জাঞ্জিবারের প্রিজন আইল্যান্ড ও স্লেভ মেমোরিয়্যাল

অতীন চক্রবর্তী



২০১৯-এর নভেম্বরের প্রথমদিকে পূর্বআফ্রিকার তানজানিয়া (Tanzania) রাষ্ট্রে ভারত মহাসাগরের কোল ঘেঁষে অবস্থিত প্রাচীন শহর দার এস সালাম-এর মাটিতে পা রাখার সৌভাগ্য হয়েছিল। দার এস সালাম (Dar es Salaam) আরবী শব্দ, যার অর্থ হল 'স্বর্গের শান্তি'। প্রায় তিনমাস প্রতিদিনই আনন্দ করে তানজানিয়ার নানা জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি। ঘুরেছি নানা শহর, দ্বীপ, বন জঙ্গল, সমুদ্রের গা-ঘেঁষা প্রাচীন গ্রাম্যজীবনের মাঝে। পেয়েছি বিদেশি বণিকদের অত্যাচারে জর্জরিত তানজানিয়ার আদিমযুগের জনবসতির জীবনযাত্রার পরিচয়। মেতেছি মাসাইজাতির নাচগানের সঙ্গে। মাসাই ছাড়া তানজানিয়া রাজ্যে জনসংখ্যার বেশিরভাগ হেহে, বেনা, চাগু, নগোনি, কিং গ্রুপস, বারবৈগরার ইত্যাদি আদিবাসীরা। আশ্চর্যজনক নীল আকাশের নীচে সমুদ্রেঘেরা গাছপালায় সাজানো তানজানিয়া বা জাঞ্জিবারের মতো শহরগুলো দেখে সত্যি মনে এনে দিয়েছে অফুরন্ত তৃপ্তি।
তানজানিয়া বা জাঞ্জিবারের প্রাচীন ইতিহাসের পুরানো পাতা উল্টালে জানা যাবে আরবরা ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্য নিয়ে একসময় এদেশে এসেছিল। অন্য ব্যবসার পাশাপাশি গরীব আদিবাসীদের দাস হিসাবে বিক্রয় করা ছিল এদের ব্যবসার একটি প্রধান উপকরণ। এখানকার ইতিহাস থেকে জানা যায় ১৪৯৮ সালে ভাস্কো ডা গামা প্রথম ইউরোপিয়ান যিনি ইস্ট আফ্রিকার সমুদ্রতটে পদার্পণ করেছিলেন। ১৫২৫ সালের মধ্যে পর্তুগিজরা পুরো উপকূলেই বসবাস শুরু করে। ১৮শ শতাব্দীর প্রথম দিকে ওমান থেকে আরবিরা এসে উপস্থিত হয় এদিকে। জাঞ্জিবার (Zanzibar) হচ্ছে দার এস সালাম-এর গাঘেঁষা দ্বীপময় একটি অঞ্চল, ওমানি সুলতান সৈয়িদ সইদ ১৮৪০ সালে তাকে রাজধানী হিসাবে ঘোষণা করেন। এরপর মজিদ বিন সৈয়িদ (১৮৩৪-১৮৭০) দার এস সালামকে স্বর্গের শান্তি রূপে সাজিয়ে তোলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশরা দার এস সালামের উপর অধিকার নেয়, যদিও বাকী পুর্বআফ্রিকা এসে যায় জার্মানদের হাতে, নাম দেয় 'তাংগানিকা' (Tanganyika)। দার এস সালাম ছিল তখনকার দিনে এদের রাজধানী। তাংগানিকা স্বাধীন হয় ১৯৬১ সালে, তাঙ্গানাইকা আফ্রিকান ন্যাশনাল ইউনিয়ন (TANU)-এর ডাকা উপনিবেশ-বিরোধী আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে। এরপর ১৯৬৪ সালে তাংগানিকা আর জাঞ্জিবার একত্রিত হয়ে নাম নেয় 'সংযুক্ত তানজানিয়া যুক্তরাষ্ট্র' (United Republic of Tanzania)। পরে অবশ্য রাজধানী সরিয়ে নেওয়া হয়েছে ডোডোমাতে ১৯৭৩ সালে। আজ জাঞ্জিবার সংযুক্ত তানজানিয়া যুক্তরাষ্ট্রের একটি স্বয়ংশাসিত অঞ্চল - ভ্রমণপিপাসু পর্যটকদের কাছে স্বর্গভূমি।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে দার এস সালাম থেকে বেরিয়ে পড়লাম জাঞ্জিবারের দ্বীপে কয়েকদিন কাটিয়ে আসার জন্য। দার এস সালাম থেকে জাঞ্জিবারে যেতে হয় আকাশপথে নতুবা সমুদ্রপথে। বিমানে সময় নেয় মিনিট কুড়ি-পঁচিশ। তবে চলন্ত বোট থেকে সমুদ্রের রূপ সত্যি উপভোগ করার মতো। আজাম মেরিন কোম্পানির( Azam Marine Co.) ফাস্ট ফেরি সার্ভিসের বিজনেস ক্লাসের তিনটে টিকিট বিকেল চারটের বোটের জন্য অনলাইনে আগেই বুক করে নিয়েছিলাম। বোটের ভেতরটা অপূর্বভাবে সাজানো। ওয়াশিংরুম, কফিস্টল সবকিছুই রয়েছে। চারপাশে ইউরোপিয়ান পর্যটকদের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছিল। সবাই সমুদ্রের রূপ দেখতে ব্যস্ত। ভারত মহাসাগরের সবুজ জলের ওপর ভেসে চলেছে নানা রঙের বোট বা বড় বড় জাহাজ। জলের ওপর পড়ন্ত সূর্যের আলাদা একটা রূপ দেখবার লোভ নিয়ে চলে এলাম বোটের শেষপ্রান্তের ডেকের দিকে। না এলে হয়তো পরে আফসোস করতে হত। এ দৃশ্য শুধু উপভোগ করা যায়, বর্ণনায় প্রকাশ করা যায়না। আকাশপথে পর্যটকরা এ আনন্দ কোনোদিনই উপলব্ধি করতে পারবেন না।

সন্ধ্যা পৌনে ছয়টায় এসে নেমেছিলাম জাঞ্জিবার বন্দরে। নিয়মকানুনের পালা শেষ করে বন্দরের কাছে আমাদের 'হোটেল মিজিঙ্গানি সি ফ্রন্ট'-এ এসে পৌঁছতে প্রায় সাড়ে সাতটা হয়ে গেল। হোটেল নয়তো যেন কোন সুলতানি আমলের প্যালেস। নির্ধারিত ঘরটি সাজানো রয়েছে অপূর্ব রাজকীয় পালঙ্ক, ড্রেসিং টেবিল, আলমারি, ঘড়ির মতো নানান মূল্যবান আসবাবপত্রে। পরে জানতে পেরেছিলাম ১৮৬৫ সালে এই ঐতিহাসিক প্রাসাদ বানানো হয়েছিল রাজকীয় নবদম্পতিদের থাকার জন্য। ১৯২৮ সালে এটিকে কাস্টম হাউস হিসাবে নেওয়া হয়েছিল। এরপর একসময় একে হোটেলে রূপান্তরিত করা হয়। ভাবতে ভালোই লাগছে এই বিদেশে অন্তত তিন-চারদিন সুলতানি মেজাজে থেকে যেতে পারব।
চা খেয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়লাম সান্ধ্যভ্রমণে। রাত আটটা এখানে সন্ধ্যা বলা চলে, ভারতে এখন রাত সাড়ে দশটা।
রাস্তার একদিকে সমুদ্র অপর দিকে জনবসতি। হোটেল থেকে বেরিয়ে চোখে পড়বে সুলতান প্যালেস মিউজিয়াম আর হাউস অফ ওয়ান্ডারস। আরও কিছুটা এগিয়ে গিয়ে পৌঁছে গেলাম ফোরধানী ফুড মার্কেটে। সারি সারি খাবারের স্টল। খোলা আকাশের নিচে চেয়ার-টেবিলে বসে গল্পগুজবে ব্যস্ত স্বদেশি-বিদেশি লোকজন। ক্রেতা-বিক্রেতা মিলে জায়গাটাকে জমজমাট করে রেখেছে। একটু আগেই এখানে বসে অনেকে পশ্চিম আকাশের সূর্যাস্ত উপভোগ করেছে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় ফোরধানী ফুড মার্কেটে এই ব্যস্ততার দৃশ্য চোখে পড়বে। জাঞ্জিবারে এসে সন্ধ্যায় এখানে না এলে জাঞ্জিবার ভ্রমণ যে অসম্পূর্ণ হয়ে থাকবে! নানা রকম সী-ফুড, রোস্টেড বা গ্রিলড কিংফিস, চ্যাংগুফিস, লবস্টার, অক্টোপাশ, স্কুইড, কাঁকড়া ইত্যাদি খাদ্য-সরঞ্জামে স্টল সাজানো। রয়েছে নানারকম ঠাণ্ডা পানীয় বা বিভিন্ন ফলের জুস। এরা জুসকে বলে জুসি।
ঘন্টা দুয়েকের মতো ওখানে সময় কাটিয়ে, নৈশভোজন শেষ করে তৃপ্তমনে হোটেলে ফিরে এলাম। সমুদ্রের পাশ দিয়ে হোটেলে ফেরার রাস্তা। এই দিকটা হল জাঞ্জিবারের 'স্টোন টাউন' এরিয়া। জাঞ্জিবারের ইতিহাসের পাতা ওল্টালে জানা যায় কতো পুরানো স্মৃতি বহন করে চলেছে এই স্টোন টাউন। জাঞ্জিবার শব্দটা এসেছে আরবি শব্দ থেকে।'Zanzibar' শব্দটা পরে পার্শীয়ান শব্দ 'Zangbar' এ পরিণত হয়। 'Zang' অর্থ কালো আর 'bar' হোল কোস্ট বা ল্যান্ড। অর্থাৎ ল্যান্ড অব ব্ল্যাকস (land of the blacks) বা কালো চামড়ার দেশ।

সমুদ্রের বুকে কতোগুলো দ্বীপ নিয়ে গড়া জাঞ্জিবার রাজ্য। আজ থেকে প্রায় কুড়ি হাজার বছর আগের মানুষদের প্রভাব ছিল এইসব অঞ্চলে। তখন ওরা পাথরের অস্ত্র বানিয়ে ব্যবহার করত। এই দ্বীপ সম্বন্ধে প্রথম জানা যায় গ্রীকদেশের একজন বণিক-নাবিকের প্রাচীন লেখা থেকে। সেটা খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকের শেষের দিকের কথা। তাঁর লেখা থেকে জানা যায় এই অঞ্চলের লোকেরা আকৃতিতে খুবই লম্বা প্রকৃতির। উনগুজা, পেম্বার মত কতগুলো দ্বীপ নিয়ে তখনকার জাঞ্জিবার রাজ্য - উনগুজা ছিল রাজধানী। আর ঐতিহাসিক স্টোনটাউন ছিল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। আজ এই স্টোনটাউনকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট রূপে গণ্য করা হয়েছে। প্রথম দিকে এইটি পার্শি প্রভাবে প্রভাবিত হলেও দুশো বছর পরে (১৫০৩ থেকে ১৭২৬) চলে আসে পর্তুগিজ প্রভাবে। এরপর আসে আরবদের হাতে। তাদের সময় প্রকৃত উন্নতি হয়েছিল এই রাজ্যের। বিশেষ করে ওমানি সুলতান সৈয়িদ সইদের রাজত্বকালে। জাঞ্জিবারকে ইস্ট আফ্রিকার রাজধানী বলে মানা হল। শিল্প ও আর্থিক দিকের উন্নতি লক্ষ্য করা গেল। এখান থেকে জায়ফল, দারচিনি, লবঙ্গ, গোলমরিচ, নানারকম মশলার ব্যবসা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ল। ক্রীতদাস ক্রয়-বিক্রয় ছিল ব্যবসার একটি প্রধান অঙ্গ। অকথ্য অত্যাচারের মধ্যে চলত তাদের 'স্লেভ ট্রেড'। কলঙ্কিত তাদের সেই ইতিহাসের কিছুটা সাক্ষী 'প্রিজন্ আইল্যান্ড' ও 'স্লেভ মেমোরিয়্যাল'। ৮ ডিসেম্বর সেই দ্বীপে যাবার আগের দিনে অবশ্যই দেখব এখানকার একটা স্পাইস গার্ডেন আর সুলতান প্যালেস মিউজিয়াম। সমুদ্রের ঢেউগুলোর পাড়ে ভেঙে পড়ার শব্দ শুনতে শুনতে প্রথম রাতে কখন যে নরম বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই। পাখির ডাকে পরের দিন ঘুম থেকে উঠে স্পাইস গার্ডেন যাবার জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগলাম। কিন্তু মনটা আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে আগামী কালের 'প্রিজন্ আইল্যান্ড' যাবার স্পিডবোট জার্নির জন্য।

গতকাল স্পাইস গার্ডেন আর প্যালেস মিউজিয়ামে পুরোদিন কাটিয়ে ছিলাম। সঙ্গে ছিল এখানকার ট্যুর প্রোগ্রামে প্রতিদিনের গাইড ফাতেমা। স্পাইস গার্ডেনে শিক্ষিত এই গাইডের গাছ-গাছড়ার ওপর বিশেষ দক্ষতা দেখে আমরা অবাক হয়েছিলাম। আজ আবার সকাল সকাল চলে এসেছে প্রিজন আইল্যান্ডে নিয়ে যাবার জন্য। জানতে পারলাম একজন আমেরিকান ভদ্রমহিলা হোটেলের বাইরে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। ওঁর গাইড আসেনি, তাই আমাদের সঙ্গে প্রিজন আইল্যান্ডে যাওয়ার অনুমতির অপেক্ষায় রয়েছেন। ওঁকে নিয়ে ফাতেমার সঙ্গে স্টোন টাউনের সমুদ্রের পারের দিকে এগিয়ে চললাম। পুরো বোট ফাতেমা আমাদের জন্য বুক করে রেখেছে। উঠে পড়তেই বোট চলতে লাগল ভারত মহাসাগরের বুকে। কখনো দুলছে, কখনো স্থিরগতিতে জলে তরঙ্গ সৃষ্টি করে এগিয়ে চলেছে। চোখে পড়ল জলের ওপর বড়ো বড়ো জাহাজ - কেউ চলেছে, কেউবা নোঙ্গর দিয়ে ভেসে রয়েছে। মাঝে মাঝে মাছ ধরার নৌকা ভাসতে দেখা যাচ্ছে। ফাতেমা ইতিমধ্যে আমাদের জন্য আনা টিফিন দিয়ে আপ্যায়ন করল। আ্যানি প্রথমে আমাদের খাবার থেকে শেয়ার করতে চায়নি, পরে শুধু জুস নিয়ে ধন্যবাদ জানাল। হাসি-খুশি, মিষ্টি ব্যবহার এই আমেরিকান মেয়েটির। অল্প সময়ের মধ্যে সবাইকে আপন করে নিয়েছিল। ফাতেমা দ্বীপটাকে বোট থেকে দেখাতে দেখাতে জানাল দ্বীপটি ৮০০ মিটার লম্বা আর সবথেকে চওড়া অংশ হচ্ছে ২৩০ মিটার। ক্রীতদাসদের এখানে এনে রেখে পরে বেচা-কেনা হত। সেসব প্রায় ১৮৬০ সালের কথা। এছাড়া এই দ্বীপে ছিল উন্নত ধরণের কোরাল মাইনস। ১৮৬০ সালে এই জঙ্গলময় জনবসতিশূন্য দ্বীপটিকে জাঞ্জিবারের সুলতান মজিদ বিন সৈয়িদ দুজন আরবকে ক্রীতদাসদের বন্দী করে রাখার জন্য ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন। এখানে অমানুষিক অত্যাচার হত তাদের ওপর। ১৮৯৩ খ্রীস্টাব্দে জাঞ্জিবারের প্রথম ব্রিটিশ মন্ত্রী লয়েড ম্যাথিউজ এই দ্বীপটি কিনেছিলেন এবং একটি জেলখানা নির্মাণ করেছিলেন। সেই সময় 'ইয়েলো ফিভার'-এর ঝামেলায় দিশাহারা হয়ে গিয়েছিল জাঞ্জিবারের শাসনকর্তারা। তাই বন্দীর বদলে তখন তাঁরা দ্বীপটিকে ইয়েলো ফিভারের কোয়ারানটাইন হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন। সেই সময় থেকে এই দ্বীপে আর কোনও বন্দী রাখা হয়নি। ১৮৯৪ সালে বন্দীশালার পুরো বিল্ডিংটার নির্মাণকাজ সম্পূর্ণ হয়েছিল। এরপর দ্বীপটি ইউরোপিয়ান এবং জাঞ্জিবারের স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য একটি জনপ্রিয় অবসরস্থল হয়ে উঠেছিল। 'ইউরোপিয়ান বাংলো' নামে পরিচিত ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছিল ১৮৯০-এর দশকের শেষদিকে। সম্প্রতি দ্বীপটি সরকারি মালিকানাধীন একটি ট্যুরিস্ট রিসর্টে পরিণত হয়েছে।

এইসব গল্প শুনতে শুনতে একসময় আমরা দ্বীপটার কাছাকাছি এসে গেলাম। আধ ঘন্টার মতো এই বোটজার্নি সত্যি মনে রাখার মতো। সাগরের বুকে বসে দ্বীপের শোভা অপূর্ব লেগেছিল দেখতে। ছোট-বড় গাছ দ্বীপটাকে সবুজ করে রেখেছে। বাঁদিকে বিশাল লম্বা একটি জেটি সমুদ্রের অনেকটা ভেতরে এগিয়ে গিয়েছে। ভালোভাবে রেলিং দিয়ে ঘেরা। তার ওপরে পর্যটকেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে।
মন্থরগতিতে কচ্ছপগুলো চলাফেরা করতে ব্যস্ত। ফাতেমা জানালো - সেইচেলেস (Seychelles)-এর ব্রিটিশ গভর্ণর এই দ্বীপকে একসময় উপহার হিসাবে কয়েকটি অ্যালডেবরা জায়ান্ট টরটোইজ (Aldabra giant tortoises) দিয়েছিলেন। তাদেরই বংশজাত অনেক কচ্ছপ আজ পর্যটকদের আনন্দের খোরাক। এদের মধ্যে কারো কারো বয়স প্রায় দুশো বছরের মতো। কিছুটা ডান দিকে চলে এলে একটা খাদের ভেতর রয়েছে ওদের ডিম পাড়ার নির্ধারিত স্থান। কয়েকটা কচ্ছপ ওখানে তখনও রয়েছে। কচ্ছপের বড়ো বড়ো ডিম দেখলাম।
জঙ্গলের ভেতর দিয়ে রাস্তা এগিয়ে গেছে ট্যুরিস্ট রিসর্টের দিকে। চলতে চলতে অনেক ময়ূর চোখে পড়ল। কেউ ঝোপের ভেতর, কেউবা রাস্তার আশে-পাশে। এই জঙ্গলে রয়েছে 'ডিক্-ডিক্' নামে খুব ছোটজাতের চঞ্চল একপ্রকার হরিণ। দেখবার লোভে জঙ্গলের একটু ভেতরের দিকে এগিয়ে চললাম। এই জাতের হরিণ আজকাল প্রায় লুপ্ত হয়ে এসেছে। শুধু ইস্ট আর সাউথ আফ্রিকাতে কিছু দেখা যায়। বেশ কয়েকটা 'ডিক্-ডিক্'কে গভীর জঙ্গলের মধ্যে ঘোরাফেরা করতে দেখবার সৌভাগ্য হয়েছিল কারো কারো।

এরপর চলে এলাম এককালের বন্দীশালায়, যার জন্য এই দ্বীপকে বলা হয় 'প্রিজন আইল্যান্ড'। পুরোটা দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। বিশাল চত্ত্বরের পাশ ধরে সারি সারি ঘরগুলোর বেশিরভাগই এখন বন্ধ রয়েছে। বিশ্রাম ঘর হিসাবে এগুলো ব্যবহার হয়। ভেতরে বসবার ব্যবস্থা রয়েছে। দেওয়ালের একদিকে রয়েছে সমুদ্রের দিকে যাওয়ার সিঁড়ি। এই স্থান দিয়েই ক্রীতদাসদের নিয়ে বোটে ওঠা-নামা ছিল সেই সময়। আজকের দিনে ওপর থেকে সমুদ্রের শোভা উপভোগ করে পর্যটকদের মন তৃপ্তিতে ভরে যায়, কিন্তু এমন দিনও ছিল যেদিন ক্রীতদাসদের এই ব্যথা-বেদনার অশ্রুজলে ভরে গিয়েছিল এই মর্মর চত্বর। চাবুকের ঘায়ে রক্ত ঝরেছিল তাদের শরীর থেকে। কলঙ্কিত সেই অতীত ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও বয়ে চলেছে ভারত মহাসাগর। ঢেউগুলো যেন বারবার ছুটে আসছে আধুনিক সভ্য জগতকে তাদের নীরব ভাষায় সেই বেদনার বার্তা জানাতে। পাড়ের কাছে এসে দুঃখে ভেঙে পড়ে ওরা বারবার।

মনটা সত্যি বিষাদে ভরে গেল এখানে এসে এইসব ইতিহাসের কাহিনি শুনে। নিঃশব্দে এগিয়ে চললাম ফাতেমার সঙ্গে দ্বীপের আরেক প্রান্তের দিকে। আ্যানী কৌতূহলী হয়ে এই দ্বীপের আগের নাম কি ছিল জানতে চাইল। ফাতেমার থেকে জানতে পারলাম একসময় এই দ্বীপের নাম রাখা হয়েছিল কোয়ারেন্টাইন বা প্রিজন আইল্যান্ড, কিন্তু কিছু পুরানো মানচিত্রে এই দ্বীপকে "কিবান্ডিকো দ্বীপ" হিসাবে দেখানো হয়েছে, যদিও এই নামটি আর ব্যবহার হয়না। একধরণের মাছ এই দ্বীপের চারপাশের সমুদ্রের জলে প্রচুর দেখা যায়, সোয়াহিলি ভাষায় মাছটার নাম 'চ্যাঙ্গু'। সেই কারণে জাঞ্জিবারের স্টোন টাউন থেকে ৫-৬ কিমি উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত এই দ্বীপের আরেকটি নাম হয়েছিল 'চ্যাঙ্গু দ্বীপ'।

হাঁটতে হাঁটতে একসময় দ্বীপের শেষপ্রান্তে অবস্থিত জেটিটার উপর উঠে পড়লাম। অনেকটা লম্বা-চওড়া, রেলিংএ ঘেরা সুন্দরভাবে সাজানো রয়েছে জেটির বেশিরভাগ অংশ। অনেক পর্যটক তখন এই জেটির ওপর দাঁড়িয়ে সমুদ্রের শোভা দেখতে ব্যস্ত। জলেতে ঝাঁকে ঝাঁকে চ্যাঙ্গু মাছ ভেসে বেড়াচ্ছে। মাছগুলোর জন্য অনেক জায়গায় জলটা কালো দেখাচ্ছে। অনেকটা তেলাপিয়া মাছের মতো দেখতে। জেটির শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে সবুজ এই দ্বীপের রমণীয় দৃশ্য সত্যি মনে এনে দেয় এক অফুরন্ত তৃপ্তি।
এবার আমাদের যেতে হবে মেন ল্যান্ডের 'স্লেভ মেমোরিয়্যাল' কমপ্লেক্সের অঞ্চলে। বিদায় চ্যাঙ্গু দ্বীপ – বিদায় প্রিজন আইল্যান্ড – বিদায়।

আবার স্টোন টাউনে ফিরে এলাম প্রিজন আইল্যান্ড থেকে। ফোরোধনী গার্ডেনের পাশ দিয়ে চললাম 'স্লেভ মেমোরিয়্যাল' কমপ্লেক্সের উদ্দেশ্যে। ১৯৩৬ সালে সুলতান খালিফা সিলভার জুবিলি উৎসবের অনুষ্ঠান করবার জন্য এই ফোরোধনী গার্ডেনের উদ্বোধন করেন। দিনের বেলায় এখানে এলে বোঝাই যাবে না যে প্রতিদিন সন্ধ্যায় স্থানীয় লোক আর পর্যটকরা মিলে কী রকম উৎসবের আমেজ সৃষ্টি করে। নানা ধরণের খাবারের দোকান, হকারদের কোলাহলের পাশাপাশি দেখতে পাওয়া যায় ছোটদের বিভিন্ন প্রকারের খেলাধূলোর আয়োজন। এরই কাছে রয়েছে ইস্টআফ্রিকায় অবস্থিত আরবদের প্রাচীনতম দুর্গ।

১৬৯৮ সালে আরবরা এখানে এসে পর্তুগিজদের ছোট্ট একটি ধর্মীয় স্থানের উপরই এই ফোর্ট নির্মাণ করেন। স্টোন টাউনের ইউনেস্কো হেরিটেজ সাইটের মধ্যে এইটিও গণ্য। এর সঙ্গে রয়েছে কালচারাল আর্ট গ্যালারি। ঘুরতে ঘুরতে একসময় চলে এলাম ইস্ট আফ্রিকা স্লেভ ট্রেড এক্সিবিট- এর হলঘরে। যারা ভেতরে ঢুকেছি বেশিরভাগই বিদেশি। বিদেশিদের টিকিটমূল্য অনেক বেশি ধার্য করা হয়েছে। হলঘরটা ভরে রয়েছে অত্যাচারের ইতিহাস নিয়ে নানা কাহিনিতে। ক্রীতদাসদের উপর অকথ্য অত্যাচারের বর্ণনা নানা ছবিসহ তুলে ধরা হয়েছে। মানুষ মানুষের ওপর এত মর্মান্তিক অত্যাচার করতে পারে এখানকার ছবিগুলো না দেখলে তা বিশ্বাস হত না। নির্মম অত্যাচারের প্রকাশক ছবিগুলো, বিষাদের ছবি। এত পর্যটক ভেতরে রয়েছে, কিন্তু সবাই নির্বাক। এ পাপের কোন ক্ষমা নেই ভগবানের দরবারে।

হলঘরের পাশেই রয়েছে স্লেভ চেম্বার। বলতে গেলে আলোবাতাসবিহীন সরু একটা টানেল। সেখানেও তাদের শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হত, তারপর সুবিধামত খরিদ্দার পেলে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হত। ক্রীতদাস কেনা-বেচা ছিল তখনকার দিনের আয়ের একটা বড় পথ। চেম্বারে ঢুকে মনটা বিষাদে ভারাক্লান্ত হয়ে গেল। নামমাত্র আলোবাতাসের ভেতর কী করে মানুষ দিনের পর দিন থাকত ভাবতেই পারা যায় না। অত্যাচারের নমুনা জনসাধারণকে বোঝাবার জন্য সম্প্রতি তৈরি করা হয়েছে একটি স্লেভ মেমোরিয়াল। বড় আয়তনের একটি চৌবাচ্চার মতো গর্ত, ভূমিতলের কিছুটা নিচে, তৈরি করে তাতে রাখা আছে অসহায় ক্রীতদাসদের স্ট্যাচু। ঘাড়ে পরানো আছে লোহার কলার যাতে বাঁধা থাকত শিকল। করুণ এই দৃশ্য কতক্ষণ আর দেখা যায়!

এই স্লেভ চেম্বারের কাছেই রয়েছে আফ্রিকার প্রথম অ্যাংলিকান ক্যাথিড্রাল ক্রাইস্ট চার্চ (Anglican Cathedral Christ church) – এককালের ক্রীতদাস কেনা-বেচা বাজারের জায়গাতেই ইউনিভার্সিটিজ মিসন টু সেন্ট্রাল আফ্রিকা (UMCA) তৈরি করেছিল এই চার্চ। উঠিয়ে দিয়েছিল সেই কুখ্যাত বাজার। এখানের বেদিটা মনে করিয়ে দেয় সেই গাছের কথা যাতে বেঁধে ক্রীতদাসদের চাবুক মারা হত। বৃত্তাকার সাদা পাথরের চারপাশে লাল রং দিয়ে ঘেরা – ক্রীতদাসদের রক্তের প্রতীক, তাদের জীবনের দুঃখময় দীর্ঘশ্বাসের প্রতীক। বিশপ স্টিভের তত্ত্বাবধানে এবং একান্ত চেষ্টায় এই চার্চটি গড়ে উঠেছিল। তাঁর বন্ধু এম.এফ. হেউওন চার্চটির লে-আউট ড্রইং করে দিয়েছিলেন।

এদেশে খ্রিস্টধর্মের প্রচারে মিশনারি ডাক্তার লিভিংস্টোনের অবদান স্মরণীয়। চার্চের বাঁদিকের দেওয়ালে একটি ক্রশ বসানো আছে। সেটি তৈরি হয়েছিল চিতাম্বো গ্রামের একটি গাছের ডাল থেকে, যে গাছের নীচে লিভিংস্টোনের হৃৎপিন্ডকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। বিষণ্ণ মনটা চার্চের নীরবতায় দাঁড়িয়ে কিছুটা শান্তি পেল। তবু তারি মাঝে সেই শিকলে বাঁধা অসহায় মানুষগুলোর মুখ বারবার ভেসে উঠছিল।
অন্যমনস্ক হয়ে চলতে চলতে কখন যে হোটেলে পৌঁছে গিয়েছিলাম মনে নেই। একসময় হঠাৎ মনে পড়ল জাঞ্জিবারের বোটম্যানের কথা, বোট থেকে নামবার সময় সে আমাদের সোয়াহিলি ভাষায় জানিয়েছিল, "রোহো সাফি না মাপেনঞ্জি" অর্থাৎ ক্লিন হার্ট অ্যান্ড লাভ ফর এভরিওয়ান।

অবিভক্ত ভারতের রাজশাহী জেলার নওগাঁতে জন্ম অতীন চক্রবর্তীর। সরকারি পেশা এবং ভ্রমণের নেশার টানে ঘুরেছেন ভারতবর্ষের নানা অঞ্চলে। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিতভাবে গল্প ও ভ্রমণকাহিনি লিখছেন। সাহিত্যক্ষেত্রে পেয়েছেন একাধিক পুরস্কারও।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher