সুন্দরী নরওয়ে

পদ্মাবতী মণ্ডল


~ নরওয়ের আরও ছবি ~

অনেকদিন থেকেই মনের মধ্যে ছোটবেলায় ভূগোল বইতে পড়া সেই নিশীথসূর্য, মেরুজ্যোতি, ইগলুর দেশ নরওয়ে ভ্রমণের ইচ্ছে ছিল। ২০১৬ সালের জুলাই মাসে হঠাৎ করেই সুযোগ জুটে গেল। তখন আমি গবেষণাসূত্রে সুইৎজারল্যান্ডের বাসেল শহরে বসবাস করি। জুলাই মাসের শুরুর দিকে প্ল্যান হয়ে গেল। জার্মানির উত্তরে হামবুর্গ শহর থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হল গাড়িতে ২০ জুলাই বিকেল পাঁচটায়। কিরণদা চালাবে গাড়ি, সুস্মিতাবৌদি সামনে আর আমি একগুচ্ছ মালপত্রের সঙ্গে পিছনে। টানা বারোদিন ধরে কিরণদা আর বুম্বাই (দাদা আর বৌদি ওদের বিএমডাবলু গাড়িটাকে ওই নামেই ডাকে) আমাদের ভরসা। গন্তব্য ডেনমার্ক, সুইডেন, দক্ষিণ নরওয়ে হয়ে উত্তর নরওয়ের নরদকেপ অর্থাৎ পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তরে যতদূর অবধি স্থলপথে যাওয়া যায়।

হামবুর্গ থেকে টানা পাঁচঘণ্টায় আমরা পৌঁছে গেলাম ডেনমার্ক-এর উত্তরের বন্দর ফ্রিদ্রিক্সহাফেন-এ। সেখান থেকে চার ঘণ্টায় জাহাজপথে সুইডেন-এর বন্দর শহর গথেনবুরগ-এ। এই জাহাজগুলো এতটাই বড় হয় যে বড় বড় ট্রাক, বাস, গাড়ি, ট্রেন অবধি ঢুকে যায়। জাহাজের ভিতরেই রয়েছে রেস্টুরেন্ট, শপিং মল, বাচ্চাদের খেলার জায়গা ইত্যাদি। বুম্বাকেও জাহাজে তুলে নেওয়া হল। গথেনবুরগ-এ সারাদিন কিরণদাদের পরিচিত কয়েকজনের আতিথেয়তা গ্রহণের পর ওইদিন বিকেলে আমরা নরওয়ের ওসলোর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। সেদিন রাতে আমাদের জীবনে প্রথম তাঁবু খাটানো ও তাঁবুতে থাকার অভিজ্ঞতা হল। ওসলোর কাছাকাছি একটা ক্যাম্পিং প্লেসে। চারদিকে অনেক তাঁবু এবং কারাভান। স্ক্যান্দানাভিয়ান দেশগুলোতে নিরাপত্তার অভাব নেই বলে যেখানে সেখানে তাঁবু খাটান যায়। কিন্তু প্রধানত টয়লেট-এর অসুবিধার জন্যই ক্যাম্পিং প্লেসে তাঁবু খাটিয়ে থাকা। জুলাই মাস বলে সারারাত আলোর মধ্যেই ঘুমাতে হল।

পরদিন সকাল সকাল সব গুছিয়ে আবার বেরিয়ে পরলাম। ঠিক হল রাস্তায় কোন ভালো জায়গা দেখে প্রাতরাশ করা যাবে। জিনিসপত্র সব সঙ্গেই আছে। আর সেই ভালো জায়গা খুঁজতে গিয়েই হল বিপত্তি। একটা দুর্ঘটনা যার জন্য আমাদের বুম্বাকে হারাতে হল। এটা ভ্রমণকাহিনি বলে ওই দুর্ঘটনা নিয়ে আর বেশি কিছু লিখছি না। শুধু বলি যে এর জন্য আমাদের একটা গোটা দিন নষ্ট হল। ওইদিন রাত্রে আমরা ওসলো-র উতরে হনেফস নামে এক মফঃস্বল এলাকায় হোটেলে রাত্রিবাস করলাম। ওই দুর্ঘটনার দরুণ আমরা সকলে এত ক্লান্ত ছিলাম যে ক্যাম্পিং প্লেস খোঁজার আর উৎসাহ ছিল না। আর তাছাড়া খুঁজবই বা কিভাবে। বুম্বা যে অচল হয়ে গেছে। যাই হোক, ইনসিওরেন্স কোম্পানির দৌলতে আমাদের আর একটি গাড়ির ব্যাবস্থা হল । জোর বৃষ্টির মধ্যে সমস্ত জিনিসপত্র দুর্ঘটনাবিধ্বস্ত বুম্বা থেকে নতুন গাড়িতে স্থানান্তরিত করে বুম্বাকে চোখের জলে বিদায় দিয়ে নতুন উদ্যমে পরের দিন সকালে আবার যাত্রা শুরু করলাম।

আগের দিনের ওরকম বাজে অভিজ্ঞতা আর নতুন গাড়ি কিরণদার হাত সেট হতে সময় লাগবে এই ভেবে প্রথম দিকে বেশ একটু ভয় ভয় করছিল। তবে সুন্দরী নরওয়ের সৌন্দর্য খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের সেই ভয় ক্লান্তি সবকিছু মুছে দিল। একটু পরেই একটা অদ্ভুত গ্রামের দেখা পেলাম যেখানে লাল লাল বিচ্ছিন্ন ছোট ছোট সব বাড়ি রয়েছে। ঠিক মনে হচ্ছে যেন এ গ্রামের কেউ কারোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখে না। এরকম বাড়ি নরওয়ের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে পরে।

সেখানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে আমরা আবার রওনা দিলাম। কয়েক ঘণ্টা পর হঠাৎ দেখলাম পাহাড়গুলো সব ন্যাড়া হয়ে এসেছে। মাঝে মাঝে বরফ। পুরো ল্যান্ডস্কেপটা যেন হঠাৎই পালটে গেল। বুঝলাম আমরা অনেক ওপরে উঠে গেছি যেখানে ঠাণ্ডার জন্য তেমন গাছগাছালি জন্মায় না। সেখানে একটা হ্রদের ধারে আমরা দুপুরে খাওয়ার জন্য থামলাম। গাড়ি থেকে পোর্টেবল গ্যাস ও অন্যান্য সরঞ্জাম বের করে শুরু হল আমাদের বোহেমিয়ান জীবনের প্রথম পিকনিক। এসব দেশে এইরকম বোহেমিয়ান ট্যুরিস্টদের জন্য এখানে সেখানে বেঞ্চ টেবিল এসব পাতা থাকে। মেনুতে পাস্তার সঙ্গে একটা লেন্টিল স্যুপের মিশ্রণ। আর সেটাকে মশলাদার করতে বাসেল থেকে নিয়ে যাওয়া কাঁচা লঙ্কার ফোড়ন। মানে ইতালি, জার্মানি ও ভারতবর্ষ মিলেমিশে একাকার। সামনে হ্রদ, তার ওপাশে বরফ - এরকম প্রাকৃতিক পরিবেশে আমাদের প্রথম মধ্যাহ্নভোজনটাও জমে ক্ষীর। আবার যাত্রা শুরু।

নরওয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমাদের আগেরদিনের দুর্ঘটনার রেশ মুছে দিয়েছে। এইটুকু দেশের মধ্যে এত সৌন্দর্য, এত বৈচিত্র্য। এই সবুজ, এই আবার ন্যাড়া পাহাড়, এই জঙ্গল, তো এখনিই আবার হ্রদ, এই বরফ, তো আবার পাহাড়ি নদী, কখনো সমুদ্র, কখনো ফিওরদ আবার পরক্ষণেই ঝরনার দেখা মিলছে। তারপর দেখতে পেলাম প্রথম ফিয়রদের যেটাকে বাংলা ভাষায় আমরা খাঁড়ি বলি। অনেকটা কেরালার ব্যাক ওয়াটারের মত। শুধু এখানে দুদিকে সমতল ভূমির বদলে উঁচু উঁচু পাহাড়। মাঝে মাঝে আমরা কখনো সেইসব সৌন্দর্য আরও বেশি করে উপভোগ করার জন্য, কখনো ক্যামেরাবন্দী করার জন্য ও কখনোবা আমাদের গাড়িচালককে আরাম দেওয়ার জন্য, বা চা-কফি পানের জন্য ছোট ছোট বিরতি নিচ্ছিলাম। ওইদিন আমরা রাত আটটা নাগাদ লেয়ারডাল এ ক্যাম্পিং করলাম। রাতের মেনু ডাল ভাত ও পকোড়া।

পরদিন সকালেই স্নান এবং প্রাতরাশ সেরে গেলাম ওখান থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে একটি বিখ্যাত স্তিভ চার্চ দেখতে। জায়গাটা এতটাই নির্জন ও ফাঁকা আমরা তো প্রথমে খুঁজেই পাচ্ছিলাম না। পরে এক ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করতে স্তিভ চার্চের খবর পাওয়া গেল। নরওয়েতে মাতৃভাষা নরওয়েইআন হলেও সবাই মোটামুটি ইংরাজি বলে। তাই ওখানে ভাষার জন্য কোন ভাবনাচিন্তা করতে হচ্ছিল না যেটা ইউরোপের অন্য অনেক দেশের প্রধান সমস্যা। এবার স্তিভ চার্চের কথায় আসি। এই চার্চগুলো নরওয়ে স্পেশাল – পুরোটাই কাঠের তৈরি এবং কালো রঙের।

ওখান থেকে ফেরার সময় একটা ২৫ কিমি. লম্বা টানেলের ভিতর দিয়ে যেতে গিয়ে সে কী প্রচণ্ড ভয় আমার। পর পর বড় বড় গাড়ি একের পর এক ওভারটেক করেই যাচ্ছে ওই সরু দুই লেন-এর বোথওয়ে টানেল দিয়ে। শুধু ভয় হচ্ছিল এখনি না কিছু একটা ঘটে যায়। এরকম টানেল পুরো নরওয়েতে ছড়িয়ে আছে। সুইৎজারল্যান্ডের মতো পাহাড় কেটে কেটে গাড়ি যাতায়াতের জন্য এইসব টানেলগুলো বানানো। তারপর গাড়ি নিয়ে লোম-এর কাছে সরু পাহাড়ি রাস্তায় ঘুরে ঘুরে উঠতে গিয়ে আবার বিপত্তি। গাড়িটা খুব শক্তপোক্ত নয় বলে পাহাড়ে উঠতে গিয়ে ইঞ্জিনের ওপর চাপ পরে ইঞ্জিন থেকে প্রচুর ধোঁয়া বেরোতে শুরু করল। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর সেটা একটু ঠিক হতে আমরা আরও ওপরে একটা ভিউ পয়েন্টে গেলাম। সেখান থেকে কয়েকটা পর্বতশৃঙ্গের মনোরম দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম।

জার্মানির কিল শহরের দুই বাইক আরোহীর সঙ্গে পরিচয় হল। আমাদের মত ওরাও জার্মানি থেকে পুরো রাস্তা স্থলপথে বাইক নিয়ে এসেছে। দুপুরে ওই পাহাড়ের ওপরে গ্লেসিয়ারকে সামনে দেখতে দেখতে রান্না ও খাওয়া দাওয়া হল। খাওয়া শেষ হতেই কোথা থেকে যেন মুষলধারে বৃষ্টি নামল। আমরা গাড়িতে সবকিছু তাড়াতাড়ি তুলে আবার রওনা দিলাম। পরবর্তী গন্তব্য গাইরাঙ্গার পাস ও গাইরাঙ্গার ফিওরদ। সেখানে জাহাজে চড়ে গাইরাঙ্গার ফিওরদ এর মধ্য দিয়ে যেতে যেতে নরওয়ের বিখ্যাত ঝরনাগুচ্ছ দেখলাম। পর পর সাতটি ঝরনার সমষ্টি এই ঝরনাগুচ্ছের নাম সেভেন সিস্টারস (সাত বোন)। জাহাজের গাইড এই সেভেন সিস্টারস এর অনেক প্রচলিত গল্প শোনাল। প্রায় দু ঘণ্টা পর পৌঁছলাম হেলেসিলত-এ। ওখানেই আমাদের ওইদিনের মত যাত্রা শেষ করে একেবারে ফিওরদ-এর ধারেই ক্যাম্পিং প্লেস-এ তাঁবু খাটালাম। কিরণদা তো সঙ্গে সঙ্গে ছিপ নিয়ে ফিওরদ-এ মাছের সন্ধানে বেরোলো এবং আমি আর বৌদি রাতের খাবারের আয়োজনে লাগলাম।

পরদিন ভোর হতেই একটা বিশাল বড় জাহাজ এসে লাগল ওখানে। ছোট্ট জনপদ মুখরিত হয়ে উঠল জাহাজযাত্রীদের কলকাকলিতে। আমরাও প্রাতরাশ সেরে রওনা দিলাম। পরের গন্তব্য ভয়ঙ্কর ত্রলস্তিগেন পাস। ওই সরু পাস দিয়ে একের পর এক গাড়ি, ক্যারাভান এমনকি বাস ট্রাকও পেরোচ্ছে। একটা কিছু আটকে গেল মানে সবার আটকে যাওয়া। একদিকে বিশাল নিচু খাত আর অন্যদিকে পাহাড়ের গায়ে ঝরনা। ছোটবেলায় পড়া সঈয়দ মুজতবা আলির যাত্রাপথের খাইবার পাসকে যেন স্বচক্ষে দেখলাম ও অনুভব করলাম।

এরপর বহু পথ পেরিয়ে দুপুর নাগাদ থামলাম আটলান্টিক রোড-এ। এই বিখ্যাত ৮ কিমি রাস্তাটির দুদিকেই সমুদ্র যেটা আটলান্টিক মহাসাগরে মিশেছে। তাই এই নামকরণ। বছরের এই সময়টাতে সমুদ্র শান্ত থাকলে শুনেছি নাকি শীতকালে অনেক সময় সমুদ্র উত্তাল হয়ে রাস্তা দিয়ে যাওয়া গাড়িগুলোকে পুরো ভিজিয়ে দেয়। ওখানে নেমে লাঞ্চ করলাম ও প্রচুর লোকজন ওখানে মাছ ধরছিল দেখে আমরাও ছিপ নিয়ে একটু মাছ ধরার বৃথা চেষ্টা করলাম।

ওইদিন রাত্রে আমাদের ক্যাম্পিং হল ত্রন্দহাইম-এর কাছাকাছি একটা জায়গায়। যত উত্তরে যাচ্ছিলাম তত দেখছি ক্যাম্পে তাঁবুর সংখ্যা কম ও কেবিনের সংখ্যা বেশি। হয়তো ঠাণ্ডা বাড়ার জন্য। আর প্রায় সব ক্যাম্পেই তাঁবু ব্যবহারকারীদের জন্য আলাদা কিচেন রয়েছে।

পরেরদিন সারাদিন টানা সাত ঘণ্টা শুধুই গাড়ি যাত্রা। মাঝে শুধু একবার লাঞ্চ ও বিকালের চা পানের জন্য দাঁড়ানো হয়েছিল। নরওয়ের এই অংশটার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য একটু কম। ঘন একঘেয়ে জঙ্গল। তারই মাঝে কোথাও সুন্দর কিছু চোখে পড়লে নেমে ক্যামেরাবন্দি বা হৃদয়বন্দী করতে ছাড়িনি আমরা। মোইরানা-তে পৌঁছে ক্যাম্পিং প্লেস আর খুঁজে পাওয়া যায় না। অনেক কষ্টে দু-তিনটে দেখার পর রাত নটা নাগাদ একটাতে জায়গা পাওয়া গেল। সেদিন রাত্রে ঘুমানোর পর শুরু হল মুষলধারে বৃষ্টি। হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম ভেঙে দেখি তাঁবুর ভিতরে চারিদিক জলে থইথই করছে। স্লিপিং ব্যাগের ভিতরেও পায়ের দিকটায় জল ঢুকে গেছে। ওই রাতেই কাপড় এবং টিস্যু পেপার দিয়ে সব জল মুছে ওইরকম ভিজে অবস্থাতেই কোনভাবে রাতটা কাটালাম।

পরের দিন সকালে যাত্রা শুরু করে দুপুরের দিকে পৌঁছলাম পোলার সার্কেল সেন্টার-এ। মানে সেখানে অক্ষাংশ ৬৬.৬৬°। আর আমার বাড়ি শান্তিনিকেতনের ঠিক তার অর্ধেক মানে ৩৩.৩৩°।

সে যাই হোক, সেখানে কিছু কার্ড ও স্মৃতিচিহ্ন কিনে আবার গাড়িতে উঠলাম। বিকেল চারটে নাগাদ পৌঁছলাম বোদোতে। ওখান থেকে আমরা সমুদ্রের মধ্য দিয়ে জাহাজসফরে যাব লোফোটেন দ্বীপ-এ। মাঝসমুদ্রে জাহাজ থেকে মধ্যরাত্রির সূর্য দেখার লোভে চার ঘণ্টার জাহাজটা ছেড়ে আমরা ছ'ঘণ্টার জাহাজটা নিলাম। জাহাজে একটা দলের সঙ্গে পরিচয় হল যারা জার্মানি থেকে ওই দ্বীপে যাচ্ছে শুধুমাত্র মাছ ধরার জন্য। মাছভক্ত বাঙালি আমরা। পৃথিবীর সর্বোৎকৃষ্ট মাছের দেশে এতদিন থেকেও মাছ না খাওয়ার দরুণ আমরা একেবারে মাছের জন্য মুখিয়ে আছি। তাই ওদের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলাম- গল্পেন অর্ধং ভোজনং। লোফোটেন-এ যখন পৌঁছলাম মধ্যরাত্রি পেরিয়েছে। চারিদিকে আলো। ওখানে ক্যাম্পিং প্লেস না থাকায় ওই রাত্রিটা আমরা গাড়িতেই কাটানোর প্ল্যান করলাম সমুদ্রের ধারে একটা পারকিং প্লেস-এ। তার একদিকে সমুদ্র অন্যদিকে পাহাড়। অসাধারণ সৌন্দর্য। আলো থাকার দরুণ রাত একটা নাগাদ আমরা যখন রাতের খাবার খাচ্ছি, ওই পারকিং প্লেস এর অন্য গাড়ির লোকজনের কেউ যাচ্ছে মাছ ধরতে তো কেউ পাহাড়ে চড়তে। সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। পরদিন সকালটা জীবনের সবথেকে সুন্দর সকালগুলোর মধ্যে একটা ছিল।

আবহাওয়াটাও ছিল চমৎকার। সকালে একটা ছোট্ট জেলেদের মিউজিয়াম দেখে আমরা মাছের খোঁজে এগিয়ে চললাম। আমরা বদ্ধপরিকর ওইদিন আমরা মাছ খাবই। গোটা দ্বীপটাই জেলেদের বাসস্থান। প্রায় প্রত্যেকটা ঘরেই বড় বড় শুকুই মাছের গুদামঘর। অনেক খোঁজার পর টাটকা মাছের গুদাম চোখে পড়ল।

খুব সস্তায় আমরা একটা তিন কেজি ওজনের মাছ কিনলাম। একটা লেক-এর পাশে গিয়ে মাছ রান্না, স্নান খাওয়া সম্পন্ন করে রওনা দিলাম ভাইকিং মিউজিয়াম-এর দিকে। সেখানে নরওয়ের পুরনো বাসিন্দা ভাইকিংদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে অবগত হলাম। ওখান থেকে কিছু স্মৃতিচিহ্ন কিনে নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করলাম। লোফোটেন দ্বীপের দক্ষিণ দিক দিয়ে জলপথে ঢুকেছিলাম। এখন উত্তর দিক দিয়ে স্থলপথে আবার মূল ভূখণ্ডে ফিরে এলাম। এখানে হঠাৎ হঠাৎই চোখে পড়ছিল একটা সরু রেললাইন যেটা দেখে আমার অনেক আগে দেখা পোলার এক্সপ্রেস সিনেমাটার কথা খুব মনে হচ্ছিল। বারবার খুব মনে হচ্ছিল যেন সত্যিই পৃথিবীর একেবারে একপ্রান্তে এসে গেছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা নারভিক পেরিয়ে ওইদিনের মত ক্যাম্পিং প্লেস-এ ঢুকলাম। রাত্রের খাবার খিচুড়ি আর মাছ ভাজা। সেদিন রাতেও প্রচুর বৃষ্টি হল। তবে তাঁবুর মধ্যে আগের রাতের মত অত জল ঢোকেনি।

পরের দিন সকালে যাত্রাপথে একটা সামি প্রজাতিদের মেলা পড়ল। সেখানে দোকান গুলো সামিদের বাড়ির মত। ভিতরে ওদের ব্যবহার করার জিনিসপত্র। ঠিক যেন সামিদের গ্রামে এসে গেছি।

এরপরের গন্তব্য ত্রমস। আর সেখানেই আমাদের নরওয়ে যাত্রার অফিশিয়াল সমাপ্তি। দুর্ঘটনার দরুণ একদিন নষ্ট হওয়ার কারনে আমাদের নরদকেপ যাওয়ার আশাটা আর পূর্ণ হল না। ত্রমস পৌঁছে সেদিন একটু এদিক ওদিক ঘুরে বাজার থেকে সালমন মাছ কিনে সন্ধেবেলা ত্রমস ইউনিভার্সিটিতে গবেষণারত এক কলিগের সাথে গ্রিলড সালমন, ভাত আর সালাড দিয়ে ডিনার সম্পূর্ণ হল।

পরদিন সকালে গাড়ি ফেরত দিয়ে হোটেলে ফিরে সারাদিন ঘুম। বিকালে আমি একাই বেরোলাম ত্রমস ঘুরতে ও ছবি তুলতে। পরদিন সকালে আমার ত্রমস থেকে ফেরার ফ্লাইট জুরিখ অবধি। ওসলোতে ছ'ঘণ্টার ফাঁকা সময়। ব্যাগপত্র এয়ারপোর্ট এর লকারে রেখে বাসে করে চলে গেলাম একা একাই ওসলো ঘুরতে। ওসলোর ভিজেল্যান্ড পার্ক, ফিওরদ সাইড ও আর দুর্গ ইত্যাদি ঘুরে পঁয়তাল্লিশ মিনিট বাসে চড়ে যখন এয়ারপোর্টে ফিরলাম তখন জুরিখ-এর ফ্লাইট ছাড়বো ছাড়বো। লকার থেকে ব্যাগ নিয়ে ছুটে ছুটে ছাড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে ফ্লাইটে উঠলাম। তবে এই কদিনে যত কিছুই ঘটুক না কেন এই সফরটা আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতা। ঝুলিতে এখন অভিজ্ঞতা আর স্মৃতি। হলফ করে বলতে পারি নরওয়ে আমার এখন অবধি দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দেশ। সুইৎজারল্যান্ডে এতদিন বসবাস করেও আমি এটা সহজেই বলতে পারি। তাও যে কেন ইউরোপ ট্যুরের লিস্টে নরওয়ে ওপরের দিকে থাকে না কে জানে? হয়ত নরওয়ের সব জায়গা এখনো সাধারণ যানবাহনের পৌঁছানোর যোগ্য হয়ে ওঠেনি তাই। আমরাও কি গাড়িতে না গেলে এই প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যময় সুন্দরী নরওয়েকে এত ভালো করে দেখতে পেতাম?

~ নরওয়ের আরও ছবি ~

বর্তমানে দক্ষিণ ভারতের তিরুপতি শহরে ভারতীয় বিজ্ঞান শিক্ষা এবং অনুসন্ধান সংস্থানের রসায়ন বিভাগে সহকারী অধ্যাপিকা হিসাবে কর্মরত পদ্মাবতী মণ্ডলের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনের কাছে নওয়াডাঙ্গাল নামক একটি গ্রামে জন্ম। ২০০৮ থেকে ২০১৮ অবধি প্রায় দশ বছর তিনি গবেষণার জন্য মিউনিখ, ফ্রাঙ্কফুর্ট (জার্মানি), বাসেল (সুইজারল্যান্ড), মার্সেই (ফ্রান্স) ইত্যাদি শহরে বসবাস করছিলেন, তখনই ইউরোপ তথা নরওয়ে ভ্রমণ। সবমিলিয়ে ইউরোপের পঁচিশটি দেশে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা হয়েছে তাঁর।

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher