ফিরে দেখা সেই কেদার

অরুণাচল চ্যাটার্জি

~ কেদারের আরও ছবি ~

চড়াই ভাঙতে ভাঙতে বার বার মন ফিরে যাচ্ছিল সেই চৌদ্দ বছর আগের দিনগুলিতে। তখন আমারও বয়স চৌদ্দ ছিল, চড়াই ভাঙতে এতটা কষ্ট হয়নি। আবার এটাও হতে পারে, নতুন যে রাস্তা এখন তৈরি হচ্ছে (যার কাজ তখনও শেষ হয়নি), তার দূরত্ব বা চড়াই আগের থেকে বেশি হয়েছে। রাস্তা ছিল ১৪ কিমি, গৌরীকুণ্ড থেকে কেদারনাথ, মাঝে দুদিক থেকেই ৭ কিমি দূরত্বে ছিল রামওয়াড়া চটি; যার অস্তিত্ব এখন আর নেই। রামওয়াড়া থেকে কিছুটা কেদারের দিকে এগিয়ে এলে আরও একটা চটি পড়ত - গরুড় চটি, সে চটির এখন আর প্রয়োজন পড়ে না, কারণ রাস্তার পরিবর্তন। একটা সময় ছিল যখন সারি সারি বাস দাঁড়িয়ে থাকতো গৌরীকুণ্ডের ওই কম পরিসরে; বাস, ট্রাক, প্রাইভেট গাড়ির ভিড়ে প্রায়শই ভয়ানক যানজট লেগে থাকতো। আর হরিদ্বার বা হৃষিকেশ থেকে সরাসরি ভুকহরতাল বা গাড়োয়াল মন্ডলের বাসে করে পৌঁছে যাওয়া যেত গৌরীকুণ্ডে। মনে পড়ে ছোট্টবেলায় যখন বাবা-মার সঙ্গে গিয়েছিলাম, বাস ধরেছিলাম হৃষিকেশ থেকে খুব ভোরে; আর বিকেল নাগাদ পৌঁছেছিলাম গৌরীকুণ্ডে। জায়গাটা পুরো মেলার মতন ছিল, মানে এত লোকজন, দোকানপাট সব গমগম করত, পাশাপাশি (সমান্তরাল) দুটো গলি ছিল, তার দুদিকে সারি দিয়ে দোকান, পর্যটকদের জন্য হোটেল ইত্যাদি। রাস্তা দিয়ে ঠিকভাবে চলার জো ছিল না। মনে পড়ে সুপ্রিয়া দেবীর হোটেলে পুরোদস্তুর বাঙালি খাবার খাওয়া, উষ্ণ প্রস্রবণে স্নান, আর খরস্রোতা মন্দাকিনীর আওয়াজ। সে আওয়াজ সারাদিন সঙ্গী ছিল। এই চৌদ্দ বছরে আমার জীবনে অনেক পরিবর্তন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু একটা ব্যাপারের আর কোনও পরিবর্তন হয়নি - তা হল হিমালয় প্রীতি। সেইবার কেদারনাথের পথের যে দৃশ্য দেখেছিলাম তখনই ঠিক করেছিলাম আবার ফিরে আসতে হবে। তাই এবার সস্ত্রীক চললাম আবার কেদারনাথ দর্শনে। এর মধ্যে ঘটে গেছে ভয়ঙ্কর এক দুর্ঘটনা, যা সবার জানা, ২০১৩-র জুনে সাংঘাতিক মেঘভাঙা বৃষ্টির ফলে চোরাবালি তাল ফেটে গিয়ে যে ধ্বংসলীলা চলেছিল, তাতে মন্দাকিনীর স্রোত পরিবর্তন থেকে তার পথের যাবতীয় রূপরেখার আমূল পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল। প্রাণহানিও যে কত হয়েছিল তা তো সবারই জানা। এই ঘটনার পরের বছর অর্থাৎ ২০১৪-তে কেদারনাথ যাত্রা প্রায় সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল পর্যটকদের জন্য। ২০১৫ -তে আবার চালু হতে এবছরই যাবার মনস্থির করে ফেললাম। উত্তরাখণ্ডের রাজ্য সরকার পর্যটকদের জন্য একটি নতুন ধরনের পরিচয় পত্র চালু করল, যাতে গাড়োয়াল-এর বিভিন্ন জায়গায় যাবার ছাড়পত্র ও সঙ্গে পর্যটকের যাবতীয় তথ্যাদি নথিভুক্তকরণ করা হল। সেই অনুযায়ী আমরা হৃষীকেশ-এর বাসস্ট্যান্ডের সামনের একটি হোটেলে গিয়ে উঠলাম। সুবিধা এই যে, সকালে কখন কোন বাস ছাড়ছে তার একটা ধারণা তৈরি হবে এবং ছাড়পত্রটিও করিয়ে নেওয়া যাবে। ভোরের একটি বাস ধরলাম, গন্তব্য গৌরীকুণ্ড। খুব ভোরে অন্ধকার থাকতেই বাস ছাড়ল। ছাড়ার পরই কিছু কথা কানে এল। বুঝলাম কন্ডাক্টার গৌরীকুণ্ড বলে বাসে তুলে, এখন বলছে রুদ্রপ্রয়াগ অবধি যাবে। কী বিপত্তি! অনেক বাক-বিতন্ডা করেও যখন বুঝলাম আর কিছু হবার নয়, তখন ছেড়ে দিলাম আর ভাবতে থাকলাম এরপর কী করে গৌরীকুণ্ড পৌঁছাব। সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ রুদ্রপ্রয়াগ এসে পৌঁছলাম। বাসের টিকিট বাবদ অতিরিক্ত টাকা ফেরত নিয়ে আর লটবহর নিয়ে খুঁজতে লাগলাম কোন্ বাস গৌরীকুণ্ড যাবে। কিন্তু কোনও বাস-ই পেলাম না যেটা ওখান থেকে সরাসরি গন্তব্যে নিয়ে যাবে। অগত্যা ট্রেকার-এ আরও অনেকের সঙ্গে সওয়ারি হয়ে চললাম গুপ্তকাশীর উদ্দেশ্যে। যা বুঝলাম, কোনও গাড়ি-ই আর সরাসরি গৌরীকুণ্ড যায় না। গুপ্তকাশী পৌঁছে আর একটি ট্রেকার করে সোনপ্রয়াগ। তখন ভাবছি আর কত ভেঙে ভেঙে যেতে হবে। এদিকে সময় আর খরচ দুটোই বেড়ে চলেছে। গাড়ি পেলেও, সে যতক্ষণ না ভর্তি হয়, ছাড়তেই চায়না। সন্ধ্যের মধ্যে গৌরীকুণ্ড পৌঁছতেই হবে। ২০১৩ দুর্ঘটনার জের যে বেশ ভয়ানক হয়েছে, সেটা বোঝা যাচ্ছে। বাসের কন্ডাক্টারকে জিজ্ঞাসা করে জেনেছিলাম যে বাস চলার উপযোগী রাস্তা আর নেই, তাই বাস ওপথে এখন আর যেতে পারবে না। পাশাপাশি পর্যটক সংখ্যাও অনেক কমে গেছে। যাই হোক অনেক কষ্ট করেই দুপুর নাগাদ গিয়ে পৌঁছলাম সোনপ্রয়াগ-এ। পৌঁছে দেখলাম নানাদিকে অবস্থার পুনরুদ্ধারের কাজ চলছে; নানারকম ক্যাম্প করা হয়েছে, পর্যটকদের সহযোগিতার জন্য।

গিয়ে জানা গেল এখান থেকে কোনও গাড়ি আর আগে যাবে না। পর্যটকদের জন্য নির্দিষ্ট কিছু শেয়ার জিপ (জনপ্রতি কুড়ি টাকা) বিকাল চারটের সময় সোনপ্রয়াগ থেকে গৌরীকুণ্ড-এ পৌঁছে দেবে। ওখানকার পুলিশই এই ব্যবস্থা করেছে কারণ সামনে কিছু বিপজ্জনক জায়গা আছে, সেগুলো সাবধানে পার করে দেওয়া হচ্ছে কড়া নজরদারিতে। রাস্তা বলে কিছু নেই, শুধুই ধ্বংসাবশেষ। তার মধ্য দিয়ে রাস্তা করা হচ্ছে। যে ব্রিজটা সোন নদীর উপর ছিল, সেটা জলের তোড়ে ভেসে গেছে। নতুন একটা টেম্পোরারি ব্রিজ দিয়ে সীমিত সংখ্যক গাড়ি চালানো হচ্ছে।

এত আগে পৌঁছে গিয়ে কী আর করা, শুধু বসেই সময় অতিবাহিত করা ছাড়া আর কোনও গতি নেই। সরকারী ক্যাম্পে আবার বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্যপরীক্ষার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। বিকেল তিনটের সময় ডাক্তারের কাছে প্রেসার, পাল্স পরীক্ষা করিয়ে, প্রয়োজনীয় কাগজ সংগ্রহ করে অপেক্ষা করতে থাকলাম কখন সেই জীপ আসবে তার জন্য। এদিকে আবহাওয়ার অবনতি হতে থাকল; শেষে বৃষ্টিও শুরু হয়ে গেল। ভাবছি রাস্তা আবার না খারাপ হয়ে যাত্রা ভন্ডুল হয়। ঠাণ্ডা বাতাসে কাঁপতে আরম্ভ করলাম, সঙ্গে রাখা গরম জামার আশ্রয় নিতেই হল। হঠাৎ শুনি জীপের আওয়াজ। পড়িমড়ি করে রুকস্যাক কাঁধে চাপিয়ে ছুটলাম দুজনে ওই গাড়ির উদ্দেশ্যে। এমন অবস্থা যেন দৌড়ে গিয়ে গাড়ির সীট না পেলে আমাদের যাওয়াই হবে না। ব্যাপারটা কিছুটা তাইই ছিল, পরে বুঝেছিলাম। মাত্র তিন-চারটে জীপ, তার মধ্যেই দখল করে উঠে পড়তে হবে। ব্যাপারটা খারাপই লেগেছিল, কিন্তু কী আর করা, 'যস্মিন দেশে যদাচার'। ব্যাগগুলো তো সব গাড়ির মাথায় তুলে দিয়েছিলাম, এদিকে বৃষ্টিও পড়ছে। ড্রাইভার ঠিকমত প্লাস্টিক দিয়ে ঢেকেছিল কি না সেই চিন্তাটা ছিলই। জামা-কাপড় ভিজলে এই ঠাণ্ডায় মুশকিলে পড়তে হবে, সে অভিজ্ঞতা আগে হয়েছে। যাই হোক শেষমেষ গৌরীকুণ্ডে উপস্থিত হলাম। গাড়ি থেকে ব্যাগ নামিয়ে আগের চেনা রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যাবার উপক্রম করতেই সম্বিত ফিরে এল। এ কোন্ গৌরীকুণ্ড! এরকম তো আগে ছিল না। পড়ন্ত বিকেল, মুখভারী আকাশ যেন আমার মনের ও বাস্তবিক পরিস্থিতিরই প্রকাশ বলে মনে হয়েছিল। গলি দিয়ে ক্রমশ এগোচ্ছি আর অতীত দৃশ্যপট মনের মধ্যে ভেসে উঠছে। এখানে তো এটার দোকান ছিল, ওই তো ওখানটায় এই খাবারের দোকানটা ছিল; এখন শুধুই ভাঙা দেওয়াল, আর কাদা ও পাথরে ভর্তি কিছু খোপ। মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। এ মা! উষ্ণপ্রস্রবণটাই তো নেই, আর আমার খুব প্রিয় সুপ্রিয়া হোটেল - সে তো এখন নদীর অংশ। পুরো গৌরীকুণ্ডটাই এখন শ্মশানস্বরূপ হয়ে পড়েছে।

"ও বাবু, ইধার আইয়ে" - চমকে স্মৃতি থেকে বাস্তবে। লোকটি সেই সোনপ্রয়াগ থেকে আমাদের পিছু নিয়েছে, নিজের হোটেলে নিয়ে তুলবে বলে। কখন যে গাড়ির পাশে ঝুলে পৌঁছে গিয়েছিল, খেয়ালই করিনি। সেই গৌরীকুণ্ডে নামার পর থেকে আবার পিছু নিয়েছে। হয়ত অনেক কিছু বিজ্ঞাপনও দিয়ে থাকবে নিজের হোটেল সম্পর্কে, আমি অত খেয়াল করিনি। তার হোটেলের ঘর দেখেশুনে নিয়েই ফেললাম। ঘরটা বেশ পরিষ্কার, তাই আর বেশি ঝামেলা করিনি, 'অফ -সিজন' -এ ওদেরও খুব অসুবিধার মধ্যে চলছে। এখন তো লোক আসাও কমে গিয়েছে আর এখন অক্টোবর মাস, আর কিছুদিন পরে কেদারনাথের শিব নেমে আসবেন উখিমঠ-এ, তখন তাঁর পুজো হবে সেখানেই, সারা শীতকাল। একটু ফ্রেশ হয়েই বেড়িয়ে পড়লাম গৌরীকুণ্ড-এর আশ-পাশটা দেখতে। কেদারনাথের দিকে যে পথ ওপরে উঠে গিয়েছে, তার ঢালে চলছে নতুন করে পাড় বাঁধানো বা নতুন কোনও কনস্ট্রাকশনের কাজ। পাশ দিয়ে সবুজ জল নিয়ে বয়ে চলেছে মন্দাকিনী। পরিবর্তন হয়নি সেই আওয়াজের যা অনেক বছর মনের মধ্যে বসেছিল। আবার তার পুনরুজ্জীবন ঘটল। মাঝে দু-একটা চায়ের দোকান, তার একটায় বসলাম। বাকী সবার চোখ-ই আমাদের দিকে; আর তো কোনও পর্যটক ছিল না দোকানে। চা আর প্রজাপতি বিস্কুট খেয়ে খানিক গরম হয়ে নিলাম। হোটেল থেকে বেরোবার আগে বলে রেখেছিলাম রুটি, আলুজিরা আর ডাল বানিয়ে রাখতে রাতের আহারের জন্য। হাতে আর একটু সময় ছিল তাই কিছুটা গৌরীকুণ্ড বাসস্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে এলাম। নদীর ধারের বাড়িগুলো আধ-ভাঙা অবস্থায় ঝুলছে নদীর ওপর। ঢালের বাড়িগুলো হেলে পড়েছে গলির ওপর, রাস্তার পাশের তলাগুলো সব ইট-কাঠ, কাদায় ভর্তি। দেওয়ালে পুরানো অনেক কিছুর স্মৃতি বুঝিয়ে দিচ্ছে আগের অবস্থা। জায়গাটা তো চারিদিক পাহাড় দিয়ে ঘেরা, সন্ধে নেমে আসছে খুব তাড়াতাড়ি। কিছু ছবি স্মৃতিস্বরূপ তুলে রাখলাম, আর মিতাকে পূর্বের অবস্থা ও অভিজ্ঞতার বিবরণ দিতে দিতে ফিরে চললাম হোটেলের দিকে।

পরেরদিন খুব ভোরে যাত্রা শুরু করতেই হল, কারণ যে ভাবে আমরা গৌরীকুণ্ড পৌঁছেছিলাম, তাতে একটা আশঙ্কা ছিল যে সামনের রাস্তার কী পরিস্থিতি হবে বা কতটা সময় লাগবে পৌঁছাতে। শুরুর দিকে চড়াই ভাঙতে একটু বেশিই কষ্ট হয়, যারা নিয়মিত পাহাড়ি রাস্তায় ট্রেকিং করেন, তারা নিশ্চয় এর কারণটা বুঝবেন। ধীরে ধীরে উচ্চতার সঙ্গে, পরিবেশের সঙ্গে খাপ খেয়ে শরীর তখন অতটা কষ্ট আর অনুভব করে না। আবহাওয়া আজ খুব পরিষ্কার লাগছে। একটা কথা বলে নেওয়া ভালো, পাহাড়ে সকালের দিকে আবহাওয়া সাধারণত খুব পরিষ্কার থাকে, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেঘলা হয়ে পড়ে, আর সঙ্গে বৃষ্টিও হতে পারে। পাহাড়ি বৃষ্টি, বর্ষাকাল বাদ দিয়ে, ক্ষণস্থায়ী হয়, পরিবেশ খুব তাড়াতাড়ি আবার পরিষ্কারও হয়ে যায়। পূর্বে যে জায়গাটা রামওয়াড়া চটি ছিল, এখন তার কোনও অস্তিত্ব চোখেই পড়ল না, কিছুটা এগিয়ে চোখে পড়ল রাস্তার ডানদিকে অর্থাৎ মন্দাকিনীর দিকেই একটা ছোট্ট হেলিপ্যাড। অনেকদিন আগেই হেলিকপ্টার-এ কেদার যাত্রা শুরু হয়েছিল। এখন গুপ্তকাশী থেকে ৭৫০০/- টাকায় যাতায়াত কেদার দর্শনের, মাত্র কুড়ি মিনিটে।

যাঁরা হেঁটে দৃশ্য উপভোগ করতে করতে কেদারদর্শনে চলেছেন, তাঁদের জন্য এ এক মানসিক বিড়ম্বনা। আপনি কষ্ট করে উঠছেন, আর কিছু লোক হুশ করে পৌঁছে যাচ্ছে "গন্তব্যে"। অবশ্য গন্তব্য পৌঁছানোই যে তাদের উদ্দেশ্য, আমাদের সেটা ছিল না। কিন্তু ওই গিরিখাতের মধ্যে দিয়ে চারিদিক কাঁপিয়ে হেলিকপ্টারের আওয়াজ বড়ই বেমানান। পাহাড়ের যে অংশ বালিপাথরের, সেখানে এই প্রচণ্ড আওয়াজ ভূমিধ্বসের সৃষ্টি করতে পারে। পথে মানুষের থেকে ঘোড়ার সংখ্যাই বেশি, তারাই সিমেন্ট, ইট, কাঠ, লোহার রড ওপরে বয়ে নিয়ে চলেছে। নতুন করে কেদার সাজাবার লক্ষ্যে। ভালোভাবে দৃশ্য উপভোগ করাই দায়। তবে ঘোড়া বা খচ্চর আগেও ছিল, কিন্তু তখন তারা মানুষবহনের কাজটাই বেশি করত। পথে যেতে যেতে ২০১৩ -এর ধ্বংসলীলার চিহ্ন যথেষ্টই চোখে পড়ছে, প্রায় কিলোমিটার ছয়েক হাঁটার পরই নদী অতিক্রম করতে হল। আগে যে পথ মন্দাকিনীকে ডানহাতে রেখে যেত, এখন গৌরীকুণ্ড থেকে কিছুদূর অগ্রসর হয়ে তা বাঁ-হাতে রেখে চলেছে। ব্রিজটি একেবারেই টেম্পোরারি, মূল রাস্তা প্রায় নদীর কাছে নেমে এসেছে, তারপর ওপারে গিয়ে আবার পাকদণ্ডী পথ ওপরের দিকে উঠে চলেছে।

দেখলাম এই ব্রিজের কিছু আগে নদীখাতের মাঝামাঝি জায়গায় নতুন একটা ব্রিজ তৈরি হচ্ছে। নদী পার হওয়ার সময় ব্রিজের ওপর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আশপাশটা ভালো করে দেখছি, পু্রনো রাস্তাটা পুরো ধ্বসে গেছে আর পাহাড়ের অবস্থাটাও সেরকম নয় যে ওখানে আবার রাস্তা তৈরি করা যাবে। তাই হয়ত নদী পেরিয়ে এ পাশে নতুন রাস্তার ব্যবস্থা। এই পাশের পাহাড়ের ঢাল বেয়ে কিছুটা এগিয়ে একটা বিস্তীর্ণ উপত্যকার সৃষ্টি করেছে। সেখান দিয়েই এঁকেবেঁকে রাস্তা উঠে গিয়েছে কেদারের দিকে। নদী পেরিয়ে সামনে খুব চড়াই ভাঙতে হল, মনে হচ্ছিল দম বেরিয়ে যাবে, সঙ্গের রুকস্যাকটাও বড্ড ভারী ছিল। আগে পুরো রাস্তার এতটা চড়াই ছিল না। এখন অনেকটা বেড়ে গেছে। এগোচ্ছি আর এপার থেকে ওপারের রাস্তাটা বার বার দেখছি, মধ্যে মধ্যে অনেকখানি করে ল্যান্ডস্লাইড হয়ে রাস্তার কোনও চিহ্নমাত্র রাখেনি। দূরে একটা চটি নজরে এল, লাল রঙের টিনের চাল, কিছু ক্যাম্পের মত আছে মনে হল। পথে পানীয় জলের পাইপও বসানো আছে। কিছু নতুন ছাউনিও করেছে। ভালো লাগল, খুব তাড়াতাড়ি সরকার পর্যটকের সুবিধার জন্য ব্যবস্থা নিয়েছে দেখে; এই শীঘ্রতার একটা সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণও আছে, তা হল, উত্তরাখণ্ডের বেশিরভাগ মানুষ এই পর্যটনশিল্পের উপর নির্ভরশীল, সঙ্গে সরকারের আর্থিক মুনাফাও রয়েছে। এই নতুন চটিটার নাম হল লীনচটি। খানিক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার শুরু হল চড়াই ভাঙা। আমরা খুব ধীরগতিতেই চলছিলাম, চারিদিক দেখা আর তা ক্যামেরাবন্দী করার 'বদ অভ্যাসের' কারণে। ফলতঃ বেলা বাড়ছিল, সঙ্গে আবহাওয়া খারাপ হওয়ার আশঙ্কাও। মেঘলা হচ্ছে মাঝে মাঝেই, আবার পরিষ্কারও হয়ে যাচ্ছে। সামনের নীলাকাশের 'ব্যাক্ড্রপ' -এ কেদারনাথ শৃঙ্গ দৃশ্যমান হচ্ছে প্রায়ই। এরই তো টানে পথ চলা, সঙ্গে কেদারডোম, আরও কত কত পিক্। অনেকটা চড়াই ভাঙার পর বহুদূরে একটা সবুজ উপত্যকা দেখা গেল, তার বুক চিরে এঁকেবেঁকে পথ উঠে গেছে আরও ওপরে, যদিও মাঝে কিছু উতরাইও আছে। মন বলছে আর উতরাই নয়, কারণ আবার যে উঠতে হবে। খালি মনে হয়, এ তো ১৪ কিমি পথ নয়। দূরত্ব কি তাহলে বেড়ে গেলো নাকি!

অনেকখানি চড়াই ভেঙে উপত্যকার একটা ধার ঘেঁষে পিছনে ফিরে তাকাই, উফ্ কী অপূর্বই না লাগছে! যে পথ, উপত্যকা আর ব্রিজ অতিক্রম করে এসেছি, তা ওপর থেকে সবই দৃশ্যমান। মন্দাকিনীর উপত্যকাও এক অপরূপ রূপ নিয়েছে সূর্যের হাল্কা আলোয়। এইখানে কিছুক্ষণ যাত্রাবিরতি নিয়ে, একটু পেটপুজো করে নতুন উদ্যমে আবার চলা, সামনে কেদারনাথ গিরিশৃঙ্গ। তারই কাছে পৌঁছতে হবে। অনেকটা খাড়া চড়াই ভাঙার পর সবুজ উপত্যকার অংশ কিছু সমতলের মত হয়েছে, মন বলছে আর একটু, তারপরই পৌঁছে যাব, বৃষ্টি আসার আগেই। আমরা ধীরে সুস্থে চারিদিক উপভোগ করতে করতে এগিয়ে চলেছি। একটা স্বপ্নপূরণের খুশি মনের মধ্যে সঞ্চারিত হচ্ছে, মিতাকে এই পথে নিয়ে আসার আর এই দৃশ্য দেখানোর অনেকদিনের সখ ছিল, তা পূরণ হচ্ছে। হাল্কা উঁচু-নীচু ঢালের বাঁদিকে একটা বোর্ড চোখে পড়ল, সেটা পড়েই মনটা একটু হালকা হল, এই তো আর মাত্র ১ কিমি, এসে পড়েছি।

কিছুটা এগিয়ে ডান হাতে চোখে পড়ল জি এম ভি এন-এর করা ছোট ছোট ক্যাম্প বা রিসর্ট এর মতো। একটু খোঁজখবর নিলাম রাত্রিবাস আর খাবারের ব্যাপারে। মন বলছিল আর একটু এগিয়ে নিশ্চয়ই আরো কিছু এরকম পাবো, এতটা পিছনে থাকলে খুব সুবিধা হবে না। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানতাম যে মন্দিরের আশে পাশে অনেক থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা পাওয়া যাবে, কিন্তু এও মনে হল বর্তমান পরিস্থিতি যে অন্যরকম। সবই নতুন 'কনস্ট্রাকশন'। আর কিছুটা এগোতে মূল হেলিপ্যাড চোখে পড়ল, বাঁদিকে, অনেকক্ষণই হেলিকপ্টারের আওয়াজ পাইনি; হয়তো এ বেলায় তা বন্ধ হয়ে যায়। পরিবেশ খুবই মেঘলা হয়ে আছে, মাঝে মধ্যেই মেঘে চারিদিকটাকে মুড়ে দিচ্ছে, আবার হাওয়ার দাপটে তা কেটেও যাচ্ছে। হেলিপ্যাডের পাশেই আবছা চোখে পড়ল সারি সারি টেন্ট, বেশ বড় বড়। কাছে যেতেই চোখে পড়ল একটা অফিসঘর, ক্যান্টিন, ইত্যাদিও আছে। জানলাম ক্যাম্পটা NIM -এর (Nehru Institute of Mountaineering) সদস্যরাই চালাচ্ছে। একশ টাকা জনপ্রতি একরাতের জন্য হিসাবে, টেন্ট এ বেড ভাড়া দেওয়া হয়, সঙ্গে স্লিপিং ব্যাগও। আর দুবার ভাবতে হয়নি। একটি টেন্টে দশ জন থাকতে পারে। আমরা 'ফ্যামিলি' বলে, দেখেশুনে একটা টেন্ট দেওয়া হল, লাঞ্চের সময় শেষ, তাই ক্যান্টিনে অন্যকিছু খাবারের জন্য বলে রাখলাম। ওদের একজন টেন্টটা দেখিয়ে দিল। ঢুকে দেখলাম, দুটো সারিতে পাঁচটা করে ক্যাম্প কট, প্রত্যেকটিতে একটা করে ভালো গদি, স্লিপিং ব্যাগ আর বালিশ রাখা আছে। একপাশে পাঁচটা বেড ভর্তি ছিল, আমরা অন্য পাশের দুটো বেড দখল করলাম। এই ব্যবস্থা পেয়ে আমাদের তো আর আনন্দ ধরে না। এরকম পাবো তো ভাবিও নি। যাক, কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে, ঠাণ্ডার জন্য উপযুক্ত পোষাক পরে, ক্যান্টিনের দিকে চললাম।

ঠাণ্ডায় গরম গরম চায়ের যে কী মহিমা, তা আর বলার নয়। কনকনে হাওয়ার দাপটে ঠাণ্ডাটা বেশ জাঁকিয়েই পড়েছে। তখনও সন্ধ্যে হয়নি। তাই চা-টা খেয়ে আমরা চললাম মন্দির প্রাঙ্গণের দিকে। নতুন বাঁধানো রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছি, একপাশে ইট তৈরির কাজ হচ্ছে, কোথাও বোল্ডার ভাঙার কাজ চলছে। রাস্তার আশেপাশে আরো কিছু ক্যাম্প চোখে পড়ল। মন্দাকিনীর নদীখাত বলে এখানে কিছু নেই। নদীর ওপারে ভাঙা ঘরবাড়ি চোখে পড়ছে, কিছু না ভেঙে পড়া বাড়িও রয়েছে, কিন্তু সেখানে আর পর্যটক যায় না, যাওয়ার দরকার পড়ে না। আগে নদীর ওই পাড়েই বসতি ছিল আর একটা পুল পেরিয়ে এপারে আসতে হত মন্দিরদর্শনে। মন্দাকিনী আগে মন্দিরের বাঁদিক দিয়ে বয়ে যেত এবং ইচ্ছে করলেই সেই নদীতে নেমে মন্দাকিনীর সবুজ কনকনে ঠাণ্ডা জল স্পর্শও করা যেত। দেখলাম মন্দিরটা একটা দ্বীপের মত অংশে রয়েছে, আর তার দুপাশ বেয়ে মন্দাকিনীর স্রোত বয়ে চলেছে। নদী নতুন খাতে বওয়ার সময় যে কী ভয়ানক ধ্বংসলীলা চালিয়েছে, তার প্রমাণ প্রত্যক্ষ করছি আর মনটা বিষাদে ভরে উঠছে। '১৩-র এই ঘটনায় চোরাবালি তাল-এর জলরাশি পুরোটাই মন্দাকিনীতে এসে পড়ে, আর তার ফলস্বরূপ যে হড়্কা বানের সৃষ্টি হয়, সঙ্গে আকাশভাঙা বৃষ্টি তো ছিলই, তাতেই নদীর দিক পরিবর্তন। মন্দিরের আশেপাশের যাবতীয় বাড়িঘরের অস্তিত্ব বলতে শুধুই ভাঙাচোরা দেওয়াল আর বেরিয়ে থাকা রড।

শুধু মন্দিরটাই বেঁচে গেছে একটা বড় বোল্ডারের জন্য, এমনটাই মনে করা হয়। মন্দিরের ঠিক পেছন দিকে এক মানুষ উঁচু আয়তাকার পাথর, পাহাড়ের গা থেকে জলের স্রোতে গড়াতে গড়াতে এসে থমকে যায়। আর সেটাই নাকি ভয়ঙ্কর জলস্রোতকে রোধ করে, মন্দিরের দেওয়ালকে বাঁচিয়ে দেয়। এই বিপুল জলরাশি, প্রচুর পরিমাণে বালি, পাথর, নুড়ি নিয়ে হাজির হয় ওই চত্ত্বরে। বান-এর জল বেরিয়ে যাওয়ার পর পুরো অঞ্চলটাই চাপা পরে বালি, মাটি পাথরে। আমরা এখন যেখান দিয়ে হেঁটে চলেছি, সেটা আগের একতলার ছাদ-এর সমান। দেখতে পাচ্ছি বাড়িগুলোর একতলা সব চাপা পড়ে গেছে। মন্দির প্রাঙ্গণে ওঠার তাই আর কোনো সিঁড়ির দরকার পড়ে না।

মন্দিরের বাঁদিকে ভারত সেবাশ্রম সংঘের বাড়ি ছিল মনে পড়ে। সবই এখন মাটির নিচে, যেদিকেই তাকাই সেদিকেই দেখি হয় ভাঙা বাড়ির দেওয়াল, মাটি থেকে বেরিয়ে আসা ঢালাইয়ের রড বা ভাঙাচোরা আসবাবপত্র। মাটির নিচে যে কত জনের সমাধি রয়েছে তা বলা মুশকিল। মন্দিরের পাশে এখন আর কোনো দোকান নেই। কিছু লোক মাটিতে বা ছোট্ট টেবিলে তার পসরা সাজিয়ে বিক্রির আশায় বসে। সন্ধে সাতটা অবধি আরতি, ততক্ষণ পর্যন্ত বসে থাকা আর কী। পসরার মধ্যে শুকিয়ে যাওয়া ব্রহ্মকমল চোখে পড়ল। এখান থেকে আসল ব্রহ্মকমল দেখার জন্য নদী পেরিয়ে উঠে যেতে হয় বাসুকি তাল-এর উদ্দেশ্যে। পথেই মেলে ব্রহ্মকমল। তাল-এর আশেপাশেও আছে শুনেছি, স্বচক্ষে আর দেখা হয়ে ওঠেনি। ঠাণ্ডার দাপট বাড়তে থাকায় ফিরে চললাম টেন্টের দিকে, প্রায় ১ কিমি হাঁটতে হবে। মন্দিরের কাছাকাছি কোনো থাকার জায়গা নেই। মন্দাকিনীর নতুন পথের পাড় বাঁধানো চলছে। জায়গাটা পুরোটাই অচেনা লাগছে। শুধু ব্যাকড্রপটাই অচল, অপরিবর্তিত। টেন্টে ফিরে আবার কিছু স্ন্যাক্সের সঙ্গে চা খেয়ে রাতের খাবারের কুপন কেটে নিলাম; ষাট টাকা জনপ্রতি। সন্ধেতে এখানে সৌরবিদ্যুৎ-এর আলোয় ক্যাম্পটা চলে। ক্যাম্পের পশ্চিমে নদীর দিকে সার দিয়ে টয়লেট তৈরি করে রাখা আছে, জলাধারও করা আছে। হেলিপ্যাডে দেখলাম কিছু মানুষ ভলিবল খেলছে। দৈনিক একঘেয়ে জীবনে কিছু আনন্দের অবতারণা আর কী! রাতের আহার বেশ তাড়াতাড়ি সারতে হল, দেরি করলে খাবার মিলবে না। আকাশ বেশ পরিষ্কার, মনে হল কাল সকালের দিকেও আকাশ পরিষ্কারই থাকবে। আমাদের প্ল্যান অনুযায়ী সেই সময়ে আবার মন্দিরের দিকে যাব আর কিছু দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করব। খুব ভোরে উঠে দেখলাম বাইরে বড্ড কুয়াশা, তখন আর বেরোলাম না। সকাল সাতটা নাগাদ আকাশ পরিষ্কার হল। পরিকল্পনামত আমরা বেরিয়ে পড়লাম আশপাশের দৃশ্য উপভোগ করতে। তখন সবে কেদারনাথ শৃঙ্গে আলো পড়েছে। বরফঢাকা কেদারশৃঙ্গ যে কী অপরূপ লাগছে, তা ভাষায় বর্ণনা করা মুশকিল। ধীরে ধীরে কেদারনাথের পাশের শৃঙ্গগুলিও চকচক করে উঠল, স্বর্ণালোকের দ্যুতিতে।

কেদারনাথ মন্দিরের ব্যাকড্রপে সোনারোদমাখা পর্বতগুলোর আকর্ষণেই তো আমার আবার ছুটে আশা এই পথে। কেদার ডোমও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, বরফহীন একটি পর্বতও রয়েছে ঠিক মন্দিরের পেছনে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পুরো শৃঙ্গমালা রোদে ঝকঝক করে উঠল। আমার স্বাদপূরণ, সঙ্গে মিতারও। এবার ফেরার পালা। টেন্টে ফেরার পথে কিছুটা এগিয়ে আসতে আসতেই কানে আসছিলো হেলিকপটারের শব্দ। ওই শুরু হল কেদার দর্শনার্থীর ফেরি - গুপ্তকাশী থেকে। যারা গতকাল এসে পৌঁছেছিল, তারা আজ ফিরে যাচ্ছে। অনেকে দিনে দিনেও ফিরে যায়। আমরাও ফিরব; সেই এক-ই পাহাড়ি পথ ধরে, চারপাশের ছবি তুলতে তুলতে, ডিজিটাল ক্যামেরায় নয়, মনের।

~ কেদারের আরও ছবি ~

অধ্যাপনার পাশাপাশি অরুণাচল চ্যাটার্জি বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ানোটা অভ্যেসে পরিণত করেছেন। বিভিন্ন পরিবেশে উপস্থিত জীববৈচিত্র্য তাঁকে আকৃষ্ট করে আর তাই জলে-জঙ্গলে-পাহাড়ে ঘোরার নেশা নতুন নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ে সহযোগিতা করে।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher