী, এই ভিন্নস্বাদের শৈলশহরটিকে ছেড়ে যাব আজ! স্মৃতিকোঠায় রয়ে গেল কোয়েনা নদী, সূর্যাস্তের কমলা আলো আর গাংচিলের ডাক।
পেশায় বিমানকর্মী সমীরন সেন চৌধুরীর নেশা দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ানো ও সেই ভ্রমণবৃত্তান্ত লেখা।