কালের বন্দর ও বন্দরের কাল

প্রজ্ঞা পারমিতা


~ কেরালার আরও ছবি ~

গত বর্ষায় বরুণদেবের বদান্যতায় কেরল যখন আর্ত বিধ্বস্ত তখন তার কিছুদিন আগেই কেরলের আনাচে কানাচে কাটানো দিনগুলোর অপূর্ব স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে মনে মনে বলছিলাম, চেরভূমি, তোমরা আবার ঘুরে দাঁড়াবে। ১৩৪১ খ্রিস্টাব্দে পেরিয়ার নদীর বিধ্বংসী বন্যা তোমাদের নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি। এক জনপদ ভেসে গেলেও অন্য এক জনপদ জেগে উঠেছিল! এক রাজশক্তি ক্ষীণ হয়ে অন্য রাজার উত্থান হয়েছিল হয়তো; কিন্তু সাধারণ মানুষ নতুন করে বেঁচে ওঠার নানা সমৃদ্ধ উদাহরণ রেখেছিল, আজও যা দর্শনে মুগ্ধতা আসে। জনসাধারণ মানেই তো দেশ।

কালের ওঠা-পড়ার প্রতিফলন কেরলের যে শহরে সবচেয়ে বেশি অনুভব করা যায় তা হল কোচি বা কোচিন। আরব সাগর আর এই বন্দর শহর মুখোমুখি হয়ে রচনা করেছে যেন দৃষ্টি সুখের উৎসব। এখানে নারকেল বন অনন্তকাল ধরে দেখে চলেছে দুকূলে বদ্ধ খাঁড়ি আর কূলহারা সমুদ্রের পাশাপাশি বৈপরীত্য। সেই নারকেল বীথি, সাগর আর খাঁড়ির জলের মায়ায় যে মানুষগুলোর জীবন কাটে তাদের ওপর সতত খেলা করে ইতিহাস আর ঐতিহ্যের আলোছায়া। এই সবকিছু মিলিয়েই তৈরি হয়েছে কোচির এক একান্ত নিজস্ব পরিচয়। সেই ব্যতিক্রমী বন্দরের ভ্রমণ বৃত্তান্ত শোনাব আজ।

এক ডিসেম্বরের সকালে কোচিন বিমানবন্দরে নেমেছিলাম আমি ও আমার জীবনসঙ্গী রাজীব। মালাবার শৈলীর ছোট্ট সুন্দর বিমানবন্দর শহর থেকে ২৯ কিমি দূরে নেদুমবাসেরিতে। নামার একটু আগে আগে চোখে পড়ল পেরিয়ার নদী একেবেঁকে বইছে নিচে। তার ঠিক পরেই নারকেল বনের খুব কাছ দিয়ে উড়ে যেতে যেতে ফ্লাইট যখন ছোট বিমানবন্দরটিতে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছিল মনে হল এই বুঝি নারকেল গাছের ওপরেই নেমে যায় যায়। কেরালার নির্ভুল দ্যোতক পেরিয়ার নদী আর নারকেল দর্শনে বুঝলাম, ব্যাপটাইজড হয়ে গেলাম চেরভূমি বেড়ানোয়।

বৃহত্তর কোচি আসলে এক যুগ্ম জনপদ, কোচি ও এর্নাকুলাম নিয়ে গঠিত। পূর্বের মূল ভূখণ্ডের অংশ হল এর্নাকুলাম ও পশ্চিমে ভেম্বানাদ লেকের ওপারে হল কোচি। এর সঙ্গে ভাইপিন, বোলগাত্তি ইত্যাদি দ্বীপের অবস্থান পুরো এলাকাটাকে যেন লোনা জল আর ডাঙা জমির কাটাকুটি খেলায় পরিণত করেছে। রেলপথে এর্নাকুলাম জংশন সারা ভারতের মানুষকে স্বাগত জানায়। আকাশপথে কোচি ভারত তথা বিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত।

এর্নাকুলামের মেরিন ড্রাইভের খুব কাছেই সুবিধাজনক অবস্থানে একটি হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করে রেখেছিলাম আগে থেকে। দিব্যি সুন্দর কদিনের সেই ঠিকানায় চেক ইন করেই চলে গেলাম খোঁজ খবর নিতে মেরিন ড্রাইভের বোট জেটিতে। এখান থেকেই বিভিন্ন দ্রষ্টব্য যেমন ফোর্ট কোচি, মাত্তানচেরি ইত্যাদি বিখ্যাত জায়গায় যাওয়ার বোট ছাড়ে। তাছাড়া এই বোট সার্ভিসই মাকড়শার জালের মত খাঁড়ি ও ভেম্বানাদ হ্রদ দিয়ে বিচ্ছিন্ন এলাকাগুলোকে যুক্ত রেখেছে যা স্থানীয় মানুষেরও এদিক ওদিক যাওয়ার মুখ্য উপায়। কোন কন্ডাক্টেড ট্যুর নয়, নিজেরা ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াব, এমনই বাসনা এযাত্রা। ভাবলাম প্রথমে আরব সাগরের সঙ্গে আলাপটাই সেরে ফেলা যাক জমিয়ে। তাই সেদিন বিকেলের একটা 'সানসেট ক্রুজ' বুক করে ফেললাম।

পড়ন্ত আলো মাখা বিকেলে মেরিন ড্রাইভ থেকে আরব সাগরমুখী এক লঞ্চে ভেসে চললাম সূর্যাস্ত দর্শনে। ভেম্বানাদ হ্রদ ধরে পশ্চিম দিকে এগোচ্ছিল লঞ্চ। ছোট বড় জাহাজের আনাগোনা দেখতে দেখতে ক্রমশ দুপাশের ব্যস্ত বন্দর এলাকা ছাড়িয়ে এগিয়ে চললাম। এক সময় বাঁদিকে বিখ্যাত চাইনিজ নেটের সারি চোখে পড়লো। ক্রুজের গাইড জানালো ওটাই ফোর্ট কোচির তটরেখা, যেখানে আমরা পরের দিন যাব বলে ভেবে রেখেছি। কিন্তু এখন আর তট নয়, দেখার শুধু জল আর আকাশের রঙের রায়ট। জলের বিস্তার বাড়তে বাড়তে একসময় দেখলাম সামনে আর কিছু নেই, আদিগন্ত আরব সাগর! সাগ্রহে লঞ্চের সামনের বিন্দুতে গিয়ে দাঁড়ালাম দুজনে। সেই "জল শুধু জল" দেখতে দেখতে মনে ভিড় করে এলো কোচিনের ইতিহাসে এই সাগরজলের ভূমিকার নানা প্রসঙ্গ। আরব সাগরের পথেই কোচিন পেয়েছে তার বিশিষ্ট বন্দরের পরিচয়।

মালাবার উপকূলের এই বন্দরের সঙ্গে খ্রিস্টজন্মের আগে থেকেই মধ্যপ্রাচ্য ও ভূমধ্যসাগরীয় দেশসমূহ এবং অবশ্যই চিনের বণিকদের গভীর পরিচয় ছিল। তবুও কোচিন বন্দরের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল জামোরিন রাজাদের কালিকট অথবা ক্র্যাঙ্গানোর যা বহির্বিশ্বে 'মুজিরি' বন্দর নামে পরিচিত। দেশীয় প্রাচীন সাহিত্যে এবং বিভিন্ন বিদেশি ঐতিহাসিক দলিলে বহু উল্লেখিত কিংবদন্তীসম এই মুজিরি বন্দর দিয়েই ইহুদী, খ্রিস্ট ও ইসলাম এই তিনটি ধর্ম আমাদের দেশে প্রথম পা রাখে। যীশু খ্রিস্টের বারোজন শিষ্যর অন্যতম সেন্ট থমাস এই মুজিরি বন্দর দিয়েই ভারতে এসেছিলেন যার মাধ্যমে দক্ষিণ ভারতে খ্রিস্টধর্ম ছড়িয়ে পড়ে। মুজিরি বন্দরে বিদেশি বণিকদের রীতিমতো স্থায়ী বসবাস ছিল। রোমানরা রাজদরবারে দেহরক্ষীর কাজ করত সাগ্রহে। আর ছিল রাজ আনুগত্যে বসবাসকারী হাজার হাজার ইহুদী। কিন্তু কোচির গল্প শোনাতে মুজিরির গান গাইছি কেন মনে হচ্ছে তো? এখানেই ইতিহাসের খেলা। সময়ের নেকনজর যার ওপর পড়ে সে উঠে আসে নতুন গুরুত্ব নিয়ে। ১৩৪১ সনে পেরিয়ার নদীর বিধ্বংসী বন্যায় ভেসে যায় সেই ক্র্যাঙ্গানোর বা মুজিরি। সেখানকার স্বদেশি বিদেশি বণিক সমুদায় তাদের ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে উঠে আসে কোচিনে, কোচিন রাজের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায়। কোচি ভ্রমণে এই ক্র্যাঙ্গানোরের কথা বারবার উঠে আসে, তাই এই ধান ভানতে শিবের গীত।

কিন্তু কোচির আন্তর্জাতিক পরিচয় তৈরি হওয়ার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কারণ কিন্তু এখনও বলা বাকি। ফোর্ট কোচি আজও বহন করে চলেছে ইতিহাসের এমন কিছু জীবন্ত অভিজ্ঞান যা শুধু দক্ষিণ ভারত বা বৃহত্তর ভারতের নয় পৃথিবীর ইতিহাসে একটা বিশেষ কালের স্বাক্ষর। যে কাল যে ঘটনা বদলে দিয়েছিল গোটা পৃথিবীর পরবর্তী ইতিহাস! ইতিহাসে বিরক্ত পাঠকরা ক্ষমা করবেন কিন্তু কোচি গেলে ইতিহাস কখনও পিছু ছাড়বে না। ইতিহাসকে সাল তারিখের শিকলে বেঁধে বিরক্তিকর করে তুলেছি আমরা, কিন্তু ইতিহাস তো আসলে মানুষেরই গল্প! রাজা থেকে নাবিক, বণিক বা ধীবর সবাই তো আদতে মানুষ!

সেটা ছিল পঞ্চদশ শতক। সেই সময়ে ইউরোপ অতি ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল সমুদ্র পথে ভারতে আসার নতুন রুট আবিষ্কার করতে। প্রায় প্রতিযোগিতাই শুরু হয়ে গিয়েছিল বলা যায়। ইউরোপের বিখ্যাত রাজদরবারগুলো ভারত-পথ-সন্ধানী অভিযানে বিপুল অর্থ খরচ করতে দ্বিধা করেনি। বহু প্রাচীন যুগ থেকে ভূমধ্য সাগর ও লোহিত সাগরের পথে ভারত থেকে মশলা যেতো ইউরোপে। স্থলপথে মূলত সিল্ক রুট ধরে অর্থাৎ মঙ্গোলিয়া ও আরবের পথে। কিন্তু আরব বা পারস্যের মশলা ব্যবসায়ীরা নিজেদের 'ট্রেড সিক্রেট' হিসেবে সঠিক পথের সন্ধান কিছুতেই দিতো না। এদিকে তুর্কি অটোমানরা কনস্টান্টিনোপল দখল করার পর সেই পথে বাণিজ্য করায় নানা বাধার সৃষ্টি হল। তুর্কিরা এশিয়া আর ইউরোপের দরজায় কড়া প্রহরা বসালো এবং সে পথের বাণিজ্যে একচেটিয়া অধিকার কায়েম করলো। এভাবে জলপথ স্থলপথ দুই হয়ে উঠল বিতর্কিত। এই পরিস্থিতি কিছুকাল চলতে লাগলে ফ্যাকাসে সিদ্ধ খাবারে অরুচিগ্রস্ত ইউরোপ অবিলম্বে নিজেরাই মশলা আমদানি করে সমস্যার সুরাহা করতে খেপে উঠলো। ইউরোপ জুড়ে প্রায় প্রতিটি রাজ পরিবারে একই আলোচনা। হায়, কবে ফিরবে খাবারে লোভনীয় গোলমরিচের ঝাঁজ বা দারুচিনি এলাচের সুগন্ধ! একমাত্র যদি অপ্রচলিত অন্য পথ খুঁজে নিজেরা সরাসরি মশলার ভাণ্ডারে পৌঁছনো যায়! ব্যাস, সাজো সাজো রব উঠলো, শ'য়ে শ'য়ে জাহাজ জলে ভাসলো শুধু ভারতে পৌঁছবে বলে! পর্তুগাল ও স্পেন সবচেয়ে তৎপরতা দেখিয়েছিল। ভারত খুঁজতে বেরিয়ে কলম্বাসের পায়ে পায়ে স্পেন হাজির হল দক্ষিণ আমেরিকায়। কিন্তু ভাস্কো দা গামার নেতৃত্বে পর্তুগালের পদচিহ্ন পড়লো ভারতে। নামলো কালিকটে অর্থাৎ বর্তমান কোঝিকোড়ে, ১৪৯৮ সনের ২০ মে। তখন মালাবার উপকূলে প্রভাবশালী 'জামোরিন' রাজাদের রাজত্ব, যাদের রাজধানী ওই কালিকট। ভাস্কো দা গামা ভেবেছিল তাকে দেখে কালিকটের রাজা এমন ভাব করবে যেন "তুমি আসায় আমি কেতাত্থ"! সে তো নয়ই উল্টে পর্তুগালের সঙ্গে মশলা বাণিজ্যে আগ্রহই দেখালো না! ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে ভাস্কো দা গামা নানা ভাবে নিষ্ঠুর প্রতিশোধ নেয় সে প্রত্যাখ্যানের। কিন্তু এসবও তো সেই কালিকট বন্দরের কথা। কোচিনের সঙ্গে কী সম্পর্ক! সে কথায় আসছি। ভাস্কো দা গামা দেশে ফিরে অভিযাত্রী হিশেবে প্রভূত সম্মান খ্যাতি পেলেও অভিযানের আসল উদ্দেশ্য অর্থাৎ পর্তুগীজ রাজত্বের বাণিজ্য দৌত্য তো সফল করতে পারেননি। সুতরাং পর্তুগিজরা বিশাল ব্যয়ে আবার অভিযানে নামল এবং এইবার তারা ভিন্ন পথ নিলো। জামোরিনের শত্রুরাজ্য কোচিনের সঙ্গে সংযোগ করলো। কোচিন বেশ কিছুকাল ধরে কালিকট রাজাদের পরাক্রমে পর্যুদস্ত। সুতরাং তারা 'শত্রুর শত্রু আমার মিত্র' এই মতে বিশ্বাস রেখে আলিঙ্গন করলো পর্তুগীজদের। বুঝল না যে উপনিবেশের প্রথম ইটটা তখনই পাতা হল। সেই পথেই এর দেড় শতক পরে এলো ডাচ এবং তার পর ইংরেজ। কোচি একমাত্র জায়গা যেখানে পর্তুগীজ, ডাচ এবং ইংরেজ তিনটি জাতিরই উপনিবেশ ছিল।

সেই থেকে ভারতের মশলা রফতানির রাজধানী কোচি। স্পাইস বোর্ড অফ ইন্ডিয়ার হেড কোয়ার্টার এখানে। শুধু তাই নয় সারা পৃথিবীর গোলমরিচ বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা 'ইন্টারন্যাশনাল পেপার [গোলমরিচ] এক্সচেঞ্জ'-এর হেড কোয়ার্টার এখানেই। ২০১১ সালে এখানে ওয়ার্ল্ড স্পাইস অর্গানাইজেশন গঠিত হয়েছে।

ইতিহাস থেকে মন সরাতে বাধ্য হলাম যখন কমলা রঙের মেরজাই পরা সূর্য সুদূরবিস্তারী সাগরের পাটে বসল প্রথমে, তারপর ডুব দিল। আরও কিছুক্ষণ আকাশে রঙের ওপর রঙের খেলা চলল। তারপর আলোর ছোঁয়াচ কমতে কমতে কালোর আভাস দেখা দিল। এই পুরো সময়টুকু আত্মস্থ করে নিলাম চিরকালের মতো। পাশে এক ইউরোপিয়ান যুবক এসে দাঁড়িয়েছে কখন খেয়াল করিনি। আমাদের সঙ্গে চোখাচোখি হতে বেশ সুন্দর আমন্ত্রণী হাসিসহ 'হাই' করলো। ভুবন গ্রামের বাসিন্দা আমরা দুজনেই, তাই রাজীব সৌজন্যসূচক টুকটাক কথা জুড়লো ছেলেটির সঙ্গে! সেও দিব্যি গল্প জুড়ে দিল। ছেলেটি ডাচ, তবে ট্যুরিস্ট নয়, ছাত্র। কলোনিয়াল আর্কিটেকচার নিয়ে গবেষণা করছে। ডাচদের তৈরি বোলগাত্তি প্যালেস নিয়ে কাজ করছে এখন। সে যখন আমাদের সঙ্গে কথোপকথনে রত, আমার মনে কেমন অদ্ভুত এক ত্রিভুজের ছবি ভেসে উঠল। ত্রিভুজের আধার আরব সাগর, যার ওপর মিলিত বাকি দুটি বাহুর একটি ইউরোপীয় ছেলেটি ও অন্যটি ভারতীয় আমরা। এ ত্রিভুজ কোচির রূপক! চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম তীরহীন কালো জলে যেন এক ক্ষুদ্র মোচার খোলায় ভাসছি। ঠিক যেমন কোচিন আর আরব সাগরের অনন্ত কালচক্রের অতি ক্ষুদ্র এক টুকরো কালের অধিকারী হলাম আমরা আজ সন্ধ্যায়।
ফেরার পথে দেখি মেরিন ড্রাইভের রেইনবো ব্রিজ, চাইনিজ নেট ব্রিজ ইত্যাদি সুন্দর ছোট থিম ব্রিজগুলো আলোর সাজে অপরূপা। তবুও নিষ্প্রভ লাগছিল কারণ মনে শুধুই সানসেট ক্রুজের মায়া।

পরদিন সকালে দক্ষিণী প্রাতরাশ সেরে সারা বেলার মতো প্রস্তুতি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বোট বাহনে গন্তব্য ফোর্ট কোচি। এটাই পুরনো কোচিন যেখানে ভারতের প্রথম বিদেশি উপনিবেশের চিহ্ন বর্তমান। প্রকৃতি ও ইতিহাসের সাহচর্যময় মনোরম সময়ের আকাঙ্ক্ষায় পা রাখি ফোর্ট কোচিতে। বিচ ধরে হাঁটাহাঁটির সুন্দর ব্যবস্থা। প্রথমেই পড়লো ভাস্কো দা গামা স্কোয়ার। সেটা ছাড়িয়ে বিচ ধরে দক্ষিণ মুখো হাঁটতে লাগলাম। ডানদিকে ক্রমাগত সাগরের ছলাৎছল, আর বাঁদিকে ইতিউতি গড়ের ধ্বংসাবশেষ চোখে পড়তে লাগলো।

১৫০০ খৃস্টাব্দে পেদ্রো আলভারেজ কাব্রালের নেতৃত্বে পর্তুগীজদের দ্বিতীয় ভারত অভিযান সফল হয়েছিল এই কোচিতে এসে। অভিযানের সাফল্য বলতে প্রথমত মশলা রফতানি চুক্তি বোঝালেও ধীরে ধীরে তারা এখানে আসন পেতে বসে। কোচিন রাজাদের অনুমতিক্রমে নিজেদের কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য পত্তন করে সান্টা ক্রুজ টাউন যা এশিয়ার প্রথম ইউরোপিয়ান টাউনশিপ। তাকে ঘিরে গড়ে তোলে পর্তুগাল-রাজের নামাঙ্কিত ফোর্ট ইমানুয়েল। বর্তমানের 'ফোর্ট কোচি' নামটা ওই গড় পত্তনের ইতিহাসেরই প্রতিফলন।

আরব সাগর তীরে এই বিশাল গড়ের প্রবল উপস্থিতি দেড়'শ বছর পর ডাচরা এসে নস্যাৎ করে দেয়। ধ্বংস করে প্রায় সবই। ফোর্ট ইমানুয়েলের প্রতিনিধিত্ব করছে দেখলাম একটা ছোট কামান সহ গানারি! আর পুরনো বন্দরের অনতি অতীত সক্রিয়তা জানান দিতে দুটি বিশাল স্টিম বয়লার আছে মাত্র। বাকি যা রয়ে গেছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে তার মাঝেই পরবর্তীতে তৈরি ডাচ উপনিবেশের নিদর্শন ডাচ কোয়ার্টার, ডাচ সেমিট্রি দেখে নিলাম ঘুরে ঘুরে।

এবার ডাচদের হাতে ধ্বংস না হওয়া একমাত্র অবশিষ্ট পর্তুগীজ নিদর্শন সেন্ট ফ্রান্সিস চার্চ দেখতে গেলাম। অ্যালবুকার্কের তৈরি এই চার্চ ভারতের প্রাচীনতম ইউরোপিয়ান চার্চ! গড়নে আহামরি বিশেষত্ব নেই, তবু কোচি দর্শনে অবশ্য দ্রষ্টব্য এই চার্চটি! কারণ ভাস্কো দা গামা - যার হাত ধরে পৃথিবীতে 'আবিষ্কারের যুগ' [Age of Discovery] শুরু, যার পদচিহ্ন ধরে আমাদের তথা সারা বিশ্বের ঔপনিবেশিক নির্মমতার সূত্রপাত, ইতিহাসের সেই অন্যতম কালপুরুষের দেহ দীর্ঘ পনেরো বছর এখানে সমাহিত ছিল।

ভাস্কো দা গামা তাঁর তৃতীয় দফা ভারত অভিযানে এসে কোচিনে ১৫২৪ সনের ক্রিসমাস ইভের দিন মারা যান। শোনা যায় ম্যালেরিয়ায় মৃত্যু হয় তাঁর। তাঁকে এই সেন্ট ফ্রান্সিস চার্চেই সমাধিস্থ করা হয়েছিল প্রথমে, পরে স্বদেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। পাঁচশ বছর বয়সী গির্জাটির ফাসাদে পর্তুগীজ স্থাপত্যের ছোঁয়া স্পষ্ট। অন্দরে প্রবেশ করে দেখলাম অ্যাংলিকান সম্প্রদায়ভুক্ত হওয়ায় স্যাংচুয়ারিতে মূর্তির বদলে ক্রুশ এবং বাইবেলের বাণী শোভিত। স্থাপিত হওয়া থেকে এই গির্জায় তিনধারায় উপাসনা হয়েছে! পর্তুগিজ আমলে ক্যাথলিক, ওলন্দাজ আমলে প্রটেস্টান্ট এবং শেষে ইংরেজ আমলে এসে অ্যাংলিকান। ঈশ্বর পুত্রকে নিয়ে যদি এমন টানাটানি হয়, খোদ ঈশ্বরকে নিয়ে তা তুমুল আকারে হওয়াই স্বাভাবিক। মনে মনে হেসে গির্জার চিরাচরিত অভ্যন্তরের আসবাবে চোখ বোলাতে লাগলাম। সারি সারি পিউ, স্যাংচুয়ারির ঠিক বাইরে বাঁ দিকে কারুকার্যময় পালপিট, ডান দিকে যথাযথ লেকটার্ন। দ্রুত দেখা সেরে যেখানে ভাস্কো দা গামার দেহ রাখা ছিল সেই স্মারকের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। এই সময় আমার ইতিহাস চেতনা মুহূর্তের জন্য দ্বন্দ্বে দীর্ণ হয়েছিল। শেষে নির্মোহ ইতিহাস দর্শনের জয় হল। ভাস্কো দা গামার দুঃসাহসী অভিযাত্রী সত্তাকে শ্রদ্ধা জানালাম আর সেই মানুষটিকে উপেক্ষা করলাম যার নিষ্ঠুরতার কাহিনী মালাবার উপকূলে আছড়ে পড়া আরব সাগরের প্রতিটা ঢেউ জানে।

পর্তুগীজরা ছিল রোমান ক্যাথলিক আর ডাচরা প্রটেস্টান্ট। ইতিহাসের চিরাচরিত প্রথায় শাসকের ধর্মই প্রধান, সুতরাং ডাচরাও সব ক্যাথলিক স্থাপত্য ধ্বংস করে দেয় বাদে সান্টা ক্রুজ ক্যাথিড্রাল ও সেন্ট ফ্রান্সিস চার্চ! কিঞ্চিৎ ইতিহাস চেতনা দেখিয়েছিল ভাবা হয়ত বাড়াবাড়ি হবে কিন্তু আমার তাই ভাবতে ভালো লাগল। সেন্ট ফ্রান্সিস চার্চ দেখেই চলে এলাম সেই সান্টা ক্রুজ ক্যাথিড্রাল দেখতে। ব্যাসিলিকার মর্যাদাপ্রাপ্ত গির্জাটি কেরলের অন্যতম ঐতিহ্যময় স্মারক। কালের এমন উপহাস, গির্জাটি ধ্বংস না করলেও ওলন্দাজরা অস্ত্রাগার হিসেবে ব্যবহার করত একে। কিন্তু ইংরেজরা এসে এটিকেও ধ্বংস করে দেয়। রয়ে যায় কিছু চিহ্ন যা এখানে ও ইন্দো-পর্তুগিজ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত। পরবর্তীকালে আবার নতুন করে গড়ে তোলা হয় গির্জাটি। মুছে যাওয়া সান্টা ক্রুজ টাউনের 'নাম চিহ্ন' বহনকারী একমাত্র স্থাপত্য সান্টা ক্রুজ ব্যাসিলিকা চত্বরে পা রাখি; এবং গির্জাটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মুগ্ধ করে রাখে। গথিক স্থাপত্যের বাহির ও অন্দর দুই সমীহ আদায় করে।



দুটি চূড়াবিশিষ্ট গির্জাটির বহিরঙ্গের সৌন্দর্যে ভাবগাম্ভীর্যই প্রধান। কিন্তু অভ্যন্তরে আবেগ ও শিল্পের সন্তুলিত সুষমা। দেয়াল ও খিলান যীশুখ্রিস্টের জীবন আধারিত ফ্রেস্কো ও ম্যুরালে সজ্জিত। রোমান ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের গির্জা, তাই অলটারে ঈশ্বরপুত্রের মূর্তি বিরাজিত! তার ঠিক ওপরে দা ভিঞ্চির লাস্ট সাপারের অনুকরণটি অনবদ্য। স্টেইনড গ্লাসের জানলা, কারুকার্যময় পালপিট ইত্যাদি তো নজর কাড়লোই, তবে সবচেয়ে মুগ্ধ হলাম সিলিঙের সাতটি ক্যানভাস দেখে। এক্ষেত্রে আমার অবলম্বন ক্ষুদ্র একটি স্পোর্টস গ্লাস, খুঁটিয়ে দেখার পিপাসা মেটাতে যার দিকে হাত বাড়াই। ছবির বিষয় 'ভিয়া ক্রুশিস' যার শাব্দিক অর্থ 'ক্রুশের পথ' এবং তাৎপর্য হল 'গভীর যন্ত্রণা'। যীশুর শেষ যাত্রার ওপর আঁকা দৃশ্যগুলো মন ভিজিয়ে দিল। দু দণ্ড আকুল হয়ে প্রার্থনা করলাম! মানুষের মৃত্যু স্বাভাবিক, কিন্তু যে মৃত্যু মনুষ্যত্বের মৃত্যুর দ্যোতক তার আর কত সাক্ষী হব আমরা!

ভারী মন নিয়ে আবার বিচে ফিরে এলাম! সমুদ্র মুহূর্তেই শুশ্রূষার পরশ দিল প্রাণে! প্রকৃতির কাছে বার বার ফিরতে এই জন্যেই ভালো লাগে। মনোযোগ ফেরালাম চাইনিজ নেটে। বিচ ছাড়ার আগে এই গুরুত্বপূর্ণ আকর্ষণের কথা না বললে কোচির গল্পই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। বৈচিত্র্যে বিশিষ্ট এই মাছ ধরার জাল প্রসঙ্গেও ইতিহাস ছাড়া গতি নেই। এই জালের টেকনিক এখানে আমদানি হয় কুবলাই খানের দরবারের বদান্যতায়। আজও এই জালেই মাছ ধরা হয় সারা কেরালায়।

ফোর্ট কোচি থেকে অটোর স্থানীয় সংস্করণ টুকটুক চড়ে পুরনো কোচির অন্যতম অংশ মাত্তানচেরি চলে আসি। বাসনা সুবিখ্যাত মাত্তানচেরি প্যালেস, জিউ টাউন, সিনাগগ ইত্যাদি চাক্ষুষ করা। পর্তুগীজরা মাত্তানচেরি প্যালেস তৈরি করে কোচিন রাজাদের উপহার দেয়! পরে ডাচরা সংস্কার করে বলে ডাচপ্যালেস নামেও পরিচিত। দেখে অবাক হলাম বিদেশিরা বানালেও এটি মালাবার স্থাপত্যশৈলী 'নালুকেত্তু' অনুযায়ী তৈরি; যার বৈশিষ্ট্য হল চার বাহু যুক্ত ভবন এবং মাঝখানে খোলা চতুষ্কোণ! দোতলা প্রাসাদের প্রতিটি দেওয়াল রামায়ণ মহাভারত বিষয়ক টেম্পেরা শৈলীর অপূর্ব ম্যুরালে সজ্জিত। সে ছবি দেখতে দেখতে কেরলের আরেক রাজ পরিবারের সন্তান সুবিখ্যাত তৈলচিত্র শিল্পী রাজা রবিবর্মার কথা মনে পড়তে বাধ্য। বিদেশি মাধ্যম আর ভারতীয় বিষয়ের সাযুজ্যের কারণেই। কোচিনরাজাদের ব্যবহৃত নানা জিনিষের চেয়ে প্যালেসের কাঠের কাজের শিল্পসুষমা ও কেরালার নিজস্ব শৈলীর মেঝে দেখে বেশি মুগ্ধ হলাম। রাজার শয়ন কক্ষের কাঠের কারুকাজে বিলাস ও শিল্পের চরম উৎকর্ষ দেখে আমি তো বাক্যহারা! আর নারকেল খোলা পুড়িয়ে তার সঙ্গে লেবুর রস, ডিমের সাদা ইত্যাদি আরও অনেক কিছু মিশিয়ে কোনো এক অজানা জটিল পদ্ধতিতে যে এমন ইটালিয়ান মার্বলের মত ঝলকানো কালো মেঝে তৈরি হয় প্রথম জানলাম! অবিশ্বাস্য পুলকে খালি পায়ে দুপাক হেঁটেও নিলাম।

প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে জিউ টাউনে এসে মনে হল যেন আস্ত এক 'অ্যান্টিক ল্যান্ড'-এই এসে পড়েছি। মাত্তানচেরির ইহুদীদের ইতিহাস গল্পকে হার মানায়। মালাবার ইহুদীদের মতে, জেরুজালেমে রোমানরা যখন দ্বিতীয় বার [1st AD] ইহুদীদের পবিত্র মন্দির ধ্বংস করে দেয় তাদের একটি দল মালাবার উপকূলে এসে ক্র্যাঙ্গানোরের রাজাদের কাছে আশ্রয় চায়। রাজানুগ্রহে প্রায় হাজার দশেক ইহুদী সেই অঞ্চলে বসবাস শুরু করে। ইহুদীদের যেহেতু ব্যবসায়ী বুদ্ধি প্রবল, মুজিরি বন্দরে ও অন্যত্রও দ্রুত তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে নেয়। রাজকোষ বৃদ্ধিতেও দারুণ সহায়তা করে তাদের উপস্থিতি। ফলে ক্র্যাঙ্গানোরের রাজা ভাস্কর বর্মা সসম্মানে ইহুদীদের নেতা জোসেফ রাব্বানকে তাম্রপত্র লিখে ইহুদী জনগোষ্ঠীর নামে প্রভূত ভূসম্পত্তির মালিকানা এবং অন্যান্য নানা সুযোগ সুবিধা প্রদান করেন। মালাবার জিউদের বিশ্বাস এই ঘটনা ৩৭৯ খ্রিস্টাব্দের। কিন্তু ঐতিহাসিকদের মতে তা ৯৯৯ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা। তবে মালাবার উপকুলে ইহুদী উপস্থিতি যে ২০০০ বছরেরও পুরনো এনিয়ে সন্দেহ নেই কারো। কারণ যীশুখ্রিস্ট মারা যাবার পরেই যখন সেন্ট থমাস মুজিরি বন্দরে আসেন সে ঘটনার প্রামাণ্য বর্ণনায় আছে যে এক ইহুদী কন্যা তাঁকে ফ্লুট বাজিয়ে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল, অভ্যর্থনাকারী দলের সদস্য হিসেবে। জিউদের সেই 'নিশ্চিন্তের বারাণসী' ক্র্যাঙ্গানোর বন্যায় ভেসে গেলে সেখানকার পাট তুলে তারা মাত্তানচেরিতে চলে আসতে বাধ্য হয়। কোচিতে আগে থেকেই ইহুদী বসবাস ছিল, তাদের সঙ্গে নিয়ে এখানেও আবার উঠে দাঁড়ায় তারা। গড়ে তোলে মাত্তানচেরি জিউ টাউন, সিনাগগ ইত্যাদি। মাথায় এই সব তথ্য এবং হৃদয়ে অনুভব নিয়ে জিউ টাউনের পথে যখন হাঁটছি মনে হল এ তো এক জীবন্ত জীবাশ্ম জনপদ! জিউ স্ট্রিটের দোকানগুলিও এমনিতে অ্যান্টিকের জন্য বিখ্যাত। দু পাশে সেই অবাক করা সম্ভার বাইরে থেকে দেখে দেখেই অবাক হতেও ভুলে গেলাম একসময়। একটা নোঙর, একটা অপূর্ব গড়নের শালতির সামনে মিনিট পনেরো দাঁড়িয়েছিলাম। সিনাগগের পথে যেতে রাস্তার দুপাশের বাড়ি ঘর দেখতে দেখতে চকিতে এক দরজায় দেখলাম বলিরেখায় কারুকার্যময় এক বৃদ্ধার মুখ। যেন 'সময়' এক ঝলক দেখা দিল আমায়। তাকে চিনতে পারায় যেন ছাড়পত্র পেলাম সিনাগগে প্রবেশের।

মাত্তানচেরির সিনাগগটি ভারতের প্রাচীনতম সক্রিয় সিনাগগ অর্থাৎ আজও প্রার্থনা হয় সেখানে। প্রবেশ মাত্র মুগ্ধ হলাম সোনালি রেলিংঘেরা ইহুদীদের প্রার্থনা বেদীটি দেখে, যার ওপর দাঁড়িয়ে পুরোহিত ধর্মোপদেশ দেন বা ধর্মগ্রন্থ পড়েন। পরে জেনেছি একে 'বেমাহ্‌' বলে। বেদীটি চার্চের 'পালপিট'-এর চেয়ে অন্যরকম গড়নের। বেশ কিছু প্রথাগত চার্চ দেখার সৌভাগ্য হলেও অভাগার ভাগ্যে এই প্রথম সিনাগগ প্রবেশ। তাই বাইবেলের প্রথমার্ধের [Old testament] অংশীদার ইহুদীদের সবকিছুই ক্রিশ্চিয়ানিটির রেফারেন্স পয়েন্ট থেকে বোঝার চেষ্টা করছিলাম। হাতে আঁকা চিনা পোর্শলিন টালি দিয়ে তৈরি সিনাগগের মেঝেটি আশ্চর্য সুন্দর। যার বৈশিষ্ট্য প্রতিটি টালির ডিজাইনই আলাদা। ইহুদী ধর্মগ্রন্থ 'তোরাহ' রাখা আর্কটি হলিউড প্রাণিত আমাদের 'ইন্ডিয়ানা জোন্স অ্যান্ড দা লস্ট আর্ক' স্মরণ করাল। এখানেই সেই বিখ্যাত তাম্রপত্রটি রাখা আছে যা দেখে এবং আরও অসংখ্য অ্যান্টিক সামগ্রী দেখতে দেখতে বিমোহিত অন্য এক অনুভবে পৌঁছে গেলাম। তাম্রপত্রটির একটি রেপ্লিকা সংগ্রহ না করে থাকতে পারিনি। ভারতের চিরন্তন 'এস জন, বসো জন' দর্শনের এক জীবন্ত দলিল মনে হয়েছিল আমার জিনিসটা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বেঞ্জামিন নেতান্যুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে এই তাম্রপত্রের একটি রেপ্লিকাই উপহার দিয়েছিলেন।

মাত্তানচেরির একটি ওয়ার্ল্ড ইভেন্ট হল 'কোচি মুজিরি বিয়েনালে' শিল্প প্রদর্শনী। শিল্পে আগ্রহীরা খোঁজ নিয়ে সেই সময় আসতে পারেন। এই প্রদর্শনী এশিয়ার বৃহত্তম সমকালীন শিল্প প্রদর্শনীর মর্যাদাপ্রাপ্ত। কোচির কাছে 'মুজিরি' শব্দের আবেদন কতটা গভীর এই নাম থেকে তা বোঝা যায়।
মাত্তানচেরিতে কিঞ্চিৎ ভোজন সেরে প্রথমে উইলিংডন ও তারপর বোলগাত্তি দ্বীপে গেলাম। উইলিংডন কৃত্রিম দ্বীপ। বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় কোচি বন্দরের আধুনিকীকরণের উদ্দেশ্যে ভেম্বানাদ হ্রদের নাব্যতা বাড়াতে যে মাটি তুলে তুলে জমা করা হয় তাই দ্বীপের রূপ নেয় যা বর্তমান কোচি বন্দরের কেন্দ্রীয় অংশ। কারণ এখানেই কোচি পোর্ট ট্রাষ্টের বিশাল অট্টালিকা। এখানেই ভারতীয় নৌসেনার সাউদার্ন ন্যাভাল কমান্ডের বেস।অন্যান্য আরও গুরুত্বপূর্ণ অফিস কাছারি ও প্রচুর হোটেলের সমাহার দেখলাম। বোলগাত্তি দ্বীপের আকর্ষণ নিরিবিলি পরিবেশে বোলগাত্তি প্যালেস যা ডাচদের কলোনিয়াল আর্কিটেকচারের একমাত্র অবশিষ্ট নিদর্শন। দুঃখের বিষয় তা এখন হেরিটেজ হোটেল হওয়ায় সাধারণের প্রবেশ নিষেধ। সানসেট ক্রুজে আলাপ হওয়া ডাচ যুবক এই প্রাসাদটি নিয়ে গবেষণা করছে। প্রাসাদের সামনে জলের ধারে বসে কিছুক্ষণ সূর্য ডোবার আয়োজন দেখে মেইন ল্যান্ডের ফেরি নিলাম।

সেদিন সন্ধ্যায় কথাকলির অনুষ্ঠান দেখতে যাওয়া ঠিক ছিল। নৃত্যের বিষয় রাবণ ও মন্দোদরীর প্রেমোপাখ্যান। নাচ, সাজ তো বটেই বিষয়ের জন্য এক কথায় চমৎকৃত হলাম। আমরা বাংলাভাষী, যে ভাষার নাট্যকাব্যে মেঘনাদ নায়ক! সুতরাং এই ভিন্ন আখ্যানের রসে দারুণ মজেছিলাম। পরদিন সন্ধ্যায় হালকা কেনাকাটা করতে গিয়ে যখন কথাকলির মুখোশ কিনে ফেললাম বুঝলাম তখনও সেই নাচের স্মৃতি মনে জেগে আছে। আর কিনেছিলাম এক ছোট্ট মালাবারি নৌকা, কারণ সেদিন অর্থাৎ আমাদের কোচিবাসের শেষদিন খাঁড়ির জলে ভেসে ভেসে কাটিয়েছিলাম সারা বেলা।

কোচি থেকে ব্যাকওয়াটারের আশ্চর্য জীবনযাত্রা দেখতে যাওয়াটা শেষ দিনের জন্য তুলে রেখেছিলাম ইচ্ছে করেই যাতে রেশ রয়ে যায়। চের জাতির নিজস্ব শৈলীর জলযান 'কেত্তুবালামে' চড়ে কোচি-ভাইকোম ব্যাকওয়াটার সফর শুরু হল। নগর বন্দর আড়াল হতেই নারকেল গাছের সারি মাথা দুলিয়ে অভ্যর্থনা জানালো! আহা, ওপরে নীল আকাশ নিচে সবুজাভ জল এবং আমরা এক শিল্পময় জলযানে আসীন! সবই মনোরম মধুরম! দেখি খাঁড়ির গা ঘেঁষে গ্রামের ঘরদোর, সে ঘরের দোরেই নৌকা এসে দাঁড়ায় নিত্য প্রয়োজনীয় প্রায় সব কিছু নিয়ে! আনাজপাতির নৌকা দেখলাম, মাছের তো আছেই! একটা নৌকা থেকে বাসনকোসন কেনাকাটা চলছিল, তাতে নানা সাংসারিক টুকিটাকি সহ খেলনাও চোখে পড়ল। স্কুলের পোষাকে ছেলে মেয়েরা স্কুল যাচ্ছে। তাদের নৌকা হাঁসের দলের পাশ কাটিয়ে চলে গেল। প্রচুর হাঁস সারা খাঁড়ি জুড়েই। দুপারের মানুষগুলোর জীবিকা মূলত মাছ ধরা আর 'কয়ার' বানানো। জল ছুঁয়ে বাস করে এরা, নিত্য যাতায়াতও এই জল বেয়েই। আক্ষরিক অর্থেই জীবনের জলছবি।

একসময় দুপুরের বিরতিতে সেই জলছবির দু দণ্ড শরিক হতে নামলাম। এক ঝলক কয়ার তৈরির কর্মকাণ্ড দেখে নিয়ে ফিরে আসতেই জলটুঙির বৃহৎ সংস্করণ এমন একটা জায়গায় আমাদের জন্য মালাবারি আহার পরিবেশিত হল। সুবিখ্যাত মিন কারি সহযোগে কলাপাতায় লালচে চালের ভাত দারুণ উপভোগ্য। মজাদার অনুষঙ্গ ছিল পাকা কলা ভাজা! জলজ গন্ধের মাঝে নারকেল গাছের হাওয়ায় বসে সেই মালাবারি মধ্যাহ্নভোজন আমাদের ভ্রমণকে সম্পূর্ণতা দিল। ফিরতি পথে দেখি ছোট ছোট শালতিতে সিমেন্ট, বালি, ইট বয়ে এনে চলছে ঘর বাড়ি তোলা। বেঁচে থাকার চিরন্তন দৃশ্য! কোন ভরসায় জলের ওপর ভিত গড়ে মানুষ! এলোমেলো হাওয়ায় সেই দৃশ্য দেখতে দেখতে মনে হয়েছিল প্রকৃতি বা ইতিহাস যতবার তছনছ করে দিক তার জীবন জীবিকা, মানুষ আবার ঠিক ঘর বেঁধে নিতে পারে। ইতিহাস তো বার বার তাই দেখিয়েছে।

~ কেরালার আরও ছবি ~

প্রজ্ঞা পারমিতা ভ্রমণ কাহিনি, প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস লিখছেন গত বছর দশেক। মেডিক্যাল জার্নালিজম করেছেন 'বর্তমান'-এর প্রকাশনা 'স্বাস্থ্য' পত্রিকায়। 'মাতৃশক্তি' ও 'জাগ্রত বিবেক' পত্রিকার সহ সম্পাদক ছিলেন। ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষায় সচেতনতা বাড়াতে কলম ব্যবহার করে থাকেন।

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher