স্পেনে - মাদ্রিদ ও টোলিডোয়

সিদ্ধার্থ চৌধুরী


স্পেনে যাবার আইডিয়াটা ছিল স্ত্রীর। গরমের ছুটিতে দশদিনের জন্যে স্পেনে বেড়াতে গেলে কেমন হয়? বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপের মধ্যে স্পেনই হচ্ছে সবচেয়ে নিরাপদ। যাহা বলা তাহা কাজ! বাড়ির সবাইকার সম্মতি পেয়ে স্পেনে যাবার ব্যবস্থা শুরু হয়ে গেলো। আমার এক বিশেষ বন্ধু স্পেনে মাদ্রিদে থাকবো শুনে টোলিডো বলে একটা শহর দেখতে বলেছিল। ঠিক করেছিলাম টোলিডোতে যাব। প্রাচীন স্পেনের সুন্দর নিদর্শন। মাদ্রিদ থেকে বেশি দূরে নয়। কিন্তু নাকি ফ্যাসিনেটিং! স্পেনের ভৌগোলিক অবস্থান বোঝানোর জন্য দেওয়া ম্যাপে দেখা যাচ্ছে স্পেনের উত্তর-পূর্বে ফ্রান্স, পশ্চিমে পর্তুগাল, দক্ষিণে জিব্রালটার প্রণালী এবং সেটা পেরিয়ে আরো দক্ষিণে গেলে শুরু হল আফ্রিকা। তার প্রথম দেশটা হল মরোক্কো। জলপথে ন্যূনতম দূরত্ব যার হল নয় মাইল। অবশ্য জিব্রালটার ক্রস করতে হবে। মাদ্রিদের দক্ষিণ দিকে একটু এগোলেই টোলিডো।
সালটা ২০১৭। ঠিক হলো ১০ অগাস্ট আমরা লস এঞ্জেলেস থেকে বেরোবো। প্রথম রাত্তিরে থাকবো মাদ্রিদে। পরের দিন সকাল বেলা বেরোবো টোলিডোর উদ্দেশ্যে। টোলিডোতে পাঁচঘন্টা কাটিয়ে আবার মাদ্রিদে চলে আসব। যদিও পুরো ট্রিপটা চারটে বড় জায়গায় থাকবার জন্যে ঠিক করেছিলাম, এই লেখাটা শুধু কিছুটা মাদ্রিদ এবং টোলিডোতে আমাদের পাঁচঘন্টা অবস্থানের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

মাদ্রিদ
কাঁটায় কাঁটায় সকাল সাতটায় মাদ্রিদে নামলাম। এয়ারপোর্ট থেকে বেরোতে কোনো ঝামেলা নেই। আটটা নাগাদ এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে এসে দেখি অনেক ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। প্লেনে সারাক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম। সুন্দর রোদে ঝলমল সকাল। আমার প্রথম ইউরোপে ট্যাক্সি চড়া। একটা অজানা রোমাঞ্চ যেন সারা গায়ে কাঁটা ধরিয়ে দিচ্ছিল। আমি ড্রাইভারের পাশে বসে আর আমার স্ত্রী এবং দুই মেয়ে পেছনের সিটে। সেলফোনে রাস্তার আশপাশের ফটো তুলছিলাম। একটা জিনিস বিশেষ ভালো লাগলো না। রাস্তার দুপাশের দেওয়ালে শুধু গ্র্যাফিত্তি। লস এঞ্জেলেস বা নিউ ইয়র্কের ফ্রিওয়েগুলোর পাশের দেওয়ালে গ্র্যাফিত্তি দেখতে দেখতে একটা যেন বিতৃষ্ণা জন্মে গেছে মনের মধ্যে। স্পেনে এসেও একই জিনিস দেখতে হবে ভাবিনি। গ্র্যাফিত্তি হলো দেওয়ালে আঁকা ছবি। সুন্দরভাবে আঁকা থাকলে তা হয়তো দৃষ্টিনন্দন হয়। তাই না? দা ভিঞ্চি বা নন্দলাল বসু আঁকলে আমার আপত্তি নেই, কিন্তু তাঁদের মতো আর্টিস্টদের সময় নেই বা প্রবৃত্তি নেই। আমেরিকা বা ইউরোপেও সেই একই অবস্থা। ব্যাপারটা মেনে নিতে হবে। অনেক কথা ভাবতে ভাবতে হোটেলে পৌঁছে গেলাম। সন্নিহিত অঞ্চল অনেক পুরোনো দিনের। কিন্তু পরিষ্কার। হোটেলটাতে নতুন এবং পুরনোর সংমিশ্রণে যেন নতুনেরই জয় হয়েছে বলে মনে হচ্ছিল।


Riverac / CC BY

হোটেলে এসে জিনিসপত্তর নামিয়ে ঠিক করা হল শহরটাকে দেখতে হবে। স্পেনে আসার আগে আমার লস এঞ্জেলেসের বন্ধুদের মধ্যে যারা আগে ঘুরে স্পেনে ঘুরে গেছে তাদের সঙ্গে স্পেনে কী করা উচিত, কী দেখা উচিত তা নিয়ে কথা বলেছিলাম। পরের দিনের জন্যে প্রথমেই হোটেলের রিসেপশন ডেস্ক থেকে টোলিডোর টিকেটটা কিনেছিলাম। কিন্তু আজকে কী করব? হোটেল থেকেই 'হপ-ইন-হপ আউট' বাসের টিকেট কিনে ফেললাম। আমরা লাল রুটের বাসের টিকেট কিনেছিলাম। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই বাসগুলো সারাদিন নিজেদের রুটে চলে। সারা মাদ্রিদে চারটে এরকম রুট আছে লাল-নীল-সবুজ এবং হলুদ। এক-একজনের প্রতিদিনের জন্যে পঁচিশ ইউরো খরচা করলে যে কোনো রুটের বাস এক্সচেঞ্জ করা যেতে পারে। কতকগুলো স্টপেজ আছে যেখানে সব রুটের বাসই দাঁড়ায়। আপনাকে একটা ম্যাপ ধরিয়ে দেবে। ব্যাপারগুলো বেশ জটিল। আগে থেকে রিসার্চ করে না এলে কোথায় কোথায় থামতে হবে সেগুলো বার করতেই বেশ সময় লাগে। আপনার কাছে হয়তো লাল রুটের বাসের টিকেট আছে। এর পরে কোনো জায়গা আপনি যদি দেখতে চান সেটা হয়তো সবুজ রঙের রুটের আওতায় পরে। সুতরাং আপনাকে দেখতে হবে কোন কোন জংশনে লাল রুটের টিকেট দেখিয়ে সবুজ রুটের টিকেটের বাসগুলোতে ট্র্যান্সফার করা যায়। আপনার পরের দেখবার জায়গাটা হয়তো নীল রুটের বাসগুলো থেকে যেতে হবে। এই মুহূর্তে আপনি হয়তো সবুজ রুটের বাসে আছেন। আপনাকে দেখতে হবে কোন জংশনে নীল এবং সবুজ রুটের বাসেরা দাঁড়ায়। ব্যাপারটা কী বলছি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন। ধরুন আপনি এই মুহূর্তে হলদে রুটের বাসে আছেন। আপনাকে হোটেলে ফিরতে হলে লাল রুটের বাসে উঠতে হবে। আপনার হলদে এবং লাল রুটের জংশন থেকে লাল রুটের বাস ধরতে হবে। ঠিকমত প্ল্যানিং না করতে পারলে আপনার সেই রাতে বাসে করে হোটেলে ফেরা নাও হতে পারে। 'জয় কালী, যা হবার হবে' বলে সকাল সাড়ে দশটার সময় বেরিয়ে পড়া গেল। সাড়ে এগারোটা নাগাদ বাসে উঠে পড়লাম। শুরু করেছিলাম লাল রুটে। এদিক ওদিকে তাকাচ্ছি আর অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম। ঐশ্বর্য আর ঔদ্ধত্য যেন উথলে উথলে পড়ছে। ঔদ্ধত্যটা কিন্তু মার্জিত। স্পেনের ইতিহাস সম্বন্ধে আমার খুব একটা ধারণা নেই। তবে যা দেখছিলাম তাতে বুঝতে পারছিলাম এই এতো ঐশ্বর্য, এতো প্রাচুর্য্যের পেছনে আছে অনেক খ্রীষ্টান ধর্মপ্রচারকের প্রবঞ্চনা, স্প্যানিশ উপনিবেশের অত্যাচার এবং তার সঙ্গে মিশে আছে আফ্রিকা এবং উত্তর এবং দক্ষিণ আমেরিকার দুঃস্থ মানুষদের কান্না এবং রক্ত। প্রথমে যে স্টপেজে নামলাম সেটা হলো বিশ্বখ্যাত 'ডেল প্রাডো মিউজিয়াম'।


OsvaldoGago / CC BY

ডেল প্রাডো বা সংক্ষেপে প্রাডো মিউজিয়াম স্পেনের বা বলতে গেলে সারা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আর্ট মিউজিয়ামগুলোর মধ্যে অন্যতম। মিউজিয়ামটি তৈরি হয়েছিল ১৮১৯ সালে - মূলতঃ চিত্র এবং ভাস্কর্য প্রদর্শনীর মিউজিয়াম হিসেবে। স্প্যানিশ পেন্টারদের মধ্যে ফ্রান্সিস্কো গোইয়া, দিয়েগো ভ্যালেসকুয়েজ, সালভাদোর দালি, পাবলো পিকাসো ছাড়াও এল গ্রেকো, হিয়েরোনিমোস বস্ক, তিশিয়ান, পিটার পল রুবেন্স এবং আরও নানান নামী-অনামী শিল্পীর বিশাল আর্টের সংগ্রহ এখানে আছে। এছাড়াও ব্রিটিশ, ফ্রেঞ্চ, জার্মান এবং রাশিয়ান পেইন্টারদের আঁকা ছবিও এই মিউজিয়ামে রয়েছে। চোখের সামনে এত সব ছবি দেখতে দেখতে যেন নির্বাক হয়ে যাচ্ছিলাম। এইসব অনুভব করার জন্য সমঝদার হবার দরকার নেই। টু ডাইমেনশন্যাল ছবি শিল্পীর আঁকার গুণে যেন থ্রি ডাইমেনশন্যাল বলে মনে হচ্ছিল। বিশাল বিশাল ফ্রেমে বাঁধানো ক্যানভাস সব দেয়ালে লাগানো - দেখলে বিশ্লেষণ না করে সরতে ইচ্ছে করে না। ছবি তোলা নিষেধ। প্রত্যেকটি ছবির একটা করে ইতিহাস আছে। অনেকগুলিই স্পেনের রাজা রানি এবং রাজবংশের বিভিন্ন লোকেদের সম্মিলিত চিত্র। মনে হচ্ছিল যেন ছবির কোনো চরিত্রকে প্রশ্ন করলে সে ছবি থেকে নেমে এসে জবাব দেবে। এতো জীবন্ত! আফসোস লাগছিলো ছবি তুলতে পারা যাবে না বলে। ঘন্টাদুয়েক মিউজিয়ামে ঘুরে বেরিয়ে পড়া গেলো। মিউজিয়ামের পাশেই একটা বোটানিক্যাল গার্ডেন। নাম 'রিয়েল জারদ্যাঁ বোটানিকো দি মাদ্রিদ'। কিছুক্ষণ বাগানে ঘুরে একটা গাছের নিচে এসে বসলাম। মেয়েরা বললো ওরা আরো কিছুক্ষণ বাগানে ছবি তুলবে। তথাস্তু! গাছের ছায়ায় বসে চোখটা যে কখন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তা মনে নেই। বউয়ের হাতের ঠেলায় উঠে পড়লাম। মেয়েরা ফিরে এসেছে। রাস্তা ক্রস করে একটা রেস্তোরাঁতে বসে ভালো করে খেয়ে আবার বাসে উঠে পড়লাম।
মাদ্রিদের রাস্তায় আমাদের বাস চলছে। ডানদিকে বাঁদিকে যেদিকে তাকাই দেখি পুরোনো সুন্দর সুন্দর বাড়ি, চার্চ, লাইব্রেরি, ক্যাথিড্রাল আর ব্যাসিলিকার ছড়াছড়ি। কোনটা হয়তো পাঁচশো বছরের পুরোনো আর কোনোটা হয়তো হাজার বছরের পুরোনো। বেশ কিছুক্ষণ পরে মেয়েরা একটা স্টপেজে নেমে পড়তে বললো। একটু হাঁটলেই নাকি একটা প্যালেসে গিয়ে পৌঁছবো। কোথায় প্যালেস? বাসস্টপ থেকে প্রায় এক মাইল হেঁটে একটা বেশ সুন্দর জায়গায় এসে পৌঁছলাম। একটা সুন্দর হাঁটার জায়গা। সামনে রেলিং এবং রেলিংয়ের পেছনে একটা সুন্দর লেক। অনেক বেলা হয়েছে। লেকের পাশ দিয়ে হেঁটে যদি প্যালেসে পৌঁছনো যায় সেই ভেবে হাঁটতে শুরু করলাম। সুন্দর চওড়া রাস্তা আর দুপাশে লম্বা লম্বা গাছ। মাঝে মাঝে বসবার জন্যে বেঞ্চ। মাইল দুয়েক হাঁটার পরেও প্যালেসের খোঁজ পাওয়া গেলনা। আজ প্রায় আট মাইল হাঁটা হয়ে গেছে। পার্কটা ভারী সুন্দর। দুপাশে নানারকম মনোরঞ্জক গাছের সারি। সুন্দর বাতাস বইছে। পেট ভরপুর। কোনো কিছু চিন্তা না করে ওই গাছের বেঞ্চিতে বসে পড়লাম। প্রায় সাড়ে আট মাইল হন্টন হয়ে গেছে। সুতরাং নিদ্রা অনিবার্য। নিদ্রা ভাঙলো ছোট মেয়ের গলা শুনে। স্থানকাল ভুলে একটা পাবলিক প্লেসে আমি নাকি নাক ডেকেছিলাম বা আমার নাসিকা গর্জন করেছিল। আমার মনে নেই। এই প্রাসাদটা বোধহয় আজ আর দেখা হবে না। লাল বাসের দেখা নেই। একটা ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে ফেরার কথা বলতে দেখলাম অন্যদের কোনো আপত্তি নেই। সুতরাং আরো দেড় মাইল হেঁটে একটা বড় রাস্তার মোড়ে গিয়ে সবাই মিলে ট্যাক্সি ধরার জন্যে দাঁড়ালাম। অজানা অচেনা শহরে আমি রাত্তির বেলায় তিনজন মেয়েকে নিয়ে পথ হারাতে চাই না। দুমিনিটের মধ্যে একটা ট্যাক্সি পাওয়া গেলো। সবাই ক্ষুধার্ত। মেয়েদের জিজ্ঞাসা করলাম কে কী খেতে চায়। সবাই 'পায়া' খেতে চায়। পায়া হচ্ছে স্প্যানিশদের অত্যন্ত পছন্দের খাবার। অনেকটা আমাদের বিরিয়ানির মতো। মেয়েরা হোটেলের রিসেপশনিস্টের সঙ্গে বাসট্রিপ শুরু করার আগে রেস্তোরাঁর নামধাম সব জেনে এসেছিল। হোটেলের আশেপাশের কোনো রাস্তাতেই আছি। রেস্টুরেন্টটা যেন ধরা দিতে চাইছে না। গুগুল ম্যাপে খোঁজাখুঁজি চললো বহুক্ষণ ধরে। মাদ্রিদের রাস্তা যেন উত্তর কলকাতার গলিগুলোর মতো। আমার পেটের নাড়িভুঁড়ি যেন জ্বলে যাচ্ছিল। বাকি সবাইকার একই অবস্থা। অবশেষে পায়াকে ক্ষমা দিয়ে একটা চব্বিশ ঘন্টার স্যান্ডউইচের দোকানে খেয়ে ট্যাক্সি চড়ে হোটেলে ফিরলাম। হোটেলের দু-একটা ব্লক পেছনে ছিলাম আমরা। ট্যাক্সির ভাড়া উঠলো মাত্র সাড়ে চার ইউরো। মাদ্রিদের প্রথম রাত। সাড়ে চার ইউরোর বদলে পাঁচ মিনিট বসার সুযোগ পাওয়াও যেন একটা পাওনা। ছোট মেয়ে সেলফোনে দুএকটা বাটন টিপে বলল ' আমরা আজ সাড়ে দশ মাইল ওয়াক করেছি।'পরেরদিন সকাল সাতটায় হোটেলের লবি থেকে ট্যুর কোম্পানির লোক আমাদের নিয়ে যাবে। সুতরাং সকাল ছটার সময় উঠে পড়তে হবে। জামাকাপড় ছেড়ে সেলফোনে ছটার সময় অ্যালার্ম দিয়ে বিছানায় শুয়েই ঘুম।
অ্যালার্মের শব্দে ঘুম না ভাঙলে বোধহয় অনন্তকাল ঘুমোতে পারতাম। প্রথম কাজ মেয়েদের ঘুম থেকে তুলে দিয়ে রেডি হতে বলা। ওরা পাশের ঘরেই ছিল। দরজায় টোকা মারতেই প্রবল আপত্তি। 'উই উইল বি রেডি বাবা, ডোন্ট ওরি' শুনে নিজের ঘরে ফিরে এসে কুড়ি মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে গেলাম। উল্টোদিকেই একটা রেস্টুরেন্ট থেকে কিছু মাফিন, টোস্ট এবং কফি তুলে নিয়ে হোটেলের লবিতে ফিরে এলাম ছটা বেজে বাহান্ন মিনিটে। ছটা বেজে পঞ্চান্ন মিনিটে মেয়েরা লবিতে এল। সেখানে বসেই আমরা গোগ্রাসে খাবারগুলো খেতে শুরু করলাম। ট্যুরকোম্পানির এক মহিলা রিসেপশন ডেস্কে এসে পৌঁছলেন সোয়া সাতটা নাগাদ। স্প্যানিশদের এই গা-ছড়ানো ভাবটা আমার ভালোই লাগছিলো। বাসে উঠলাম সাড়ে আটটা নাগাদ। যাচ্ছি টোলিডোতে।

টোলিডো
বাসে তো উঠলাম। বাসটা এদিক সেদিক ঘুরে এই হোটেলে ওই হোটেলে লোক তুলে যখন সত্যিকারের যাত্রা শুরু করলো তখন প্রায় দশটা বাজে। বাসে মাদ্রিদ থেকে টোলিডো মাত্র দেড় ঘন্টার পথ। একটা সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে বাসটা দাঁড়ালো। এর পরে একটার পরে একটা এস্কালেটরে চড়ে আমরা প্রায় দু-তিন হাজার ফুট ওপরে পৌঁছে গেলাম। আমাদের গাইড ছিল ভারী সুন্দরী কিন্তু ইংরেজি বলতে পারছিলো না। ভীষণভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছিলো আমাদের ইংরেজিতে বোঝানোর।
টোলিডো সেন্ট্রাল স্পেনের একটা নামকরা ঐতিহাসিক শহর। ১৯৮৬ সালে ইউনেস্কো টোলিডোকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। স্পেনের অনেক নামী লোকজন টোলিডোতে বসবাস করেছেন। যাদের মধ্যে আছেন ব্রূনহিলডা অফ অস্ট্রেশিয়া, আল -জারকালি, আলফনসো এক্স, গার্সিলাসো দে লা ভেগা, ইলিয়ানোর অফ টোলিডো এবং এল গ্রেকো। এঁদের সম্বন্ধে কিছু বলে নিই।
ব্রূনহিলডা অফ অস্ট্রেশিয়া - ব্রূনহিলডা সম্ভবতঃ জন্মেছিলেন ৫৪৩ সালে এবং বেঁচেছিলেন ৬১৩ সাল অবধি। ঠিক কতদিন উনি টোলিডোতে ছিলেন তা কেউ সঠিক বলতে পারবে না। উনি বিয়ে করেছিলেন মেরোভিঙিয়ানের রাজা সিগেবের্ট ওয়ান অফ অস্ট্রেসিয়াকে। তাঁকে ভীষণ নৃশংসভাবে খুন করা হয়।
আল -জারকালি - 'আবু ইশাক ইব্রাহিম ইবন ইয়াহিয়া আল নাককাস আল -জারকালি' বা সংক্ষেপে 'আল জারকালি' ছিলেন এক আরব মুসলিম যিনি নাকি বাদ্যযন্ত্র তৈরি করতেন। তিনি ছিলেন সেইসময়ের একজন জ্যোতিষী তথা জ্যোতির্বিদ। 'Arzachel- (আর্যাচেল)' নামে চাঁদের একটা ক্রেটার ওঁর নামে দেওয়া হয়েছে। জন্মেছিলেন টোলিডোর পাশে একটা গ্রামে ১০২৯ সালে এবং বেঁচেছিলেন ১০৮৭ সাল পর্য্যন্ত। এছাড়াও ধাতবদ্রব্য নিয়ে কাজ করতে ভালোবাসতেন; তাঁর নাম হয়ে গিয়েছিলো আল নেক্কাছ' বা 'খোদাইকার'। ১০৮৫ সালে খ্রীষ্টান রাজা আলফনসো সিক্স টোলিডো জয় করেন। আল জারকালি টোলিডো ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। কেউ জানেনা উনি কর্ডোবা বলে একটা শহরে পালিয়ে গিয়েছিলেন বা কোনো মুরিশ রেফিউজি ক্যাম্পে মারা গিয়েছিলেন কিনা।
আলফনসো এক্স - আলফনসো এক্স জন্মেছিলেন ১২২১ সালের তেইশে নভেম্বর এবং মারা যান চৌঠা এপ্রিল ১২৮৪ সালে মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে সেভিলে। আলফনসো এক্স ছিলেন এক বীরযোদ্ধা এবং রাজা। এছাড়াও ছিলেন একজন কবি, একজন কৃষক শ্রমিক নেতা এবং একজন প্রেমিক। উনি ছিলেন রোম্যান ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বী কিন্তু যে কোনো ধর্মের (মুসলিম, খ্রিস্টান বা ইহুদি) লোকজন ওনার দরবারে এসে তাঁদের দাবি বা মতামত ব্যক্ত করতে পারত এবং সুবিচার নিয়ে ফিরে যেতে পারত। ঠিক কতদিন উনি টোলিডোতে ছিলেন সেটা বলা মুশকিল।
গার্সিলাসো দে লা ভেগা - গার্সিলাসো দে লা ভেগা ছিলেন একাধারে একজন যোদ্ধা এবং কবি। সম্ভবতঃ জন্মেছিলেন ১৫০১ সালে এবং মারা যান ১৫৩৬ সালে, মাত্র পঁয়তিরিশ বছর বয়সে। কিন্তু তার মধ্যেই তাঁর অপরিসীম প্রতিভার দান স্পেনের সাহিত্যজগতে ছাপ ফেলেছিলো।
ইলিয়ানোর অফ টোলিডো - ইলিয়ানোর অফ টোলিডো জন্মেছিলেন ১৫২২ সালে এবং মারা যান ১৫৬২ সালে। উচ্চবংশীয় এই মহিলা খুব সুন্দরী ছিলেন এবং তাঁর জীবদ্দশায় তিনি স্পেনের একজন সন্মানীত নারী হিসেবে জীবন কাটিয়েছিলেন। মাত্র সতেরো বছর বয়সে উনি বিয়ে করেছিলেন তখনকার দিনের ইতালির বিখ্যাত মেদিচি ফ্যামিলিতে। তাঁর স্বামী ছিলেন 'কসিমো I ডি মেদিচি (Cosimo I de' Medici)'। স্বামী স্ত্রী দুজনেই ধার্মিক ছিলেন এবং তাঁদের দাম্পত্যজীবন ছিল অত্যন্ত সুখের এবং শান্তিপূর্ণ। বিবাহের তেইশ বছরের মধ্যে ওনাদের এগারোটি সন্তানসন্ততি হয়। বিয়ের পরে তাঁরা ইতালির ফ্লোরেন্সে চলে যান এবং সেখানেই বসবাস শুরু করেন। তাঁদের জীবনযাপন খুব বিলাসবহুল ছিল। তৎকালীন ইতালিয়ান সমাজেও অত্যন্ত সম্মানীত ইলিয়ানোর অফ টোলিডো ম্যালেরিয়াতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান 'পিসা' শহরে।
এল গ্রেকো - এল গ্রেকোর (বা 'দ্য গ্রীক') আসল নাম হলো ডোমেনিকাস থিওটোকোপোলাস। ১৫৪১ সালে গ্রীসের 'ক্রীট' নামে এক দ্বীপে উনি জন্মেছিলেন, যদিও সেই সময় দ্বীপটি 'রিপাবলিক অফ ভেনিস' এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইতালির ভেনিস তখন এক সার্বভৌম শাসকের অধীনে ছিল। ভেনিসের শাসককে বলা হতো 'ডোগে অফ ভেনিস (Duke of Venice)' । কোনো 'ডোগে' মারা গেলে পরবর্তী 'ডোগে' কে হবেন তা ঠিক করতেন ভেনিসের অভিজাত নাগরিকেরা। সবচেয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তির ওপরে এই কাজের ভারটা দেওয়া হত। ৬৯৭ খ্রীস্টাব্দ থেকে ১৭৯৭ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত ইতালির উত্তরপূর্ব অঞ্চলের মধ্যমণি ভেনিস নিজেদের সার্বভৌমত্ব বজায় রেখেছিল। 'এল গ্রেকো' ২৬ বছর বয়সে 'ক্রীট' থেকে ভেনিসে চলে যান। অন্যান্য গ্রীক আর্টিস্টরাও তাই করতেন। ১৫৭০ সালে উনি রোমে যান এবং একটার পরে একটা ছবির কাজ করেন।। ১৫৭৭ সালে 'এল গ্রেকো' প্রথমে মাদ্রিদে এবং ওই বছরেই পরে টোলিডোতে চলে আসেন।

গতকালই প্রাডো মিউজিয়ামে 'এল গ্রেকো'র ছবিগুলো অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে দেখেছিলাম। একটা ছবি আমার মনে এখনো লেগে আছে। ক্যানভাসের ওপরে তেলরঙে আঁকা ছবিটি পনেরো ফুট দশ ইঞ্চি উঁচু এবং প্রস্থে এগারো ফুট আট ইঞ্চি।

José Luis Filpo Cabana / CC BY
ডন গঞ্জালো লুইস নামে সেইসময়ের একজন স্থানীয় খ্যাতনামা লোকের মৃতদেহ সমাধিস্থকরণের চিত্ররূপ। ডন গঞ্জালো লুইস ছিলেন টোলিডোর বাসিন্দা এবং টোলিডোর পাশেই 'অর্গাজ' বলে একটা শহরের একজন মাননীয় নাগরিক ছিলেন। মৃত্যুর পরে তাঁর পরিবারকে 'কাউন্ট' উপাধি দেওয়া হয়েছিল। 'কাউন্ট অফ অর্গাজ' ছিলেন একজন সত্যিকারের সুন্দর মানুষ। নানারকমভাবে মানুষকে সাহায্য করতেন তিনি। নানান চ্যারিটি ছাড়াও তিনি অনেক টাকা 'চার্চ অফ স্যান্টো ডোমে' কে দান করেন। এল গ্রেকো ওই চার্চেই যেতেন এবং 'কাউন্ট অফ অর্গাজ'-এর সমাধির সময় উনি উপস্থিত ছিলেন। কথিত আছে 'কাউন্ট অফ অর্গাজ' কে সমাধিস্থ করার সময় 'সেন্ট স্টিফেন' এবং 'সেন্ট অগাস্টিন' স্বর্গ থেকে নেমে আসেন এবং তাঁরা স্বহস্তে 'কাউন্ট অফ অর্গাজ'কে কবর দেন। ছবিটি মনে পড়ছিল - যেখানে তাঁকে কবর দেওয়া হচ্ছে, সেখানে অনেক মানুষের ভিড়। হলুদ গাউন পরে দুজন হলেন 'সেন্ট স্টিফেন' এবং 'সেন্ট অগাস্টিন'। ঠিক পেছনে ঘাড় বেঁকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন স্বয়ং 'এল গ্রেকো'। নিচের লেভেলের সবাইকার ঠিক মাথার ওপরে আরেকটি স্তর। ওটা হচ্ছে স্বর্গ। সবচেয়ে ওপরে যীশুখ্রিষ্ট সাদা পোশাকে মোড়া। নিচে ম্যাডোনা, 'সেন্ট জর্জ' এবং 'দ্বিতীয় ফিলিপ' (যদিও উনি তখন বেঁচে ছিলেন)। নিচের লেভেলে কালো রঙের পোশাক পরা মানুষেরা যেন শোকের ছায়ায় মুহ্যমান। স্বর্গে যীশু এবং ম্যাডোনারা তাঁকে তুলে নেবার জন্যে প্রস্তুত। অসাধারণ ! মনে হচ্ছিল ওই যুগে যদি ফিরে যেতে পারতাম। অন্তত কয়েক ঘন্টার জন্যে।
টোলিডো বা ল্যাটিন ভাষায় টোলেটাম-এর কথা রোমান ঐতিহাসিক লিভির খ্রিস্টপূর্ব ৫৯ থেকে ১৭ খ্রিস্টাব্দ ) বর্ণনায় আছে। লিভির কথা অনুযায়ী মার্কাস ফুলভিউস নোবিলিওর নামে একজন রোমান জেনারেল খ্রিস্টপূর্ব ১৯৩-তে টোলিডোর কাছেই একটা শহরে কিছু স্থানীয় উপজাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয় করে তাদের রাজা 'হিলেরমুস' কে বন্দি করেন। টোলিডোতে এই সময় 'কার্পেটানি' বলে একটা উপজাতি রাজত্ব করতো এবং এটা 'কার্পেটানিয়া' বলে একটা জায়গার অন্তর্ভুক্ত ছিল। নোবিলিওর কার্পেটানিয়া জয় করে স্থানীয় লোকেদের রোমান নাগরিকত্ব দেন এবং টোলিডোর উন্নতির দিকে মন দেন। টোলিডোতে এই সময় অনেক রাস্তা, স্নানাগার, জল সরবরাহ ব্যবস্থা, প্রাচীর এবং একটা উন্মুক্ত স্টেডিয়াম তৈরি করা হয়েছিল (উন্মুক্ত স্টেডিয়ামকে তখনকার দিনে বলা হতো সার্কাস)। এখানে বাজি ধরে 'রথের দৌড়' (CHARIOT RACE) হত এবং যাবতীয় সামাজিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বা মিটিং এই সার্কাসেই বা স্টেডিয়ামেই হতো। স্টেডিয়াম বা সার্কাসটাতে আনুমানিক পনেরো হাজার লোক ধরতো। ধরুন আজ থেকে ২২০০ বছর আগে এই সব ঘটনাগুলো টোলিডোতে হচ্ছিল। আমি মাঝে মাঝে বসে বসে ভাবছিলাম। গাইড আমাদের যে জায়গাটাতে তুলে এনেছিল সেটা টোলিডোর সবচেয়ে উঁচুতে। একটা চত্ত্বরের মধ্যে নিয়ে এলো যেখানে পাশাপাশি সেন্ট ইগলেসিয়া চার্চ এবং পাশেই এল গ্রেকোর সমাধিস্থল।


Arturo Mann / CC BY-SA

রাস্তাটা বাঁক ফেরাতেই আরো একটা মিউজিয়াম ভিসিগথ সংস্কৃতির ওপরে। ভিসিগথরা জার্মানির থেকে এসেছিলো। ওদের জীবনযাত্রা অনেকটা বেদুইনদের মতো ছিল। ভিসিগথরা খুব সম্ভবতঃ ৫৪৬ সাল থেকে ৭২০ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করে। এর পরে আসে আফ্রিকা থেকে ইসলামিক মুরেরা। মুর বলতে বোঝায় আফ্রিকার কালো মুসলমানদের। শেক্সপীয়ার-এর 'ওথেলো' তে ওথেলো ছিল মুর। উইট্টিজা নামে এক ভিসিগথ রাজার মৃত্যুর পরে রুডরিক বলে আর একজন টোলিডোর রাজা হন। কিন্তু রাজত্ব ভেঙে পড়ছিলো। ইতিমধ্যে 'মুসা ইবন নাসের' নামে একজন আরবি মুসলমান টোলিডোর কাছে কিছু জায়গার দখল নিয়ে নেন। 'তারিক বিন জিয়াদ' ছিলেন মুসার সেনাপতি। রুডরিকের মৃত্যুর পর ভিসিগথদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তারিক সম্ভবতঃ ৭১১ বা ৭১২ সালে টোলিডো জয় করেন।
টোলিডোতে যুদ্ধে জেতার পরে মুসা এবং তারিক দামাস্কাসে (সিরিয়া) ফিরে যান। স্পেনের আরবিক মুসলমান রাজত্ব প্রথমে সেভিলে শুরু হলেও পরে তা কর্ডোবাতে নিয়ে যাওয়া হয়। কর্ডোবাতে আল আন্দালুসের রাজ্যপাল ছিলেন তখন 'আবাদ আল মালিক ইব্ন কাতান' নামে এক মুসলমান। মুরদের এই ইতিহাস চলে ১০৮৫ সাল অবধি। অর্থাৎ প্রায় ৩৭৩ বছর ধরে। ১০৮৫ সালের ২৫ শে মে 'আলফনসো ৬' প্রথম খ্রীষ্টান হিসেবে টোলিডো জয় করেন। আলফনসো ৬ কিন্তু কোনো মুসলমান বা ইহুদিদের সংস্কৃতির ওপরে অত্যাচার করেননি। উল্টে তিনি অনেক মুসলিম এবং ইহুদি পণ্ডিতদের দিয়ে ওদের লাইব্রেরির বইগুলিকে স্থানীয় ভাষায় অনুবাদ করিয়েছিলেন। এদিক সেদিক ঘুরিয়ে গাইড আমাদের বললো যে আমরা এখন ইহুদিদের (jew) কোয়ার্টারে এসে গেছি। একটা চড়া বিচ্ছিরি গন্ধ যেন আমার নাকে এসে লাগলো। এ গন্ধ আমার চেনা ! গন্ধটা যেন কয়েকশো বছরের পুরোনো। আমার ছোটবেলার কয়েকটা বছর কেটেছিল কলকাতার জোড়াবাগানে। একটা ছানাপট্টি ছিল আমাদের বাড়ির কাছেই। ওই ছানাপট্টির পাশ দিয়ে গেলেই একটা যেন পচা গন্ধ আমি পেতাম। আমার নাকে ওই ছানাপট্টির গন্ধটা যেন ধক করে এসে লাগলো। এ গন্ধ যেন হাজার বছর আগের পৃথিবীর গন্ধ। বারোশো এবং তেরোশো সালে স্পেনের অনেক ধনী ইহুদিরা এই অঞ্চলটাতে থাকতো। রাস্তার দুপাশে সুন্দর সুন্দর বুটিকের দোকান, সুন্দর সুন্দর রেস্টোরেন্ট, এবং আরো অনেক রকমের জমজমাট দোকানের সারি। এই অঞ্চলটাকে সম্মান দেবার এবং চিহ্নিত করার জন্য ইজরায়েলি সরকার রাস্তার ওপরে কিছু ফলক লাগিয়েছে। স্ত্রী এবং মেয়েরা কিছুটা এগিয়ে গিয়েছিলো। আমি বোঝাতে পারবোনা কিভাবে যেন একটা অন্য রকম সেন্সেশন শরীরে ফিল করছিলাম। কিছুক্ষণ একটা বেঞ্চে বসে একটু এগিয়ে গিয়েই দেখলাম একটা সিনাগগ।
সিনাগগটার নাম 'সান্তা মারিয়া লা ব্লাঙ্কা'। সিনাগগটি তৈরি করেছিল মূরেরা সম্ভবতঃ ১২০৫ সাল নাগাদ। সিনাগগটা নিঃসন্দেহে পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো সিনাগগ। সামনে একটা খোলা চত্বর এবং ভেতরে ইহুদিদের প্রার্থনার জায়গা। ভেতরে ঢুকলে মনে হবে না প্রায় আটশো দশ বছর আগে এটা তৈরি হয়েছিল। আলো ঝলমলে দালান, নতুন রং করা দেয়াল আর ঝাঁ-চকচকে মেঝে দেখে কেউ যদি আপনাকে বলে এই বাড়িটা ছমাস আগে তৈরি হয়েছে, আপনি কোনো আপত্তি করতে নাও পারেন। সিনাগগ থেকে বেরিয়ে কিছুটা সোজা গিয়ে ডানদিকে টার্ন করতেই একটা 'মনাস্টেরি' দেখতে পেলাম। নাম হচ্ছে 'Monastery of San Juan de Los Reyes'।
Cesar / CC BY-SA
মনাস্টেরিটা তৈরি করেছিলেন আরাগনের শাসক ফার্ডিনান্ড II এবং ক্যাস্টিলের রানি ইসাবেলা l ১৪৭৬ সালে ফার্ডিনান্ড II পর্তুগালের আলফনসো V-কে যুদ্ধে পরাস্ত করেন। এইসময় তাঁদের এক সন্তান জন্মায়। এই সুসময়ের স্মৃতিগুলি ধরে রাখবার জন্যে তাঁরা মনাস্টেরিটা বানান। নির্মাণকার্য শুরু হয় ১৪৭৭ সালে এবং শেষ হয় ১৫০৪ সালে। আমাদের সময় নেই ভেতরে ঢুকে এটা দেখবার। বাইরের দেওয়ালে প্রায় পঞ্চাশ-ষাট ফুট ওপরে অনেকগুলো শেকল ঝুলছে। মনে হয় যেন একটা নারকীয় দৃশ্য! রানী ইসাবেলা ছিলেন একজন উদারস্বভাবের মহিলা। কলম্বাসের আমেরিকা আসার স্পনসর ছিলেন উনি। এইজন্যে ওনার নাম হয়েছিল 'ইসাবেলা দি ক্যাথলিক'। ক্যাথলিকরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জেতার পর দেখেন মুসলমান রাজাদের অনেক ক্যাথলিক ক্রীতদাস ছিল। রানী ইসাবেলা সমস্ত ক্রীতদাসকে মুক্ত করে দেন এবং স্বাধীনতার স্মারক হিসেবে ওই চেনগুলোকে মনাস্টেরির দেয়ালে লাগিয়ে দেন। এই হিসেবে রানি ইসাবেলাকে অনেকে 'মুক্তিদাতা ইসাবেলা' নামেও ডেকে থাকেন।
সবকিছু দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম। রাস্তার মোড়ের এপারে একটি ইহুদিপাড়া আর উল্টোদিকে খ্রিস্টানদের গির্জা এবং মুসলমানদের মসজিদ। প্রত্যেকটা ধর্মই যেন একই সঙ্গে চলমান ছিল। এরমধ্যে গাইড আমাদের একটা স্ট্যাচুর সামনে নিয়ে এল। স্ট্যাচুটা 'জুয়ান লোপেজ ডি পাডিলা' নামে টোলিডোর একজন বিশ্বস্ত নাগরিকের। জুয়ান লোপেজ ডি পাডিলা ১৪৯০ সালে টোলিডোতে জন্মগ্রহণ করেন এবং তৎকালীন টোলিডোর শত্রুদের (মূলতঃ রোমান) বিরুদ্ধে লড়াই করে যান। ১৫২১ সালের ২৩ এপ্রিল ' ভিয়ালার ডি লস কমুনেরস'-এ তাঁর সৈন্যবাহিনী চরমভাবে পরাজিত হয় এবং পরের দিন অর্থাৎ ২৪ এপ্রিল জনসমক্ষে পাডিলার মুণ্ডচ্ছেদ করা হয়।
এসব বলার পরেই গাইড বলল আমাদের বাসের কাছে ফিরে যেতে হবে আর আধঘন্টার মধ্যে। আমার বন্ধু চিরঞ্জীব বলেছিল টোলিডোতে নাকি খ্যাতনামা লেখক সারভান্তির লেখা উপন্যাসের চরিত্র ডন কিহোটে'র (Don Quixote) কার্যকলাপের অনেক নিদর্শন আছে। গাইডের সময়ের সতর্কবাণী শুনে বুঝলাম যে ওই সমস্ত নিদর্শন এযাত্রায় আর দেখা হবে না। ১০২ ডিগ্রী তাপমাত্রায় বেশ লম্বা একটা ব্রিজ পেরিয়ে আবার বাসে উঠে পড়লাম। প্রায় পনেরো মিনিট বাসে বসে থাকতে হল বাকী যাত্রীদের দেরি করে আসার জন্যে। কিন্তু ওই সময়টায় বাসের ঠান্ডা এয়ার কন্ডিশনারটা আমাকে অন্য জগতে নিয়ে গিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিল। সেই ঘুম ভেঙেছিল আড়াই ঘন্টা পরে মাদ্রিদে পৌঁছে। সে গল্প পরে হবে !!


Diliff / CC BY-SA

 

ক্যালিফোর্নিয়ার লস এঞ্জেলেসের কাছে এক ছোট্ট শহরের বাসিন্দা সিদ্ধার্থ চৌধুরী। শিবপুর বি.ই. কলেজ থেকে পাস করে উচ্চশিক্ষার্থে মিচিগানে আসেন। পরে চাকরিসূত্রে বিদেশেই থিতু হন। বর্তমানে অবসর নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এদেশ-ওদেশ আর লিখে ফেলছেন সেইসব বৃত্তান্ত।

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher