ওই বাংলার মায়াভরা পথে
নীলিমা ঘোষ
পাসপোর্ট আগে থেকে করাই ছিল কিন্তু ব্যবহারের সুযোগ হয়ে ওঠেনি। ঘরের পাশেই বিদেশ। তার ওপর বাঙালিদের বিদেশ। শেষমেষ ঘোরার একটা ছক কষেই ফেললাম। খুব কৌতূহল ছিল। ঘুরে যা দেখলাম তা অভাবনীয়। অবিভক্ত বাংলার, প্রাচীন বাংলার মন্দির, বৌদ্ধমঠ আমার ধ্যান-ধারণাকে একটা নতুন রূপ দিল। সেই সঙ্গে চারপাশের নাগরিকদের আন্তরিকতা। বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে ভিসা সংগ্রহ করে কলকাতা স্টেশনে সোনালী ব্যাংক কাউন্টার থেকে ভারতীয় টাকার বিনিময়ে কিছু বাংলাদেশি টাকা নিয়ে নির্দিষ্ট দিনে বন্ধন এক্সপ্রেসে চেপে বসলাম। দিনটা দুর্গাপুজোর পঞ্চমী। ইমিগ্রেশন চেকিং-এর লাইনে দাঁড়িয়ে যথারীতি কাজকর্ম মিটিয়ে ট্রেনে উঠলাম। প্রায় সাড়ে বারোটা নাগাদ খুলনা পৌঁছিয়ে পরিকল্পনামতো মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মভিটে দর্শন দিয়ে আমার ভ্রমণ আরম্ভ হল। প্ল্যাটফর্মের এক ভদ্রলোককে সাগরদাঁড়ি কিভাবে যাব জিজ্ঞেস করাতে উনি বললেন 'আপনি প্ল্যাটফর্মের বাইরে বেরিয়ে অটোতে চেপে সোনাডাঙা (যতদূর মনে পড়ছে জায়গাটার নাম সোনাডাঙা-ই হবে) যাবেন। সেখান থেকে সাগরদাঁড়ির সাইকেল ভ্যান কিংবা অটো পেয়ে যাবেন।' ধন্যবাদ জানিয়ে অটোতে চেপে বসলাম।
মাইকেল-এর বাসগৃহের সামনে টিকিট কাউন্টার আছে। বাংলাদেশ সরকার বাসগৃহটি সংস্কার করেছেন। পঞ্চমীর দিন গিয়েছি, তাই ঠাকুরদালানে প্রতিমা সাজানো, আলো লাগানো হচ্ছিল। ঘরগুলিতে তখনকার দিনের ব্যবহৃত আসবাবপত্র, গ্রামাফোন, লোহার সিন্দুক ইত্যাদি সাজানো আছে। মধুসূদনের স্বহস্তে লিখিত কিছু কথা বাঁধানো দেখলাম। একটি বংশলতিকাও বাঁধানো আছে। এক ভদ্রমহিলা ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছিলেন। উনি বাসভবনের তত্ত্বাবধানে আছেন বললেন। একতলায় একটি ছোট ঘরে লাইব্রেরি রয়েছে। বাইরে বেরিয়ে একটা ফাঁকা জায়গায় তুলসী মঞ্চের কাছে একটা ফলকে লেখা "কবির প্রসূতি স্থল"। বাড়ির ভেতরের বারান্দায় এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হলো চেয়ারে বসে আছেন। ভদ্রমহিলা পরিচয় করিয়ে দিলেন, উনি মধুসূদনের কাকার বংশধর। সরকার বাড়িটি অধিগ্রহণ করায় এখন অন্যত্র থাকেন। ভদ্রমহিলা বললেন "বাড়ির বাইরে কিছুটা গেলে রাস্তার ধারে একটা বাদাম গাছ দেখবেন। তার নিচে মাইকেল কিছুদিন হেনরিয়েটা ও পুত্র অ্যালবার্টসহ থেকেছিলেন।" খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করে বিলেত থেকে ফেরায় বাড়ি ঢোকার অনুমতি পাননি। সামনেই কপোতাক্ষ নদী, তার বাঁধানো ঘাটে নৌকা লেগে রয়েছে। পাকা রাস্তার অপরদিকে ঘেরা বাগানের মধ্যে মধুসূদনের মূর্তি রয়েছে।
সন্ধে নেমে এসেছে, আমি কেশবপুরের হোটেলে থাকব সে রাত্রিটা। ভোরে যশোর চলে যাব। সেখান থেকে কুষ্ঠিয়া যাওয়ার বাস ছাড়ে। কেশবপুরের হোটেলে রাত্রে থানা থেকে এক ভদ্রলোক এসে পাসপোর্ট দেখতে চাইলেন। হোটেলে আবাসিকদের একজন বয়স্কা মহিলা দেখাশোনা করেন। তাঁকে দরকার হলে ডাকতে বলে গেলেন।
পরদিন সকল আটটার মধ্যে যশোর যাওয়ার বাসে উঠে পড়লাম। যশোর থেকে আবার বাসে কুষ্ঠিয়া। বাসস্ট্যান্ড থেকে রিকশা নিয়ে কুষ্ঠিয়া বাজারে এক হোটেলে উঠলাম। তখন বারোটা বেজে গিয়েছে। ঘরে ঢুকে একটু বিশ্রাম নিচ্ছি, এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল। খুলে দেখি হোটেলের রিসেপশন কাউন্টারের ছেলেটির সঙ্গে এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে। আমি ভারত থেকে এসেছি শুনে ওনার হোটেলে খাওয়াবার জন্য নিতে এসেছেন। বললাম, আপনি যান, আমি তৈরি হয়ে নিয়ে একটু বাদে যাচ্ছি। খানিক বাদে হোটেলের বাইরে এসে দেখি উনি দাঁড়িয়ে আছেন নিয়ে যাবেন বলে।
নিরামিষ পদই খেলাম, দামও সাধ্যের মধ্যে। ওনার মা ও একজন অল্পবয়সি মহিলা খুব যত্ন করে খাওয়ালেন। কিছুক্ষণ আলাপের পর আমি বিদায় নিলাম। এবার লালন ফকিরের মাজার যাব। খুব কাছেই। ছেউড়িয়া। ওনারা রাস্তা বলে দিলেন। মলম শা ফকির পালক পিতা। মতিজান ফকিরানি পালকমাতা। লালন ফকির, স্ত্রী বিশাখা ফকিরানির সমাধি রয়েছে ঘর ও তৎসংলগ্ন ঘেরা বারান্দাতে ও বাইরের উন্মুক্ত স্থানে। সেখানে আরও কিছু সংখ্যক পরিচিত ব্যক্তিরও সমাধি রয়েছে। ছিমছাম পরিবেশ। সেদিন জনসমাগম একটু বেশিই হয়েছিল। মাজারের পাশেই লালন আকাদেমি। একতলায় সভাগৃহ। চারধার উন্মুক্ত। গান হচ্ছে।
যে কেউ যখন খুশি আসছে আবার উঠেও যাচ্ছে। অন্যত্র কেউ কেউ চাদর বিছিয়ে আলোচনাচক্রে অংশগ্রহণ করছেন। দোতলায় লাইব্রেরি। আকাদেমিতে সঙ্গীতচর্চাও হয়। শুনলাম কিছুদিন বাদে লালনমেলাও হবে। পথে বেরিয়ে হোটেলের নামটা মনে করতে পারছিলাম না। এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে ছিলেন। জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাব। হোটেলের নাম মনে না পড়ায় উনি কাছেপিঠে উল্লেখযোগ্য কিছু আছে কি না জানতে চাইলেন। একটা মিষ্টির দোকানের নাম করলাম। মিষ্টির দোকানটা আসতেই হোটেলটা চিনতে পারলাম। ভদ্রলোক আমার সঙ্গে অটোতে উঠেছিলেন, বললেন, আমি কাছেই যাব। ধন্যবাদ জানিয়ে নেমে পড়লাম। এইভাবে পরবর্তী সময়ে পথেঘাটে অনেকেই নানা ভাবে সহযোগিতা করেছেন। মিষ্টির দোকান থেকে রসগোল্লা আর অন্য দোকান থেকে রুটি তরকারি কিনে হোটেলে ফিরে এলাম। রসগোল্লা খুবই সুস্বাদু ছিল।
পরেরদিন সকল সাতটার মধ্যেই বেরিয়ে পড়লাম। আজ যাব শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি। কুষ্ঠিয়া শহরের পাশেই গড়াই নদী। একটা রিকশা নিয়ে ঘোড়াঘাটে গেলাম। ঘাটে তিন টাকা দিতে হল। নৌকা ফেরিতে পারাপারের ভাড়া আলাদা। সে সময় বৃষ্টির ফলে নদীর পাড় কর্দমাক্ত। একটা নৌকা তখন ঘাটে ভিড়ছে। নৌকায় সকলে দাঁড়িয়ে আছে। ঘাটে যিনি ভাড়া নিচ্ছিলেন বললেন, এই কাদাপথ দিয়ে পাড়ে যেতে সময় কম লাগবে বটে, তবে আপনার নদী না পেরিয়ে সাইকেল ভ্যানে ব্রিজ দিয়ে যাওয়াই ভাল। একটা সাইকেল ভ্যান দাঁড়িয়ে ছিল। ভদ্রলোক ভ্যানচালককে ডেকে বললেন, এনাকে নিয়ে যা কুঠিবাড়ি। পদ্মানদী আর তার চারপাশ ঘুরিয়ে দেখিয়ে দিবি। আমাকে বললেন লোকালে গেলে অর্থাৎ অন্য সহযাত্রী থাকলে চল্লিশ টাকা কিন্তু আপনি একা রিজার্ভে যাচ্ছেন বলে একশো টাকা দেবেন।
সাইকেল ভ্যানে যেতে যেতে ভ্যানচালকের সঙ্গে নানা কথা হচ্ছিল। পাকা রাস্তা অতি মনোরম। নতুন ব্রিজের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় বাঁদিকে ব্রিটিশ আমলের রেলব্রিজ চোখে পড়ল। কথা প্রসঙ্গে বললাম কয়াগ্রামে বাঘাযতীনের জন্মস্থান আর লাহানি গ্রামে 'বিষাদসিন্ধু'র লেখক মীর মুশারফ হোসেনের বাড়ি কুঠিবাড়ি যাওয়ার পথেই তো পড়ে? ভ্যানচালক বলল, আগে বললেন না কেন, ঘুরিয়ে আনতাম। কুঠিবাড়িতে ঢোকার আগে পাশের রাস্তা দিয়ে আমাকে সে পদ্মানদী দেখাতে নিয়ে গেল। ভাবলাম, এই নদী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কত সাহিত্যকীর্তির সাক্ষী হয়ে আছে। দূরে ঘাটে নৌকা ভিড়ে আছে, মালপত্র ওঠানামা হচ্ছে।
কুঠিবাড়িতে যখন পৌছলাম, তখন গেট খুলে গিয়েছে। টিকিট কেটে ভেতরে বাগানের মধ্য দিয়ে কুঠিবাড়ি যাওয়ার বাঁধানো পথে এসে পৌঁছলাম। অত্যন্ত সাজানো গোছানো মনোরম পরিবেশ। ঘরে ঢুকে মনে হল এককালে রবিঠাকুর ঘরগুলি ব্যবহার করেছিলেন। দুটি পালকি আছে, একটি বড় ষোলো বেয়ারার বহনযোগ্য, অপরটি আট বেয়ারার। কবি যে বজরা ব্যবহার করতেন তার ছবি আছে। ঘরে ঘরে দেওয়ালে কোথাও ওনার কবিতার পাণ্ডুলিপি, আবার কোথাও নিজ হাতে আঁকা অনেক স্কেচ ও রয়েছে। আর আছে কিছু চিঠিপত্র ও পারিবারিক ছবি। ঘরে মৃদু রবীন্দ্রসঙ্গীত বেজে চলেছে। বারান্দায় একটা নৌকা রয়েছে। সমস্ত কিছুই মনে হয় রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজড়িত। দোতলা থেকে নেমে এলাম। বাড়ির পাশে বাগান। আমগাছ, দোলনা, ছোটোরা দৌড়াদৌড়ি করছে। পথের ধারে সার দেওয়া বকুলগাছ। বড়টি রবীন্দ্রকালের। পাশে অনেকগুলি চারা মহাজনেরা রোপণ করে গিয়েছেন। পেছনে একটি বাঁধানো পুকুর। রবীন্দ্রনাথ সপরিবারে এই জায়গায় বিশ্রাম নিতেন।
বকুলগাছের পাশ দিয়ে বাঁধানো পথে লাইব্রেরিতে এসে পড়লাম। ছোট একটি ঘর, লাইব্রেরিয়ান ছিলেন। রবীন্দ্র-রচনবলীর সেট ও কিছু অন্যান্য বই আলমারিতে রাখা আছে। লাইব্রেরিয়ান পাশে সুদৃশ্য বাড়িটি দেখিয়ে বললেন, নতুন লাইব্রেরি ঘর, কিছুদিনের মধ্যেই খুলে দেওয়া হবে। আমার সঙ্গে উনি বাইরের বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। সামনের দিকে আঙুল তুলে বললেন, ওই যে তিনটি তালগাছ দেখছেন, এই রাস্তা দিয়ে গিয়ে ওই গাছগুলোর কাছে পৌঁছে দেখবেন রাস্তার পাশে উপেনের ভিটে। "বাবু বলিলেন, 'বুঝেছ উপেন এ জমি লইব কিনে'।" রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এই জমিটি ওদের কাছ থেকে কেনেন। ছোট রবীন্দ্রনাথের ঘটনাটি মনে দাগ কেটেছিল। লাইব্রেরিয়ান সেরেস্তাঘর, লোকজনদের থাকার ঘর, সব চিনিয়ে দিলেন। কুঠিবাড়িতে প্রজাদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ছবিও রয়েছে।
কুঠিবাড়ি থেকে বেরিয়ে, সাইকেলভ্যানে চেপে কিছুদূর গিয়ে, আবার অটোয় চেপে রেলগেট পর্যন্ত গেলাম। সেখান থেকে হোটেল কাছেই। ম্যানেজারবাবুকে বলা ছিল, কারণ বারোটায় ঘর ছেড়ে দিতে হয়। আমি সোয়া বারোটা নাগাদ লাগেজ নিয়ে রাজশাহী যাত্রা করলাম। মদনপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসে উঠে রাজশাহী। পড়ন্ত বিকেলে রাজশাহী নেমে একটা হোটেলে উঠলাম। হোটেলমালিক অতিশয় ভদ্র। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এখানে কী দেখবেন? আমি বললাম, বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম যাব। উনি বললেন কাল যদি না থাকেন তবে আপনার লাগেজ লাগেজরুমে রেখে বের হবেন। কারণ বেলা বারোটার মধ্যে ঘর ছেড়ে দিতে হবে। কোন তাড়া থাকবে না, ধীরেসুস্থে ঘুরতে পারবেন। যখন খুশি এসে লাগেজ নিয়ে যাবেন। ভদ্রলোক নিজেও ঘুরতে খুব ভালবাসেন জানালেন। পরদিন সকালে পরোটা-সবজি খেয়ে একটা রিকশা নিয়ে বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম অভিমুখে রওনা দিলাম। কপাল মন্দ। পুজোর জন্যে মিউজিয়াম পাঁচদিন বন্ধ। কেয়ারটেকার বললেন, ভেতরে এসে চারধার ঘুরে যান। পরে না হয় এসে ভালভাবে দেখে যাবেন, এখন ঘরগুলি বন্ধ।
রাজশাহীতে আমার দ্রষ্টব্য ছিল বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম। এখানে দ্বাদশ শতকের কিছু মূর্তি রাজশাহী জেলার গোদাবাড়ি থানার দেওপাড়া গ্রাম থেকে পাওয়া যায়। এছাড়া আরো কিছু মূল্যবান প্রাচীন নিদর্শন এই মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। বাংলাদেশের মিউজিয়ামগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম সমৃদ্ধ মিউজিয়াম।
হোটেল থেকে জিনিসপত্র নিয়ে বগুড়া যাওয়ার বাস কাউন্টারে গেলাম। নাটোরের ওপর দিয়ে যাবার সময় রাস্তার পাশে দেখলাম এক বিশাল নদী। পাশের সহযাত্রীকে নদীর নাম জিজ্ঞাসা করায় বললেন এটা নদী নয়। এর নাম চলন বিল। দেখলাম বিশাল এর ব্যাপ্তি। বাসের কনডাক্টরকে বলেছিলাম যেখানে হোটেল পাওয়া যাবে সেখানে নামিয়ে দিতে। পাশের সহযাত্রীটি বললেন সামনের স্টপে নেমে যাবেন। কাছাকাছি অনেক হোটেল পাবেন। নেমে দেখলাম সেটা রিকশাস্ট্যান্ড। একজন রিকশা চালককে একটা হোটেলে নিয়ে যেতে বলায় সে আমার ব্যাগটা নিয়ে রাস্তা পেরিয়ে একটা বাজারের গলির মধ্যে রেখে, এখানে অনেক হোটেল আছে বলে চলে গেল। সামনের হোটেলের ম্যানেজার একটি ছেলেকে আমাকে অন্য একটি হোটেলে পৌঁছে দিতে বললেন। জায়গাটি তিনমাথা রেলগেট পুরানো বগুড়া। ছেলেটি আমাকে তিনতলায় পৌঁছে দিয়ে চলে গেল। কিছু জিজ্ঞাসাবাদের পর কাউন্টারে যিনি বসে ছিলেন আমার পাসপোর্টের ফটোকপি নিয়ে বললেন, একটা ঘর খালি আছে আপাতত থাকুন, কাল সকালে অন্য ঘর ঠিক করে দেব। যদি বের হন চাবিটা রেখে যাবেন।
পরদিন খুব ভোরে উঠলাম, মহাস্থানগড় যাব। ব্যাগে তালা দিয়ে ঘরের চাবি কাউন্টারে জমা দিলাম। নিচে অটোস্ট্যান্ডে গিয়ে জানতে পারলাম মহাস্থানগড়ের বাস চার নং রেলগেট থেকে ছাড়ে। সেখানে গিয়ে বাসে উঠলাম। ১১ কিমি মতো পথ। স্টপে নেমে জানতে পারলাম বড়রাস্তা থেকে শিবগঞ্জ রোড ধরে মহাস্থানগড় প্রায় দেড় কিমি। স্থানীয় একজন বললেন, একটা রিকশা করতে। সেই সমস্ত কিছু ঘুরে দেখিয়ে দেবে। রিকশাচালককে কত নেবে জিজ্ঞেস করাতে বলল আগে ঘুরে তো দেখুন।
প্রথমেই পড়ে সুলতানের মাজার। বলল এটা একেবারে শেষকালে দেখবেন। খানিক বাদেই দেখা গেল রাস্তার বাঁদিকে মহাস্থানগড়ের পাঁচিল। কোন কোন জায়গায় ভেঙে গেছে। মহাস্থানকে আগে পুনড্রনগরী বলা হত। পুনড্র একটি প্রাচীন জাতি। মহাস্থানগড়ের অন্যতম দ্রষ্টব্য বস্তু এর প্রাচীর। কোন কোন জায়গা ধংসস্তূপে পরিণত হলেও এর উচ্চতা ১০ ফুটেরও বেশি। আগে পুনড্র নগর প্রাচীরবেষ্টিত ছিল। প্রাচীরের ওপর চার-পাঁচজন পাশাপাশি হেঁটে যেতে পারে। লোহার সিঁড়ি দিয়ে উঠে পাঁচিলের সঙ্গে লাগানো লোহার সেতু দিয়ে গিয়ে পাঁচিলে ঘোরা যায়। টিকিট লাগে।
মহাস্থানগড়ের ধংসস্তুপে খননকার্যের ফলে দেখা গেছে এর প্রায় ২৫ ফুট নিচে অকর্ষিত মাটি রয়েছে। এর মধ্যে অনেকগুলি নির্মাণ স্তর রয়েছে। খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকেও এখানে জনবসতি ছিল। এবং পরবর্তী কালে বিভিন্ন রাজবংশের দ্বারা যেমন গুপ্ত যুগে, পাল যুগে নির্মাণকার্য হয়। প্রাচীরে কয়েকটি প্রবেশদ্বার ছিল। বৈরাগীর ভিটা, গোবিন্দ ভিটা, পরশুরামের প্রাসাদ, জীয়ৎকুণ্ড, শীলা দেবীর ঘাট, লখীন্দর মেধ। অনেকে একে বৌদ্ধ উপাসনালয় ছিল বলে মনে করেন। এগুলি মহাস্থান গড়ের অন্যতম দর্শনীয় স্থান। মহাস্থানগড়ের প্রবেশ দ্বারের ডান দিকে গোবিন্দভিটা। বলা হয় যে এটি একটি বিষ্ণু মন্দিরের নিম্নাংশ। লোকমুখে প্রচলিত এখান থেকে একটি কৃষ্ণ মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল। এখন মাটির ওপর খানিক ভিতটুকু আছে। এর ডান দিকে শীর্ণ করতোয়া নদী বয়ে চলেছে। জাদুঘর খুলবে দেড়টার সময়।
মহাস্থানগড় নটা নাগাদ পৌঁছে ছিলাম, সেইজন্যে ওখান থেকে ভাসুবিহার (অনেকে বসুবিহারও লেখেন) দেখতে গেলাম। স্যার কানিংহ্যাম একে উয়ান চোয়াং পোর উল্লিখিত পো-শি-পো বিহারের ধ্বংসাবশেষ বলেছেন। উয়ান চোয়াং বলেছেন, এটি একটি বিরাট সঙ্ঘারাম ছিল। এখানে মহাযান মতাবলম্বী শতাধিক ভিক্ষু বাস করতেন। বিভিন্ন স্থান থেকে বহু পন্ডিত ও জ্ঞানী ব্যক্তিরা এই বিহারে আসতেন। এটি খ্রিস্টিয় অষ্টম-নবম শতাব্দীতে নির্মিত। এর স্থাপত্যকলা শেষ গুপ্তযুগ ও পালযুগের বলে অনুমান করা হয়।
বিহারটি সংস্কারের ফলে প্রাচীন নির্মাণের ওপর বর্তমানে পাতলা ইট ও রং ব্যবহার করা হয়েছে। কোথাও কোথাও ভিতের ওপর মূল পাথর বা ইট পরিলক্ষিত হয়। মূল ভিটেতে অলঙ্করণ দেখে চমৎকৃত হতে হয়। যেহেতু রচনাটি আমার ভ্রমণকাহিনি তাই ভাসুবিহার বা এর পরবর্তী বিহারগুলি ভ্রমণের সময় ঐতিহাসিক ও পুরাতাত্ত্বিক তথ্য সবিশেষে উল্লেখ করছি না। প্রত্যেক বিহার বা দ্রষ্টব্য স্থানগুলিতে প্রস্তরফলকে বিহারের স্থান, কাল, নির্মাণকার্য ও নির্মাতার বিবরণ দেওয়া আছে। খননকার্যে উদ্ধার করা বস্তুসমূহের বিবরণও আছে।
ভাসুবিহার থেকে ফিরে এসে জাদুঘর খোলার পর টিকিট কেটে জাদুঘরের চত্ত্বরে বিভিন্ন যুগের পাথর বা কাঠের ওপর অলংকৃত দরজার ফ্রেমের মধ্য দিয়ে মূল কক্ষে প্রবেশ করলাম। পোড়া মাটির জিনিস, ধাতব অলংকার, পাথরের তৈরি জিনিস, ছাঁচে ঢালা ও ছাপ যুক্ত ধাতব মুদ্রা আনুমানিক খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক বা তারও আগে প্রচলিত ছিল। এ ছাড়াও বিভিন্ন কালে নির্মিত মূর্তিগুলি আলাদা গুরুত্ব পেয়েছে। অনুমান করা যায়, বৌদ্ধ ধর্মের পাশাপাশি হিন্দু ধর্মেরও প্রভাব ছিল।
জাদুঘর থেকে বেরিয়ে এবার গেলাম গোকুলমেধ। স্থানীয়রা বলেন বেহুলা লখীন্দরের বাসরঘর। মহাস্থানগড় থেকে ২ কিমি দক্ষিণে গোকুল গ্রামে এই সুউচ্চ স্তুপটির অবস্থান। আনুমানিক সপ্তম-বারো'শ শতাব্দীর মধ্যে এটি নির্মিত। প্রায় ৪৫ ফিট উঁচু স্তুপটি মখমলের মত সবুজ ঘাসে ঢাকা। স্তুপটির সমস্ত গায়ে ত্রিকোণাকৃতি খোপ। ওপরে ওঠার জন্যে স্তুপটির গায়ে ধাপ কাটা আছে। ধাপ দিয়ে মাথায় পৌঁছনো যায়। উপরিভাগ সমতল। একটি পোড়া ঘর আছে। একটি স্নানঘর আছে। মধস্থানে একটি কূপ। পরে কূপটি ভরাট করে দেওয়া হয়। এ বিষয়ে নানা কাহিনী প্রচলিত আছে। খননকার্যের ফলে একটি স্বর্ণপাত্রে ষাঁড়ের মূর্তি আবিষ্কৃত হয়। পরবর্তীকালে অনেকে এটি শিবমন্দির ছিল বলে অনুমান করেন। আবার অনেকে মনে করেন, স্তুপটির ত্রিকোণবিশিষ্ট কুঠুরিগুলিতে বৌদ্ধ ভিক্ষু বা যোগীগণের ধ্যানাসন ছিল। এই হেতু এই স্তুপের নাম দেওয়া হয় মেধ, অর্থাৎ যজ্ঞ বা পূজার স্থান। বর্তমান গবেষকগণ মনে করেন অষ্টম-নবম শতাব্দীতে রাজা দেব পাল এই বৌদ্ধ মঠটি নির্মাণ করেন। লোককথা অনুযায়ী এককালে এই স্থানেই বেহুলার বাসরঘর ছিল। তবে বেহুলার কাহিনি এর অনেক আগের ঘটনা।
এবার আমার গন্তব্য পরশুরামের জীয়ৎকুণ্ড। এটি একটি বৃহৎ কূপ। প্রবাদ, এই কূপের জলপান করে পরশুরামের সৈন্যরা সুস্থ্ হতেন। কথিত আছে, মহাস্থানগড়ের শেষ ক্ষত্রিয় রাজা ছিলেন পরশুরাম। এই পরশুরামের সঙ্গে আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন দরবেশ হজরত শাহ সুলতান মাহমূদ বলখী (রহঃ)র যুদ্ধ হয়। সে অন্য ঘটনা। জীয়ৎকুণ্ড দেখার পর গেলাম শিলাদেবীর ঘাট। অনেকে শিলাদ্বীপের ঘাটও বলেন। মহাস্থানগড়ের পূবদিকে পাঁচিল খননের ফলে একটি দরজা আবিষ্কৃত হয়। এটিকে শিলাদ্বীপের ঘাটের দরজা বলে। আবার লোককাহিনি অনুযায়ী, শিলাদেবী পরশুরামের বোন ছিলেন। উনি অনূঢ়া ছিলেন। পূবদিকে প্রবাহিত করতোয়া নদীর তীরে এই স্থানে আত্মাহুতি দেন। সেই থেকে এই স্থানের নাম হয়েছে শিলাদেবীর ঘাট। পর্যটকদের বিশ্রামের জন্য নদীর তীরে একটি বাঁধানো চত্বর রয়েছে।
এবার গন্তব্য হজরত শাহ সুলতান মাহীসাওয়ার বলখী (রহঃ)-র মাজার শরীফ। উনি ছিলেন আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন। তাঁর সম্পর্কে অনেক কিংবদন্তী প্রচলিত আছে। সিঁড়িপথ দিয়ে ওপরে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে এলাম। দানপাত্রে কিছু দানও করলাম। তখন চারটে বেজে গেছে। কিছু জায়গা বাদ পড়ে গেল। ঘোরা হল না। রিকশাচালককে তার প্রাপ্য মিটিয়ে বাসে ওঠবার জন্য এগোচ্ছি, সে বলল উঠে বসুন। একেবারে বাসস্টপে বাসে তুলে দিয়ে সে বিদায় নিল। চারমাথার মোড়ে নেমে একটা ভাতের হোটেলে ভাত-ডাল-সব্জি খেয়ে একটা অটো ধরে তিনমাথার মোড়ে রেলগেটের কাছে নামলাম। ওখানেই আমার আবাসিক হোটেল। নিচের দোকান থেকে কেক-বিস্কুট কিনে দেখি, দুই ভাইয়ের মধ্যে দাদা বসে আছেন, আর তাদের বাবা।
আপনার জিনিসপত্র অন্য ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছি, একবার দেখে নিন। বলে দাদা চাবিটা আমার হাতে দিলেন। ওনাদের বাবা বললেন, এখানে অমুক বাড়িতে দুর্গা পুজো হয়, খুব নাম করা। সামনে একটা বারোয়ারী পুজোও হয়, যান গিয়ে দেখে আসুন। আর নবাব বাড়িটাও পারলে দেখে নেবেন। তখন সবে নবমীর সন্ধে নেমেছে আমি বললাম, এখন খুব ক্লান্ত লাগছে দেখি খানিক বাদে যদি বিশ্রাম নিয়ে যেতে পারি বলে ঘরে ঢুকে গেলাম। আর যেতে পারিনি। পরেরদিন আবার সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম। আজ যাব পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার, যা সোমপুর বিহার নামেও খ্যাত।
চারমাথার মোড় থেকে বাস ধরে জয়পুরহাট। দূরত্ব প্রায় ৬০ কিমির মতো। বাস স্ট্যান্ড থেকে জয়পুরহাট বাজার অটোতে করে যেতে হবে। বাজার থেকে পাহাড় বা বৌদ্ধ বিহার রিকশা বা সাইকেল ভ্যানে যাওয়া যায়। সোমপুর বৌদ্ধ বিহার ভারতবর্ষে অন্যতম বড় বৌদ্ধ বিহার বলে খ্যাত ছিল। অষ্টম শতাব্দীতে পাল বংশের রাজা ধর্মপাল এই বিহার স্থাপন করেন। টিকিট কেটে ঢুকতেই প্রাচীর বেষ্টিত বিশাল ময়দান। পাঁচিলের ধারে ধারে বিশ্রাম নেবার জন্যে বেঞ্চ রয়েছে। একটু এগোতেই বাঁ দিকের রাস্তায় জাদুঘর। জাদুঘর সেদিন বন্ধ ছিল। সোজা এগিয়ে গেলে বাঁ দিকে মন্দির। সিঁড়ির ধাপ দিয়ে উঠে চত্বরের ডান ও বাঁ দিকে বহু কক্ষের ভিত রয়েছে গোলকৃতি ভাবে মূল মন্দিরকে ঘিরে। আবার সিঁড়ি দিয়ে সমতলে নেমে মূল মন্দিরে ওঠার সিঁড়ি আছে। সমতল থেকে প্রায় ৭২ থেকে ৮০ ফিট উঁচু। মুসলমানদের রাজত্বকালে মূল মন্দিরের চূড়াটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কালে কালে ধুলো মাটি জমে পাহাড়ের আকার নেয় ও গাছপালা জন্মায় এবং জায়গাটার নাম হয় পাহাড়পুর।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বুকানন হ্যামিল্টন সাহেব এই পুরাকীর্তি প্রথম আবিষ্কার করেন এবং পরবর্তীকালে বহু প্রত্নতত্ত্ববিদ ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহযোগিতায় খননকার্যের ফলে সোমপুরবিহারের স্বরূপ ক্রমশ উদঘাটিত হয়। গুপ্ত ও পাল বংশের রাজার আমলে নির্মিত এই বৌদ্ধ বিহার। পাল যুগে একাধিক বৌদ্ধ বিহার বিভিন্ন স্থানে নির্মিত হয় এবং এদের মধ্যে একটা যোগসূত্রও দেখা যায়। বহু তিব্বতীয় ভিক্ষু নবম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে সোমপুরবিহারে পদার্পণ করেন। বিহারটির মন্দির কোন ভারতীয় মন্দিরের সঙ্গে সাদৃশ্য নেই। বরং বর্মা, জাভা, কম্বোডিয়ার ক্রূশাকৃতি ভিত্তিস্থাপন ও বৌদ্ধমন্দিরের পিরামিড স্থাপত্যের সঙ্গে মিল পাওয়া যায়। বিশেষ করে পাল যুগে পূর্বভারতের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটা যোগসূত্র দেখা যায়। সোমপুরবিহারে মধ্যস্থলে অবস্থিত মন্দিরটি ক্রূশাকৃতি এবং এর চারধারে প্রদক্ষিণ পথ আছে। পর্যটকদের ওপরে ওঠার সুবিধার জন্য লোহার সিঁড়ি করা হয়েছে। বিহারে এতগুলি কক্ষ থাকায় অনুমান করা হয়, যে এটি এককালে বৌদ্ধশিক্ষাকেন্দ্র ছিল। এখানে বিভিন্ন যুগের বহু দেবদেবীর মূর্তি ও অন্যান্য প্রত্নবস্তু আবিষ্কৃত হয়েছে যা জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। ভেতরে মন্দিরের গায়ে অনেক দেবদেবীর মূর্তি ও অন্যান্য চিত্র খোদিত আছে। মূল মন্দিরের ভেতর প্রবেশ করিনি বা লোহার সিঁড়ি দিয়ে ওপরেও উঠতে পারিনি। তাহলে অনেক কিছু তথ্য আরও জানতে পারতাম।
সোমপুর বৌদ্ধ বিহার থেকে বেরিয়ে এসে যথারীতি সাইকেলভ্যান ও অটো চেপে আবার বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছলাম। বাসে চেপে চারমাথার মোড়ে নেমে ভাতের হোটেলে ভাত খেলাম। তখন বিকেলের একটু আলো ছিল। ভাবলাম, নবাববাড়িটা ঘুরে নিলে মন্দ হয় না। একটা রিকশা নিলাম। আজ বিজয়া দশমী। ঠাকুর ভাসানের জন্যে ট্রাফিক পুলিশ সব রিকশা অন্য রাস্তায় ঘুরিয়ে দিচ্ছে। দেখলাম, বেশ কিছু ঠাকুর বেরিয়েছে। আমি জ্যামের মধ্যে রিকশায় বসে ঠাকুর দেখে নিলাম। রাস্তা ঘুরিয়ে দিতে রিকশাচালক নবাববাড়ি গুলিয়ে ফেলেছে। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে অবশেষে সে নিয়ে গেল। তখন সন্ধে হয়ে গেছে। ভাবলাম এখন বোধ হয় খোলা থাকবে না। দ্বাররক্ষীকে জিজ্ঞেস করে জানলাম সন্ধে সাতটা পর্যন্ত খোলা থাকে। টিকিট কেটে ঢুকলাম। ঢুকেই দুপাশে খোদাই করা চিত্রিত দেওয়াল। সামনের চত্বরে ছোটদের বিনোদনের জন্য ছোট রেলগাড়ি ও আরও নানা আয়োজন রয়েছে। স্ন্যাকসের একটা দোকানও আছে। বাগানে কিছু মূর্তি রয়েছে দেড়শ বছরের পুরোনো। বাড়িটি ব্রিটিশ আমলে নীল কুঠি ছিল। পরে নবাবরা এটি কিনে নেন। কিছু জীবজন্তুও ছিল। জীবন্ত ও মূর্তি। তবে সন্ধে হয়ে গিয়েছিল বলে আলো অপ্রতুল। বাড়িটির মধ্যে ঢুকতে গেলে আবার টিকিট কাটতে হয়। মানুষ-পুতুল দিয়ে সাজানো ড্রইং রুম। টেবিলের চারধারে বসে আছেন। অন্য ঘরে দেওয়ালে পরিচিতি সহ নবাবদের ছবি। গাইড দেওয়ালে পারিবারিক চিত্রকরের আঁকা কিছু ছবিও দেখালেন। এ ছাড়া নবাব আমলের কিছু বাদ্যযন্ত্র, অস্ত্রশস্ত্র ও পোশাক রয়েছে।
নবাব বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছু খাবার কিনে সোজা হোটেলের ঘরে ঢুকে গেলাম। তার আগে হোটেলের মালিককে জানালাম অনেক ঠাকুর দেখেছি, নবাব বাড়িও ঘুরেছি।
পরদিন খুব সকালে সাতমাথা বি আর টি সি বাসস্ট্যান্ডে টিকিট কাউন্টার থেকে ঢাকা যাওয়ার টিকিট নিলাম। বৃষ্টি পড়ছিল। টিকিট কাউন্টারে যে ভদ্রলোক টিকিট দিচ্ছিলেন, বললেন ঢাকার কোন বাসস্ট্যান্ডে যাবেন। আমি পড়লাম ফাঁপরে। বললাম ঢাকা থেকে সোনারগাওঁ, ময়নামতী ক্যান্টনমেন্ট যাব। বললেন, এখুনি পৌনে সাতটায় একটা বাস আছে। গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে যাবে। যদি মনে করেন, তবে ওটায় যেতে পারেন। আমি রাজি হয়ে গেলাম। উনি আমার হাতে একটা টিকিট দিয়ে একটা ছেলেকে ডেকে বললেন রাস্তা পেরিয়ে বাসে তুলে দিতে। পথে যেতে যেতে সহযাত্রীকে জিজ্ঞাসা করলাম, ঢাকায় গাবতলী বাসস্ট্যান্ডের কাছাকাছি সাধারণ মানের থাকবার হোটেল আছে কি না। ভদ্রলোক বললেন স্ট্যান্ডে ঢোকার আগেই বাসরাস্তাতে নেমে পড়বেন। এই বলে বাস কন্ডাক্টরকে ডেকে যেখানে আবাসিক হোটেল পাওয়া যাবে, সেখানে নামিয়ে দিতে বললেন। ঢাকায় নেমে একটা রিকশা নিয়ে দু চারটে হোটেল ঘুরে অবশেষে একটা হোটেলে উঠলাম।
পরদিন ভোরবেলাই বেরিয়ে পড়ব। সকালে উঠে রিকশায় চেপে বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে জানতে পারলাম গুলিস্তান বাস স্ট্যান্ড থেকে সোনারগাঁও যাওয়ার বাস পাওয়া যাবে। অগত্যা গুলিস্তান যাওয়ার বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকলাম। দুজন সহযাত্রীনির সঙ্গে আলাপ হল, তারাও গুলিস্তান থেকে যাবে। তবে সোনারগাঁও ছাড়িয়ে যাবে। তাদের সঙ্গে বাসে উঠে গুলিস্তান গেলাম। তারপর গুলিস্তানের বাস কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে সোনারগাঁও যাওয়ার বাসে উঠলাম। আমি মোগরাপাড়া চৌরাস্তা নামব। সেখান থেকে বাঁদিকে এক কিমি মতন যেতে হবে। একটা রিকশা নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছালাম। পথে যেতে যেতে রিকশাচালক ছেলেটি নতুন জাদুঘর দেখাল। তবে বন্ধ। সঙ্গে আমার লাগেজ রয়েছে। রিকশাচালক আমার জিনিসপত্র একটা সেলুনের ভেতর রেখে বলল, এনার জিনিসপত্র যদি কিছুক্ষণের জন্য এখানে রাখতে দ্যান, উনি সোনারগাঁও ঘুরে এখুনি ফিরে আসবেন। সেলুনের ছেলেটি বলল রাখুন তবে বেশি দেরি করবেন না। রিকশা ছেড়ে দিয়ে দু'পা এগিয়ে দেখি সামনের রাস্তায় ব্যারিকেড। যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ। পাশে টিকিট কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে সেই রাস্তায় প্রবেশ করলাম। দেখি একটি পরিত্যক্ত নগরী অতীতের স্মৃতি বহন করে চলেছে। পরপর বাড়িগুলি ইতিহাসের সাক্ষ্য দিচ্ছে।
বারো ভূঁইয়ার অন্যতম ঈশা খাঁর আমলে সোনারগাঁও সমৃদ্ধির শিখরে পৌঁছয়। সুবর্ণ গ্রাম থেকে সোনারগাঁও নামটি আসে। বৌদ্ধ শাসক দনুজ মাধব দশরথ দেব বিক্রমপুর থেকে সোনারগাঁয়ে তেরোশো শতাব্দীর মধ্যভাগে শাসনকার্য স্থানান্তরিত করেন। পানাম নগরী সোনারগাঁও অঞ্চলে। পানাম নগরী স্থাপিত হয় উনিশশো শতকে ব্রিটিশ আমলে। এটা সুতি বস্ত্রের বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। হিন্দু বস্ত্র ব্যবসায়ীরা তাদের গৃহ নির্মাণ করেন এই অঞ্চলে। এই গৃহগুলি তারই নিদর্শন। তবে সোনারগাঁওয়ে সুন্দর প্রাসাদ, লোকশিল্প মিউজিয়াম ও জয়নুল আবেদীন আর্ট এন্ড ক্রাফট মিউজিয়াম কোনটাই দেখা হয়নি। মিউজিয়ামের নতুন বাড়ি উদ্বোধন হয়নি বলে দেখা হয়নি। যাই হোক পরিতক্ত নগরীর পথে ঘোরার সময় এক ব্যক্তি, তার সঙ্গে অল্পবয়সী ছেলে, মনে হয় বাজার করে ফিরছিলেন। আমাকে ঘুরতে দেখে ওনারা দাঁড়িয়ে পড়লেন। জিজ্ঞাসা করলেন, মিউজিয়াম গেছেন? আমি বললাম নতুন বাড়িটা দেখলাম কিন্তু বন্ধ। উনি বললেন আমি আজ খুব ব্যস্ত নইলে আপনাকে চারপাশটা ঘুরিয়ে দেখিয়ে দিতাম। আপনি জমিদারবাড়ি যেতে পারেন, কাছেই। ওখানে বৃদ্ধ দম্পতি থাকেন। জমিদারবাড়ি গেলে অনেক কথা জানতে পারবেন। কাছেই শিব মন্দির আছে। বললাম দেখি পারি তো নিশ্চয়ই যাবো। টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। আমি তাড়াতাড়ি সেলুনে ঢুকে আমার জিনিসপত্র নিয়ে একটা রিকশায় উঠে পড়লাম। জমিদারবাড়ি যাওয়া হলো না, জাদুঘর দেখা হল না। শুধু এক টুকরো অতীত ইতিহাস মনে আঁকা হয়ে রইল। রিকশা আমাকে বাসরাস্তায় নামিয়ে দিল।
মোগরাপাড়া থেকে ময়নামতী ৬৮ কিমি। কুমিল্লা পৌঁছবার ৭ কিমি আগে ক্যান্টনমেন্ট। বাসে উঠে কন্ডাক্টরকে বললাম ময়নামতী ক্যান্টনমেন্ট যাব। যেখানে থাকার হোটেল পাওয়া যাবে, এরকম জায়গায় নামিয়ে দেবেন। আমি বৌদ্ধ বিহারগুলো দেখবো। ময়নামতী ক্যান্টনমেন্ট বাজারে সে আমাকে নামিয়ে দিল। বাস থেকে নেমে এদিক সেদিক তাকাচ্ছি, একটা ছেলেকে আসতে দেখলাম। তাকে হোটেলের কথা জিজ্ঞাসা করাতে সে আমার ট্রলিব্যাগটা নিয়ে, আসুন বলে খানিক এগিয়ে পাশের গলিতে ঢুকে, একটা বাড়ির তিনতলায় উঠলো। ব্যাগ রেখে ঘর খুলে রেজিস্টার খাতা নিয়ে এসে বলল, ম্যানেজার এখন নেই, আপনার কোন অসুবিধা হবে না। ময়নামতী ক্যান্টনমেন্ট সেনা বিভাগের এলাকার মধ্যে রয়েছে রাণী ময়নামতীর প্রাসাদ বর্তমানে ধ্বংসস্তুপ, একটি টিলা, চারপত্র মুড়া, কোটিলা মুড়া। কোটিলা মুড়া থেকে ৩ কিমি দক্ষিণে শালবন বিহার। তার ঠিক উল্টো দিকে নবশালবন বিহার থাইল্যান্ড সরকারের আনুকূল্যে প্রতিষ্ঠিত। শালবন বিহারের পাশেই জাদুঘর। সেদিন বিশ্রাম নিয়ে পরের দিন গেলাম শালবন বিহার। হোটেলের ছেলেটি একটি শেয়ারের টাটা সুমোয় তুলে দিল। টাটা সুমো আমাকে বড় রাস্তায় ছেড়ে দিল। সেখান থেকে রিকশা নিয়ে ভেতরে খানিকটা রাস্তা যেতে হবে। শালবন বিহারে নেমে টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকে দেখলাম পাঁচিল দিয়ে ঘেরা সুন্দর বাগানের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে পথ।
আমার সঙ্গে সাইকেল নিয়ে এক ভদ্রলোক ঢুকলেন। জানালেন তিনি এই বিহারের তত্ত্বাবধান করেন। সাইকেল অফিসঘরে রেখে এসে সমস্ত কিছু ঘুরে দেখাতে লাগলেন। সমতল থেকে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে হয়। ওপর থেকে কেন্দ্রস্থলে দেখা যায় মূল মন্দিরটি ক্রুশাকৃতি। চারিধারে ভিক্ষুদের বাসগৃহ। মধ্যস্থলে মূল মন্দির ছাড়াও অন্যান্য বৌদ্ধ মন্দির খননকার্যের ফলে উদ্ধার হয়েছে। তবে কোনটাই পূর্ণাঙ্গ মন্দির নয়, নিম্নাংশটুকু সংরক্ষণ করা গিয়েছে। ফলকে এর বিবরণ দেওয়া আছে। আগে এই প্রত্নস্থানটি শালবন রাজার বাড়ি নামে পরিচিত ছিল। খননের পর বেশ কিছু ভিক্ষুকক্ষবিশিষ্ট একটি বৌদ্ধবিহারের ভূমি নকশা উন্মোচিত হয়েছে। বিহারটিতে চারটি ও কেন্দ্রীয় মন্দিরে ছটি নির্মাণ যুগের প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। খননে প্রাপ্ত একটি পোড়ামাটির মুদ্রা থেকে জানা যায় এই বিহারটি দেব বংশের চতুর্থ রাজা শ্রী ভবদেব খৃষ্টীয় আট শতকে নির্মাণ করেছেন। এর আসল নাম ছিল ভবদেব মহাবিহার। খনন থেকে প্রাপ্ত প্রত্নবস্তুগুলির আনুমানিক কাল সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর। এগুলি শালবন বিহার জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। শালবন বিহার থেকে বেরিয়ে এসে পাশেই জাদুঘরে টিকিট কেটে ঢুকলাম। জাদুঘরে ঢোকার আগে পাশে ঘেরা এলাকায় কিছু ফসিল রাখা আছে। জাদুঘরে নানা মুদ্রায় বুদ্ধমূর্তি ছাড়াও নানান দেবদেবীর মূর্তি ও আছে। একটি বিশাল ঘন্টা দ্রষ্টব্য বস্তুগুলির মধ্যে অন্যতম। কোটিলা মুড়া, চারপত্র মুড়ার মডেল কাঁচের শোকেসে প্রদর্শিত হয়েছে। এছাড়া মুদ্রা ও নানান ব্যবহৃত বস্তুও রয়েছে। শালবন বিহার জাদুঘর থেকে বেরিয়ে, রিকশা নিয়ে, কাছেই রূপবানমুড়া ও ইটখোলা বিহারে গেলাম। সামনে সেনাবাহিনীর জওয়ানদের এলাকা। বড় রাস্তা থেকে বাঁদিকে খানিক চড়াইয়ে উঠে রূপবান বিহার। বিহারের খোলা চত্বরে প্রবেশদ্বার হচ্ছে। পাশে পাথরের ফলকে বিহারের বিবরণ লেখা আছে। সেখান থেকে ফিরতি পথে একটা অটো ধরলাম। একটুখানি রাস্তা, অটোচালক ভাড়া নিতে চাইলেন না। দুপা হেঁটে ইটখোলা বিহার। উন্মুক্ত এলাকায় দেখি একটি লোক মাঠের ঘাস ছাঁটছে। আমাকে দেখে উঠে এসে বললেন, যান সিঁড়ি দিয়ে উঠে দেখে আসুন বুদ্ধমূর্তি আছে। তবে মাথায় কোনো আচ্ছাদন নেই। আমিই দেখাশোনা করি। মাটি কোপাতে গিয়ে তামার ফলকে লেখা পেয়েছিলাম, মুদ্রাও পেয়েছিলাম। অফিসারের কাছে জমা দিয়েছি। এইজন্য ওনারা আমাকে পুরস্কার দিয়েছিলেন।
এবার হোটেলে ফিরে চললাম, আজই চট্টগ্রাম যাব, সঙ্গের ব্যাগ লাগেজ রুমে জমা করে দিয়েছিলাম। হোটেলের ছেলেটি আমার জিনিসপত্র নিয়ে একটা ভাড়ার টাটা সুমোয় আমাকে তুলে দিয়ে ড্রাইভারকে চট্টগ্রাম যাওয়ার বাসে তুলে দিতে বলে দিল। গাড়ির যাত্রীরা একে একে নেমে গেল। ড্রাইভার জানালো এখানেই শেষ, তবে আপনাকে আমি একটু আগে চট্টগ্রামের বাস যেখানে থামে সেখানে নামিয়ে দেবো। টাটা সুমো থেকে নেমে দাঁড়িয়ে আছি কোন বাসই থামে না। বলে সিট নেই। আগে থেকেই বোধ হয় বুকিং হয়ে গেছে, আমি মহিলা, তার ওপর বয়স্ক মানুষ, তাই হয়তো তুলতে রাজি হল না। রাস্তার উল্টোদিকে একজন বাস ধুচ্ছিল, জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবেন? বললাম, চট্টগ্রাম।
(ক্রমশঃ)
বাহাত্তর বছরের নীলিমা ঘোষ ঘরের কাজের থেকে সময় করে মাঝেমাঝেই বেরিয়ে পড়েন পথে। তাঁর আগ্রহ ভ্রমণস্থানটির প্রাকৃতিক, ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি।