বারাণসী ও এলাহাবাদ
তপন পাল
প্রস্তাবনা।।
বারাণসী। গঙ্গার পশ্চিমতীরে বরুণা ও অসি নদীর মধ্যবর্তী বারাণসী শহরটি শুনেছি বিশ্বের প্রাচীনতম জীবন্ত শহর; অর্থাৎ একনাগাড়ে এত শতাব্দী ধরে মনুষ্য বসবাসের নজির পৃথিবীর আর কোন শহরের নেই। বারাণসী শহর পত্তন করেছিলেন নাকি সুহোত্রের পুত্র কাস্য। তাই বারাণসীর অপর নাম কাশী। মতান্তরে, শিব এই শহর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কুরুক্ষেত্রযুদ্ধ পরবর্তীকালে পাণ্ডবভ্রাতারা ভ্রাতৃহত্যা ও ব্রহ্মহত্যাজনিত পাপ থেকে উদ্ধার পেতে শিবের খোঁজ করতে এই শহরে এসেছিলেন। হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে, যে সাতটি শহর মোক্ষ প্রদান করতে পারে, সেগুলির একটি হল বারাণসী (হে সহৃদয় পাঠক, দয়া করে অন্য ছটি শহরের নাম জিজ্ঞাসা করবেন না; জানি না)।
৫২৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বারাণসীর কাছে সারনাথে মহাকারুণিক তথাগত বুদ্ধ তাঁর প্রথম দেশনা, 'ধর্মচক্রপ্রবর্ত্তনসূত্র' প্রবর্তন করেন। ৬৩৫ খ্রিস্টাব্দে ফা হিয়েন ও খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে হিউয়েন সাং বারাণসীতে এসেছিলেন। ১১৯৪ সালে তুর্কি মুসলমান শাসক কুতুবুদ্দিন আইবক বারাণসী জয় করে শহরের প্রায় এক হাজার মন্দির ধ্বংস করার আদেশ দিয়েছিলেন। ১৩৭৬ সালে ফিরোজ শাহ বারাণসী অঞ্চলের কিছু হিন্দু মন্দির ধ্বংস করার আদেশ দিয়েছিলেন। ১৪৯৬ সালে আফগান শাসন সিকন্দর লোদি অবশিষ্ট মন্দিরগুলির অধিকাংশই ধ্বংস করে দেন। কবীর ও রবিদাস বারাণসীতেই জন্মেছিলেন। ১৫০৭ সালের শিবরাত্রি উৎসবের সময় গুরু নানক এই শহরে আসেন। ষোড়শ শতাব্দীতে সম্রাট আকবর এই শহরে শিব ও বিষ্ণুর দুটি বিশাল মন্দির নির্মাণ করিয়ে দেন। পুণের রাজা প্রতিষ্ঠা করেন অন্নপূর্ণা মন্দির; ১৬৬৫ সালে আসেন ফরাসি পর্যটক জ্যঁ ব্যপ্তিস্ত তাভার্নিয়ার।
ভারতে জন্মানো প্রথম নোবেল বিজেতা বারাণসী শহরটিকে বর্ণনা করেছেন 'দু হাজার মন্দির, আর দুই দুগুণে চার হাজার দুর্গন্ধ' ('of Two Thousand Temples, and twice two thousand stenches')। বেনারস নামের উৎসসন্ধান করতে গিয়ে কিপলিং লিখেছেন বে, উর্দু শব্দ, মানে বিনা, ব্যতীত; আর নারেস ল্যাটিন শব্দ, অর্থ নাসিকাগহ্বর। অর্থাৎ বেনারসে ঢুকতে হলে নাসিকাটিকে ছুটি দিয়েই ঢুকতে হবে। ১৯১৫তে গোপাল কৃষ্ণ গোখেলের অনুরোধে ভারতে ফিরে বাপুজির প্রথম রাজনৈতিক বক্তৃতা এই বারাণসীতেই, ১৯১৬য়। সেখানে তিনি শহরের বাসিন্দাদের দস্তুরমত ভর্ৎসনা করেন শহরটিকে নোংরা করে রাখার জন্য। তাঁর আত্মজীবনীতেও তিনি বারাণসীর তীর্থযাত্রী আর দোকানদারদের উচ্চকিত কোলাহল আর মাছির পালকে মনে করেছেন 'অসহ্য'। সময় বদলায়, কাশী বদলায় না, এই সেদিনেও (নভেম্বর ২০১৮) বারাণসীতে নর্দমা পরিষ্কার করতে গিয়ে দুজন সাফাইকর্মী মারা গেলেন।
তবে এইসব পড়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। শুধু হোমড়াচোমড়ারাই তো আর কাশী যায় না, হরিপদ কেরানি, ক্যাপাতুল্লা শেখেরাও যায়। আর আমার মত কিছু লোক, ধর্মভীরু না হয়েও, প্রতি বছরই যায়।
প্রথম দিন।।
সাবেক কালে বাঙালি কাশী যেত আপার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেসে। হরিহর অপু সর্বজয়াকে নিয়ে এই রেলগাড়িতেই কাশী গিয়েছিলেন, সর্বজয়া অপুকে নিয়ে এই রেলগাড়িতেই কাশী থেকে ফিরেছিলেন; এমনকি আজ থেকে পঞ্চাশ-ষাট বছর আগের যে মায়েরা পুত্র অসবর্ণ বিবাহ করছে জানতে পারলেই 'বাবা তুই আমাকে কাশী পাঠিয়ে দে' বলে কাঁদতে বসতেন, তাঁরাও এই রেলগাড়িতেই কাশী যেতেন। বিগত তিন শতক ধরে যে বাঙালি মহিলারা, বিশেষত বিধবা মহিলারা কাশী যেতেন তাদের অধিকাংশই অনন্যোপায় হয়ে যেতেন না ফেরার পথে। 'অন্নপূর্ণা ঘরে ঢুকিতেই বিনোদিনী কহিল, "মা, আমাকে তোমার পায়ে স্থান দিতে হইবে। পাপিষ্ঠা বলিয়া আমাকে তুমি ঠেলিয়ো না।" অন্নপূর্ণা কহিলেন, "মা, চলো, আমার সঙ্গেই চলো।" তাই ফেরার পথে আপার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস অনেকখানি ফাঁকা থাকত।
শ্যালদা থেকে রাতের বেলা ট্রেন; বাঙালি ট্রেনে উঠত পরোটা আলুচচ্চড়ি বেঁধে। দক্ষিণেশ্বরে একবার পেন্নাম ঠুকেই পরোটা আলুচচ্চড়ির সদ্গতি, তারপর ঘুম। ভোর হত বারহাড়োয়ায় পানিপাঁড়ের ডাকে। তারপর জানা অজানা অনেক স্টেশনে থামতে থামতে সকরিগলি, সুলতানগঞ্জ, জামালপু্র, কিউল, মোকামা, বক্তিয়ারপুর পেরিয়ে রাতের বেলা কাশী – যেতে পুরো এক দিন। তাতে বাঙালির কোন আপত্তি ছিল না, কারণ সে জানত তীর্থক্ষেত্র পথের শেষে নয়, পথের দুধারেই; তীর্থযাত্রা কথাটির মধ্যেই নিহিত আছে যাত্রার অনুষঙ্গ।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলায় মানসিকতা। আপার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস আজও ছাড়ে; যাত্রাপথ খণ্ডিত হয়ে, নাম বদলে সে এখন ১৩১৩৩ শিয়ালদহ বারাণসী এক্সপ্রেস; শিয়ালদহ ছাড়ে রাত সোয়া নটায়, বারাণসী পৌঁছায় পরদিন রাত নটা চল্লিশে। তেরোটি মাত্র কামরা নিয়ে আশিটি বিরতি দিয়ে ৮৭২ কিলোমিটার যেতে সে সময় নেয় চব্বিশ ঘণ্টা পঁচিশ মিনিট; গড় গতিবেগ ৩৬ কিলোমিটার/ঘণ্টা। তবে নেহাত দায়ে না পড়লে ওই গাড়িতে কেউ চড়ে না। লোকের পছন্দ অপেক্ষাকৃত দ্রুতগামী রাতের রেলগাড়িগুলি, যথা দুন এক্সপ্রেস বা অমৃতসর মেল, বিভূতি এক্সপ্রেস বা হিমগিরি এক্সপ্রেস। তবে আমার পছন্দ দিনের রেলগাড়ি, বার্থে ঠ্যাং ছড়িয়ে মোটা কাচের মধ্য দিয়ে চেয়ে থাকবো জানালা ছাড়িয়ে দূরে, দেখবো গাছ, নদী, পাহাড়, ছেলেমেয়েদের ইস্কুল গমন ও প্রত্যাবর্তন - এবং মানুষের অর্বাচীন সভ্যতা। ১২৩৮১ পূর্বা এক্সপ্রেস হাওড়া ছাড়ে রবি, বুধ আর বেস্পতিবারে, সকাল সোয়া আটটায়, বাইশটি LHB কামরা নিয়ে ৬১২০ অশ্বশক্তির WAP 7 লোকোর পিছনে গ্র্যান্ড কর্ড হয়ে, ধানবাদ, কোডারমা গয়া দেহরি অন শোন হয়ে, বরাকর কাত্রি জামুনিয়া দামোদর ধাধর ফল্গু পুনপুন শোন দুর্গতি কর্মনাশা এবং পরিশেষে গঙ্গা পেরিয়ে বারাণসী পৌঁছায় বিকেল পৌনে সাতটায়।
হাওড়া ছেড়ে মধ্যাহ্নভোজের পর কোডারমা। হাওড়া সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে দশ মিটার উঁচুতে, আর কোডারমা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে তিনশো নিরানব্বই মিটার উঁচুতে। এতটা উঁচুতে উঠে এসেছি ভাবতেই আমার শ্বাসকষ্ট শুরু হল; বাতাস এখানে বড়ই পাতলা। বার্থে লম্বা হলাম, চেয়ে চেয়ে দেখতে রইলাম ঢেউখেলানো টাঁড় জমি, প্রায়-শুকনো নদীবক্ষ, টানেল, অরণ্য, টিলা, আর অনেক দূরে দূরে বাড়িঘর। গয়া দেহরি অন শোন পেরিয়ে মুঘলসরাই। ১২৩৮১ পূর্বা এক্সপ্রেস আগে এখানে ইঞ্জিন বদলাত - বারাণসী লাইন তখন ছিল অবৈদ্যুতায়িত। এখন আর সেসব নেই, মুঘলসরাই; তারপরেই বারাণসী।
তীর্থযাত্রা, তীর্থভ্রমণ – শব্দগুলির মধ্যে নিহিত যাত্রা বা ভ্রমণের যে অনুষঙ্গ, তা আমার মনে বহুমাত্রিক; সে যতখানি না বস্তুগত, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি আধ্যাত্নিক। গুরু নানক তখন জ্ঞানের সন্ধানে পূর্ব ভারতের হিন্দু তীর্থস্থানগুলিতে ভ্রমণরত। প্রথানুগ তীর্থক্ষেত্রগুলি তাঁকে টানল না – মলিন অপরাহ্নে আকাশ চিরে উড়ে চলা এক পরিযায়ী পাখির ঝাঁক তাঁকে ঈশ্বরদর্শনের আনন্দ দিল - মনে হল নদীঘাটে স্নানরত পাপস্খালনোন্মুখ লোকগুলির চেয়ে ঐ বিহঙ্গরা স্বর্গের অনেক কাছাকাছি। রৌপ্যশুভ্র পক্ষ, দীর্ঘগ্রীবা ও লোহিত অক্ষপুটের এই বিহঙ্গরা উড়ে যায় কত দূর - কত সাগর নদী জনপদ উপত্যকা পর্বতমালা পেরিয়ে – শুধু যাওয়ার জন্য, যাওয়ার আনন্দে। তীর্থযাত্রাও তেমনতর, পথচলাটাই সেখানে মুখ্য, গৌণ গন্তব্য। জিম করবেট সাহেবও তার রুদ্রপ্রয়াগের নরখাদক চিতার (আসলে লেপার্ড, Panthera pardus, চিতা Acinonyx jubatus – তবে বাংলা প্রতিশব্দের অভাবে আমরা চিতাই বলবো – যেমন turtle ও tortoise দুজনকেই বাংলায় কচ্ছপ বলি, antelope ও deer দুজনকেই বলি হরিণ, crocodile আর alligator দুজনেই কুমীর) আখ্যানে লিখেছেন কিভাবে সমতলবাসী তীর্থযাত্রীদের রক্তাক্ত পদচ্ছাপ পদচিহ্ন রেখে যায় গাড়োয়ালের পুণ্যভূমিতে। আমরা বয়স্কদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করি, সে কি তাদের পায়ে লেগে থাকা দূর দূরান্তরের তীর্থরজ মস্তকে নিয়ে তাদের অর্জিত পুণ্যের, অভিজ্ঞতার, অন্তঃকরণ প্রসারতার অংশভাক হওয়ার প্রত্যাশায়; ঠিক যেমনটি তীর্থযাত্রার কাহিনী শুনে মানুষ পুণ্যার্জনের প্রত্যাশা করে!
গলায় মুণ্ডমালা, একহাতে ময়ূরপুচ্ছের ঝাঁটা, অন্য হাতে ত্রিশূল, কুকুরবাহন কালভৈরব হলেন কাশীর কোতোয়াল। এনার নিবাস ভারনাথ, বিশ্বেশ্বরগঞ্জে। শহরটাকে আপদ-বিপদ থেকে ইনিই রক্ষা করেন। এনার অনুমতি না হলে কাশীতে কেউ রাত্রিবাস করতে পারেন না। 'কাল' – সময় ও মরণ দুই অর্থেই – এঁর কাছে পরাভূত। কাশীর সমস্ত বড় বড় মন্দির মুসলিম শাসকদের হাতে পড়ে বারবার ধ্বংস হয়েছে। ঔরঙ্গজেব তো কাশীর একটা মন্দিরকেও আস্ত রাখেননি। কিন্তু কালভৈরব মন্দিরে কদাচ কাহারও হাত পড়েনি। ইনি শিবের সহচর; মতান্তরে অন্যতর রূপ। কালভৈরব মন্দিরের পাশেই মৃত্যুঞ্জয় মহাদেব মন্দির; সঙ্গে পবিত্র কূপ। ওঁদের সঙ্গে দেখা করে অনুমতি নিয়ে আমরা হোটেলে।
বারাণসীতে আমরা উঠি মিরঘাটের নদীতীরবর্তী এক হোটেলে; হোটেলটি অতীব মনোরম ও স্বাচ্ছন্দ্যমূলক, কিন্তু অতিশয় মহার্ঘ – এতটাই মহার্ঘ যে অবসরজীবনে পেনসনের আয়ে তথায় স্থিতি ক্রমশ দুরূহ হয়ে উঠছে। তার বারান্দায় দাঁড়ালে দেখা যায় নদীর ওপর দিয়ে ছুটে যাওয়া বাউন্ডুলে বাতাস, ধেয়ে আসা বৃষ্টি; কিন্তু হোটেলটিতে পৌঁছতে হলে রিকশা বা অটো থেকে নেমে প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তা গলি দিয়ে গোবর মাড়িয়ে, বিশ্বনাথ মন্দিরের খিড়কি কাটিয়ে, কাশীতে সতীদেবীর তিন অক্ষির একটি যেখানে পতিত হয়েছিল বলে লোকবিশ্বাস সেই বিশালাক্ষী মন্দিরের গা ঘেঁষে, হাঁটতে হয়। সেইরকমভাবেই হোটেলে পৌঁছানো গেল। 'কেবল পেটে বড় ভুখ, না খেলে নাই কোন সুখ। আয়রে তবে খাওয়া যাক, মন্ডা মিঠাই চাওয়া যাক।' তবে কাশীতে গঙ্গাতীরে আমিষভক্ষণ নিষিদ্ধ বলে 'কোর্মা কালিয়া পোলাও, জলদি লাও, জলদি লাও' উহ্য রইল।
দ্বিতীয় দিন।।
'ত আলল্লা বনারস চশমে বদ দুর/ বহিশতে খুর্রমো ফিরদৌসে মামুর /ইবাতত খান নাকুসিয়াঁ অস্ত/ হমানা কাবয়ে হিন্দোস্তাঁ অস্ত' গালিবদাদার এই লাইন কটির সারাৎসার 'হে ঈশ্বর, আনন্দময় স্বর্গ বেনারসকে তুমি অশুভ দৃষ্টি থেকে দূরে রেখো। ঘণ্টাবাদকদের (হিন্দুদের) এই উপাসনাস্থল হিন্দুস্তানের কাবা'।
পরদিন ভোর না হতেই নৌকাবিহারে। গাঢ় কুয়াশা নদীর উপর ঝুলে রয়েছে – জিলিপির কড়াইয়ের উপর জিলিপির মত। হোটেলের ঘাট থেকেই নৌকা ধরে অনেকখানি গিয়ে অসি ঘাট, সেখান থেকে যাত্রা শুরু হল। একদা, যখন চাকরি করতাম, পুরী ও তৎসন্নিহিত অঞ্চলের উপর ধর্মভীরু ভারতীয় ভ্রমণার্থীদের জন্য ইংরাজিতে একটি ট্রাভেল গাইড লিখেছিলাম। প্রকাশক সত্তর হাজার টাকা চেয়ে বসাতে সেই বই আলোর মুখ দেখেনি। তাতে কি! এবারে বারাণসীর উপর ওমত একটি ট্রাভেল গাইড লিখব বলে আদাজল খেয়ে লেগেছি। তার জন্য ঘাটগুলি খুঁটিয়ে দেখা বড় দরকার ছিল। অসি থেকে বরুণা, এর মধ্যে উত্তরবাহিনী গঙ্গার পশ্চিমপাড়ে প্রায় নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে বিরাশিটি ঘাট, প্রতিটি ঘাটের উপরে তিন চারটি করে মন্দির, কোথাও কোথাও আরও বেশি; এবং ঘাটের নিকটবর্তী মন্দিরের সংখ্যাও কম নয়। এর একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা দরকার ছিল।
প্রসঙ্গত কোলকাতায় খ্যাত অখ্যাত মিলিয়ে ঘাট নাকি ঊনষাটটা, আর বাংলার বারাণসী পণ্যহাটি বা পানিহাটিতে উনিশটা - তবে পানিহাটিতে ঘাটের সংখ্যা আমি মিলিয়ে দেখিনি। পাশাপাশি শহর কাটোয়া প্রাচীনকাল থেকে গুপ্ত বারাণসীর মর্যাদা পেয়েছিল।
অসি 'আমাদের ছোট নদী চলে আঁকে বাঁকে' – এসে গঙ্গায় পড়েছে। প্রস্থে ছোট হলে কি হয়, মাহাত্ম্যে সে বড়। বারাণসী শহরের দক্ষিণতম বিন্দু এটিই। সেখানেই অসি ঘাট। এরপর গঙ্গামহল ঘাট, রেওয়ান ঘাট, তুলসি ঘাট, ভাদাইনি ঘাট, জানকী ঘাট, আনন্দময়ী ঘাট, ভচ্চরাজা ঘাট, নিষাদ ঘাট, প্রভু ঘাট, পঞ্চকোটা ঘাট, চেতসিং ঘাট, নিরঞ্জনী ঘাট, মহানির্বাণী ঘাট, শিবলা ঘাট, গুলারিয়া ঘাট, দণ্ডি ঘাট, হনুমান ঘাট, প্রাচীন হনুমান ঘাট, কর্ণাটক ঘাট, হরিশচন্দ্র ঘাট, লালি ঘাট, বিজয়নগর ঘাট, পেরিয়ে চব্বিশতম ঘাট হচ্ছে কেদার ঘাট। এটি একটি প্রধান ঘাট।
বশিষ্ঠ নামে উজ্জয়িনীর এক ব্রাহ্মণ বারাণসী থেকে প্রতি বছর কেদারদর্শনে যেতেন। ক্রমে বয়স বাড়ে, জরা ধরে, হিমালয় দুর্গমতর হয়ে ওঠে। পরিশেষে এক রাত্রে তিনি স্বপ্ন দেখেন যে, স্বয়ং কেদারনাথ তাঁকে বরপ্রদানে উদ্যত; তিনি কেদারনাথকে কাশীতে অবস্থান করতে অনুরোধ করেন। তখন হিমালয়ের কেদারনাথের এক অংশ থেকে বারাণসীর গঙ্গার ধারে স্বয়ম্ভু এক শিবলিঙ্গের সৃষ্টি হয়, সেটিই কেদারেশ্বর শিব। কেদারঘাটে রয়েছে গৌরী কেদারেশ্বর মন্দির, অনেকগুলো সিঁড়ি ভেঙে যেতে হয়; পাথরের লিঙ্দর্শনে কেদারনাথ দর্শনের পুণ্য অর্জন করা যায় বলে গুজব। এই ঘাটটি বাঙালিদের কাছে অতীব জনপ্রিয়।
এরপর চৌকি ঘাট, সোমেশ্বর ঘাট, মানসসরোবর ঘাট, নারদ ঘাট, রাজা ঘাট, খড়ি ঘাট, পাণ্ডে ঘাট, সর্বেশ্বর ঘাট, দিগপটিয়া ঘাট, চৌষত্তি ঘাট, রাণামহল ঘাট, দ্বারভাঙা ঘাট, মুনশি ঘাট, অহল্যাবাই ঘাট, শীতলা ঘাট পেরিয়ে দশাশ্বমেধ ঘাট; চল্লিশতম ঘাট এবং সম্ভবত কাশীর প্রধানতম ঘাট। মনে পড়ে 'অপু কয়দিন গিয়া দশাশ্বমেধ ঘাটের উপর ডাক্তারের ডিসপেন্সারি হইতে ঔষধ আনিল বিশেষ কোনো ফল দেখা গেল না। দিন দিন হরিহর দুর্বল হইয়া পড়িতে লাগিল'। দশাশ্বমেধ ঘাটে নাকি স্বয়ং ব্রহ্মা দশটি অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন, তাই এই নাম। মতান্তরে, এই ঘাটে স্নান করলে দশটি অশ্বমেধ যজ্ঞ নিষ্পন্ন করার পুণ্য অর্জিত হয়। দশাশ্বমেধ ঘাটের ওপরে বিশাল বিশাল ছাতার তলায় পন্ডিতরা পুরোহিতরা জাঁকিয়ে বসে – কেউ হাত দেখছেন, কেউ ধর্মীয় আচার সম্পন্ন করছেন, কেউ ধর্মগ্রন্থ পাঠ করছেন। 'পাড়ার ছেলে স্নানের ঘাটে জল ছিটিয়ে সাঁতার কাটে' – সে যেন এক মেলা। কাশীর বিখ্যাত বাঁশের ছাতা এই ঘাটেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় দেখা যায়। হাত দিয়ে দেখলাম, অসম্ভব ভারি, নচেৎ একটা বাড়ি নিয়ে গেলে হত, ছাদে লাগাতাম। এখানে সন্ধ্যায় গঙ্গা আরতি হয়, আমাদের হোটেলের ঘর থেকে দেখা যায়; সে এক হইহই কাণ্ড।
তার গায়েগায়েই প্রয়াগ ঘাট, রাজেন্দ্রপ্রসাদ ঘাট, মানমন্দির ঘাট। এখানে কাশীর 'যন্তর মন্তর'। জয়পুরের রাজার তৈরি এই ঘাটে প্রতিদিন সকালে শ্বেতবস্ত্র, মুন্ডিতমস্তক সৌম্যদর্শন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা আরাধনা করেন। এরপর ত্রিপুরাভৈরবী ঘাট, মির ঘাট। আমাদের হোটেল এই ঘাটের একদম ওপরে; হোটেল থেকে সিঁড়ি সোজা জলে নেমে এসেছে। রোজ সন্ধ্যাবেলা একজন হোটেল কর্মচারী ঘণ্টা নেড়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে ঘাটে দাঁড়িয়ে গঙ্গা আরতি করেন। শ্রীমতী পাল তাকে দক্ষিণা দেন, তিনি আমাকে পেঁড়া দেন। অনেক অনেক বছর আগে যখন মেডিক্যাল কলেজে চাকরি করতাম, সেখানকার অধ্যক্ষ মহোদয়, স্বনামধন্য শারীরবিদ্যার অধ্যাপক, আমার রক্তে চিনির পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে কম দেখে আমাকে পান্তুয়া খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ফলে 'চুলে আমার যত ধরুক পাক' – মিষ্টি পেলে ভুলতে পারি পরকালের ডাক।
মিরঘাট পেরিয়ে ফুটো বা নয়া ঘাট, নেপালি ঘাট, ললিতা ঘাট, তার উপরেই ললিতাগৌরী মন্দির। এরপর জলশায়ী ঘাট, খিড়কি ঘাট পেরিয়ে একান্নতম ঘাট, মণিকর্ণিকা। এই শ্মশানে চিতা কখনও নেভে না। আমাদের কৈশোরে এখন যাকে বলে নাইটলাইফ, তেমন কিছু ছিল না। সেই ঘাটতি আমরা পোষাতাম আত্মীয় পরিজন প্রতিবেশীদের জন্যে হাসপাতালে রাত জেগে, আর শ্মশানে মড়া পুড়িয়ে। যাবতীয় নিষিদ্ধ আমোদের সেই ছিল উৎসমুখ। তাই শ্মশান আমার খুব পছন্দের জায়গা। সেখানে আমার কোনরকম অস্বস্তি হয় না, বরং শ্মশানের মাটিতে দাঁড়ালেই আমার খিদে পায়। নৌকা ভিড়িয়ে নামলাম।
শঙ্করাচার্য একবার এই ঘাটে এসেছেন, আচমকা এক কদাকার ভীষণমূর্তি চণ্ডাল চারটি কুকুর নিয়ে এগিয়ে এল। ওরে যা যা। শঙ্করাচার্য উত্তেজিত কন্ঠে চণ্ডালকে কুকুরগুলি সরাতে বললেন। চণ্ডাল বললেন 'কোথায় সরে যেতে বলছেন প্রভু, এক অন্নময় দেহ থেকে আরেক অন্নময় দেহে? নাকি এক চৈতন্য থেকে অন্য চৈতন্যে? কোথায় যাব? আপনি কি দেহটাকে সরে যেতে বলছেন? না আত্মাকে? আত্মা তো সর্বব্যাপী নিষ্ক্রিয় ও সতত শুদ্ধস্বভাব। আর যদি দেহটাকে সরে যেতে বলে থাকেন, দেহ তো জড়, সে কি করে সরে যাবে? আর আপনার দেহ হতে অন্য দেহ কোন অংশে ভিন্ন? অদ্বৈত তত্ত্বজ্ঞের দৃষ্টিতে ব্রাহ্মণ-চন্ডালে কি কোনো ভেদ আছে? গঙ্গাজলে প্রতিবিম্বিত সূর্য ও সুরামধ্যে প্রতিবিম্বিত সূর্য কি পৃথক?' শঙ্করাচার্য বুঝলেন ইনিই স্বয়ং শিব। চন্ডালের বেশে কাশীর গঙ্গাতীরে তাঁকে অদ্বৈততত্ত্ব বোঝাতে এসেছেন।
বাড়ির দেওয়ালগুলোও ধোঁয়ায় কালো হয়ে গেছে, বাতাসে পোড়া গন্ধ। জলে ভাসছে শবযাত্রীদের পরিত্যক্ত বর্জ্য। সামনেই এক দেহাতি বৃদ্ধের মড়া, সঙ্গে ছয় ছেলে। তারা এসেছেন উত্তরে লখনউ পার হয়ে সিতাপুর থেকে, সময় লেগেছে দশ ঘণ্টা। কেন গো! তোমাদের ওখানে শ্মশান নেই? জানা গেল মণিকর্ণিকায় দাহ হতে পারলে পুনর্জন্ম হবে না- এমনতর অপরীক্ষিত বিশ্বাসে প্রয়াত বৃদ্ধ মৃত্যুকালে পুত্রদের বলে গেছেন তাকে মণিকর্ণিকায় দাহ করতে। এবং উনি একা নন, একই বিশ্বাসে দূরদূরান্ত থেকে মৃতদেহ এখানে আসে দাহ হতে। কেন রে বাবা, আবার জন্মাতে এত আপত্তি কেন? আর জন্মাতে এতই যদি আপত্তি, তুই কোন আক্কেলে ছটা ছেলের জন্ম দিলি!! নিজের বেলায় আঁটিসাটি পরের বেলায় দাঁত কপাটি। অ্যাঁ!! আপনার বেলায় ছ' কড়ায় গণ্ডা, পরের বেলায় তিন গণ্ডা। আর না জন্মালে কি জানতে পারতিস আকাশটা কতখানি নীল, বৃষ্টিধারাস্নাতা নীপবন কতখানি হরিদ্বর্ণ, কৈশোরের প্রেম কতটা তীব্র!! শঙ্খধবল রসগোল্লা তালু আর জিভের মধ্যে বসিয়ে চাপ দিলে মিষ্টি রস বিছিয়ে যাবে মুখগহ্বর জুড়ে, জিভের স্বাদগ্রন্থিগুলি নিষিক্ত হবে রসে, শরীর-মন জুড়ে ছড়িয়ে যাবে এক অপরূপ প্রশান্তি – শুধু এই অনুভূতিটির জন্যেই তো হাজারবার জন্মানো যেতে পারে; তাই না! এসো না, কাঁটার পথে আঁধার রাতে আবার যাত্রা করি, আঘাত খেয়ে বাঁচি না হয় আঘাত খেয়ে মরি।
বিষ্ণু সুদর্শনচক্র দিয়ে মাটি খুঁড়ে গর্ত করে, ওই কাজকাম না থাকলে যা হয় আর কি, হর-গৌরীর তপস্যা শুরু করলেন। তাঁর শরীরের ঘামে গর্ত ভরে গেল। তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে হর-গৌরী দর্শন দিলেন, অতিরিক্ত উচ্ছ্বাসে গৌরীর কানের দুল খুলে জলে পড়ে গেল। আগে থেকেই প্যাঁচ আলগা ছিল বোধহয়। সেই থেকে এই ঘাটের নাম মণিকর্ণিকা। ঘাটের উপর তারকেশ্বরের মন্দির; কাশীবাসীদের অন্তিম সময়ে তাদের কানে নাকি তারকব্রহ্ম মন্ত্র দেন এই তারকেশ্বর শিব। গঙ্গার উপরে রত্নেশ্বর মহাদেব মন্দির হেলানো, আধ-ভাঙা হয়ে জলে ভাসছে। মন্দিরের দ্বারোদ্ঘাটনের সময়ে প্রতিষ্ঠাত্রী নাকি বলেছিলেন 'মা, তোমার ঋণ শোধ করলাম' – সেই দম্ভেই মন্দিরের ওই অবস্থা।
মণিকর্ণিকার পর কুয়াশা গাঢ়তর, সূর্য অবলুপ্ত এবং নদীবক্ষ নির্জনতর। আমি ও শ্রীমতী পাল ভেসে চললাম রবিঠাকুরের নিরুদ্দেশ যাত্রার মত। বাজিরাও ঘাট, সিন্ধিয়া ঘাট, এখানেই নবগ্রহ সন্নিধানে সঙ্কটাদেবীর মন্দির; পাশের ঘাটটির নাম দেবীর নামে, সঙ্কট ঘাট, গঙ্গামহল ঘাট, ভোঁসলে ঘাট, নয়া ঘাট, গণেশ ঘাট, মেহতা ঘাট, রাম ঘাট, জাতারা ঘাট, রাজা গোয়ালিয়র ঘাট, মঙ্গলা গৌরী ঘাট, বেণীমাধব ঘাট, পঞ্চগঙ্গা ঘাট। পেশোয়াদের বংশের কেউ বালাজী বিষ্ণুর মন্দির গড়ে তুলেছিলেন পঞ্চগঙ্গা ঘাটে। তাই এই ঘাট 'বালাজী ঘাট' নামেও পরিচিত। ওস্তাদ বিসমিল্লাহ্ খাঁ সাহেব এই ঘাটে রেওয়াজ করতেন; বিন্দুমাধব মন্দির এই ঘাটের উপরে। এই মন্দির, প্রয়াগ সঙ্গমের বেণীমাধব ও রামেশ্বরমের সেতুমাধব এক ত্রিত্ব – একই ধরনের মন্দির, একই ধরনের বিগ্রহ।
তারপর দুর্গা ঘাট, ব্রহ্ম ঘাট, বুন্দি ঘাট, আদি শীতলা ঘাট, লাল ঘাট, হনুমানগড়ি ঘাট, গাই ঘাট, বদরিনারায়ণ ঘাট, ত্রিলোচন ঘাট, গোলা ঘাট, নন্দেশ্বর ঘাট, সক্কা ঘাট, তেলিয়ানালা ঘাট, নয়া ঘাট, প্রহ্লাদ ঘাট, রাজা ঘাট; তারপর সেতুর নিচে দিয়ে অনেকখানি গিয়ে আদি কেশব ঘাট – তার পরেই বরুণা; মূল বারাণসীর সীমা শেষ। অসিঘাট প্রভু বিষ্ণুর মস্তক, দশাশ্বমেধ ঘাট বক্ষ, মণিকর্ণিকা ঘাট নাভি, পঞ্চগঙ্গা ঘাট উরুদ্বয় আর আদি কেশব ঘাট পদদ্বয়। ভুলে যাবেন না যে ভগবান বিষ্ণু মর্ত্যে প্রথম নেমেছিলেন এই বারাণসীতেই; তার সেই পদচ্ছাপ আজও রক্ষিত আছে মণিকর্ণিকা ঘাট ও আদি কেশব ঘাটে।
ঘাট দেখতে দেখতেই দুপুর গড়িয়ে বিকেল, অপরাহ্ণিক গন্তব্য বারাণসীর প্রধান মন্দিররাজি। বারাণসীতে মন্দিরের মোট সংখ্যা শুনেছি বারো হাজার। এই সংখ্যাটির প্রামাণ্যতা নিয়ে আমার ঘোর সন্দেহ আছে। তবে বারাণসীর ছটি মন্দির দেখলে (এবং পয়সা দিলে) নাকি শুনেছি বারাণসী পরিক্রমা সম্পূর্ণ হয়। তার মধ্যে বিশ্বেশ্বরগঞ্জের কালভৈরব মন্দির আগের দিনই দেখা হয়ে গেছে, হোটেলে আসাযাওয়ার পথে দেখা হয়ে গেছে গলির মধ্যে বিশালাক্ষী মন্দির, দেবীর ভৈরব কালভৈরব। দেবী বিশালাক্ষ্মীর চোখ দুটি সোনায় বাঁধানো, এটি একান্নপীঠের অন্যতম। দেখা হয়ে গেছে গঙ্গাও; তাহলে বাকি থাকলো বাবা কাশী বিশ্বনাথ, ধুন্দিরাজ আর দণ্ডপাণি। এই তিনটি মন্দির মোটামুটি পাশাপাশি; যখন কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরে যাবো তখন দেখা হবে।
প্রথম গন্তব্য অসি নদীর তীরে কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে পণ্ডিত মদনমোহন মালব্যের দ্বারা নির্মিত সঙ্কটমোচন হনুমানের মন্দির। এইখানেই নাকি সন্ত তুলসীদাস হনুমানের দেখা পেয়েছিলেন। প্রতি মঙ্গলবারে প্রচুর ভিড় হয়; প্রতিদিন হনুমান চালিশা ও সুন্দরকাণ্ড পাঠ হয়; মন্দির থেকে বইদুটি নিয়ে তুমি পড়তে পারো কিন্তু ফেরত দিয়ে আসতে হবে, বাইবেলের মত বিনামূল্যে এখানে বই বিলি হয় না। হিন্দু জ্যোতিষমতে হনুমান দুষ্টগ্রহ শনিকে দমন করেন। তাই অনেকে শনিগ্রহদোষ খণ্ডন করার জন্য এই মন্দিরে পূজা দেন। বিস্তৃত চত্বর, তোরণ দিয়ে ঢুকে গাছপালাঘেরা বাঁদরসঙ্কুল পথে কিছুটা হেঁটে নিচু ছাদের মন্দির। পরিবেশটি ভারি ঘরোয়া, এসেছো যখন একটু বসে যাও ভাই গোছের; অনেক লোক ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে মন্ত্রপাঠ করছেন।
এবারে তুলসীমানস মন্দির, সন্ত তুলসীদাসের স্মৃতিতে ১৯৬৪ তে নির্মিত শিখর স্থাপত্যের রামমন্দির; দেওয়ালে রামচরিতমানসের স্তোত্র উৎকীর্ণ।
দুর্গাকুণ্ড মন্দির একটি আয়তাকার কুণ্ডকে ঘিরে নাগরা স্থাপত্যের উজ্জ্বল লোহিত বর্ণের অষ্টাদশ শতাব্দীতে নির্মিত মন্দির। মন্দিরের লাল রং দেবী দুর্গার প্রতীক। মন্দিরটিতে কয়েকটি বহুতল মিনার আছে। নাগপঞ্চমী উপলক্ষ্যে কুণ্ডে অনন্তনাগের উপর শায়িত বিষ্ণুর মূর্তি পূজা করা হয়। আয়তাকার কুণ্ডটি আগে সরাসরি গঙ্গার সঙ্গে যুক্ত ছিল – এখন বৃষ্টির জলই ভরসা।
দুর্গা মন্দির দুর্গা ঘাটের উপরে, বারাণসীর প্রধান মন্দিরদের অন্যতম।
আলমগির মসজিদ পঞ্চগঙ্গা ঘাটের উপরেই, সপ্তদশ শতাব্দীতে আওরঙ্গজেব কর্তৃক ইসলামিক ও ভারতীয় স্থাপত্যের যুগলবন্দীতে নির্মিত; বেণীমাধব মন্দির ভেঙে তৈরি বলে লোকে আজও একে বেণীমাধব কা দরেরা বলে। অমুসলমানদের প্রবেশ নিষেধ।
তিলভাণ্ডেশ্বর মহাদেব মন্দির বাঙালিটোলায়। মালয়ালি ও উত্তর ভারতীয় স্থাপত্যের যুগলবন্দীতে নির্মিত অতিপুরাতন এই মন্দিরটির শিবলিঙ্গ নাকি প্রতি বছরই লম্বা হচ্ছেন, 'দেখ আমি বাড়ছি মামি'।
উনবিংশ শতকের নেপালি মন্দির নেপালের পশুপতিনাথ মন্দিরের আদলে নেপালের রাজা কর্তৃক নির্মিত।
ভারতমাতা মন্দির কাশী বিদ্যাপীঠ ক্যাম্পাসে। স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত বারাণসীর এক জমিদার পরিবারের সদস্য, শিবপ্রসাদ গুপ্ত, ১৯২১ সালে নির্মাণ করেন কাশী বিদ্যাপীঠ। ১৯৩৬ সালে তা উদ্বোধন করেছিলেন মহাত্মা গাঁধী। মন্দিরটিরও উদ্বোধন করেছিলেন মহাত্মা গাঁধী। মন্দিরের মেঝেতে সাদা মার্বেল দিয়ে অবিভক্ত ভারতের এক বিশাল মানচিত্র। মন্দিরের পাঁচটি স্তম্ভ সৃষ্টির পাঁচ উপাদানের (অগ্নি, পৃথিবী, বায়ু, জল, অন্তরীক্ষ) প্রতীক।
বটুকভৈরব মন্দির গুরুবাগে, অঘোরী আর তান্ত্রিকদের আখড়া; অখণ্ড দীপ সেই কোন কাল থেকে জ্বলেই চলেছে। সেই দীপের পোড়াতেল নাকি সর্বরোগের মহৌষধ। সারাদিন ঘুরে ঘুরে পায়ে একটু ব্যথা হয়েছিল, একটু খুঁড়িয়ে হাঁটছিলাম; তাই দেখে ওই পোড়াতেল আমাকে নেওয়ার জন্য ঝুলোঝুলি, নিয়ে যান, মালিশ করে দেখবেন, বাত ব্যথা পালাবার পথ পাবে না। প্রসঙ্গত, বটুকভৈরব শিবেরই অন্যতর, কিঞ্চিৎ অপরিশীলিত রূপ।
বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি ১৯১৬তে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মদনমোহন মালব্য। বর্তমানে এটি একটি আন্তর্জাতিক মানের কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও এশিয়ার বৃহত্তম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। ইন্দো-গথিক স্থাপত্যের ভবনগুলি, সঙ্গে বিস্তর খোলা জায়গা, দেখলেই ঘাসে শুয়ে পড়তে ইচ্ছা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরেই নতুন বিশ্বনাথ মন্দির, বিড়লা মন্দির নামেই সবিশেষ প্রসিদ্ধ। আসল বিশ্বনাথ মন্দিরে প্রবেশাধিকার কেবলমাত্র হিন্দুদের; তাই পন্ডিত মদনমোহন মালব্যের অনুপ্রেরণায় বিড়লারা এই মন্দির নির্মাণ করেন। অর্ধচন্দ্রাকার বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ঠিক মধ্যিখানে এই মন্দিরটি, মন্দিরের শিখর যেন আকাশ ছুঁয়েছে, আর সামনে রয়েছে পন্ডিত মদনমোহন মালব্যের পূর্ণাবয়ব মূর্তি। বাবা বিশ্বনাথ থাকেন একতলায়, তার মাথার ওপরে দোতলায় থাকেন রাধাকৃষ্ণ। দোতলার বারান্দা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকটা অংশ দেখা যায়, গাছগাছালি আর পাখির ডাক। মূলমন্দিরের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পঞ্চমুখী শিব, পার্বতী, লক্ষ্মী, গণেশ, রামসীতা, হনুমান মন্দির। কিছুটা দূরে মস্ত এক গাছের নিচে কড়ি মার মন্দির। সম্পর্কে ইনি শিবের ভগিনী। সবাই সেখানে কড়ি দিয়ে পুজা দেয়।
রামনগর দুর্গ তুলসী ঘাটের বিপরীতে গঙ্গার পূর্বকূলে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে কাশীর রাজা মুঘল স্থাপত্যের এই দুর্গটি 'চুনার' বেলেপাথরে তৈরি করান। দুর্গের বৈশিষ্ট্য অর্ধচন্দ্রাকার বারান্দা, খোলা উঠোন, আর প্যাভিলিয়নগুলি। জাদুঘরটি কাশীর রাজাদের ইতিহাস বলে। দুর্গের একটি অংশই জনসাধারণের জন্য খোলা থাকে, বাকি এলাকাটি কাশীর রাজার বাসভবন। ব্যাসমন্দির রামনগরে, মহাভারতকারের স্মৃতিতে। পিলিকোঠি অঞ্চলে স্বপ্ন, মানে বেনারসি শাড়ি বোনা হয়। সর্বত্রই বেনারসী শাড়ি ছেয়ে আছে; দেখতে বেশ লাগে।
বারাণসীতে এখন হইহই করে চলছে কাশী বিশ্বনাথ মন্দির করিডরের কাজ, ৬০০ কোটি টাকার এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য পুণ্যার্থীদের গঙ্গার ললিতা ঘাট-জলসেন ঘাট থেকে সরাসরি কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরে পৌঁছে দেওয়া, এখন কিছুটা ঘুরপথে যেতে হয়৷ অন্যতর উদ্দেশ্য, যাতে দূর থেকে কাশী বিশ্বনাথ মন্দির দেখা যায়। এই নিয়ে বিতর্ক বিস্তর। ক্ষমতাসীনদের দাবি, করিডরের মধ্যে থাকবে নানা মন্দির, থাকবে সংগ্রহশালা; তীর্থযাত্রীরা দেখবেন কাশীর সমাজ-সংস্কৃতির বিবর্তনের ইতিহাস - শিব এবার গেরস্থের গ্রাস থেকে মুক্তি পাবেন। ওই পথে, এবং ব্যাপকতর অর্থে সমগ্র বারাণসীতেই বাড়তি, অনর্জিত আয়ের সন্ধানে বিগত কয়েক শতক ধরে যত্রতত্র গড়ে উঠেছে মন্দির। সেই সব সরিয়ে, চওড়া রাস্তা বানাতে গিয়ে মিরঘাট মণিকর্ণিকা ঘাটের সংলগ্ন লাহোরিটোলা এলাকায় ভাঙতে হয়েছে ২৫০–৩০০–৩৫০ বছরের পুরনো কয়েকশো বসতবাড়ি। বারাণসীর পথে চলতে এবার থেকে নাকি আর পদেপদে গোবর মাড়াতে হবে না।
শুনে মনে হয় ভালোই তো! ভাল কী না সেই প্রশ্ন পরে; তবে স্বার্থে ঘা পড়লে হইহই হবেই। কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের ট্রাস্টি সংস্থা এবং মন্দির লাগোয়া অঞ্জুমান ইন্তেজামিয়া মসজিদ কর্তৃপক্ষ একজোট হয়ে করিডরের নির্মাণ কাজ বন্ধ করার জন্য সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছেন। সংখ্যালঘুদের আশঙ্কা, করিডর হলে জ্ঞানবাপী মসজিদ বিপন্ন হবে না তো? সংখ্যাগুরুদের অভিযোগ বহিঃশত্রুদের হাত থেকে বাঁচাতে বারাণসীতে বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে মন্দির তৈরি করাই রীতি; এটিই এখানকার ইতিহাস, কৃষ্টি, সংস্কৃতি। অথচ করিডরের নামে বারাণসীতে একাধিক শিবমন্দির ভাঙ্গা হয়েছে। যার সঙ্গেই কথা বলি, নৌকার মাঝি বা রিকশাওয়ালা, বিশ্বনাথ গলির প্যাড়াওয়ালা বা মন্দিরের পূজারী – সবার গলাতেই ক্ষোভ – সেটা যতখানি না কাশীর ঐতিহ্যের কথা ভেবে, তার চেয়ে বেশি জীবিকা হারানোর ভয়ে!!
নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য বা জনস্বাস্থ্য গুরুত্বপূর্ণ অবশ্যই, তবে পরিষ্কার পথঘাট দেখতে কেউ বারাণসী যায় না; তার জন্যে সিঙ্গাপুর আছে। বারাণসী গিয়ে বরং পায়ে পিচিত করে গোবর না লাগলে মন কেমন করে, মনে হয় এবারের আসাটাই অর্থহীন হয়ে গেলো, এর চেয়ে ব্যাংকক গেলেই হতো। কাশী ঠিক যে জন্য কাশী, সেই কাশীত্বটুকুই হারিয়ে যেতে বসেছে। কোন ভেনিসবাসী কি কোনদিন বলে, নালাগুলো বুজিয়ে রাস্তা করা দরকার, বা রোমবাসী কেউ বলে ফোয়ারাগুলো বন্ধ করে দেওয়া দরকার, কোনদিন যদি ছেলেপিলে পড়ে মরে যায়! হিন্দুদের তীর্থস্থানগুলি, বিশেষত শৈব মন্দিরগুলি, বিশৃঙ্খলা ও অব্যবস্থা, ভিড় ও অপরিচ্ছন্নতার জন্য খ্যাত। তাই পেরিয়ে যার যেতে ইচ্ছা হয় সে যায়, যার ইচ্ছা হয় না সে যায় না। যে যায় না সে জানে যে খ্রিস্টানদের রবিবার না মুসলমানদের শুক্রবারের মত হিন্দুদের ধর্মস্থান গমন ও প্রার্থনা বাধ্যতামূলক নয়, কারণ ঈশ্বর যিনি মন্দিরে যান আর যিনি মন্দিরে যান না উভয়ের প্রতিই সমদর্শী। সেখানে হিন্দু ধর্মস্থানকে খ্রিস্টান ধর্মস্থানসুলভ ঝাঁ চকচকে 'লুক' দেওয়ার সহসা কী প্রয়োজন পড়ল কে জানে!!
ক্ষপাবেলায় হোটেলে, বারান্দায় মকরবাহিনী, ওপারে বালি, মনে পড়ল নারায়ণ সান্যালের রূপমঞ্জরী, হটী বিদ্যালঙ্কার এই বালি মাড়িয়েই হয়তো গিয়েছিলেন ত্রৈলঙ্গস্বামী সন্নিধানে; সালটা ছিল ১৭৭৪।
আকাশ মেঘলা… হয়তো কখন নিশুত রাতে উঠবে হাওয়া।
- ক্রমশঃ -
হিসাবশাস্ত্রের স্নাতকোত্তর শ্রী তপন পাল West Bengal Audit & Accounts Service থেকে অবসর নিয়েছেন সম্প্রতি। তাঁর উৎসাহের মূলক্ষেত্র রেল - বিশেষত রেলের ইতিহাস ও রেলের অর্থনীতি। সেবিষয়ে লেখালেখি সবই ইংরাজিতে। পাশাপাশি সাপ নিয়েও তাঁর উৎসাহ ও চর্চা। বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি এবং ইন্ডিয়ান রেলওয়ে ফ্যান ক্লাবের সদস্য শ্রী পালকে বাংলা লিখতে শিখিয়েছে 'আমাদের ছুটি'। স্বল্পদূরত্বের দিনান্তভ্রমণ শ্রী পালের শখ; কারণ 'একলা লোককে হোটেল ঘর দেয় না।'