তুঙ্গনাথের পথে

অরিন্দম পাত্র


ভোর ভোর ঘুম ভেঙে গেছিল। সাড়ে পাঁচটা বাজে। ভাল করে আলো ফোটেনি এখনো। আজ আমাদের বেরিয়ে যেতে হবে উখিমঠ থেকে চোপতা। ওখানে সারাদিন থাকার কথা। পরের দিন ওখান থেকে সকালে বেরিয়ে তুঙ্গনাথে পৌঁছে রাত্রে কালি-কমলি ধরমশালায় থাকব। কিন্তু আমার সঙ্গী দুজন ইতিমধ্যেই রণে ভঙ্গ দিয়েছে। ওরা আর হাঁটাহাঁটির চক্করে পড়তে নারাজ। তাই আগামীকাল তুঙ্গনাথ দর্শন করতে আমি একাই উঠব চোপতা থেকে। কিন্তু রাত্রে থাকব না, তাই আর চন্দ্রশিলাও যাব না। অর্থাৎ চোপতায় আগামীকাল আমাদের থাকাটা এক দিন বাড়িয়ে নিতে হবে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে চোপতার হোটেল মালিক দীনেশজী'র ফোনে কানেকশন পাচ্ছি না। তাই গিয়ে কথা বলা ছাড়া উপায় নেই। মনে পড়ল কলকাতার স্টিফেন হাউসে কালি-কমলির হেড অফিসে ষাট-পঁয়ষট্টি জনের পিছনে লাইন দিয়ে ধাক্কাধাক্কি করে তুঙ্গনাথে থাকার জন্য ফর্ম তোলার কথা। সব বেকার হয়ে গেল..!
এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে মন ফিরে এল উখিমঠে। সেই স্বর্গীয় ঘন্টা ধ্বনি আর উদাত্ত কন্ঠে মন্ত্রোচ্চারণ ফের শোনা যাচ্ছে। ওমকারেশ্বর মন্দিরে প্রভাতী আরাধনা শুরু হয়েছে। ভোরের আলো ফুটতে চলেছে ধীরে ধীরে। বাইরে বারান্দায় চলে এলাম, মেঘমুক্ত নির্মল আকাশ, সামনেই দিগন্ত জুড়ে বিরাজমান বিশালাকৃতির পর্বতশৃঙ্গ, কেদারনাথ! শ্রদ্ধায় আপনা থেকেই যেন মাথা নত হয়ে এল! এক না একদিন যেতেই হবে কেদারনাথ বাবাজীর দর্শনলাভের উদ্দেশ্যে।
আস্তে আস্তে আকাশে দিনশুরুর রঙ ধরতে শুরু করছে, আর কেদারনাথ শৃঙ্গতে সোনারঙের খেলা শুরু হয়ে গেছে। মুগ্ধ বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই খেলা দেখলাম। প্রকৃতির কী অপরূপ লীলা! তারপর রোদ উঠতে রুপোলী বর্ণধারণ। চিরকাল মনে রাখার মত দৃশ্য।
সকাল দশটা নাগাদ সকালের যৎসামান্য জলখাবার সেরে, বীর সিংজির পাওনাগন্ডা মিটিয়ে চোপতার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। রাস্তা বেশিক্ষণের নয়। এক ঘন্টার আশেপাশে। মনোরম সব দৃশ্যপটের ভান্ডার সেই রাস্তার দুপাশে! চোপতা ঢোকার কিছুটা আগে দুগ্গলভিটায় একটু দাঁড়ালাম। চারিদিকে সবুজ তৃণভূমি, তার মাঝে যত্রতত্র সব টুরিস্টদের জন্য ক্যাম্প আর টেন্ট তৈরি করা হয়েছে রংবেরঙের, আর দূরে তুষারশুভ্র পর্বতমালা। সত্যিই দেশীয় সুইৎজারল্যান্ড! জানি এ ভাবে বলা উচিত না! সুইৎজারল্যান্ড এর সৌন্দর্য একরকম, আমার জন্মভূমির সৌন্দর্য আর একরকম! স্বকীয়তায় ভরপুর আমার দেশ। তবু যেহেতু চোপতাকে ভারতের সুইৎজারল্যান্ড বলা হয়,তাই এই প্রসঙ্গের অবতারণা!

যাইহোক, চোপতায় ঢুকে গেছি। একের পর এক মেডো'জ ক্যাম্প আশেপাশে ফেলে এসে চলে এলাম একেবারে শেষ প্রান্তে। হ্যাঁ, এবারে নামতে হবে। প্রচুর গাড়ি চারিদিকে পার্ক করা আছে। ওইতো ঘন্টা,আর সিঁড়ি উঠে যাচ্ছে। জয় বাবা তুঙ্গনাথ!!
গাড়ি থেকে নেমে দু-একজনকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিলাম হোটেল তুঙ্গেশ্বরের লোকেশন। ওই সিঁড়ি বেয়ে অল্প উঠেই ডানহাতি আমাদের হোটেল বা হোম স্টে যাই বলুন! দীনেশজীর সঙ্গে দেখা হল। কিন্তু কথা বলে বিনামেঘে বজ্রপাত ঘটল! উনি যা বল্লেন তা হল "স্যার জী", আগামীকাল ওনার কাছে কোন ঘর খালি নেই। আগামীকাল বেলা বারোটার মধ্যে ঘর খালি করে দিতে হবে আমাদের। আর আশেপাশে অন্য কোন হোটেলে ঘর পাওয়াও প্রায় অসম্ভব। পড়লাম অথৈ জলে! আগামীকাল তুঙ্গনাথে ওঠার কথা, কী করব আমি?
আমার অবস্থা দেখে দীনেশজীই সমাধানসুত্র বাতলে দিলেন। উনি বল্লেন "স্যার জী" এখন তো এগারোটা বাজে। "আজ মৌসম ভি সাফ আছে"....আপনি আজই বাবাজীর দর্শনে বেরিয়ে পড়ুন। ম্যাডাম আর বাবু নীচে এখানেই থাক। আপনি ধীরেসুস্থে দর্শন করে নেমে আসুন। রাতটা এখানে কাটিয়ে আগামীকাল বেরিয়ে পড়ুন। আপনাদের জন্য আগামীকাল আমি মুক্কুমঠে একটা হোম স্টে'র ব্যাবস্থা করে দেব। ওখানে আগামীকাল থাকবেন।
প্রস্তাবটা মনে ধরল। আর এছাড়া কিছু করারও নেই। মানসিক প্রস্তুতি নেওয়ার টাইমও পেলাম না। দীনেশজী বললেন, দুপুরে খাওয়ার টাইম তো পাবেন না। কিছু বানিয়ে দিই? আমি সম্মত হলাম। ওনার দ্রুতহাতে বানানো ঝাল ছাড়া একটা আলুর পরোটা খেয়ে ঘরে চলে এলাম। তাড়াতাড়ি করে কাঁধের ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। টর্চ, ছাতা, রেইনকোট, ওষুধের প্যাকেট, জলের বোতল এইসব আর কি! ঘটনার আকস্মিকতায় আমার ছেলে হতবাক! বাবাকে এত দ্রুত এসেই বেরিয়ে পড়তে হচ্ছে দেখে ও চিন্তায় পড়ে গেল। ওকে আদর করে, ওর মা'য়ের কাছে রেখে দীনেশজীর দেওয়া লাঠি হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। শুরু হল আমার তুঙ্গনাথ যাত্রা।

কার্তিকস্বামী মন্দির ট্রেকের সময় ভোলানাথ বাবু বলে দিয়েছিলেন যে, তুঙ্গনাথের শুরুর ধাপগুলো দেখে ঘাবড়াবেন না যেন! বেশ খাড়াই। সত্যিই তাই। দীনেশজীর হোম স্টে থেকেই পিছু নিয়েছে একজন টাট্টুওয়ালা। "ও বাঙ্গালী দাদা, ঘোড়া লিজিয়ে না!" জটায়ুর মত আমারও উট বলুন, ঘোড়া বলুন সবেতেই খুব ভয়। তার ওপর খাদের পাশ দিয়ে ঘোড়ার পিঠে চেপে যাতায়াত করার মত সিংহহৃদয় ব্যক্তি আমি নই। জোরের সঙ্গে দুদিকে মাথা নাড়তে নাড়তে দাঁতে দাঁত চেপে এগিয়ে চললাম। কিন্তু গায়ের গরম পোষাক, সোয়েটার, জ্যাকেট, পিঠের ভারী ব্যাগ সব কিরকম অসহ্য ঠেকতে লাগল। মাথা গুলিয়ে উঠল। পারব তো?? আর যাইহোক অভ্যস্ত পদাতিক তো আমি নই! ৪ কিমি বহু দূর মনে হচ্ছে এখন। ১০০ মিটারও আসিনি হয়ত।
ঠিক সেই সময়, ঠিক সেই সময়...দেবদূতের মত একজন আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন...

আমি তখন দরদর করে ঘামছি। পিঠের ভারী ব্যাগের ওজন আর যেন নিতে পারছিনা। গায়ের মোটা জ্যাকেট, সোয়েটারের তলায় জামা একদম ভিজে জবজবে হয়ে গেছে। বুকটা হাপরের মত ওঠানামা করছে হাঁপিয়ে উঠে। ঠিক তখনই সে সামনে এসে দাঁড়াল! মোটামুটি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ইয়ং এনার্জেটিক একটি ছেলে। বয়েস কত হবে? চব্বিশ-পঁচিশ। বা হয়ত আরও কম! দেখেই মনে হল বাঙালি। তাকে হাত নেড়ে দাঁড়াতে বলে হাঁপাতে হাঁপাতে বল্লাম,"ভাই, উঠতে কতক্ষণ লাগছে? আমি তো মনে হচ্ছে আর পারবই না!" ও খুব ক্যাজুয়াল ভঙ্গীতে বলল, আমি তো দেড় ঘন্টায় উঠে গেছি। আমি তোতলিয়ে উঠে বললাম "না মানে! তোমার বয়েস আর আমার বয়েস! এক হল?" ও আমায় আশ্বস্ত করে বলল, "নো টেনশন! একদম ছোট ছোট স্টেপ ফেলতে ফেলতে এগোন। তাড়াহুড়োর তো কিছু নেই। ঢের সময় আছে হাতে! দেখবেন ঠিক পৌঁছে গেছেন!" ওর কথা শুনে যেন একটু হলেও আশার আলো দেখলাম। সত্তর আর আশির দশকের ফুটবলাররা যেরকম কোচ পি.কে.ব্যানার্জীর ভোকাল টনিকে উদ্বুদ্ধ হত, আমিও বাচ্চা ছেলেটির কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে উঠলাম। আশ্বাসবাণী শুনিয়ে আমার দেবদূত নেমে চলে গেল তার গন্তব্যের দিকে! হয়ত আর কোনোদিনই তার সঙ্গে দেখা হবেনা। কিন্তু তাকে মনে রেখে দেব সারাজীবন।
শিবজীর নাম স্মরণ করে শুরু করলাম ওঠা। যেখানে যেখানে খাদের ধারে রেলিং দিয়ে ঘেরা, সেখানে সেখানে বাঁ হাত দিয়ে রেলিং আঁকড়ে ধরে আর ডান হাতে লাঠি ভর করে উঠছি চার ঠ্যাঙে গল্পের কাকাবাবুর মত! আর যেখানে রেলিং নেই সেখানে আমি সৃজিত বাবুর ফিল্মের তিন ঠ্যাঙে কাকাবাবু হয়ে যাচ্ছি। বেশ খানিকটা উঠতে উঠতে অভ্যাস হয়ে গেল ব্যাপারটা। কার্তিকস্বামীর সঙ্গে এই রাস্তার তফাত এটাই যে কার্তিকস্বামীর তুলনায় রাস্তার খাড়াইটা অনেক বেশি। কিন্তু কার্তিকস্বামীর রাস্তা মারাত্মক এবড়োখেবড়ো ছিল, এই রাস্তা কিন্তু রীতিমতো পাথরে বাঁধানো।
কয়েকজন উঠতি বয়েসের ছেলেমেয়ে লাঠি ফাঠির তোয়াক্কা না করে আমাকে লজ্জা দিয়ে পাশ দিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেল! তবে আমার ব্যক্তিগত অভিমত আমি এক ঘন্টায় মন্দিরে পৌঁছে গেলে আমাকে তো কেউ আর অলিম্পিক মেডেল দেবে না! এসেছি তুঙ্গনাথ বাবাজী'র দর্শনলাভের জন্য, নিজের শারীরিক সক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য নয়! তাই আমি কচ্ছপের মতই চলতে থাকলাম। ঘড়িতে টাইম দেখে নিয়েছিলাম, যখন শুরু করি ওঠা, বেলা এগারটা ঊনচল্লিশ মিনিট।

বেশ খানিকটা উঠেই একটা প্রশস্ত বুগিয়াল (সবুজ তৃণভূমি)...তার পাশে একটা ছোট চায়ের দোকান। উল্টো দিকে বায়ো টয়লেট। পেরিয়ে চলতে লাগলাম এগিয়ে। যেকোন ট্রেকিং রুট বা পায়ে চলার পথে মনের মত সঙ্গী থাকা খুব জরুরী। আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে তাইই মনে হল। বাঙালি দেখলেই তাই গায়ে পড়ে আলাপ জমাতে থাকলাম। একসঙ্গে অল্প আলাপ জমাতে জমাতে উঠলে পথের ক্লান্তি একটু কম বোধ হয়! হালিশহরের ছোট ভাই রাজদীপের সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল। ও এসেছে বাবা, মা আর দিদির সঙ্গে। ওনারা পিছিয়ে পড়েছেন। ও এগোচ্ছে আমার সঙ্গে সঙ্গে। সাতপাঁচ গল্প করতে করতে আর ছবি তুলতে তুলতে এগোলাম দুজনে। একে অপরের ছবিও তোলা হল। বেশ কিছুটা ধাতস্থ বোধ করছি আপাতত। আমার আবার ক্যামেরার বাতিক। প্রতি পথের বাঁকে বাঁকে প্রকৃতির অপরূপ রূপ দেখে মুগ্ধ হয়ে পড়ছি আর দাঁড়িয়ে পড়ছি। রাজদীপকে এগিয়ে যেতে বল্লাম। আসার আগে ভেবেছিলাম একটা ছোট ভিডিও বানাব। মাঝে মাঝে মোবাইল দিয়ে সেই শটগুলোও নেওয়া চলছে।
আলাপ হয়ে গেল হরিয়ানা থেকে আগত রাজেশজী'র সঙ্গে। উনি আর ওনার বন্ধু এসেছেন, কেদারনাথ দর্শন করে। তুঙ্গনাথ দর্শন করে আজই বদ্রীনাথের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাবেন। ওনারা আর আরও অনেকেই দেখছিলাম শর্টকাট মারছিলেন। রাস্তা ধরে না এগিয়ে এবড়োখেবড়ো পাথর টপকে হাঁচড়পাঁচড় করে উঠছিলেন। এতে দূরত্ব হয়ত কমানো যায়, কিন্তু শারীরিক পরিশ্রম অনেকটাই হয়। আর এর জন্য খুব ভাল ট্রেকিং শু দরকার। এসবের কথা আমি মাথাতেই আনলাম না। দুই বন্ধু ওইভাবে হাঁচড়পাঁচড় করে উঠে এক খাদের মুখে চায়ের দোকানে আমার মুখোমুখি হলেন। বেঞ্চে বসে খানিক বিশ্রাম নেওয়া গেল। আমার থেকে চেয়ে জলও খেলেন দুজনে। তারপর ফের চলা শুরু। চায়ের দোকানদার বলে দিলেন,আরও বেশ খানিকটা উপরে উঠে যে চায়ের দোকান পড়বে, তখন জানবেন যে অর্ধেক রাস্তা পেরিয়ে এসেছেন। আর বাকি থাকবে ২ কিমি। তারপর কিন্তু চড়াই আরও বাড়বে।

ওখান থেকে বেরিয়ে এগিয়ে চললাম। রাজেশজী আর তাঁর বন্ধু বিদায় জানিয়ে এগিয়ে গেলেন শর্ট কাট মারতে মারতে। রাজদীপকে আর খুঁজে পাচ্ছি না। হঠাৎ এসে পড়লাম একঝাঁক প্রাণবন্ত মানুষের দলের মাঝে। আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড অভিজিৎ পাল মহাশয়ের অফিসকোলিগ সৌজন্য বাবু এবং তাঁদের বন্ধুরা তিন-চারজন কচিকাঁচা সমেত বিরাট টিম নিয়ে চলেছেন ওপরে। রাতেও থাকবেন কালি-কমলিতে। গল্প করার প্রচুর লোক পেয়ে গেলাম ফের। চারদিকে তখন বাঙালি গিজগিজ করছে। মনে মনে হেসে ভাবলাম,"তুঙ্গনাথের রাস্তায় যত বাঙালি দেখলাম অত বাঙালি ধর্মতলাতেও দেখিনা!"
দ্বিতীয় চায়ের দোকানটা এসে গেছে। হাফ রাস্তা পেরোতে পেরেছি তার মানে! এইখানে সৌজন্যবাবুদের টিমকে বিদায় জানিয়ে এগোতে হল। ওনারা এই দোকানে একটু রেস্ট নেবেন। আমিও অল্প রেস্ট নিয়ে এগিয়ে চললাম। কারণ আমাকে বিকেল পাঁচটার মধ্যে আলো থাকতে থাকতেই নেমে আসতে হবে। যত ওপরে উঠছি চড়াই বাড়ছে। বিশ্রাম নেওয়ার জন্য দাঁড়াতে হচ্ছে ঘন ঘন। অনেকটাই এগিয়ে এলাম। একজন ভদ্রলোক নেমে আসছেন, কপালে তিলক, পুজো দিয়ে নামছেন। হিন্দিতে শুধোলাম "আর কতদূর?" একগাল হেসে ইংরেজিতে উত্তর দিলেন "ফর্টিফাইভ মিনিটস মোর..." উচ্চারণ শুনে বুঝলাম দক্ষিণ ভারত থেকে এসেছেন। আমার চারদিকে এখন মিনি ভারতবর্ষ! নানা জাতি, নানা মত, নানা পরিধান, কিন্তু তাও "বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান!"
যত ওপরে উঠছি আকাশের ঝকঝকে নীল ভাবটা উধাও হয়ে যাচ্ছে। মেঘ চলে আসছে। মেঘ এসে গালে ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে। কথা বলে বুঝলাম আর আধঘন্টা বাকি। লাস্ট ল্যাপে আলাপ হয়ে গেল দমদমের সায়ন করের সঙ্গে। ওনার তুঙ্গনাথে থাকার ইচ্ছে আজ। কিন্তু কোন বুকিং নেই। বললেন চিন্তা করছি না এই নিয়ে। কোথাও না কোথাও ঠাঁই জুটেই যাবে। আমার জুতোটা দেখে উনি পাল্টানোর পরামর্শ দিলেন। বললেন ভাল ট্রেকিং শু নিন দাদা।
হাঁপ ধরছে খুব। কিন্তু আর বেশি দূর নেই। এসেই গেছি প্রায়। আর কতক্ষণ? মিনিট কুড়ি নাকি আরও কম?

ওই তো মন্দিরের চূড়া দেখা যাচ্ছে! জয় বাবা তুঙ্গনাথ! আর চিন্তা নেই। তবে আমি স্পিড আর বাড়াচ্ছি না। ক্যামেরা আপাতত বন্ধ রেখেছি। কত ছবি তুলেছি নিজেই খেয়াল করতে পারছিনা। একটা গোটা মেমোরি কার্ড পুরো ভর্তি হয়ে গেছে। মন্দিরের সিঁড়ির কাছে এসে পড়েছি। সায়ন বাবুর কাছ থেকে আপাতত বিদায় নিতে হল। উনি রাতের আস্তানার খোঁজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে উঠে পড়লাম। আমার মিশন কমপ্লিট। পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখি বাজে দুপুর দুটো ঊনচল্লিশ। কাঁটায় কাঁটায় তিন ঘন্টায় পৌঁছলাম। মন্দিরের সামনে লাইন পড়েছে পুজো দেওয়ার জন্য। দাঁড়িয়ে পড়লাম। এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখলাম! চেনা চেনা সব মুখগুলোকে লাইনে দাঁড়িয়ে দেখলাম! সেই রাজদীপ, সেই রাজেশ, সেই নাম না জানা বয়স্ক কাকু! এক ঝলকে মনে হল তুঙ্গনাথের রাস্তার এই সফর কিছুটা যেন আমাদের জীবনের সফরের মত নয় কি? জীবনের রাস্তায় আমরা বাঁচার তাগিদে ছুটে চলি একে অপরকে টপকে, এগিয়ে চলি, কখনও বা পিছিয়ে পড়ি। কিন্তু এক না একদিন দেখা হয়েই যায় কোন এক প্রান্তে!

ভক্তিভরে পুজো দিলাম বাবার চরণে মাথা ঠেকিয়ে। পূজারিজীরা আলোচনা করছিলেন শুনলাম আজ রবিবার তাই স্থানীয় অনেক মানুষ এসেছেন। আর বাঙালি বাবুরা তো আছেনই। মন্দিরে প্রসাদ পাওয়া যায়না। পুজো সেরে কপালে তিলক এঁকে একটু নেমে এসে নীচের দোকান থেকে প্রসাদ কিনলাম বাড়ির জন্য! এরপর চন্দ্রশিলার রাস্তাটা একঝলক দেখে নিয়ে নীচে নামার পালা!

পেশায় চিকিৎসক (নাক কান ও গলা বিশেষজ্ঞ) অরিন্দম পাত্রের নেশা ছবি তোলা। এছাড়াও দেশের মধ্যে নানা জায়গায় ভ্রমণ করা তাঁর আর এক শখ।

 

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher