শিবখোলা আর লাটপাঞ্চারে

অরুণাচল চ্যাটার্জি


ভোরের দিকে বেশ কিছু পাখির ডাকে ঘুমটা ভেঙে গেল, এ অঞ্চলে আগে আসিনি, তাই ডাক শুনে চট করে চেনাও মুশকিল সেটা কোন পাখির। ময়ূরের ডাক-ই যা চিনতে পারছি। শুয়ে শুয়ে চিন্তা করছি, সবাই মিলে যে এইসময় বেড়াতে বেরিয়ে পড়লাম, সেটা কি ঠিক করেছি? বিশ্বজোড়া 'গেল গেল' রব, তার মধ্যে আমাদের ছোট্ট কন্যাসহ বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম দোলের ছুটিতে, বেশি দূর না, শিলিগুড়ি থেকে খুব কাছেই, শিবখোলা আর লাটপাঞ্চার।

নানা রকম চিন্তাভাবনা যখন মস্তিস্কটাকে পেঁচিয়ে ধরছে, শরীরের সমগ্র শক্তি দিয়ে তাদের ছিটকে ফেলে টপাং করে একলাফে বিছানার বাইরে বেরিয়ে এলাম। খুব ঠাণ্ডা না থাকলেও একটা জ্যাকেট তো জড়াতেই হয়। বাইরে রোদ তখনও ওঠেনি। বেশ কয়েকটি কটেজ একসারিতে, খোলার (পড়ুন শিবখোলা, মানে ছোট্ট নদী) ছড়ানো উপত্যকার একপাশে রয়েছে। উপত্যকার একদিকে খাড়া পাহাড় আর অন্যপাশটা ধাপে ধাপে ওপরে উঠে রাস্তায় গিয়ে মিশেছে। তাই এই বাটির মতো অংশে রোদ এসে পৌঁছাতে একটু দেরি হবে। কটেজগুলোর সামনের অংশে কিছু লম্বা গাছপালা রয়েছে, তবে মাদার গাছের আধিক্যই বেশি চোখে পড়ে। পাতাহীন মাদার-এর শাখা-প্রশাখাগুলির শেষপ্রান্ত গুচ্ছগুচ্ছ ফুলে ভর্তি, টকটকে লাল রঙের। ফুলের মধু খেতে পাখিদের আনাগোনাও দেখার মতন। মাদার গাছগুলো পেরিয়েই, শিবখোলা বয়ে চলেছে আমাদের বামদিক থেকে ডানদিকে। এসময় বেশি জল নেই, কোথাও হাঁটু জল তো কোথাও গোড়ালি-ডোবা জল। খুব সরু একটা বাঁশের সাঁকো করা রয়েছে, জল বাড়লে অথবা কেউ যদি পা না ভিজিয়ে পারাপার করতে চায়, তাহলে এরই শরণাপন্ন হতে হবে। জলধারার মধ্যে মধ্যে বড় বড় বোল্ডার। মূল রাস্তা থেকে অনেকটা নেমে এসে নদী পেরিয়ে তবে এই ক্যাম্পে আসা। অ্যাডভেঞ্চার ক্যাম্পে থাকা-খাওয়াবাবদ দৈনিক ১২০০ টাকা জনপ্রতি। মেনু নির্দিষ্ট থাকে। থাকার জায়গাটা অনেকটা আটচালার মধ্যে টেন্ট খাটানো। প্রসাধনের ব্যবস্থা বেশ ভালোই।

খোলার পাশে গিয়ে একটা বোল্ডারে বসলাম। কত অজানা পাখির বাস এই অঞ্চলে। চুপচাপ বসে ওদের 'কথা' শুনছি। স্বচ্ছ জলের তলার নুড়িগুলো বেশ দেখা যায়। আমাদের মেয়ে গতকাল পৌঁছেই এই নুড়ি নিয়ে মেতে ছিল। অবশ্য আমরাও তো কম যাইনা এব্যাপারে। সামনের বড় বোল্ডারে একটা হোয়াইট-কেপড রেডস্টার্ট (white-capped redstart) এসে বসলো। কাল বিকেলে একজোড়া প্লামবিয়াস ওয়াটার রেডস্টার্ট-ও (plumbeous water redstart) দেখেছিলাম। বন্ধুদের সৌজন্যে অনেকগুলো পাখি দেখা হল এসে থেকে।

গতকাল এন.জে.পি. স্টেশন থেকে বেরিয়ে, শিবখোলা থেকে পাঠানো গাড়িতে রওনা হয়েছিলাম। পথে রংটং-এ একবার জল-খাবারের জন্য দাঁড়ানো হল। প্রায় এগারোটা নাগাদ পৌঁছেছিলাম শিবখোলায়। তারপর থেকে যেন কান-এর শান্তি। পাখির আর পোকার ডাক ছাড়া কোনো কোলাহল নেই। নিশ্চিন্তে বিশ্রাম। দুপুরে খাওয়ার পর নালা ধরে একটু আধটু এগিয়েছিলাম আমরা, তা শম্বুকগতিতেই, কোনও তাড়া নেই, গন্তব্যে পৌঁছানোর কোনও উদ্দেশ্য নেই। নালার একটা অংশে জমা জলে অনেক ব্যাঙাচি দেখলাম। কন্যা তো তাই দেখে মেতে রইল। প্রকৃতিপাঠের জন্য উপযুক্ত জায়গা বটে। তবে ঝোরায় কিছু ভাঙা কাঁচের বোতল দেখে একটু খারাপও লাগল। সারাদিন ভালো করে রোদ ওঠেনি, তাই কেমন একটা মন কেমন করা পরিবেশ। সূর্য না থাকলে তা আমাদের মনে কী যে প্রভাব বিস্তার করে প্রায় সকলেই জানি।

বন্ধুরা মিলে নালার বোল্ডার-এর ওপর বসে জমিয়ে আড্ডা শুরু হল, বিষয়ের তো কোনো অভাব নেই। আমাদের দিনযাপন, পরিবেশ, পেশা, প্রাণী ইত্যাদি কত কী নিয়ে আড্ডা চলল আর তা সে কতক্ষণ বলতে পারবো না। হঠাৎ টিপ টিপ করে বৃষ্টি শুরু হল, অগত্যা ক্যাম্পের ক্যান্টিনের দিকে হাঁটা দিলাম। ভাবছিলাম যদি একটু গরম চা পাওয়া যেত, এই হালকা ঠাণ্ডা, মেঘমাখা পরিবেশে, নেহাত মন্দ হত না। কিন্তু পরিচারিকারা বলল যে আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। সন্ধ্যের চা-পকোড়ার প্রস্তুতিতে এখনও খানিকটা সময় লাগবে, আর তাই আমরাও বৃষ্টি দেখতে দেখতে গল্পে ফিরে গেলাম। সঙ্গে যোগ দিলেন প্রধান বাবু, অর্থাৎ এই ক্যাম্পের দেখভাল করেন যিনি। তাঁর কাছ থেকেই শুনছিলাম মরসুমি পরিবর্তনে এ পরিবেশের কীরকম বদল হয়, তার সঙ্গে কী কী ধরণের পাখি আসে এখানে, কখন তারা বাসা বানায়, এই অঞ্চলের নির্দিষ্ট কোন কোন অংশে কোন কোন পাখি দেখা যায় এই সব। ওনার উৎসাহের সঙ্গে আমাদের উৎসাহের বিষয়গুলো যারপরনাই মিলে যাচ্ছে দেখেউনি সোৎসাহে আরো জমিয়ে বসলেন আমাদের সঙ্গে। এইসবের মধ্যে এসে গেলো চা আর পকোড়া, উফ্ফ, যাকে বলে সোনায় সোহাগা।

আমাদের, মানে বাঙালিদের, বেড়াতে গিয়েও কিছু জিনিস যেমন পিছু ছাড়ে না, তার অন্যতম হল সন্ধ্যেবেলা মুড়ি-চানাচুর। ক্যাম্পেরই একজনকে কোথায় মুড়ি পাবো জিজ্ঞাসা করায়নিজেই উৎসাহ নিয়ে এনে দেবে বলল। ঝালমুড়ি খেতে খেতে কটেজের বারান্দায় বসে সময় কাটাচ্ছি। বৃষ্টিটা ধরে এসেছে, সামনের পাহাড়ের পেছন থেকে ধীরে ধীরে চাঁদ উঠছে, এ জিনিস পুরোনো হয়না, তাই না! জ্যোৎস্নার আলোয় জঙ্গলের গাছপালাগুলো জলছবির মতো দেখতে লাগছে। সন্ধে থেকে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাকের সঙ্গে ময়ূরের ডাকও শোনা যাচ্ছিল। জায়গাটার আশেপাশে হেঁটে বেড়ানোর অনেক সুযোগ রয়েছে, তবে বাকেট লিস্ট-এ টিক দেওয়ার মতো সে জায়গা নয়। এ জায়গা শুধু ছোট ছোট টিলা, সবুজ জঙ্গলে ঘেরা পাহাড়, চা-বাগান, মেঠো রাস্তা, সরু ঝোরা, তাতে বয়ে চলা স্বচ্ছ জল, পাহাড়ি পাখি, পোকামাকড় আর পাহাড়ি মানুষের কথা অনুভব করার।

সকালে ঝোরার ধরে বসে বসে সাত-পাঁচ ভাবছি, গতকালের বৃষ্টির পর ঝকঝকে রোদে পুরো উপত্যকা ভরে উঠেছে;হঠাৎ মেয়ের চিৎকার "বাবা জলে পাথর ছুঁড়ব।" আজ আমরা এ জায়গা ছেড়ে অন্য একটি জায়গায় যাব। সেখানে এতো কাছে নদী পাব কিনা জানা নেই, তাই মেয়েকে নিয়ে একসঙ্গে নদীতে অনেক পাথর ছোঁড়া হল। আরো ছোট্টবন্ধুরা পাশের এলাকাগুলো ঘুরে দেখে এলো, সঙ্গে নিয়ে এল অনেক পাখি দেখার স্মৃতি। জলখাবার সেরে বেরিয়ে পড়লাম আর একটি পাখি দেখার এলাকার দিকে - লাটপাঞ্চার।

সিমরিং গ্রামের কাছে রাস্তায় একবার গাড়ি দাঁড়ালো, ড্রাইভার দাজু বলল এখান থেকে খুব ভালো পাহাড়ের দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। পাতলা মেঘের স্তরের মধ্যে দিয়ে দৃশ্য উপভোগ করার চেষ্টা করছি, অনেকটা ঘষা কাঁচের মধ্য দিয়ে দেখার মতো। তবে এই ভ্যালি ক্লাউড সরে যেতেই আসল রূপ চোখে পড়ল। আবারো বলতে হয়, ওই টিক্ মারার জায়গার থেকেও কিছু কম নয় এই পথচলতি হঠাৎ পাওয়া ভিউ পয়েন্ট। পাহাড়ি পথের বাঁকে বাঁকে সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে, আর তার সঙ্গে ভ্যালি ক্লাউড মিশে অতি সুন্দর মায়াময় পরিবেশ তৈরি করে।

তেমনই আর কিছুটা এগোতেই দাজু আবার গাড়ি থামালো, আবারও একটি ভিউ পয়েন্ট - নাম "টপ অফ দ্য তরাইন" (top of the terrain)। এখানেও একই অবস্থা হলো, মেঘে ঢাকা সবকিছু। কিছু দেখার উপায় নেই। তাই আর বেশি সময় না নিয়ে এগিয়ে চললাম নামথিং পোখরির দিকে। পোখরি কথার অর্থ পুকুর। তা সে পুকুরে তো এখন জল নেই। কিন্তু হঠাৎ এ পুকুর দেখায়ই বা এতো উৎসাহ কেন বলছি – এই পুকুরে আছে একটি লেজযুক্ত উভয়চর প্রাণী, অনেকটা টিকটিকির মতো দেখতে, নাম স্যালামাণ্ডার। এরা এই লেকের জলেই ঘুরে বেড়ায়, আর জল শুকিয়ে গেলে শুকনো পুকুরের ঝোপ হয়ে যাওয়া অংশে মাটির তলায় দিন কাটায়। এই ধরণের উভচর প্রাণীটি মানুষের কার্য্যকলাপের কারণে খুব কোণঠাসা হয়ে পড়েছে, এবং এরা সংখ্যায় এতই কমে গিয়েছে যে এই স্থানীয় জীববৈচিত্র্যটি প্রায় বিলুপ্তির মুখে। সেই কারণে এই বড় পুকুরটির চারপাশে বেড়া দেওয়া আছে। এই পুকুরের চারপাশ দেখে, আশেপাশের জঙ্গলে কিছু পাখির খোঁজ করে ফিরে এলাম।

এবার পরের গন্তব্য অহলদাঁড়া। এটি একটি সুন্দর ভিউপয়েন্ট যেখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায় বটে, কিন্তু সে সুযোগ হলনা, বাধ সাধলো মেঘরাজি। তবে এখান থেকে দূরে অনেকটা নিচের দিকে নদী, তার অববাহিকা, আর ছোটবেলায় খাতায় আঁকা পাহাড়ের সারির মতন সবুজে ঢাকা পাহাড় দেখা যায়। ভিউপয়েন্ট-এর বাঁহাতে একটি পাথরের ঢাল, যার শৈলশিরা এঁকেবেঁকে ঠিক যেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মুখাবয়ব সৃষ্টি করেছে। নাম রাখা হয়েছে টেগোর রক (Tagore rock)।

র‍্যাপটরদের (যে মাংসাশী পাখিরা তাদের তীক্ষ্ণ বাঁকানো ঠোঁট ও নখর ব্যবহার করে শিকার করার জন্য বা আত্মরক্ষার্থে) মতো আমরাও বার্ডস আই ভিউ পেয়ে গেলাম এখান থেকে। রোদ-ঝলমলে পরিবেশে খানিক সময় কাটিয়ে, দ্বিপ্রাহরিক আহারের জন্য অহলদাঁড়া থেকে বেরিয়ে পড়লাম লাটপাঞ্চার -এর উদ্দেশ্যে।

লাটপাঞ্চার-এ সাবির সুব্বা-র হোমস্টে আগে থেকেই বুক করে রাখা ছিল, এখানেও ব্যবস্থা একই রকম, দৈনিক ৯০০ টাকা জনপ্রতি, থাকা-খাওয়া মিলিয়ে। দুপুরের খাওয়ার পর বেরিয়ে পড়লাম আশপাশটা ঘুরে দেখতে। এখানে দুরাত্রি থাকা, তাই সময় একটু বেশি পাওয়া যাবে। জলে-জঙ্গলে ঘোরার অভ্যেস থেকে যেদিকেই পায়ে হেঁটে যাওয়া যায়, সেদিকেই রওনা দিই। তাতে মাঝে মধ্যে কিছু অসুবিধার সৃষ্টি হয় বৈকি। যেমন এক্ষেত্রে ঘটল। সুব্বার হোমস্টে থেকে বেরিয়ে বাঁদিকে নীচে যাবার রাস্তা ধরলাম। খানিক পিচরাস্তায় হেঁটে, আমরা পাহাড়ের ঢালের জঙ্গলে ঢুকে পড়লাম। বড় বড় ওক, শাল, পাইন গাছের জঙ্গল। উঁচু উঁচু গাছের নিচে ঝোপঝাড়, লতাগুল্মের জঙ্গল, খুব ঘন নয়; তবে মাঝে মধ্যে মেঠো পথের মতোও আছে। বেশ পোকামাকড়ের উপদ্রব। সবাই মিলে প্রকৃতির গন্ধ নিতে নিতে বিক্ষিপ্তভাবে এগিয়ে চলেছি। কিছুটা এগিয়ে দেখি সামনের বেশ কিছুটা অংশ জুড়ে সারি সারি আয়তাকার স্মৃতিসৌধ। সহজেই বোধগম্য যে আমরা কোথায় এসে পড়েছি। গাছের পাতার আচ্ছাদন আকাশের অনেকাংশ ঢেকে দেয় এই ধরণের জঙ্গলে, ফলত, সূর্যাস্তের সময় ভালো করে পাখি দেখারও জো নেই, উপরন্তু কিছু হাতির গোবর দেখে, পড়ন্ত বেলায় পাহাড়ের ঢাল বেয়ে আর নীচের দিকে যাওয়া সমীচীন মনে হলোনা। ফিরে এলাম রাস্তায়, নামতে থাকলাম নীচের দিকে, কিছুটা এগিয়ে একটা বসতি, গ্রামের নাম শিটং, আরও খানিকটা এগিয়ে একটা রাস্তা ডানদিকে কিছুটা ওপরের দিকে উঠে গেছে, মহানন্দা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের বীট অফিসের দিকে।

মহানন্দা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যটি হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত, একপাশ দিয়ে বয়ে চলেছে তিস্তা নদী আর অন্যদিকে মহানন্দা। দার্জিলিং জেলার অন্তর্গত এই অভয়ারণ্যটি শিলিগুড়ি থেকে ২০ কিলোমিটারের মধ্যেই। এর আয়তন ১৫০ বর্গ কিলোমিটারের কিছু বেশি। শিবখোলা, লাটপাঞ্চার – দুটো জায়গাই এই অভয়ারণ্যের মধ্যে পড়ে। বাসিন্দাদের মধ্যে রয়েছে নানারকমের পাখি ছাড়াও রয়েছে হাতি, বাঘ, গাউর, ভাল্লুক ও আরো কত কী। আগামীকাল ভোরের গন্তব্য হল অভয়ারণ্যটির একদিকের অতি ক্ষুদ্র অংশ যেখানে মানুষের কোন বসবাস নেই।

সাবির সুব্বা আগেই গাড়ি ঠিক করে রেখেছিল আমাদের কথামত। সাতশো টাকায় যাতায়াত মহানন্দা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের লাটপাঞ্চার বীট অফিস, হোমস্টে থেকে। ভোরের আলো তখন সবে ফুটেছে, সবাই চলেছি নতুন কিছু অভিজ্ঞতার আশায়। পিচরাস্তা থেকে ডানদিক বরাবর ওপরের দিকে উঠে গাড়ি একেবারে জঙ্গলে ঢুকে পড়ল। এবার কিছুটা হালকা রোদে সামনের ঝোপঝাড়ে পাখির সক্রিয়তা চোখে পড়ল। তবে চেনা দুরূহ। বেশ কিছু সিঙ্কোনা চাষের বাগান রয়েছে এখানে। মেঠো রাস্তার দুধারে সারি সারি ফুলের গাছ লাগানো হয়েছে। নাম অ্যাজেলিয়া (Azalea), হিমালয়ান গোল্ডেন স্যাফায়ার (Himalayan Golden Sapphire), রডোডেনড্রন ফুলের গাছ, গোলাপি, সাদা দুরকমেরই রয়েছে, এগুলো গুল্মজাতীয়, বড় বড় গাছের ছায়ায় থাকতে পছন্দ করে।

আমাদের সঙ্গে গাইড ছিল, নাহলে এজায়গায় প্রবেশ নিষেধ। তাছাড়া জনপ্রতি একশো টাকা প্রবেশমূল্য। যদিও পৌঁছে, প্রবেশদ্বারে যে অফিস আছে, তার আশেপাশে বড়জোর ১৫০-২০০ মিটার যাওয়া যায়, তারপর আর যেতে দেওয়া হয়না। জায়গায় জায়গায় হাতির গোবর পড়ে থাকতে দেখলাম, তাই বোঝাই যাচ্ছে কেন আরো গভীরে প্রবেশ নিষেধ। অফিসের চারদিকে ইলেকট্রিক তারের বেড়া। রোদ আর একটু কড়া হতেই পাখির গতিবিধি বেশিমাত্রায় চোখে পড়ল। সকালের এই সুন্দর নরম আলোয় পাখি দেখার ও তার ছবি তোলার পক্ষে আদর্শ। একজোড়া স্কারলেট মিনিভেট চোখে পড়ল, স্বামী-স্ত্রী আমাদের যথেষ্ট সময় দিলেন ভালো করে দেখার।

আমাদের সঙ্গের বন্ধুরা পাখি দেখায় বেশ দক্ষ, তাই আমাদের আর বেশি বেগ পেতে হয়নি। ওইটুকু অঞ্চলেই অনেক ছোট ছোট পাখি গুল্মজাতীয় গাছের ফাঁকে ফাঁকে দেখতে পেলাম। কলকাতার আশেপাশে সহজেই বেনেবৌ (কালো মাথা, হলুদ গা) চোখে পড়ে, এই অঞ্চলে তামারঙের বেনেবৌ চোখে পড়ল। বেশকিছু শিকারি পাখিও দেখা হল। সমতলে নানা ধরণের বসন্তবৌরি (Barbet)চোখে পড়ে, এখানে, প্রায় ১৫০০ মিটার উচ্চতায় গ্রেট বারবেট (Great Barbet) চোখে পড়ল। শান্ত নিরিবিলি পরিবেশে শুধু পাখির ডাক শুনে, পাখি দেখে আর চারিপাশের কত অজানা গাছগাছালি, তার ফুল, ফল, এইসব দেখে, তাদের ছবি তুলে খুব ভালো একটা সময় কাটল। কিছু পায়েচলা পথ জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেছে, সেদিকে রাস্তার ওপরের গাছ, লতাপাতা এমন ভাবে ঝুঁকে পড়েছে যে অনেকটা সুড়ঙ্গের আকার ধারণ করেছে। আরো কিছুক্ষণ কাটিয়ে ফেরার রাস্তা ধরলাম।

লাটপাঞ্চারের এক পাশে একটি নার্সারি আছে, শুনলাম সেখানেও নাকি অনেক পাখি আসে। শীতের রুক্ষতার পর বসন্তকালে গাছে গাছে নতুন পাতা, সঙ্গে ফুল, যা আকর্ষণ করে নানারঙের ও রকমের পোকা-মাকড় ও প্রজাপতিকে। ফুলের মধু বা মকরন্দ বা পোকামাকড় খেতে এই সময় পাখিদের আনাগোনা ও বেড়ে যায় এই সময়টায়। তাই নার্সারি শুনেই ওদিকে যাবার লোভ সামলাতে পারলাম না। আমরা ফিরেই তড়িঘড়ি জলখাবার আর চা খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম সাবির সুব্বার সঙ্গে। এবারের গাইড উনিই। শুরুতে সুব্বা ভাইয়া যে দিকে যাওয়ার কথা বলেছিলেন, লক্ষ্য করলাম আমরা সেদিকে যাচ্ছিনা। কী হল বুঝতে পারছিনা। শুনলাম সুব্বা ভাইয়া ওদেরই একজনের সঙ্গে ওদের ভাষায় কথা বলছেন। খানিক ধাতস্থ হয়ে বুঝলাম, কাছেই কিছু বিশেষ ফুল গাছ আছে, সেগুলোতে মধু খেতে একধরণের আগুনরাঙা মৌটুসী পাখি (Mrs. Gould's sunbird) এসেছে, সেদিকেই এখন যাব আমরা। এই আর্দ্র পর্ণমোচী বৃক্ষের জঙ্গলে একটি চিরহরিৎ গুল্ম হল এই ফুলগাছটি, যার আকর্ষণেই সেই পাখির ওখানে আসা। বাংলাভাষায় গাছটির কোনও নাম পাওয়া যায় না, তবে অসমিয়া ভাষায় এটিকে তিতাফূল বা রঙ্গবাহক বলে। গাছের ফুলগুলি টকটকে লালরঙের এবং একটি মঞ্জরীদন্ডের ওপর সাজানো। গাছটির ফুল, ফল, পাতা সবেরই ভেষজ গুণ আছে, এরকমটাই বলে স্থানীয়রা।

লক্ষ্যে পৌঁছে দেখি গোটা দশ-পনেরজন লোক কাঁধে গদার মতো বড় বড় লেন্সওয়ালা ক্যামেরা নিয়ে তাক করে আছে ওই ফুলগাছটার দিকে। উফফ সে এক দৃশ্য বটে! হঠাৎ শুনি পরপর শাটারের আওয়াজ, মানে সেই মৌটুসী দেখা দিয়েছেন। এসব দেখে পাখি দেখার উৎসাহই প্রায় হারিয়ে ফেলছি, এমন সময় আমার এক বন্ধু বলল, পাশেই একটা গাছে সেই মৌটুসীরই আরেকজন এসেছে। সেদিকটায় গিয়ে পাহাড়ি ধাপে বসে পড়লাম পরিবার এবং বন্ধুসহ, এবার বেশ কাছ থেকে দেখা যাচ্ছে। কী তার রূপ! কোনো রং বাদ নেই শরীরে। মাথার ওপর বেগুনি, পিঠের দিকটা টকটকে লাল, বুকের কিছুটা অংশ লাল আর পেটের দিকটা হলুদ, লম্বা লেজের রং বেগনেটে-নীল। ডানায় ব্রোঞ্জ রং। সস্ত্রীক এসেছে সে। নিজেদের মধ্যে খেলা আর ফুলের মধু খাওয়া এই চলছে অবিরত। আরও কিছু পাখি এল, গেল ওই একই গাছে, আমরাও ওই জায়গাতেই ঘন্টাখানেক কাটিয়ে দিলাম। ভাবছি প্রকৃতির কী সৃষ্টি! কোনো ভাষা, কোনো শব্দ কি আছে, তা বর্ণনা করার? এ শুধু দেখার আর উপলব্ধি করার।

বিকেলের দিকে আবার বেরিয়ে পড়লাম জায়গাটা আরও কিছুটা চেনার উদ্দেশ্যে। নীচের বাঁহাতে রাস্তা নেমে গেছে একটা গ্রামের দিকে, গতকাল হেঁটেছিলাম এই রাস্তায় কিছুটা। সেদিকেই হাঁটতে লাগলাম, এবার কোনো গন্তব্য নেই, তবে সন্ধে হলেই ফিরতে হবে, কারণ অন্ধকারে তো পাহাড়ি রাস্তা বুঝতে পারবনা, তারপর কোথায় যেতে কোথায় গিয়ে উঠব। রাস্তার গায়ে পাহাড়ের পেছনে সূর্যাস্ত হয়েছে, ঝিমিয়েপড়া আলো আর গ্রাম্য জীবন এই দেখতে দেখতে পথ হাঁটছি। কোথাও সবে উনুনে ধোঁয়া দেওয়া শুরু হয়েছে, কোথাও দিনের শেষ আলোয় হিমশীতল জলে চলছে বাসন মাজা, কোথাও পাহাড়ি মেয়েরা সেরে নিচ্ছে দিনের শেষ প্রসাধনী। বাড়ির পুরুষেরা ঘাসের বোঝা নিয়ে বাড়ি ফিরে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে দাওয়ায়, কোথাও গৃহিণী চা এনে দিচ্ছে বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠকে। ছোট মুদির দোকান হয়তো আর কিছুক্ষণ বাদেই গুটিয়ে নেবে তার পসরা। এভাবেই ছোট হয়ে আসছে দিনের সময়। পুবাকাশে কিছু কালো মেঘের আনাগোনা যেন তারই বার্তা দিচ্ছে, আকাশের আলো নিভে গিয়ে চারিদিকে নিস্তব্ধ পরিবেশ।

সন্ধে পেরোতেই মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হল, জানালা দিয়ে তা দেখার সুখানুভূতি ভাষায় ব্যাখ্যা করা আমার সাধ্যি না। তাই সে চেষ্টাই করছি না। বৃষ্টির মাঝে মাঝে আকাশচেরা আলোর ঝলকানি, সিল্যুয়েট-এ আচমকা দেখা পাহাড়, গ্রাম আর মেঘের গুড় গুড় আওয়াজ;ভাবতে-দেখতে-শুনতে সময় কাটছে ভালো। দমকা হাওয়ায় বৃষ্টির ফোঁটা ভিজিয়ে দেয় আমার বাড়ানো হাত। হাতছানি দেয় শুদ্ধিকরণের।

সকাল সাতটার মধ্যে তৈরি হয়ে নিলাম, আজ যাব আর একটু গভীর জঙ্গলে, পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে আমাদের সুব্বা ভাইয়া। গতকাল পাহাড়ের যে ঢালে আগুনরঙা মৌটুসী দেখেছিলাম, তার পাশ দিয়ে আরো অনেকটা নীচে নামার পালা। খুব উঁচু উঁচু গাছের নিচের অংশে ছোটছোট ঝোপঝাড়, বড় পাথর বসিয়ে বসিয়ে ধাপের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাথরগুলোয় অতিমাত্রায় অভ্রর উপস্থিতি, আর শিশিরের জল পড়ে খুব পিচ্ছিল হয়ে রয়েছে। তাই অতি সাবধানে নামতে হচ্ছে। কিছুটা অংশে পাথরের ধাপের বদলে ভেজা মাটি, নামতে গিয়ে পা হড়কে যাচ্ছে, বিশেষত ঝরাপাতা ভিজে যাওয়ায় ভালো করে পায়ের গ্রিপ পাওয়া যাচ্ছে না। বিপদ বাড়ায় এই পাতার তলায় লুকিয়ে থাকা ডুমুরজাতীয় ফলের উপস্থিতি। গোল গোল ফলগুলি পায়ের তলায় পড়লেই তাল রাখা মুশকিল হয়। ক্রমশ ঘন জঙ্গলের দিকে নামছি, মাঝে কিছু পাখি দেখলেই একটু সময় নেওয়া হচ্ছে। প্রায় ঘন্টাখানেক নামার পর আমাদের গাইড সুব্বা ভাইয়া সবাইকে এক জায়গায় দাঁড়াতে বলল। নিজে কিছু একটা শোনার চেষ্টা করছে মনে হচ্ছে, কান খাড়া করে একটু ওপরে উঠতেই আওয়াজটা আরো পরিষ্কার হলো। সুব্বা ভাইয়া জানান দিলো বাদামি গলা ধনেশ-এর ডাক এটা। ভিতরে ভিতরে খুব উত্তেজিত হলাম, তাহলে দেখতে পাবো বাদামি গলা ধনেশ পাখিটি! সুব্বা ভাইয়া বলার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দূরে দেখতে পেলাম সেই ধনেশ দম্পতিকে, বাঁদিক থেকে ডানদিকের পাহাড়ের ঢালের জঙ্গলে উড়ে যেতে। আকারে অনেক বড়, গলা ও ঘাড় উজ্জ্বল বাদামি রঙের, সারা শরীর কালো পালকে ঢাকা, লম্বা লেজের শেষপ্রান্ত সাদা। আর যে বৈশিষ্ট্যটি না বললেই নয়, সেটি হল বড় মোটা হলুদ রঙের চঞ্চু যার ওপর তির্যকভাবে কালো দাগ থাকে। ঠোঁটের ওপর এই দাগ দিয়েই পাখিটির বয়স সম্পর্কে কিছুটা ধারণা করা যায়। গাইড বলল, আরো জঙ্গলের মধ্যে যেতে পারলে ওদের বাসাটাও দেখা যাবে। আমরা কয়েকজন ধনেশ পাখির বাসা দেখার জন্য সুব্বা ভাইয়ার সঙ্গে আরো নীচের দিকের ঘন জঙ্গলে নামতে থাকলাম।

জায়গাটায় লতাগুল্মের জঙ্গল বেশ ঘন, সঙ্গে বিচুটি গাছের প্রাধান্য। তাই অতি সাবধানে, অথচ খুব দ্রুত যেতে হবে, না হলে ধনেশ পাখির বাসা দেখার সুযোগও ফিকে হবে। আমরা ক'জন প্রায় পড়ি-মড়ি করে ঝোপঝাড় কাটিয়ে এগোচ্ছি, অবশেষে সুব্বাবা ভাইয়া হাত তুলে দিক নির্দেশ করে দেখাল, ওই যে ধনেশযুগল বাসার বাইরের একটা ডালে বসে আছে। চটপট কয়েকটা ছবি তোলা হল। একটি লম্বা গাছের মাঝামাঝি গাছের গুঁড়িতে একটা কোটর রয়েছে, সেখানেই তাদের বাসা গুছিয়ে নিয়েছে ধনেশ দম্পতি। আশেপাশে একই রকম অনেক গাছ আছে, তার কাছাকাছি ডুমুর জাতীয় ফলের গাছও চোখে পড়ল, ওরা প্রধানত ফলাহারী। বেশিক্ষণ দেখার সৌভাগ্য হল না বটে, তবে এই যা দেখলাম, সেটাই বা কম কী? মনটা বেশ ভালো হয়ে গেল।

আরও কিছু পাখি দেখলাম, তার মধ্যে সুলতান টিট, কয়েকরকমের ফ্লাইক্যাচার, থ্রাশ, স্ট্রায়েটেড বুলবুল উল্লেখযোগ্য। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পথের ভিজে ভাবটা আর নেই, তাই উঠতে সুবিধে হল। মাঝে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার ওঠার পালা। বিশ্রামের সময় চোখে পড়ল একটি কাঠি পোকা (stick insect), কী অসাধারণভাবে গাছের সরু ডালের সঙ্গে মিশে রয়েছে, সবসময় চোখেও পড়ে না। এরা গাছের সরু ডালের গঠন হুবহু নকল করে মিশে থাকে, আলাদা করে সাজতেও হয়না।

আস্তে আস্তে উঠে এলাম গ্রামের পথে, এ-বাড়ি ও-বাড়ির গলি কাটিয়ে চলে এলাম পিচরাস্তায়। এবার গন্তব্য হবে সমতলের দিকে। এই তিনদিনে অনেক নতুন অভিজ্ঞতা হল, সঙ্গে নিয়ে এলাম বেশকিছু স্মৃতি, যা রোমন্থন করে চালাতে হবে বেশ কয়েকদিন। শুনছি পৃথিবীর মানুষের অবস্থা ভালো নয়, পরের বেড়াতে যাওয়াটা, অনেকটাই তাই নির্ভর করে রয়েছে নানাবিধ আর্থসামাজিক পরিস্থিতির ওপর। তবে আমরা আসি বা না আসি তাতে ওদের দিনযাপনের কোনো পরিবর্তন হবে না।

এখন মানুষ ভালো নেই, কিন্তু ওরা ভালো আছে।

অধ্যাপনার পাশাপাশি অরুণাচল চ্যাটার্জি বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ানোটা অভ্যেসে পরিণত করেছেন। বিভিন্ন পরিবেশে উপস্থিত জীববৈচিত্র্য তাঁকে আকৃষ্ট করে আর তাই জলে-জঙ্গলে-পাহাড়ে ঘোরার নেশা নতুন নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ে সহযোগিতা করে।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher