সিংহল দ্বীপে
অর্পিতা সরকার জানা
দিনটা ছিল ১৭ অক্টোবর,২০১৮। বিকেলবেলায় নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে বসেও ভাবতে পারছিলাম না যে আগামীকাল আমরা এই সময় ভিনদেশে থাকব!ভাবতে ভাবতে সময় হয়ে এল আকাশে ওড়ার এবং ইণ্ডিগোর বিমানে চেপে পৌঁছে গেলাম চেন্নাই। তখন বাজে রাত সাড়ে আটটা। পরের উড়ান ছিল ১৮ অক্টোবর, ২০১৮, সকাল সাড়ে ছটায় চেন্নাই থেকে রাবণ রাজার দেশের উদ্দেশ্যে।
প্রথম দিন
পা রাখলাম বন্দরনায়েক ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে। বেরিয়েই দেখতে পেলাম প্ল্যাকার্ড হাতে অপেক্ষা করছে ইকবাল, একাধারে সারথি ও গাইড এবং আমাদের এই দশ দিনের সফরসঙ্গী।
প্রথম গন্তব্য ছিল সিগিরিয়া। এয়ারপোর্ট থেকে সিগিরিয়ার দূরত্ব ১৫০ কিমি। গাড়িতে উঠে আমাদের প্রথমে পৌঁছালাম ভুবনবিখ্যাত 'সিগিরিয়া রক' যার আরেক নাম 'লায়ন রক'। এটি একটি অপূর্ব সুন্দর গুহামন্দির। ছয়শত ফুট উঁচু এক পাথর কেটে দুর্ভেদ্য প্রাসাদ বানিয়েছিলেন রাজা -অনেকটা মৌচাকের মতো। বিশাল সিংহমূর্তির আদলের পাথরের প্রবেশপথটির অনেকখানি এখনো টিঁকে আছে। প্রাগৈতিহাসিক এই গুহাটি খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০ শতাব্দী থেকেই সাধু-সন্ন্যাসীদের আশ্রম হিসেবে ব্যবহৃত হত। শোনা যায় দক্ষিণ ভারতীয় রাজা কাশ্যপ কোনো যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ৪৯৫ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এখানে আশ্রয় নেন এবং সুরক্ষিত একটি দুর্গ গড়ে তোলেন। পরবর্তীতে এটি বৌদ্ধদের মঠে পরিণত হয়। চৌদ্দ শতক বৌদ্ধমন্দির হিসেবে পর্যন্ত ব্যবহৃত হত। বর্তমানে এটি শ্রীলঙ্কার একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র এবং ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। একটি মিউজিয়ামও বিদ্যমান। বেরিয়ে এসে এলিফ্যান্ট সাফারি করতে করতে আবারও রকের অপূর্ব দৃশ্য প্রত্যক্ষ করলাম। এরপর গাড়ি পৌঁছে গেল 'ফ্রেসকো ওয়াটার ভিলা' – আমাদের প্রথম রাতের ঠিকানায়। সিগিরিয়া শ্রীলঙ্কার সেন্ট্রাল প্রভিন্সের মাতালে জেলায় অবস্থিত। এখানে আমাদের দুরাত্রি থাকার পরিকল্পনা।
দ্বিতীয় দিন
দ্বিতীয় দিনটি কাটলো আশেপাশের স্থানাদিদর্শনের মধ্য দিয়ে - কান্দালামা লেক (Kanadalama Reservoir)এবং ড্যাম, হেনরি বাটিকস, পোথানা এবং স্থানীয় গ্রামের সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য। ৬৯ ফুট (২১ মিটার) উঁচু এবং চওড়ায় ৫২০০ ফুট (১৬০০ মিটার) কান্দালামা রিজার্ভারটি সেচকার্যের জন্য নির্মিত হয়েছিল। পোথানায় গুহার ভিতরে গুম্ফা সত্যিই অতুলনীয়, বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বসবাস করেন এখানে। হেনরি বাটিকসে রয়েছে বাটিকের কারখানা। শ্রীলঙ্কার বাটিক জগৎ বিখ্যাত। ঘুরতে ঘুরতেই বাফে লাঞ্চ সেরে হোটেলে ফিরলাম বিকেলে। আগামীকালের গন্তব্য ট্রিঙ্কোম্যালি।
তৃতীয় দিন
সিগিরিয়া থেকে ১০০ কিমি দূরে সমুদ্র তীরবর্তী ত্রিঙ্কোমালী (Trincomalee) গোকান্না বা গোকর্ণ নামেও পরিচিত, শ্রীলঙ্কার পূর্ব প্রদেশের (East Province) প্রধান বন্দর শহর। এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন শহর এটি। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে দ্বীপের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ইতিহাসে একটি প্রধান সমুদ্রবন্দর হিসাবে কাজ করেছে। ইকবাল গাড়ি চালাতে চালাতে শ্রীলঙ্কার অনেক গল্প শোনাতে লাগলো। এরপর গাড়ি পৌঁছে গেল 'সি লোটাস পার্ক ' হোটেল ট্রিঙ্কোম্যালিতে। সৈকতের গায়েই হোটেল হওয়াতে ঘর থেকেই সোনালি বালুকাবেলার ওপর নীল জলের আছড়ে পড়ার দেখছিলাম।
হোটেলে পৌঁছে বেশি দেরী না করে লাঞ্চ সেরে ফেললাম আর সামান্য বিশ্রামের পর একটু ফ্রেশ হয়েই আবার বেরিয়ে পড়লাম লোকাল সাইট সিইং-এর জন্য। প্রথমেই গেলাম কোণেশ্বরম মন্দিরে। হাজার স্তম্ভের শিবমন্দিরটি পাহাড়ের ওপরে অবস্থিত। এছাড়াও এখানে ভদ্রকালী, গণেশ, বিষ্ণু, সূর্য, রাবণ, মুরুগান (কার্তিক) ইত্যাদি দেবদেবীর পূজা হয়। ট্রিঙ্কোমালিতে আশেপাশের জায়গাগুলির মধ্যে ফোর্ট ফ্রেডেরিক, গোকান্না রাজামহাবিহার অন্যতম।
বিকেলের স্ন্যাক্স হিসেবে ইকবাল এগ হপার্স (Egg Hoppers) নামের একটি নতুন খাবারের সঙ্গে পরিচয় করালো। ট্রিঙ্কোমালির সৈকতে সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয়ের অপরূপ দৃশ্যকে সাক্ষী রেখে বিদায় জানালাম শহরটিকে। পরবর্তী গন্তব্য ডাম্বুলা, রামবোডা হয়ে ক্যাণ্ডি।
চতুর্থ দিন
সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথম গন্তব্য ডাম্বুলার বিখ্যাত কেভ টেম্পল। ডাম্বুলা গুহা মন্দির শ্রীলঙ্কার সেন্ট্রাল প্রভিন্সের মাতালে জেলায় অবস্থিত। ডাম্বুলার এই গুহামন্দিরও ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট -শ্রীলঙ্কার বৃহত্তম এবং সর্বাধিক সংরক্ষিত গুহা মন্দির কমপ্লেক্স। আশপাশের সমভূমিগুলির ওপরে শিলা টাওয়ার ১৬০ মিটার। আশিটিরও বেশি গুহা রয়েছে। প্রধান আকর্ষণ পাঁচটি গুহার, যাদের মধ্যে মূর্তি এবং ফ্রেস্কো (Fresco) রয়েছে। দেওয়ালচিত্র এবং মূর্তিগুলি মূলতঃ গৌতম বুদ্ধ এবং তাঁর জীবনের সাথে সম্পর্কিত। মোট একশ তিপান্নটি বুদ্ধের মূর্তি, শ্রীলঙ্কার রাজার তিনটি মূর্তি এবং বিষ্ণু এবং গণেশসহ চারটি দেবদেবীর মূর্তি রয়েছে । দ্বিতীয়টির মধ্যে রয়েছে ম্যুরালগুলি ২১০০ বর্গমিটার (২৩,০০০ বর্গফুট) অঞ্চল জুড়ে।
এছাড়াও আছে ডাম্বুলার স্বর্ণ মন্দির যেখানে পৃথিবীর বৃহত্তম (১০০ফুট) বুদ্ধদেবের ধর্মচক্রপ্রবর্তন রূপের মূর্তিটি সত্যিই অতুলনীয়।
ডাম্বুলা থেকে রIমবোডার ওপর দিয়ে যাওয়ার পথে আমরা শ্রী ভক্ত হনুমান মন্দির দর্শন করলাম। সেখান থেকে গেলাম রIমবোডা জলপ্রপাত। রIমবোডা জলপ্রপাতটি ১০৯ মিটার (৩৫৮ ফুট) উচ্চ। এটি পুসেল্লাভা অঞ্চলে অবস্থিত।
এরপর গেলাম ডামরো চা ফ্যাকট্রিতে। চা পাতার প্রক্রিয়াকরণ করে কীকরে তাকে প্যাকেটজাত করা হয়ে থাকে তার সুন্দর বিবরণ পেলাম এবং দেখলাম। শ্রীলঙ্কার পার্বত্য অঞ্চল বলতে এই স্থানকেই বোঝায়। 'ডামরো লাবোকেলি টি লাউঞ্জে' ("DAMRO LABOOKELLIE TEA LOUNGE") বসে গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে সবুজ গালিচা মোড়া পাহাড়, উপত্যকা এবং চা বাগানের অপরূপ দৃশ্য দেখতে দেখতে প্রকৃতির কোলে হারিয়ে গেলাম। ইকবালের ডাকে সম্বিত ফিরে পেলাম। চার বাক্স চা কিনে গাড়িতে চেপে বসলাম স্পাইস গার্ডেন যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
পথে এক জায়গায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে ইকবাল সিংহলের বিখ্যাত কিং কোকোনাট (King Coconut) খাওয়ালো। কী মিষ্টি সেই ডাবের জল! কমলা রঙের সেই ডাবের জল একজনের পক্ষে শেষ করা সত্যিই দুষ্কর। তিনজনে মিলে একটা ডাবের জলপান করলাম!
শ্রীলঙ্কার এই মশলা উদ্যানগুলি এক অদ্ভুত অ্যারোম্যাটিক অভিজ্ঞতা। এখানে পনেরো ধরণের মশলা চাষ করা হয়;যার বেশিরভাগই বিশ্ব মশলাবাজারে রপ্তানি হয়। গোলমরিচ, হলুদ, এলাচ, লবঙ্গ, জায়ফল, দারুচিনি, আনারস, ভ্যানিলা, অ্যালোভেরা, কোকো এবং অন্যান্য গুল্মগুলি নিয়মিত পরিচর্যার মধ্য দিয়ে বড় হচ্ছে। দুপুরের লাঞ্চ এখানেই সেরে ক্যাণ্ডি শহরে প্রবেশ করলাম।
ক্যান্ডি শ্রীলঙ্কার সেন্ট্রাল প্রভিন্সের অন্যতম শহর। রাজধানী কলম্বোর পর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর এটি। শ্রীলঙ্কার প্রাচীন রাজাদের সর্বশেষ রাজধানী ছিল ক্যান্ডি, বর্তমানে এটি সেন্ট্রাল প্রভিন্সের রাজধানী। পাহাড়ের পাদদেশে শহরটি গড়ে উঠেছে চা উৎপাদনকারী অঞ্চল হিসেবে। তাছাড়াও প্রশাসনিক ও ধর্মীয় কারণে এ শহরের বিশেষ পরিচিতি রয়েছে। বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের কাছে অন্যতম তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিত ক্যান্ডিতে রয়েছে সুবিশাল টুথ রেলিক (শ্রী দালাদা মালিগায়া) মন্দির (Temple of the Sacred Tooth Relic)। ১৯৮৮ সালে ইউনেস্কো এটিকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ঘোষণা করে।
পাশেই রয়েছে সুদৃশ্য ক্যান্ডি লেক। কথিত আছে গৌতম বুদ্ধের দাঁত এনে এই মন্দির স্থাপন করেছিলেন রাজকন্যা হেমামালী এবং তার স্বামী যুবরাজ দন্ত। কত যুদ্ধের এবং বৈদেশিক শক্তির আঘাত কাটিয়ে আজও সুন্দর,নিপুণ ভাস্কর্যের সাক্ষী এই মন্দির। লেকের জলে অসংখ্য বড় বড় মাছ খেলা করে চলেছে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হল। চা-বিস্কুটের সঙ্গে ক্যান্ডির কালচারাল ডান্স দেখে আমাদের গাড়ি ছুটে চললো হোটেলের উদ্দেশ্যে।
পঞ্চম দিন
শৈলশহর ক্যান্ডি ছাড়ার আগে শহরটিকে আরেকটু দেখে নেওয়ার পালা। সকালবেলায় ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম "পেরাডেনিয়ার রয়্যাল বটানিক্যাল গার্ডেনটি" দেখতে। প্রায় ১৪৭ একর জায়গা জুড়ে এই বাগানটিতে রয়েছে অসংখ্য অর্কিড, মশলা, মহৌষধি এবং খেজুর গাছ সহ ৪০০০ প্রজাতির বেশি উদ্ভিদ। এটি শ্রীলঙ্কার দীর্ঘতম নদী মহাভেলির কাছে অবস্থিত। আমাদের পুত্র আয়ূষ আজ এই অসংখ্য গাছের মাঝে সবুজ ঘাসে মোড়া মাঠে ছুটে দৌড়ে খুব মজা করেছে। অনেকক্ষণ সেখানে কাটালাম।
বটানিক্যাল গার্ডেন থেকে গেলাম 'স্টোরফিল্ড টি ফ্যাকট্রিতে'। একটা ট্রে-তে দশ রকম চায়ের কাপ নিয়ে এলেন এক শ্রীলঙ্কান মহিলা। বিভিন্ন রকম চায়ের (white tea, golden tea, green tea) খাঁটি গন্ধ এবং স্বাদ বিনামূল্যে উপভোগ করলাম। এক ব্যাগ হোয়াইট টি কিনে ফেললাম।
এরপর আমাদের গাড়ি তীরবেগে ছুটে চললো নুয়ারা এলিয়ার দিকে। শ্রীলঙ্কার সেন্ট্রাল প্রভিন্সের পার্বত্য অঞ্চলের নুয়ারা এলিয়াকে বলা হয় 'লিটল ইংল্যাণ্ড'। ১৮৬৮ মিটার (৬১২৮ ফুট) উচ্চতায় অবস্থিত এই শহর শ্রীলঙ্কার শীতলতম অঞ্চল হিসেবেও পরিচিত। এটি নুয়ারা এলিয়া জেলার প্রশাসনিক রাজধানী। চারিদিকে চা বাগানে ঘেরা পাকদণ্ডী রাস্তা পেরিয়ে পৌঁছলাম গন্তব্যে। হিমঠাণ্ডার মধ্যেই রেস কোর্স,মনাস্ট্রি আর কুয়াশায় ঘেরা গ্রেগরি লেকের নৈসর্গিক দৃশ্য দেখে 'ইন্ডিয়ান সামার' রেস্টুরেন্টে পেটপুজো করে পৌঁছে গেলাম আজ রাতের ঠিকানায়। দূরের পাহাড়ে দোকান, বাড়ি, হোটেলের অসংখ্য আলো জোনাকি পোকার মতো জ্বলছে। ডিনার সেরে শুয়ে পড়লাম শৈলশহর নুয়ারা এলিয়াকে শুভরাত্রি জানিয়ে।
ষষ্ঠ দিন
আজ আরো এক লম্বা সফরের পালা। নুয়ারা এলিয়া থেকে এল্যা হয়ে ইয়ালা জাতীয় উদ্যানে যাব। আমাদের হোটেল তিস্সামাহারামাতে। শ্রীলঙ্কার সাদার্ন প্রভিন্সের (Southern Province) হাম্বানটোটা জেলার তিস্সামাহারমা থেকেই ইয়ালা জাতীয় উদ্যানের সূচনা।
নুয়ারা এলিয়ার কনকনে ঠাণ্ডায় গরম গরম ব্রেকফাস্ট সেরে প্রথমেই এলাম সীতা এলিয়া। এটিই রামায়ণের অশোক বাটিকা। রাবণ রাজার খাসতালুক। কথিত যে সীতাহরণের পর লঙ্কেশ্বর তাঁকে এখানেই এনে রেখেছিলেন। এখন সেখানে সীতামায়ের ছোট্ট এক মন্দির। চারদিকে অসংখ্য বানর খেলে বেড়াচ্ছে। পাশেই সবুজ পাহাড়। সেখানে থেকে উপচে পড়া ঝরনা নীচে এক খরস্রোতা নদীর সৃষ্টি করে স্থানটির নিস্তব্ধতা হরণ করেছে। বলা হয় অশোক বনে থাকাকালীন এখানেই সীতামা স্নান সারতেন। হনুমানের সুবিশাল পায়ের ছাপও দেখলাম। মিছরি দিয়ে পুজো দিলাম সীতামায়ের মন্দিরে।
সেখান থেকে হাকগালা বটানিক্যাল গার্ডেন হয়ে গাড়ি পৌঁছালো এল্যাতে। এল্যা যাওয়ার রাস্তার প্রাকৃতিক দৃশ্য সত্যিই অপূর্ব। সবুজ পাহাড়, সাদা মেঘরাশি এবং চা বাগান এক মোহময়ী জগতে নিয়ে যায়। গাড়ি এসে দাঁড়ালো রাবণ ফলসে (Rawana Falls)। এটি শ্রীলঙ্কার একটি জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান। জলপ্রপাতটির উচ্চতা প্রায় ২৫ মিটার (৮২ ফুট)। দৃষ্টিনন্দন এই জলপ্রপাতে বেশ খানিক্ষণ সময় কাটিয়ে আবার গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চললাম। পথে লাঞ্চ সেরে নিয়ে অবশেষে পৌঁছে গেলাম "ওক রে লেক রিসর্ট" তিস্সামাহারমাতে - সুবিশাল তিস্সা লেকের গায়েই। হ্রদটি কৃত্রিমভাবে নির্মিত হ্রদটি অত্যাধুনিক সেচ ব্যবস্থার একটি অংশ।
ভারত মহাসাগরের সীমান্তবর্তী ইয়ালা (রুহুনা) জাতীয় উদ্যান শ্রীলঙ্কার সর্বাধিক দেখা এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতীয় উদ্যান। ৯৭৯ বর্গকিলোমিটার জায়গা জুড়ে পার্কটি অবস্থিত। ২০০৪ সালের সুনামিতে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এটি। বিকেলে জাঙ্গল সাফারি করলাম। নিজস্ব গাড়ি জঙ্গলে প্রবেশ নিষেধ। বিশালাকৃতি জিপগাড়িতে চেপে তিনজনে চললাম জঙ্গলের কোর এরিয়াতে। উদ্যানের ব্লক-১ জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। বিভিন্ন ধরণের বন্য প্রাণী যেমন ভালুক, শ্রীলঙ্কান চিতা, শ্রীলঙ্কান হাতি, বাইসন, বুনো শুয়োর, হরিণের জন্য সবচেয়ে বেশি পরিচিত। হাতি, বাইসন, হরিণ, বিভিন্ন রকমের সরীসৃপ, কুমীর আর নানারকমের নাম না জানা পাখি দেখলাম। জলাভূমি, গুল্মের জঙ্গল,দিঘি, লেগুন, ম্যানগ্রোভে ঘেরা এক অসম্ভব সুন্দর উদ্যানের স্মৃতি নিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম। ডিনারের পর ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দেখলাম রাতের তিস্সা লেকের মোহময়ী রূপ।
সপ্তম দিন
আজ তিস্সামাহরমা থেকে ট্যাংগেল (Tangalle) হয়ে ১৫০ কিমি দূরে গালে শহরে যাব। শ্রীলঙ্কার অন্যতম প্রধান শহর গালে সাদার্ন প্রভিন্সের প্রশাসনিক রাজধানী ও গালে জেলার রাজধানী। ইবনে বতুতার সমসাময়িক কাল থেকেই দ্বীপরাষ্ট্রটির প্রধান বন্দর হিসেবে পরিচিতি পায় গালে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পর্তুগিজদের স্থাপত্যশৈলীর উজ্জ্বল নিদর্শনক্ষেত্র এটি। ১৬৪৯ সাল থেকে ওলন্দাজরাও এ শহরের প্রাচীরকে বিস্তৃত করেছে। ইউরোপীয় দখলদার কর্তৃক নির্মিত এশিয়ার অন্যতম বিশাল দুর্গ হিসেবে আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট গালে ফোর্ট। গালেতে শ্রীলঙ্কার দক্ষিণতম প্রান্তে ভারত মহাসাগরের নীল সলিল রাশির সামনে দাঁড়িয়ে এক অনবদ্য অনুভূতি হল। গালে দূর্গ, গালে আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম, ওলন্দাজদের পুনর্নির্মিত চার্চ, লাইট হাউস ইত্যাদি দর্শনীয় স্থান দেখলাম। দুপুরের খাওয়া সারা হল গালে-তে।
স্টিল্ট ফিশিং একটি অদৃশ্য নৈপুণ্য। ঝোড়ো সমুদ্রের মাঝখানে খুঁটি পোঁতা আর সেই খুঁটির ওপরে মৎস্যজীবীরা বসে মাছ ধরে চলেছে। সূ্র্যাস্তের সময় গালের সমুদ্র সৈকতে সেই স্থবির মৎস্যজীবীদের কার্যকলাপ দেখলাম। পথে নজরে পড়ল সুনামিতে মারা যাওয়া অসংখ্য মানুষের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত বামিয়ান বুদ্ধমূর্তিটি।
পরের গন্তব্য বেনটোটা। আমাদের হোটেল 'ওশান কুইন' ওয়াদ্দুয়াতে। এটি ওয়েষ্টার্ণ প্রভিন্সের (Western Provience)শহর। এখানে আমাদের দুরাত্রি যাপনের পরিকল্পনা। ওয়াদ্দুয়ার সোনালি বেলে সমুদ্র সৈকত এবং উপকূলগুলি এই অঞ্চলের সর্বাধিক দৃষ্টিনন্দন স্থান। ওয়াদ্দুয়া থেকে কলম্বো পর্যন্ত উপকূলরেখা বরাবর ট্রেনলাইন চলে গিয়েছে। সুন্দর হোটেলটি সমুদ্রের পাশেই। রাত্রে ডিনার সেরে সমুদ্রের ঢেউয়ের গর্জন শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
অষ্টম দিন
আজ বেনটোটা ঘুরে নেওয়ার পালা। বিভিন্ন রকম ফল, দুধ, বিস্কুট, লুচি, তরকারি, ওমলেট, পাউরুটি, চা, কফি, ফলের রস ইত্যাদি সমাহারে প্রাতরাশ সেরে প্রথমেই গেলাম মাডু ম্যানগ্রোভ রিভার সাফারি। এটি শ্রীলঙ্কার প্রধান আকর্ষণগুলির একটি। প্রচুর বানর, কাঠবেড়ালি, বিভিন্ন রকমের সরীসৃপ, সাপ, কুমীর, মাছরাঙা এবং পরিযায়ী পাখিদের বাস। ম্যানগ্রোভে ঘেরা অঞ্চলটিতে অসংখ্য দ্বীপ ছিল যার অধিকাংশই জলের নীচে চলে গিয়েছে বলে অনুমান করা হয়। কিছু দ্বীপে মানুষ বসতিস্থাপন করেছে তবে সবগুলিই বন এবং গুল্মদ্বারা আবৃত। বৃহৎ জনবসতিপূর্ণ একটি দ্বীপ 'কোথ দুওয়া'তে একটি বৌদ্ধ মন্দির রয়েছে। দ্বীপগুলির কোনোটা সাপেদের রাজ্য তো কোনোটি বাদুড়ের। সিন্নামন দ্বীপ (Cinnamon Island) আবার দারুচিনি গাছে ভর্তি। দারুচিনি গাছ থেকে কী করে দারুচিনি উৎপাদন হয় বুঝিয়ে বলছেন এক বৃদ্ধা এই দ্বীপে আগত সকল দর্শনার্থীকে।
'ফিস ফুট স্পা' এখানে খুবই জনপ্রিয়। একটি বড় জায়গা খুঁটির মধ্যে বাঁধা জাল দিয়ে ভাগ করা; সেই জায়গাতে ছোটো ছোটো কমলা রং-এর অসংখ্য মাছ এদিক ওদিক নির্দ্বিধায় মুক্ত। এর মধ্যে পা ডুবিয়ে বসে থাকলেই ম্যাসাজ শুরু।
ম্যানগ্রোভ অরণ্যের ভেতরে সরু সরু খাঁড়ি দিয়ে দুঘন্টা ঘুরে এলাম স্পিডবোটে।
এরপর গেলাম টার্টল হ্যাচারিতে। সমুদ্রের ধারে অসংখ্য ছোটো, বড়ো, নানা রঙের নানা জাতের কচ্ছপ (Oliver Ridley Turtle, Green Turtle, Hawksbill Turtle, Loggerhead turtle, Leatherback Turtle)। আহত, বৃদ্ধ,আবার কেউ দু দিনের বা দশ দিনের। এদের সেবা-শুশ্রূষা করে সমুদ্রে ছেড়ে দেওয়া হয়।
হোটেলে এসে লাঞ্চ সেরে সৈকতে বসলাম। বিকেলে সূর্যাস্তের সময় কমলা আভা দিগন্তে বিলীন হয়ে গেল।
নবম দিন
আর একদিন পরেই আবার নিজেদের দেশে ফিরবো। আমাদের শেষ গন্তব্য ছিল কলম্বো।
শ্রীলঙ্কার পশ্চিম উপকূলে কালানী নদীর মোহনায় অবস্থিত সমুদ্রবন্দর কলম্বো শ্রীলঙ্কার রাজধানী এবং বৃহত্তম শহর। ওয়াদ্দুয়া থেকে কলম্বো আসতে আসতে রাস্তায় নানা জায়গায় কেনাকাটা করলাম। নভযুগ (Navayuga) নামে একটি ভারতীয় রেস্তোরাঁয় দ্বিপ্রাহরিক ভোজনের পর ইকবাল আমাদেরকে নিয়ে গেল লাকশালা (Laksala) নামে হস্তশিল্পের এক বিশাল স্যুভেনির বুটিকে। এই বহুতল বিপণির এক-এক তলে রয়েছে এক-একটি বিভাগ, শ্রীলঙ্কার মুখোস, হস্তনির্মিত গহনা, সিলোন চা, হস্তশিল্প থেকে নকশাকরা পোশাক ইত্যাদি। রাত্রে হোটেলে প্যাকিং সেরে জলদি ডিনার করে নিলাম।
দশম দিন
আজ রাত্রি ৮।৩০টায় ইন্ডিগোর বিমানে আমরা চেন্নাই ফিরে যাব। সকাল সকাল উঠেই স্নান সেরে হোটেলে ব্রেকফাস্ট সারলাম। হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে কলম্বোর স্থানগুলিকে দেখে নেওয়ার পালা।
প্রথমেই গেলাম রামকৃষ্ণ মিশন কলম্বোতে। এরপর গঙ্গারামায়া বৌদ্ধ মন্দির, গ্যাল ফেস গ্রীনের সুবিস্তৃত উপকূলরেখা, কলম্বো লোটাস টাওয়ার, অস্কারমায়া বৌদ্ধ মন্দির, খান ক্লক টাওয়ার ইত্যাদি দেখতে দেখতে হঠাৎ খবর পেলাম শ্রীলঙ্কায় সাংবিধানিক সঙ্কটের কারণে ধর্মঘট ও নানা অশান্তির সূচনা হয়েছে। একটু দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম কারণ আজই আমাদের দেশে ফেরার বিমান।
ইকবাল তৎপরতায় এয়ারপোর্টে পৌঁছাতে কোনো অসুবিধে হলনা। আলবিদা জানিয়েও বললাম 'আবার দেখা হবে'। আমন্ত্রণ জানালাম ভারতবর্ষে ঘুরতে আসার জন্যে। বিমানের সময় হয়ে গেলো দেখতে দেখতে। সমুদ্র, পাহাড় আর নারকেল গাছ ঘেরা ছোট্ট দেশটাকে মাটিতে রেখে হুশ করে আকাশে উঠে গেল প্লেনটা।
ভ্রমণই নেশা অর্পিতা সরকার জানার। সময় পেলেই স্বামী-স্ত্রী বেরিয়ে পড়েন অজানার উদ্দেশ্যে।