পাহাড়িয়া পুরুলিয়া

রাহুল গুহ


অনেকদিন ধরে চেষ্টা করছি কিন্তু, পাহাড়টা আর কিছুতেই যাওয়া হচ্ছে না! অনেকে অনেক রকম ভাবে সহযোগিতা করেছেন ট্যুর পরিকল্পনা ইত্যাদি বিষয়ে তবুও রেলিং ঘেঁষে দার্জিলিং রোলিং হয়ে গিয়েছে। পাহাড়টা ভেস্তে গেলে তুরন্ত্ পুরুলিয়াটা ঠিক করে ফেললাম । হ্যাঁ, পাহাড় তো আছে! আর যেমন ভাবা তেমনই কাজ! থাকা ঘোরা বন্দোবস্ত হলে ট্রেনের টিকিট করে নিলাম। হাওড়া - পুরুলিয়া সুপারফাস্ট ধরে সুপার ভাবে গন্তব্যে পৌঁছালাম।
অতিথিশালার অভাব নেই পুরুলিয়াতে। আজকের দিনে ইন্টারনেট ঘেঁটে নিমেষেই খোঁজ মেলে নানান হোটেলের। পরদিন গাড়িতেই সকালের খাদ্য মজুত করে পাহাড়ের দিকে রওনা দিলাম। মাঠা অরণ্য অঞ্চল দিয়ে রাস্তা যেভাবে তার বাঁক নিয়েছে সেভাবেই চারিধারে সবুজের সাথে সখ্যতা করে ছুটল আমাদের গাড়ি। পুরুলিয়ার রাস্তা ভাল তবে পাহাড়ের অপর দিক অর্থাৎ বামনি, তুর্গা জলপ্রপাতের দিক দিয়ে নামার পথ বড়ই বন্ধুর। পাহাড়ের প্রথমেই ধরা দিল পি পি এস পি লোয়ার ড্যাম (P.P.S.P Lower Dam)।

লোয়ার ড্যাম থেকে পাখির চোখে আপামর অঞ্চলের অপরূপ সৌন্দর্য ধরা দেয়। তারপর বেশ খানিকটা ওপরে ওঠার পর দেখা মিলল আপার ড্যাম-এর।

কিছুটা সময় নিয়ে ঘুরে ঘুরে ছবি তুললাম। এক অপার শান্তি মিশে রয়েছে চারিদিকে। এখান থেকে এবার বামনি, তুর্গার দিকে অগ্রসর হলাম। পথে যেতে যেতে পড়ল মার্বেল লেক।

চারিধারে মার্বেল-এর পাহাড়, তারই মাঝে ছোট্ট একটি জলাশয়। ভারি সুন্দর জায়গাটি। তারপর আমাদের গন্তব্য বামনি, তুর্গা। হেলতে দুলতে চড়াই উতরোলাম। বামনির নিচের দিকে হাঁটতে শুরু করেছি এরই মধ্যে টুপটাপ বৃষ্টি আরম্ভ হল। ভরসা পেলাম না, চটপট উঠে এসে সোজা গাড়িতে। আর তুর্গা, ময়ূর পাহাড়, পাখি পাহাড়, লহড়িয়া শিব মন্দির দেখা হল না। নেমে এলাম বাগমুন্ডি মোড়ে। সেখানে দুপুরের খাওয়া সারলাম। তারপর ভরা উদর নিয়ে আমাদের পরের গন্তব্য চড়িদা (মুখোশ) গ্রাম।

পরপর সারিবাঁধা দোকান ঠিক কুমোরটুলির মতো। সব দোকান এক এক করে ঘুরে দেখা, ছবি তোলা, দোকানে দরদাম করা। কিনেও নিলাম হাতের কাজের সুন্দর সুন্দর পুরুলিয়ার স্মৃতি। ওখান থেকে আরও ৯ কি.মি গেলে দেখা মিলবে খয়ড়াবেরা ড্যামের। ফিরে এলাম আজকের মতো আস্তানায়। আবার কাল শুরু করব ।

পরদিন সকাল থেকে আবার ঘুরে দেখার পালা। মোটামুটি ঠিকঠাক করেই রেখেছিলাম আজ কোথায় কোথায় যাব আর তাই জামা গুঁজে, গুগল খুঁজে বেরিয়ে পড়লাম আমাদের গন্তব্য দেউলঘাটার দিকে।
সোজা পুরুলিয়া-রাঁচি রোড ধরে ছুটল গাড়ি। ঘন্টা খানেকের (প্রায় ৩০ কি.মি) মধ্যে পৌঁছে গেলাম আমাদের প্রথম গন্তব্যে। ইতিহাসবিদদের মতে আনুমানিক দশ থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়খণ্ডের কিছু অংশে জৈন স্থাপত্য গড়ে ওঠে। সেই সময় প্রচুর পরিমাণে ইট ও পাথরের মন্দির তৈরি হয়। কশাই নদীর তীরে তিনটি স্থাপত্যের মধ্যে দুটি অবশিষ্ট রয়েছে। আশ্চর্য কারুকার্যের নিদর্শন নিয়ে আজও অবিচল দেউলঘাটার স্থাপত্য।

দেউলঘাটা থেকে বেরিয়ে আমাদের পরের গন্তব্য মুরগুমা। ঝালদা ব্লক অন্তর্গত বেগুন কোদরের উত্তর দিকে অবস্থিত। কংসাবতীর শাখার উপর বর্তমান মুরগুমা ড্যাম। সুন্দর, নির্জন, কোলাহল বর্জিত আদর্শ পিকনিক স্পট ও পুরুলিয়ার অবশ্য দ্রষ্টব্যগুলির মধ্যে একটি। প্রকৃতিকে উপভোগ করার আদর্শ স্থান।

ঝালদা থেকে ইচাক মোড় হয়ে খামার রোড ধরে যেমন ভাবে রাস্তা এঁকে বেঁকে গেছে সেই পথ অনুসরণ করে চলল আমাদের গাড়ি জঙ্গলের বুক ভেদ করে। এতক্ষণ পাহাড়গুলো নিজেদের গুটিয়ে রাখলেও অবশেষে তারা হাজির চোখের সামনে। গ্রাম্য ঘ্রাণ গায়ে মেখে প্রকৃতির অপরূপ শোভা দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম জজহাতু-তে। সিন্দ্রিয়া, জারিয়া, কীর্তনিয়া পাহাড়ের পাদদেশ জুড়ে বিস্তৃত গ্রাম আদিবাসী সম্প্রদায়ের সহাবস্থানে জজহাতু যেন পুরুলিয়ার এক টুকরো স্বর্গ।

একরাশ শান্ত স্নিগ্ধ ঠাণ্ডা বাতাস দিয়ে জজহাতু আমাদের স্বাগত জানাল, কিন্তু ইতিমধ্যেই আবার কালো ঘনঘটা! পাহাড়ের উপর কালো মেঘের কুণ্ডলী, আবার বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। চালক বলল বিকেল হয়ে আসছে, বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবে না। বন্য হাতি নেমে আসার সম্ভাবনা থাকে। একেই জজহাতুর অপূর্ব শোভা তার উপর হাতির কথা ভেবে শিহরিত হচ্ছে সারা শরীর! এক আশ্চর্য অনুভূতি। উপায় নেই তাই অগত্যা গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে ফিরতি পথ ধরলাম।
তৃতীয় দিন সকাল থেকেই আবহাওয়া দুর্দান্ত ছিল। যখন বেরোলাম বেশ ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে ফুর ফুর করে। জয়চণ্ডী পাহাড়ের দিকটা আমাদের প্রথম গন্তব্য। গাড়ি ছুটল সেদিকেই। পুরুলিয়া - বরাকর - আসানসোল রোড হয়ে যেতে যেতে দেখেছি দুরে আবার মেঘ ষড়যন্ত্র করা শুরু করছে এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি আরম্ভ হল। বর্ষণের গতি ও গাড়ির গতিতে রীতিমত প্রতিযোগিতা চলছে। ধুন্ধুমার বৃষ্টি! গাড়ির কাচের ওপর বৃষ্টির জল আর ওয়াইপারের তুমুল লড়াই চলছে ! বৃষ্টি নিয়েই পৌঁছলাম জয়চণ্ডী পাহাড়ে।

আদ্রা ও রঘুনাথপুরের মাঝে অবস্থিত জয়চণ্ডী পাহাড় থেকেই অঞ্চলের নাম জয়চণ্ডী। এখানেই সত্যজিৎ রায় পরিচালিত "হীরক রাজার দেশে"র একটা অংশ শুটিং হয়েছিল। পাহাড়ের উপর বিরাজ করছেন মা চণ্ডী। রয়েছে তাঁর মন্দির। চারশ আশিটি সিঁড়ি অতিক্রম করে পৌঁছে যাওয়া যাবে মায়ের মন্দিরে। পঁচানব্বই কে.জি ওজন নিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে বসে প্রবল বৃষ্টিতে মুড়িমাখা আর চা খেতে খেতে ভাবছিলাম ওপরে যেতে পারব তো! তখনই মনে পড়ল চক্ দে, কবীর খান আর "ইয়ে সত্তর মিনট্"। আর বেশি দেরী না করে ছাতা হাতে সোজা ওপরের দিকে রওনা হলাম। বর্ষার সময় পাহাড় আর জঙ্গলের শোভা এক আলাদা মাত্রা পায়। এসব দেখতে দেখতে একসময় পৌঁছলাম পাহাড়ের ওপর অবস্থিত মায়ের মন্দিরে। ওপর থেকে জয়চণ্ডীর দৃশ্য অবর্ণনীয়। বৃষ্টি তখনও হচ্ছে।

গড় পঞ্চকোট যখন পৌঁছলাম, বৃষ্টি থেমে গেছে। ট্যুরিস্টের বেশ আনাগোনা চলছে এই অঞ্চলে। পাঞ্চেত পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত পঞ্চকোট প্যালেস। ১৭৪০ সালে আলীবর্দি খান বাংলার নবাব হন তৎকালীন সরফরাজ খানকে হত্যা করে। সরফরাজ খানের আত্মীয় রুস্তম জং প্রতিশোধ নিতে গেলে আলীবর্দির কাছে পরাস্ত হন। রুস্তম তখন ডান হস্ত হন নাগপুরের মারাঠা রাজা রঘুজী ভোঁসলের। পাঞ্চেত দিয়ে অষ্টাদশ শতাব্দীতে হানা দিল মারাঠা সৈন্য দল যাদের আমরা বর্গী বলে আখ্যা দিই। প্রায় দশ বছর ধরে বাংলার বুকে নির্মমভাবে চলতে থাকে বর্গী হানা। সেই বর্গী আক্রমণের অন্যতম নিদর্শন রূপে আজও নিজের সাক্ষ্য দিয়ে চলেছে গড় পঞ্চকোট। পাশেই চারুলতা রিসর্টের ওয়াচ টাওয়ার থেকে পাখির চোখে গড় পঞ্চকোট, এক কথায় চোখের প্রশান্তি।

পথে গড় পঞ্চকোট ইকো ট্যুরিজমে মধ্যাহ্ন ভোজ সেরে পাঞ্চেত ড্যামের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। বেশ ভাল ব্যবস্থা! দুশো টাকায় নিরামিষ ও আড়াইশো টাকায় আমিষ ব্যুফে। দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনের প্রথম পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত চারটি বহুমুখী বাঁধগুলির মধ্যে পাঞ্চেত বাঁধ হল সর্বশেষ - ঝাড়খণ্ড রাজ্যের ধানবাদ জেলার অন্তর্গত। পাঞ্চেত ড্যাম, দামোদর নদের ওপরে নির্মিত হয়েছিল এবং ১৯৫৯ সালে এটি চালু হয়েছিল। পুরুলিয়ার কাছাকাছি সুবিশাল দামোদর নদের উপর এই বিশাল বাঁধ অবশ্যই দ্রষ্টব্য। পাঞ্চেত ড্যামের খুব কাছেই রয়েছে মোবারক আনসারির মোবারক স্নেক গার্ডেন। আমাদের বড়ন্তি যাওয়ার তাড়া ছিল তাই যাওয়া হল না।

তখন বিকেল ও সন্ধ্যার সন্ধিক্ষণ, অপরূপা হয়ে উঠেছিল বড়ন্তি। সন্ধ্যার আকাশ যেন তাকে আগলে রেখেছে দুহাত দিয়ে। মনমোহিতকরা দৃশ্য। নিশ্চিন্তে দুটো রাত এখানে কাটিয়ে দেওয়া যায়, এমন সৌন্দর্যের ডালি সাজিয়ে রেখেছে বড়ন্তি। পুরুলিয়ার বিশেষত্ত্ব হল তার এক একটি স্থান এক এক রকমের সুন্দর। পুরুলিয়া জেলার রঘুনাথপুর মহকুমার অন্তর্গত সন্তুড়ির একটি ছোট উপজাতি গ্রাম হল বড়ন্তি। মুরারডি লেকের পাশে অবস্থিত। এটি পশ্চিমবঙ্গের একটি ক্রমবর্ধমান পর্যটন স্পট।
ফেরার দিনে ধামসা, মাদল, টুসু, ভাদুকে বিদায় জানিয়ে ৩৩০ কি.মি. দূরের পথ পাড়ি দেওয়ার পালা।
"পুরুলিয়া ট্য বড্ড সুন্দর জাগা! ম্যুনে পুড়বে উয়াকে বড়।"

 

রাজ্য সরকারি কর্মচারী রাহুল গুহ ভালোবাসেন বেড়াতে ও ছবি তুলতে।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher